তারকারাজি- (০৪)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
আকাশটা মেঘলা। শারদীয় বর্ষণের সমাপ্তি ঘটেছে বহুক্ষণ আগেই। মিশমি এক হাতে তার সাদা সালোয়ার উঁচু করে বেশ সাবধানে হেঁটে চলেছে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুদের কাছে। বিস্তীর্ণ তৃণাবৃত মাঠটা যেমন বৃষ্টিস্নানে সতেজ দেখাচ্ছে। তেমন-ই মাঠের এখানে-সেখানে থৈ-থৈ করছে কাঁদা-জল৷ অথচ তার পাশাপাশি হেঁটে চলা বান্ধবী নীলাশার কোনো উদ্বিগ্নতা-ই নেই নিজের পরিধানকৃত সাদা চুড়িদার নিয়ে। সে আনমনে এদিক-সেদিক তাকিয়ে হেঁটে চলেছে বেশ! এমন সাবধানতা অবলম্বন করেই মিশমিরা গিয়ে পৌঁছাল নিশানদের কাছে। বলা বাহুল্য যে সেখানে নিশান, রিশান ও পিহু তো ছিলই। সেই সাথে আরও একদল ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। নীলাশা গুরুত্ব না-দিলেও অস্বস্তিতে জবুথবু হয়ে যাচ্ছিল মিশমি। গুনে-গুনে সাতটা ছেলে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা ছেলে তো রসিকতায় বলেই ফেলল যে, নিশানরা আজকাল মেয়েদের পিছনে ঘোরা শুরু করেছে। সেই নিয়ে পিহুর কী প্রতিবাদ! সে তো খিটখিটিয়ে বলেই বসল,
“ কেন ভাইয়া, বন্ধু বলে কোনো শব্দ কি আপনাদের ডিকশনারিতে নেই? ”
সেই নিয়েই তাদের মাঝ থেকে শিহাব নামের একটি ছেলে অমর্ষ সমালোচনা করে বসল। পিহু পরাস্ত হলো ঠিকি কিন্তু সমালোচনাটা আঘাত হানল মনে৷ এদিকে শিহাবের ঠাট্টাকে ভীষণ নিন্দিত সমালোচনা হিসেবে ধরে নিয়ে ক্ষিপ্ত হলো নীলাশা। নীলাশার অপরিবর্তিত এক বৈশিষ্ট্য, বন্ধু মানেই তার প্রাণ! বন্ধুত্বের ব্যাপারে এমন ধারণা সে মানবে না। তীক্ষ্ণ চোখে শিহাবের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
“ হুয়াই আর ইউ টকিং লাইক দিজ, মিস্টার শিহাব? আপনার কাছে ফ্রেন্ডশিপের মানে এমন জঘন্য কী-করে হতে পারে? অ্যাকচুয়লি ইউ নো হুয়াট, ইউ গাইজ হ্যাভ আ চিপ মেন্টালিটি লাইক দ্য সো-কল্ড ডিসগাস্টিং পার্সন। ব্লাডি… ”
নীলাশা সম্পন্ন করতে পারল না তার কথা। তার আগেই রিশান ধমকে বলল,
“ ব্রিটিইশ্শা মাইয়া, অফ যা এইবার! বড় ভাইদের সাথে তুই এখন লাগালাগি করবি? অবশ্য ব্রিটিশরা এছাড়া আর পারে কী? বাঙালিদের উপর অত্যাচার করা তো তাদের স্বভাব। ”
পিহু উত্তর দেয়,
“ তুই ওকে কেন দুষতাছিস? ও একদম ঠিক কথা বলছে। আর হ্যাঁ শোন, সব-সময় ওর ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে ওকে খোঁচাবি না৷ ওর মাতৃভাষা বাংলা। বিদেশে পড়াশোনা করেছে বলেই সেই দেশের ভাষা বলায় অভ্যস্ত ও৷ ভাষায় নীল ব্রিটিশদের মতো হতে পারে, রক্তে না। ”
পিহুর কথাটাও পছন্দ হয় না রিশানের। কথা কাটাকাটি করতেই জানা যায়, পিহুও নীলাশার কথায়-কথায় ইংলিশ বলায় বিরক্ত হতো। তাদের বাক-বিতণ্ডা থামাতে মিশমি বলল,
“ থাম না ইয়ার! কেন আজাইরা ঝগড়া করছিস তোরা? নীলকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা না-করলে কি তোদের দুই ভাইয়ের খাবার হজম হয় না? ”
নিশানের স্পষ্ট কথা, “ তো কি তোকে নিয়ে তামাশা করব, মাদারবোর্ড? তুই তো সারাদিন হাম্মা-হাম্মা কইরা দিনরে রাত আর রাতরে দিন করিস৷ অনেক পোলারে দেখছি মাও-পাগলা হয়। তুই মাইয়া হইয়ে যে মাও কইয়া জ্ঞান হারাস, সেইটা মাইকিং করতে বলছিস? আর তোর মাও উঠতে-বসতে তোর মাথায় যে প্যারেক মারে, সেইটাও বলতে বলছিস? তোর জামাইয়ের কপালে বিরাট দুঃখ আছে এমন শয়তান শ্বা… ”
“ আম্মুকে নিয়ে কিছু বলতে নিষেধ করেছি, নিশান! ”
মেয়েটা ধমকও দেয় খুব নিম্ন স্বরে। সামনের ছেলেগুলো মজা নিচ্ছিলো ভালোই। তারপর শুরু হলো তাদের পরিচয় পর্ব। পরিচিত হতে-হতে অপর পক্ষের ছেলেগুলোর নাম সায়ান, রোহান, সাহেল, শিহাব, তনয়, সাইফ বলে শেষ করে যখন নিশান বলে উঠল গিটার হাতে ছেলেটির নাম আরাভ। তখনই যেন নীলাশার মন মোচড় দিয়ে মুখে বুলি ফুটিয়ে তুলল,
“ কে আরাভ? ”
হঠাৎই সেই প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে থমকে যায় নিশান৷ পরিচয় পর্বে নীলাশার গুরুত্বহীন ভাবটা যে কীভাবে এতটা গুরুত্বে টইটম্বুর হয়ে গেল তা ধরতে পারছে না সে। নীলাশার হুট করেই কী যেন হয়ে যায়! এই মেয়েকে বোঝা মুশকিল বলেই মনে করে নিশান৷ সে ঠিক নীলাশার সামনের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলে, “ এইযে এইটা আরাভ ভাই। ”
সেই প্রথম তাকানো, আপাদমস্তক কৃষ্ণাভ ছায়ার সুদর্শন পুরুষটাকে দেখে নেওয়ার ইচ্ছা দমিয়ে রাখা আর হলো না নীলাশার। আরাভের মাথার ঝাঁকড়া চুল আর শ্যামবর্ণের ছিমছাম মুখের গঠন দেখে নীলাশার মনে একটা শব্দই উঁকি দিয়ে উঠল, কবি। আরাভের এহেন চিত্র তার কাছে কবিদের মতোই লাগছে যার গহীন নয়নে ডুবন্ত কতশতই-না কবিতা! ঠিক সেই সময়টা আরাভের চোখও অস্থির নীলাশার চোখের চাহনি পড়তে ব্যস্ত। এইযে একটু আগের বেখেয়ালি, উদ্বেগহীন মেয়েটা তার নাম শুনেই কেমন খেয়ালি হয়ে উঠেছে। এতে অবশ্য আরাভ অবাক হয়নি। কারণ সে নীলাশার মুখটা দেখে অল্প হলেও ধারণা করতে পেরেছিল কিছু। আর যখন সে গরগর করে শিহাবের প্রতি রাগ দেখিয়ে উঠল। তখন যেন ধারণাটা বিশ্বাসেই পরিণত হয়ে গেল আরাভের। সে নীলাশার এরূপ অস্থিরতা দেখেও বলে উঠল,
“ বিষাদকন্যার চোখ দুটো স্বাভাবিক হয়েছে? না-কি এখনও বিষাদে ভরে আছে? ”
বিষাদকন্যা… কী নাম! নীলাশার মনে হঠাৎই উঁকি দেওয়া বেমানান শব্দটা আর বেমানান রইল না যেন। ছেলেটির মাঝে হয়তো সত্যিই কবি-কবি ভাব দেখতে পেয়েছিল নীলাশা। আরাভের মুখে ওই নামটা শুনে যে নীলাশার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছিল, তা আর চোখ এড়িয়ে গেল না কারোর। সবাই যেন সবার গোপনেই সাংঘাতিক কিছু কথা ভেবে নিল। সেই অনুযায়ী প্রশ্ন করতেই আরাভ খুব সুন্দর করে তাদের ভাবনাকে ঘুরিয়ে দিয়ে জানালো তাদের প্রথম দেখার কথা। কোনো এক অন্ধকার রাজ্যে অভিমানিনীর সাথে কাটানো কিছু মুহূর্তের কথা কেটে-ছেটে আরও বেশি হ্রস্বতর করে বলে ফেলল আরাভ। বুদ্ধিমতী নীলাশাও ব্যাপারটা বুঝে আরাভের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ আর না-তে না মিলালো। ঠিক তখনই নিশান বলে উঠল,
“ দেখছোস বান্ধবী, আরাভ ভাই-ও বুঝছিল তুই আলালের ঘরের দুলালি। ”
কথাটা শোনা মাত্রই ঠিক পাশে দাঁড়ানো বন্ধুর পায়ে নিজের জুতোর দ্বারা অসহনীয় আঘাত করার ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল নিশান। মুখে ব্যথাময় শব্দ এঁটেই বলল,
“ বেয়াদব মহিলা! মাইয়া মাইনষের আর কিছু থাকুক বা না-থাকুক, সর্বনাশী এক জোড়া জুতা থাকবোই থাকবো। মাইয়া মানেই জ্বালা! ”
নিশানের কথা শুনে দুই পক্ষই হেসে উঠল। কথায় কথায় জানা গেল, হাইস্কুলে কর্মরত শিক্ষক মঈনুল হোসেনের সাথে আরাভের বাবা প্রফেসর আহসান চৌধুরী ও আরাভের কী-সব দরকারি কাজ আছে৷ মঈনুল হোসেন নিশানদের বান্ধবীর বাবা জানতে পেরে আরাভের কাজটা করায় সুবিধা-ই হবে বেশ! তার জন্যই আরাভের মিশমির সাথে কথা বলা। সেই সাথে দুই বন্ধুদলের যে এভাবে পরিচয়টা হয়ে যাবে তা জানা ছিল না তাদের। আরাভ আর নীলাশারও জানা ছিল না যে, হঠাৎ দেখা হওয়া একদম অপরিচিত দু’জনার পরিচয়টা এত সহজেই হয়ে যাবে। মনে হয় একটু জলদিই ছুটে এলো তাদের পরিচিত হওয়ার সময়টা! সময়ের যেন খুব বেশিই তাড়া!
মিশমির কাছে কলটা এলো ঠিক মধ্যরাতে। যখন বাহিরে শনশন হাওয়ায় এলোমেলো হতে থাকা চুলগুলোকে খুব যত্নে বিনুনিতে বেঁধে ফেলতে মিশমি ব্যস্ত ছিল ঠিক সেই সময়েই। মিশমির রাত করে পড়াশোনা করার অভ্যাস রয়েছে। তাই ঘুমোতে-ঘুমোতে রাত একটা বা দেড়টা বাজা নতুন কিছু না। আজও হয়তো ঘুমোতে-ঘুমোতে একটা বেজে যেত। কিন্তু তার আগেই এই অপরিচিত নাম্বারের কলটি ধরে মিশমি যতটা পাগলপ্রায় হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করে বোঝানোটা বেশ মুশকিল! মিশমি যখন ফোনটা কানে ধরে ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলো তখন ওপাশের মোহাবিষ্ট পুরুষ কাব্যিক স্বরে বলে উঠল,
“ পারুলতা মিশমি, তোমায় প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিন তুমি ছিলে আস্ত একটা পারুল ফুল। তুমি তো পরী। তোমার কি আদৌ কোনোকিছুর কমতি রয়েছে? অথচ সেদিনের আমি তোমার মোহমাখা রূপের মোহে পড়তে পারিনি৷ খুব করে চেয়েছিলাম সেই মোহে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখতে। কিন্তু পারিনি আমি। আসলে সুন্দরের প্রেমে পড়তে চাইনি৷ কারণ সুন্দরীরা না-কি সাধারণ ছেলেদের ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে থাকে। তোমাকে দেখার অনেকগুলো দিন হয়ে গেল জানো? কিন্তু তোমায় ভুলে থাকা হলো না আমার। কত ছলনায় তুমি উঁকি দিতে লাগলে আমার মনে। অথচ কথা ছিল তোমাকে ভুলে থাকার। আমি যে ভীষণ অসুস্থ। তুমি কি জানো তোমার দেওয়া এই অসুস্থতার ওষুধ আমি কোথায় পাবো? মিশমি, তোমায় ভালোবেসে ফেলিনি তো আবার? তাহলে যে সেই পারুলতাতেই আমার মরণ নিশ্চিত! ”
সংযোগ কেটে গেল। এত রাতে কল করা কে এই প্রশ্নদাতা? মিশমি ত্রস্ত-মনে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই একটি অরুচিকর কাজ করে বসল। নাম্বারটিতে কল করে গেল একের পর এক। কিন্তু একি! কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলেই জানা গেল। উত্তেজনায় সুধীরতা থেকে অধীরতায় পরিবর্তন হওয়া মিশমির মন যেন নেশাসুলভ কিছু খুঁজে পেয়েছিল সেই পুরুষের কণ্ঠে। দেয়াল ঘড়িতে একের পর একেক ঘর অতিক্রমের ঘণ্টা বেজে উঠে। মিশমি শুনতে পায়। তবে মনের ব্যাকুলতা দূর হয় না তার। কে এই সুকণ্ঠ পুরুষ? না-জানা পর্যন্ত যেন মিশমির মনের এই অস্থিরতা দূর হয় না। সে অপেক্ষা করে। বিনিদ্র রাত্রি থেকে ভোরের প্রথম আলো ফুটতে দেখে। অথচ সংযোগ স্থাপন-ই ঘটাতে পারে না সে। নিজের অদ্ভুত ইচ্ছায় সে নিজেই অবাক হয়ে যায়। রাত্রি জেগে কোনো পুরুষের পরিচয় পেতে চাওয়ার মতো পাগলামোটা মিশমি এই জীবনে করেছিল কি-না সন্দেহ!
শারদীয় বর্ষণপূর্ণ রাত্রিটা মিশমির অনিদ্রায় কাটলেও সকাল হতেই রাজ্যের ঘুম ভর করল তার চোখে। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটে মাখো-মাখো ঘামে জবজবে শরীরটায় যখন কারো স্পর্শে মিশমির চোখ প্রসারিত হলো, তখন তার মস্তিষ্কে যেন বিদ্যুৎপ্রভার মতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ধারণাশক্তি। সে তো সকালে ঘুমিয়েছিল। ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় ফুরিয়ে গেল না-কি? মিশমি ত্রস্তব্যস্ত স্বভাবে উঠে বসে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাল। সাড়ে সর্বনাশ বেজে গেছে যে! পাশে দাঁড়ানো মায়ের বকুনি কম জুটল না তার কপালে। মা যেতেই চোখ থেকে ঘুমের চিহ্ন মুছে ফোনের স্ক্রিনে তাকাল মিশমি। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা বার্তাটি চোখে পড়তেই চমকে উঠল সে। কাল রাতের সেই অপরিচিত নাম্বার থেকে বার্তা পেয়ে মনটা আবারও ছটফটিয়ে উঠল মিশমির। সেখানে লেখা ছিল,
“ নবীনবরণে পারুলতাকে পারুল বেশেই দেখতে চাই ”
#চলবে ইন শা আল্লাহ!
[কিছুটা সমস্যায় থাকায় পর্ব বড় করে দিতে পারছি না৷ তবে আমি এর থেকেও বড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব, ইন শা আল্লাহ]