#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব: ২৫
সায়মা আপুর গায়ে হলুদে সবাই হলুদ শাড়ি পরবে। শাড়ি পরা ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগে। ভালো লাগা থেকেই আমি এই পর্যন্ত অনেক শাড়ি কিনেছি। কিন্তু সেগুলো পরা আর হয়ে ওঠে না। হলুদে যে মেয়েরা শাড়ি পরবে, এই ধারণা আমার ছিল। কিন্তু কেন জানি আমার শাড়ি পরতে ইচ্ছে হয়নি, তাই আনিয়োনি। হলুদে পরার জন্য হলুদ আর লাল রঙের মিশেল একটা থ্রি-পিস এনেছি। থ্রি-পিসটা পরে, চুলগুলো বেঁধে, ঠোঁটে হালকা একটু লিপস্টিক আর কানে দুল পরে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। বাড়ির সামনের ফাঁকা উঠোনে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। আজ সারাদিন ধরে পুরো বাড়ি ডেকোরেশন চলেছে। বাড়ি এখন মানুষজনে ভর্তি। এত মানুষের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনকেই আমি চিনি। সর্বপ্রথম পড়লাম শ্রেয়ান ভাইয়ার সামনে। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে দেখে আগাগোড়া নিরীক্ষণ করে বললেন,“আজ তো সবাই হলুদ শাড়ি পরেছে। তুমি পরোনি কেন ইলোমিলো?”
আমি বললাম,“আমার ইচ্ছে করছে না ভাইয়া।”
“কেন?”
“এমনিতেই।”
“ওহ্! যাক, তোমাকে এই সাজেও কিন্তু কম সুন্দর লাগছে না।”
আমি মৃদু হাসলাম। শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে বাড়ির সামনের উঠোনে চললাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম বাড়ির মেয়েরা সবাই হলুদ শাড়ি আর ভারী মেকআপ করে সেলফিতে মগ্ন। আমি সেখানে যেতেই সবাই শ্রেয়ান ভাইয়ার মতো একই প্রশ্ন করল, আমি শাড়ি পারিনি কেন? আমি সবাইকেই উত্তর দিলাম, আমার ইচ্ছে করছে না তাই পারিনি। তাজ ভাই তার কাজিনদের সাথে হলুদের স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। শ্রেয়ান ভাইয়াও সেখানে চলে গেছেন। তাজ ভাইয়ের সাথে আমার শুধু একবার চোখাচোখি হলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। গতকালের ট্রুথ অর ডেয়ার খেলার পর থেকে আমি ওনার থেকে ইচ্ছে করেই দূরে দূরে থাকছি। বিয়ে বাড়ি বলে উনিও খুব একটা জ্বালাচ্ছেন না। কিন্তু যতবারই চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে ততবারই ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছি। ভুলে যেতে চাইলেও বারবার ঐ কথাটাই মস্তিষ্কে কড়া নাড়ে,‘আই রিয়েলি লাভ ইউ মাই ড্রিম গার্ল। উইল ইউ ম্যারি মি?’ আমি জানি এটা নিছকই একটা খেলা ছিল। কিন্তু কেন জানি আমার মন এটাকে শুধুই খেলা ভাবতে পারছে না। মনে হচ্ছে খেলার ছলেই মনের অপ্রকাশিত কথা প্রকাশ করা হয়েছে। মনে হবে না-ই বা কেন? এতদিনে আমি এটুকু তো নিশ্চিত হয়েছি যে আমাকে নিয়ে ওনার মনে কিছু অনুভূতি আছে। কিন্তু উনি তা প্রকাশ করছেন না কেন এটাই আমার বড়ো প্রশ্ন। সায়মা আপুকে এখনও পার্লারের মেয়েরা সাজাচ্ছে। তাকে স্টেজে আনা হয়নি বলে যে যার মতো ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমার বিরক্তি এসে গেলেও চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। অপরিচিত জায়গায় এলে যা হয় আরকি। ফোনটা বের করতেই পাশ থেকে কেউ বলে উঠল,“হাই কিউটি।”
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম জুম্মান ভাইয়া হাসিমুখে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তার গলায় ডিএসএলআর ঝুলানো। আমি তাকাতেই উনি আবার বললেন,“একা একা দাঁড়িয়ে আছো যে? সবার সাথে এনজয় করো।”
“সবাই তো ব্যস্ত।”
“সবাই সাজগোজ করেছে, ছবি তো তুলতেই হয়। ছবি তুলতে ভালো লাগে না তোমার?”
“যখন-তখন ভালো লাগে না।”
জুম্মান ভাইয়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,“তাহলে আমি তুলছি, তুমি সুন্দর করে দাঁড়াও তো।”
আমি ইতস্তত করে বললাম,“না ভাইয়া, দরকার নেই।”
“আমার দরকার আছে। একটু হাসো তো।”
জুম্মান ভাইয়ার জোরাজুরিতে আমি ছবি তুলতে রাজি হলাম। কিন্তু যখনই ছবি তোলার জন্য সুন্দর করে দাঁড়িয়ে একটু হাসতে যাব তখনই কোত্থেকে অর্নি ভাবি এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,“আরে ইলোরা, তোমার শাড়ি কোথায়?”
জুম্মান ভাইয়া বিরক্তি নিয়ে বলল,“ভাবি, দিলে তো ছবির বারোটা বাজিয়ে?”
অর্নি ভাবি একবার জুম্মান ভাইয়া আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“ওহ্! তুমি যে ছবি তুলছিলে তা তো খেয়াল করিনি ভাই। আচ্ছা ছবি পরে তোলা যাবে। এই ইলোরা, তুমি শাড়ি পরোনি কেন?”
আমি বললাম,“আমার ইচ্ছে করছে না ভাবি।”
“ইচ্ছে করছে না মানে? সব মেয়েরা আজ শাড়ি পরেছে, আর তুমি থ্রি-পিস পরে ঘুরছো? দেখো আমিও তো শাড়ি পরেছি। চলো এখনই শাড়ি পরবে।”
“না ভাবি। সবাই তো পরেছে, আমি একা না পরলে কী হবে?”
“অনেক কিছু হবে। চলো তুমি, আমি হেল্প করছি তোমাকে।”
অর্নি ভাবি আমার হাত ধরে টানতে শুরু করলেন। আমি ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,“ভাবি, আমি আসলে হলুদে শাড়ি পরব না ভেবে শাড়ি আনিনি।”
“আরে এটা কোনো প্রবলেম হলো? আমার শাড়ি পরবে, চলো।”
আমি ইতস্তত করে বললাম,“থাক না ভাবি।”
ভাবি হার মানলেন না। উনি হয়তো পণ করেছেন আমাকে শাড়ি পরিয়েই ছাড়বেন। ভাবির সাথে জুম্মান ভাইয়াও এবার বলতে শুরু করলেন,“যাও ইলোরা, না কোরো না আর। সবাই যেহেতু পরেছে, মাঝখান থেকে তুমি কেন বাদ যাবে?”
শেষমেষ আমি হার মেনে নিয়ে ভাবির সাথে তার রুমে এলাম। ভাবি তার লাগেজ থেকে হলুদের মধ্যে সাদা সংমিশ্রণে জর্জেট একটা শাড়ি বের করলেন। তার একটা ব্লাউজ আর পেটিকোট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন পরে নিতে। বাধ্য হয়েই আমি ওয়াশরুমে গিয়ে ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে এলাম। ভাবির ব্লাউজ আমার পরনে কিছুটা ঢিলেঢালা হলেও তেমন অসুবিধা হয়নি। যদিও আমি নিজে শাড়ি পরতে পারি, কিন্তু তাড়াতাড়ি করার জন্য ভাবি নিজেই আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। দ্রুত শাড়ি পরিয়ে দিয়ে তার থেকে কিছু গহনা আর মেকআপ বের করে আমাকে সাজাতে বসালেন। আমি মেকআপ করতে রাজি হলাম না, তাই ভাবিও জোর করলেন না। আমার চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে একপাশে ছেড়ে দিলেন। গহনা হাতে নিতেই মিনহা আপু রুমে এল। সে এসেই ব্যস্ত হয়ে বলল,“ভাবি, ওদিকে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। তোমাকে সবাই খুঁজছে। ইলোরাকে সাজানো হয়নি এখনও?”
অর্নি ভাবি বললেন,“এইতো হয়ে গেছে। ইলোরা, তুমি গহনাগুলো পরে চলে এসো।”
অর্নি ভাবি আমার হাতে গহনাগুলো ধরিয়ে দিলেন। আমি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালাম। অর্নি ভাবি মিনহা আপুর সাথে চলে গেলেন। আমি ঝটপট গহনা পরে নিলাম। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে বিধায় শাড়ির কুঁচি ধরে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। রুম থেকে বেরোতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তাজ ভাই আমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ওনাকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। উনি আমার দিকেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছেন। আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে পাশ কেটে চলে যেতে নিতেই উনি পেছন থেকে খপ করে আমার ডান হাতটা মুঠোবন্দী করলেন। হাতে টান পড়তেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। পেছন ফিরে না তাকিয়েই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে ঢোক গিললাম। কিন্তু ওনার মুঠো থেকে হাত ছাড়ানোর মতো শক্তি আমার হয়ে ওঠেনি। আমি বলতে চাইলাম, হাত ছাড়ুন। কিন্তু কেন জানি গলা দিয়ে শব্দ বের হলো না। একটু পানি হলে ভালো হত। গলাটা একটু ভিজিয়ে নেয়া দরকার। উনি আমাকে আবার হেঁচকা টানে নিজের দিকে ঘুরালেন। আমি ওনার দিকে তাকালাম না। মাথা নিচু করে অপর হাত দিয়ে ওনার মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে চললাম। না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারলাম উনি এখনও একইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ উনি এক হাত এগিয়ে এনে আমার বাঁ পাশে ছড়িয়ে থাকা চুলে হাত রাখলেন। আমি চকিত চাহনিতে ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার থমকালাম। উনি আমার চুলগুলো ঠেলে পিঠে ছড়িয়ে দেওয়ার সময় গলায় ওনার হাতের স্পর্শে আমি কেঁপে উঠলাম। সাহস জুগিয়ে কাঁপা গলায় আমতা-আমতা করে বললাম,“হাত ছাড়ুন।”
উনি ততক্ষণে আমার চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে কিছুটা নিচু স্বরে বললেন,“কেন? অস্বস্তি লাগছে? অন্য ছেলেদের সামনে স্টাইল করে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সময় অস্বস্তি লাগেনি?”
আমি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে ফেললাম। কোন কথার সাথে কোন কথার খিচুড়ি পাকায় লোকটা! তাছাড়া আমি তো ছবি তুলিনি। তার আগেই অর্না ভাবি শাড়ি পরাতে নিয়ে এসেছেন। আমি বললাম,“আমি ছবি তুলিনি।”
“জুম্মান জোর করছিল, তাই না? তুই নিষেধ করার পরও ও জোর করল কীভাবে?”
আমি আবার হাত মোচড়াতে মোচড়াতে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,“এত কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি। হাত ছাড়ুন। লজ্জা-শরম নেই আপনার?”
উনি আমার হাত তো ছাড়লেনই না, উলটো আমার কথা শুনে হাতের বন্ধন শক্ত করলেন। এবার আমি হাতে একটু ব্যথা পেয়ে মুখটা কালো করে ফেললাম। উনি আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে শাসনের সুরে বললেন,“মামু বলেছিল না আমার সাথে সাথে থাকতে? আর তুই কী করছিস? সারাদিনে তোর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি পেকে গেছিস? এখন থেকে আমার পাশ থেকে এক পা নড়লে একদম শুট করে দিব।”
আবার গান! বিপজ্জনক লোকটা এই এক ব্ল্যাকমেইল করে করে আমার জীবনটা তেজপাতা বানিয়ে দিলো। তবু তো জীবনের মায়া আমারও আছে। আমি গানের কথা শুনে চুপ মেরে গেলাম। তাজ ভাই আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে উলটো দিক ঘুরে সামনে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন,“চল।”
অগত্যা আমি মনে মনে ওনাকে হাজারটা বকা দিতে দিতে ওনার পেছন পেছন হাঁটা দিলাম। হলুদের স্টেজের দিকে যেতেই কোত্থেকে জুম্মান ভাইয়া এসে উপস্থিত। আমার সামনে দাঁড়িয়ে উনি অবাক হয়ে বললেন,“ওয়াও ইলোরা! তোমাকে তো শাড়িতে দারুণ মানিয়েছে। এবার খুব সুন্দর ছবি আসবে। চলো, সুন্দর করে দাঁড়াও তো।”
জুম্মান ভাইয়া আমার দিকে ডিএসএলআর তাক করতেই আমি আড়চোখে পাশে দাঁড়ানো যমরাজের দিকে তাকালাম। উনি চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে জুম্মান ভাইয়াকে বললাম,“ভাইয়া, আমার এখন ছবি তুলতে ইচ্ছে করছে না। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।”
জুম্মান ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো উনি আমার কথায় অসন্তুষ্ট হলেন। উনি ফের কোনো প্রশ্ন করার আগেই আমি স্টেজের পাশে মেয়েদের কাছে চলে গেলাম। সবাই আমার সৌন্দর্যের বেশ প্রশংসা করলেও আমিরা আপু মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি সায়মা আপুকে হলুদ ছুঁইয়ে স্টেজ থেকে নেমে আসতেই শ্রেয়ান ভাইয়া আমাকে ডাকলেন। তার পাশে তাজ ভাই, আদনান ভাইয়া আর নাসের ভাইয়াও আছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বললেন,“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে ইলোমিলো।”
বিনিময়ে আমিও একটু হেসে বললাম,“ধন্যবাদ ভাইয়া।”
পেছন থেকে হঠাৎ কেউ একজন বলে উঠল,“আমাকে কেমন লাগছে তা তো কেউ বলল না।”
আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম আমিরা আপু হেলেদুলে এগিয়ে আসছে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে সে বেশ আকর্ষণীয়ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে বলল,“তাজ ভাইয়া, আমাকে কেমন লাগছে বললেন না তো?”
তাজ ভাই মিষ্টি হেসে বললেন,“ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। মুখের ওপরের আবর্জনাগুলো আগে পরিষ্কার করে আয়, তাহলে হয়তো বলতে পারব।”
আমিরা আপুর মুখটা চুপসে গেল। বাকিরা সবাই মুখ টিপে হাসছেন। আমিরা আপু কপট অহংকার নিয়ে বলল,“ফাজলামি করছেন কেন ভাইয়া? কী জানেন? সবাই আবার সব কিছুতে অভ্যস্ত হয় না। অনেক মেয়েরা তো ক্ষ্যাতের মতো মেকআপ করতেই জানে না। নিজেকে নেচারাল বুঝাতে প্রোগ্রামেও মেকআপ ছাড়া আসে।”
কথাটা যে আমাকে খোঁচা মেরে বলা হয়েছে তা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হলো না। আদনান ভাইয়া হেসে বললেন,“যারা সত্যিকারের সুন্দর তাদের তোর মতো কয়েক কেজি আটা, ময়দা, সুজি মাখাতে হয় না। এসব আস্তরণ ধুয়ে আয়, নইলে পঁচা দুর্গন্ধ ছড়াবে।”
আদনান ভাইয়ার কথাটা আমিরা আপুর গায়ে লাগল। কিন্তু বড়ো ভাই বলে মুখ বুজে সহ্য করতে হলো বেচারিকে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে আমার দিকে এক পলক অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করেই ধুপধাপ পা ফেলে প্রস্থান করল। সঙ্গে সঙ্গে আদনান ভাইয়া শব্দ করে হেসে উঠলেন।
সবাই সবাইকে হলুদ লাগাচ্ছে, আমিও ছাড় পাইনি। অথচ তাজ ভাইয়ের পাশে হলুদ নিয়ে গেলেই উনি একেকজনকে ধমকে সরিয়ে দিচ্ছেন। শেষে এই নিয়ে বাজি ধরা হলো। জায়েদ ভাইয়া ঘোষণা দিলেন তাজ ভাইকে যে হলুদ ছোঁয়াতে পারবে তাকে পাঁচ হাজার টাকা পুরষ্কার দেওয়া হবে। ঘোষণা শুনে সবাই তাজ ভাইয়ের পেছনে উঠেপড়ে লেগে পড়ল। কিন্তু কেউই হলুদ ছোঁয়াতে সক্ষম হলো না। মাহিন ভাইয়া আর আফনান ভাইয়া এই নিয়ে মেয়েদের ‘হেরো’ বলে খেপিয়ে চলেছেন। এভাবে চলতে চলতে একসময় তাজ ভাই রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। সবাই দরজা ধাক্কাধাক্কি করে শেষমেষ হাল ছেড়ে দিলে অর্নি ভাবি আমার পাশে এসে ফিসফিস করে বললেন,“এই ইলোরা, তুমি চেষ্টা করছো না কেন?”
আমি মেকি হেসে বললাম,“ওনার গগন কাঁপানো ধমক শোনার শখ নেই আমার।”
“আরে একবার চেষ্টা করে দেখই না। আমার মনে হয় তুমি পারবে।”
“নাহ্।”
“পাঁচ হাজার টাকা পাবে।”
“তার থেকে আমার জীবনের মূল্য বহুগুণ বেশি।”
অর্নি ভাবি হাসতে হাসতে আমাকে ঠেলেঠুলে তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে নিয়ে গেলেন। আমি তাকে আটকাতে পারলাম না। তাজ ভাইয়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অর্নি ভাবি বললেন,“ডাকো তাড়াতাড়ি।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম,“না ভাবি। আমার টাকা লাগবে না।”
অর্নি ভাবি নিজেই দরজায় টোকা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে তাজ ভাই কড়া গলায় বললেন,“আর একবার দরজা ধাক্কলে সবকটাকে হলুদ গুলিয়ে খাওয়াব।”
অর্নি ভাবি মুখ টিপে হেসে উঁচু গলায় বললেন,“সে না হয় পরে দেখা যাবে। আগে দরজা খোলো। দেখি মহারানিকে হলুদ গোলা কীভাবে খাওয়াও।”
এক মিনিটের মাথায় দরজা খুলে গেল, কিন্তু তাজ ভাইকে দেখলাম না। সঙ্গে সঙ্গে অর্নি ভাবি তার হাতের হলুদের বাটিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঠেলে রুমের ভেতর পাঠিয়ে দিলেন। আমি গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম। নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সামনে জলজ্যান্ত শয়তানকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি ঢোক গিললাম। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মেকি হেসে বললাম,“আমি আসতে চাইনি। ঐ, ভাবি আমাকে জোর করে পাঠিয়েছেন। এখনই চলে যাচ্ছি।”
আমি ঘুরে দাঁড়াতেই উনি চোখের পলকে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে ফেললেন। আমি চোখ বড়ো বড়ো করে চকিত চাহনিতে তাকাতেই উনি বাঁকা হেসে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। ওনাকে এগোতে দেখেই আমি দ্রুত পিছিয়ে যেতে যেতে ভীতু কন্ঠে বললাম,“দরজা বন্ধ করলেন কেন? বলছি তো আমি ইচ্ছে করে আসিনি। হলুদ লাগাব না আপনাকে। সত্যি বলছি। যেতে দিন না আমাকে।”
উনি আমার কথায় কান না দিয়ে আমার কাছাকাছি চলে এলেন। আমি পিছিয়ে যেতে যেতে দেয়ালের সাথে ধাক্কা লাগতে যেতেই তাজ ভাই দ্রুত এগিয়ে এসে আমার মাথার পেছনের দেয়ালে হাত রাখলেন। আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকলেও মাথাটা ওনার হাতে ঠেকল। ফলস্বরূপ মাথাটা একটা বড়োসড়ো ধাক্কা থেকে বেঁচে গেল। তাজ ভাইকে এতটা কাছে দেখে মুহূর্তে আমার গলাটা শুকিয়ে গেল। এই লোকের থেকে আমি যতই দূরে থাকতে চাই ততই কাছে চলে আসে। হঠাৎ করে আমার হাত-পায়ে কম্পন ধরে গেল। সাথে আমার হাতের হলুদের বাটিটাও পড়ে যাওয়ার জোগাড় হলো। তাজ ভাই ধমকের সুরে বললেন,“একশ বছরের বুড়ির মতো কাঁপছিস কেন? হলুদ লাগাবি না?”
আমি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম,“না। আমি বাইরে যাব।”
“যে কারনে এসেছিস আগে তা করে নে।”
“আমাকে জোর করে পাঠিয়েছে।”
তাজ ভাই সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার হাতের হলুদের বাটি থেকে অনেকটা হলুদ হাতে নিয়ে আমার বাঁ গালে মাখিয়ে দিলেন। আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললাম। পরক্ষণেই গালে কিছুর খোঁচা খেয়ে ফট করে চোখ খুলতেই আমার চোখ চড়কগাছ। তাজ ভাই ততক্ষণে আমার গালের হলুদ নিজের গালে নিয়ে নিয়েছেন। ফলস্বরূপ আমার গালে ওনার খোঁচা খোঁচা দাড়ির গুঁতো খেয়ে গালটা জ্বলে গেল। আমি এতটাই চমকে উঠলাম যে আমার হাতের বাটিটা স্বশব্দে মেঝেতে পড়ে গেল। তাজ ভাই তখন আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসছেন। ওনার এই ছোঁয়াটা আমি ঠিক নিতে পারলাম না। রাগে-দুঃখে দুহাতে ওনাকে জোরেশোরে এক ধাক্কা মারলাম। হঠাৎ এমন ধাক্কা খাওয়ায় উনি কিছুটা পিছিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিলেন। কিন্তু আমি আর ওনার দিকে ফিরেও তাকালাম না। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই সামনে পুরো গ্যাং সামনে পড়ল। তাজ ভাইয়ের দরজার সামনে জায়েদ ভাইয়া, অর্নি ভাবি, আদনান ভাইয়া, আফনান ভাইয়া, মাহিন ভাইয়া, জুম্মান ভাইয়া, শ্রেয়ান ভাইয়া, নাসের ভাইয়া, মিনহা আপু, আমিরা আপু আরও কয়েকজন বেশ আগ্রহী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তাদের দেখে একটু থমকে গেলেও পরক্ষণেই আবার ছুটে সেখান থেকে চলে এলাম। আমার জন্য বরাদ্দকৃত রুমটায় এসেই দরজা লাগালাম। হঠাৎ হঠাৎ ওনার এই ছুঁয়ে দেয়ার ব্যাপারটা আমাকে বিরক্ত করে তুলল। ওনার প্রতি ক্ষোভ থেকে চোখের কোণে পানিও জমে গেল। ধপ করে বিছানার কোণে জড়োসড়ো হয়ে সেই যে বসলাম, এরপর অনেকে এসে দরজা ধাক্কাধাক্কি করার পরও সাড়াশব্দ করলাম না। শেষে যখন তাজ ভাইয়ের বড়ো কাকা এসে ডাকলেন তখন আর বসে থাকতে পারলাম না। দরজা খুলতেই উনি খেতে যেতে বললেন। কিন্তু আমি বলে দিলাম আমার ক্ষুধা নেই। তবু কাকা কয়েকবার ডাকাডাকি করে চলে গেলেন। আমি গায়ের গহনাগুলো খুলে রেখে লাগেজ খুলে থ্রি-পিস বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। শাড়িটা চেঞ্জ করে ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই আবার রাগ উঠে গেল। বরাবরের মতোই তাজ ভাই আমার বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে ফোন চাপছেন। আমি ওনাকে দেখেও না দেখার ভান করে শাড়িটা নিয়ে বিছানায় রাখলাম। তাজ ভাই আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,“খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে আবার অসুস্থ হওয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছে?”
আমি গাল ফুলিয়ে বিছানার পাশ থেকে সরে দরজার দিকে হাঁটা দিলাম। তাজ ভাই দৌড়ে এসে আমার হাত টেনে ধরে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। আমি রাগত স্বরে বললাম,“সমস্যা কী আপনার? ছোঁয়া-ছুঁয়ির ব্যারামে পেয়েছে? এটা বাংলাদেশ, সুইডেন না যে মেয়েদের ছুঁয়ে দিলেও সেটা স্বাভাবিক বলে চালিয়ে দেওয়া হবে। সম্পর্কে আপনি আমার ফুপাতো ভাই। আমাকে ছোঁয়ার নূন্যতম অধিকারও আপনার নেই। দয়া করে দূরে থাকুন আমার থেকে। আমি আপনার ওপর সত্যিই বিরক্ত।”
কথাগুলো বলতে বলতে আমার চোখ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। উনি স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মিনিট দুয়েক চুপচাপ বসে
থেকে উনি উঠে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলেন। আমি চুপচাপ এক জায়গায় ঠাঁয় বসে রইলাম। মিনিট দুয়েক পর তাজ ভাই আবার এসে আমার সামনে বসলেন। এবার ওনার হাতে খাবারের প্লেট দেখলাম। এতক্ষণ বোধ হয় টেবিলে রাখা ছিল। উনি খাবার মাখিয়ে আমার মুখের সামনে তুলে ধরে নরম কন্ঠে বললেন,“হা কর। না খেয়ে থাকলে তোর শরীরের ক্ষতি হবে। ডক্টর কী বলেছে শুনিসনি? খাবারে অনিয়ম একদম চলবে না।”
আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। উনি আবার বললেন,“তুই অসুস্থ হলে মামু আমাকে কী ভাববে বল তো? ভববে আমি তোর খেয়াল রাখিনি। আচ্ছা আমি সরি। এবার হা কর।”
আমি থমথমে মুখে ওনার দিকে তাকালেও হা করলাম না। উনি এবার বাঁ হাতে নিজের এক কান ধরে অসহায় মুখে বললেন,“সরি বলছি তো। আমার ওপর রাগ করলেও খাবারের ওপর করিস না। খেয়ে নে প্লিজ। আমারও তো ক্ষুধা পেয়েছে। সেই কখন থেকে না খেয়ে আছি। হা কর।”
কেন জানি এবার আমি পালটা উত্তর দিতে পারলাম না। ফের রাগও দেখাতে পারলাম না। একবার বলতে চাইলাম যে আমি নিজের হাতে খাব। কিন্তু কন্ঠনালি বাঁধ সাধল। এমনটা কেন হচ্ছে? ওনার হাতে খাওয়াটা কি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাচ্ছে? হতেও পারে। কিন্তু আমি চাই না উনি আমার অভ্যাস হোক। অথচ এই প্রথম ওনার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মায়া হলো। অজানা কারণে রাগটাও হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। রোবটের মতো আমি ওনার কথামতো ওনার হাতেই খাবার খেতে লাগলাম।
চলবে………..…..….…….?