#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:৩৪
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
বিবর্ণ প্রত্যেকটা যন্ত্রণাময় প্রহর। ব্যথাতুর হাত নিয়ে কিছু করা যেন দায় হয়ে যাচ্ছে মাধুর্যের জন্য। এখানে তার প্রত্যেকটা প্রহর যে লড়তে হবে সে বেশ বুঝতে পারছে। তার ব্যথাতুর আর্তনাদেও কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায় নি। সবাই একদফা হেসে আর ওই মেয়েটাকে উৎসাহ দিয়ে যে যার মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে ।
আর সে! হাতে আর কোমড়ের ব্যথা নিয়েই উঠে দাঁড়িয়েছে। মাধুর্যের কান্না পাচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। বাসার সবার কথা মনের কোণে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সামনে থাকা দুইটা বেডের অচেনা মেয়েগুলোর চাহনী দেখে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে সে।
লাগেজ থেকে একে একে সব বের করে হাতে পরিষ্কার করে নিলো সে।
সবকিছু গুছিয়ে বেডে বসতেই মোবাইলের আওয়াজে সম্বিৎ ফেরে তার। জ্বলজ্বল করা স্ক্রিনে আবেশের নামটা ভেসে উঠতেই চোখ মুছে মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুঁটিয়ে মোবাইল তুলে নিলো সে । ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে ভেসে এলো,
‘ ঠিক আছো তুমি ?’
আবেশের এহেন প্রশ্নে কী জবাব দিবে খুজে পেতে বেশ বেগ পেতে হলো মাধুর্যের। মিথ্যা বলবে না সত্যিটা বলবে সেটা নিয়ে দোটানা কাটিয়ে উঠার পূর্বেই আবেশ আবারো বলল,
‘ কথা বলছো না কেনো !’
মাধুর্য রিনরিনে কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘ ভালো আছি।’
‘ মিথ্যা বলছো কেনো ?’
আবেশের প্রশ্নের মুখে চোরের ন্যায় মুখ করে বসে রইলো সে। লোকটা কী করে বুঝলো সে মিথ্যা বলছে?
মাধুর্য চুপ করে আছে। আবেশকে তার বলতে ইচ্ছা হচ্ছে,আমাকে নিয়ে যাবেন প্লিজ। নিঃশব্দ প্রত্যেকটা শব্দ আওড়াতে ইচ্ছা হলেও ভাবশূন্য হয়ে বসে রইলো সে। আবেশ নম্র কন্ঠে বলল,
‘ মন খারাপ ?’
‘ কিছুটা।’
‘ হাতে বেশি ব্যথা পেয়েছো?’
আবেশের উক্ত প্রশ্ন শুনে মাধুর্য আকাশ থেকে পড়লো যেন। উৎকন্ঠা নিয়ে বসে রইলো সে। আবেশ কি করে জানলো এই কথা?
প্রশ্নটা করার পূর্বেই আবেশ জবাব দিলো,
‘ তোমাদের হোস্টেল সুপার বিষয়টা দেখেই আমাকে ইনফর্ম করেছেন। আর ওই মেয়েটাকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টাও দেখছেন। তোমাকে আমি রেখে এসেছি ভেবো না দায়িত্ব ত্যাগ করেছি। তোমার ছোট ছোট জিনিস,প্রয়োজন,ব্যথা প্রত্যেকটা বিষয়ের প্রতি আমার নজর আছে এবং থাকবে।’
আবেশের বলা কথায় মাধুর্য ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আবেশ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অন্ধকারছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে মাধুর্যের ক্রন্দনরত মুখশ্রী কল্পনা করতেই শিউরে উঠলো । হৃদয়ের গভীরতম স্থান থেকে নিঃসৃত হলো বেদনার রক্তপ্রবাহ। তার মাধবীলতা ভালো নেই ভাবতেই সূক্ষ্ম বেদনার রেশ হানা দিলো তার সর্বাঙ্গ জুড়ে।
তার রাজ্যে আজ দুঃখের আনাগোনা,কারণটা যে সাম্রাজ্যের রাণী।
আবেশ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে শীতল কন্ঠে বলল,
‘ তোমার লাগেজের লাস্টের চেইন খুলে দেখো কিছু মেডিসিন রাখা আছে।’
‘ মেডিসিন দিতে হবে না। ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ কথা বাড়িয়ো না। আমার রাগ সম্পর্কে তোমার ধারণা নিশ্চয়’ই আছে মাধবীলতা।’
আবেশের ধমকের সুর মাধুর্য উপলব্ধি করতে পারলো খুব করে। বিনাবাক্য চেইন খুলে তার সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো পেলো। সেই সাথে মান্থলীর যে সমস্ত উপকরণ আর মেডিসিন প্রয়োজন সে সমস্ত কিছু দেখে মাধুর্যের সমস্ত ব্যথা যেন নিমিষেই নিঃশেষ হয়ে এলো।
আবেশ ইতিমধ্যে ফোন কেটে দিয়েছে। মাধুর্য বুঝতে পেরে হাসলো। এতোক্ষণ,এতোটা সময় পর তার শান্তি অনুভব হচ্ছে।
সে কাছে নেই তবুও দূরেও যে নেই।
________________
শীতের প্রকোপ শহুরে জীবনে খুব একটা বিচার করতে পারে না সেটা মাধুর্য এই দু’দিনে বুঝতে পারছে। তবে এই ভিন্ন পরিবেশের মানুষ গুলোও ভিন্ন। ক্লাস শুরু হবে কাল। আশেপাশের কতো মেয়ে তবুও যেন কেউ নেই। মাধুর্য পড়ার টেবিলে বসে সামনের বেডের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে।
মেয়েটার চেহারায় চেনা মানুষের কিছুটা ছাপ পাচ্ছে মাধুর্য । সে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে যা মেয়েটার মুখে বিরক্তির আভা ফুঁটিয়ে তুলছে খনেখনে। মাধুর্য সে দিকে তোয়াক্কা না করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
মেয়েটা তার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বইয়ে মনোযোগী হতেই মাধুর্য তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ তুমি কি ফার্স্ট ইয়ার? জানো আমিও ফার্স্ট ইয়ার।’
মেয়েটার বিরক্তি সূচক চাহনী নমনীয় হলো মাধুর্যের কন্ঠের মিষ্টতায়। মাধুর্যের দিকে মুখে তুলে তাকিয়ে খানিক হাসির রেখা টেনে বলল,
‘ এই রুমের সবাই ফার্স্ট ইয়ার। যাইহোক দাঁড়িয়ে কেন! বসো এখানে।’
মাধুর্য অনুমতি পেয়েই বসে পড়লো। মেয়েটার মুখের দিকে না তাকিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে মুখের আদল চেনার খুব চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ সে। নির্বিকার ভাবে বসে রইলো। মেয়েটা বেশ কিছুক্ষণ মাধুর্যকে পর্যবেক্ষণ করে সুমিষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ নাম কী তোমার? ‘
মাধুর্য নীচুস্বরে বলল, ‘ মাধুর্য।তোমার নাম কি আপু।’
মেয়েটা স্বশব্দে হাসল। হাসতে হাসতেই বলল,
‘ আমার নাম প্রভাতি। আমাকে তুই করেই বলতে পারিস।এইবার দেখি তো হাত কতোখানি ইঞ্জুর হয়েছে।’
বলেই সে মাধুর্যের হাত টেনে নিয়ে আফসোসের শিষ তুললো। কন্ঠে রাগ এনে বলল,
‘ ওই হারামি টা এমন বেয়াদবি সব সময় করে। ইশ! কতোখানি কেটেছে।’
‘ ঠিক হয়ে যাবে মেডিসিন লাগিয়েছি আমি।’
‘ তুই চুপ। এইবার থেকে আমি বুঝবো।’
বলেই প্রভাতী হন্তদন্ত হয়ে উঠলো। যে মেয়েটার চোখেমুখে একটু আগেও বিরক্তি ছিলো কিছু মুহূর্ত পরেই ভালোবাসা দেখতে পাবে মোটেও ভাবে নি মাধুর্য।
এই শহরের মানুষ গুলা আদেও খারাপ না। এই বাক্যটা উচ্চারণ করেও করলো না মাধুর্য।
______________
এহসান বাড়ি সদরে আজও কুয়াশার পসরা বসেছে। ডাইনিং টেবিলের টুংটাং আওয়াজ হলেও সবাই চুপচাপ খাবার খাচ্ছে। শীতের দাপট সারা সিলেট দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । নজরুল সাহেব সবার মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে যেতে যেতে বলল,
‘ মাধুর্য পড়তে গিয়েছে মারা যায় নি।’
উক্ত কথাটা কেমন কটূক্তিময় শোনালো সবার নিকট। মাহফুজা রাগান্বিত হয়ে বলল,
‘ এইটা কেমন কথা।’
‘ মেয়েটাকে উৎসাহ দেওয়ার বদলে তোমরা আরো ভেঙ্গে দিচ্ছো। আচ্ছা শোনো,সে যদি জানতে পারে তোমরা তাকে ছাড়া ভালো নেই । এইটা শোনার পর পড়ায় মনোযোগ দিতে পারবে সে ? তাই নিজেরাও হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করো মাধুর্যকেও রাখো।’
বলেই নজরুল সাহেব চলে গেলেন। ইদানীং তার ব্যবহার কেমন অচেনা লাগছে সবার নিকট। আবেশ কিছুক্ষণ পর বলল,
‘ বাবা কিন্তু সঠিক কথাই বলেছেন। নাজিফা তুই ও আর মাধুর্যের কাছে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করবি না। মাথায় থাকে যেন ।’
________________
মার্চের শুরুর দিকে গরম আর কিছুটা শীতল পরিবেশ উপভোগ্য। সিলেট ছেড়ে আসার দেড় মাস যেন দেড় বছরের সমান মাধুর্যের কাছে। প্রতিনিয়ত ক্লাস আর ব্যস্ততা দিনে থাকলেও রাতে বেশ শূন্যতা অনুভব হয় তার।
প্রভাতীর সাথে সম্পর্কটা বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে । মেয়েটাকে ভালো না বেশি ভালো বলা চলে। মাধুর্যকে নিজের বোনের মতো আগলে রাখে। ওই প্রথম দিনের ঘটনার পর কোনো ধরণের সমস্যায় পড়তে হয় নি তাকে আর।
তবে ইদানীং সিলেট যাবার জন্য আর আবেশকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে তার মন।
প্রভাতী তখনো বাইরে। হয়তো কোনো ইম্পোর্ট্যান্ট নোটস আনতে গিয়েছে।
পাশের বেডের মেয়েটা শিফট হয়েছে অন্য রুমে। ফাঁকা রুমে বেশ ভয়’ই লাগছে মাধুর্যের। পড়ায় মনোযোগ দিতে চাইলেও পারছে না। তারউপর সকাল থেকে জ্বর জ্বর লাগছে তার।
টেবিল ছেড়ে উঠে আবেশকে ফোন দিলো সে। আবেশকে বারবার ফোন দিয়ে না পেয়ে নাজিফাকেও ফোন দিলো সে।
নাজিফাও ফোনা না উঠালে মাধুর্যের ভয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। বাসার সবাইকে ফোন দিয়েও এক অবস্থা দেখে ভয়ে আরো শিউরে উঠলো সে।
চলবে……..