তারকারাজি- (১১)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
আকাশ থেকে খণ্ড খণ্ড মেঘ সরে গিয়ে উদোম হয়েছে রাত্রির বিশাল কৃষ্ণাভ নীল আকাশ। বদ্ধ বারান্দার গ্রিলে জমেছে বিন্দু বিন্দু শিশিরকণা। মিশমি তার আদুরে হাতে শিশির স্পর্শ করতেই যেন তা লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে, গড়িয়ে পড়ে শূন্যে। গৃহময় প্রকট নীরবতা। বাহিরে শৈত্য হাওয়া বইছে, শনশন শনশন। মিশমি এক টানে চুলের বাঁধন খুলে ফেলে। হাওয়ার দোলায় দুলতে দেয় স্বাধীন চুলের গুচ্ছকে। আজ চারটে দিন কেটে গেলেও তিহামের বার্তা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা হয় না মিশমির। মিশমি শুনেছিল, কিছু ‘অজানা’ অজানা থাকা-ই ভালো। জেনে গেলে না-কি তার প্রতি আকর্ষণটা কমে যায়। তিহামের প্রতি তার আকর্ষণটাও কমে গেল না-কি? হয়তো সত্যিই কমে গেছে। যেখানে আকর্ষণ-ই থাকে না সেখানে প্রেম হয় কী-করে? ভালোবাসার কথা তো দূরেই থাকল। মিশমি তার মোবাইল ফোনের পর্দায় তাকায়৷ মেসেজ ও কলের প্রজ্ঞাপন উপচিয়ে পড়ছে যেন! তার ধারণা করা শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের মানুষটা এমন বেপরোয়া হলো কেন? অধীরতায় যেন মারা যাচ্ছে তিহাম! মিশমি ফোনের একটি নির্দিষ্ট বোতাম শক্ত করে চেপে ধরে। ফোনটা বন্ধ হয়ে যেতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার। মিশমির কী করা উচিত? ভেবে পায় না সে।
একটার পর একটা ক্লাস করে মাথাটা ভীষণ ভার-ভার লাগছে নীলাশার। ক্লান্ত দেহটাকে আরেকটু পুড়িয়ে সে এগিয়ে যায় রোকেয়া হলের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে-উঠতেই নীলাশা উপলব্ধি করল, সে ভীষণ ক্লান্ত আজ। শরীরের ভারটা বোধহয় আর বয়ে চলা সম্ভব হবে না নিজের পক্ষে৷ তবে হ্যাঁ, নির্দিষ্ট কক্ষে গিয়েই কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখতে পায় নীলাশা। সানাম এই ভ্যাপসা গরমেও নিজেকে আগা-গোড়া কাঁথায় মুড়িয়ে রেখেছে। নীলাশা ভাবল একবার কথা বলবে তার সাথে। নয়তো বন্ধু দু’জনা তো মুখ ভার করে বসেছে যে, সানামের শিক্ষা না-হওয়া পর্যন্ত তারা কথা বলবে না। মানুষকে তেল মালিশ করার সময় না-কি তাদের নেই। আচ্ছা, কারো কষ্টে তাকে সান্ত্বনা দেওয়া কি তেল মালিশ করা? এদেশে ফিরে এসে নীলাশা একটা জিনিস খুব ভালো বুঝেছে যে, দেশ ভেদে বন্ধুত্ব ও বন্ধুর আচার-আচরণ পর্যন্তও ভিন্ন হতে পারে। নীলাশা নিজেই নিজের ভাবনার বিচ্ছেদ ঘটায়। দরজায় দাঁড়িয়েই উঁকি দেয় সানামের দিকে। মেয়েটার শরীর কি মৃদুভাবে কেঁপে উঠল না? নীলাশা অপেক্ষা করে কিছুক্ষণ। এক মিনিট যায়, দুই মিনিট যায়… অতঃপর আবারও সানামের শয়নরত দেহকে কেঁপে উঠতে দেখে সে। নীলাশার মনে হলো সানাম কাঁদছে। এখন কি তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে? না, নীলাশা আর ডাকে না সানামকে। তার মনে হয়, কেউ কাঁদতে চাইলে তাকে কাঁদতে দেওয়া উচিত। কারণ মানবজাতি মিথ্যে হেসে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারলেও মিথ্যে কেঁদে মন হালকা করতে পারে না। নীলাশা হল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগে।
রোকেয়া হল থেকে বের হওয়ার পথেই রিশানের কল এসেছিল। মিশমির মা ঝুমুর বেগম কয়েক দিনের জন্য বাসায় থাকবেন না। মঈনুল হোসেনকে কোনোভাবে রাজি করিয়ে নিলেই তাদের বন্ধুদের দুই বছরের পরিকল্পিত যাত্রাটা অসাধ্য সাধনে রূপ নিবে। এখন তো পিহু-ও যোগ হয়েছে দলে। মিশমির মাকে ফাঁকি দেওয়ার পরিকল্পনাটা বেশ গুছিয়ে নিয়েছে বাকিরা। এখন নীলাশার পরিবারকে রাজি করানোর বুদ্ধি আঁটতে হলেও তো নীলাশাকে প্রয়োজন হবে? তাই নীলাশার যত তাড়া! এটা সত্যি কথা যে, নীলাশা বৈদেশিক সমুদ্র দেখেছে। কিন্তু নিজ দেশের সমুদ্র স্ব-চোখে দেখা হয়নি তার। বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যেতে কার না-ইচ্ছা করে? সমুদ্রের পাড়ে কেমন আনন্দ করবে তা ভাবতে ভাবতেই টিএসসির দিকে ছুটে যায় সে। কিন্তু সেখানে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আর দেখা করা হয়নি তার। নীলাশা দূর থেকেই দেখতে পেয়েছে যে, আরাভ ও তার কয়েক জন বন্ধু মিশমি ও পিহুসহ নিশান-রিশানের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। নীলাশার পা দুটো তখনই থমকে দাঁড়ালো। সেদিনের পর আরাভকে আজ-ই প্রথম দেখছে সে। তাকে দেখা মাত্রই যেন নীলাশার দু’কাঁধ শীতল, মোলায়েম এক হাওয়া ছুঁয়ে গেল। আরে, এটা কি সত্যিই হৈমন্তিক হাওয়া ছিল? না-কি ছিল প্রণয়িনীর লুকায়িত মনের ধরা দেওয়ার ডাক? হঠাৎই ভীষণ লজ্জায় একদম লজ্জাবতী তরুর মতো নুইয়ে গেল মেয়েটি। যে প্রণয়িনী বহুত আগেই সেই মানবের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে, সে নতুন করে আবার কীভাবেই-বা ধরা পড়বে? নীলাশা আরাভের সামনে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। সে জানে, তার অত্যন্ত কোমল প্রণয়ী মন আজ আবারও নিজের অনুভূতির নগ্নতা প্রকাশ করে ফেলবে৷ না, এই মুহূর্তে আরাভের সামনে যাওয়া যাবে না। নীলাশা উল্টো পথে পা বাড়ানোর জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই মিশমির ডাক আসে,
“ নীল, এদিক আয়। ”
নীলাশা আবারও থমকে দাঁড়ায়। জিভ কামড়ে ধরে দ্বিতীয় ভুল করার মতোই পিছনে ঘুরে তাকায় সে। চোখ পড়ে তারকারাজিদের সাথে আরাভদের গোটা সমাবেশ। তারাও নীলাশাকে দেখছে। আরাভের চোখে চোখ পড়ে তার। নীলাশা কেঁপে ওঠে। আরেহ্, না দেখতে পাওয়ার ভান করে চলে গেলেই তো হতো! বোকার মতো পিছনে ঘুরতে গেল কেন সে? নীলাশার বুকটা প্রবল বেগে কাঁপছে। শিরা-উপশিরায় শীতলতা প্রবাহ হচ্ছে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতেই ফের নিশানের ডাক এলো। নীলাশা আর দেরি করে না। ছুটে চলে সেই পথের দিকে, ঠিক যে পথটা একদম মিশমিদের বিপরীতে। নীলাশার হুড়মুড়িয়ে উল্টো দৌড় দেখে কয়েক জোড়া দৃষ্টিতে যেন রাজ্যের বিস্ময়! পিহু ভূত দেখার মতো বলে উঠে,
“ ও পাগল হয়ে গেছে না-কি? দৌড় মারল কেন? ”
পিহুর অভিনয়তে আরেকটু অভিনয় যোগ করে রিশান চোখ কচলে তাকাল। ওই দূরে দৌড়ে যাওয়া নীলাশার দিকে উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে বলল,
“ মামা, ঘটনা জটিল! সুন্দ্রী চলেছে একা পথে। তার মানে ভেজাল নিশ্চিত আছে। ”
মিশমি কটাক্ষ করল, “ এই, সব-সময় তোরা ওর পিছে লাগিস ক্যান? হয়তো দরকারি কোনো কাজের কথা মনে পড়ছে আর তাই তা করতে গেল। এতে এত সন্দেহ করার কী আছে? ”
নিশান তেতে উঠে, “এই ছেড়ি ঝাণ্ডুবাম! তোর কি মাথা ধরানি আলাপ না-করলে টয়লেট ক্লিয়ার হয় না? শোন, এমন অনেক কিসসা আছে যে, বিদেশী মাইয়ারা এই দেশে এসে প্রেমে প… ”
পিহু নিশানকে কথা শেষ করতে না দিয়েই কেমন বিজ্ঞদের মতো বলে উঠল, “ আমি তো সবটাই জানি! ও প্রেমে পড়ছে এইটাও জানি আর কার প্রেমে পড়ছে সেইটাও জানি। সে তো বর্তমানে… ”
মিশমি আর কথা বাড়াতে দেয় না৷ এখানে তাদের থেকেও বয়োজ্যেষ্ঠ ছেলেরা উপস্থিত। অথচ তারা কি-না নির্লজ্জের মতো সরাসরি নীলাশার প্রেম বিষয়ক আলোচনা করছে? মিশমির চোখের ইশারায় থেমে যায় পিহু। আসল ব্যাপারটা তারা দুই বান্ধবী সেদিন-ই বুঝতে পেরেছিল যেদিন নীলাশা আরাভের সাথে শেষবারের মতো কথা বলেছিল। ঘটনা যে সত্য তা আজ যেন হাড়েহাড়ে প্রমাণিত! কিন্তু বাকি দু’জনকে কে বোঝাবে যে, মেয়েটি উল্টো পথে দৌড়ালেও মেয়েটির প্রণয়ী মনটা ফের ছুটে এসেছে শ্যামবর্ণের কাছে?
বেশ অস্বস্তিতেই গোটা দিনটা কেটে গেল নীলাশার। দিনের সৌন্দর্য বা বিমর্ষতা সম্পর্কে জানা নেই তার। তবে অন্য কোথাও নীলাশার মতোই দারুণ অস্বস্তি বুকে চেপে, কারো কল পাওয়ার জন্য অধীর অপেক্ষায় জবুথবু হয়ে বসে আছে পিহু। ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে বিমিশ্র মিঠে হাসিতে প্রিয় মানুষটির কণ্ঠ পাওয়ার ভীষণ ব্যাকুলতা! সে জানে, ফোনটি বাজবে… বেজে উঠবেই এইবার। সময় যে হয়ে এসেছে! অতঃপর ফোনের পর্দায় ভেসে উঠল কাঙ্ক্ষিত মানুষটির নাম, আদ্রাফ। পিহু ফোন তুলে নেয় ঝটপট। ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে,
“ দেড়ি করে ফেললাম, তাই না? ”
পিহু মুচকি হাসে। ফিসফিসিয়ে উত্তর দেয়,
“ একদম না৷ কেমন আছো তুমি? ”
“ আমি আর ভালো না থেকে পারি না-কি? আমি ভালোই আছি। শুধু তোমার শূন্যতায় পুড়ছি ভীষণ। ”
পিহু খুব সাবধানে হাসে। এই হাসিতে প্রণয়-প্রীতি যেন তৃপ্তির চূড়ায় পৌঁছে যায়। পিহু হারিয়ে যায় পুরনো দিনের রঙে। গহীন বর্ষণে কলেজ পড়ুয়া পিহুর মাথায় ছাতা ধরা রোগা-সোগা আদ্রাফ ছেলেটি ছিল পিহুদের এক সিনিয়র আপুর বড় ভাই। প্রেমের প্রস্তাবটা আদ্রাফের তরফ থেকেই এসেছিল। মাস খানিক কেটে যাওয়ার পর যখন প্রেমের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিল পিহু, তখন সবে নতুন চাকরি পাওয়ায় ময়মনসিংহ থেকে খুলনা শহরে বসবাস শুরু করে আদ্রাফ। পিহুর তখন ফোন ছিল না। বাধ্য হয়ে আদ্রাফের ছোট বোনকেই লুকিয়ে-চুরিয়ে একটা ফোন জোগাড় করে দিতে হয়েছিল তাকে। সারা রাত জেগে কথা হতো তাদের। কিন্তু প্রণয়ের মাস দুয়েক পেরোতে না-পেরোতেই ফোনসহ ধরা পড়ে যায় পিহু। তখন পিহুকে পারিবারিক শাসন সহ্য করতে হয়েছিল অনেক। ফোনটার কী অবস্থা করেছিল তার পরিবার তা এখনো জানে না সে। তাদের সম্পর্কে আসে দীর্ঘ বিরতি। তবে পিহু ঢাকা শহরে আসার আগেই আদ্রাফ ও তার দীর্ঘ দূরত্বের সম্পর্ককে মেনে নেওয়া হয় তাদের দু’জনার পরিবারে। ছেলে ভালো কোম্পানিতে চাকরি করছে। দেখতে-শুনতেও যেমন ভালো, পারিবারিক অবস্থাও তেমন ভালো। বছর কয়েক পরে তাদের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটাও চূড়ান্ত হয়েছে। এই সকল কথা যেন আয়নায় প্রতিচ্ছবি দেখার মতো ফুটে ওঠে পিহুর অন্তরাক্ষীতে। প্রণয়ের সেই সময় যেমন সুন্দর ছিল, তেমনই সুন্দর লাগে প্রণয়ের এই সমটাকেও। শুধু অপেক্ষা চিরতরে পূর্ণতা পাওয়ার!
“ হ্যালো? লাইনে আছো তো? ”
পিহু চমকে উঠে আদ্রাফের কণ্ঠে। সেই কণ্ঠে কী গভীর আবেগ! পিহু ফিসফিসিয়ে উত্তর দেয়,
“ হুম, আছি। বলো। ”
“ এমন ফিসফিস করে কথা বলছো কেন? ব্যস্ত না-কি? ”
পিহু একবার নিজের আশেপাশে তাকায়। অতঃপর বলে,
“ বড় আপুরা আছে রুমে। কথা বলতে পারছি না একটুও। আর না বাইরে যেতে পারছি। ”
“ বুঝতে পারছি। ”
কথাটা বলেই স্বল্প সময়ের বিরতিতে আদ্রাফ আবারও বলল,
“ আচ্ছা, আমার পোস্টিংটা ঢাকায় হয় না কেন বলো তো? খুলনা গেলাম, বরিশাল গেলাম… তোমার কাছাকাছি কেন যাওয়া হয় না? ”
পিহু না-চাইতেও খিলখিল করে হেসে উঠে। সে বলে,
“ সবুর করেন মহারাজ! সবকিছু একবারে পেতে হয় না। আমরা দূরে থেকেও একে-অপরকে ভালোবাসতে পারছি, এটাই অনেক। নাহলে সবাই কি ভালোবাসায় এই দূরত্ব মেনে নিতে পারে? ”
“ আচ্ছা! তুমি স্বীকার করছো যে তুমি আমার থেকে হাজার দূরে থাকলেও আমাকে ভালোবাসবে? এমনকি আমি মরে গেলেও আমাকেই ভালোবাসবে? ”
আদ্রাফের কথাটা বলা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই পিহু সংযোগে বিচ্ছেদ ঘটায়। ফোনটা বন্ধ করে রেখে দেয় বিছানার এক কোণায়। আদ্রাফের বলা কথাটা যে এই প্রথম শুনছে পিহু, তা নয়। এর আগেও আদ্রাফ এমন প্রশ্ন করেছে তাকে। পিহুর মনটা তখনই খুব খারাপ হয়ে যেত। এইবারও তা-ই হলো। উল্টো দিকে ফিরে শুয়ে ভাবতে লাগে পিহু, জন্ম যখন হয়েছে তখন মৃত্যুও হবে। কেউ আগে যাবে আর কেউ পরে৷ শুধু একটাই প্রার্থনা, সেই মৃত্যু যেন তাদের কাছে বেদনাদায়ক না হয়। সেই বেদনা আদ্রাফ সহ্য করতে পারবে কি পারবে না তা জানা নেই পিহুর। তবে পিহুর কাছে আদ্রাফকে হারানোর ব্যথাটা তাজা-ই রয়ে যাবে আজীবন। পিহুর জীবনে এমনটা না হোক। প্রিয় মানুষকে হাসিমুখে বিদায় দেওয়ার একটা লিখিত নিয়ম হোক। সেই নিয়ম ভঙ্গের-ও কঠিন সাজা জারি করা হোক। শুধু নিজের প্রিয় মানুষগুলোকে বিদায় দিতে পিহুর বিন্দুমাত্র কষ্টও না হোক!
#চলবে ইন শা আল্লাহ!
(রি-চেইক করা হয়নি। কোনো ভুল থাকলে জানাবেন)