#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:১৯
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম আজ ভার্সিটিতে যাব। কিন্তু শরীরের যা অবস্থা তাতে তো রুম থেকেই বেরোতে পারছি না। জ্বরটা কিছুটা কমেছে। শরীরের অবস্থা ভালো না হলেও গতকালের মতো অত খারাপও না। ঘড়ির কাঁটা নয়টা আটত্রিশের ঘরে। বাবা নিশ্চয়ই অফিসে চলে গেছে। তাজ ভাই কী করছেন? ওনার কথাটা মাথায় আসতেই গতকালের ঘটনা মনে পড়ে গেল। লোকটা কাল মাঝরাত পর্যন্ত কত যত্ন করল! পা টিপতেও দ্বিধা বোধ করল না! আমাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে ঘুমাতে পেরেছে কি না কে জানে? পরশু রাতেও তো এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি বেচারা। আচ্ছা? আম্মুর মতো এত যত্ন সে শিখেছে কীভাবে? প্রতিবারের মতো এবার আর আমার বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ লাগেনি। আমি খেয়াল করলাম কাল প্রথমবারের মতো অসুস্থ শরীরে আমি আম্মুকে কিছুটা কমই মিস করেছি। মনে হয়েছিল আমার যত্ন নেয়ার জন্য, একাকীত্ব ঘোচানোর জন্য কেউ একজন আছে। কিন্তু এখন আমার প্রচন্ড লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে ওনার সামনে মুখ দেখাতেও পারব না। ভাবলাম আজ ভুল করেও ওনার সামনে পড়ব না। কিন্তু ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলাম তাজ ভাই আমার বিছানায় আয়েশ করে বসে ফোন স্ক্রলিং করছেন। গ্রাম্য একটা প্রবাদ বাক্য মনে পড়ে গেল। ‘যার লাইগা দুনিয়া ছাড়া, হেয় আইয়া সামনে খাঁড়া।’ হাস্যকর লাগলেও এটাই এখন আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমি ওনাকে দেখেও না দেখার ভান করে এক পা দু’পা করে রুম থেকে বেরোতে যেতেই তাজ ভাই পিছু ডেকে বললেন,“ঐ পিচ্চি, কোথায় যাচ্ছিস?”
আমার রাগ উঠলেও জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু কন্ঠে বললাম,“রুমে ভালো লাগছে না।”
“আচ্ছা, ব্রেকফাস্ট করে তারপর বের হ। এদিকে আয়।”
আমি একই জায়গায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। অস্বস্তিতে ওড়নার কোণা আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে এদিক-ওদিক চঞ্চল দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগলাম। তাজ ভাই এবার কিছুটা জোরেই বললেন,“কী হলো? খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে আসতে বললাম না?”
আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানার কাছে দাঁড়ালাম। উনি চোখের ইশারায় বসতে বললেন। আমি বিছানায় এক পা তুলে আরেক পা নিচে ঝুলিয়ে আড়ষ্টতা নিয়ে বসলাম। উনি আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে হুট করে আমাকে টেনে বিছানায় সম্পূর্ণ উঠিয়ে বসিয়ে দিলেন। আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। উনি আমার কপালে হাত রেখে জ্বর আছে কি না পরীক্ষা করলেন। তারপর বেড সাইড টেবিল থেকে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে উনি নিজের সামনে রাখলেন। উনি খাবারের প্লেটে হাত দিতেই বুঝলাম খাইয়ে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। তাই আগে ভাগেই বলে উঠলাম,“আমি নিজের হাত দিয়ে খাব।”
উনি আমার কথা তোয়াক্কা না করে মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলেন। আমি আবার বললাম,“বলছি তো নিজের হাতে খাব।”
উনি জোর করে আমার মুখে খাবার পুরে দিলেন।আমি বাধ্য হয়ে খাবার চিবোতে লাগলাম। ওনার থেকে প্লেটটা নেয়ার জন্য হাত বাড়াতেই উনি খপ করে আমার হাতটা মুঠোয় বন্দি করে বাঁকা হেসে বললেন,“মাফিয়ারা কিন্তু মাথায় গান ধরতে পটু।”
আমি হতচকিত হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। গলায় খাবার আটকে কাশি উঠে গেল। তাজ ভাই আমার দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে ধরলেন। আমি দুই ঢোক পানি খেয়ে গ্লাসটা ফেরত দিলাম। তারপর ঢোক গিলে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকালাম। আমার তো মনেই ছিল না যে শয়তানটা মাইন্ড রিড করতে জানে। এখন নিশ্চয়ই মাইন্ড রিড করে এটাও জেনে গেছে যে আমি তাদের গানের খবর পেয়ে গেছি। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,“আ..আপনি সত্যিই মাফিয়া?”
তাজ ভাই ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়েই বললেন,“রিল্যাক্স পিচ্চি। এটুকুতেই এত ভয় পেলে চলে? শুধু তো একটা গানই দেখেছিস। এর বেশি কিছু তো আর না।”
আমি ঢোক গিলে বললাম,“আপনি জানলেন কীভাবে?”
“কিছু মানুষের উপস্থিতি টের পাওয়ার এক অলৌকিক ক্ষমতা আছে আমার। তোর পিচ্চি মাথায় তা ঢুকবে না। এখন হা কর।”
আমি ওনার কথায় কান না দিয়ে প্রশ্ন করলাম,“আপনি সত্যি সত্যিই মাফিয়া?”
উনি আমার মুখে খাবার পুরে বললেন,“কোনো সন্দেহ আছে?”
“না। কিন্তু আমি তো জানতাম আপনি রাজ ভাইয়ার সাথে বিজনেস সামলান। আর বাংলাদেশেও এসেছেন বেশিদিন হয়নি। তাহলে?”
তাজ ভাই ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,“মাফিয়ার সামনে বসে ফটাফট কথা বলছিস। ভয় লাগছে না?”
“লাগছে, তবে বেশি না।”
“কেন?”
“কারণ আমি জানি আপনি বাবার কোনো ক্ষতি করবেন না।”
“যদি তোকে শুট করে দেই?”
আমি চমকে উঠলাম। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নড়েচড়ে বসে বললাম,“আমি কিন্তু বাবার কাছে বলে দিব আপনি ভালো মানুষের আড়ালে একজন মাফিয়া।”
তাজ ভাই এমনভাবে হাসলেন যেন আমি কোনো জোকস্ শুনিয়েছি। তারপর আবার বললেন,“তার আগেই যদি মেরে দেই?”
আমি এবার কাঁদো কাঁদো মুখ করে ফেললাম। উনি হেসে বললেন,“কুল ডাউন পিচ্চি। তুই মুখ বন্ধ রাখলে আমি কিছুই করব না। এতদিন যেরকম ছিলি সেরকমই থাকবি। তুই কিছু দেখিসওনি আর জানিসও না। ওকে?”
আমি ভীতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,“ওকে।”
“আমার ব্যাপারে মাথা ঘামানো চলবে না আর কথার হেরফের করা চলবে না। নইলে মাফিয়াদের দিয়ে কিন্তু বিশ্বাস নেই। মনে থাকবে?”
আমি ঢোক গিলে দ্রুত গতিতে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম। তাজ ভাই বাঁকা হেসে বললেন,“গুড গার্ল। এবার হা কর।”
আমি রোবটের মতো চুপচাপ হা করলাম। মুখে বিস্বাদ লাগা সত্ত্বেও ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বিনা বাক্যে ওনার হাতে খাবার খেতে লাগলাম। মনে মনে আফসোস করলাম, ইশ্! ওনাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য কত কিছুই না ভেবে রেখেছিলাম আমি। সব জলে গেল। এখন তো মনে হচ্ছে উনিই আমাকে পুতুলের মতো নাচাবেন। এতদিন তো শুধু ব্ল্যাকমেইল চলেছে। আর এখন থেকে তার সাথে যোগ হলো গান। বাহ্, দারুণ! আমার এত সাধের জীবনটা বাঁশপাতা হয়ে গেল! খাবার শেষ করে ঔষধ খেয়ে নিলাম। পুরোটা সময় আমি টু শব্দও করলাম না। উনি প্রশ্ন করলেন,“শরীর ভালো লাগছে এখন?”
আমি উপর নিচে মাথা দোলালাম। ওনার পরবর্তী প্রশ্ন,“এক্সামের কতদিন বাকি?”
আমি মৃদু কন্ঠে উত্তর দিলাম,“দশ দিন।”
“এখন পড়তে বসবি।”
আমি অনীহা নিয়ে বললাম,“ইচ্ছে করছে না।”
উনি চোখ পাকিয়ে বললেন,“আবার বল।”
আমি থতমত খেয়ে বললাম,“এখনই বসব।”
“হুম। আমি এখন বাইরে যাব। এসে যেন বই হাতে দেখি?”
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। যত যাই হোক, উনি গেলে আবার আমার একা একা বসে থাকতে হবে। আমি মনমরা হয়ে ঘাড় কাত করলাম। তাজ ভাই আমার মাথায় সস্নেহে হাত রেখে বললেন,“তাড়াতাড়ি চলে আসব। ততক্ষণ পর্যন্ত মন দিয়ে পড়।”
আমি ভাবলাম উনি এখনই চলে যাবেন। কিন্তু ওনার কান্ডে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। উনি কিছুটা এগিয়ে এসে আমার বাঁ হাতটা নিজের দুহাতের মুঠোয় নিলেন। আমার হাতের চুড়ি দুটো নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। আমি চুপ মেরে ওনার কান্ড দেখে যাচ্ছি। হুট করেই উনি ঝুঁকে পড়ে চুড়ির ওপরে আলতো করে চুমু খেলেন। কিন্তু চুড়ির সাথে আমার হাতেও ওনার ঠোঁটের স্পর্শ লেগে গেল। আমি দ্রুত হাত সরিয়ে ছিটকে দূরে সরে গোল গোল চোখে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। উনি মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে উঠে চলে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলাম। তারপর একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বই নিয়ে বসলাম। দশ দিন পর পরীক্ষা, অথচ আমার প্রস্তুতির কথা না বললেই ভালো।
তাজ ভাই ফিরলেন ঠিক দুপুরের সময়। তার সাথে বাবাও ফিরল। তখন আমি শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে চুল মুছছিলাম। কলিংবেলের আওয়াজ কানে আসতেই বুঝতে পেরেছি হয় তাজ ভাই আর নয় বাবা এসেছেন। আমি কোনোমতে চুল মুছে বেরিয়ে এলাম। বাবা আমাকে দেখে এগিয়ে এসে আমার কপালে হাত ছুঁইয়ে হেসে বলল,“শরীর কেমন আম্মা?”
আমি জবাব দিলাম,“ভালো।”
“গোসল সেরে আসছি।” বলতে বলতে বাবা নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলো। আমি ভাবলাম ততক্ষণ বসে বসে টিভি দেখি। কিন্তু সামনে তাকাতেই দেখলাম যম আমার দিকে শক্ত মুখে তাকিয়ে আছেন। আমি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললাম,“আমি পড়েছি তো। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ পড়েছি। সত্যি বলছি।”
আমার কথা শেষ হতেই তাজ ভাই তেড়ে এসে আমার চুলগুলো মুঠোয় চেপে ধরলেন। কিন্তু খুব বেশি জোরেও ধরেননি যে আমি ব্যথায় কাতরাব। আমি অবাক হয়ে মিনমিনে গলায় বললাম,“চুল ধরলেন কেন? কী করেছি আমি?”
তাজ ভাই ধমকের সুরে বললেন,“গোসল করে চুল মুছিসনি কেন? জ্বর জিইয়ে রাখার এত শখ?”
“মুছলাম তো।”
“তো এত পানি এল কোত্থেকে চুলে? টপটপ করে ফ্লোরেও পড়ছে।”
“আমি তো এভাবেই মুছি।”
তাজ ভাই আমার চুল ছেড়ে দিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করলেন,“কেয়ারলেস।”
শব্দটা উচ্চারণ করেই উনি হনহন করে হেঁটে নিজের রুমে চলে গেলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সোফায় দুই পা তুলে আরাম করে বসে টিভি অন করলাম। রিমোট নিয়ে একের পর এক চ্যানেল পালটাতে লাগলাম। দেখার মতো কিছুই পাচ্ছি না তাও চ্যানেল পালটে চলেছি। হঠাৎ মাথায় কিছু একটা অনুভব করে তড়িঘড়ি করে পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম স্বয়ং যমরাজ আমার পেছনে দাঁড়িয়ে পরম যত্নে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে দিচ্ছেন। আমি সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই উনি আমার এক গোছা চুল টেনে ধরে বললেন,“ছিঁড়ে ফেলব।”
আমি গাল ফুলিয়ে আবার সোজা হয়ে বসলাম। এই উজবুকের সাথে এখন তর্ক করার ইচ্ছা নেই। উনি ভালোভাবে চুল মোছা শেষ করে তোয়ালে নিয়ে আবার চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বাবা চলে এল। বাবা খাবার টেবিলে বসে আমাকে ডাকলেন। আমি গিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম। মারজিয়া খালা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিলেন। ততক্ষণে তাজ ভাইও ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে চলে এলেন। আমার বিপরীত পাশের চেয়ার টেনে বসতে বসতে উনি বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“মামু, তোমাকে তো বলাই হয়নি, আমি দুজন মেয়ে সার্ভেন্ট ঠিক করেছি।”
বাবা প্রশ্ন করলেন,“দুজন সার্ভেন্ট কেন?”
“তোমার অকর্মা মেয়ের খেয়াল রাখার জন্য। তাছাড়া খালার বয়স হয়েছে। একা মানুষ কত খাটতে পারে? কাল থেকেই ঐ দুজন কাজ শুরু করবে।”
বাবা মুচকি হাসি মুখে ঝুলিয়ে মাথা দুলিয়ে বলল,“আচ্ছা।”
মারজিয়া খালা খাবার পরিবেশন করলেন। আমি খাবার মুখে তুলে বুঝলাম মুখের তেতো ভাবটা কমে গেছে। যাক বাবা! ভালোই হয়েছে। কয়েক লোকমা খাওয়ার পর হঠাৎ বাবা খেতে খেতেই বলে উঠল,“চুড়িগুলো কিন্তু আমিই গড়িয়ে দিয়েছিলাম আলোকে।”
আমি চমকে উঠে খাবার মুখে তুলতে গিয়েও থেমে গেলাম। ঝট করে বাঁ হাতটা টেবিলের ওপর থেকে নামিয়ে নিচে লুকিয়ে ফেললাম। বাবার দৃষ্টি হাতের ওপরেই পড়তে হলো! আল্লাহ্! এখন কী হবে? বাবা কী ভাববে? কী বলবে এখন? শয়তানটার জন্য আমি ফ্যাসাদে পড়ব? তাজ ভাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম মহারাজ পরম তৃপ্তিতে খাবার গিলে চলেছেন। বাবা এবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,“আমার জিনিস আমার কাছেই ফেরত এল না-কি?”
তাজ ভাই না তাকিয়েই খাবার মুখে তুলতে তুলতে বলল,“উঁহু। তোমার বোনের জিনিস মেয়ের কাছে এসেছে। এতে তোমার কোনো ভাগ নেই। ওদিকে নজর দিও না।”
বাবা শুধু মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকালেন। আমি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে একবার বাবার দিকে আরেকবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। কারোর মধ্যেই ব্যাপারটা নিয়ে তেমন উত্তেজনা বা ভাবনার লেশ মাত্র নেই। তারা তাদের মতো তৃপ্তি সহকারে খেতে ব্যস্ত। যেন আমার হাতে ফুপির পছন্দের চুড়ি, ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। এটা নিয়ে ভাবাভাবির কিছুই নেই। আশ্চর্য! আমি তো ভেবেছিলাম বাবা অনেক কিছুই ভেবে বসবে বা জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু তার কিছুই হলো না! তবে বাবা এটা নিয়ে মাথা না ঘামানোয় আমি বেশ স্বস্তি পেলাম। এরপর আর আমি টু শব্দটিও করলাম না। চুপচাপ খেয়ে চললাম। বাবা আর তাজ ভাই খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে অনেক কথাই বললেন। আমি যত দ্রুত সম্ভব খাওয়া শেষ করে উঠে চলে এলাম। কিন্তু আমার কপালে কি আর শান্তি শব্দটা শোভা পায়? সে বেচারা তো তাজ নামক যম আসার পর থেকেই চিরবিদায় নিয়েছে। রুমে এসে ফোনটা নিয়ে বসেছি বান্ধবীদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়ার আশায়। কিন্তু আমার আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে যমরাজ তার ল্যাপটপ নিয়ে আমার বিছানায় গেড়ে বসলেন। শুধু বসেই কি আর শান্তি পেয়েছেন? আমার হাত থেকে ফোনটাও কেড়ে নিয়েছেন। গানের ভয়ে আমি না কিছু বলতে পারছি আর না সহ্য করতে পারছি। গাল ফুলিয়ে বসে মনে মনে তাকে অদ্ভুত সব বকা দিতে লাগলাম। তারপর আমি সাহস নিয়ে বললাম,“ফোন নিলেন কেন? দিন না।”
উনি আমার কথায় বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলেন না। ল্যাপটপ খুলে তাতে মুখ গুঁজে বসে রইলেন। আমি ওনার এমন আচরণের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। ল্যাপটপ নিয়ে হঠাৎ আমার রুমে আসার মানে কী? ওনার নিজের রুমে কি জায়গার কমতি পড়েছে? তাজ ভাই হঠাৎ আমাকে টেনে তার পাশে বসিয়ে ল্যাপটপটা সামনে রাখলেন। আমি ভ্যাবলার মতো তার মুখের দিকে তাকালাম। তাজ ভাই আমার মুখটা ধরে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে ঘুরালেন। স্ক্রিনের দিকে চোখ পড়তেই আমি চোখ বড়ো করে উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলাম,“রাজ ভাইয়া!”
ওপাশ থেকে রাজ ভাইয়া হাসিমুখে বললেন,“হাই ইলু। কেমন আছিস?”
আমি খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম,“অনেক ভালো আছি ভাইয়া। তুমি কেমন আছো?”
“ভালো আছি। তুই না-কি অসুস্থ, তো অনেক ভালো আছিস কীভাবে?”
আমি দাঁত কেলিয়ে হেসে বললাম,“তোমাকে দেখে ভালো হয়ে গেছি। ভাবি কোথায়? আমি ভাবিকে দেখব।”
“এত বছর পর ভাইকে দেখে তাকে রেখে ভাবির সাথে কথা বলার জন্য ব্যস্ত হচ্ছিস? একটুও মায়া নেই ভাইয়ের জন্য!”
আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,“আমি তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তোমার এই শয়তান ভাই আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আজ কথা বলতে দিলো। ভাবির ছবিটা পর্যন্ত দেখায়নি। প্লিজ ভাবিকে ডাক না।”
রাজ ভাইয়া হেসে বললেন,“তাজ ঠিকই বলেছে, তুই এখনও সেই পিচ্চি ইলু আছিস।”
আমি কপাল কুঁচকে তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি হাস্যোজ্জ্বল মুখে বসে আছেন। আমি বললাম,“ভাইয়া, আগে ভাবিকে ডাক।”
“আমি অফিসে আছি ইলু। তোর ভাবি বাসায় আছে। মন খারাপ করিস না। বাসায় গিয়ে আমি তোর সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিব। ওকে?”
আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম,“ওকে।”
“মিস্টার তাজওয়ার কি তোকে খুব জ্বালাচ্ছে?”
আমি আড়চোখে একবার তাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি বিদ্রোহী হয়ে বললেন,“হেই ব্রো, এটা কেমন প্রশ্ন? আমাকে এমন মনে হয় তোর? আমি না, বরং এই পিচ্চিই আমার মাথা খায়।”
আমি অবাক হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,“কী বললেন? এত বড়ো মিথ্যা কথা!”
“সত্য কথা সবসময়ই মূল্যহীন।”
“আপনি তো সত্যই বলেননি, তার আবার মূল্য আশা করেন কোন আক্কেলে?”
“চুপ মাথামোটা।”
“একদম আজেবাজে নামে ডাকবেন না।”
রাজ ভাইয়া শব্দ করে হেসে বললেন,“তোরা দুটোতে কি সারাজীবনই এমন ঝগড়া করবি? সেই ছোটো বেলার মতো এখনও একজন আরেকজনের পেছনে লেগে আছিস। ফাজিল দুটো!”
আমি আর তাজ ভাই একদম চুপ হয়ে গেলাম। হঠাৎ করেই আমার মনে পড়ল কিছুক্ষণের জন্য আমি তাজ ভাইয়ের প্রতি সব ভয় ভুলে বসেছিলাম। পরে নিশ্চয়ই এর শোধ তুলবে। একে দিয়ে বিশ্বাস নেই। আমি আর ওনার দিকে ফিরেও তাকালাম না। হাসিমুখে রাজ ভাইয়ার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
- চলবে…………………..?