তারকারাজি- (০৯)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
|| দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ||
এই জীবনে হসপিটালে দাঁড়িয়ে থাকার মুহূর্তগুলো সব-সময়ই দুঃখের হয় না। আবার সুখেরও হয় না। ওইযে, এক প্রৌঢ় পুরুষ তার হাড্ডিসার বৃদ্ধ মাকে দীর্ঘদিন পর হসপিটাল থেকে নিজ বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে সে কতোই না খুশি! অথচ এদিকে একটি মেয়ে আগের মতো সুস্থ হতে পারবে কি-না তা শোনার জন্যই শুধুমাত্র ভীড় করেছে আটজন তরুণ-তরূণী। সেখানে শিক্ষক আর চিন্তিত বাবা-মায়েদের কথা তো বাদ-ই দেওয়া হলো।
নীলাশার অবস্থা করুণ। ক্রন্দনের দাপটে তার গলাটা ঘামে জবজবে হয়ে গেলেও সে নিজেকে ক্লান্ত মনে করতে পারছে না। যে যতো বেশি হাসে সে কাঁদেও ততো বেশি— এই উক্তিটির আবিষ্কারক যে ভুল কিছু আবিষ্কার করেনি তা পিহুকে না দেখলে হয়তো বোঝা মুশকিল ছিল। তাদের এহেন অধোগতিতে বিরক্ত নার্সও কিছু বলতে পারছেন না। কী-করে বলবেন? তাদের স্যার অভ্র যে ভীষণ অনুরোধে তাদের থামিয়ে রেখেছেন। দূর থেকে দেখা গেল বেশ পরিপাটি তবে চিন্তিত স্বভাবে এগিয়ে আসছেন ইয়াসিন চৌধুরী ও নৌশিন আহমেদ। ওনারা এসে প্রথমে মিশমির খোঁজ নিলেন। অতঃপর ইয়াসিন চৌধুরী মঈনুল হোসেনের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ বিলটা আমি মিটিয়ে দিয়ে আসছি। আপনি এতো কিছু চিন্তা করতে যাবেন না। হাই প্রেশার না আপনার? শান্ত হোন। মিশমির কিছুই হবে না। যিনি অপারেট করছেন তিনি আমার পরিচিত না-হলেও আমার লোকের পরিচিত। শুনেছি ভালো রেকর্ডও আছে ওনার। ভরসা রাখুন। ”
মঈনুল হোসেনের বোধহয় মনে শান্তি মিললো না একটুকুও। আসলে যার যায় সে বোঝে! তিনি নিজের অনুভূতিও প্রকাশ করলেন। ইয়াসিন চৌধুরীর টাকার লেনা-দেনাটা মানতে পারলেন না তিনি। তবুও ইয়াসিন চৌধুরী বললেন,
“ আপনার মেয়ে কি আমার মেয়ে না, ভাইজান? মেয়েটাকে চোখে দেখার পরও তার এই অবস্থা শুনে যদি আমি চুপচাপ বসে থাকতাম তাহলে আমি তো নীলাশার-ও একজন ভালো বাবা হতে পারতাম না। আজ শনিবার… ব্যাংক বন্ধ। আপনি তো এখনি এতোগুলো টাকার ব্যবস্থা করতে পারতেন না। হসপিটালেরও তো কিছু নিয়ম আছে! ওকে সুস্থ করে দেওয়ার ক্ষমতা তো আমার নেই। যতটা পারব আপনাদের সাহায্য করতে ঠিক ততোটাই না-হয় করি? আপনি আমাকে বাঁধা দিয়েন না ভাইজান। মেয়েটার জন্য খরচ ছাড়া আর কিছুই করতে পারব না। এইটুকু না-হয় করতে দেন আমায়, প্লিজ। পরে তো আপনাকেই সব সামলাতে হবে। ”
মঈনুল হোসেন ভেজা চোখ দুটো আড়াল করলেন। এইযে মেয়েটাকে বাঁচাতে চারপাশ থেকে সুবিধারা ঝাঁক বেঁধে আসছে… এরপরও যদি মেয়েটা বেঁচে না-ফিরে তবে কেমন হবে সকলের মনের পরিস্থিতি? তিনিই-বা কীভাবে বাঁচবেন নিজের মেয়েকে ছাড়া? তিনি এগিয়ে গেলেন আরাভের দিকে। থমকানো স্বরে বললেন,
“ বাবা, তোমার ভাই তো এখনো আসছে না। আমার মেয়েটা প্রাণে বাঁচবে তো? ”
আরাভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওনার কাঁধে হাত রাখল,
“ ভাইয়া তো কিছু বলতে পারবে না, আঙ্কেল। যিনি ট্রিটমেন্ট করছেন তিনিই বলতে পারবেন কী হবে আর না-হবে। আপনি ভেঙে পড়বেন না। মিশমি যে এই বোকামোটা করবে তা আমরা বুঝতে পারি নাই, আঙ্কেল। মাফ করবেন আমাদের। ওকে দেখে রাখা উচিত ছিল৷ ”
মঈনুল হোসেন কথা বললেন না আর কোনো। ওদিকে ইয়াসিন চৌধুরী যখন ক্রন্দনে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন, তখনই যেন ভীষণ আহ্লাদিত হয়ে নীলাশা তার কান্নার আওয়াজ বাড়িয়ে তুলল। ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে বাবার বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে লাগল মেয়েটি। তখন ইয়াসিন চৌধুরীকে আদুরে স্বরে বলতে শোনা গেল,
“ ডোন্ট ক্রাই মাই প্রিন্সেস। হসপিটালে এমন কান্নাকাটি করে মানুষকে ডিস্টার্ব করার কোনো মানে হয় না। তুমি তো ব্র্যাভ গার্ল! ভরসা রাখো যে, মিশমি সুস্থ হয়ে যাবে। ”
নীলাশার কান্নার বেগ থেকে-থেকেই বাড়তে লাগল। অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক এই মনের কথাগুলো দু’ঠোঁট চিড়ে বেরোতে চাইলো না। অথচ চিন্তাপূর্ণ পরিবেশটাকে আরও ভীষণ চিন্তার অতলে ডুবিয়ে দিল বন্ধুপ্রাণ নীলাশা।
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে যখন ইয়াসিন চৌধুরী খেয়াল করলেন— নীলাশার কান্না থামলেও নীলাশা কাঁপছে তখন ওনার বুকটা আপনা-আপনিই কেঁপে উঠল অন্য এক ভয়ে। নীলাশার এই প্রচণ্ড কাঁপুনি তো ক্রন্দনের নয়! তিনি তার মেয়েকে দাঁড় করানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হলেও মেয়ের নীরক্ত মুখশ্রী দেখতে পেলেন। নীলাশার চোখ আধবোজা, মস্তিষ্ক নিশ্চল। তখন ইয়াসিন চৌধুরী ভয়ার্ত বুক নিয়ে মেয়েকে ডাকাডাকি করতেই সকলে বিষয়টি লক্ষ্য করল৷ নীলাশা এমন-ই ছটফট করছে যেন তার জীবনটা কেউ টেনে-হিঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে। নৌশিন আহমেদ মেয়েকে ঝাপটে ধরে তার এই কাঁপুনি বন্ধ করার চেষ্টা চালালেন তবে কিছুতেই কোনোকিছু উপকারে এলো না৷ অতঃপর যখন নীলাশার মুখ থেকে বুদবুদযুক্ত তরল বেরিয়ে এলো তখন সেখানে পরিস্থিতি প্রায় পাগলপ্রায়। মিশমির সাথে-সাথে কি এবার নীলাশা-ও…?
চিৎকার-চেঁচামেচির মাঝেই ইয়াসিন চৌধুরীর হাত থেকে নীলাশাকে কেড়ে নিল আরাভ। সময় নষ্ট না করে তাকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হলো চিকিৎসার জন্য। দু’দিকে দুজন সহচরীর মৃত্যুসম্বন্ধীয় দশায় হসপিটালের সেই করিডোরটা মুহূর্তেই হৃদয় ছারখার করা মরা-বাড়ির ভয়ানক ক্রন্দনে পরিপূর্ণ পরিস্থিতির জন্ম দিয়ে ফেলল। উপস্থিত জীবগুলো যেন আজীবন ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারবে না এই হৃদয় বিদীর্ণকরণ স্মৃতি!
‘তোদের জন্য কলিজাও ছিঁড়ে দিব!’ এইতো দু’দিনের পুরনো কথা! বন্ধুত্বের দিন উপলক্ষে ভার্সিটিতে যখন বন্ধু-বান্ধবের দলে সুখকর উৎসবের ঢেউ উপচে উঠছে ঠিক তখন-ই একরাশ বিরক্তি নিয়ে নীলাশা বলেছিল,
“ ফ্রেন্ডশিপের আবার দিন হয় না-কি? তাহলে তো এটা নিয়ম হওয়া উচিত ছিল যে, যার সাথে যেদিন ফ্রেন্ডশিপ হবে ঠিক সেদিন-ই তাদের তা সেলিব্রেট করতে হবে। ”
সানাম বলেছিল, “ আরেব্বাস! আমাদের ইয়াং জেনারেশনের রঙঢঙ তো এমনিতেই শেষ হয় না। এমন নিয়ম হলে তো আমাদের এভরিডে উৎসব হতো। ”
“ ধুর! বাংলার ইতিহাসের সাল-ই তো মনে রাখতে পারি না আর তো কবে কার সাথে ফ্রেন্ডশিপ হইছে তা মনে রাখব। ভাগ্যিস এমন নিয়ম হয় নাই! ”
পিহুর কথাতে হেসে উঠেছিল গোটা বন্ধুমহল। নিশান তো বলেছিল,
“ এমন নিয়ম হইলেও আমি মানতাম না। আচ্ছা তোরাই বল, আমাদের কি এইসব ডে-ফে দেখে ফ্রেন্ডশিপ হইছিল? না-কি আমরা ডে-ফে দেখে সবাই সবার সাথে মিশি? ”
রিশানও সহমত প্রদর্শন করে বলেছিল, “ রাইট! আমরা তো এভরিডে সবাই সবার সাথে মিশি৷ তার মানে আমাদের এভরিডে-ই ফ্রেন্ডশিপ ডে। ”
ঠিক সেই মুহূর্তে কিশোরী বয়সের প্রতিজ্ঞাটা আবারও নতুনভাবে তাদের ছয়জনের মাঝে তুলে এনেছিল মিশমি। সে বলেছিল উপরোক্ত বিশেষ কথাটি আর সেই ধ্বনিতেই একে-অপরের হাত ধরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল সবাই,
“ আমরা আমাদের জন্য কলিজাটাও ছিঁড়ে দিব। শুধু আমরা যেন ভালো থাকি একসাথে! ”
তবে অন্তরের নিভৃত থেকে খুব যতন করে বলা কথাটা ভঙ্গ করার সময় মিশমি হয়তো ভাবেনি তার বন্ধুদের কথা। ওইযে বাবা-মা দুঃখ পেল শুধুমাত্র তার ও একজন প্রতারকের স্বল্প ঘনিষ্টতার জন্য! তাতেই মিশমি জ্ঞান হারালো উচিত-অনুচিতের। বন্ধুদের কৈশোরের হারিয়ে যাওয়া আবেগী অনুভূতিগুলো আজ খুবই জীবন্ত হয়ে উঠল। বাবা-মাকে কষ্ট দেওয়ায় যে মেয়েটা লুটিয়ে পড়ল মৃত্যুর উদ্দেশ্যে আজ সেই মেয়েটাকে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক আঘাত করে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করল,
“ কোথায় গেল তোর বন্ধুত্ব, মিশমি? তুই না প্রতারকের নোংরামি সহ্য করতে না পেরে… বাবা-মায়ের অহেতুক অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের জীবন দিয়ে দিলি? এখন তুইও যে একটা প্রতারক, মিশমি। হাত ছুঁয়ে দেওয়া কথাটায় একসাথে পথ চলার যে স্বপনে বুঁদ হয়েছিলাম সবাই আজ সেই স্বপনে মন্দ দৃশ্য এনে, বুকটা কাঁপিয়ে দিয়ে কেন প্রমাণ দিলি তোর প্রতারণার? কেন ভরসা কেড়ে পাগল করলি আমাদের-ই একজন নীল তারকাকে? কেন আঘাত করলি তোর নিশান, রিশান, পিহু ও সানামের মতো বন্ধুগুলোর বুকে? তুই কবে হলি এতটা নিকৃষ্ট প্রতারক? ”
সেই ক্ষোভে আচ্ছাদিত প্রশ্নগুলো করা হচ্ছে না কোনো মতেই। সবার বুকেই তখন কুণ্ঠাবোধের দামামা বাজছে। থেকে-থেকেই বলে উঠছে যে, মিশমি বাঁচবে না। যতই হোক তিনতলা…! অতো উঁচু থেকে পড়ে মিশমির মতো মৃত্যুর তৃষ্ণাদগ্ধ মেয়েটি কী-করে বাঁচবে? ওদিকে নীলাশাও অতিরিক্ত উত্তেজনাবশত স্ট্রোক করে শূন্য জ্ঞানে সুষুপ্ত। ঠিক এই সময়-ই দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা পর দেখা মিললো অভ্র ও মিশমির চিকিৎসকের। অভ্র সময় দিতে পারল না। মিশমির মাঝে প্রাণ আছে তা জানিয়েই নীলাশার চিকিৎসকের সাথে নীলাশাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। মিশমির চিকিৎসক জানালো— মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডে আঘাত পাওয়ায় মিশমি সম্পূর্ণভাবে প্যারালাইজড। অনুভব শক্তি, মন ও মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকলেও তার শরীরের প্রত্যেকটি অংশই নিস্ক্রিয়।অতীতে, খুব ছোটবেলায় বা’পায়ে আঘাত পেয়েছিল মেয়েটি; বিধায় তাড়াহুড়োয় হাঁটতেও অসুবিধা হতো তার। মিশমির সেই পায়েই পুরনো আঘাতটা যেন নতুনভাগে জেগে উঠেছে। তবে এটা সাময়িক যা সহজেই বলা যায়। কিন্তু তার এহেন অবস্থার উন্নতি হতে পারে আবার না-ও হতে পারে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। উন্নতি ঘটলে তা ঠিক কখন বা কবে ঘটবে সেইটা বলা মুশকিল। আর যদি উন্নতি না-ও ঘটে তবে মেয়েটাকে বাঁচতেও হবে প্যারালাইজড হয়ে, মারাও যেতে হবে প্যারালাইজড হয়ে। এই দুটোই যেন নির্মম এক সত্যি!
ডাক্তারের এইটুকু কথা-ই সকলের মনে আনন্দ এনে দিয়েছিল খুব। কিন্তু দুটো দিন পার হতেই যেন হাঁসফাঁস করে উঠল সকলে। আরেহ্… মিশমি যে একটা পাথরতুল্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে! যার প্রাণ থেকেও নেই। সে শুধুমাত্রই তার গভীর চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। সে কি আদৌ কিছু অনুভব করতে পারছে? ডাক্তার তো বলল— শারীরিক ক্ষমতা হারালেও মানসিক ক্ষমতাটা আগের মতোই আছে মেয়েটির। কিন্তু অঙ্গনার সেই শারীরিক ক্ষমতার নিদারুণ দশা কারই-বা সহ্যের সীমানায় থাকছে? সবাই-ই যে ঢের আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার কথা শোনার জন্য… তাকে হাসতে দেখার জন্য… তাকে আগের মতো ফিরে পাওয়ার জন্য!
ওদিকে একই তলার তিনটে কেবিন বাদেই নেওয়া হয়েছিল নীলাশার কেবিন। ঘুমে মত্ত থাকা মেয়েটির দিকে ভীষণ উদাসীনতার সহিত তাকিয়ে আছেন ইয়াসিন চৌধুরী ও নৌশিন আহমেদ। ইয়াসিন চৌধুরী ভাবেন গতকাল রাতের কথা। ঘুম থেকে জাগ্রত নীলাশাকে করিডরে বেরিয়ে, লিফটের দিকে যেতে দেখেছিল নিশান। অতঃপর তিনি যখন তড়িঘড়ি করে গিয়ে মেয়ের হাত চেপে ধরে শুধালেন,
“ নীলাশা, হোয়ার আর ইউ গোয়িং? আর ইউ অলরাইট মাই চাইল্ড? ”
নীলাশা কেমন যেন চমকে উঠেছিল তখন। টলমলে চোখে তাকিয়ে বলে উঠেছিল,
“ ড্যাড? আই হ্যাভ টু গো, ড্যাড। মিশমি আমাকে ডাকছে… ছাদে। ও আমায় বলেছে— আমি ওকে রেখে আসছিলাম দেখে ও প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে। আমাকেও যেতে হবে এখন, ড্যাড। আমি কী-করে রেখে আসলাম ওকে? আমাকে বলেছে ও যেন আমিও উপর থেকে পড়ে যাই। ও ওয়েট করছে আমার জন্য। সরো। ”
ইয়াসিন চৌধুরী এই কথা শুনে নিজেকে সামলাতে পারেননি আর। কেউ কিছু জানার আগেই মেয়ের গায়ে হাত তুলেছিলেন তিনি। স্টেসির সময়ও নীলাশা এমন স্বপ্ন দেখেছিল। ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে নীলাশা যে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা ওই অভিজ্ঞ মস্তিষ্ক বুঝতে দেরি করেনি। নিজের মেয়েকে হাজার বকা-ঝকা করার সময় তিনি দেখেছিলেন সেই একটি মানুষকে যে কি-না চট করেই নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নীলাশাকে শান্ত করে ফেলেছিল… আরাভ! অবশ্য সানামও এক কথায় বাজিমাত করেছিল বেশ। সে বলেছিল,
“ তোর আর আমার ফ্রেন্ডশিপটা আমরা ইউনিক করতে চাইছিলাম, তোর মনে পড়ে নীল? তুই আমাকে শর্ত দিছিলি যেন আমি কখনোই তোদের ছেড়ে না যাই আর আমি দিছিলাম যে, তুই কখনোই আমাদের জন্য এমন কিছু করবি না যাতে আঙ্কেল-আন্টি কষ্ট পায়। তুইও কি মিশমির মতো এই দাম দিবি বন্ধুত্বের? ”
ইয়াসিন চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন— তার আদরের মেয়েটাকে ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। অথচ মেয়েটার যেন অসীম ভালোবাসাই চাই! তিনি মেয়ের ঘুমন্ত মুখশ্রীতে দৃষ্টি স্থির রেখেই স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“ ভাবছি আরাভ আর নীলাশার বিয়েটা আজ-কালের মধ্যেই দিয়ে দেব। ”
হঠাৎ স্বামীর এমন কথা শুনে ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো নৌশিন আহমেদের। অভ্রর বিয়ের সময় আরাভ ও নীলাশার প্রেমব্যঞ্জক অনুভূতি সম্পর্কে প্রথম সন্দেহ করেছিলেন আরাভের বাবা আহসান চৌধুরী। অতঃপর তিনি তার বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রীকে বিষয়টি জানিয়ে, আরাভ ও নীলাশাকে জিজ্ঞাসা করতেই তারা বিনা বাক্য ব্যয়ে স্বীকার করে নিয়েছিল বিষয়টি। এই ক্ষেত্রে নীলাশা ছিল আরাভের থেকে দু’কদম এগিয়ে। তবে আরাভ আগেই জানিয়ে দেয় যে, সে নীলাশাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চায় যখন সে তার যোগ্য স্বামী হিসেবে ইয়াসিন চৌধুরীদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে। সেই সময়টুকু যেন তাকে দেওয়া হয় নিঃশর্তে। তাদের সহজ স্বীকারোক্তিতে ইয়াসিন চৌধুরীদের আনন্দ যেন উপচে পড়ার ধাপে পৌঁছেছিল! দু’পরিবার থেকেই যখন সম্মতি জানানো হয়েছিল তখন স্বামীর হঠাৎ উক্ত কথাটি বলা যেন নৌশিন আহমেদের কাছে ঝাপসা আয়না দেখার মতো লাগল। তিনি এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেই ইয়াসিন চৌধুরী বললেন,
“ দেখো নৌশিন, আরাভ ছেলেটা ভালো। প্রতিষ্ঠিতও হতে পারবে ও। আর তুমি তো তোমার মেয়েকে চেনোই! মিশমি যতদিন না সুস্থ হচ্ছে ততোদিন ওকে ভালো রাখাটা আমাদের জন্যও একটা যুদ্ধ। কে জানে মিশমি কবে সুস্থ হবে! আর স্টেসির ওই ইন্সিডেন্টের পর নিজেই তো দেখেছো ওকে। না আমরা ওর জন্য ভালো থাকতে পারছি আর না ওকে আমরা ভালো রাখতে পারছি। দরকার কী সেভাবে চেষ্টা করার? আমি বলছি না মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিব। আহসানের সাথে কথা বলার পর ওরাই না-হয় ঠিক করবে ওরা আলাদা থাকবে না-কি একসাথে। বিয়ের পর নীলাশা আরাভের সাথেও একটু ব্যস্ত থাকতে পারবে, নিজের হাসবেন্ডকে টাইম দিতে পারবে। মেইনলি, ও যখন একটা নতুন পরিবেশ পাবে তখন মিশমিকে নিয়ে ওর এই ট্রমাটা এতটাই কাজ করবে না যে, ও সুইসাইড করার চিন্তা-ভাবনা করবে। আমার মেয়েকে আমি চিনি। ও আরাভকে হারানোর মতো কোনো স্টেপ নিতে পারবে না। কখনোই না! ”
“ তুমি কি বলতে চাইছো আমরা আমাদের মেয়েকে ভালো রাখতে পারব না? আর তাছাড়া এতো ফাস্ট ওর বিয়েটা দেওয়ার কী প্রয়োজন? আরাভেরও তো সামনে এক্সাম! না ইয়াসিন, বিয়েটা এখনি দেওয়া ঠিক হবে না। আমাদের মেয়েকে আমরা ভালো রাখতে পারব। একবার ভুল পদ্ধতি ফলো করেছিলাম বলে এবারও করব না-কি? বাবা-মা হিসেবে কি এতোটাই ব্যর্থ আমরা? ”
ইয়াসিন চৌধুরী ক্ষীণ হেসে স্ত্রীকে এক বাহুতে আগলে ধরে বললেন,
“ অ্যাজ আ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট, বাবা-মায়েরা সন্তানকে তাদের অভাবটা কখনোই বুঝতে দিতে চায় না। যদি তা-ই হতো তো সন্তানরা কখনোই বাবা-মা ব্যতীত অন্য কোনো মানুষকে ভালোবাসতে পারতো না৷ একবার ভাবো তো, সব সন্তানরা যদি বাবা-মাকে পুরোপুরিভাবে বুঝে নিতো তবে কী হতো? এই পৃথিবীতে বাবা-মা ব্যতীত কেউ কাউকে অধিক ভালোবাসতে পারতো না৷ কারো বিয়ে হতো না, কারো সন্তান হতো না৷ সব আবেগ ভালোবাসাই হয়তো থেমে থাকতো তার বাবা-মাতেই। তারা এতটাই ভালোবাসার যোগ্য হয়! তখন কি সত্যিই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব থাকতো? তুমি থাকতে, আমি থাকতাম না-কি আমাদের নীলাশা আর নাজিফ থাকতো? অথচ পৃথিবীতে এমন নিয়ম সৃষ্টি করা আছে যেখানে বাবা-মায়ের স্ট্রাগলটা বাবা-মা না হওয়া পর্যন্ত সঠিকভাবে কেউ বুঝতে পারে না। হয়তো-বা স্ট্রাগলের উপর ডিপেন্ড করে কেউ-ই নিজের পিছনে তার বাবা-মায়ের ভূমিকাটা সঠিকভাবে বুঝে না। এইযে দেখো তুমি আর আমি! আমাদের দুজনের বাবা-মা লন্ডনে ভালো আছেন জেনেই আমরা ভালো আছি একে-অপরের সাথে। অথচ বাবা-মাকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারলে হয়তো ও-দেশ ছেড়ে এদেশে নিজের সন্তানের জন্য ফিরে আসতে আত্মা কাঁদতো। যতই আমরা বাবা-মা হই না-কেন! দিন শেষে এটাও তো সত্য যে, আমরাও কারো সন্তান? বাবা-মা যদি আমাদের সুখের অভাবটা না-বুঝে নীলাশাকে এখানে আনতে না দিত তো আমরা কী-করে সুখী হতাম আমাদের সন্তানের অসুখে? ওর সুখের অভাব রাখতাম কী-করে? ”
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অতঃপর আবারও বললেন,
“ এই সময় নীলাশার আরাভকেই প্রয়োজন। আমরা যত ভালো পদ্ধতিই ফলো করি না-কেন! আরাভের ভালোবাসা, স্নেহ… কোনোটাই আমরা ওকে দিতে পারব না। ওদের স্পেস দাও একটু। আমরা যদি এগুলো না বুঝি তো আর কোন মানুষটাই-বা আছে যে আমাদের বাচ্চাদের অভাব বুঝবে? এমন তো নয়— আমার মেয়েটা ছোট আর তা জেনেও অন্যায় আবদার করে ফেলছি আমি! ওরা দুজনেই অ্যাডাল্ট। নিজেদের কী করা উচিত তা ওরাই ভালো বুঝবে… স্পেশালি আরাভ! ও আরাভের সাথে ব্যস্ত থাকলে ভালো থাকবে, ট্রাস্ট মি নৌশিন? আর বিষয়টা নিয়ে আমি নিজেই আহসান আর আরাভের সাথে কথা বলব। দেখি কিছু করতে পারি কি-না! ”
#চলবে ইন শা আল্লাহ!