তোমাতেই অস্তিত্ব আমার পর্ব-২৯

0
2281

#তোমাতেই_অস্তিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা

২৯.

রেজিস্ট্রি পেপার সামনে নিয়ে কাদছি।টকটকে লাল লেহেঙ্গা গায়ে জড়িয়ে, ভারী ভারী গয়না পরে বিয়ের সাজে সেজে বসে আছি।পায়ে দড়ির বাধন আমার।কাবিননামায় বরের সাক্ষরের জায়গাটায় ইশতিয়াক আরমান নামটা জ্বলজ্বল করছে।আর সে মানুষটা শেরওয়ানী পরে আমার আব্বুর কপালে গান ঠেকিয়ে বাকা হাসছেন।কোনো বিশাল বাসার ড্রয়িংরুম এটা।অনেক বড়।আশেপাশে কালো সুটবুট পরা বডিগার্ডের মতো দশ পনেরো জন দাড়িয়ে ।আব্বুকে আর কবির আঙ্কেলকে চেয়ারে মুখ বেধে হাত পা বেধে রাখা।সবটা দেখছেন ওনারা,ছোটার চেষ্টা করছেন আর চোখের পানি ফেলছেন।পাশের রুম থেকেই আম্মু,মাইশু,রিয়াপি,ওর আম্মুর আওয়াজ আসছে।সবার সাথে আমাকেও তুলে এনেছেন উনি,জোর করে বিয়ের সজে সাজতে বাধ্য করেছেন।

-সাইনটা করো মিথি।

কান্নারত অবস্থাতেই তার দিকে তাকালাম।এই মানুষটা এতো হিংস্র তা আমার কল্পনাতীত ছিলো।ওনাকে বলেছি আমি,আব্বুর ইচ্ছাতেই বিয়ে করবো আমি।তা বলে এমনটা করবেন উনি?

-সইটা করো না!ধৈর্যে সইছে না আমার!আজ থেকে আর তোমাকে দুরে সরিয়ে রাখতে হবে না।

আমি কাদতে কাদতেই বললাম,

-কেনো এসব করছেন আপনি?ছেড়ে দিন না সবাইকে।প্লিজ!

-কেনো করছি?মিস্টার আলম কোন সাহসে তোমার বিয়ের কথা ভাবে মিথি?তুমি জানো,কাল তোমার বিয়ে দেওয়ার প্লান ওনার?এতোটা বেশি অধিকার দিয়ে দিয়েছো তাকে যে সে তোমার কথাই ভাবতে ভুলে গেছে।

অবাক হয়ে আব্বুর দিকে তাকালাম।সেদিন আরমানকে অস্বীকার করার পর কোনো ছেলেই দেখতে আসে নি আমাকে।বিয়ে কি করে?এভাবে না জানিয়ে?আব্বু এসব কি করে ভাবলেন?আব্বু মাথা নাড়িয়ে মানা করছেন।

-সেদিন তুমি আমাকে রিজেক্ট করার পর তোমার বাসার ধারে কাছে একটা ছেলেকেও যেতে দেইনি।তোমার আব্বু টের পেয়ে তাই লুকিয়ে বিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন তোমার।

আরো বেশি করে কান্না পাচ্ছে আমার।কাদছিও।বললাম,

-বিশ্বাস করি না।

-আমিও বিশ্বাস করি না তোমার আব্বুকে।সইটা করো।

-কি সমস্যা?আমি আমার ইচ্ছেতে বিয়ে করবো।আব্বু যদি ভেবে থাকেন তবে তাই।এমন কেনো করছেন আপনি?প্লিজজ্ যেতে দিন।

-সাইনটা করো।কান্নাটাও বন্ধ করো।

আমি কাদছিই।উনি কপালটা আঙুলে স্লাইড করিয়ে বললেন,

-রাগ তুলো না আমার।ডু ইট!অর…

-অ্ অর?

-এটাকে সিরিয়াসলি নাও।

বলে গানটা আরো জোরে আব্বুর কপালে চেপে ধরলেন আরমান।আব্বু তবুও মাথা দিয়ে মানা করছে।ভয়ে কাপছি আমি।আরমান বললেন,

-এমনিতেও মাহবুব আলমের উপর রাগ আছে আমার।সাইনটা না করলে সেটা বেরিয়ে আসবে মিথি।

ফুপিয়ে কাদছি তখনো।উনি চেচিয়ে বললেন,

-সাইনটা করো!

ধমকে আতকে উঠলাম।কোনো উপায় নেই আমার আর।কাপাকাপা হাতে সাইনটা করলাম।তারপর কোনো এক বয়স্ক কাজী এসে ইসলামী রীতিতে তিনবার কবুল পরিয়ে বিয়েটা শেষ করলো।কান্না করছি।বিবাহিত আমি!আরমান এসে আমার কপালে চুমো দিয়ে বললেন,

-ওয়েলকাম টু মাই লাইফ এজ মিসেস ইশতিয়াক আরমান।

তার স্পর্শে গায়ে কাটা দিলো আমার।উনি এগিয়ে গিয়ে আব্বু আর কবির আঙ্কেলের মুখের বাধন খুলে দিয়ে বললেন,

-অনেক তো প্লানিং প্লটিং করলেন!মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলো।এবার আলহামদুলিল্লাহ তো বলুন!
আব্বু চেচিয়ে বললেন,

-মানি না এ বিয়ে।ভয় দেখিয়ে জোর করে বিয়ে করেছো তুমি।তোমার মতো একটা ছেলের সাথে আমার মেয়েকে থাকতে দেবোনা আমি।

আরমান গানটা একজনের দিকে ছুড়ে দিলেসেটা সে ক্যাচ করে নিলো।উনি বললেন,

-কিপ ইট সেইফলি।ওটাকে জাদুঘরে রাখার ব্যবস্থা করবো।ওটার জোরে মিথিকে পেয়েছি।
আব্বু বললেন,

-কিচ্ছু পাওনি।কিচ্ছু হয়নি।মিথিকে নিয়ে যাবো আমি!

-কিন্তু শশুরমশাই,বিয়েটা হয়ে গেছে!

-মানি না।তোমার মতো একটা ছেলে,যে কি না ইয়াং এইজ থেকেই ….

-মিস্টার আলম!আপনি ভুল জানেন।সেদিন…

-কিচ্ছু ভুল জানি না আমি।আজ তো আরো শিওর হলাম,তুমি কেমন ছেলে!

-কিন্তু আমি সত্যিই ওসব করি নি।

-শাট আপ!তুমিই দায়ী।ওই অতোগুলো বস্তিবাসী দেওলিয়া হয়েছিলো শুধুমাত্র তোমার জন্য।

আব্বুর কথাটা শুনে আরো কাদতে লাগলাম।এতোটা খারাপ আরমান?একটা গুন্ডার সাথে বিয়ে হয়েছে আমার।যাকে শুধু ঘৃনা করতে পারি আমি।নাহ!ওনার সাথে থাকবো না আমি।কোনোদিনও না।নিজেকে সামলে বললাম,

-বিয়েটা তো হয়ে গেছে,ওনাদের যেতে দিন এবার!

আরমান বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-বিয়েটা মানছো তুমি?

-যা বাস্তব,তা অস্বীকার করে কি লাভ?

-কি বলছিস কি তুই মিথি?

-ঠিকই বলছি আব্বু!আমার বিয়ে হয়ে গেছে আরমানের সাথে।
-কিন্তু…

-কোনো কিন্তু নয় আব্বু।বিয়েটা হয়ে গেছে।

-মিথি!!!

-ধমকালে সত্যিটা পাল্টাবে না আব্বু।আরমান,এবার তো ওনাদের ছেড়ে দিন?

আরমান এতোক্ষন অবাক হয়ে দেখছিলেন শুধু।হাত বারিয়ে দুপা এগোলেন আমার দিকে।আমার পা চেয়ারে বাধা,সরতে পারবো না।মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম,

-আগে ওনাদের যেতে দিন।আমি আপনার সাথেই থাকবো।বিয়েটা তো হয়েই গেছে।এতো লোকজন ভালো লাগছে না আমার।দম বন্ধ হয়ে আসছে।

আরমান একপলক আমার দিকে দেখে গার্ডসদের একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-ওনাদের এভাবেই বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসো।তোমরাও ওখানকার কাজে যাও।

এরপর আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললেন,

-লিসেন শশুরমশাই!বিয়েটা হয়ে গেছে।আপনার মেয়েও মেনে নিয়েছে।শুধুশুধু ঝামেলার চেষ্টা করিয়েন না।বেআইনিভাবে বিয়ে করেছি মানলাম,কিন্তু বিয়েটা কিন্তু সবদিক মেনেই হয়েছে।মিথি এখন লিগালি আমার ওয়াইফ!তাই আর কোনো এদিক সেদিকের চেষ্টা না করে সবটা মেনে নিতে শিখুন।আর কাগজগুলো এখন দিয়ে দিন।মেয়ে জামাইকে আর কতোদিন মিথ্যে দোষী হয়ে থাকতে দেখতে চান বলুন?

-কোনোদিন পাবে না তুমি ওসব।আর মিথিও…

-বৌভাতের দাওয়াত পেয়ে যাবেন।এখন আসুন।

উনি ইশারা করতেই রিয়াপি বাদে বাকি সবাইকে ধস্তাধস্তি করে নিয়ে চলে গেলো ওরা।শুধু সবার কান্নাকাটি দেখলাম আর নিজেও বাধা অবস্থায় নিশব্দে চোখের জল ফেললাম।রিয়াপি এসে সব বাধন খুলে দিয়ে জরিয়ে ধরলো আমাকে।আরমান বললেন,

-এজন্য আপিকে যেতে দেইনি।রিয়াপি,বোঝাও না তোমার বোনকে।এই কিউট বরটাকে যেনো কষ্ট না দেয়!

রিয়াপি অগ্নিদৃষ্টি ছুড়ে দিলো আরমানের দিকে।আরমান ঘাড়টা চুলকে ফোন রিসিভ করলো।বেশ কিছুক্ষন হলো বাজছিলো ওটা।

-হ্যাঁ আম্মু বলো।

…..

-হ্যাঁ,হ্যাঁ।আনছি তোমার বউমা।

….

-হোয়াট?

….

-বেশ,আমি কল করছি।

আরমান ফোনটা কেটে একটু চিন্তিতভাবে কাউকে ডাকলেন,

-আদিব?

লোকটা মন খারাপ নিয়ে এসে দাড়ালেন।বললেন,

-হ্যাঁ বল।

-ভাই তুই এখনো রাগ করে আছিস?আবে বিয়ে করলাম,কোথায় মজা করবি তা না কিভাবে বিয়ে করলাম সেই শোকে,কেনো হুট করে বিয়ে করলাম সেই শকে আছিস!

লোকটা কিছু বললেন না।আরমান ওনার ফোনটা এগিয়ে দিতে আবারো বললেন,

-নাম্বারটা ডায়াল করে আমাদের বাসায় চলে যেতে বল।আমি একটু মিথিকে দেখি।

লোকটা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন।আমি জোরে কান্না করতে লাগলাম।রিয়াপি বললো,

-মিথি,কান্না থামাও।কেউ বুঝবে না তোমার কষ্ট!

-কেনো?আমি বুঝি তো!মিথি কেদো না।রিয়াপি থামতে বলো না ওকে!

-তুমি বোঝো?

-হোয়াই নট?বউ হয় আমার।আমিই তো বুঝবো।

-ওর ক্ষুধা লেগেছে।ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না একদম।

-ওহ্!এই ব্যাপার?রিয়াপি,বাসায়‌ আম্মু আরু মিথির জন্য অস্থির হয়ে আছে।চলো ওখানে গিয়ে খেয়ে নিবে।এখনাকার খাবার!ওখানে আম্মু নিজ হাতে খাওয়াবে।

-না!

-না মানে?

-ন্ না মানে,এরমধ্যে ও কিন্তু সেন্সলেস হয়ে যাবে।অসুস্থ্য হয়ে পরবে।

-না।তা কেনো?ওকে ওয়েট!

আরমান আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো গার্ডস নেই।ও নিজেই বলেছে চলে যেতে সবাইকে।দরজা লক,আর চাবি আরমানের কাছে।তাই নিজেই উঠে হাটা লাগালো কিচেনের দিকে।আপি আমার কানে বললো,

-মিথি,আরমান চলে গেছে।

আমি মাথা তুলে চোখ মুছলাম।ওখানে রিয়াপি ছাড়া কেউ নেই।গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে আপি দরজা চেক করলো।ওটা লক!অনেক খুজে রুমের এক কোনায় ছোট কাচের জানালা পেলাম।বাইরের অন্ধকারটা দেখা যাচ্ছে।এগিয়ে গেলাম দুজনেই।কিন্তু কাচ ভাঙলে তো শব্দ হবে!এ ছাড়া আর উপায়ও নেই পালানোর।
হ্যাঁ,পালাবো।থাকবো না এর কাছে।অনেক দুরে চলে যাবো।তাইতো সবাইকে পাঠিয়ে দিলাম।এই জানালা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই।আপি পাশে রাখা একটা ছোট স্ট্যাচু দিয়ে বারি লাগালো কাচে।শব্দে শরীর ঝাকি দিয়ে উঠলো আমার।আরমান বলে উঠলেন,

-কি হলো?

আমি লেহেঙ্গা ধরে জানালা দিয়ে বের হচ্ছি।আপি ভেতরেই।চিচিয়ে বললো,

-রাগে সামনের টেবিলের কাচ ভেঙেছি।তুমি খাবার আনো।

আরমান দৌড়ে এলো।ততক্ষনে আমি বেরিয়ে গিয়েছি।বেরিয়েই রাস্তা।সোজা দৌড় লাগালাম।পেছনে আরমানের গলা শুনতে পেলাম,

-শিট্!এটার কথা মনেই ছিলো না আমার।মিথি দাড়াও,লেগে যাবে।মিথির কিছু হলে তোমাকে আমি ছাড়বো না রিয়াপি!

ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ফাকা রাস্তায় দৌড়াচ্ছি।গায়ে গয়না,একা একটা মেয়ে।আরমানের থেকেও বড় বিপদ হতে পারে আমার তা জেনেও পা চালাচ্ছি।উদ্দেশ্য যে করেই হোক,আরমানের কাছ থেকে দুরে চলে যাবো।বাসায়ও ফিরবো না।আমাকে না পেয়ে হয়তো কিছুদিন সবাই হা হুতাশ করবে,তারপর ফিরে এলেই ঠিক হয়ে যাবে সবটা।আরমানও ভুলে যাবে এসব।কিন্তু এখন পালানোই সবচেয়ে জরুরি।বেশিদুর আসিও নি।এতোক্ষনে আরমানও হয়তো বেরিয়ে পরেছেন।দেখেছেন কি আমাকে?নাহ্,দেখলে নিয়ে যেতেন এতোক্ষনে!স্বস্তি নিশ্বাস ফেলার আগেই মনে পরলো আমি এখনো নিরাপদ না।রাস্তার দু পাশে শালবাগানের মতো কিছু দেখা যাচ্ছে।তবে ভয় করছে না মোটেও।আজ যা যা হয়ে গেলো আমার জীবনে,তারপর ভয়টা ভুলেই যাচ্ছি।আব্বুর মাথায় রিভলবার দেখেছি।এক হিংস্র আরমানকে দেখেছি।নানা চিন্তা করতে করতে মোড়ে বাক নিচ্ছিলাম।আচমকাই সামনে কোনো গাড়ির হেডলাইট জ্বলে ওঠে।চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম।কিন্তু সামলাতে পারি নি নিজেকে।ধাক্কা লাগে গাড়িটার সাথে।

আহ্!!!আর্তনাত করে মাথা ধরে পরে গেলাম।
বুঝতে পারলাম,এক্সিডেন্ট হয়েছে আমার।কপালের উপরে ফেটে গেছে,হাত পা জখম হয়ে আছে,রাস্তায় পরে আছি আমি।চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।এরপর একবার তাকিয়ে আপির কোলে নিজেকে দেখলাম,মরমরে পাতার উপর আপির কোলে শুয়ে আমি।আপি কাদছে।আমার সারা শরীরে ব্যথা।চোখ ঘোলাটে হয়ে আসলো আমার।মৃত্যুযন্ত্রনা বুঝি এমনি হয়!!!

*
আতকে উঠে চোখ খুলে নিলাম।আরমান গুলিটা সাইডেই শুট করেছে।আব্বুর কিছু হয়নি।চোখ বেয়ে পানি পরছে।এতোটা ভয়ানক অতীত আমার?ওই এক্সিডেন্টে মেমোরি লস হয় আমার?আরমানের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে আমার?আমার বর সে!এজন্যই ওনার স্পর্শে কিছু বলতে পারতাম না আমি,কাউকে সহ্য করতে পারতাম না ওনার পাশে,কষ্ট হতো ওনার কষ্টে।কিন্তু এতোটা নিষ্ঠুর কেনো উনি?বারবার কেনো এমন করছেন?রিয়াপি চিৎকার করে বললো,

-কি করেছো তুমি আরমান?কেনো মিথিকে জোর করছো? সেদিন ওকে পালাতে সাহায্য করেছিলাম বলে তার প্রায়শ্চিত্ব কতোভাবেই তো করলাম।মেয়েটা এক্সিডেন্টের পর রাস্তায় পরে ছিলো কতোক্ষন।তোমার কাছ থেকে বাচাতে উল্টোপথ বলে দিয়েছিলাম ওকে।তোমার চোখ এড়িয়ে ওর কাছে পৌছাতে কতো সময় লেগেছে আমার!এরপর লুকিয়ে সে রাতের অর্ধেকটা ওভাবেই জঙ্গলে কাটিয়েছি ওর সেন্সলেস রক্তাক্ত শরীর নিয়ে।মাহবুব আঙ্কেলের সাথে কতো কষ্টে এক পথচারীর ফোন দিয়ে যোগাযোগ করে ওখানে এনেছিলাম।বাসা ছেড়ে অন্যজায়গায় চিকিৎসা নিয়েছে ও‌ তিন তিনটা মাস।ওর মেমোরিও হারালো।
তারপর যখন নিজের ভুলটা বুঝলাম,সবরকম খবর দিয়েছি তো তোমাকে ও বাসার।মিথির ফিরে আসা,ভার্সিটি জয়েন,তোমার ওকে সবকিছু মনে করানোর সব প্লান,এমদাদ আঙ্কেলের ওখানে যাওয়া,সবখানে,সবখানে তো ইনভল্ব ছিলাম আমি।আজকেও তো সিয়ামের খবরটা আমিই তোমাকে দিলাম।তবে আবারো কেনো এসব করছো?মেয়েটাকে কেনো আবারো কষ্ট দিচ্ছো?বিয়ে করা বউ ও তোমার!!!

আপির কথায় বাসা স্তব্ধ হয়ে গেছে।আমি ডুকরে কেদে উঠলাম।ভাঙা গলায় বললাম,

-আ্ আপি!সবটা মনে পরে গেছে আমার!

আরমান বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন আমার দিকে। একছুটে এসে জাপটে জরিয়ে ধরলো আমাকে।সারা চোখেমুখে ঠোট ছুইয়ে দিচ্ছে পাগলের মতো,আমার দম আটকে আসছে।ছাড়ানোর চেষ্টা করছি।আবারো বুকে জরিয়ে ধরে বললেন,

-সব?সব মনে পরে গেছে তোমার?আদিব!আদিব জলদি আয়।ওদের বাধন খুলে দে।
আদিব ভাইয়া দৌড়ে এসে আরমানের কাধে হাত রাখলো।আরমান সবটা জানিয়েছে ওকে,কাদছে ও।মিথির সবটা মনে পরায় আরমানের আনন্দ অশ্রু দেখে আদিবও কাদছে।আরমান কাদছেন,পাগলের মতো মুখে হাসি আর চোখভর্তি জল ওনার।আমার পায়ের বাধন খুলতে খুলতে বললো,

-দেখেছো মিথি?বলেছিলাম না সবটা মনে পরে যাবে তোমার!দেখেছো,মনে পরে গেছে তোমার সবটা।

পায়ের বাধন ছাড়া পেতেই দৌড়ে আব্বুর কাছে গিয়ে জরিয়ে ধরলাম ওনাকে।এই মানুষটার কপালে গান ঠেকিয়েছিলো আরমান।আমি আব্বুর চোখ মুখ খুলে দিলাম।আদিব ভাইয়া কবির আঙ্কেলকে ছাড়াচ্ছে।আরমান আব্বুর দিকে এগিয়ে এসে হাতের বাধন ধরতে গেলেই বললাম,

-একদম ছোবেন না ওনাকে।আমার আব্বুর মতো কাউকে ভালোবাসা দেখানোর মতো যোগ্যতা আপনার নেই।

-মিথি!

-দুরে থাকুন!

আরমান দুরে সরে গেলেন।কবির আঙ্কেল ছাড়া পেয়ে আম্মুদের আটকে রাখা রুমের দরজা খুলে দিলেন।ওরাও এগিয়ে এসেছে।কিন্তু রিয়াপি এককোনে দাড়িয়ে আছে।আব্বু ছাড়া পেয়ে কিছুক্ষন আমাকে জরিয়ে ধরে ছিলেন।অগ্নিদৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে চেচিয়ে আরমানকে বললেন,

-ইউ স্কাউন্ড্রেল!আর কতোভাবে নিজের গুন্ডামি দেখাবে?আর কতভাবে নিজের বিশ্রী মানসিকতার পরিচয় দেবে?

আমি আম্মুকে জরিয়ে ধরে কাদছি।রিয়াপি বললো,

-আঙ্কেল আরমান…

-চুপ!একদম চুপ রিয়া।তুমিও শেষ পর্যন্ত ঠকালে আমাকে?এতোদিন তোমার ভরসায় মিথিকে ছাড়তাম আমি,আর তুমি কিনা এই গুন্ডাটার কথামতো সবকিছু করলে?

-আঙ্কেল,আরমান এসব মিথির ভালোর জন্যই…

রিয়াপির আম্মু বললো,

-থাম রিয়া।আমাদের ভালোবাসায় কি কমতি ছিলো?এই ছেলের জন্য নিজের ফ্যামিলিকে অবদি ঠকালি তুই?

-আম্মু,বলতে তো দেবে আমাকে?আমি…

কবির আঙ্কেল এবার মুখ খুললেন।হুংকার দিয়ে বললেন,

-চুপ করো মাধবী।আজ থেকে রিয়া নামের কোনো মেয়ে নেই আমার।কথা এখানেই শেষ।

-আব্বু!

-তোমার আব্বু মরে গেছে।যে মেয়ে অচেনা একটা ছেলের জন্য নিজের পরিবারকে ঠকায়,তার পরিবার পাওয়ারই কোনো অধিকার নেই।তোমার মুখে আব্বু শোনার চেয়ে মর…

-না প্লিজ।ডাকবো না তোমাকে।ওসব বলো না প্লিজ!

রিয়াপি মুখ ধরে হুহু করে কেদে দিলো।আমিও আম্মুর কোলে মুখ গুছে কাদছি।আরমান হাত মুঠো করে দাড়িয়েই আছে নিচদিক তাকিয়ে।আব্বু কপালে আঙুল ঠেকিয়ে বসে আছেন।আরমানের গার্ডসের ভিড়ে কিই বা করবেন উনি?বললেন,

-কি চাও তুমি আরমান?

-আমার বউ।বাসায় নিয়ে যাবো ওকে।

– তুমি তো বলেছিলে কাগজগুলো পেলেই মিথিকে ছেড়ে দিবে।

আরমান চোয়াল শক্ত করে মাথা উচু করে বললো,

-ছেড়ে দেবার কথা একবারও বলি নি।বলেছিলাম তুলে নিয়ে যাবো না।ও আমার বউ,সবকিছু মনে পরেছে ওর।ওকে আমার হাতে তুলে দিন।বাসায় আম্মু বরন করবে বলে অপেক্ষা করছে।

-যাবে না ও।

-আপনি ভুলে যাচ্ছেন,আইনীভাবে আপনি আমাকে আটকাতে পারেন না।শুধুমাত্র ও আপনার অনুমতি চায় বলে চুপ করে আছি।

-পাঠাবো না মিথিকে তোমার মতো ঠকবাজের কাছে,যে কিনা এতো ছোট বয়সেই গরিবের পেটে লাথি দিয়ে টাকা রোজগারের কথা ভাবে।

আরমান কিছু না বলে টেবিলে থাকা কিছু ফাইল এনে আব্বুর সামনে দিলেন।মাথা তুলে বললেন,

-এগুলো কি?

-পড়ে দেখুন।
আব্বু ফাইলগুলো চেক করলেন।আমি আম্মুর কোলে মুখ লুকিয়ে আছি।আব্বু একটার পর একটা চেক করছেন আর অবাক হয়ে আরমানের দিকে তাকাচ্ছেন।আরমান বিরক্তি নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।

-ত্ তারমানে ঐদিন তোমাকে…

-জ্বী হ্যাঁ।সেদিন আমাকে ফাসানো হয়েছিলো।ওরা আমাকে ব্যবহার করে নিজেদের কাজ হাসিল করেছিলো।

-মানে,এসব পুরোটাই প্লানড্?তুমি নিজে বস্তির জায়গা দখলে জড়িত ছিলে না?

-না।

আব্বুর চোখেমুখে কিছুটা অনুতাপ।কবির আঙ্কেলও কাগজগুলো দেখে একই রিয়্যাক্ট দিলেন।বললেন,

-শুধুশুধু ছেলেটাকে ভুল বুঝেছি।ও তো এই ইস্যুতে ছিলোই না।ওর উদ্দেশ্য তো ভালোই ছিলো।

আমি শুধু শুনছি।সবটা না বুঝলেও এটা বুঝতে পারছি যে কারনে আরমানকে আব্বু ঘৃনা করতেন সেটা সম্পুর্নই ওনার ভুল বোঝাবুঝি ছিলো। আরমান বললেন,

-এবার বুঝেছেন?আপনি আমাকে যা ভাবেন,তা নই আমি।যা করেছি,সবটা সবার ভালোর জন্যই।এবার হাসিমুখে মেয়েকে শশুরবাড়ী পাঠান।

আব্বুর চোয়াল আবারো শক্ত হয়ে গেলো।বললেন,

-হাহ!ওটা না হয় ভুল ছিলো,তুমি অস্বীকার করতে পারবে আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যাং নেই তোমার।লোকজনকে আতঙ্কে রাখো না তুমি?সেদিনের মতো আজকেও কি ব্যবহারটা করেছো আমাদের সাথে!

-দেখুন,আজকে এমন করার একমাত্র কারন মিথির যেনো সবটা মনে পরে তাই।আর…

-যতো যাই কিছু বলো আর করো না কেনো,এসবের পরেও তোমার মতো ছেলের কাছে মিথিকে পাঠাবো তুমি ভাবলে কি করে?

-তাহলে কি এর মতো ছেলের কাছে পাঠাবেন?
সবাই বিস্ময় নিয়ে দরজার দিকে তাকালো।

আদিব ভাইয়া সিয়ামের কলার ধরে টেনে হিচড়ে নিয়ে এলো ভিতরে।সিয়ামের অবস্থা খুবই খারাপ।সারা মুখ জখম হয়ে ফুলে আছে।হাতে পায়ে ছোপ ছোপ দাগ।শিউরে উঠলাম আমি।আরমানের দিকে ঘৃনার দৃষ্টিতে আরেকবার তাকালাম।এই ছেলেটার সাথে আমার বিয়ের কথা বলে এই হাল করেছে ওনার?এতোটা নিষ্ঠুর এই মানুষটা?আব্বু এগিয়ে যেতে যেতে বললেন,

-সিয়াম?তোমার এই অবস্থা…

আরমানের গার্ডসরা থামিয়ে দিলো আব্বুকে।আব্বু কঠোরভাবে বললেন,

-এই ছেলেটাকে এভাবে কষ্ট দিয়েছো কেনো?ও কি দোষ করেছে?আমি চুজ করেছি ওকে মিথির জন্য।ওর তো কোনো দোষ নেই!

-ও তোর বন্ধু আর আরমানের বড় চাচ্চু আশরাফ জামানকে
কষ্ট দিয়েছে,তোদের ঠকিয়েছে,ওর আইডলের নাম বদনাম করেছে,নিজের নোংরা খেলায় মিথিকেও জরিয়েছে,এগুলোই ওর দোষ!

আবারো দরজার দিকে তাকালাম সবাই।এটা তো সিয়ামের আব্বু!উনি আরমানের চাচ্চু মানে?আমাদের ঠকিয়েছে?নোংরা খেলা?মানে কি এসবের?কি হচ্ছে টা কি এসব?আব্বু বললেন,

-আশরাফ?কি বলছিস তুই এসব?

উনি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

-ঠিকই বলছি আমি মাহবুব!তোর বন্ধু আমি এই পরিচয়টা যেমন সত্য,আরমানের বাবা আফরোজ জামানের বড় ভাই আমি এটাও ততোটাই সত্য।

-তারমানে তুই আরমানের চাচা?আর সিয়াম আরমানের চাচাতো ভাই?

উনি আব্বুকে বললেন,

-হ্যাঁ,আরমানের বড় চাচ্চু আমি।কিন্তু সিয়াম নামের এই জানোয়ারটা আমার ছেলে নয়!

আমি কান্না থামিয়ে এই গোলকধাধাকে বুঝতে একবার আরমান একবার ওই লোকের দিকে তাকাচ্ছি।আরমান,আদিব ভাইয়া,রিয়াপি বাদে উপস্থিত সবার চোখেমুখে বিস্ময়।আরমান শান্ত দৃষ্টিতে আমারই দিকে তাকিয়ে আছেন।রিয়াপিও শক্তভাবে দাড়িয়ে।সিয়াম মেঝেতে হাটু গেরে বসে,ওর হাত বাধা।আদিব ভাইয়া ওর পাশে দাড়িয়েই কলার ধরে আছে।আব্বু জোরে বললেন,

-কি বলছিস কি তুই আশরাফ?

আশরাফ আঙ্কেল আব্বুকে ধরে বসালেন।নিজেও সোফায় বসে বললেন,

-ঠিকই বলছি আমি মাহবুব।

-কিন্তু আমি ওর সিভি দেখেছি।আট বছর হলো চিনি ওকে আমি!

কবির আঙ্কেলও বললেন,

-হ্যাঁ,সে সূত্রে আমিও ওকে আট বছর হলোই‌ চিনি।

আশরাফ আঙ্কেল শান্তভাবে বললেন,

-মাহবুব,আমার এক মেয়ে দুই ছেলে।আটবছর আগে তোর সাথে দেখা করে বলেছিলাম তোকে।সময় কম থাকায় ডিটেইলস্ বলিনি তোকে।আমার বড় ছেলে শোয়াইব,মেয়ে সুহানা,আর ছোট ছেলে শাহরিয়ার।বড় ছেলে বাদে মেয়ে,স্ত্রী আরেক ছেলে নিয়ে আমি কানাডায় সেটেল্ড।ওখানে থেকেই মোটামুটি বিজনেজ চালাতাম আমি।

-তাহলে সিয়াম?

-ও কেউ হয় না আমার।আমার বড় ছেলে শোয়াইব দেশে থাকতো,দেশসেবা করবে ও এমনটা ইচ্ছে ছিলো ওর।পেশায় পুলিশ।আটবছর আগে আরমানের ওই ইনসিডেন্টের সাথে জড়িয়ে জীবন দিতে হয় ওকে।আরমানের নির্দোষ হওয়ার সবটাই জানতো ও।প্রমান ছিলো ওর কাছে।এজন্যই ওই কার্লপ্রিটগুলোর হাতে প্রান যায় ওর।শোয়াইবের মৃত্যুর কথা শুনে যখন দেশে ফিরলাম,কেউ কিডন্যাপ করে নেয় আমাকে।এরপর শুরু হয় সিয়ামের জঘন্য খেলা।আগে শোয়াইবের সিভি কালেক্ট করে ও।নিজের নাম নিকনেইম হিসাবে বসায় তাতে।যেটা তুই দেখেছিস।কিন্তু এসব খুব বেশি সময় আরমানের আড়ালে ছিলো না।আরমান টের পাওয়া মাত্রই সিয়ামের আসল রুপ ফাস করে দিতে চেয়েছিলো।কিন্তু আমার ক্ষতি করে দেবে ও এমনটা থ্রেট দেয় বলে এতোদিনেও সিয়ামকে কিছু বলে নি ও।সিয়াম তোর সাথে কথা বলাতো আমাকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে,কাউকে যাতে কিছু না বলতে পারি।কাল ও আসে নি,আমাকে পাঠিয়ে জানালা দিয়ে বন্দুক তাক করে দাড়িয়ে ছিলো।তাই কিছু বলতে পারি নি তোদের।

আমি তব্দা মেরে বসে আছি।কি হয়েছে,কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না।আব্বু বললেন,

-কেনো করলো এসব সিয়াম?

আরমান এবার বলতে শুরু করলেন।সিয়ামের দিকে এগিয়ে রাগে তাকিয়ে বললেন,

-ওর আর ওর বাবার চোখ জামান ইন্ডাস্ট্রির দিকে।

আশরাফ আঙ্কেল বিস্ময় নিয়ে বললেন,
-কি বলছো তুমি আরমান?

-হ্যাঁ,ঠিকই‌ বলছি আমি।ও আমাদের কোম্পানির কনসাল্টেন্ট মিস্টার কাদেরের ছেলে।

আরমানের কথায় সবাই অবাক।সিয়াম নিজেও শকে আছেন।খুব কষ্টে মুখ খুলে বললেন,

-এ্ এটা ত্ তুমি কি করে,,,

আরমান বাকা হেসে বললেন,

-কি করে জানি তাইতো?তুই কি ভেবেছিস?আমার পেছনে তোরা বাপ ছেলেতে মিলে দুনিয়াজয়ের জন্য প্লান করবি আর আমি কিচ্ছু টের পাবো না?শুধুমাত্র আশরাফ আঙ্কেলের ক্ষতি করে দিবি তুই সেই ভয়ে কিছু বলি নি আমি।শোয়াইবের মতো আঙ্কেলকেও হারাতে চাইনি আমি।নইলে তো কবেই তোকে,,,তোর বাবাকে অলরেডি জেলে পাঠিয়েছি।তোকে এখানে রেখেছি শুধু সবার থেকে তোর প্রাপ্য তোকে বুঝিয়ে দেবো বলে।

আদিব ভাইয়া সিয়ামের মুখে আরেকটা ঘুষি মেরে বললো,

-সালা!খুব চালাক ভাবিস না তুই নিজেকে?

আরমান থামালেন আদিব ভাইয়াকে।বললেন,

-আটবছর আগে শোয়াইব ভাইয়া মারা যায়।জামান ইন্ডাস্ট্রির একটা উত্তরসুরী,কাদেরদের পথের কাটা সরে যায়।শাহরিয়ার, সুহানা বিদেশেই।বাকি থাকি আমি,যার বিরুদ্ধে ঐ ঘটনারই‌ দায় পরে।এই সুযোগ কাজে লাগায় কাদের।আমি যাতে কোনোভাবেই নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে না পারি তাই শোয়াইব ভাইয়ার সিভি দেখিয়ে বস্তির প্রেজেন্ট ওনারশিপের কাগজ হাতিয়ে নেয় ও আপনার থেকে।

আব্বু বললেন,

-কাগজ দিয়ে দিয়েছিলাম তো ওকে আমি।তারপরেও এসবের মধ্যে মিথিকে কেনো জড়ালো ও?

-কারন মিথি আমার লাইফে আসার পর আমি ঐ কালো অধ্যায়টাকে ভুলতে শুরু করি,যা ওদের বাবা ছেলের জন্য হানিকারক ছিলো।কোম্পানিতে যাতায়াত শুরু করেছিলাম আমি।সবটা জেনে একপর্যায়ে মিথিকে কিডন্যাপেরও চেষ্টা করেছিলো ওরা।

আরমানের কথায় আমার সেদিনের সেই নদীপারের কথা মনে পরলো।ওরা তো বলেছিলো সেদিন,মেয়েটাকে উঠাবো।আরমান আবারো বললেন,

-কাদের,সিয়ামের আরেকটা ধারনা ছিলো আমি মিথিকে বিয়ে করলে কাগজগুলো পেয়ে যাবো আপনার কাছ থেকে।তাই মিথির মেমোরি লসের পর,আমাকে মিধির মৃত্যর কথা শুনিয়ে ওকেই বিয়ে করে সিয়াম এটা আটকাতে চেয়েছিলো।মিথি এক্সিডেন্টে মারা গেছে এমনটা শুনে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম আমি।অফিস ভুলে ঘরকুনো হয়ে পরি।প্লান ইনিশিয়েট হয় সিয়ামের।তারপর যেদিন মিথিকে দেখলাম রাস্তায়,আমি ওদের প্লানের সবটা বুঝতে পারি।রিয়াপি আর ওর বাবাকে কিডন্যাপের প্লানটা করে আপনাদের একটু টাচ দেই,মিথির লাইফে আমি আছি।মাথা ঘুরে যায় সিয়ামের।মেইন কাগজ রেখে কিছু ফলস কাগজ দিয়ে আপনাকে পাঠিয়ে দেয় আমার সাথে ডিল করতে।ওর আড়ালে থাকি আমিও।কারন আমার তখনো আশরাফ আঙ্কেলকে খুজে বের করা বাকি ছিলো।আমাকে মিথির আশেপাশে না পেয়ে সিয়াম ভেবে বসে আমি সত্যিই ভুলে গেছি ওকে।বিয়েটা সেরে আমাকে আরো বড়সড় কষ্ট দিয়ে,আঘাত করে আরো ঘরকুনো করে দিতে চেয়েছিলো ও।যাতে কোম্পানি লুটতে সুবিধা হয় ওদের।

কাল যখন ও আঙ্কেলকে এ বাসায় পাঠায়,রিয়াপি সবটা জানায় আমাকে।নিজে রুমে না ঢুকে আঙ্কেলকে ভিতরে পাঠায়,জানালা দিয়ে বন্দুক তাক করে।হুহ!আগে বাইরে থেকে ওকে ধরি,তারপর আঙ্কেলকেও বাচাই।ওর কাছ থেকে কাগজগুলো আদায় করি।মিস্টার কাদেরকে পুলিশ নিয়ে গেছে।

সিয়াম বলে উঠলেন,

-এটা তুই ঠিক করলি না আরমান।বাবাকে পুলিশে দিয়েছিস?তোকে আমি…

আরমান ওকে চড় লাগিয়ে দিয়ে বললেন,

-কিছু করতে পারবি না তুই।শুনে রাখ,সেদিন মাঝরাস্তায় মাস্ক পরা যে লোক তোকে ঘুষি লাগিয়েছিলো,সেটা আমি ছিলাম।এই ইশতিয়াক আরমান।আর হ্যাঁ,এটা মিথিও জানতো।

সিয়াম কিছুটা গা ঝারা দিয়ে বললেন,

-আরমান!

আশরাফ আঙ্কেল গিয়ে আরেকটা চড় লাগালেন ওকে।বললেন,

-ইউ বাস্টার্ড!আমাকে কষ্ট দিয়েছিস মেনে নিয়েছি।তুই আমার ছেলের নাম খারাপ কাজে ব্যবহার করেছিস।সেই ছেলে যে খারাপ কাজ করা তো দুর ,সহ্যই করতো না।আবার আরমানকেও ওভাবে বলছিস?

আব্বুও এগিয়ে গেলেন।বললেন,

-পাওনা আমার কাছেও ছিলো তোমার।দিলাম না।অনেক শাস্তি পেয়েছো।এবার যা করার পুলিশ করবে তোমাকে।

আদিব ভাইয়া কল লাগালেন কাউকে।পুলিশ এসে সাথেসাথে নিয়ে গেলো সিয়ামকে।যেনো বাইরেই দাড়িয়ে ছিলো।সবার কাছে সবটা পানির মতো পরিষ্কার।আরমানের কাজের মুল উদ্দেশ্য হতদরিদ্রদের সাহায্য করা,এরমধ্যে ওনাকে কেউ ফাসিয়ে দেয় যেকারনে আব্বুসহ ভুল বোঝে সবাই ওনাকে,সে সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ওদেরই কোম্পানির কনসাল্টেন্ট তার ছেলেকে শোয়াইব ভাইয়ার পরিচয়ে বাইরে রাখেন,আরমান তার বড়চাচার জন্য সবটা মেনে নেন,আর সেদিনের-আজকের এই রুপ শুধুমাত্র আমাকে ভালোবেসে আপন করতে,আগের কথাগুলো মনে করাতে।এমন একটা মানুষকে সবার মতো আমিও ভুল বুঝতে যাচ্ছিলাম?আমার চেয়ে বড় অপরাধী আর কে হতে পারে?যে নিজের নির্দোষ স্বামীকে ভুল বোঝে?ঘৃনা করে?রিয়াপি এগিয়ে এসে বললো,

-আমি সবটাই জানতাম।আব্বু,আঙ্কেল,আপনাদের ঠকাইনি আমি।শুধু আড়ালে দুটো মানুষকে ওদের ভালোবাসাটা ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।আমি জানতাম,একটা দিন সবটাই জানবেন আপনারা।অনেক রকম ছল চাতুরী করে সবটা আড়াল করেছিলাম,কিডন্যাপ হওয়া,মিথিকে নিয়ে এমদাদ আঙ্কেলের ওখানে যাওয়া সবকিছুতেই আরমান আর আমার প্রিপ্লান করা ছিলো যাতে কেউ আমাকে এতোটুকো সন্দেহ না করে।আরমান চায়নি ওর জন্য আমি কোনো কষ্ট পাই,কিন্তু আজ আমিই বলে দিলাম সবটা।কারন আমি তোমার কাছে কোনোদিন কিছু লুকাতেই চাইনি আব্বু।

কবির আঙ্কেল রিয়াপির মাথায় হাত রেখে বললেন

-সরি মা।আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো,রিয়া কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।আমাকে ক্ষমা…

-না আব্বু,ক্ষমা চেয়ো না।সবটা তো এবার ঠিক হয়ে গেছে।

-আরমানের থেকে মিথিকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না মাহবুব।

আব্বু মাথা নিচু করেই ছিলেন।আশরাফ আঙ্কেলের কথায় মাথা তুলে একবার আরমানের দিকে একবার আমার দিকে তাকালেন।আমি শক্ত হয়েই বসে আছি।আমার মানুষটা নির্দোষ,আমি দেখতে চাই আব্বু এখন কি বলেন।

-হ্যাঁ আঙ্কেল।মিথিকে ওর হাতে তুলে দিন।আপনার অনিচ্ছায় ওরা জীবন শুরু করতে পারবে না।

আম্মু বললো,

-আজ অবদি তোমার সব কথা শুনেছি মিথির আব্বু।আজ আমি বলছি,না জেনে মেয়েটার জীবন যেমন নষ্ট করে দিয়েছিলাম আমরা,আজ সবটা জেনে ওকে আরমানের হাতে তুলে দাও।ওর থেকে দুরে ভালো থাকবে না মিথি।

আব্বু তখনো চুপ।আদিব ভাইয়া গিয়ে আরমানের কাধে হাত রাখলেন।আরমান এগিয়ে এসে আব্বুর সামনে হাটুগেরে বসলেন।উনার হাত মুঠো করে ধরে বললেন,

-আমি কথা দিচ্ছি,আজ থেকে এমন কোনো কাজ করবো না যাতে আপনার মনে হয় আপনার মেয়েকে কোনো গ্যাংস্টারের হাতে তুলে দিয়েছেন।কোনোদিন মিথিকে শুনতে হবে না ওর বর কোনো খারাপ কাজ করেছে।আমি এমন কিছুই ঘটাবো না যার জন্য আপনার খারাপ লাগে এটা ভেবে আপনার মেয়েজামাই খারাপ কাজ করে।কথা দিচ্ছি আমি আপনাকে।

আরমানের কথাগুলো কানে বাজছে আমার।সবার দৃষ্টি এবার আব্বুর দিকে।কি হবে এর পরিনতি?এখনো কি আব্বু রেগে আছেন আরমানের উপর?এতোসব করেও কি পাবেন উনি?আব্বু না চাইলে,আমি যেতে পারবো ওনার সাথে?কেনো পারবো না?ভালোবাসি ওনাকে,নির্দোষ উনি।তারথেকেও বড় কথা,উনি যে আমার বর!বিয়ে হয়েছে আমাদের!আব্বু নতমস্তকে গম্ভীরভাবেই বসে আছেন।

#চলবে…

®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here