তারকারাজি- (১০)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
|| দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ||
|| প্রথমাংশ ||
নভেম্বরের ধোঁয়াশাময় গোধূলিতে অত্যন্ত নীরবে নিজের হলের দিয়ে হেঁটে চলছে সানাম। গতকাল বৃষ্টি হওয়ায় প্রকৃতিতে বর্ষা ও শৈতের মিশ্র আমেজ পরিলক্ষিত। কেমন একটা সতেজ ঘ্রাণ চারিপাশে! ক্ষীণ কুয়াশার আস্তরণ মুকুট বেশে স্থির হয়েছে গাছ-গাছালির শীর্ষ শাখায়। সানাম সেই সারি-সারি জীর্ণ গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বিলম্বে পলক ফেলে নিল একবার। ছবি তোলার মতো মনোমুগ্ধকর কিছুই নেই ওতে! অথচ লাল টুকটুকে ঠোঁট জোড়ার টিয়া পাখিটি কোত্থেকে যেন উড়ে এসে জবুথবু হয়ে বসে আছে ভীষণ আনন্দে। সানাম কি তা খেয়াল করেনি? না-কি তীক্ষ্ণ ভর্ৎসনায় সুন্দরী টিয়াকে অনাহূত ভেবে, মুখ বাঁকিয়ে অপমান করে গেল মেয়েটি? হতে পারে! কিন্তু এই অতিশয় চঞ্চল মেয়েটি যে আজ প্রচণ্ড ধৈর্যচ্যুত হয়ে উঠেছে তা তার প্রতিটি পদভারের খটখটে, বিদঘুটে আওয়াজটি-ই যেন সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে অনবরত। তখন কল এলো। নরম আওয়াজে ফোনটির বেজে ওঠাতেও যেন সে দারুণ বিরক্তির কারণ খুঁজে পেল। নিশান কেন ফোন করছে আবার? সানাম সংযোগের ডাকে সাড়া দিতেই ওপাশ থেকে ধমকের আওয়াজ এলো,
“ ওই শালি আবাল! ফোন তুলোস না ক্যান রে? ”
সরব সানাম চমকে ওঠার চেষ্টা করল। দুর্বল কণ্ঠেই নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
“ বেদ্দপ ছ্যাঁড়া! তুই কল কয়বার দিছোস যে, আমারে এই প্রশ্ন করোস? ”
ওপাশের নিশান বোধহয় খানিকটা থতমত খেয়ে বলল,
“ ওই হইলো একটা! কিন্তু রিং তো হইছে চারবার? ওইটার হিসাব রাখছো ময়না? আর আমি তোর সাথে ক্যান কথা বলতাছি? তুই পিহুরে দে। ওরে আমি লাইনে পাইতাছি না। ”
নিশান হয়তো সংযোগের ওপাশে থেকেই আশা করেছিল যে, তার বান্ধবী সানামটা মুহূর্তেই রণরঙ্গিণী রূপ ধারণ করে, নিজের ঝাঁজালো বাণীতে পরাজিত করবে তাকে। কিন্তু না… সানাম কেমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
“ আমি ওর কাছে নাই, বাইরে আছি। যাইতাছি হলে। ”
সানামের এহেন স্বাভাবিকতা বোধহয় কাবু করতে পারেনি নিশানকে। বরং নিশানকে ম্রিয়মাণ বেশে বলতে শোনা গেল,
“ পিহুর হইছেডা কী, বল তো? ফোন-টোন বন্ধ করে এতো ঢং কারে দেখাইতাছে ও? আমার মনডায় চায় ওরে ঠাসঠাসি কয়েকডা থাপ্পড় মাইরা দেই। বিরক্তিকর! এর জন্যই এইরকম ন্যাকা মানুষদের আমার সহ্য হয় না। ধুর! ”
“ ইশ! কেন ওইভাবে বলতাছিস তুই? ”
“ বন্ধু হয়ে বন্ধুরে দাম না দিলে কেমন লাগে বল? ”
চলার পথে অটল থেকে ভীষণ নরম কণ্ঠে বলল সানাম,
“ জানিস-ই তো ওর লাইফে কী চলতাছে? সেই তিন মাস আগের কথা…! আদ্রাফ ভাইয়ের দাদি অসুস্থ দেখে, পিহুর ইয়ার চ্যাঞ্জিং এক্সামের পর এনগেজমেন্টের অ্যারেঞ্জমেন্ট করে ফেলছিল। মাঝখান থেকে মিশাটার যা অবস্থা হলো…! ”
সানামের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা তপ্ত শ্বাসটা মুহূর্তেই শীতল হাওয়ার সাথে মিশে গেল। সে আবারও বলল,
“ জানিস? মিশাও বলছিল যে, পিহুর এনগেজমেন্টে নাকানিচুবানি খেয়ে হলেও আন্টিকে রাজি করাবে যাতে ওরে ময়মনসিংহে, পিহুর এনগেজমেন্ট পার্টিতে থাকতে দেয়৷ আমরা সবাই না-কি সেদিন আকাশী শাড়ি পরব আর পিহু গাঢ় নীল। সেদিনও আমরা পিহুর রিং পড়ানোটাকে কাজে লাগিয়ে টাকা আদায় করব আদ্রাফ ভাইয়ের থেকে— বলছিল ও। এতো এতো চিন্তা-ভাবনা করা মেয়েটাকে দেখ; শুয়ে আছে হসপিটালের বিছানায়। আর এইদিকে ওর জন্য… শুধুমাত্র ওর জন্য ওয়েট করে পিহু, আদ্রাফ ভাই আর ওদের ফ্যামিলিতে ঝামেলা হইতাছে। এগুলা কি ওর খুব ভালো লাগতাছে? ওই কি এমনি-এমনি ডিপ্রেশনে আছে বলে তোর মনে হয়? আসলে কী জানোস, দোস্ত? আমাদের জীবনটা খুব কঠিন। এখানে তুই ইমোশমরে সায় দিলে লজিক্যালিটির প্রশ্ন আসবে আবার লজিক্যালিটিরে সায় দিলেও ইমোশনের হত্যাকারী হইতে হবে। দিস ইজ নট ফেয়ার! ”
নিশানের দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেল সানাম। কথা হলো আরও অনেক। পৌঁছে যাওয়া হলো নিজেদের হলের বরাদ্দকৃত ঘরটিতে। পিহুকে আগা-গোড়া কম্বল মুড়িয়ে, জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে সানামের মুখটাও কেমন মলিন হয়ে এলো। সংযোগ স্থাপন করে স্মরণে আনল গত তিনটি মাসের ঘটনা। বান্ধবীর আত্মহত্যার চেষ্টা যেন এক নিমিষেই আগ্নেয়গিরির ছিন্ন-বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকা লাভার মতো করে তুললো জীবনটাকে।
হাস্যোজ্জ্বল পিহুর মাঝে কৌতুকপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটা ধীরে ধীরে কয়লার খণ্ডে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। নিজের বাগদানে শুধুমাত্র নিজের বান্ধবীর জন্য দেওয়া বাঁধাটা মেনে নিতে সানামদেরও খুব অদ্ভুত লাগে, পাগলামো মনে হয়। কিন্তু অন্তঃস্থলে জমা বাষ্পের মতো কোমল অনুভূতিটাকে কি সহজেই বোঝানো যায়— ওটা শুধুমাত্রই তাদের বান্ধবীর আবদার ছিল, তেমন বিশেষ কিছু নয়! সানামও পারে না তা ‘সামান্য’ ভেবে উড়িয়ে দিতে। তাহলে পিহুর কী দোষ এখানে? ওদিকে নিশান আর রিশানটার-ও আজকাল ব্যস্ততার শেষ দেখা যাচ্ছে না। সেই তো টিউশনি-ই করছে! তবুও তারা নিত্যদিনের যান্ত্রিকতায় কঠোরভাবে বদ্ধ। যতটুকু সময় দেওয়ার তা উজাড় করেই দেয়। তবুও মন কি মানে, বন্ধনের সুতো ছিঁড়ে দূরত্বকে আরো বাড়তে দিতে? তা যে একবার বেড়ে গেলে সহজে ঘুচে না…!
আর এই দূরত্বের সুতোই যখন নিজে অসুখী তখন সুখী কী-করে রাখবে তারকারাজির মহলটিকে? নীলাশা নামক সুতোটা যে অকারণেই বড্ড বেশি অসুখী…!
চব্বিশ ঘণ্টা হসপিটালের কেবিনে থেকে ওই পক্ষাঘাতগ্রস্ত মিশমির পক্ষে দিন আর রাতের পার্থক্য করাটা কতটা সম্ভাবনীয় তা উপলব্ধি করতে পারে না নীলাশা। এইযে এখন নিকষ কালো নীলচে আঁধারের আকাশটার বুকে শুধুমাত্র শুকতারাটা ক্ষীণ জ্বলে জানান দিচ্ছে তার নিঃসঙ্গতা, তা কি মিশমি আদৌ জানে? না, সে জানে না হয়তো। কিন্তু নীলাশা ঠিকি উপলব্ধি করতে পারে নিজের অস্থিরতা। এই রাত্রির আঁধারে অত্যন্ত নীরবে মিশমির কাছে আসাটা নীলাশার জন্য নতুন নয়। নীলাশা এসে যখন মিশমির পাশে বসল তখনও মিশমি তার আরশিতুল্য স্বচ্ছ চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ। নীলাশা ক্ষীণ হাসল। মিশমির মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“ আব্বে আমি এখানে। তুই ঐদিক কী দেখোস সারাক্ষণ? ”
কিন্তু মিশমির মাথাটা পুনরায় ঘুরে গেল আগের অবস্থানে। নীলাশার দীর্ঘশ্বাস শোনার রইল না কেউ। তবুও মিশমির সাথে এটা-ওটা বলে তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালালো সে। মেয়েটা কি একটু নড়েচড়ে উঠল? না, সচল হয় না তার দেহ। তবুও নীলাশা চেষ্টা করে গেল অহেতুক। যদি জেগে ওঠে? একবার হেসে বলে— সে সম্পূর্ণ সুস্থ? সেই চেষ্টাতেই সময় যায়, রাত বাড়ে, ঘড়ির কাঁটা অক্লান্ত ঘুরে ঘর পাল্টায়। কিন্তু মিশমির দেহ সক্রিয় হয় না কোনোমতেই।
রাত আরেকটু গভীর হতেই নীলাশা ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে রাখল মিশমির বুকে। মিশমির বুকের সেই ক্ষীণ ধুকপুকানি নীলাশার কর্ণ হতে সারা শরীরের শিরা-উপশিরায় প্রশান্তি এনে দিল মুহূর্তেই। মেয়েটা বেঁচে আছে। তার হৃদয়ের স্পন্দনে নীলাশা শুনতে পায় অতীতের সকল সুখকর মুহূর্তের কথা। কল্পপটে ভেসে উঠে সেই সকল স্মৃতি যা তারা কাটিয়ে এসেছে মিশমির সাথে। নীলাশা কণ্টকপূর্ণ কণ্ঠে থমকে-থমকে গেয়ে উঠল ভীষণ যন্ত্রণায়,
‘ আয় আর-একটিবার আয় রে সখা,
প্রাণের মাঝে আয়/
মোরা সুখের দুখের কথা কব,
প্রাণ জুড়াবে তায়। ’
বন্ধুত্বে এই যন্ত্রণার তিক্ততা ক’জনই-বা বোঝে? বন্ধুরা ছাড়া কি সত্যিই কোনো মানুষ বোঝে বন্ধু হারানোর যাতনা? নীলাশার মতে— তা বুঝতে পারে না কেউই।
কখনোই না আর কোনোমতেই না…!
#চলবে ইন শা আল্লাহ!
(#বিঃদ্রঃ অনেকদিন পর দিলাম। তাই দয়া করে সবাই বেশি-বেশি মন্তব্য / কমেন্ট করবেন, আশা করি। আর বর্ধিতাংশের পর পরের পর্বগুলো বড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব, ইন শা আল্লাহ)