#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:২১
সন্ধ্যার পর একটু আয়েশ করার আশায় বিছানায় সটান শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু যমরাজের তো আর আমার আয়েশ সহ্য হয় না। সে এসে আমাকে টেনেহিঁচড়ে তুলে বই হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। তার মহান বাণী, এক্সামে ফেল করলে খবর আছে। এদিকে আমি বই হাতে নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুনগুনিয়ে পড়ে চলেছি। শয়তানটা আমার সামনেই ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে আছে, বিধায় নড়াচড়া করাও কষ্টকর। কোথায় ভেবেছিলাম গ্রাম থেকে এসেই ওনাকে একটু শিক্ষা দিব। অথচ হচ্ছে তার উলটোটা। গানের ভয়ে ওনাকে শিক্ষা দেয়ার প্ল্যানটা ফ্লপ হলো। অন্যকিছু ভাবতে হবে। দৃষ্টি বইয়ের দিকে থাকলেও আমার মাথায় চলছে অন্যকিছু। আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল তাজ ভাইয়ের ধমকে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে ধমকে উঠে বললেন,“গুনগুন করে মন্ত্র জপছিস? ঠিকমতো পড়।”
আমি চমকে উঠে নড়েচড়ে বসলাম। ঠোঁট উল্টে বললাম,“অনেক পড়েছি তো। আর ইচ্ছা করে না। ”
তাজ ভাই ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে ল্যাপটপে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন,“চা নিয়ে আয়।”
আমি অলস ভঙ্গিতে বললাম,“আমি?”
“তুই যে আমার এসিস্ট্যান্ট, এর মাঝেই ভুলে বসে আছিস? চুপচাপ গিয়ে চা কর।”
“খালাকে বলি?”
“ভালোয় ভালোয় কথা শোন।”
এই ঘাড়ত্যাড়া লোক যে আমাকে খাটিয়ে ছাড়বে তা স্পষ্ট। তাই কথা না বাড়িয়ে মুখ ফুলিয়ে চললাম চা করতে। দরজা পর্যন্ত যেতেই তাজ ভাই পিছু ডেকে বললেন,“শোন।”
আমি পেছন ফিরে তাকাতেই আবার বললেন,“এদিকে আয়।”
আমি প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওনার দিকে এগিয়ে গেলাম। বিছানার পাশে দাঁড়াতেই উনি আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলেন। তারপর নিজে বিছানা থেকে নেমে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। আমি ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছি। উনি হঠাৎ আমার মচকে যাওয়া পা-টা নিজের হাঁটুর ওপর রেখে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষণ করতে লাগলেন। আমি নড়েচড়ে উঠতেই উনি প্রশ্ন করলেন,“ব্যথা আছে এখনও?”
আমি ছোটো একটা শব্দ করলাম,“উঁহু।”
উনি আমার পায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে ছেড়ে দিলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,“যা।”
আমি চুপচাপ উঠে চলে গেলাম। রান্নাঘরের সামনে এসে দেখলাম মারজিয়া খালা চলে যাচ্ছেন। আমি চুপচাপ চা করতে লেগে পড়লাম। কাপে চা ঢালার সময় তাজ ভাই এসে উপস্থিত। পেছন থেকে বললেন,“এতক্ষণ লাগে চা করতে।”
আমি বিড়বিড় করে বললাম,“নিজে করে খেতে পারেন না? হুকুম জারি করায় পটু।”
কথাটা এতটা আস্তে বললাম যে ওনার কান অবধি পৌঁছল না। এক কাপ চা ওনার দিকে এগিয়ে ধরতেই উনি বললেন,“শ্রেয়ান এসেছে। ওর জন্যও নিয়ে আয়।”
উনি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি দুই কাপ চা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ড্রয়িংরুমে যেতেই শ্রেয়ান ভাইয়া একগাল হেসে বললেন,“সো সরি ইলোমিলো। ইম্পর্ট্যান্ট একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল তাই তোমাকে ফুসকা খাওয়ানো হলো না।”
আমি দুজনের হাতে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বললাম,“সমস্যা নেই ভাইয়া। অন্য একদিন খাব।”
“অন্য একদিন না। আজই চলো। এখন তো ফ্রী আছি।”
তাজ ভাই চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গিয়ে বললেন,“এখন?”
শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“হ্যাঁ। কেন? কোনো প্রবলেম আছে?”
সন্ধ্যাবেলা বাইরে থেকে ঘুরে আসার চান্সটা আমি কোনোভাবেই মিস করতে চাই না। তাই তাজ ভাই কিছু বলার আগেই আমি ফট করে বলে উঠলাম,“একদম না। কোনো সমস্যা নেই। আমি যাব।”
শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বললেন,“তাহলে রেডি হয়ে আসো। তিনজন মিলে খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি ফিরব।”
তাজ ভাই বললেন,“মামু আসার সময় হয়ে গেছে।”
আমি বললাম,“বাবাকে আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। আপনারা চা খান, আমি দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে আসছি।”
তাজ ভাই হয়তো আরও কিছু বলতেন। তাই ওনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে রুমে চলে এলাম। আমাকে রেডি হতে দেখে জেমি চোখ বড়ো করে মিয়াও মিয়াও গান শুরু করে দিলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,“ফুসকা খেতে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। তুই চুপচাপ ঘুমা।”
ও কী বুঝল কে জানে? ধপ করে শুয়ে পড়ল। আমি মৃদু শব্দ তুলে হেসে ফেললাম। যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বেরিয়ে এলাম। এরমধ্যে বাবাকেও ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি। আমি গিয়ে দেখলাম তাজ ভাইও রেডি, কিন্তু মুখ দেখে মনে হচ্ছে ওনার যাওয়ার ইচ্ছা নেই তবু যাচ্ছেন। আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম পায়ে হেঁটে। কারণ আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি সন্ধ্যাবেলা গাড়ি নেয়ার দরকার নেই। ফুটপাত ধরে হাঁটতে ভালো লাগবে। তাজ ভাই আপত্তি জানালেও শ্রেয়ান ভাইয়া থামিয়ে দিয়েছেন। হাঁটতে হাঁটতে শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে আমার অনেক কথা হলো। কিন্তু তাজ ভাই নিশ্চুপ ছিলেন। প্রায় বারো মিনিট হাঁটার পর একটা ফুসকার দোকানে ঢুকলাম। তাজ ভাই খাবেন না তাই শ্রেয়ান ভাইয়া দুই প্লেট ফুসকা অর্ডার করলেন। আমি আর শ্রেয়ান ভাইয়া দারুণ উল্লাসে ফুসকা খেলাম আর তাজ ভাই পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে ব্যস্ত ছিলেন। মাঝে মাঝে অবশ্য আমার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়েছেন। কিন্তু আমি সেদিকে তোয়াক্কা না করে শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে হাসি-গল্পে ফুসকা শেষ করেছি। আমার খাওয়া শেষ হওয়ার পর শ্রেয়ান ভাইয়া প্রশ্ন করলেন,“আরেক প্লেট খাবে?”
আমি কিছু বলার আগেই তাজ ভাই কড়া গলায় বললেন,“একদম না। এক প্লেট খেয়েছে তাতেই হবে। বেশি খেলে পরে শরীর খারাপ হবে।”
শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“ঠিক আছে। আর খেতে হবে না ইলোমিলো। আরেকদিন আবার খাব।”
আমি চুপসানো মুখে মাথা নাড়লাম। ফুসকার দোকান থেকে বেরিয়ে আমরা ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলাম। তাজ ভাই আর শ্রেয়ান ভাইয়ার মাঝখানে আমি হাঁটছি। আমি শ্রেয়ান ভাইয়ার সাথে গল্পে মেতে উঠেছি। কিন্তু তাজ ভাই প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলছেন না। সাধে কি আর বলি এই লোকের জন্মের পর ফুপি তার মুখে মধু দিতে ভুলে গেছে? শ্রেয়ান ভাইয়া হঠাৎ প্রশ্ন করলেন,“ইলোমিলো, আইসক্রিম খাবে?”
আমি দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম। শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“তাজ, চল আইসক্রিম খেয়ে আসি।”
তাজ ভাই বললেন,“আমি খাব না।”
“কিছুই খাবি না?”
“উঁহু।”
“আচ্ছা, তাহলে এমনিতেই চল।”
আইসক্রিম পার্লারটা রাস্তার বিপরীত পাশে। তাই রাস্তা পার হয়ে তবেই যেতে হবে। আমরা তিনজন রাস্তা পার হতে ঘুরে দাঁড়ালাম। তাজ ভাই আমার হাত ধরার জন্য নিজের হাতটা বাড়েতেই আমার অপর হাতটা শ্রেয়ান ভাইয়া ধরে ফেললেন। উনি অবশ্য তাজ ভাইকে খেয়াল করেননি। আমি তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি শান্ত দৃষ্টিতে শ্রেয়ান ভাইয়ার মুঠোয় বন্দি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছেন। শ্রেয়ান ভাইয়া তাড়া দিতেই আমি ওনার সাথে রাস্তা পার হলাম। তাজ ভাইও পেছন পেছন চলে এলেন। আমরা আইসক্রিম পার্লারে ঢুকলাম। শ্রেয়ান ভাইয়া পুরো এক বক্স আইসক্রিম কিনে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি সেখান থেকে একটা আইসক্রিম বের করে খেতে শুরু করলাম। শ্রেয়ান ভাইয়ার দিকে একটা আইসক্রিম বাড়িয়ে ধরতেই উনি হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,“আমাকে এখন যেতে হবে ইলোমিলো। তুমি খাও এটা।”
আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,“সবসময় এত তাড়া দেখান কেন আপনি? মাফিয়াগিরি ছাড়া কী আর এত কাজ আপনার?”
শ্রেয়ান ভাইয়ার মুখ দেখে মনে হলো উনি আমার কথায় কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছেন। উনি অবাক দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে আরেকবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালেন। আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,“এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। আমি জেনে গেছি।”
শ্রেয়ান ভাইয়া মাথা চুলকে বললেন,“তুমি এসব………..।”
শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা শেষ করতে না দিয়েই তাজ ভাই বললেন,“তোর লেট হয়ে যাচ্ছে শ্রেয়ান। এক মিনিট, তুই বাইক আনিসনি কেন?”
শ্রেয়ান ভাইয়া বললেন,“এমনিতেই। আমি আসলে এমনিতেই বাইরে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ল আজ ইলোমিলোকে ফুসকা খাওয়াতে পারিনি তাই চলে এসেছি।”
আমি উৎসুক হয়ে বললাম,“আপনি বাইক চালান? কই? একদিনও তো দেখলাম না।”
শ্রেয়ান ভাইয়া হেসে বললেন,“পরেরবার তোমাকে পিছনে বসিয়ে বাইক চালাব, তখন দেখো।”
আমিও হেসে ফেললাম। শ্রেয়ান ভাইয়া আমাদেরকে বিদায় জানিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে চলে গেলেন। এবার শুধু আমি আর স্বয়ং যমরাজ। আমি আইসক্রিম খেতে খেতে আড়চোখে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃদপিন্ডে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে গেল। কারণ যমরাজ আমার দিকে শক্ত মুখে তাকিয়ে আছেন। চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর রেগে আছেন। হঠাৎ আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণ বুঝতে না পেরে আমি এলোমেলো দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বললাম,“কী হয়েছে?”
উনি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েই আছেন। আমি হাতের আধখাওয়া আইসক্রিমটা ভয়ে ভয়ে ওনার দিকে এগিয়ে ধরে বললাম,“আইসক্রিম খাবেন?”
উনি সঙ্গে সঙ্গে খপ করে আমার হাতটা ধরে ফেললেন। উনি আমার হাতটা এতটা জোরে চেপে ধরেছেন যে আমি ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম। হাতের আইসক্রিমটুকুও পড়ে গেল। উনি দাঁতে দাঁত পিষে কঠিন গলায় বললেন,“খুব ফুসকা খাওয়ার শখ না? খাওয়াচ্ছি তোকে ফুসকা। চল, দেখি তুই কত ফুসকা খেতে পারিস।”
আমি কিছু বলার আগেই উনি আমার হাত ধরে টানতে টানতে আবার উলটো পথে পা বাড়ালেন। আমি থামার চেষ্টা করেও পারলাম না। উলটো আমার অপর হাতের আইসক্রিমের বক্সটাই রাস্তায় পড়ে গেল। আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,“আরে, আমার আইসক্রিম পড়ে গেছে। থামুন, আমার আইসক্রিম।”
উনি থামলেন না। আমার সাধের আইসক্রিমের দুঃখে শয়তানটার মাথা ফাটাতে ইচ্ছা করছে। উনি গিয়ে থামলেন সেই ফুসকার দোকানে। কিন্তু আমার হাত ছাড়লেন না। আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি দোকানিকে বললেন,“মামা, পাঁচ প্লেট ফুসকা দিন তো।”
আমি হা করে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,“পাঁচ প্লেট ফুসকা কে খাবে?”
উনি বাঁকা হেসে বললেন,“কেন? তোর না খুব ফুসকা খাওয়ার শখ? অবশ্যই তুই খাবি।”
আমি চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে বললাম,“কী? আমি এইমাত্র ফুসকা আর আইসক্রিম খেয়েছি। এতগুলো ফুসকা খাওয়ার মতো জায়গা নেই পেটে।”
“তবুও খাবি।”
আমি মাথা দুলিয়ে বললাম,“পারব না। আপনি তো আমাকে ফুসকা খেতে দিতেই চান না। তাহলে এখন এমন করছেন কেন?”
“কেমন করছি? কখনও খেতে দিতে চাই না বলেই তো এখন মনভরে খাওয়াব।”
শয়তানটার মাথায় আবার কোন শয়তান চেপেছে আল্লাহ্ জানে। আমি হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বললাম,“আমি খাব না, বাড়ি যাব। হাত ছাড়ুন, লাগছে।”
উনি আমার হাতটা আরেকটু চেপে ধরে ধমকে উঠে বললেন,“আমি ধরতে না ধরতেই ছাড়ুন ছাড়ুন শুরু হয়ে গেছে। আর শ্রেয়ান যখন ধরল তখন? তখন খুব ভালো লেগেছিল বুঝি?”
আমি হতবিহ্বল হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এটা কী বললেন উনি? শ্রেয়ান ভাইয়া তো আমার ভালোর জন্যই হাত ধরেছিলেন। অথচ উনি এমনভাবে বলছেন যেন নিজের বন্ধুকেই হিংসা করছেন। আমি বিস্ময় নিয়েই বললাম,“উনি তো আমাকে রাস্তা পার করে দেয়ার জন্য হাত ধরেছিলেন।”
তাজ ভাই আবার ধমকে উঠলেন,“কেন ধরবে? রাস্তা পার করানোর জন্য আমি ছিলাম না? ও কেন ছুঁবে? কোন অধিকারে ছুঁবে?”
আমি মনে মনে বললাম,“তো আপনি কোন অধিকারে ছুঁয়েছেন?” কিন্তু কথাটা কন্ঠনালি দিয়ে বেরোনোর আগেই গিলে ফেললাম। নইলে যে এই যমরাজ আমাকেই আস্ত গিলে খাবে। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে অসহায়ের মতো মুখ করে বললাম,“ব্যথা পাচ্ছি।”
উনি শক্ত মুখে বললেন,“আর কোনোদিন কাউকে ছুঁতে দিবি?”
আমি দ্রুত ডানে বায়ে মাথা নাড়লাম। উনি আবার বললেন,“মনে থাকবে?”
আমি এবার ওপর নিচে মাথা ঝাঁকালাম। উনি এক ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,“যদি না থাকে?”
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। হাতের ব্যথায় ইতোমধ্যে আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছে। উনি আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে চাপা স্বরে বললেন,“আজকের পর যদি নিজেকে কোনো ছেলেকে ছুঁতে দিয়েছিস, একদম শুট করে দিব। মাইন্ড ইট পিচ্চি।”
উনি আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন। আমি অপর হাত দিয়ে ঐ হাত ঘষতে লাগলাম। হাতের কব্জি লাল হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে আমার ইচ্ছে করছে রাস্তায় হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে। চোখে টলমলে পানি নিয়ে মুখ কালো করে আমি অন্যদিকে মুখ ফিরালাম। তাজ ভাই দোকানিকে বললেন,“মামা, ফুসকা দেয়ার দরকার নেই। যারা অপেক্ষা করছে তাদের দিয়ে দিন। অন্য একদিন আবার আসব।”
দোকানি তাজ ভাইয়ের কথায় কী উত্তর দিলেন তা আমার কানে এল না। ততক্ষণে আমি দিক-বিদিক ভুলে সোজা হাঁটা শুরু করেছি। কিন্তু কয়েক পা সামনে এগোতেই হঠাৎ আমার বাঁ হাতটা কেউ হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। আমি খুব ভালো করেই জানি এটা কার কাজ। তাই পাশ ফিরে না তাকিয়েই হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাজ ভাই আমার হাতটা শক্ত করে ধরে পাশাপাশি হাঁটছেন। আমি কিছুক্ষণ হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে তারপর নিজেই থেমে গেলাম। থমথমে মুখে নিঃশব্দে হেঁটে চললাম। একসময় তাজ ভাই নীরবতা ভেঙে বললেন,“পিচ্চিদের এত রাগ ভালো না। ভুল করলে তো শাস্তি পেতেই হবে।”
ওনার কথায় রাগটা আরও বেড়ে গেল। এখানে আমার ভুলটা কোথায়? আমি তো একা রাস্তা পার হতে পারি না। শ্রেয়ান ভাইয়া তো শুধু হেল্পই করেছে, আর তো কিছু করেননি। শ্রেয়ান ভাইয়া ছুঁতে না পারলে উনি কেন ছোঁবেন? এতে কোনো ভুল নেই? হাঁটতে হাঁটতে উনি আমাকে খেপানোর জন্য অনেক কথাই বললেন। কিন্তু আমি নিশ্চুপ ছিলাম। বাড়ি ফিরে দেখলাম বাবা টিভিতে খবর দেখছেন। সামনের টি-টেবিলে একগাদা কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাবা হেসে বলল,“আমি তো ভাবলাম তোরা ডিনার করে ফিরবি।”
তাজ ভাই পাশের সোফায় ধপ করে বসে বললেন,“নাহ্। ডিনার বাড়িতেই করব।”
আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ রুমে চলে এলাম। রুমে এসেই ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। জেমি আমাকে দেখে এগিয়ে এসে আমার গায়ের সাথে ঘষাঘষি শুরু করে দিলো, তবু চোখ খুললাম না। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে পড়ে থেকে কিছু একটা ভেবে উঠে বসলাম। ফোনটা হাতে নিয়ে আফরা আপুকে কল করলাম। কয়েকবার রিং হওয়ার পরই আফরা আপু ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলল। আমি বললাম,“কেমন আছো আপু?”
ফোনের ওপাশ থেকে আফরা আপু বলল,“ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”
“ভালো। তুমি আমাদের বাড়িতে আসছো কবে?”
“আমি ভেবেছি তোর এক্সামটা শেষ হওয়ার পর যাব।”
“কেন?”
“আমি গেলে তোর পড়াশোনায় ডিস্টার্ব হবে।”
“আমি কখনও এমনটা বলেছি না-কি?”
“তুই বলবি কেন? আমি নিজেই ঠিক করেছি। তোর এক্সাম শেষ হলেই আমি চলে যাব।”
আফরা আপুকে অনেক বুঝিয়েও রাজি করাতে পারলাম না। তার এক কথা, সে আমার এক্সামের পরেই আসবে। কোথায় ভাবলাম আপু এলে তাকে দিয়ে শয়তানটাকে একটু শিক্ষা দেওয়াব, তা আর হলো না। রাগে দুঃখে ফোনটা ছুঁড়ে মারলাম বিছানার একপাশে। তারপর কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলাম। পরীক্ষার চিন্তাটা মাথায় কড়া নাড়তেই বই নিয়ে বসলাম। কিন্তু পড়ায় মনোযোগ দিতে পারলাম না। বই সামনে রেখে ফোনে ডুব দিলাম। কিছুক্ষণ পর পর বইয়ের পাতায় একটু উঁকি ঝুঁকি মারলাম। এভাবেই সময় পার করে রাত দশটা বাজালাম। কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল ছিল না। আমার পূর্ণ মনোযোগ তখন ফোনের স্ক্রিনে। হঠাৎ কেউ আমার ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। আমি হন্তদন্ত হয়ে ফিরে তাকাতেই তাজ ভাইয়ের রাগত মুখটা চোখে পড়ল। ওনাকে দেখে আমি আর কথা বাড়ালাম না। মুখ ফিরিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। তাজ ভাই বললেন,“ডিনার করতে চল।”
আমি কোনো কথা বললাম না। চুপচাপ বিছানার দিকে পা বাড়ালাম। তাজ ভাই এসে আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বললেন,“কথা শুনতে পাচ্ছিস না? ডিনার করতে চল।”
আমি ওনার দিকে না তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে বললাম,“ক্ষুধা নেই।”
উনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,“জিজ্ঞেস করিনি তোকে। চুপচাপ খেতে চল।”
খাবার টেবিলের সামনে এসে আমি চুপ মেরে গেলাম। কারণ সামনে বাবা বসে আছে। বাবার প্রশ্নের মুখে পড়তে চাই না বিধায় বিনা বাক্যে খেতে বসলাম।
চলবে…………………….?
(আসসালামু আলাইকুম পাঠকগণ। পেজ থেকে যারা গল্প পড়েন তাদের কোনো সাড়া পাই না কেন??)