তারকারাজি- (১৫)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
|| দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ||
ত্রিশটি ঘন্টা অন্তরে চাপা উন্মত্ততাতেই চারবন্ধু মিলে সানামকে ধরে-বেঁধে নিয়ে হাজির হলো মিশমির কেবিনে৷ তখন রাত্রি আটটা। ঝুমুর বেগম ঠিক রাত ন’টায় উপস্থিত হবে জেনেও নিজেদের অতি গুরুত্বপূর্ণ, নিগূঢ় কথাটি নিয়ে এখানেই আলোচনাসভা বসাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারকারা। এ-অবধি সকল বন্ধুরা ছাড়া তাদের তারকারাজির বৈঠক কখনো বসেছিল না-কি? হ্যাঁ, ঈশাকে নিয়ে বসেছিল যেখানে অতীব প্রয়োজনেই বাদ দেওয়া হয়ছিল দুই যমজ ভাইকে। তবে ওইটাই হয়তো প্রথম ছিল!
মিশমির বিছানায় সানামকে বসিয়ে বাকি চারজন চারটি স্তম্ভের মতোই দাঁড়িয়ে পড়ল তার সামনে। সানাম বিস্ময়ে হতবিহ্বল! ঝড়ো হাওয়ার মতো সাঁইসাঁই করতে লাগল তার মন। নিশ্চিত সাংঘাতিক কিছু ঘটে গিয়েছে বলেই বন্ধুদের এরূপ গম্ভীরতা। সানাম আঁড় চোখে একবার মিশমির দিকে তাকাল। তাদের পক্ষাঘাতগ্রস্ত বান্ধবীটা নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। আশেপাশের যন্ত্রপাতিও জানান দিচ্ছে যে, সে বেঁচে আছে। তাহলে সাংঘাতিক ঘটনাটা কী ঘটল? মনে প্রশ্ন জাগতে না জাগতেই পিহু তার হাত দুটো খপ করে মুঠোবন্দী করে নিল। সানাম এখনও আতঙ্কগ্রস্ত আঁখি জোড়া মেলে তাকিয়ে আছে বন্ধুদের দিকে। কিন্তু সে রণরঙ্গিণী ভাবমূর্তি তখন ধারণ করল যখন পিহু তার হাত দুটো তার-ই ক্যামেরার উপর রেখে শান্ত কণ্ঠে বলতে আরম্ভ করল,
“ বল— যা বলিব সত্য বলিব, সত্য ছাড়া মিথ্যা বলিব না। তোর আর সাইফ ভাইয়ের মধ্যে কী চলে হেইডা সত্যি সত্যি বলে দে। না-হলে তোর ক্যামেরা এই জীবনে আর অন হবে না, বলে দিলাম। ”
এই প্রথমবার… বন্ধুদের সাথে এই প্রথমবার সানাম অজানা কোনো কারণে আকাশচুম্বী গম্ভীরতা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় থাকার পর যখন পিহুর মুখ থেকে এরূপ কথা শুনলো, তখন দেয়ালে মাথা ঠুকে দুঃখ প্রকাশ করার ভাবনাটাই আগে এলো তার মনে। সে সটান উঠে দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
“ তোদের ড্রামা দেখে মনডা চাইতাছে দেয়ালে মাথা ঠুকাই। কার মাথা আগে সামনে দিবি বল খালি। ”
তার কথায় কারো বিশেষ কোনোকিছু অনুভূত হলো বলে মনে হলো না। বরং নীলাশা তার দু’বাহুতে চাপ দিয়ে পুনরায় বসিয়ে দিল পূর্বের স্থানেই। স্বাভাবিকভাবেই দারুণ উত্তেজনা নিয়ে একই প্রশ্ন করল সে। সেই সাথে বলল— তারা তাদের দু’জনকে একসাথে রিকশায় বসতে দেখেছে। কোথায় গিয়েছিল তারা? তাদের মধ্যে যখন অন্যরকম একটা সম্পর্কই আছে তো কেন এতো নাটকীয়তা? এই দুটো প্রশ্নেই থেমে গেল না বন্ধুগণ। নিশান তাদের ভার্সিটি জীবনের শুরু থেকে সানাম ও সাইফের বিতণ্ডাগুলো বিশ্লেষণ করছে আর বাকি তিনজন তার-ই প্রেক্ষিতে কৈফিয়ত চাইতে উঠেপড়ে লেগেছে। সানাম উচ্চবাচ্যে বলে উঠল,
“ ধুরু বা*! পুরানা কাসুন্দি না ঘাঁটলে তোদের শান্তি হচ্ছে না? ”
পিহু বলল, “ তার মানে তোরা পুরানা সব কথা ভুলে নিউলি সবটা স্টার্ট করতে চাচ্ছিস? এতো দূর চলে গেলি অথচ আমাদের জানাইলিও না? তুই জানিস না— বিশ্বাসঘাতকতা করেই মীরজাফরের পতন হইছিল? তাও তুই মীরজাফরি করতে পারলি? তোর আত্মা কাঁপল না নিজের মানুষদের এভাবে ধোঁকা দিতে? ”
সানাম কপালের সমান্তরাল ভাঁজ দুটোকে গভীরতায় ফুটিয়ে তুলল। প্রচুর বিরক্তিতে চ-এর মতো অনর্থক শব্দ উচ্চারণ করতেই পিহু ফের বলে উঠল,
“ চুম্মা-চাম্মিও শেষ করে ফেলছিস? এত্তদূর…? ”
সানাম আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে পিহুর গালে এক দানবীয় থাপ্পড় বসিয়ে দিল। মেজাজটা তার এমনিতেও খুব খারাপ! সে গড়গড়িয়ে বলতে লাগল,
“ তোরে আমি কইছি আমরা রিলেশনে আছি? লাথি মেরে চ্যাপ্টা বানায় দিব, ফাজিল মাইয়া। ওর কাছে আমার ক্যামেরার মেমোরি কার্ড ছিল আর সেইটাই দেওয়ার জন্য আমারে ডাকছে। আর তোরা? কী সুন্দর যোগ, গুণ করে ফেলছিস। ”
রিশান তিক্ত কণ্ঠে বলল, “ তোর কি আমাদের ছাগল মনে হয়? তোর মেমোরি কার্ড ভাইয়ের কাছে যায় ক্যামনে? আর মেমোরি কার্ড দেওয়ার হইলে রিকশার মধ্যে উইঠে দেওয়া লাগে? সত্যি করে বল তোদের মধ্যে খালি রিকশাই চলে না-কি টেম্পুও চলতাছে? ”
সানাম উত্তর দিবে তার আগেই নীলাশা প্রশ্ন করল,
“ এই টেম্পু না ট্রামগাড়ির নাম? ”
নিশান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। এমন চঞ্চল পরিবেশে নীলাশার প্রশ্নটা গায়ে জ্বালা করার মতোই ছিল। সে বিরক্তিতে পরিপূর্ণ তীর্যক চাহনি নিক্ষেপ করে বলে উঠল,
“ আমি তো ভাবছিলাম তুই বড়লোক। তুই দেখি আমার থেকেও ফইন্নি! ফোনেত কি এমবি নাই? গুগলে সার্চ না মেরে হুদাই কান খাস ক্যান? তুই হইলি কুত্তার লেঙ্গুড়। ব্রিটিশ থেকে আর বাঙালি হইতে পারবি না যেইরকম কুত্তার লেজ আরএফ… ”
কথা সমাপ্ত করার আগেই রিশান মেকি হেসে বলল,
“ আরএফএল পাইপের মধ্যে ঢুকাইলেও সোজা হয় না, তাই না ভাই? এখন আসল কথায় আয়। ”
রিশান এবার সানামের উদ্দেশ্যে বলল,
“ ঠোঁটপালিশ? ঠিকঠাক উত্তর দে আমার প্রশ্নের। না হইলে কিন্তু টুঁটির মধ্যে পাড়া মেরে ধরমু। ”
নীলাশা আবারও প্রশ্ন জুড়ে দিল তখন যে, টুঁটি কী জিনিস। তার উত্তরে অবশ্য আরেক দফা ঝাড়িও খেল সে। তাদের এই নিয়ে বিরক্তির শেষ নেই! অতঃপর সানাম বলে দিল আসল কথা। গতকাল সত্য অর্থেই সাইফ সানামকে ডেকেছিল তার মেমোরি কার্ড ফিরিয়ে দিতে যা ক্যামেরা ভাঙার সময়-ই সেদিন পকেটে তুলে রেখেছিল সে। ঠিক কেন সেই মেমোরি কার্ড নিজের কাছে রেখেছিল তা না-কি মনে নেই সাইফের। তবে বহুদিন বাদে তা হাতের মুঠোয় পাওয়ায় ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেছিল সে। মেমোরি কার্ডটা সানামের নিজের জন্যও ছিল বিশেষ কিছু। হারিয়েছে ভেবে যতটা মর্মযন্ত্রণায় ভুগছিল সে, কাল ফিরে পাওয়ার আশা দেখে তার থেকেও বেশি সুখানুভব হচ্ছিল তার৷ তাই নিজের চাচার বাসায় যাওয়ার পূর্বে তা হাসিল করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু সাইফ না-কি তা আনতে ভুলে গিয়েছে। অফিসে নিজের ডেস্কে রেখে এসেছে বলেই সানামকে নিজের সাথে অফিসে যেতে বলেছিল তখন। সানামও রিকশায় উঠে পড়েছিল তার সাথে। কিন্তু চলার পথে হঠাৎই রিকশা থামিয়ে সাইফ জানায় যে, তার মনে পড়েছে— মেমোরি কার্ডটা আসলে তাদের ভাড়া করা বাসায় রাখা আছে, অফিসে না। সে না-কি নিশান-রিশানদের কাছেই তা পাঠিয়ে দিবে আজ। আর উল্টোপথে এতটা যখন নিয়েই এসেছে সানামকে তখন সানামকে তার চাচার বাসায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও না-কি তার! সানাম অবশ্য স্বনির্ভরশীল নারীর মতোই প্রতিবাদ করে চলে এসেছিল সেখান থেকে। ঝগড়াও করেছিল। অতঃপর আজ সকালেই সাইফ তাকে কল করে বলেছে যে, সে না-কি নিশানদের কাছে ওই মেমোরি কার্ডটা দিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছে। অনেক সকালে উঠে ভার্সিটিতে এসেছে কি-না! এই নিয়েও সকাল-সকাল আরেক দফা বাকবিতণ্ডা লেগেছিল তাদের মাঝে এবং এটাই হলো সমস্ত ঘটনার আসল সারাংশ।
কিন্তু এই সহজ, সাবলীল সারাংশটি বোধহয় পছন্দ হলো না কারো। পিহুকে এক উদ্ভট মুখভঙ্গিমায় প্রশ্ন করতে দেখা গেল,
“ অ্যাহ? আমরা কতকিছু ভাবলাম আর তুই কি-না এই গপ্পো শুনায় দিলি আমাদের? ”
সানাম উত্তরে মেকি হাসল কেবল। পিহুদের অপ্রতিরোধ্য উত্তেজনা নিমিষেই ক্ষয়ে গেল, মিইয়ে গেল মুখ। তবে নিশান স্পষ্ট দাবি জানিয়ে বলল,
“ অসম্ভব! তুই বললি সাইফ ভাইয়ের সাথে কালকে ঝগড়া করেই তুই তোর চাচার বাসায় চলে গেছিস। তাও যে-সে ঝগড়া না তুমুল ঝগড়া! তার পরেও সাইফ ভাই সক্কাল-সক্কাল তোরে ফোন দিল জাস্ট এইটাই বলতে যে, হেতি আমাদের মেমোরি কার্ড দিতে ভুলে গেছে? ক্যান, তুই আমাদের জিগাইলে কি আমরা কইতাম— ভাই আমাদের কার্ডটা দিছে? আর এতো ঝগড়ার পর তো তোরে কার্ডটা ফেরত দেওয়ার-ও কথা না, তাহলে তোরে ওইটা ফেরত দেওয়ার জন্যে উইঠে-পইড়ে লাগল ক্যান? ভাই তো এতো ভালা মানুষ না! ”
এই কথাটা সানামের জানা। আপন মনে যে অনেক কিছুই বুঝে গিয়েছে তা আর প্রকাশ করল না সে। তবে নীলাশা হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে উঠল,
“ তার মানে কি ওইদিক থেকে সামথিং-সামথিং আর এইদিক থেকে নাথিং-নাথিং? ওই সানাম, ঠিক করে বল তো বিষয়টা আসলে কী? একদম ন্যাকামি করবি না। ”
সানাম কেমন অস্থিরতায় আশেপাশে তাকাল। অতঃপর কুজ্ঝটিকাচ্ছন্ন ঝাপসা উত্তর দিল,
“ আমি মানুষের মনের কথা জানি না-কি? সেইটা তো ওই ফালতু লোক-ই বলতে পারবে। বাট আমি আমার দিক থেকে একদম ক্রিস্টাল-ক্লিয়ার। অবশ্যই নাথিং-নাথিং! আমার শুধু মেমোরি কার্ডটা চাই। নিশান? রিশান? যে করেই হোক তোরা কার্ডটা এনে দিবি৷ এই অভদ্রলোক ব্যাপক ঘাইরা! ওর উপ্রে এতো বিশ্বাস নাই আমার। কী-জানি কখন কী করে ফেলবে কার্ডটা নিয়ে।”
সানামের কথা শুনে নিশান আর রিশান কেমন অদ্ভুত চাহনিতে একে-অপরের দিকে তাকাল। সেই তামাশাভরা চাহনিতে দুই ভাই ঠিকি বুঝে নিয়েছে একে-অপরের করণীয়। তবে পিহু দমে গেল না। সে সানামকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল যে, সে যতই ‘নাথিং নাথিং’ করে উড়িয়ে দিক না-কেন! সানামের মনে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে যার জন্য গতকাল বিনা বাক্য ব্যয়ে সে সাইফের সাথে চলে গিয়েছিল। নইলে তাদের সানাম কি এতই বোকা যে, ডাকল আর চলে গেল? তবে সানাম তা মানল না। তার যাওয়ার কারণ স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে সে, তাহলে এখানে তো আর কোনো কথা থাকবার কথা নয়? পিহু মিশমির দিকে উবু হয়ে গেল এবার। তর্জনী তুলে শাসানির স্বরে বলল,
“ মিশ্শি? শুনলি তো সবকিছু? সানাম কিন্তু বলছে— ও সাইফ ভাইরে জীবনেও ভালোবাসবে না। এরপর যদি কোনোদিন ও আমাদের সাইফ ভাইয়ের প্রেমে পড়ে যায় তাহলে তুই কিন্তু থাপড়ায়ে ওরে প্যারালাইজড করে দিবি। কী কইলাম বুঝছোস? ”
মেয়েটি স্তব্ধ থাকল বরাবরের মতোই। কিন্তু নিশান নিজের গালে হাত রেখে বলল,
“ ভাবা গো ভাবা, এই ছেড়ির হাত না তো যেন আম্বুজা সিমেন্ট! একটা থাপ্পড় খাইয়েই সাধ মিটে গেছিল আমার। ”
সানাম বিস্ময়ের স্বরে প্রশ্ন করল, “ তোরে মিশা থাপ্পড় মারছিল? ক্যান? ”
রিশান ফিক করে হেসে ফেলল। বলল, “ কলেজে থাকতে এক মেয়েরে প্রপোজ করতে গিয়ে মিশারে প্রপোজ করে ফেলছিল নিশান। পিছন থেকে তো আর বুঝে নাই ওইটা আমাদের মিশা! পরে মিশা সেই রকম এক থাপ্পড় দিয়ে শাবানা মার্কা ডায়লগ দিছিল, ‘এই তোর ফ্রেন্ডশিপের নমুনা? ’ তোর মনে আছে, নীল? ”
রিশানের মিশমিকে নকল করা দেখে বন্ধুদের মতো নীলাশাও হেসে সম্মতি জানালো যে, তার মনে আছে। নীলাশা আরও বলল,
“ বাট এই শাবানাটা যেন কে? আমাদের কলেজে পড়তো কি? ”
সবাই চোখ বড়-বড় করে তাকাল নীলাশার দিকে। আজ কথায়-কথায়ই ভীষণ জ্বালাচ্ছে এই মেয়েটা। নিশান নীলাশার দিকে রাগান্বিত নজরে তাকিয়ে, শার্টের হাতা গোটাতে লাগল। ভাবটা এমন করল যেন এক্ষুনি নীলাশার খুলিটা উড়িয়ে দিবে সে। তার এমন ভঙ্গিমা দেখে নীলাশাও বুঝে গেল যে, সে ভুল কিছুই বলেছে। পরমুহূর্তেই কিছু মনে পড়াতে সে ভীষণ তাড়াহুড়োয় বলে উঠল,
“ ওহ, হ্যাঁ। বুঝছি, বুঝছি, বুঝছি। তোরা তোদের বাংলা সিনামার এক্ট্রেসের কথা বলতাছিস, তাই না? এর আগেও তো তাকে নিয়ে কী যেন বলছিলি। ”
নিশান তেতে উঠল বান্ধবীর কথা শুনে, “ কী কইলি তুই? তোদের বাংলা সিনামা মানে? তুই শালা কোন জাতি থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসছোস এখানে? ব্রিটিইশ্শার বাচ্চা, কুত্তার লেঙ্গুড় তুই ডেঙ্গুতে মরবি। তুই এইদেশের শত্রু। ভেগে যা এই দেশ থেকে। ”
নীলাশা মুখ কালো করল, “ বাংলাদেশে এমনিই তো ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে আর তুই এমন বদদোয়া দিলি আমাকে? তোরা বন্ধু নামে কলঙ্ক। ধুর! ”
কথাটা বলেই তুমুল আক্রোশে ফেটে পড়া নীলাশা সেই পুরনো অভিমানিনীটির ন্যায় বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। এদিকে নিশানরা সকলেই এই তুচ্ছতম কারণে হেসে কুটিকুটি হয়ে গেল। কতদিন পর এই মেয়েটাকে ‘ব্রিটিইশ্শা’ বলে ক্ষ্যাপানোর সুযোগ হলো তাদের! বন্ধুদলটা যেন নব যৌবনার দিনগুলোর মতোই উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা হলো মুছে যাওয়া ঠাট্টা-তামাশার স্মৃতিতে৷ তখন মুখে ঝলক দেওয়া হাসি রেখেই সানাম একবার আঁড় চোখে তাকাল মিশমির নিষ্ক্রিয়, থমথমে, মলিন মুখটির দিকে। নীলাশার মতোন বন্ধুদের প্রতি অনুভূতি প্রকাশ করাতে সানামের লজ্জার শেষ নেই! বাবা-মাকে ভালোবাসার পরও তা বলার সুযোগ পায়নি মেয়েটি। তার চাচাতো ভাই রাহাতকে এতো ভালোবাসার পরও তা কোনোদিন প্রকাশ করা হয়নি। অথচ বন্ধুদের ভালোবেসে খুব সহজেই তা প্রকাশ করা কি সানামের কাছে মুখের কথা? এইযে মিশমিকে ভালোবেসে তার কতো বিনিদ্র রাত গেল কান্নায় গলা শুকিয়ে ফেলার, তা তো পিহুও কখনো এক ঘরে থেকে টের পায়নি! সানামের হঠাৎ করেই মনে হলো— আজ মিশমি সুস্থ থাকলে কী করতো? নিশ্চয়ই নীলাশাকে এমন কথা বলায় তার অভিব্যক্তি হতো,
“ তোরা কেন শুধু-শুধু ওর পিছে লাগিস? আর এই ডেঙ্গু হওয়ার কথাটা বলার দরকার ছিল কোনো? পরে দেখবি ভয়ের চোটে মশারির ভিতর থেকেই বের হচ্ছে না, নীল৷ এমন করে বলার কোনো মানে আছে? আম্মুর কাছে শুনছিলান— অনেক ভয় পেলে না-কি মানুষ মারা যায়। আর তোরা এটা করতে পারলি? ”
কথাটা মনে হতেই সানাম আপন চিত্তে হাসল। আরেকটু উঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল— বন্ধুদের এতো রঙঢঙের আলাপ-আলোচনায় এই শয়নরত মেয়েটাও একটু হাসল কি-না। ঠোঁটের কোণা দুটো কি একটু বেঁকে গেল? সানাম খুব ভালো করে খেয়াল করল। না, বাঁকেনি একটুও। মিশমি সেই আগের মতোই অনড়, পাথুরে, নির্বাক। এইযে ছয়টা মাস ইনিয়ে-বিনিয়ে চলে গেল, মিশমি কেন এখনও হয়-না স্বাভাবিক? ও কি শুনতে পায় না ওর অপেক্ষমাণ বন্ধুদের ডাক? ও তো অনুভব করতে পারে সব। ওর হৃদয়ে কি তবে সত্যিই আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে, বন্ধুদের হাতে হাত রাখার কোনো তাড়া নেই? এতোটা নির্দয় তো মিশমি ছিল না!
#চলবে ইন শা আল্লাহ!
(গতকাল রাতে হঠাৎই এক পাব্লিক গ্রুপে নিজের নাম সার্চ দিয়ে দেখলাম যে, প্রকৃত অর্থেই আমার কোনো সাপোর্টার আছে কি-না। আর তা দেখে আমি অবাক! অনামিকা আপু, সারাহ্ সানাম আপু সহ অনেকেই আমাকে স্ব-ইচ্ছায় সাপোর্ট করেছে খুব। ধন্যবাদ আপনাদের পাঠক)