#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৩৩
অপেক্ষার প্রহর এত সুদীর্ঘ কেন? এক-একটা মিনিট যেন এক-একটা ঘন্টার সমান। পৃথিবীর কতশত কপোত-কপোতী প্রিয় মানুষটার জন্য অপেক্ষা করে। দিন-মাস-বছর পেরিয়ে যায়। তবু তারা ক্লান্ত হয় না। অথচ তারা জানে যে যার জন্য এত অপেক্ষা, সে যুগ পেরোলেও ফিরবে না। তবু কেন এত অপেক্ষা? ‘ভালোবাসা’ নামক এই ছোট্ট শব্দটার বুঝি এত শক্তি! এতই যদি শক্তিশালী হয়ে থাকে, তবে কেন মানুষ ভালোবাসার অভাবে ভোগে? কেন বালিশে মুখ গুঁজে বিনিদ্র রজনী জাগে? কেন শতশত প্রাণ আত্নদান করে? এতকিছুর পরও ভালোবাসা ভালোবাসাই। না এর শক্তি পালটাবে, না অর্থ।
রাত এখন সাড়ে এগারোটা। মাথার ওপরে সিলিং ফ্যানটা ফুল স্পীডে ঘুরছে। আর আমি বিছানায় সটান শুয়ে সেদিকে তাকিয়ে দুনিয়ার যত ভাবনা ভাবছি। অথচ কোনো ভাবনাই স্থায়ী হচ্ছে না। এটা ভাবছি তো ওটা ভালো লাগছে না, ওটা ভাবছি তো এটা ভালো লাগছে না। একটা সম্পূর্ণ না করেই আরেকটার পেছনে লেগে পড়ছি। জেমির মিয়াও মিয়াও ডাকে পাশ ফিরে তাকালাম। টেবিলে চোখ পড়ল। ঢেকে রাখা খাবারের প্লেটটা দেখে উঠে বসলাম। এখনও কি উনি আসেননি? সকালের সেই নিউজ শোনার পরও অনেকবার ওনাকে ফোন করেছি। রিং হওয়ার পরও উনি বারবার কেটে দিয়েছেন। অথচ বাবার ফোন ঠিকই ধরেছেন। বাবা বলেছে উনি না কি তাড়াতাড়ি ফিরবেন বলেছেন। অথচ এখনও ফেরেননি। এদিকে আফরা আপু আজ সারাটা দিন ধরে ঘরে আটকে আছে। হাজারবার ডাকলেও সে দরজা খোলেনি। মাঝে না কি সন্ধ্যায় একবার বেরিয়েছিল বেশি ক্ষুধা পেয়েছিল বলে। তখন আমি দেখিনি। মিতা-রিতা চলে যাওয়ার সময় দেখেছিল। তারপর ওরা এসে আমাকে বলে গেছে। জানি না আপুর মনে এখন কী চলছে। হয়তো প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে। পেটের মধ্যে হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। প্রচুর ক্ষুধা পেয়েছে। সেই সকালে একটা রুটি খেয়েছিলাম। তারপর দুপুরে খাইনি। রাতে বাবা জোরাজুরি করছিল বলে খাবার নিয়ে রুমে চলে এসেছি। কিন্তু খাইনি। একজন দূর থেকে যে আমার খাদ্য ভক্ষণের ইচ্ছেটাও কেড়ে নিয়েছে। শোয়া থেকে উঠে বসলাম। ভাবলাম একটু পানি খেলে ভালো হয়। বেড সাইড টেবিলে শূন্য জগ পড়ে আছে। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে জগ হাতে বাইরে হাঁটা দিলাম। টেবিলের কাছে যাওয়ার আগে তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে তাকালাম। আমার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। রুমে বাতি জ্বলছে, তার মানে উনি এসেছেন। হাতের জগটা টেবিলে রেখে এসে দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে সোজা ওনার রুমে ঢুকে গেলাম। বিছানায় ল্যাপটপ, ফোন আর অগোছালো জামা-কাপড় নজরে পড়ল। এগুলো পরেই উনি গতকাল বেরিয়েছিলেন। কিন্তু রুম তো ফাঁকা, ওয়াশরুমের দরজাও ভেজানো। তাহলে উনি কোথায়? বেলকনিতে ছুট লাগালাম। সেখানেও নেই। রুম থেকে বেরিয়ে আমি রান্নাঘর আর ড্রয়িংরুমে খোঁজ করলাম। কোথাও নেই। কোমরে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলাম উনি কোথায় আছেন। ওপরে না কি? হয়তো আফরা আপুকে স্বান্তনা দিতে গেছেন। এক দৌড়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে চলে গেলাম। আফরা আপুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কান পাতলাম। নাহ্, ভেতরে ‘টু’ শব্দটুকুও নেই। যে আমি রাতে ভূতের ভয়ে ড্রয়িংরুমে যেতেও ভয় পাই, সেই আমি কি না আজ এই রাতে সারা বাড়ি ছুটে বেড়ালাম! পুনরায় নিরাশ হলাম। উনি কি তাহলে আবার কোথাও গেছেন? ধুর! বাইরে গেলে কি ফোন রেখে যেতেন? আর কোথায় খুঁজব? গার্ডেনে, না ছাদে? ওসব জায়গায় আমি যাব কীভাবে? গার্ডেনে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। হ্যাঁ, ছাদের দরজা খোলা থাকলে বুঝব উনি ছাদে গেছেন। বন্ধ থাকলে যাননি। ছাদের সিঁড়ি ঘরের দিকে ছুটলাম। মুহূর্তেই মুখে হাসি ফুটল। দরজা খোলা। এবার ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দরজায় দাঁড়ালাম। চাঁদের আবছা আলোয় চারদিকে চোখ বোলালাম। ওই তো উনি। ওদিক মুখ করে বসে আছেন। দৃষ্টি বোধ করি আকাশের দিকে। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম। ওনার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে মিনিট দুই সময় নিয়ে সাহস জোগালাম। তারপর দ্রুত গিয়ে হুট করে ওনার পাশে বসে পড়লাম। ভেবেছিলাম উনি চমকে উঠবেন। কিন্তু মহাশয় আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। যেভাবে বসে ছিলেন সেভাবেই বসে রইলেন। আশ্চর্য! আজকাল কি সামনে না থাকলেও উনি মাইন্ড রিড করতে জানেন? যেচে একটু গলা ঝেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। ইচ্ছে করল শয়তানটার অ্যাটিটিউডকে গলা টিপে হত্যা করতে। মিনিট দুই কেটে গেল। ভেবেছিলাম আমি চুপ থাকলে উনি হয়তো কথা বলবেন। ওই ভাবনা ভাবনাই রয়ে গেল। চাঁদের আবছা আলোয় ওনার মুখের অভিপ্রায় বুঝতে পারলাম না। শেষমেষ হতাশ আমি বড়ো করে দম নিয়ে মুখ খুললাম। ওনার মতোই দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে কোনোকিছু না ভেবেই হঠাৎ শান্ত স্বরে বলে উঠলাম,
“প্রেম-ভালোবাসার সংজ্ঞা জানেন তাজ ভাই? জানাটা খুব প্রয়োজন আমার। বলবেন?”
ভাবিনি এক কথায় উনি মুখ খুলবেন। আমার প্রশ্নের গোষ্ঠীর তুষ্টি উদ্ধার করে খুব সুন্দর করে বললেন,“তিক্ত কথার মানুষের মুখে এসব শুনতে ভালো লাগবে না। শ্রেয়ানকে জিজ্ঞেস করলে ও বেশ ভালো করে বুঝিয়ে বলতে পারবে।”
আমি গাল ফুলিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। উনি এসবের জের ধরেই বাড়ি ফিরেননি। এবার আমি সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করলাম,“দুদিন পর বাড়ি ফিরলেন কেন? বোধ হয় হাজারবার কল করেছি। গতকাল না হয় ধরে নিলাম কাজের চাপে রিসিভ করেননি। আজ কেটে দিলেন কেন? বাবার ফোন তো ঠিকই ধরেছেন।”
তাজ ভাই আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলেন,“প্রয়োজন বোধ করিনি।”
ওনার এটুকু কথায় এক গুচ্ছ অভিমান এসে আমার মনে জমাট বাঁধতে চাইল। সেসব দূরে ঠেলে দিয়ে পুনরায় বললাম,“জানেন আমি কত চিন্তায় ছিলাম? না আপনি ফোন রিসিভ করেছিলেন, না শ্রেয়ান ভাইয়া।”
“এত স্পেশাল মানুষের ফোন ইগনোর করল!”
বুঝলাম, উনি শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা বলছেন। কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান। আমি মিনমিনে গলায় বললাম,“সরি।”
“কেন?” গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন উনি।
আমি মাথা নিচু করে বললাম,“আমি সত্যিই শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে ভার্সিটি যেতে চাইনি। বাবা যেতে বলেছিল বলে বাধ্য হয়েছি।”
সঙ্গে সঙ্গে আমার বাহুতে চাপ পড়ল। উনি আমার এক বাহু চেপে ধরে কাছে টেনে চোখে চোখ রাখলেন। সে চোখে যেন আগুন ঠিকরে পড়ছে। রাগে গজগজ করতে করতে ধমকে উঠলেন,“মুখে বলেছিলাম মেপে মেপে বিশ হাত দূরে থাকতে। আর চোখে দেখলাম হাত ধরাধরি করে হাঁটতে। বাইকে গা ঘেঁষে বসাটাও হয়ে গেছে। আহ্! অনিচ্ছাকৃত স্পর্শ। খুব সুন্দর মোমেন্ট ছিল, তাই না? প্রেমের সূচনা বলে কথা!”
আমার চোখে পানি এসে গেল। হাতের ব্যথার থেকে বেশি ব্যথা অনুভব করলাম বুকের বাঁ পাশটায়। ওনার এমন কঠিন কথাগুলো এসে যেন বুকের মধ্যে তীরের মতো বিঁধল। অসহায় মুখে, ছলছল চোখে আমি বললাম,“এসব কী বলছেন আপনি? শ্রেয়ান ভাইয়া নিজেই বাড়ি বয়ে এসে আমাকে ভার্সিটি নিয়ে যেতে চাইছিলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে না বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে বাবার কথায় মানতে বাধ্য হয়েছিলাম। বাইকে গেলেও আমি ওনার গা ঘেঁষে বসিনি। যথেষ্ট দূরত্ব রেখেছিলাম। আর হাত ধরাধরি করে হাঁটিওনি। একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যাচ্ছিলাম। তখন শ্রেয়ান ভাইয়া আমার হাত ধরে সামলে নিয়েছিলেন। ওই মেয়েটার ওপর ভাইয়া রেগে গিয়েছিলেন। রাগের মাথায় দ্রুত গেইটের বাইরে আসতে গিয়ে হাত ছাড়তে ভুলে গেছেন। আমি হাত ছাড়ার কথা বলব তার আগেই দেখলাম গেইটের বাইরে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। সত্যি বলছি, আপনার দিব্যি।”
কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেই তাজ ভাইয়ের হাত আলগা হয়ে এল। সেই সুযোগে আমি ওনার হাত থেকে আমার বাহু ছাড়িয়ে অপর হাতের তালুতে ঘঁষতে লাগলাম। তাজ ভাই দুহাতে মুখ ঢেকে জোরে শ্বাস নিলেন। আমি হাত ঘঁষতে-ঘঁষতে অসহায় মুখে বললাম,“নিচে চলুন না, ক্ষুধা পেয়েছে আমার।”
উনি মুখ ঢেকে রেখেই বিরক্তি নিয়ে বললেন,“তো গিলতে যা। আমি কি আটকে রেখেছি তোকে?”
“সারাদিন ধরে অভুক্ত আমি”, ঠোঁট উলটে বললাম আমি।
সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাই দ্রুত মুখ থেকে হাত সরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। অবাক কন্ঠে বলে উঠলেন,”কী বললি? সারাদিন ধরে অভুক্ত মানে?”
আমি ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,“সেই সকালে একটা রুটি খেয়েছিলাম।”
“হোয়াট!” চেঁচিয়ে উঠলেন তাজ ভাই।
আমি মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। উনি আমার হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে হাঁটা ধরলেন। দ্রুত ছাদ থেকে নেমে এলেন। ডায়নিং টেবিলের পাশে এসে চেয়ার টেনে বসিয়ে দিয়ে কড়া গলায় বললেন,“এক পা-ও নড়বি না এখান থেকে।”
‘খাবার গরম করব না’ বলতে গিয়েও বললাম না। দেখি মহারাজ কী করেন। বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ বসে রইলাম। তাজ ভাই সোজা রান্নাঘরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন পাঁচ মিনিট পর। প্লেটে খাবার নিয়েই এসেছেন। আমার পাশের চেয়ার টেনে বসে ভাত মেখে মুখে তুলে দিতে দিতে গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,“না খেয়ে ছিলি কেন?”
“এমনিতেই।”
“এমনিতেই?”
“ইচ্ছে করেনি।”
“সারাদিনেও তোর খেতে ইচ্ছে করেনি? তো কী ইচ্ছে করেছে?”
“সারাদিন তো আপনার চিন্তা করে করেই আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে”, বিরক্তি নিয়ে কিছুটা জোরেই বলে উঠলাম আমি।
তাজ ভাই নিজের মুখে খাবার তুলতে গিয়েও থেমে গেলেন। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,“আমার জন্য তোকে আজাইরা চিন্তা করতে বলেছে কে? প্রেমে-ট্রেমে পড়েছিস না কি আমার?”
কথাটা বলেই তাজ ভাই ভ্রু নাচালেন। আমি কিছুটা মিইয়ে গেলাম। এই প্রশ্ন তো সারাদিন ধরে আমি নিজেই নিজেকে করে এসেছি। তবু নিজে একধাপ এগিয়ে থাকার জন্য মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠলাম,“আপনার প্রেমে পড়ে যেচে পায়ে কুঠার মারব আমি? কথায় কথায় মাথায় গান চেপে ধরেন। বিপজ্জনক লোক!”
কথাটা বলেই আবার আগ্রহী দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,“ওহহো! আপনাকে তো এখন আর মাফিয়া বলতে পারব না। আপনি তো ডিটেকটিভ। তাতে কী? আপনার স্বভাব মাফিয়াদের মতোই থেকে যাবে। আপনি ডিটেকটিভ না, মাফিয়া হিসেবেই পারফেক্ট।”
তাজ ভাই ঠোঁট এলিয়ে হেসে বললেন,“তো তোকে যদি মার্ডার করে সুইসাইড কেস বলে চালিয়ে দেই। তাহলে কেমন হবে?”
আমি চমকে উঠে ঢোক গিলে বললাম,“এই একদম ব্ল্যাকমেইল করবেন না। আপনার এই স্বভাবটা সবচেয়ে বেশি খারাপ। এসব বাদ দিয়ে আপনার এতদিনের রহস্যের কথা বলুন তো একটু।”
“কী বলব?”
“আপনাদের পরিচয় আমার কাছে লুকালেন কেন? বাবার কাছে তো লুকাননি। আমি কি ঢাক পিটিয়ে অ্যানাউন্স করে বেড়াতাম?”
“বলা তো যায় না, হয়তো এটাই করতি। তোদের মহিলা জাতির এটাই স্বভাব। সব কথা ঢাক পিটিয়ে অ্যানাউন্স করা। পেটে থাকলে তো বদহজম হয় তোদের।”
আমি বিরক্ত হলেও তা পাত্তা না দিয়ে আবার বললাম,“ঠিক আছে, পরিচয় লুকানোর কারণ বুঝলাম। তো, দুদিন পর পর আমার বালিশের পাশে আবেগঘন চিরকুট রেখে আসা, আমার পছন্দের জিনিস কিনে রেখে আসা, ওই বনলতা নাম, তুমি সম্বোধন, খাইয়ে দেওয়া, শ্রেয়ান ভাইয়ার থেকে দূরে থাকতে বলা, আমাকে নিয়ে এত চিন্তা, এত যত্ন, এসবের কারণ?”
তাজ ভাই এক ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন,“কী শুনতে চাইছিস?”
“আপনার উত্তর।”
“আচ্ছা। ভাবলাম দুদিন পর তো এমনিতেই বিদায় করে দিব এ বাড়ি থেকে। এখন একটু যত্নআত্তি করি। পরে যেন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আমাদের বদনাম করতে না পারিস।”
“ফালতু কথা না বলে সত্যি কথা বলতে পারেন না?”
“আমি তো ভেবেছিলাম আমি না বললেও শ্রেয়ান বলে দিবে। এত কাছের মানুষ হয়েও বলল না!”
আমি গোমড়া মুখে বললাম,“আপনি এখনও রেগে আছেন? একটু আগে তো আমি না খেয়ে আছি শুনেই রাগ ফুস করে উড়ে গিয়েছিল।”
“সবার ওপর রাগ দেখাই না আমি।”
আমি ভেংচি কেটে বললাম,“অথচ রাগের জন্যই দুদিন পার করে বাড়ি ফিরেছেন।”
“আমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ফেলে রেখে আমি এসে বাড়ি বসে থাকতাম? বলদ কোথাকার! এসব বলদমার্কা কথা শিখিস কার থেকে?”
“এত কথা না বাড়িয়ে সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেই পারেন।”
“বেশি কৌতুহল ভালো না।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। গাল ফুলিয়ে চুপচাপ খাবার শেষ করলাম। খাবারের প্লেট ধুয়ে রেখে এসে দেখলাম তাজ ভাই ফোনে কথা বলছেন। কোনো কাজের ব্যাপারেই কথা বলছেন। আমি ওনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি ফোন রাখতেই বললাম,“ডিটেকটিভ সাহেব কি আজ ঘুমাবেন না? না কি সারারাত জেগে বসে বসে কাজ করবেন?”
তাজ ভাই ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন,“তিনটা রাত ঘুমাইনি। লম্বা একটা ঘুমের প্রয়োজন।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,“তিনটা রাত ঘুমাননি মানে?”
“দেখলিই তো কী হয়ে গেল। গ্রামে গিয়ে দম ফেলার সময়টুকুও পাইনি।”
“কাকাকে কি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিবে?”
“মুক্তি চাইছিস?”
“আমার এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে কাকা এমন জঘন্য কাজ করেছে”, ধরা গলায় বললাম আমি।
তাজ ভাই গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“শোন, আফরাকে বলবি কাল সকালে আমার সাথে কথা বলতে।”
আমি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম। তাজ ভাই হঠাৎ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,“কাল রাতে কখন ঘুমিয়েছিলি?”
আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম, কিন্তু কোনো জবাব দিলাম না। উনি আবার বললেন,“শুকনো মুখ অনেক কিছু বলে দিচ্ছে। সত্যি কথা বল।”
“তিনটার দিকে”, মিনমিনে গলায় কথাটা বলেই আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।
“অপেক্ষা করছিলি?”
আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাথা ঝাঁকালাম। উনি বললেন,“আমার জন্য আর কখনও অপেক্ষা করবি না। আর কখনও না খেয়েও থাকবি না। এরপর থেকে আমার কাজের চাপ আরও বাড়বে।”
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে নখ খুঁটছিলাম। নিচু স্বরে প্রশ্ন করলাম,“আপনার রাগ কমেছে?”
উনি মৃদু হেসে আমার বাঁ হাতটা নিজের দুহাতের মুঠোয় নিলেন। চুড়ি দুটো নাড়াচাড়া করতে করতে সেদিকে দৃষ্টি রেখেই বললেন,“চাইলেও সবার ওপর রাগ স্থায়ী করা যায় না। সাধ্য থাকে না।”
আমি স্থির দৃষ্টিতে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“শুয়ে পড় গিয়ে”, বলেই উনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। যেতে যেতে বললেন,“প্রেমের বহু সংজ্ঞা হয়, ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা হয় না। এটা সম্পূর্ণই একটা অনুভুতি। অন্যরকম অনুভূতি। হঠাৎ উড়ে এসে হৃদয়ে জুড়ে বসে নিত্যদিনের জীবনটাই ওলট-পালট করে দেয়। আটকানোর চেষ্টাটুকুও করা যায় না।”
চলবে………………..?
(মন্তব্য করেন না কেন বলে যান তো একটু।?)