#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:০৪
সারাদিনের সকল ক্লান্তি দূর করতে সূয্যিমামা পশ্চিম আকাশে ডুব মেরেছে। পুরোটা রাত বিশ্রাম নিয়ে আবার আগামীকাল সকালে নির্দিষ্ট সময়ে তার আগমন ঘটবে। এটাই তার নিয়ম। পৃথিবীটা কতশত নিয়মে ভরপুর। কেউ মানে তো কেউ এড়িয়ে যায়। যখন আম্মু বেঁচে ছিল তখন আমার জীবনে খুব কম নিয়মই ছিল। কিন্তু সে চলে যাওয়ার পর জীবনটা সম্পূর্ণ বদলে গেল। সত্যি, মা নামক মানুষটা না থাকা যে কতটা কষ্টদায়ক তা আমি এই আট বছরে হারে-হারে টের পেয়েছি। আট বছর আগে আমি নিজের হাতে তুলে খেতে পারতাম না, বেশিরভাগ খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেত। এখনও এমন হয় কিন্তু আজ আর তুলে খাওয়ানোর মানুষটা নেই। কোনো কোনো দিন বাবা সময় করে খাইয়ে দিতে চাইত কিন্তু আমিই না করতাম। আট বছর আগে আমার সব ড্রেস আম্মুর পছন্দে কেনা হত। অথচ আজ আমি মার্কেটে গেলে ড্রেস চুজ করতে বললে কনফিউশনে পড়ে যাই। আমার সুস্থতার, সব কাজের এমনকি চুলের যত্ন নেয়ার মানুষটা হারিয়ে গেছে আমার থেকে। এই আট বছরে অনেক চেষ্টা করেছি বাবার সাথে আনন্দে থাকার। অনেকটা সফলও হয়েছি। এভাবেই তো মানিয়ে নিতে শিখেছি আম্মুকে ছাড়া। ফুরফুরে মনে শহরটা ঘুরে দেখি না অনেকদিন। বাবা ব্যবসায়ী মানুষ, তার এত সময় কোথায়? তবুও তো মানুষটা যথাসাধ্য চেষ্টা করে সবদিক সামাল দেয়ার। একা মানুষ, কষ্ট তো তারও হয়। হয়তো আমার থেকেও বেশি। সেও তো নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়েছে আটটা বছর ধরে। ভালোবাসা! কথাটা মাথায় এলেই শ্রেয়ান ভাইয়ার কথাগুলো মনে পড়ে যায়। তাকে নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে জাগছে আমার। এমন একজন প্রেমিক এই প্রথম দেখলাম আমি। মানুষ কত বিচিত্র! গভীরভাবে ভেবে বুঝলাম নেহাল কোনোদিনই আমার যোগ্য ছিল না। ভালোবাসা তো দূর ওর প্রতি ভালোলাগা টুকুও এখন আর আসছে না আমার। তবে এটা ভেবে ভালো লাগছে যে ওর প্রতি আমার কোনো ভালোবাসা ছিল না। ও তো ভালোবাসার যোগ্যই না। এই ব্যাপারটা বুঝানোর জন্য তাজ ভাইয়া কিছুটা হলেও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু আমি তাকে ধন্যবাদ জানাব না। শয়তানটার দেমাগ বেড়ে যাবে তাহলে। আজ যদি আম্মু থাকত, তাহলে হয়তো ভালোবাসার মতো এত মূল্যবান একটা বিষয় বুঝতে আমি ভুল করতাম না। তোমার মেয়ে তোমাকে মিস করছে আম্মু।
“আলুর নেহালের জন্য এখনও কাঁদছিস?” তাজ ভাইয়ার কন্ঠস্বর শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালাম। সে আমার পাশেই রেলিং ঘেঁষে সামনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে জলপাই রঙের টি-শার্ট আর কালো ট্রাউজার। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে তাকে একদম অন্যরকম লাগছে। মন খুলে গল্প করার ইচ্ছে জাগছে তার সাথে। আমি মলিন হেসে দৃষ্টি সামনে রেখে বললাম,“ওর জন্য কাঁদার আর কোনো প্রশ্নই ওঠে না।”
তাজ ভাইয়া শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলেন,“তাহলে?”
তার কন্ঠ শুনে মনে হলো সে ঠিকই বুঝতে পারছে আমার কান্নার কারণ। তবু আমার মুখে শুনতে চাচ্ছে। একবার ভাবলাম চোখের পানিটুকু মুছে ফেলি। তারপর আবার কী ভেবে সেদিকে খেয়াল না দিয়ে বললাম,“সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষগুলো আমাদের জীবন থেকে কেন হারিয়ে যায় বলুন তো?”
তাজ ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন,“হারিয়ে গিয়ে তারা তাদের মূল্য বুঝিয়ে দেয়। এটাই তো নিয়ম।”
আমি উদাস ভাবে বললাম,“এই নিয়মের কারণে বাবাও হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে আম্মুর মতো। আমার কী মনে হয় জানেন? এই নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ আমি একদিন সম্পূর্ণ একা হয়ে যাব। একদম একা। আমার আশোপাশে থাকবে সব পূর্বপরিচিত বা সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ। কিন্তু আমাকে বুঝার মতো কেউ থাকবে না।”
“সেই একাকীত্ব ঘোচাতে কেউ একজন তো থাকবে।”
তাজ ভাইয়ার কথায় আমি মৃদু শব্দ করে হেসে বললাম,“সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা হারানোর কষ্ট মুছে দিতে পারবে?”
তাজ ভাইয়া নীরব দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়েই বললেন,“কিছুটা হয়তো পারবে। কিন্তু মানুষের জীবনে কিছুটা কষ্ট থাকতে হয়। কষ্ট না থাকলে সেটা অনুভব করার ক্ষমতা থাকে না। হাসে তো সবাই, কাঁদে কজন? তবে হাসির মধ্যেও কৃত্রিমতা আছে। পৃথিবীতে হাজারো মানুষ আছে যাদের কৃত্তিম হাসির নিচে পাহাড়সম কষ্ট চাপা পড়ে থাকে।”
আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাজ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। মানুষটার চিন্তা ভাবনা কত সুন্দর! কত গভীরভাবে চিন্তা করে! অথচ বাইরে থেকে তাকে দেখে তা বুঝার উপায় নেই। সবসময় যদি মানুষটা এরকমই থাকত তাহলে নিশ্চিত তার প্রেমে পড়ে যেতাম। তাজ ভাইয়ার কথায় ধ্যান ভাঙল আবার কিছুটা চমকেও উঠলাম। উনি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলেন,“তুই কি চাস তোর জীবনে এমন কেউ আসুক যে তোর কষ্টগুলো মুছে দিবে?”
উনি এমন প্রশ্ন করবেন বুঝতে পারিনি। কী উত্তর দিবো তাও বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে এমন একজন মানুষ কে না চায়? থাকলে তো ভালোই হত। কিন্তু আমি উল্টো প্রশ্ন করে বসলাম,“সব চাওয়া কি পূরণ হয়?”
উনি দৃঢ় কন্ঠে বললেন,“তুই চাইলে হবে।”
ওনার কথায় আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম,“কীভাবে?”
আমাকে অবাক করে দিয়ে তাজ ভাইয়া আমার চোখে চোখ রেখে দক্ষ প্রেমিকের মতো বললেন,“জীবন থেকে সম্পূর্ণ কষ্ট মুছে দিতে পারব কি না জানি না। তবে ভাগাভাগি করে চার ভাগের তিন ভাগ কষ্ট নিজের বুকে নিয়ে নিব। আর বাকি এক ভাগ অনুভূতি টুকু বুঝার জন্য রেখে দেবো। তাও যদি না পারি তাহলে প্রাণখোলা হাসির কারণ হব।”
কথাগুলো বলেই উনি ধীর পায়ে বেলকনি থেকে চলে গেলেন। আমি অবাকের উচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছি ইতোমধ্যে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে। ওনার কথাটা বোধগম্য হয়েও হচ্ছে না। কথাগুলো মনে মনে ভাবতেই কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভূতি হতে লাগল। অশ্রুসিক্ত চোখে আরও কিছু পানি এসে জমা হলো। এভাবে এতটা আবেগ মিশিয়ে কেউ কোনোদিন আমাকে এমন কথা বলেনি। কিছুক্ষণের জন্য আমি প্রচন্ড আবেগী হয়ে পড়লাম। কিন্তু পরক্ষণেই মাথায় এল উনি কি ইনডিরেক্টলি আমাকে প্রপোজ করলেন? না-কি ভাই হিসেবে কথাগুলো বললেন? মনে হয় ভাই হিসেবেই বলেছেন। উনি প্রপোজ করবে, তাও আবার আমাকে! ওনার সব আচরণই তো বলে দেয় আমাকে উনি সবচেয়ে বড়ো শত্রু মনে করেন। কিন্তু ভাই হিসেবে বললে আমার এমন অনুভূতি হচ্ছে কেন? আর তাছাড়া এভাবে কেউ প্রপোজ করে না-কি? আমার ফ্রেন্ডদের বয়ফ্রেন্ডরা যখন প্রপোজ করেছিল তখন তো শুনেছিলাম কত সুন্দর করে প্রপোজ করেছে। আজকাল ভাইরাও যে এমন আবেগ মিশিয়ে কথা বলতে পারে তা এই বিপজ্জনক লোকটাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার মাথায় এই প্রশ্নটা জেঁকে বসল যে এটা প্রপোজ ছিল না সান্ত্বনা? এর উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি একদমই শান্তি পাব না। মাথার মধ্যে পোকার মতো কিলবিল করতে থাকবে এটা। কিন্তু কীভাবে পাব? ভাবতে ভাবতে রুমে চলে এলাম। কান্না পুরোপুরি থেমে গেছে। বিছানার এককোণে জেমি ঘুমাচ্ছে। সারাদিন রাত যে ও কত ঘুমাতে পারে! ওর ঘুম দেখলে হিংসা হয় আমার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সন্ধ্যা সাতটা বাজে। সামনেই অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা। ইচ্ছে না থাকলেও পড়তে বসতে হবে। নইলে পরীক্ষায় আস্ত একটা কালো চশমা উপহার পাব। আর সেই চশমা চোখে দিয়ে সবার থেকে নিজের চক্ষুলজ্জা আড়াল করতে হবে। এসব উদ্ভট ভাবনা ভেবে বই খুলে বসলাম। জেমি মাথা তুলে তাকিয়ে আমাকে দেখে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে আমার পায়ের কাছে এসে লাফালাফি শুরু করে দিলো। এর অর্থ সে কোলে উঠতে চায়। আমি হেসে ওকে কোলে তুলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ও আমার কোলেই আবার ঘুমিয়ে পড়ল। আমি বইয়ের পাতায় চোখ রেখে মনে মনে পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছি না। তাজ ভাইয়ার কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ঝেড়ে ফেলতেও পারছি না। পড়ার মাঝে নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতে রাত দশটা বেজে গেল। এত সময়ের মধ্যে আমি বোধহয় এক ঘন্টাও পড়িনি। ভাবনা চিন্তায়ই পুরোটা সময় পার হয়ে গেছে। এখন ঘুমরাজ্যের সব ঘুম আমার চোখে নেমে এসেছে। বই খোলা রেখেই আমি ঝিমুতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর টেবিলে কেউ খুব জোরে থাপ্পড় মারল। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ঢোক গিলে ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলাম তাজ ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিরক্ত কন্ঠে বললাম,“আপনার কি আক্কেল জ্ঞান নেই তাজ ভাইয়া? ঘুমন্ত একটা মানুষকে এভাবে কেউ ভয় দেখায়?”
উনি ত্যাড়াভাবে বললেন,“আমি দেখাই। বই খুলে রেখে ঘুমাচ্ছিলি! তুই তো প্রচুর ফাঁকিবাজ। এই তোর চিন্তা ভাবনা কী রে? সারাজীবন আমার মামুর ঘাড়ে বসে অন্ন ধ্বংস করবি?”
এমনিতেই চোখে রাজ্যের ঘুম তারমধ্যে ওনার এই আজগুবি কথা শুনে মেজাজটা বিগড়ে গেল আমার। আমি রাগত কন্ঠে বললাম,“অন্ন ধ্বংস করি মানে কী? আমারই তো বাবা।”
“বুঝি বুঝি। তোর ঐ সাংঘাতিক মামু এসব কূটবুদ্ধি শেখায় তোকে।”
“এরমধ্যে আবার মামাকে টানছেন কেন? আপনি আসলেই একটা ফালতু লোক।”
“মামুকে জানাতে হবে তার মেয়ে কত বড়ো বেয়াদব। আট বছরের ছোটো হয়ে আমার সাথে কেমন দজ্জালের মতো আচরণ করে!”
“আপনি নিজে কী? জানেন আপনি ঠিক কতটা বিরক্তিকর লোক?”
তাজ ভাইয়া ভাব নিয়ে বললেন,“আমি জানি আমি খুব কিউট, সুইট অ্যান্ড হ্যান্ডসাম একটা ছেলে। সবাই এটাই বলে। তুই তো আমার সাথে শত্রুতা করে এসব বলছিস। তাতে কী? আই ডোন্ট কেয়ার।”
ভাব দেখে আমার গা জ্বলে উঠল। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,“আপনি যান তো তাজ ভাইয়া। ঘুমে আমি চোখ খুলে রাখতে পারছি না।”
তাজ ভাইয়া অবাক হয়ে বললেন,“বাড়িতে মেহমান থাকলে তাকে রাত দশটার মধ্যে ডিনার করাতে হয় এটাও জানিস না? রাত দশটা একত্রিশ বাজে অথচ আমার এখনও ডিনার করা হয়নি।”
আমি ভ্রুকুটি করে বললাম,“আপনি মেহমান?”
“তো কী? আমি জানতাম শ্বশুরের বাড়িতে জামাই অনেক আদরযত্নে থাকে। কিন্তু যে বাড়িতে তোর মতো একটা কুটনি আছে সেই বাড়িতে আদরযত্ন তো অমাবস্যার চাঁদের মতো।”
আমি মাথা চুলকে কথাটার আগামাথা ভাবতে লাগলাম। শ্বশুরবাড়ি মানে কী? উনি কি কোনোভাবে নিজের মামুকে শ্বশুর দাবি করছেন। তাহলে আমাকে কুটনি কেন বলবেন? আমার তো আরেকজন বোনও নেই। ধুর ধুর! এই লোকটার কথার আগামাথা শুধু জিলাপির প্যাঁচে ভর্তি। এসব ভেবে ভেবে পাগল হওয়ার কোনো মানেই হয় না। উনি হঠাৎ আমার মাথায় চাটি মেরে বললেন,“এসব বুঝা তোর কর্ম নয় রে মাথামোটা পিচ্চি। এইটুকু একটা মাথায় কতটুকুই বা বুদ্ধি ধরে?”
আমি রেগেমেগে বললাম,“বারবার বলেছি আমাকে মাথামোটা বা পিচ্চি বলবেন না।”
উনি আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন,“চল তাড়াতাড়ি। ক্ষুধা পেয়েছে।”
“তো গিয়ে খেয়ে নিন। আমাকে ডাকছেন কেন?”
“তুই খাবার বেড়ে দিবি তাই। তাছাড়া একা একা বসে খেতে ভালো লাগে না আমার।”
“তাহলে এ্যাসিস্ট্যান্ট রাখুন একটা।”
“ভালো কথা বলেছিস তো পিচ্চি। আজ থেকে তুই আমার এ্যাসিস্ট্যান্ট।”
আমি চোখ বড়ো করে বললাম,“আমাকে কি পাগলা কুকুর কামড়াইছে যে আপনার এ্যাসিস্ট্যান্ট হব? আর আমার টাকারও প্রয়োজন নেই যে এই চাকরি করব।”
তাজ ভাইয়া তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,“টাকা দেব কে বলল তোকে? তুই তো বাধ্য এই চাকরি করতে।”
আমি অবাক হয়ে তার দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,“কী?”
তাজ ভাইয়া বাঁকা হেসে বললেন,“ঐ চিঠি আর পিকটা যদি মামুর হাতে যায় তো কেমন হবে বল তো? আর তার থেকেও ইন্টারেস্টিং হবে যদি আমি পিকটা ভাইরাল করে দেই। তুই তো ফেমাস হয়ে যাবি রে এই অছিলায়।”
আমি শুকনো একটা ঢোক গিললাম। কী সাংঘাতিক লোক! যদি সত্যি সত্যিই এমনটা করে বসে তাহলে? না না, একে দিয়ে কোনো বিশ্বাস নেই। রিস্ক নেয়া চলবে না। আমি ভয়ে ভয়ে বিরক্ত মুখে বললাম,“আপনি এমন সাংঘাতিক লোক কেন বলুন তো? আমি জানতাম আপনি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করবেন।”
উনি আবাক হওয়ার ভান করে বললেন,“ব্ল্যাকমেইল কোথায় করলাম? আমি তোকে বাস্তবতা বুঝতে সাহায্য করলাম, মামুর হাতে চিঠি আর পিকটা দিলাম না। তোর এত-এত বড়ো উপকার করলাম আর তুই সামান্য এসিস্ট্যান্ট হয়ে আমার ঋণ শোধ করতে পারবি না? একেই বলে অকৃতজ্ঞ।”
আমি গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি এবার কিছুটা সিরিয়াস হয়ে বললেন,“হয় আমার এ্যাসিস্ট্যান্ট হবি নয় ওই চিঠি আর পিক মামুর হাতে যাবে আর নয়তো ফেসবুকে ভাইরাল হবে। যেকোনো একটা অপশন চুজ কর, ফাস্ট।”
আমি অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। তবু পাষাণটার মনে একটুও মায়া হলো না। উনি শয়তানি হাসি দিয়ে আবার বললেন,“নীরবতা সম্মতির লক্ষণ। তো আজ থেকে তুই আমার এ্যাসিস্ট্যান্ট। আমি যা যা বলব তাই তাই করবি। কোনো ঘাড়ত্যাড়ামি করলেই পানিশমেন্ট। দেটস ফাইনাল। এখন চুপচাপ এসে খাবার দে আমাকে।”
আমার উপর হুকুম জারি করে জাহাপনা ভাব নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি কটমট চাহনিতে তার চলে যাওয়া দেখলাম। ইচ্ছে হলো দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে ঘাড়টা মটকে দেই। কিন্তু এসব ভাবনা বাস্তব হবার নয়। তাই কাঁদো কাঁদো মুখে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। মহারাজ খাবার টেবিলে বসে ফোন চাপছেন। একবার তার দিকে তাকিয়ে আমি রান্নাঘরে চলে গেলাম। মারজিয়া খালা সন্ধ্যায়ই রাতের খাবার রান্না করে রেখে যায়। আমরা খাওয়ার সময় খাবার গরম করে নেই। একরাশ বিরক্তি নিয়ে খাবার গরম করে নিয়ে টেবিলে শব্দ করে রাখলাম। একটা প্লেটে খাবার বেড়ে ওনার দিকে ঠেলে দিলাম। উনি ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,“এসিস্ট্যান্ট হয়ে বসের সাথে কেমন বিহেভ করতে হয় শিখে নিস। প্রথমদিন বলে কিছু বললাম না। এখন বসে পড় ওই চেয়ারে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি?”
আমি রাগে দুঃখে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি একটা প্লেটে খাবার বেড়ে আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন,“আমি চাই না আমার খাবারের দিকে কেউ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকুক আর পরে আমার পেটব্যথা হোক।”
আমি বললাম,“আমি কখন আপনার খাবারের দিকে তাকালাম? ফালতু কথা বাদ দিয়ে চুপচাপ খান তো। আমার ক্ষুধা নেই।”
উনি হঠাৎ শক্ত মুখে বললেন,“খাবি না-কি আমি এই সব খাবার একসাথে তোর মুখে পুরে দিবো?”
আমি বিরক্তি নিয়ে খাবার মুখে দিলাম। উনিও খেতে খেতে বললেন,“প্রথমদিন তুই আমাকে একটা মিথ্যে বলেছিলি যে তুই সন্ধ্যায় ডিনার করিস। অথচ তুই তো রাত দশটার আগে একদিনও ডিনার করিস না। মিথ্যাবাদী প্রমাণ হলি। আর কত রূপ যে বের হবে একে একে!”
“আমার সেদিন খেতে ইচ্ছে করেনি তাই এটা বলেছি। কারণ বাবা শুনলে আমাকে জোর করে খাবার টেবিলে বসিয়ে দিত। এখন আপনি নিজের খাবার খান তো ভাইয়া। আপনার কথা অসহ্য লাগছে আমার।”
আমার কথায় তাজ ভাইয়া কিছু একটা ভেবে বললেন,“এই, তুই আমাকে আর ভাইয়া ডাকবি না।”
আমি ভীষণ রকম অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,“ভাইয়াকে ভাইয়া ডাকব না তো কী ডাকব?”
উনি বিদ্রুপ করে বললেন,“তোর মতো মাথামোটার ভাইয়া হওয়ার অত শখ নেই আমার। ভাইয়া ডাকলে মনে হয় যে নিজের আপন বোন ডাকছে। তুই তো আমার আপন বোন হওয়ার যোগ্যই না। তার চেয়ে বরং ভাই ডাকিস। তাহলে মনে হবে আশেপাশের কোনো একটা মেয়ে এমনিতেই মানবতার খাতিরে ভাই বলে ডাকছে। যদিও তোর মধ্যে মানবতারও অভাব আছে। তাও ভাই ডাকার পারমিশন দিলাম।”
আমি ওনার কথা শুনে হা হয়ে গেলাম। এমন গাঁজাখুরি কথাবার্তা আমি জীবনে এই প্রথম শুনলাম। ভাইয়া আর ভাইয়ের মধ্যে আজগুবি পার্থক্য। ওনার মুখের উপর তো জাতীয় পদক ছুঁড়ে মারা উচিত।
চলবে…………………?
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্প পড়ে নিজেদের মন্তব্য প্রকাশ করবেন। ধন্যবাদ।)