তারকারাজি সিজন 1 পর্ব-২৫

0
305

তারকারাজি- (২৫)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

সেদিনকার মতো আজও বৃষ্টিতে গা ভাসিয়েছিল প্রকৃতি। ভ্রমণের দ্বিতীয় সকালটার আয়োজনকে এভাবে মাটিতে পিষিয়ে ফেলার অপরাধে বৃষ্টিকন্যা কম বকা শোনেনি! তবুও যখন সকাল আটটায় রোদের স্বর্ণাভে বিশ্বব্রহ্মাভকে সবুজে, সতেজে ঝলমলিয়ে উঠতে দেখা গেল তখন আর ইচ্ছে হলো না চার দেয়ালে বন্দী থাকার আয়োজনেই সীমাবদ্ধ থাকতে। তড়িঘড়ি করে আরাভের আত্মীয় আবিরকে দুটো চান্দের গাড়ির খোঁজ দিতে বলেই হন্তদন্ত পায়ে ছুটে চলা হলো সকালের খাবারের উদ্দেশ্যে। খাওয়া-দাওয়া হলো। ফাঁকা পেয়ে সকলেই ইচ্ছা প্রকাশ করল হিমছড়ি জলপ্রপাত থেকে ঘুরে আসার। সেখান থেকেই গাড়ি ভাড়া করে ছুটে চলা হলো বাহারছড়ার দিকে। আবির খোঁজ দিয়েছে, বিকেলের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে সেখানকার শান্ত এলাকায় না গেলেই নয়! ট্রলারে করে স্বল্প সময়ের জন্য সমুদ্র শাসনের সিদ্ধান্ত নিল সকলেই। ওটা আবিরদের এলাকা। তাই কম টাকায় লাভবান হওয়ার সুযোগটাও আছে তাদের হাতে। কিন্তু সেখানে পৌঁছেই যে সানাম এভাবে সকলের আবেগ, উত্তেজনাকে বৃদ্ধি করে দিবে তা বাকিদের ধারণার বাহিরেই ছিল বৈ কী! বাহারছড়া ইউনিয়নে প্রবেশ করার পর, দলে আবিরকে যোগ করার জন্য যখন গাড়ি থামানো হলো তখন সানামকে বলতে শোনা গেল,

“ আবির ভাই? আপনি তো এই এলাকার লোক। একটা উপকার করবেন? ”

আবির অপ্রস্তুত হলো সানামের প্রশ্নে। না জানি কীভাবে উপকার করার আবদার জুড়ে বসবে এই অচেনা মেয়েটি! সে হেসে উত্তর দিল,

“ পারলে অবশ্যই করার চেষ্টা করব। ”

সানাম বিরক্তি প্রকাশক ভঙ্গিমায় বলল,

“ এই ট্রলারে অনেক ঘুরছি। লাইফে একটু অ্যাডভেঞ্চার প্রয়োজন! আমি বিশাল ট্রলারে উঠতে চাই আবির ভাই। ওইযে যেই ট্রলারে করে জেলেরা মাছ ধরে? ওই ট্রলারে। ”

সানাম একটু থামল। অতঃপর আবারও বলল,

“ বাকি সবাই ঘুরে আসুক। আমি একাই একশ ওই ট্রলারে যাওয়ার জন্য। আপনি আমাকে একটু ব্যবস্থা করে দেন না? ”

আবির আরেকটু অপ্রস্তুত হলো এবার। মেয়েটা যে অন্যরকম তা গতকাল সন্ধ্যায় কথা হতেই বুঝেছিল। কিন্তু এমন একটা আবদার সে করে বসবে তা আবির ভাবেনি। এখন এই আয়োজন কীভাবে করবে সে? ভাবতে ভাবতেই নীলাশা মুখ খুললো,

“ আবির ভাইয়া, আই অলসো ওয়ান্ট টু গো উইদ সানাম। ট্রিপে যদি অ্যাডভেঞ্চার-ই না থাকে তবে বন্ধুদের সাথে এসে কী লাভ? সেই তো আমার ড্যাডের সাথে ট্রিপে আসার মতোই হলো ব্যাপারটা! এখানে যাবা না, ওটা করবা, সেইটা ধরবা না… এগুলো ফ্যামিলি ট্রিপেই মানতে ভালো লাগে, আই থিঙ্ক! ”

নীলাশার কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে সকলেই মুচকি হাসল। অতঃপর একে-একে সকলেই তাল মিলালো যে, শুধু ট্রলার না। তারা মাছ ধরার ট্রলারে করে ঘুরবে আজ। এই শুনে মিশমি মুখ কাঁচুমাচু করে দু’হাতে নিজের পেট চেপে ধরল। সে বলল,

“ আমার না পেট ব্যথা করতেছে খুব। আমি না-হয় না গিয়ে সমুদ্রের পাড়েই বসে থাকব। ”

এই শুনে পিহুও সুর দিল,

“ আমারও পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা, পা ব্যথা। আর এই হাবলি একা একা বসে থাকতে পারবে না-কি? আমি আর ও থাকি। তোরা গিয়ে ঘুরে আয়। ”

রিশান সেই ব্যথিত সুরে তরল হলো না একটুও। বরং ধমকে উঠে বলল,

“ যেই শুনছোস মাছ ধরার ট্রলার আর অমনিই তোদের যত ব্যথা শুরু হয়ে গেল, তাই না? তোদের দুইটারে ট্রলারের দুই মাথায় বেঁধে দিমু। তারপর ঝুলে ঝুলে যাবি তোরা। ”

মিশমিরা বেঁকে বসল। তারা দু’জন কিছুতেই যাবে না। নীলাশা জানে না দুটো ট্রলারে আকার-আকৃতিগত পার্থক্য ছাড়া আরো কোনো ভিন্নতা রয়েছে কি-না। সে তো এই প্রথম বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রকে স্পর্শ করার সুযোগ পেল! তবুও জীবনে কিছু সুন্দর মুহূর্ত আঁটকে রাখতে সানামের সাথে তাল মিলিয়েছে সে। আর তা-ই করা হলো অবশ্য! কেউ রাজি থাকুক বা না-থাকুক, দল বেঁধে ওঠা হলো দুটো মাছ ধরার বিশাল-বিশাল নৌকায়।

আট হাজার টাকা ব্যয়ে কিছু সমুদ্রবিলাসের অক্ষয় গল্প তৈরি করতে ছুটন্ত যুবক-যুবতীর মনে ছিল প্রশান্তি, তৃষ্ণা ও একই সাথে প্রচণ্ড ভয়। শহরতলীকে পিছনে ফেলে জেলেদের বসবাসরত এই সুনসান দ্বীপেও রয়েছে অদেখা এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। রাস্তার পূবে হরিদ্বর্ণ চাদরে ঘেরা বিশাল পাহাড় আর পশ্চিমের ঝাউগাছের বাগান পেড়িয়ে সুজলা জলধি। প্রেক্ষাপটের এই প্রান্তে এসে বৃষ্টিকন্যাকে গালি-গালাজ করা বন্ধুদল দুটোও স্বীকার করে নিল যে, প্রকৃতির দীর্ঘ বৃষ্টিস্নান ও তারপর রোদের আলোয় তার ঝলমলিয়ে ওঠাটা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যাইহোক, জেলেদের বিশাল নৌকায় অবস্থান করা যায় তেরো জনেরও বেশি। কিন্তু তারা তেরো জন এবং তিহাম ও আবিরকে নিয়ে মোট পনেরো জন যদি একটি নৌকায় ওঠে তো নৌকা পরিচালনা করবে কে? হিসাব মিলতেই একটি নৌকায় অবস্থান করল নীলাশা, মিশমি, রিশান, তিহাম, সায়ান, আরাভ, আবির, সাইফ ও চারজন জেলেভাই। আর অন্য একটিতে অবস্থান করল নিশান, সানাম ও পিহুসহ বাকিরা সবাই। নৌকা যখন ধার ছাড়িয়ে গভীরে পৌঁছাতে চাইলো তখনও মিশমি ছিল একদম স্বাভাবিক। নীলাশার পাশে বসে উন্মাদী হয়েছিল নৌকার দোলায় ও সমুদ্রের কলরবে। কিন্তু নৌকা গভীরে যাওয়ার সাথে সাথে যে সমুদ্রও তার উন্মাদনা দেখাবে তা মিশমি বা নীলাশা কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। তরঙ্গের দাপটে এই বিশাল নৌকাটিও যেন উল্টে পড়বে এমন অবস্থা! নীলাশা খানিকটা ভয় পেলেও মিশমিকে দেখা গেল ভয়ে চোখের পানি ফেলতে। এক জেলে ভাই তাদের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন যে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সাধারণ নৌযান আর তাদের নৌযানে আকাশ-পাতাল তফাত থাকলেও এই নৌকা ডুববে না। সমুদ্র অভিযানে পারদর্শীরা ব্যতীত এইসব নৌকায় ছাড়া হাত-পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তো দূর, কেউ বসেও থাকতে পারবে না। কিন্তু মিশমির কান্না থামল না ওনার কথা শুনে। তিহাম তার দুই হাতে মিশমিকে আগলে রাখলেও ভয় কমলো না মেয়েটির। আশেপাশের মানুষগুলো দেখল তিহামের নির্লজ্জ সব কাণ্ড। মেয়েটি শুধু তার শার্ট খামচে ধরলেও তিহাম এতোগুলা মানুষের সামনে গোটা মিশমিকেই ধরে রেখেছে। তাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করেই সাইফ রিশানকে বলল,

“ কী রে, তোরা তিহামের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জানিস না? ওরে লুইচ্চা বললেও তো ভুল হবে। পাক্কা মা*বাজ! মিশমিরে তো একটু বুঝাইতে পারিস? ”

রিশান অপ্রস্তুত হলো সাইফের কথা শুনে। কাল-ই তারা দুই ভাই ও পিহু তিহামের সম্পর্কে জেনেছে। এমনকি হোটেলে মিশমির সাথে তিহামের আচরণ সম্পর্কেও জেনেছে তারা। কিন্তু এখানে তারা কী করবে যেখানে মিশমিই প্রশ্রয় দিয়েছে? রিশান উত্তর দিতে চাইলে নীলাশা-ই সেখানে এসে উপস্থিত হয়ে দারুণ সতর্কতার সাথে বলল,

“ ওকে কী বুঝিয়ে বলব, সাইফ ভাই? কালকে তো এই নিয়ে কম কথা বলিনি আমরা পাঁচজন। জানেন কালকে কী হয়েছে? ”

সাইফ তীব্র আগ্রহ নিয়ে নীলাশার দিকে তাকাতেই নীলাশা উন্মুক্ত করল কালকের ঘটনা। মিশমি স্বভাবতই একটা কথা দীর্ঘ সময় চেপে রাখতে পারে না। হোটেলের ঘটনাটি বান্ধবী দুজনকে বললেও নীলাশারা দুজন সেই নিয়ে তেমন কিছুই বলেনি মিশমিকে। উদ্দেশ্য ছিল সবাই মিলে বুঝিয়ে বলবে তাকে। কারণ সানাম তিহামের সম্পর্কে আগেই জেনে গিয়েছিল সবটা। শুধু জানার অপেক্ষায় ছিল যে, এ-ই সেই তিহাম কি-না! অতঃপর সবটা পরিষ্কার হতেই যখন হোটেলে ফিরে এসে মিশমিকে নিয়ে ছোটমোটো একটা বৈঠক-ই বসিয়ে ফেলল তারা ছয়জন তখন সানাম বলেছিল,

“ মিশমি, শুনলি তো ওই কী-রকম লুইচ্চা মার্কা পোলা? তুই ভাবতে পারিস? কোনো ভয়-ডর বলতে কিছুই নাই ওর। পুরা ভার্সিটিতে শুধুই ওর দুর্নাম আর দুর্নাম। ”

মিশমি তখন হেসে বলেছিল, “ আমি সবকিছুই আগের থেকে জানি সানাম। তোদের হয়তো মানুষ ঘুরিয়ে-পেচিয়ে, তেল-মশলা মাখিয়ে বলছে কথাগুলো। এটা ঠিক ওর দুর্নাম পুরা ভার্সিটিতেই। কিন্তু এক বছরে ওর কোনো ব্যাড রেকর্ড আছে বলে শুনছিস? ”

সানামসহ সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিল তখন। কারো থেকে উত্তর না পেয়ে মিশমি বলেছিল,

“ দেখ, আমরা ভার্সিটিতে পড়ি মানেই আমরা যে খুব বড় হয়ে গেছি আসলে তা না। শারীরিক বয়স বাড়লেও কি সকলের মনস্তাত্ত্বিক বয়স বাড়ে? যদি তাই হতো তো তুই কখনোই সাইফ ভাইদের নামে ডাইরেক্ট উপাচার্যের কাছে অভিযোগ করতিস না। আর… ”

“ তুই কোন কালের কথা টেনে আনতেছিস মিশা? ওইটা আর এইটা এক হলো? ”

সানাম তেতে উঠে কথাটা বললেও মিশমি কোনো ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি তখন। বরং সে নরম স্বরেই বলেছিল,

“ ও তখন ভুল করেছিল ঠিকি তার মানে এই না যে, ও এখনো ভুল কিছু করছে। তিহাম অনুতপ্ত দোস্ত! ও এখন কোনো খারাপ কিছুর সাথেই জড়িত না। আর আমি তো সবটাই জানি, বল? জেনে-বুঝে কি সম্পর্কে জড়াইনি? ”

নিশান কঠোর প্রশ্ন করেছিল, “ এইসব তোকে কে জানাইছে মিশু? আর জানার পরও তুই মেনে নিলি ক্যামনে যেখানে এতো ভালো-ভালো ছেলেরেও তুই রিজেক্ট করে আসছিস? ”

মিশমি উত্তর দিয়েছিল যে, তাকে তিহাম-ই সবটা জানিয়েছে। তিহাম যদি ভালো না হতো তাহলে কি নিজের সকল দোষ স্বীকার করে মিশমিকে বলতো যে, মিশমি চাইলে তাকেও প্রত্যাখ্যান করতে পারে? মিশমির এরূপ বক্তব্য শুনে সানাম সেই বৈঠক থেকে উঠে গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়েছিল। আর এ-ই বলে উঠেছিল,

“ দোস্ত, তোরা বাদ দে। ওই বদজাত পোলা ওর ব্রেইনওয়াশ করে ফেলছে অলরেডি। আমাদের বলেও কোনো লাভ হবে না। ”

তবুও বাকি চারজন বুঝিয়েছিল অনেক আর মিশমি বিনা আক্রোশে তাদেরকে বুঝিয়ে গিয়েছিল যে, তিহাম নিজের ভুল শুধরে নিয়েছে। মানুষটা এখন মিশমিকেই তার পাশে চায় যাকে সে নিঃশর্তে ভালোবেসে যেতে পারবে এবং যার থেকে নিঃশর্তে ভালোবাসা পেতে পারবে। মিশমি জানে তার বন্ধুরা তাকে খুব ভালোবাসে দেখেই তিহাম আর তার সম্পর্ক নিয়ে চিন্তিত। তাইতো মিশমি না রেগে এই ভালোবাসাটা উপভোগ করে গিয়েছিল গতকাল। সে এটাও বলেছিল যে, সে তার ভালোবাসায় বিশ্বাসী। তিহাম যদি এখনও খারাপ হয় তো সে নিজের ভালোবাসা দিয়েই তিহামকে শুধরে দিবে। কিন্তু এইসব শুনে সাইফ মোটেও সন্তুষ্ট নয়। সে বলল,

“ মিশমি একটু বেশিই ইমোশনাল! আরেহ আবুল, ওই নিজের নামে সবকিছু স্বীকার না করলে তো মিশমি এমনিই জেনে যেত যে, তিহাম একটা ধান্দাবাজ। তারপরও কি মিশমি রিলেশনশিপে যেত? ব্যাটা আস্ত আবুলরেই বশ করার জন্য পাইছে। ”

এই কথা শুনে তারা দুজন-ই সহমত প্রদর্শন করল।ফাঁকা পেয়ে রিশান একবার সায়ানের দিকে তাকাল। আরাভ আর আবির নিজেদের আলোচনায় মগ্ন থাকলেও সায়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে নানান বাহানায় তিহাম-মিশমিকে দেখছে। এই দেখে রিশান বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল,

“ সায়ান ভাই মিশমিরে খুব লাইক করে, তাই না সাইফ ভাই? ”

সাইফ চমকে উঠল। সায়ান বলেছিল যে, নীলাশা সব বুঝে গিয়েছে। কিন্তু বিষয়টা যে তারা এতো দ্রুতই জেনে যাবে তা বুঝতে পারেনি। সাইফ আগের থেকেও সতর্কতা অবলম্বন করে বলল,

“ তোরা জানিস? ”

রিশানের ব্যথিত উত্তর, “ আসল মানুষটা বাদে সবাই-ই সবটা জানি, সাইফ ভাই ! ”

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

( আজ আরাভ আর নীলাশাকে নিয়েও লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সময় পাবো না বলে লিখতে পারলাম না। পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here