তাজ ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব:০৫

0
516

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:০৫

সকাল সকাল তাজ ভাইয়ার হুকুম জারিতে আমার মেজাজ আগুনের ন্যায় গরম হয়ে গেল। মহারাজের হুকুম, আমায় না-কি রুটি বানাতে হবে! এত করে বললাম আমি এসব পারি না। জীবনে তো এসব করিইনি, পারব কীভাবে? কিন্তু না। উনি তো এখন উঠতে বসতে ব্ল্যাকমেইল করতে শিখেছেন। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে উনি মারজিয়া খালাকে কয়েকদিনের ছুটি দিয়েছেন। কী বলে ছুটি দিয়েছেন কে জানে? নিশ্চয়ই কোনো মিথ্যে কথা বলেছেন। নইলে বাবা আমাকে বাসায় রেখে গেছে জেনেও মারজিয়া খালা ছুটি নিতেন না। এই নিয়ে ওনার সাথে অনেকক্ষণ তর্ক বিতর্ক চলল। ওনার সাথে তর্কে না পেরে বাধ্য হয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম। এই রুটি বানানোর কাজটা আমার কাছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো মনে হয়। দুনিয়াতে বোধ হয় এর মতো বিরক্তিকর কাজ আর দ্বিতীয়টি নেই। যদিও আমি জানি কীভাবে কীভাবে বানাতে হয় কিন্তু কোনোদিন না বানানোয় আজ সাহস জুগিয়ে উঠতে পারছি না। কিছুক্ষণ দোটানায় ভুগে তারপর সাহস করে প্রয়োজনীয় সবকিছু নামিয়ে নিলাম। আগে তো চেষ্টা করি তারপর যা হবার হবে। কিন্তু ময়দা মাখাতে গিয়ে ঘটলো ইয়া বড়ো বিপত্তি। পানির পরিমাণ বেশি হয়ে গেছে বিধায় আরও দুই কাপ ময়দা দিয়েছি। তাতে আরেকটু পানি লাগবে দেখে আরও একটু পানি দিয়েছি। কিন্তু তাতেও হলো না। একবার ময়দা বাড়াতে হচ্ছে তো একবার পানি। ইতোমধ্যে অনেক ময়দা মাখিয়ে ফেলেছি। দুই হাত ময়দায় মাখামাখি। আমি হতাশ হয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে মনে মনে তাজ ভাইয়াকে বকতে শুরু করলাম। তখনই মহারাজ রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,“এখনও সকালের চা পাইনি আমি। ইরেসপন্সিবল এসিস্ট্যান্ট!”

আমি ওনার কথায় কান দিলাম না। আপাতত আমার মাথায় ময়দার ঝামেলা ঘুরপাক খাচ্ছে। উনি এগিয়ে এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলেন। তারপর বড়ো বড়ো চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন,“এই মাথামোটা, একি হাল করেছিস তুই!”

আমি কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,“বললাম না আমি জীবনেও এসব করিনি?”

উনি বিদ্রুপ করে বললেন,“অকর্মার ঢেঁকি পালতেছে আমার মামু। তোকে তো প্রত্যেকদিন খাটিয়ে খাওয়ানো উচিত। শুধু গিলতে জানিস?”

“বাজে কথা বলবেন না। আপনার এত শখ তো আপনি বানাতে পারেন না?”

“অবশ্যই পারি। আমাকে কি তোর মতো অকর্মা মনে হয়? আমি সব পারি। আর কালকে থেকে তুই আমার থেকে সব কাজ শিখবি।”

আমি ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললাম,“আমি শিখব আপনার কাছে কাজ! অসম্ভব! আর আমার দরকারও নেই শেখার।”

“আহা! কাজ শেখার দরকার নেই? শাশুড়ি দিনে দশবার চুলের মুঠি ধরে টানবে। তার থেকে বড়ো কথা তুই আমার এসিস্ট্যান্ট। সবসময় আমি যা বলব তাই করবি। এখন এগুলো রেখে চুপচাপ গিয়ে রেডি হয়ে নে। ব্রেকফাস্ট বাইরে করব, তারপর ভার্সিটিতে দিয়ে আসব।”

কথাটা বলে উনি বাইরে চলে গেলেন। রাগে দুঃখে আমার হাত পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কোনোমতে রান্নাঘরটা পরিষ্কার করে রেখে ছুটলাম রেডি হতে। তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে ব্যাগ নিয়ে বের হলাম। জেমি আমার কাছে এসে লাফালাফি করছে আর ডাকছে। আমি ওকে কোলে তুলে নিয়ে ভাবতে লাগলাম ওকে তো আজ একা বাসায় রেখে যেতে হবে। প্রতিদিন তো মারজিয়া খালা থাকে। তাজ ভাইয়া তখন রুম থেকে বেরিয়ে বললেন,“চল।”

আমি মন খারাপ করে জেমির দিকে তাকিয়ে রইলাম। জেমিও করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাজ ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,“কী সমস্যা?”

আমি ঝাঁঝালো গলায় বললাম,“খালাকে তো ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। এখন জেমি একা বাসায় থাকবে?”

উনি দায়সারাভাবে বললেন,“তো? ও একটা বিড়াল। একা রেখে গেলে বাচ্চাদের মতো কাঁদবে না।”

আমার আরও রাগ উঠে গেল। ওকে রেখে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। তাই ওকে আদর করে আমার রুমে রেখে গেলাম আর কিছু খাবারও দিয়ে গেলাম। তাজ ভাইয়া আমাকে নিয়ে আগে একটা রেস্টুরেন্টে গেলেন। উনি খাবার অর্ডার করার কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার চলে এল। আমি চুপচাপ খাবার শেষ করলাম। উনিও কোনো কথা বললেন না বলে শান্তি পেলাম। ভার্সিটিতে পৌঁছে আমি ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথে বান্ধবী গুলো আমাকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরল। সবার মুখে এক কথা। তোর ফুপাতো ভাই দেখতে মা শা আল্লাহ্! কী চেহারা! আমি তো ফিদা হয়ে গেলাম। তুই আবার প্রেমে পড়িস না কিন্তু। আমি ওনাকে প্রপোজ করব‌ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে টেনে ভাবলাম,“এই লোককে তো চিনিস না বাছারা। চিনলে আর এমন কথা মুখেও আনতি না।” আজ সারাটা ক্লাস ওদের এই বকবক শুনে আমার মাথা ধরে গেছে। আমি শুধু ছুটির অপেক্ষা করতে লাগলাম। এটাই এই আজাইরা আলাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র রাস্তা‌। মুক্তিই বা কোথায়? এখান থেকে মুক্তি পেলে বাইরে আরও ভয়ংকর বিপদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ছুটির পর ক্লাস থেকে বেরিয়ে দেখলাম আজও তাজ ভাইয়া আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। উনি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললেন,“তো? দুপুরের লাঞ্চে কী খাওয়া হবে?”

আমি কপাল কুঁচকে বললাম,“আমি কীভাবে জানব? খালাকে আপনি ছুটি দিয়েছেন তো আপনিই এবার ভাবুন কী খাবেন।”

“কাল থেকে সকাল আর রাতের খাবার তুই বানাবি। আমি শিখিয়ে দিবো। আর দুপুরের খাবার না হয় অর্ডার করে নেব।”

“এত সময় নিয়ে আমি রান্না করতে পারব না। আমার অভ্যাসও নেই।”

“নেই তো কী হয়েছে? এখন থেকে করবি। আগে তুই আজাইরা জনগণের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলি। কিন্তু এখন তুই আহনাফ তাজওয়ারের এসিস্ট্যান্ট। আর আমার এসিস্ট্যান্ট হতে হবে আমার মতোই সব কাজে পটু। যদিও আমার মতো হওয়া তোর পক্ষে সাত জন্মেও সম্ভব না। তবু কিছুটা চেষ্টা তো করতেই হবে।”

আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,“ভাইয়া, আপনার আজাইরা বকবক একটু বন্ধ করবেন প্লিজ। আমার মাথা ঘুরছে।”

উনি ধমকের সুরে বললেন,“তোকে না বলেছি আমাকে ভাইয়া ডাকবি না। আর একবার ভাইয়া ডাকলে পানিশমেন্ট পেতে হবে। মনে থাকে যেন।”

আমি গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। সেই ছোটো বেলা থেকে ভাইয়া ডাকছি। আর এখন না-কি তাকে ভাই ডাকতে হবে! যত্তসব ঢং! ইচ্ছে করছে ধাক্কা মেরে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দিতে। ভয়ানক ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখে ঠিক করলাম এখন থেকে ভাই বলেই ডাকব। এত বড়ো একটা লোককে ভাইয়া থেকে ভাই ডাকতে কেমন যেন ইতস্তত লাগছে। বাড়ি পৌঁছে জেমিকে আদর করে গোসল করতে ঢুকে পড়লাম। গোসল সেরে রুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম তাজ ভাইয়া থুক্কু ভাইয়া বলা তো নিষেধ, তাজ ভাই খাবার টেবিলে বসে আছেন। সামনে কিছু খাবারের প্যাকেট। বাব্বাহ্! এত তাড়াতাড়ি খাবার এসে গেছে! আমাকে দেখেই উনি ভ্রুকুটি করে নিরীক্ষণ করে বললেন,“চুল থেকে পানি পড়ে তো ঘরটা বঙ্গোপসাগরে পরিণত হবে। ভালো করে চুল মুছতে পারলি না? মাথামোটা!”

আমি বললাম,“না পারি না। আপনার কী? আপনি নিজের দিকে নজর দিন আমার দিকে না দিয়ে।”

“তোর মতো শাকচুন্নীর দিকে নজর দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার নেই। চুপচাপ খাবার বাড়।”

খাবারের কথা মনে পড়তেই প্রচুর ক্ষুধা অনুভব করলাম। কোনো প্রকার ঝামেলা না করে প্যাকেট থেকে খাবারগুলো ঢেলে দুজনের প্লেটে বাড়লাম। ওনার দিকে একটা প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে নিজেও খেতে শুরু করলাম। খেতে খেতে উনি প্রশ্ন করলেন,“মামুর সাথে কথা হয়েছে তোর?”

“হুঁ।”

“ওনার আসতে একটু দেরি হবে। বলেছে?”

“হুঁ।”

“মামু ফেরার আগে আমিও গ্রামে যাব।”

কথাটা শুনে আমার গলায় খাবার আটকে গেল। কোনোরকম সেটা গিলে নিয়ে চোখ বড়ো করে বললাম,“আমি কি একা বাসায় থাকব?”

“আমি কি জানি?”

ওনার দায়সারা কথায় আমি অবাক হয়ে গেলাম। বাবা না-কি আমাকে এই রাক্ষসটার ওপর ভরসা করে রেখে গেছে! আর ইনি কি না বলছেন আমাকে একা ফেলে রেখে গ্রামে যাবে। আমি কিছু একটা ভাবলাম। হঠাৎ একটা প্ল্যান মাথায় আসতেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। খুব আগ্রহ নিয়ে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,“কবে যাবেন?”

উনি সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন। পরক্ষণেই বাঁকা হেসে বললেন,“মনে মনে এত নাচানাচি করে লাভ নেই। আমি গেলে সাথে তুইও যাবি। ভুলে গেলি তুই আমার এ্যাসিস্ট্যান্ট?”

ব্যাস,আমার দিলটা খন্ড খন্ড হয়ে গেল। কোথায় ভাবলাম উনি গেলে আমার সব বান্ধবীদের বাসায় নিয়ে এসে মনের সুখে ফুর্তি করব। এক নিমিষে আমার সুখ কেড়ে নিল শয়তানটা। আমি মুখ গোমড়া করে বললাম,“আমি যাব না আপনার সাথে।”

“আমি জিজ্ঞেস করিনি সেটা। আমি যাব মানে তুইও যাবি।‌”

“আমার ইচ্ছে নেই।”

“গ্রাম তো তোর পছন্দের জায়গা।”

“কে বলল আপনাকে?”

উনি এর জবাব না দিয়ে চুপচাপ খাবার শেষ করলেন। আমি নিজের খাবার শেষ করে জেমির জন্য খাবার নিয়ে গেলাম। ও খাবার দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠল। ওকে খাবার খেতে দিয়ে আমি ভাবতে লাগলাম কী করব। হঠাৎ করেই গতকাল সন্ধ্যায় তাজ ভাইয়া থুক্কু ভাইয়ের বলা কথাটা মনে পড়ে গেল। ওনার জ্বালাতনে কথাটা প্রায় ভুলে বসেছিলাম। এখন আবার মনে পড়তেই মাথার মধ্যে কিলবিল করতে লাগল। ওনার আচরণে আমি একশ ভাগ নিশ্চিত উনি আমাকে পছন্দ করেন না। কিন্তু তবু ঐ কথাটা মাথা থেকে কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছি না। আবেগী মন বারবার বলছে কোনো এক রহস্য নিশ্চয়ই আছে। আমি অনেকক্ষন ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম আনহার সাথে কথা বলব এ ব্যাপারে। ও এসব ব্যাপারে খুবই অভিজ্ঞ।‌ বলার সঙ্গে সঙ্গেই রহস্য ঘেঁটে বের করে ফেলবে। কিন্তু এখন কেমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। তাই ঠিক করলাম ঘুম থেকে উঠে ওকে ফোন করব। ঘড়িতে দেখলাম তিনটা আটান্ন বাজে। তারপর বিছানায় সটান শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম। সেই যে চোখ বন্ধ করলাম তারপর চোখ খুলে দেখলাম পুরো রুম ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিছানায় উঠে বসে আমি এত অন্ধকার দেখে ভয়ে ঢোক গিললাম। বালিশের কাছে হাতড়ে হাতড়ে ফোনটা খুঁজে বের করলাম। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। তাড়াতাড়ি গিয়ে সুইচ টিপে রুমের বাতি জ্বালালাম। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘড়ির টাইম দেখে তো আমার চোখ কপালে। সন্ধ্যা সাতটা ছয় বাজে! এতটা সময় কীভাবে ঘুমিয়েছি আমি! এমন মরা ঘুম তো কখনও ঘুমাই না আমি। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসে দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে তাজ ভাইয়ের রুমের দিকে তাকালাম। দরজা ভেজিয়ে রাখা। কী করছেন কে জানে? যা ইচ্ছে করুক আমার কী? ওদিকে পাত্তা না দিয়ে আমি রান্নাঘরে ঢুকলাম। ভাবলাম এক কাপ কফি বানাব। তখনই মহারাজ এসে হাজির। পেছন থেকে আমার এক মুঠো চুল ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বললেন,“কিরে পিচ্চি? বেঁচে আছিস এখনও? আমি তো ভাবলাম মরে ভুত হয়ে গেছিস এতক্ষণে। যা ঘুম ঘুমিয়েছিস!”

চুলে টান পড়ায় আমি ব্যথায় মুখটা কুঁচকে ফেললাম। ঝাড়ি দিয়ে বললাম,“এটা কোন ধরণের অসভ্যতা? চুলে ব্যথা পেয়েছি না?”

উনি আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে আবার আমার চুল টেনে ধরে সূক্ষ্ম চোখে নিরীক্ষণ করে ছেড়ে দিয়ে নাক মুখ কুঁচকে বললেন,“চুলের যত্ন করতে পারিস না? অলস কোথাকার! তোর মতো অলস মেয়ে শুধু শুধু দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো কাজে লাগবে না। সরকারের উচিত তোকে দেশছাড়া করে দেয়া।”

আমি কোমড়ে দুহাত রেখে মুখ বাঁকিয়ে বললাম,“আর আপনাকে দিয়ে বুঝি দেশ উদ্ধার হয়ে যাবে? আপনাকে তো শুধু এই দেশ না এই পৃথিবী ছাড়া করা উচিত।”

উনি ভাব নিয়ে বললেন,“আমার মতো একজন দায়িত্ববান নাগরিক দেশে হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। তোর মতো মাথামোটা পিচ্চি এসব বুঝবে না। এখন কফি বানিয়ে নিয়ে আয় আমার জন্য।”

হুকুম জারি করে জাহাপনা গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন। উজবুকটার মাথায় গরম কফি ঢেলে কফি খাওয়ার সাধ মিটিয়ে দিতে হয়। ওনাকে বকতে বকতে কফি বানিয়ে নিয়ে গেলাম। রুমে ঢুকে দেখলাম উনি ল্যাপটপ নিয়ে বসেছেন। মনোযোগ দিয়ে কী যেন করছেন। আমি এসেছি বুঝতে পেরেও এদিকে খেয়াল দিলেন না। দেখে মনে হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে উল্টে ফেলছেন। ওনার মতো আজাইরা জনগণ করবে কাজ! হাস্যকর ব্যাপার। আমি বেডসাইড টেবিলে কফি মগটা রেখে চুপচাপ যেভাবে এসেছিলাম সেভাবেই বেরিয়ে গেলাম। রুমে ঢুকে কফি খেতে খেতে মনে পড়ল আনহাকে ফোন করার কথা। তাড়াতাড়ি কফিটা শেষ করে আমি ফোন হাতে নিয়ে আনহার নাম্বারে ডায়াল করলাম। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ও ফোন রিসিভ করল। বেশি কথা না বাড়িয়ে আমি ওকে গতকালের ঘটনাটা খুলে বললাম। ও তো কথাটা শুনেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল। সেই সাথে দারুণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল তাজ ভাই মনে মনে আমাকে খুব পছন্দ করে। আমি তো ওর কথা মানতে নারাজ। পৃথিবী উল্টে গেলেও এটা সত্যি হবে না। কিন্তু আনহা ওর কথায় বহাল রইল। এই নিয়ে ওর সাথে একধাপ বিতর্ক প্রতিযোগিতা চালালাম। কিন্তু কেউই কাউকে হারাতে পারলাম না। শেষে গম্ভীর মুখে ফোন কাটতেই খেয়াল করলাম আমার রুমের দরজার পর্দাটা হালকা নড়ে উঠল। আমি কিছু একটা ভেবে দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে বাইরে উঁকি দিলাম কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না। তারপর দেখলাম রুমের বাইরে কিছুটা দূরে জেমি বসে আছে। বুঝলাম ও-ই পর্দা নাড়িয়েছে। রুমে ঢুকে গালে হাত দিয়ে আনহার কথাগুলো ভাবতে বসলাম। ভাবনার কোনো কূল কিনারা না পেয়ে পড়ার টেবিলে বসে পড়লাম। পড়া শেষ করে উঠলাম দশটা উনিশে। শয়তানটা বোধ হয় রাতের খাবারও অর্ডার করেছে। পড়ার মাঝেই একবার কলিংবেলের শব্দ শুনেছিলাম কিন্তু আমি দরজা খুলতে যাইনি। আজই আমার শান্তিতে বসে বসে খাওয়ার সমাপ্তি। কাল থেকে রাক্ষসটা আমার কী হাল করবে আল্লাহ্ জানে! আমি রুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম খাবার টেবিলে কোনো প্যাকেট নেই। রান্নাঘরে গিয়ে সেখানে পেলাম। খাবার বের করে বুঝলাম অনেকক্ষণ আগে দিয়ে যাওয়ায় ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমি খাবারগুলো গরম করে টেবিলে নিয়ে রাখলাম। কিন্তু আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। ভাবলাম মহারাজাকে ডাকব কি না। ওনাকে ডাকার ইচ্ছেও নেই আমার। বসার ঘরে ঢুকে টিভি ছেড়ে বসলাম। দেখার মতো কিছুই পেলাম না। একে একে চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে বিরক্ত হয়ে গেলাম। তাজ ভাইয়ার ডাক শুনে টিভি বন্ধ করে গিয়ে দেখি উনি প্লেটে খাবার বেড়ে বসে আছেন। বাব্বাহ্, এত উন্নতি কখন হলো! আমাকে দেখে উনি গম্ভীর মুখে বললেন,“খেতে বস।”

আমি স্বাভাবিকভাবেই বললাম,“আপনি খান। আমি খাব না আজ।”

উনি ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করলেন,“কেন?”

“ইচ্ছে করছে না।”

“চুপচাপ খেতে বস। কোনো কথা শুনতে চাই না।”

“বললাম না ইচ্ছে করছে না?”

কথাটা বলে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। উনি চোখের পলকে এগিয়ে এসে আমাকে টেনে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই উনি আমার প্লেট থেকে এক লোকমা খাবার তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিলেন। ওনার এমন কান্ডে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। সারাক্ষণ আমার সাথে ঝগড়া করে আর এখন জোর করে মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে! আমি না খেলে ওনার কী? আমাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি কড়া গলায় বললেন,“মুখ বন্ধ রেখে চুপচাপ খা। নইলে খবর আছে।”

আমাকে হুমকি দেয়, সাহস কত! আমি বললাম,“মুখ বন্ধ রেখে খায় কীভাবে?”

আমার কথা শুনে উনি নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। ওনার ঠোঁটের কোণে যে এক টুকরো মুচকি হাসি লেগে আছে তা আমার দৃষ্টিগোচর হলো না। উনি হয়তো ভেবেছেন আমি দেখিনি। ওনার সাথে আর ঝামেলায় না জড়িয়ে চুপচাপ কিছুটা খাবার খেলাম। খাবার শেষ করে টেবিল পরিষ্কার করে প্লেট আর বাটিগুলো নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। সেগুলো পরিষ্কার করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখলাম উনি এখনও একটা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ওনার পাশ কেটে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই উনি খপ করে আমার এক হাতের কব্জি ধরে ফেললেন। আমার বুকটা ধক করে উঠল। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকালাম। উনি আমার হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে গেলেন। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,“কী করছেন? হাত ছাড়ুন। রুমে যাব কী করতে?”

উনি আমার কথায় পাত্তাই দিলেন না। রুমে নিয়ে দাঁড় করিয়ে হাত ছেড়ে দিলেন। আমি রাগত কন্ঠে বললাম,“কী সমস্যা আপনার?”

উনি কোনো উত্তর না দিয়ে ওনার কাবার্ড খুলে কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন। আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার কান্ড দেখছি। উনি এভাবে টেনে নিয়ে আসায় আমার রাগ উঠে গেছে। তার ওপর আবার খারাপ চিন্তা ভাবনাও আসছে মাথায়। তাই ভয় ভয়ও লাগছে। আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম উনি কী করছেন। মিনিট দুয়েক পর উনি ছোট্ট একটা গোল বক্স হাতে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি বক্সটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম। উনি বক্সটা খুলে এক জোড়া চুড়ি বের করলেন। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম চুড়ি জোড়া খুবই সুন্দর! ডিজাইন দেখেই বুঝা যাচ্ছে এগুলো অবিবাহিতরাও পড়তে পারবে। কিন্তু এগুলো কার আর ওনার কাছেই বা কেন? আমি বিস্ময় নিয়ে চুড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আরো বিস্ময় বাড়ল যখন উনি হুট করে আমার বাঁ হাতটা টেনে নিয়ে চুড়ি জোড়া পরিয়ে দিলেন। আমার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না। আমি ফ্যালফ্যাল করে একবার নিজের হাতের দিকে আরেকবার ওনার মুখের দিকে তাকালাম। উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,“মায়ের খুব পছন্দের চুড়ি এগুলো। আমার কাছেই ছিল এতদিন। তার পুত্রবধূর জন্য যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। হাত থেকে যেন খুলতে না দেখি কখনও।”

কথাটা বলেই উনি আমাকে পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার পরপরই টিভির শব্দ কানে এল। হয়তো উনি টিভি ছেড়ে বসেছেন। আমি বিস্ময়ে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেলাম। হাতের দিকে হা করে তাকিয়ে সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। কী হয়ে গেল এটা! পুরো ব্যাপারটা যেন মাথার ওপর দিয়ে প্লেনের মতো চলে গেল। আনহার বলা কথাটা বারবার কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল,“উনি তোকে খুব পছন্দ করে।” হঠাৎ করেই আমার মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগল। মনে হলো আমি শারীরিক শক্তি আর বাকশক্তি দুটোই হারিয়ে ফেলেছি। সম্পূর্ণ নতুন এক অনুভূতি এসে জাদুর মতো ভর করল আমার ওপর। এবার আমার মনেও প্রশ্ন জাগল,“সত্যিই কি তাই?”

চলবে……………………?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here