#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২২
আধভাঙা মন নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে তোহা।ঘরের বাতি নিভানো।জানালায় ভারি পর্দা টেনে দেয়া।
ফলস্বরূপ দুপুরের সময় হওয়া সত্ত্বেও ঘরের আলোর ছিঁটেফোটাও নেই।বালিশে মুখ গুঁজে স্বশব্দে ফোঁপাচ্ছে তোহা।সেদিন তিহানের ঘর থেকে বের হওয়ার পূর্বে তিহান কাঠ কাঠ কন্ঠে স্পষ্টভাষায় তাকে বলে দিয়েছিলো,”অনন্তের ব্যাপারটায় আমার কাছ থেকে কোনরকম এক্সপেক্টেশন রাখবানা।যা করার নিজে করতে পারলে করবা নয়তো না।কিন্তু এটা ভাববানা যে আমি খালুকে যেয়ে বলবো বা এরকম কিছু।”এতটুকু শোনার পর আর শোনেনি তোহা,ছুটে বেরিয়ে এসেছিলো।পুরো একটা দিন কেটে গেলো অথচ তিহান সত্যিই তার সাথে কোন কথা তো দুর সে তো চলেই গেছে কোথায় যেন।এতো রাগ কেনো?তার দিকটা একটু বোঝার চেষ্টা করলোনা তিহান?তার পরিস্থিতি,তার মনের কষ্টটা বুঝলোনা?আবারো হুহু করে উঠলো তোহা।
ব্যাথায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে রীতিমত।
দুপুরের খাওয়া শেষে ধীরপায়ে বাবার রুমের দরজায় টোঁকা দিলো তোহা।মা এখন রুমে নেই,সে রান্নাঘরে।আরেকবার টোঁকা দিতেই ভেতর থেকে আরমান সাহেবের গম্ভীর কন্ঠের অনুমতি পেয়ে মাথায় ওড়না টেনে নিয়ে জোরে একটা শ্বাস ছাড়লো তোহা।খাবার টেবিলে আরমান সাহেব বিয়ের ব্যাপারে তোহার মতামতের ব্যাপারে শুনতে চেয়েছিলেন তবে তোহা তখন কোনো উওর দেয়নি।চুপ করে ছিলো।
গুটিগুটি পায়ে রুমে প্রবেশ করলো তোহা।দরজাটা ভিজিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে দাড়ালো।আরমান সাহেব বিছানায় বসে আছেন।তোহা এগিয়ে যেতেই তাকে হাতের ইশারায় পাশে বসতে বললেন তিনি।কোনো কারণ ছাড়াই তার ছোট মেয়েটা তাকে ভয় পায়।কখনো সন্তানদের সাথে উচ্চস্বরে ধমকাধমকি করেননি তিনি।আর ছোট মেয়েকে তো আরো মাথায় তুলে রেখেছেন তবুও ছোট মেয়েটা তাকে ভয় পায়।মুখ ফুটে কখনো কিছু বলেনা।
মেয়ে কিছু একটা বলতে এসেছে তবে তার আড়ষ্টতা বুঝতে পারলো আরমান সাহেব।মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন উনি।বললেন,
—“কিছু বলবে?”
উপরনিচে মাথা নাড়লো তোহা।তবে মুখ দিয়ে কথা বের হলোনা তার।খানিকবাদে আরমান আবারো বললেন,
—“নির্দিধায় বলো,তোমার কি উনাদের প্রস্তাব টায় মত নেই?আমি তাহলে তাদের মানা করে দিব।”
—“উনি আমার সাথে অসভ্য আচরণ করেছেন আব্বু।আমার গায়ে হাত দিয়েছেন।”মাথা নিচু করে কথাটা বলেই একপ্রকার মিইয়ে গেলো তোহা।
মেয়ের কথায় যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো আরমান সাহেবের।তার মেয়ের সাথে এমন কিছু হয়েছে কাল ঘুনাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি তিনি।পারলে তখনই মুখের উপর তাদের বিদায় করে দিতেন।
মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে তার।চোখে ক্ষোভ।তোহার মাথা থেকে হাত সরিয়ে বজ্রকন্ঠে উনি বললেন,
—“তুমি আমাকে আগে বলোনি কেনো?”
একটা ফাঁকা ঢোক গিললো তোহা।বললো,
—“উনি বলেছেন আমি বিয়েতে “না” করলে আপুর সংসারে ঝামেলা হবে।সেজন্যই…”
—“এতো বড় সাহস।কোনো কাপুরুষের সাথে নিশার বিয়ে দেইনি আমি,যে এই ঠুনকো বিষয়ে তার সংসারে ঝামেলা হবে।”বলে ফোনটা হাতে নিলেন উনি।সৌহার্দ্য কে ফোন করে কড়া শব্দে কিছুক্ষণ কথোপকোথন চালিয়ে ফোনটা রাখতেই ফুঁপিয়ে উঠলো তোহা।নিজেকে আটকাতে না পেরে উচ্চশব্দে কান্না করে দিলো।
আরমান সাহেব ভাবলেন না।মেয়ের বুকে টেনে নিয়ে স্বস্নেহে মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
_________________
বিকেলের পরে গিয়েছে।কলিংবেলের শব্দে বুকটা ধক্ করে উঠলো তোহার।নিশা,সৌহার্দ্য,অনন্ত উনাদের বাবা-মা সবাইকে বাসায় আসতে বলেছেন আরমান সাহেব।তাঁরাই হয়তো এসেছে।বাড়ির উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যাবে তা জানেনা তোহা।ভয়ে হাত পা কাঁপছে কার।
দরজায় কান লাগিয়ে ড্রইংরুমের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো তোহা।কিছু বুঝতে না পেরে বিছানায় এসে বসতেই দরজা খুলে প্রবেশ করলো আতিয়া।দরজার সামনে দাড়িয়েই বললো,
—“তোমার বাবা যেতে বলেছে তোমাকে।যাও।”
মায়ের মুখে “তুমি” সম্মোধনটা ঠি ক মানতে পারলোনা তোহা।টলমলে পায়ে ড্রইংরুমে উপস্থিত হলো সে।গুটিগুটি পায়ে বাবার সোফার পাশে যেয়ে দাড়ালো সে।
পরিবেশ থমথমে।অনন্তর মা বলে উঠলেন,
—“আমার ছেলে তোমার সাথে অসভ্য আচরণ করেছে কোন প্রমাণ আছে?”
—“প্রমাণ থাকার তো কথা নয় আন্টি।আমি তো জানতাম না আপনার ছেলে এমন করবে।”সাবলিলভাবে উওর দিলেও মাথায় রাগ চেপে বসেছে তোহার।
অনন্তর ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
—“আপনার মেয়ে মিথ্যা বলছে।আমি এমন কিছু করিনি।”
মাথায় রক্ত উঠে গেলো তোহার।দু’কদম এগিয়ে যেয়ে আচমকাই সজোরে অনন্তের গালে চড় বসিয়ে দিলো সে।হঠাৎই চুপ হয়ে গেলো সবাই।অনন্তের গালে হাত।চোখে বিস্ময়।একটা মেয়ের হাতের চড়ের তীব্র অপমানটা সহজে হজম করতে পারলোনা সে।
খানিকবাদে আরমান সাহেব উঠে দাড়ালেন।তোহার হাত টেনে তাকে নিজের পাশে বসিয়ে বললেন,
—“দেখুন আমার মেয়েকে যথেষ্ট বিশ্বাস করি আমি।আপনারা হয়তো নিজেরাও জানেন আপনাদের ছেলে কেমন।শুধু শুধু দোষ ঢেকে লাভ নেই।আপনাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনারা ছেলের দোষ স্বীকার করেছেন।যাই হোক,আমার মেয়ে চড় মেরেছে সেজন্য আমি দু:খিত নই।চড়টা আপনাদের ছেলের প্রাপ্য ছিলো।আর সৌহার্দ্য তুমি যদি এই ঘটনার রেশ ধরে নিশার…”
—“নিশা আর আমার সংসারে এর প্রভাব পরবেনা বাবা।আমি নিজেই লজ্জিত আমার ভাইয়ের কর্মকান্ডে।আপনি দয়া করে এসব বলে আমাকে আর ছোট করবেন না প্লিজ।”
আরমান সাহেব একটু হাসলেন।দুই ভাই অথচ কত পার্থক্য।তবে মেয়ের বাবা হওয়া সোজা না।কথাটার মর্মার্থ আজ উপলদ্ধি করতে পারছেন তিনি।
_______________
ফোনের ডায়াল লিস্টে শুধুই তিহানের নাম্বার।বারান্দায় বসে একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছে তোহা।তিহান রিসিভ করেনি একবারও।চোখে আবারো পানি এসেছো তোহার।আরো দু’চারবার রিং হয়ে ফোন কেটে যাওয়ার পর তপ্ত শ্বাস ছাড়লো সে।লাজ-লজ্জা ভুলে আরেকবার ফোন দিলে এবার ফোনটা বন্ধ শোনাচ্ছে।তারমানে তার ফোন করায় বিরক্ত হয়ে তিহান ফোন বন্ধ করে দিয়েছে?এতটা রাগ?আজ সারাদিনে ওই ফ্ল্যাটে যায়নি তোহা।তিহানের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতেও শোনেনি।
একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ পাশের বারান্দার দিকে চেয়ে রইলো তোহা।তিহানের অনুপস্থিতি বড্ড পোড়াচ্ছে তাকে।বড্ড বেশিই পোড়াচ্ছে।হঠাৎই ডুকরে কেঁদে উঠলো সে।দু’হাটুতে মুখ গুঁজে কান্নাজড়ানো কন্ঠে আর্তনাদ করে বললো,”আপনি কোথায়?আমার যে ভালো লাগছেনা।একা একা লাগছে খুব।ফিরে আসুননা প্লিজ।”
~চলবে~