#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:২৯
ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে বারোটার ঘর ছুঁই ছুঁই। এখনও তাজ ভাইয়ের বাড়ি ফেরার নাম নেই। বাবা আর আফরা আপু সাড়ে দশটায় ডিনার করেছে। আমাকে খেতে ডাকায় আমি বলে দিয়েছি ক্ষুধা নেই। তবে কথাটা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। কেন জানি খেতে ইচ্ছে করছে না। আধা ঘন্টা যাবত তাজ ভাইয়ের নাম্বারে ডায়াল করেই চলেছি। কিন্তু প্রতিবারই রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে। শ্রেয়ান ভাইয়ার নাম্বারটা থাকলে তাকে ফোন করে খবর নেওয়া যেত। কেন যে তার নাম্বারটা রাখলাম না। নিজের বোকামির জন্য মনে মনে নিজেকেই বকতে লাগলাম। ইতিপূর্বে উনি এত দেরি করে বাড়ি ফিরেননি। ঘড়ির কাঁটা যতই সামনে এগোচ্ছে, ততই আমার মাঝে অস্থিরতা বাড়ছে। এর আগে কখনও বাবার জন্যও আমি এতটা চিন্তায় পড়িনি। তাজ ভাইকে ফোন করতে করতে আমি রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। বাবার রুমের দরজা বন্ধ। বোধ হয় ঘুমাচ্ছে। আফরা আপু দোতলার একটা রুমে আছে। সে-ও হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। আফরা আপুর ইচ্ছে ছিল তাজ ভাইয়ের আশেপাশের কোনো রুমে থাকার। কিন্তু নিচের তলায় কোনো রুম খালি নেই। তিনটা রুমে আমি, বাবা, তাজ ভাই থাকি। বাকি একটা বাবার পার্সোনাল রুম। ওখানে আমিও যাই না। আমি ঠিক করেছি তাজ ভাইকে এখন থেকে ওপরের তলার কোনো রুমে থাকতে বলব। আফরা আপু দোতলায় একা একা থাকলে, ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। শত হলেও সে আমাদের অতিথি। এতরাতে একা-একা ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে থাকতেও আমার ভয় লাগছে। সারা বাড়ি নিশ্চুপ। এমনিতেই ভূতে আর অন্ধকারে আমার প্রচন্ড ভয় আছে। হঠাৎ মনে হলো এখন যদি লোডশেডিং হয়, তাহলে তো আমি ভয়ে এখানেই জ্ঞান হারাব। কথাটা মাথায় আসতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। তখনই হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ কানে এল। সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। তাজ ভাই দরজা আটকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সামনে আমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ব্যস্ত হয়ে বললাম,“এতক্ষণে আসার সময় হলো আপনার? এত দেরি হলো কেন? ফোন রিসিভ করেননি কেন?”
তাজ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কথাগুলো শুনেও কোনো উত্তর দিলেন না। ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে সোফায় বসে পড়লেন। আমি ওনার সামনে দাঁড়িয়ে একইভাবে বললাম,“এত রাত করে ফিরবেন, একটা ফোন করে তা জানিয়ে দিতে পারলেন না? কয়টা বাজে খেয়াল আছে আপনার? পৌনে একটা বেজে গেছে। এতক্ষণ অবধি জেগে ছিলাম আমি।”
তাজ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“আমার কাছে এক্সট্রা চাবি ছিল। জেগে থাকতে কে বলেছে?”
আমি রাগত স্বরে বললাম,“টেনশন হচ্ছিল তাই জেগে ছিলাম। শখ করে মাফিয়া হয়েছেন, দুনিয়াতে আর কোনো কাজ ছিল না? মাফিয়াগিরি করে রাত-দুপুরে বাড়ি ফিরবেন? কত গর্বের কাজ!”
তাজ ভাই এবারও প্রতিউত্তর করলেন না। বড়ো একটা দম নিয়ে দুহাত এক করে নিজের কপালে ঠেকালেন। ওনার ডান হাতের দিকে দৃষ্টি পড়তেই আমি চমকে উঠলাম। খপ করে ওনার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ভালোভাবে দেখতেই আমার মাথাটা ভনভন করে উঠল। আমি ধপ করে ওনার পাশে বসে পড়লাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,“এত রক্ত কেন?”
তাজ ভাই ঝট করে নিজের হাতটা আমার হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পেছনে লুকিয়ে ফেললেন। ওনার হাতের অনেকটা অংশ জখম হয়ে গেছে। সেখানে তাজা রক্ত জমাট বেঁধে আছে। আমি একহাতে মাথা চেপে ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। তাজ ভাই আমার পাশ থেকে উঠে গেলেন। একটা গ্লাসে পানি নিয়ে এসে আবার আমার পাশে বসলেন। জখম হওয়া ডান হাতে আমাকে আলতো করে আগলে ধরে, আরেক হাতে পানির গ্লাস মুখের সামনে ধরলেন। আমি দ্রুত কিছুটা পানি খেলাম। উনি পাশের টি-টেবিলে গ্লাসটা রেখে আমার মাথাটা নিজের বুকে রাখলেন। আমি চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম। মিনিট দশেক এভাবেই বসে থাকার পর আমি কিছুটা স্বস্তি অনুভব করলাম। তারপর তাজ ভাইয়ের কাছ থেকে সরে, উঠে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে হাঁটা দিতেই তাজ ভাই পিছু ডেকে বললেন,“চলে যাচ্ছিস?”
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম,“ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসি।”
উনি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাঁধা দিয়ে বললেন,“দরকার নেই। আমি রুমে গিয়ে ব্যান্ডেজ করে নিচ্ছি।”
কথাটা বলেই উনি নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলেন। আমি পেছন থেকে প্রশ্ন করলাম,“ডিনার করবেন না?”
“ইচ্ছে করছে না।” বলেই উনি রুমে চলে গেলেন। কোনো কিছু না ভেবে আমিও ওনার রুমের দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে চোখ পড়তেই আমার পা থেমে গেল। ওপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আফরা আপু এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু বলার আগেই আপু ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের দিকে চলে গেল। আমার মনে খটকা লাগল, কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা কি আফরা আপু দেখে ফেলেছে? দেখে থাকলে সে কী ভেবেছে? আফরা আপুকে নিয়ে বেশি না ভেবে তাজ ভাইয়ের রুমে চললাম। দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে দেখলাম তাজ ভাই বিছানায় উঠে বসে হাতে ব্যান্ডেজ করছেন। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতে ব্যান্ডেজ করতে তার মোটেও অসুবিধা হচ্ছে না। মাফিয়া বলে কথা! এমন জখম বা ব্যান্ডেজের ব্যাপারে নিশ্চয়ই খুব অভিজ্ঞতা আছে। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে তাজ ভাই ব্যান্ডেজ ঠিক করতে করতে বললেন,“ঘুমাতে যাচ্ছিস না কেন?”
আমি তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উলটো রাগ দেখিয়ে বললাম,“মাফিয়া হয়ে কী পেয়েছেন আপনি? এমন আঘাত পেয়ে কী মজা পান? কোনো লাভ আছে, শুধু গুন্ডামি ছাড়া? এমন তো নয় যে টাকা উপার্জনের জন্য আপনাকে মাফিয়া হতে হয়েছে। তাহলে? এই পথ বেছে নেওয়ার মানে কী? আমি কালই বাবাকে সব বলে দিব। তার আদরের ভাগনে কত গর্বের কাজ করে বেড়ায়, তা জানাতে হবে না তাকে?”
কথাগুলো বলে আমি দরজার দিকে পা বাড়াতেই তাজ ভাই বললেন,“চিঠি আর ছবিটা কিন্তু এখনও আমার হাতে আছে।”
আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে শক্ত মুখে বললাম,“ওগুলো ভিজিয়ে পানি খান বসে বসে।”
“তোর বাপকে দেখাব।”
“দেখান গিয়ে।”
“ভয় পাস না।”
“আপনি বাঘ, না ভাল্লুক?” বলেই আমি আবার দরজার দিকে পা বাড়ালাম। চোখের পলকে তাজ ভাই বিছানা ছেড়ে নেমে এসে পেছন থেকে আমার হাত টেনে ধরলেন। আমি দাঁড়িয়ে পড়লেও পেছন ফিরে তাকালাম না। উনি আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে বললেন,“এত রাগ কিসের?”
“আমি রাগ করব কোন দুঃখে?”
“ডিনার করেছিলি?”
“জেনে কী করবেন?”
“গান সাথেই আছে। শুট করব?”
“হাত ছাড়ুন।”
“কেন?”
“ঘুম আসছে।”
“খাবার গরম করবে কে?”
“একটু আগেই তো বললেন খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“এখন করছে। যা, দ্রুত গিয়ে খাবার গরম কর।” বলেই উনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না। দ্রুত প্রস্থান করলাম। রান্নাঘরে গিয়ে খাবার গরম করার সময় তাজ ভাই এসে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। আমি ওনার দিকে এক নজর তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। উনি গলা ঝেড়ে বললেন,“আজ কিন্তু কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বলে আগলে রেখেছিলাম। এক্ষেত্রেও কি সুইডেন আর বাংলাদেশের তফাৎ মাপা হবে?“
আমি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে ওনার দিকে তাকালাম। বললাম,“আপনাকে কোনো কথা বলাই মহাপাপ। এক কথা নিয়ে সবসময় পড়ে থাকেন। পাজি লোক!”
উনি হাসলেন। তারপর আবার বললেন,“এই, তোকে না বলেছিলাম রান্না শিখতে? কোনোমতে রুটি বানানো শিখে আর কিছু শেখার নাম নেই। কাল থেকে যখন সময় পাবি টুকটাক রান্না শিখবি।”
“পারব না। আমি রান্না শিখে কী করব? সার্ভেন্ট আছে কী করতে?”
“ঐ যে বললাম, বিয়ের পর কাজ না জানলে শ্বাশুড়ি চুল ছিঁড়ে ফেলবে।”
“আপনাকে বলেছে?”
“এসব আমার জানা আছে। তোর মতো অকর্মা মেয়ের কপালে দজ্জাল শ্বাশুড়িই জুটবে।”
“আপনি কীভাবে শিওর হলেন যে আমি বিয়ে করব?”
“আমার মামুর অন্ন ধ্বংস করার সুযোগ দিব ভেবেছিস?”
“আমার বাবা হয় সে। আমাকে ভাগিয়ে দিয়ে আপনার আমিরাকে এ বাড়িতে তোলার প্ল্যান করছেন না কি?” বলতে বলতে খাবার নিয়ে ওনাকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। উনি আমার পেছন পেছন আসতে আসতে বললেন,“কী বললি? আবার বল।”
“কানে সমস্যা হলে ডক্টরের কাছে যান।”
“এই পিচ্চি, ভালো কথা মনে করেছিস। আমিরা আর আফরার মধ্যে কাকে বিয়ে করা উচিত বলতো?”
আমি প্লেটে খাবার তুলতে তুলতে বললাম,“দুজনকেই করুন। ডানে এক বউ থাকবে, আর বায়ে এক বউ। মাঝখানে আপনি দুই বউয়ের যত্ন-আত্তি পেয়ে আকাশে উড়বেন।”
উনি চেয়ার টেনে বসে বললেন,“মাথামোটা কি তোকে এমনি-এমনি বলি?”
আমি ওনার দিকে প্লেট এগিয়ে দিয়ে ওনার পাশের চেয়ারে বসে পড়লাম। ওনার হাতের কথা মনে পড়তেই বললাম,“আপনি খাবেন কীভাবে?”
উনি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন,“চামচ দে।”
আমি ওনার দিকে একটা চামচ এগিয়ে দিলাম। ওনার হাতের যা অবস্থা তাতে আজ আর আমাকে খাইয়ে দিতে পারবেন না। নিজের প্লেটটা টেনে নিয়ে আমি খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। উনি চেষ্টা করেও ডান হাতে খেতে পারলেন না। বাঁ হাতে চামচ নিতেই আমি আমতা-আমতা করে বললাম,“আমি খাইয়ে দিই? আমি যখন অসুস্থ ছিলাম, তখন তো আপনিও খাইয়ে দিয়েছিলেন। তাই আর কী।”
উনি আমার দিকে তাকিয়ে চামচ রেখে দিলেন। অর্থাৎ সম্মতি আছে। আমি ওনার প্লেটটা কাছে টেনে এনে ভাত মেখে ইতস্তত করে ওনার মুখের সামনে তুলে ধরলাম। উনি বললেন,“আগে নিজে খান, তারপর অন্যকে খাওয়াবেন।”
আমি বললাম,“আমার খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত আপনি বসে থাকবেন?”
“আপনাকে খাওয়ানোর সময় আমি না খেয়ে বসে থাকি?”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। রাত অনেক হয়েছে, ঘুমও আসছে। চুপচাপ ওনার প্লেট থেকেই নিজেও খেলাম ওনাকেও খাইয়ে দিলাম। অস্বস্তি বোধ করলেও তা পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করলাম। খাওয়া শেষ করে বাটি আর প্লেট নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। সেগুলো পরিষ্কার করে এসে দেখলাম তাজ ভাই এখনও বসে আছেন। আমি প্রশ্ন করলাম,“এখনও বসে আছেন কেন? ঘুমাবেন না?“
“হুম। যা গিয়ে শুয়ে পড়।” বলে উনি উঠে রুমের দিকে হাঁটা দিলেন। আমি পেছন থেকে বলে উঠলাম,“যে কাজে নিজের শরীরে আঘাত পান, তা ছেড়ে দিলে কী হয়?”
তাজ ভাই দাঁড়ালেন না। যেতে যেতেই বললেন,“ছেড়ে দিলেই মনের আঘাত সারবে?”
আমি অবাক হয়ে ওনার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মাফিয়ার সাথে মনের আঘাতের কী সম্পর্ক বুঝে উঠতে পারলাম না। তবু এটা নিয়ে বেশি ভাবতে পারলাম না। ঘুমে দুচোখ বুজে আসছে।
•
আবার শুরু হয়েছে আমার চা বানানো। সকাল সকাল মহারাজ আমাকে ঠেলে রান্নাঘরে পাঠিয়েছেন চা খাবেন বলে। আমি রান্নাঘরে ঢুকে দেখলাম আফরা আপু চা বানাচ্ছে। আমি বেশ খুশিই হলাম। হাসিমুখে বললাম,“কখন উঠেছ আপু?”
আপু উত্তর দিলো না। তার মুখটা কেমন যেন গম্ভীর দেখাচ্ছে। আমি তার মনোভাব বুঝার চেষ্টা করে আবার বললাম,“তোমার কি শরীর খারাপ? তাহলে রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”
আপু শক্ত মুখে বলল,“আমার শরীরের ভালো-খারাপ আমি নিজেই সামলাতে পারি। অন্য কাউকে প্রয়োজন হয় না।”
কথাটা যে আমাকে খোঁচা মেরে বলা হয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। গত রাতের ঘটনাটা হয়তো আপু ভালোভাবে নিতে পারেনি। কিন্তু তাতে তো খারাপ কিছু ছিল না। আপু দুই কাপ চা নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি এগিয়ে গিয়ে দেখলাম আপু দুই কাপের বেশি চা করেনি। কী আর করা? আমি নিজেই চা বসালাম। দু কাপ চা করে এক কাপ টেবিলে রেখে আরেক কাপ নিয়ে বাবার রুমে চললাম। বাবাকে চা দিয়ে টেবিলের কাছে আসতেই আমি অবাক হলাম। টেবিলে চায়ের কাপ নেই। একটু আগে আমি নিজে টেবিলের ওপর রেখে গেলাম। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে উধাও হলো কীভাবে! রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখলাম মিতা-রিতা এসেছে। মারজিয়া খালা আসেনি এখনও। হয়তো মিতা বা রিতা সরিয়ে নিয়েছে ঠান্ডা হয়ে যাবে ভেবে। আমি রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম,“আমি টেবিলে চা রেখে গিয়েছিলাম। সরিয়েছে কে?”
মিতা বলল,“ভাইয়াকে নিতে দেখেছি।”
আমি অবাক হয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলাম,“কখন?”
“মাত্রই দেখলাম টেবিল থেকে চায়ের কাপ নিয়ে ড্রয়িং রুমে যেতে।”
আমি ড্রয়িং রুমে ছুট লাগালাম। গিয়ে দেখলাম জাহাপনা পায়ের ওপর পা তুলে চা পান করছেন আর আরামসে টিভি দেখছেন। আমি ওনার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কোমরে হাত রেখে বললাম,“আমার চা চুরি করেছেন কেন?”
তাজ ভাই চোখ দুটো সরু করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“তোর চা? কই? চায়ে তো তোর নাম লেখা দেখছি না। কাপের কোথাও-ও না।”
বলতে-বলতে উনি চায়ের কাপটা পর্যবেক্ষণ করলেন। আমি বললাম,“চা-টা আমি নিজে বানিয়েছি। আপনি নিলেন কেন? একবার না খেয়েছেন? আবার খাওয়ার কী হলো?”
“কখন খেলাম?”
“একটু আগেই তো আফরা আপু আপনার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে গেল।”
“ও।” বলেই আবার উনি টিভিতে মনোযোগ দিলেন। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,“আপনার আবার চা খেতে ইচ্ছে হলে আফরা আপুকে বলতে পারলেন না? না বলে আমারটা নিয়েছেন কেন? চোর কোথাকার!”
“ভুলে যাচ্ছিস তুই আমার এসিস্ট্যান্ট?”
আবার শুরু হয়ে গেছে আজাইরা বকবক। এখানে দাঁড়িয়ে ওনার বকবক শোনার থেকে রুমে বসে ঝিমানো ঢের ভালো। উলটো দিক ঘুরে সামনে পা বাড়াতেই আফরা আপুর সামনে পড়লাম। আফরা আপু আমার পাশ কাটিয়ে তাজ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গেল। তাই আমিও আর দাঁড়ালাম না। কিন্তু আফরা আপুর কথা শুনে পুনরায় অবাক হলাম। ড্রয়িং রুম থেকে বেরোনোর সময় আমার কানে এল আফরা আপুর বিস্মিত কন্ঠের একটা কথা। সে বলল,“এ কী ভাইয়া! আপনি না বললেন চা খেতে ইচ্ছে করছে না? আপনি খাবেন না বলায় আমি তো দুই কাপ চা একাই খেয়েছি। তাহলে এখন খাচ্ছেন যে!”
তাজ ভাই স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন,“মাথা ধরেছে।”
ব্যাস, নিসঙ্কোচে একটা মিথ্যা বলে ফেললেন। আরেকজন কষ্ট করে চা বানাল তার জন্য, তা খেতে ইচ্ছে করেনি। অথচ আমারটা চুরি করে খেতে খুব ভালো লেগেছে। এই লোকের ভালো হওয়ার আর বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। এসব আবোল-তাবোল ভাবনা মাথায় চেপে আমি সোজা রুমে চলে এলাম।
আজ ভার্সিটিতে যাওয়া হবে না। তাজ ভাই না কি আজ বিকালের আগে বাইরে বেরোবেন না। বাড়িতে বসে ল্যাপটপ আর একগাদা কাগজপত্র নিয়ে কীসব কাজ করছেন। মনে সাহস জুগিয়ে আমি বারবার বলেছি একটা টেক্সি ডেকে দিতে। কিন্তু না, ওনার সাফ-সাফ কথা, উনি ছাড়া আর কারো সাথে বাইরে বেরোতে পারব না। এক কথায় আমার ওপর মহারাজের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। বাবা অনেক আগেই অফিসে চলে গেছে। নইলে বাবার সাথেই যেতে পারতাম। আফরা আপুও ভার্সিটিতে চলে গেছে। এদিকে আমি অসহায়, অবলা প্রাণীর মতো হাত-পা গুটিয়ে মহারাজের পাশে বই নিয়ে বসে আছি। ভেবেছিলাম ভার্সিটিতে না গেলে বসে বসে টিভি দেখব। আমার ভাবনার গলায় ধারালো ছুরি চালিয়ে, শয়তানটা আমাকে ধরে এনে নিজের পাশে বই নিয়ে বসিয়ে রেখেছেন। উঠতে চাইলেই ধমকে উঠে বলছেন,“হয় পড়তে হবে, নয় আজকে দুপুরের সব খাবার রান্না করতে হবে।” বেছে বেছে দুটো বিরক্তিকর কাজই জুটিয়ে দিয়েছেন। আমি গাল ফুলিয়ে একবার বইয়ের দিকে তাকাচ্ছি, আরেকবার ওনার দিকে। লোকটা আমার ফোনটাও নিজের কাছে আটকে রেখেছে। অথচ নিজে তখন থেকে ল্যাপটপ ঘেঁটে চলেছেন। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ কানে আসতেই আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,“কে যেন এসেছে। যাই দরজা খুলে দিয়ে আসি।”
উনি কপাল কুঁচকে বললেন,“বাড়িতে তিনজন সার্ভেন্ট আছে।”
আমি গাল ফুলিয়ে আবার বসে পড়লাম। মিনিট দুয়েক পরই দরজা ঠেলে ভেতরে এলেন শ্রেয়ান ভাইয়া। তাকে দেখে আমি বেশ খুশিই হলাম। এখন অন্তত গাল ফুলিয়ে বসে থাকতে হবে না। শ্রেয়ান ভাইয়া তাজ ভাইয়ের পাশে বসে সবসময়কার মতো একগাল হেসে আমাকে বললেন,“হাই ইলোমিলো, কী অবস্থা তোমার?”
আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“আপনাদের মাফিয়াদের পাল্লায় পাড়লে যেমন অবস্থা হয়।”
শ্রেয়ান ভাইয়া এবার শব্দ করে হেসে বললেন,“আমরা আবার কী করলাম?”
“এই যে, অসহায় প্রাণীর মতো হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসিয়ে রেখেছে।”
“আহারে! তাজ, তোর সত্যিই দয়ামায়া নেই।”
তাজ ভাই শ্রেয়ান ভাইয়ার কথায় কান না দিয়ে ল্যাপটপটা তার দিকে ঘুরিয়ে বললেন,“এই দেখ।”
শ্রেয়ান ভাইয়া মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে চোখ বুলালেন। আমি মাথা উঁচিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দূর থেকে কিছুই দেখতে পেলাম না। শ্রেয়ান ভাইয়া ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখেই প্রশ্ন করলেন,“কখনকার কনভারসেশন?”
তাজ ভাই উত্তর দিলেন,“কিছুক্ষণ আগের। কী মনে হচ্ছে তোর?”
শ্রেয়ান ভাইয়া কপালে ভাঁজ ফেলে মাথা দুলিয়ে বললেন,“বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। আশা করি কাজে আসবে।”
তাজ ভাইও মাথা দোলালেন। আমি গালে হাত দিয়ে বললাম,“সামনে আস্ত দুটো মাফিয়া বসে আলোচনায় ব্যস্ত। আর আমি একজন পুলিশ অফিসারের নাম্বারের অভাবে খবর দিতে পারছি না।”
শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বললেন,“আহারে! পুলিশ অফিসারের নাম্বার লাগবে তোমার? কিন্তু শেষে যদি, অফিসার তোমার প্রেমে পড়ে যায়?”
“আমি প্রেম করতে না, আপনাদের ধরিয়ে দিতে ফোন করব।”
তাজ ভাই বললেন,“তালগাছ থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙে যাবজ্জীবন পঙ্গু হয়ে জীবন কাটাবে, তবু কেউ তোর প্রেমে পড়বে না রে পিচ্চি।”
শ্রেয়ান ভাইয়া আবার হা হা করে হেসে উঠলেন। আমি কপাল কুঁচকে বললাম,“আর আপনার প্রেমে ঐ আমিরার মতো গায়ে পড়া মেয়েরাই পড়বে। ওহ্ হো! প্রেমে কী পড়বে? সে তো এখন আপনার হবু বউ।”
শ্রেয়ান ভাইয়া গলা ঝেড়ে বললেন,“বিয়েটা তো হোক। হলে আমার নাম পালটে শ্রেয়ান থেকে সারেং রাখব।”
এবার আমিও হেসে উঠলাম। কথায় কথায় শ্রেয়ান ভাইয়া হঠাৎ বলে উঠলেন,“এই ইলোমিলো, তুমি বলেছিলে না আমার বাইকে উঠবে? আজ তো দুপুর পর্যন্ত আমি ফ্রি আছি। বাইকও সাথে নিয়ে এসেছি। ঘুরতে যাবে?”
আমি আনন্দে গদগদ হয়ে ‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। আড়চোখে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। শয়তানটা আগে থেকেই সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি মিইয়ে গেলাম। এর আগে দু-দুবার শ্রেয়ান ভাইয়ার জন্য বকা শুনেছি। আজ ঘুরতে গেলে যে তৃতীয়বারের মতো আবার বকা শুনতে হবে, দৃষ্টিতেই তার পূর্বাভাস পেয়ে গেলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া আমার নিরবতা দেখে আবার প্রশ্ন করলেন,“যাবে না?”
আমি আমতা-আমতা করে বললাম,“না ভাইয়া। আসলে, আমার এখন বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না।”
শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো উনি আমার থেকে এমন উত্তর আশা করেননি। তবু মেকি হেসে বললেন,“ঠিক আছে। আজ তাহলে থাক। অন্য একদিন যেয়ো।”
চলবে…………………..?
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রেসপন্স করার অনুরোধ রইল। হ্যাপি রিডিং।?)