#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:৩৫
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
মাধুর্য ভয়ে শিথিল হয়ে আছে। দম বদ্ধকর পরিবেশ যেন তার চারিপাশে নিঃশ্বাস আটকে আটকে আসছে। ভুবনে তখন সন্ধ্যার কাঁলচে আঁধার ছেয়েছে। প্রভাতী রুমে এসে মাধুর্যকে মেঝেতে বসে থাকতে দেখে ভড়কে গেলো।
দ্রুতগতিতে ছুঁটে এলো তার দিকে। অস্থির কন্ঠে বারংবার প্রশ্ন করলো, ‘ কী হয়েছে!’
মাধুর্য ঘন ঘন শ্বাস টেনে মোবাইলের দিকে দেখানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। তার সর্ব শরীর যেন অসাড় হয়ে আসছে। নানা ধরণের জল্পনাকল্পনায় গ্রাস করে আছে তার মস্তিষ্ক ।
সে ধরেই নিয়েছে বাসার কারো বড় ধরণের কিছু একটা হয়েছে। যার ফলাফল হিসেবে কেউ ফোন তুলছে না। প্রভাতী বুঝতে পারলো মাধুর্য হয়তো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যার দরুণ প্যানিক হয়ে গিয়েছে। সে মাধুর্যকে বলল লম্বা লম্বা শ্বাস গ্রহণ করতে। মাধুর্য নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে সোজা হয়ে উঠে বসে প্রভাতীর হাত ধরে বলল,
‘ বাসার কেউ ফোন তুলছে না প্রভা। আমার যে বড্ড ভয় হচ্ছে।’
প্রভাতী আশ্বস্ত করে বলল,
‘ হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত। তুই আবার ফোন দে।’
মাধুর্য তটস্থ হয়ে বসে রইলো। মোবাইল কাছে নিয়ে আবেশকে ফোন করতে গেলে খুদেবার্তা নজরে পড়লো। যা এসেছে ইরার নিকট থেকে। সেখানে দুই লাইনের বার্তায় লেখা হয়েছে,
‘ মাধুর্য, নিজেকে সামলিয়ো ভেঙ্গে পড়বা না।তোমার মা মানে লতা আন্টি ইন্তেকাল করেছেন। আবেশের ফোন বাসায় ফেলে রেখেছে সাথে বাকি সবার। তাড়াহুড়োর মাঝে কী থেকে কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। আবেশ ঢাকা যাচ্ছে। নিজের মনোবল ভাঙ্গতে দিয়ো না।’
বার্তা টুকু মাধুর্যের ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা নিয়ে যেন লেখা হয়েছে। নির্বাক হয়ে বসে আছে সে। লতা বেগমের মলিন মুখশ্রী ভেসে উঠলো তার নয়নে। রাব্বীর বলা সেই কথা বারবার ভেসে আসতে লাগলো,’ আমার মা’কে দেখে রাখিস।’
_________________
শুষ্ক প্রকৃতি। দূর আকাশ গাম্ভীর্যপূর্ণ আবহাওয়ার রেশ। কোথাও বিন্দুমাত্র মেঘের আনাগোনা নেই। বাতাসটাও যেন ভারী। মাধুর্যের যখন জ্ঞান ফিরলো নিজেকে আবেশের কোলে মাথা রাখা অবস্থায় আবিষ্কার করলো। আবেশ গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে আধবোজা চোখে বসে আছে। আর ডান হাতে মাধুর্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
আবেশ তখন নিজ চেতনায় বিভোর ছিলো। লতা বেগমের মৃত্যুর সংবাদটা সে যখন পেলো তখন সবেমাত্র সে অফিস থেকে ফিরেছে। লতা বেগমের পাশের বাসা থেকে খবর টা দেওয়া হয়েছিলো তাদের। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষটার মৃত্যুর রহস্য উৎঘাটন হবার আগেই দাফনকাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। সিলেট থেকে ঢাকা আসার পথটুকুর মাঝেই সব কাজ যে সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে সেই বার্তাটা নাজিফা আবেশকে দিয়েছে।
আবেশে খবরটা পেয়ে দ্রুত ড্রাইভ করে মাধুর্যের হলে এসে স্পেশাল পার্মিশন নিতে গিয়েই আঁচ করে মাধুর্য অসুস্থ হয়ে জ্ঞানশূন্য অবস্থায় অডিটোরিয়ামের এককোণে অচেনা এক মেয়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
আবেশের আর বুঝতে বাকি নেই কি অবস্থা গিয়েছে মাধুর্যের উপর দিয়ে। এইজন্যই সে বারংবার বারণ করেছিলো কোনো প্রকার সংবাদ যেন মাধুর্যের নিকটা না পৌছায়।
‘ মা’কী সত্যিই নেই আবেশ।’ মাধুর্যের কন্ঠে ব্যাকুলতা। সেই কন্ঠ যেন আবেশের পুরুষ হৃদয়ে তোলপাড় তুলতে বাধ্য।
আবেশ জবাব না দিয়ে মাধুর্যের মাথাটা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
‘ প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এই আয়াতটুকু মানো তো মাধবীলতা ?’
আবেশের প্রশ্ন শুনে ক্রন্দনরত অবস্থায় মাধুর্য মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিতেই আবেশ আবার বলল,
‘ সেই হিসেবে লতা আন্টির সময় শেষ হয়ে এসেছে। তাকে যে তার নীড়ে ফিরতে হতোই। সেটা আজ হোক বা কাল। আমি তুমি সবাই আমাদের নিজস্ব নীড়ে ফিরে যাব বেলা শেষে। লতা আন্টির বেলা শেষ মাধু।’
‘ রাব্বী ভাইয়ার কথা…টা আবেশ। আমি রাখতে পারলাম না যে।’
‘ সে খুশি হয়েছে। সে উপলব্ধি করেছে,তার মায়ের শান্তির দরকার। তাই মৃত্যুর মাধ্যমেই তার মা শান্তি বেছে নিয়েছে।’
‘ রাব্বী ভাই এইটা বলেছেন?’
‘ হ্যাঁ , তাকে জামিন দিয়েছিলো আদালত। আন্টির জানাজা পড়ে আবার জেলে নেওয়া হয়েছে তাকে।’
মাধুর্য আবারো অস্থির হয়ে উঠলো। আবেশ তার অস্থিরতা বুঝতে পেরে মাধুর্যের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে আদরমাখা গলায় বলল,
‘ আত্মার মাগফেরাত কামনা করো মাধুর্য। মৃত্যুর পর দুনিয়ার হাওয়া বাতাস তার জন্য আজাব। তাই কবরস্থ দ্রুত করাটাই শ্রেয় তাই নয় কী ? ‘
মাধুর্য আবেশের বুকে মুখ লুকিয়ে খুব করে কাঁদলো। লতা বেগম তার সাথে অন্যায় করলেও দিনশেষে একটু হলেও ভালোবাসা বিলিয়ে দিতো। মায়ের মতো আরেকটা মা হারালো সে আবার।
তার সাথেই কেন এমনটা হয়! এর উত্তর মিলবে কবে।
___________________
ধরণীতে তখন নিশুতি। চারদিকে সর্বকালের কালো আঁধার গ্রাস করে আছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই আছে শুধু নীরবতা। দূরের রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের টিমটিম হলদেটে আলো আঁধার ঘুচানোর সর্বোপরি চেষ্টায় মত্ত্ব।
নজরুল সাহেবের প্রতিটা পদক্ষেপ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে। তবুও জুতার সাথে মেঝের ঘর্ষণের আওয়াজটা বিকট।
তিনি ডান হাত দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে বাসার বাইরে বেরিয়ে এলেন। একবার পেছনে ফিরে তার বিশাল সাম্রাজ্য টা দেখে তৃপ্তির হাসি আঁটলেন মুখে। ঘোলাটে আলোয় বাসার নেমপ্লেটের চোখ বুলিয়ে মুখে চওড়া হাসি টেনে বারদুয়েক উচ্চারণ করলেন,
‘ এহসান মঞ্জিল,নজরুল এহসান,রোড নং…’
তার বাড়ি এইটা। তার স্বপ্নের সাম্রাজ্য। আজ সব উচ্ছেদ করে দিয়ে এসেছে সে। আর একজন বাকি তার পাপের হিসেবের খাতার একটা পৃষ্ঠা।
আর সেটা হচ্ছে রাব্বী । এরপর সকল পাপের হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে দিবে সে। ভাবতেই কেমন আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছে তার মন গহীনে।
সম্পত্তি পাওয়ার আশায় কতোটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো সে নিজেও জানে না। শুধু তার মনে হচ্ছে,সে যা করেছিলো এইটার মাঝেই সুখ নিহিত।
মাধুর্যের মায়ের থেকে সম্পত্তি নেওয়া এরপরে মাধুর্যের বাবাকে ভুল বুঝানো,রাব্বীকে বিপথে ঠেলে দেওয়া,মাধুর্যকে বিনা অপরাধে বহুদিন নরকীয় যন্ত্রণা দেওয়া সবকিছুই যেন তার কাছে নিছক একটা কাজ মনে হয়।
তার কোনো অনুশোচনা হয় না। তবে ভয় হয়। বড্ড ভয় হয়। সবকিছু আবেশ, ফয়েজ,নাজিফা,নাবিহা জানলে তাকে ভুল বুঝে ফেলে রেখে গেলে কী হবে!
এইজন্য সে সব প্রমাণ শেষ করে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে আছে।
আর কিছুদিন এরপরেই তো সব সুন্দর মসৃণ হবে। ভাবতেই নজরুল সাহেব খুশিতে টগবগিয়ে উঠলেন।
গেট খুলে সামনে এগিয়ে গেলো সে।
‘ তুমি খাবার নিয়ে অবহেলা কেন করো? ‘
আবেশের প্রশ্নে চোখ তুলে তাকালো মাধুর্য। কাল রাতে সিলেট এসে পৌছিয়েছে তারা। অত্যাধিক ক্লান্তির জন্য মাধুর্য কখন এসেছে বলতে পারবে না। মন বিষিয়ে আছে তার। শতহোক মানুষের স্মৃতি এতো সহজে ত্যাগ করা মুশকিল।
আবেশ খাবারের প্লেট নিয়ে মাধুর্যের সামনে বসে আবার বলল,
‘ মাধবীলতা।’
‘ হ্যাঁ….হ্যাঁ বলো।’
‘ হলে খাবার খাও না কেন।’
মাধুর্য উত্তর দিলো না। তার কান্না পাচ্ছে। তার মায়ের কথা মনে হচ্ছে। সেই সাথে লতা বেগমের মায়াময় মলিন মুখ।
আবেশ সবেই খাবারের প্লেটটা পাশে নামিয়েছে। মাধুর্য ঝাঁপিয়ে পড়লো আবেশের বুকে। খাঁমচে ধরলো আবেশের পিঠের শার্ট। ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে ভেঙ্গে আসা গলায় উচ্চারণ করলো,
‘ আবেশ আমাকে মেরে ফেলুন নয়তো ঘুমের ঔষধ দিন আমি খেয়ে এই যন্ত্রণাময় পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে চাই।’
‘ মাধবীলতা তুমি তো নরম নও। স্ট্রোং ছিলে । এখন কেন এতো ভেঙ্গে পড়ছো।’
‘ আমি পারছি না আবেশ। আপনি ভাবুন আমার জীবনটা নরক ছিলো। যেই আবার একটু ভালোবাসা খুজতেছি এর মাঝেই আবার চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে। ‘
আবেশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাধুর্যের মাথায় উষ্ণ চুম্বন ছুঁইয়ে বিরস কন্ঠে বলল,
‘ আমার সাম্রাজ্যের রাণী তো ভেতর থেকে মলিন ছিলো না। তার সাম্রাজ্য ঘিরে বেঁচে থাকার লড়াই ছিলো একার। আজ তার সাম্রাজ্য আমি থাকতেও কেন তার বেদনা। তবে কী আমি ধরে নিবো আমার ভালোবাসা তোমাকে ভালো রাখতে বৃথা ? ‘
চলবে………….
ভর্তি প্রক্রিয়া চলছে। একটু নার্ভাস আমি। তাই গুছিয়ে নিতে একটু একটু সময় নিচ্ছি।