#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৬৯
(২৩২)
আবরার ওর সাথে কোনো কথা না বলে কোটিটা খুলে হ্যাঙ্গারে ঝলিয়ে কাবার্ডের পার্টটা লাগিয়ে দেয়।তারপর ইয়ারাবীরর পাশ কেটে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘড়ি খুলতে থাকে,মুখে কোনো কথা নেই।ইয়ারাবীর বুঝতে বাকী নেই জনাবের রাগ হয়েছে,তাই পিছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“দুঃখীত,এমন আর কখনো করবোনা।”
আবরার ওর হাত দু’টো ছাড়িয়ে দিয়ে বলে,
-“দেখি সরে দাঁড়াও,বাইরের থেকে এসেছি ফ্রেস হবো।”
-“না,আপনি রেগে আছেন।”
-“এটা করা কী স্বাভাবিক নয়?”
-“বললাম তো দুঃখীত,আজ মনটা ভালো ছিলোনা তাই এরুপ কাজ করেছি।আর করবোনা প্রমিজ।”
-“হু”
-“কী হু,হ্যাঁ?আপনি এখনো রেগে আছেন কিন্তু সেটা প্রকাশ করছেন না।”
-“ইয়ু,ভালো লাগছেনা।”
আবরার কথাটা বলে ও সরিয়ে দিয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।ইয়ারাবী মুখ ফুলিয়ে টেবিল থেকে ডাইরি উঠিয়ে রোজকার নিয়ম করে দিনলিপি লিখতে থাকে।তবে আজ সকাল থেকে ওর মনে অজানা ভয় হানা দিয়েছে, এসব কাউকে বলতে গেলে যে ও নিশ্চিত ধমক খাবে সেই ভয়ে কাউকে বলতেও পারছেনা।হঠাৎ করে পায়ে নরম কিছুর স্পর্শে তাকিয়ে দেখে ইনি ওর পায়ের কাছে মুখ ঘষছে,যার অর্থ আমাকে কোলে নাও।ইয়ারাবী ডাইরিটা বন্ধ করে হেসে বলে উঠে,
-“বড় একটা লাফ দিয়ে কাউচে উঠ,আমি কোলে নিচ্ছি।”
ইনি ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে “মিয়াও” শব্দ করে একটা লাফ দিয়ে কাউচে উঠলে ইয়ারাবী হাত বাড়িয়ে ওকে কোলে নেয়।ইনি জিহ্বা দিয়ে নিজের ডান হাতটা অনবরত চাটছে।মিনি তেমন একটা ইয়ারাবীর পিছু না ঘুরলেও ইনি সব সময় ওর আশেপাশে থাকে।যার জন্য চেলসির সাথে ওর বেশি মারামারি বাঁধে,তাই যখন চেলসিকে সামনে দেখে তখন উঁচু কিছুর উপর বসে মিয়াও মিয়াও করতে থাকে।আর ইয়ারাবী কথা বললে ওর নীল চোখ দিয়ে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন ও সবটা বোঝে।ইয়ারাবী ওকে নিয়ে গায়ের উপর একটা চাদর জড়িয়ে বেলকনিতে যেয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
-“জানিস ইনি,তোর বাবা সব সময় আমার সাথে রাগ দেখায়।আরে বাবা আমিও জানি প্রেগন্যান্সির সময় কী করতে হয় আর কী নয়?কিন্তু উনার ভাবখানা এমন যে উনিই সব জানে।তুই জানিস, তোর বাবা আমাকে একটু আগেও বকা দিয়েছে।”
ইনি হাত চাটা বন্ধ করে চোখগুলো বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে আবার মিয়াও শব্দ করে উঠে।ইয়ারাবী ইনিকে দু’হাতে উঁচু করে ধরে বলে,
-“শোন,তোর বাবার সাথে একদম কথা বলবিনা।আগের মতো একটুও ভালোবাসেনা।দুই মাস থেকে পরীক্ষা ছাড়া ঘরের বাইরে যেতেই দেয়না।”
-“মিয়াও”
-“বিড়ালটাকেও ছাড় দিলিনা আমার নামে নালিশ করার থেকে।”
আবরার পিছনে দাঁড়িয়ে মুখ মুছতে মুছতে কথা বলে উঠলে ইয়ারাবী ওর দিকে ঘুরে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
-“এটার নাম ইনি,আপনি নিজেই রেখেছিলেন।”
-“ও হ্যাঁ,তা ইনি বাবা আপনি দেখি মায়ের ভক্ত তাই বাবার দুর্নাম শোনা হচ্ছে।”
-“ওই আপনি ধমক দিচ্ছেন ইনিকে?”
-“কই ধমক দিলাম।যাই হোক,চলো ডিনার করে নিবে।”
-“খাবোনা,একটু আগে এতগুলো ফল মিষ্ঠু আপু খাইয়ে দিয়ে গেছে।”
-“তুমি যে কতগুলো খাও সেটা জানি।”
আবরার জোর করে ইয়ারাবীকে বাইরে এনে ডাইনিং বসিয়ে দেয়।মি.রায়হান এক সপ্তাহ হলো লন্ডনে কিছু কাজে এসেছেন,তারপর আর ফেরা হয়নি,ভাবলেন স্ত্রী-সন্তানের সাথে কিছুটা সময় কাটানোর কথা।মি.রায়হান খাবার টেবিলে স্ত্রীর সাথে টুকটাক কথা বলছেন তখন এনা খাবার এনে টেবিলে রাখলো।আবরার একটা প্লেটে মাংস আর পরোটা ছিড়ে ইয়ারাবীর সামনে তুলে ধরলে ইয়ারাবী বলে উঠে,
-“জানেন আল্লাহ তা’আলা আমাকে সুস্থ দুইটা হাত দিয়েছেন।”
-“খাইয়ে দিলে দোষ কী?এখন এটা বলোনা যে তোমার আব্বু-মমের সামনে খেতে লজ্জা লাগছে, কারণ এটা নতুন কোনো বিষয় নয়।”
-“ঘাড়ত্যাড়া লোক,ওই শুনন আমি খাবোনা।আম্মু বলুন না উনাকে।”
মিসেস রায়হান ইয়ারাবীর দিকে চোখে বুলিয়ে নিজের প্লেটে মনোযোগ দিয়ে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-“মিষ্ঠু সন্ধ্যায় জোর করে একটা আপেল আর কমলা খাইয়ে দিয়েছে,এভাবে চললে হয় বল।একটু বেশি করে খাওয়া ওকে,তুই না থাকলে খাওয়া-দাওয়া কিছুই করেনা।”
-“আম্মু,আপনি এটা কী বলছেন?”
-“ইয়ারাবী,তোর ভালোর জন্যই বলছি।”
আবরার মুচকি হেসে ওর গালে খাবারটুকু তুুলে দেয়,না পেরে খেয়ে নিতে হয় অনিচ্ছা সত্ত্বেও।কিন্তু দুই বার খাওয়ার পরেই ওর পেটে প্রচুর ব্যাথা শুরু হয়।সচারচর ব্যাথা হয় তবে এটা অন্যান্য ব্যাথা থেকে অনেক বেশি।ও পেটে হাত দিয়ে জোরে চিৎকার করে উঠে,সবাই অনেকটা চমকে যায়।মিসেস রায়হান প্লেটে খাবার ছেড়ে দিয়ে ওর কাছে এসে বলেন,
-“কী হয়েছে মা?”
ইয়ারাবীর এতটাই ব্যাথা করছে যে মুখে কিছু বলতে পারছেনা,কারণ এমন যন্ত্রনা ও আগে কখনো পায়নি।আবরার হাতটা ধুয়ে ওর মুখে হাত রেখে বলে,
-“কি হচ্ছে বলো?”
-………..
-“কী হয়েছে না বললে বুঝবো কীভাবে?”
-“ব্ ব্যাথা ক করছে।”
-“মনে হয় বেবীরা কিক করেছে এজন্য ব্যাথা করছে।”
-“না,এটা…আহ্,আম্মু কি…কিছু করুন।”
আবরার অনেকটা ভয় পেয়ে যায় ওর ব্যবহারে, রিতিমতো শীতের মধ্যেও ওর শরীরে ঘাম ধরে গেছে।মি.রায়হান বিষয়টা বুঝতে পেরে ডাক্তারকে ফোন করতে গেলে উনার স্ত্রী বলে উঠেন,
-“ডাক্তারকে ফোন করে লাভ নেই,ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।তুমি উইলিয়ামকে গাড়ি বের করতে বলো দ্রুত।”
মি.রায়হান দ্রুত ডাইনিং থেকে বেড়িয়ে যেতেই আবরার ইয়ারাবীকে কোলে তুলে নেয়।অবশ্য ইয়ারাবীর ওজন বেড়ে গেছে,ওর নিতে অনেকটা কষ্ট হলেও সাবধানে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যায়।
হাসপাতালে আসলে ডা.নিনা জানায় ডেলিভারি করতে হবে।আবরার কথাটা শুনে অনেকটা অবাক হয়ে যেয়ে বলে,
-“ডা.নিনা,ওর তো একমাস ডেট ছিলো।তাহলে এত তাড়াতাড়ি…..”
-“মাঝে মধ্যে অনেক সময় এমনটা ঘটে থাকে এআর, আমাদের দেরী করলে চলবেনা।তুমি ব্লাডের ব্যাবস্থা করো,যেহেতু বাচ্চা জমজ তাই সিজারে করতে হবে।”
-“কিন্তু এখন নেগেটিভ ব্লাড পাবো কার কাছ থেকে।”
-“তুমি ব্লাড ডোনারদেরকে চেনো নিশ্চয়ই, ওদেরকে যোগাযোগ করলে ব্যার্থ হবেনা।”
-“ব্লাড ব্যাংকেও….”
-“নেই,আমরা খোঁজ করেছিলাম।যা করার দ্রুত করতে হবে,নয়তো তুমি জানো সবটা।আর যদি ওটির সময় থাকতে চাও তবে দ্রুত করো।ওর ব্যাথা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হচ্ছে।”
ডা.নিনা কথা বলে ওটির জন্য তৈরি হতে চলে যান,এদিকে আরবার নিজের পরিচিত ডোনারদের কল করতে থাকে।কিন্তু যে পাঁচজন ডোনার ছিলো তাদের মধ্য একজনের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ তবে সে এখন শহরের বাইরে অবস্থান করছে,আর এখন রওনা দিলে সকালে পৌঁছাবে।কথায় আছেনা,”বিপদ যখন আসে সব দিক থেকেই আসে।”কেননা ব্লাডের জন্য এই ডোনারকে ঠিক করে রাখা ছিলো,কিন্তু কে জানতো সবকিছু এত দ্রুত ঘটে যাবে।আবরার অনেকটা ভেঙ্গে পরেছে, কেবিন থেকে ইয়ারাবীর চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসছে।আবরার কিছু একটা ভেবে ফোনটা উঠিয়ে কাউকে কল করতে যাবে তখনি ওর ফুপির পরিবার হাসপাতালে আসে।উনাদের সবটা বললে ওর ফুপা বলে উঠে,
-“বাবা তোমার চিন্তা করতে হবেনা,আমার রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ।আর আল্লাহর রহমতে আজ পর্যন্ত হাই পাওয়ারের কোনো মেডিসিন নেওয়া হয়নি।বৌমাকে রক্ত আমি দিবো।”
কিন্তু উনাদের ছেলে রাসেল বেঁকে বসে,ও নিজের বাবাকে নানা ভাবে রক্ত না দেওয়ার জন্য লজিক দেখায়।পরিবারের সবাই খুব বিরক্ত হয় রাসেলের উপরে।ওর বাবা রাসেলকে বলে,
-“মাত্র এক-দুই ব্যাগ রক্তে এমন কিছু হয়ে যাবেনা যে তুমি এরুপ আচারণ করছো রাসেল।”
-“বাবা তুমি কীভাবে জানবে রক্ত দিলে কী হয়?তাছাড়া আবরারের খেয়াল রাখা উচিত ছিলো, কিভাবে যে কান্ড-জ্ঞানহীন কাজ করতে পারে আল্লাহ জানে,এই হলো বুদ্ধিমান ছেলের উদাহরণ।উচিত ছিলো আগে থেকে রক্তের ব্যবস্থা করে রাখা।দেখ বাবা,তুমি রক্ত দিবেনা।আমি বলছি…..”
রাসেলকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ওর বাবা একটা তাড়া মারে।আবরারের কোনো কিছু শোনার মন-মানসিকতা নেই,মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে।তবে ও বুঝতে পারেনা রাসেল সব সময় ওর সাথে এমন কেন করে,দুইজন সমবয়সী।কিন্তু রাসেল সব সময় আবরারকে হিংসা করে এসেছে,ও যতোই রাসেলের সাথে ভালো ব্যবহারে করুক না কেন?তাই একটা সময় রাসেলের উপর থেকে আবরারের মন উঠে যায়,বর্তমানে আবরার ওকে ফুপাতো ভাই হিসাবেই মানেনা।এখন যদি আবরার এমন পরিস্থিতর মধ্যে না থাকতো তবে রাসেল ঠিকভাবে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারতোনা।
আবরার ফুপার হ্যাঁ উত্তর শুনে মনে এক ধরনের শান্তি পায়।রাসেলের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইয়ারাবীর কাছে চলে যায়।রাত সাড়ে নয়টার দিকে ওটি শুরু হয়,বাইরে দাঁড়িয়ে সবাই পায়চারি করছে,ওর শ্বাশুড়ি আল্লাহর নাম নিচ্ছেন।এর মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে ইফাজ।হ্যাঁ,ইফাজ বিয়ের দুই মাস পরেই লন্ডনে চলে আসে।মি.রায়হান ওকে দেখেই বলে উঠে,
-“তোমাকে ফোন করছিলাম কিন্তু তুমি…”
-“আঙ্কেল আমি ওটিতে ছিলাম,পরে কেবিনে এসে ফোনে আপনার ম্যাসেজ দেখতে পায়।আবরার ওর সাথে আছে?”
-“হ্যাঁ,তবে চিন্তা হচ্ছে খুব।”
-“আল্লাহ ভরসা,সব ঠিক হয়ে যাবে।বাড়িতে জানে?”
-“হ্যাঁ,বলেছি সবাইকে।”
ওর শ্বশুড় সবার কাছে ফোন করে ইয়ারাবীর কথা সেই মুহুর্তে জানিয়ে দিয়েছে।মিসেস ইশানি খবর পাওয়ার পর থেকে নামাযের পাটিতে বসে অনাবরত চোখের পানি ফেলে দোয়া করে চলেছেন মেয়ের আর মেয়ের অনাগত সন্তানদের জন্য।তারা,রোজ আর ইমন খবরটা পাওয়ার পরপরই মি.ফুয়াদের বাসায় চলে আসেন।ওইদিনে চৌধুরী বাড়িতেও সবাই চিন্তা করছে।
(২৩৩)
মিসেস রায়হানের সকালের কথা মনে পরতেই অনেকটা আতকে উঠেন।কারণ সকাল বেলা আবরার চলে যাওয়ার পর ইয়ারাবী ঘর থেকে বের হয়ে উপরে শ্বাশুড়ি ঘরের দিকে মিয়োর সাহায্যে যায়।যখন থেকে আবরার সুংবাদ পেয়েছে তখনি উপর থেকে নিচের ঘরে চলে এসেছে ওর সুবিধার জন্য।মিয়ো সিঁড়ি দিয়ে এই অবস্থায় নিয়ে যেতে চাইনি কিন্তু ইয়ারাবীর চোখ রাঙানি দেখে বাধ্য হয়।মিসেস রায়হান পুত্রবধূকে উপরে আসতে দেখে খুব রেগে যেয়ে বকা দেন।কিন্তু ইয়ারাবী হজম করে নেয়,কেননা এইগুলো সে প্রায়ই শুনে থাকে।মিসেস রায়হানের মাথা ঠান্ডা হলে উনি মিয়োকে চলে যেতে বলে ইয়ারাবীকে নিজের সামনে বসায়।ইয়ারাবী হালকা হেসে বলে উঠে,
-“আম্মু মাথা কী বেশি গরম হয়ে গেছে?আমি এনাকে বরফ অানতে বলি,আপনি ওইগুলো মাথায় দিলে ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল হয়ে যাবেন।”
-“ফাজলামি হচ্ছে শ্বাশুড়ির সাথে?”
-“ও…মা…গো!ফাজলামি কোথায়,আমি তো আপনার উপকারই করলাম।”
মিসেস রায়হান ওর কথা শুনে আর চেহারার অঙ্গভঙ্গি দেখে হেসে ফেলেন,আসলে এটা নতুন কিছু নয়।ওনাদের সম্পর্ক ঠিক মা-মেয়ের মতো হয়ে গেছে বর্তমানে।উনি ইয়ারাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
-“জানিস,তোর বর যদি জানে তাহলে কী হবে?”
-“কে বলবে?তাছাড়া উনার ধমক তো এমনিতেও শুনতে হয়।হাসপাতালে যাওয়ার আগেও বকা দিয়ে গেছে।”
উনি ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে ওর জামার দিকে চোখ দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে,
-“তোর জামায় সাদা গুঁড়া কী এগুলো?”
-“ও এইটা গুঁড়া দুধ।আসলে আপনার সুপুত্র আমার আচার খাওয়াটা একদম কমিয়ে দিয়েছে।মিয়ো,এনা উনার কথামতো একটু একটু দেয়।তাই আজ কিচেনে আচার খুঁজতে যেয়ে গুঁড়া দুধ দেখলাম।তাই একটু টেস্ট করলাম ঠিক আছে কী না?”
-“শুধু টেস্ট করলি!”
-“না মানে একটু খেয়েছি।আম্মু প্লীজ উনাকে বলবেন না।”
-“আচ্ছা বলবোনা পাগলি।”
-“আম্মু একটা কথা জানতে চাইছিলাম।”
মিসেস রায়হান কাবার্ডে শুকনো কাপড় ভাজ করে রাখতে রাখতে বলেন,
-“বলে ফেল,এতক্ষণ তো মুখে কই ফুটছিলো।এমন কী কথা যে বলতে সংকোচ করছিস।”
-“না আম্মু মানে বলতে চাইছিলাম মৃত মানুষের স্বপ্ন দেখলে কী হয়?হাদিসে কী এমন কিছু আছে?”
মিসেস রায়হান কথাটা শুনে থমকে যান,হাতের ভাজকৃত জামাটা বিছানায় জড়ো করে রেখে ইয়ারাবীর সামনে বসে বলেন,
-“এসব কেন বলছিস তুই?এই সত্যি করে বলতো কী হয়েছে?”
-“আম্মু গত এক সপ্তাহ ধরে আমি খালামনি আর য়ুহার আপুদের স্বপ্নে দেখছি।”
-“কী দেখেছিস তুই?”
-“একবার খালামনিকে দেখি উনি সোফায় বসে আছেন।ইমন ভাইয়া উনাকে দেখে যখন বলে আম্মু তুমি না মারা গেছো?তখন খালামনি কোনো জবাব না দিয়ে শুধু মুচকি হাসছিলেন।আবার একবার দেখলাম,শৈল ভাইয়ার সাথে য়ুহার আপুর বিয়ে হচ্ছে তবে জায়গাটা পরিচিত নয়।আপু আমাকে বলছে তোকে আমার সাথে নিয়ে যাবো শ্বশুড়বাড়িতে,কয়দিন থাকবি ওখানে মজা হবে।জানেন আম্মু,আবার দেখেছি আমি প্রাণো আপুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।কিন্তু রাস্তা মনে করতে পারছিনা তখন খালামনি হঠাৎ এসে বলে,তোকে আমি নিয়ে যাচ্ছি চল।জানেন,খালামনির হাত অনেক ঠান্ডা ছিলো।আমি উনাকে বলতেও পারছিনা কথাগুলো যদি চিন্তা করে,আর আপনাকে বলবো বলবো করে বলা হচ্ছেনা।”
এসব শুনে উনার ভ্রু দুইটা কুঁচকে আসে,চিন্তায় পরে যান উনি।নিজেকে সামলে বলেন,
-“মা রে,হাদিসে কী আছে আমি সেটা সঠিক জানিনা।তবে আমার মা বলতো এসব দেখা ভালো না।তুই বরং আবরারের কাছে শুনিস,ও বলতে পারবে।”
কথাগুলো মনে পড়তেই মিসেস রায়হানের গা শিউরে উঠে,গত সাতটা দিন ধরে মৃত মানুষের স্বপ্ন একভাবে দেখে আসছে বিষয়টা উনার কাছে ভয়ংকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।উনি বসে বসে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন পুত্রবধূর জন্য।
সাড়ে তিনঘন্টা পার হয়ে গেছে এখনি একটা খবরও কেউ পায়নি।সবার এবার বড্ডো চিন্তা হচ্ছে।হঠাৎ করে দুই জন নার্স কোলে দুটো তোয়ালে পেচিয়ে বেবীদের নিয়ে এগিয়ে আসতেই মি.রায়হান দ্রুত উনাদের কাছে যান।নার্স দুইটা হাসি মুখে শুভেচ্ছা জানাতেই বাকীরাও এগিয়ে আসে।নার্সরা বেবীগুলোকে উনাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন,
-“একটা মেয়ে আর একটা ছেলে,মেয়েটি ছেলেটির থেকে তেরো মিনিটের বড়।”
মিষ্টার এবং মিসেস রায়হান বেবীদেরকে কোলে নিয়ে দেখে বেবীদের চোখগুলো সম্পূর্ন আবরারের মতো,চুলগুলোও আবরারের মতো,অতিরিক্ত ফর্সা,তবে দুইটা বাচ্চা বাবার মতো হলেও মেয়েটার চোখের দুই পাশে ইয়ারাবীর মতো দুইটো তিল আছে।বাচ্চা দুইটা চোখ পিটপিট করে,ছোট ছোট হাত-পা ছুড়ে সবকিছু দেখছে,সবকিছু অদ্ভুত লাগছে যে তাদের কাছে।উনারা বেবীদেরকে আদর দেন।ইফাজ নার্সের দিকে উদ্দেশ্যে করে বলেন,
-“পেসেন্ট কেমন আছে সিস্টার?”
-“আশঙ্কার বাইরে আছেন,রক্ত দেওয়া হচ্ছে।কিছুক্ষণে পরে বেডে শিফট্ করে দেওয়া হবে।”
-“বাচ্চাদের কোনো সমস্যা নেই তো?”
-“সেটা ডাক্তার বলতে পারবেন,তবে সময়ের আগে হওয়ায় কিছুটা সমস্যা থাকতে পারে।”
ইফাজ বেবীদের ছবি তুলে আত্মীয়দের কাছে পাঠিয়ে দেয়।তারা ছবি পেয়েই মামা-মামীকে দেখালে উনারা বারবার ছবিটা ছুঁয়ে দেখছে আর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছেন।মি.ফুয়াদ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“দেখেছো ইশা,নাতনিটার ঠিক ইস্মার মতো চোখে তিল আছে।এইতো সেদিন মেয়েটা হলো আজ নিজেও মা হয়ে গেলো।”
-“তুমি ঠিক বলেছো,আর প্রেগন্যান্সির পুরো সময়টা ওখানে ছিলো বলে বাচ্চারাও ওমন হয়েছে।কিন্তু মেয়েটা ঠিক আছে তো?”
-“এরা তো বলছে রক্ত লাগছে,আমি তো কিছু বুঝছিনা।মা তারা ইফাজের কাছে ফোন করে একটু শোন না মা?”
তারা মামার কথা শুনে দ্রত ইফাজের নাম্বারে ফোন করে।এদিকে কিছুক্ষণ আগে ইয়ারাবীকে কেবিনে শিফট্ করা হয়েছে তবে ওর জ্ঞান ফেরেনি।বেবীদেরকে কিছুক্ষণ অবজার্ভেশনে রাখার জন্য নার্সরা নিয়ে গেছে।রাতে কেউ খায়নি তাই মি.রায়হান সবাইকে নিয়ে খেতে গেছেন অবশ্যই আবরার সবাইকে জোর করে পাঠিয়েছে।এই মুহুর্তে কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আবরার আর ইফাজ ডাক্তারের সাথে কথা বলছে।ডা.মিক আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ইয়া প্রচুর দুর্বল।আর সময়ের আগে বেবীরা ভূমিষ্ঠ হওয়া বেবীদের ওজনটা অনেক কম।ছেলেটার হালকা শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে।”
-“মানে?”
-“আমি বুঝতে পারছি তোমার সমস্যা বন্ধু,প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দ অন্যদিকে চিন্তা।যাই হোক ইয়ার দিকে খেয়াল রাখবে।তো স্ত্রীর কাছে যাও এখন।”
ইফাজ মিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“বেবীদের কখন দেওয়া হবে?”
-“ইয়ার জ্ঞান ফিরলেই পাবে।”
মিক চলে যেতেই ওরা কেবিনে ঢোকে।
(২৩৪)
বাংলাদেশে সকাল নয়টার দিকে অনু ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হবে ঠিক তখনি প্রত্যয় বাইক নিয়ে ওর সামনে এসে থাকে।অনু প্রথমে ভয় পেলেও বাইক দেখে চিনে ফেলে।প্রত্যয় হেলমেটটা খুলে বলে,
-“কেমন আছো?”
-“কে আপনি?আপনাকে কেন বলবো?”
অনু অনেকটা রেগে কথাটা বলে উঠলে প্রত্যয় বাম হাত দিয়ে নিজের কান ধরে বলে,
-“স্যরি,আর হবেনা।কে জানতো তুমি ভয় পাবে?”
-“রাস্তা ছাড়ুন,আমার ক্লাসের দেরী হয়ে যাবে।”
-“আরে বাবা বললাম তো স্যরি,মাফ করে দাও।এমন ভুল আর করবোনা।”
অনু কিছুটা ভাব নিয়ে বলে,
-“আচ্ছা যান,মাসি হওয়ার খুশিতে মাফ করে দিলাম।”
-“মাসি মানে?”
প্রত্যয় অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলে অনু বলে উঠে,
-“হ্যাঁ মাসি,লন্ডনের সময় রাত বারোটার দিকে ইয়ারাবীর দুইটা মিষ্টা বাবু হয়েছে।কতটা যে সুন্দর আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারবোনা।”
-“কী আবরার তো কিছু বলেনি?”
-“আমিও জানতাম না,আসলে সময়ের আগে হয়েছে।মেঘ আমাকে ফোন করে বলবো ভোরের দিকে।ছবিও পাঠিয়েছে,পুরোটাই জিজুর মতো হয়েছে।”
-“যাক তাহলে বাচ্চার বাপ হয়েই গেল শেষমেশ,ছবি আছে তো ফোনে দেখাও তো।”
অনু হ্যান্ডব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে বাচ্চা দুইটার ছবি দেখায়।প্রত্যয় ছবি দেখে মুচকি হেসে বলে,
-“আবরারের কার্বণ কপি হয়েছে পুরোটা,একটুও বাদ নেই।”
-“হুম,আমিতো ফোনের ওয়ালপেপারে দিয়েছি পিচ্চি দুইটার ছবি।কে জানতো শ্যামলা মেয়ের এত কিউট বাচ্চা হবে?”
-“কে বললো শ্যামলা মেয়েদের ফর্সা বাচ্চা হয়না?ও শুনো একটা জরুরি কথা ছিলো বলে দেখা করতে এলাম।জানো আজ একদিনের ছুটি নিয়েছি অনেক কষ্টে।পুরো এক সপ্তাহ ধরে ছুটিটার জন্য অপেক্ষা করেছি।”
অনু কিছুটা অবাক হয়ে যায় ওর কথা শুনে,ও বুঝতে পারছেনা আজ এমন কোনো দিন যার জন্য ওর ছুটি জুরুরি ছিলো।নিজের এলোমেলো চুলগুলে কানের পাশে গুজে দিচ্ছে আর ভাবছে।প্রত্যয় ওর সামনে তুরি বাজিয়ে বলে,
-“বিয়ে করবে আমার?”
অনু অনেকটা অবাক হয়ে যায় ওর কথা শুনে।কারণ ওদের অাশীর্বাদ সম্পন্ন হয়ে গেছে তাহলে এখন এমন প্রশ্ন কেন করছে ছেলেটা।ও সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা অনেকটা গম্ভীর ভাবে কিছু ভাবছে।অনু ওর কাঁধের উপর হাত রেখে প্রশ্নের সহিত বলে উঠে,
-“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?বিয়ে তো আমাদের হবেই।”
-“উহু,হবেনা।”
-“মানে?”
অনু প্রশ্ন করে সাথে সাথে স্তব্ধ হয়ে যায়,ওর ভাবতে পারেনি প্রত্যয় এমন কিছু বলতে পারে।তাহলে কী প্রত্যয়ও দীগন্তের মতো?তাহলে কী প্রত্যয় ও ধোঁকা দিলো?এবার সমাজে শুধু ওকে নয় ওর বাবা-মাও অপমানিত হবে?অনু কাঁপাকাঁপা কন্ঠে প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
-“তুমি পাগলের মতো কী বলছো এসব?প্রত্যয় আমাদের আশীর্বাদ হয়ে গেছে,সমাজের অনেকে জানে কথাটা।এখন যদি বিয়ে ভেঙ্গে দাও তবে মরণ ছাড়া গতি হবেনা আমার।”
-“চুপ করবে তুমি,কীসের মরণ?বাকী কথা শুনে তারপর বলবে?”
-“বলো কী বলবে?”
-“বাবা কাল বাসায় খুব ঝামেলা তৈরি করেছে,উনি কাউকে না জানিয়ে ওই মেয়ের সাথে সামনের শুক্রবারে বিয়ে ঠিক করে এসেছে।বাড়ির সবাই তোমাকে চাই,কিন্তু উনি আর উনার বোন এসব কান্ড করে বেড়াচ্ছে।আমি কিছুই জানতাম না, কোয়াটারে ছিলাম তাই।প্রাপ্ত রাতে ফোন করে সবটা বলে আমাকে।”
-“এখন তুমি কী চাও?”
-“তুমি আমাকে বিয়ে করবে নাকী সেটা বলো?আজই বিয়ে করতে চায় তোমাকে?”
-“কি বলছো এসব?বাবা-মা…”
-“বিয়ের পরে সবাইকে জানাবে,সবার মত আছে।আশাকরি সবাই পরিস্থিতি বুঝতে পারবে।তুমি আমার বাবাকে চেনোনা,সে এতটাই খারাপ হয়ে গেছে নিজের স্বার্থের জন্য সবটা করতে পারে।উনি যদি কোনো এক প্রকার খারাপ রিপোর্ট দিয়ে দেয় তবে আমি চাকরিটা হারাবো।”
-“আমি….”
-“চলো আমার সাথে ম্যাজেস অফিস,তারপর যাবো মন্দিরে।দাদা-দাদু সবাই ওখানে আছে,বাইকে উঠো।”
-“প্রত্যয় এসব ঠিক না,না জানিয়ে বিয়ে।”
-“কী ঠিক নয়?তুমি কী চাওনা এই বিয়ে হোক?আশীর্বাদ হয়ে গেছে এখন তুমি পিছপা হবেনা।”
-“আমার বাবা-মাকে কী জবাব দিবো?উনারাতো কষ্ট পাবেন।”
-“প্রাপ্ত দাদুকে সব বলেছে,উনি এসব ম্যানেজ করে নিবে।আর বিয়ের পর তুমি আমার সাথে কোয়াটারে থেকে পড়াশোনা করবে।”
অনু অনেকটা চিন্তায় পরে যায়,কী করবে ঠিক বুঝতে পারছেনা।বাবা-মায়ের মনে কষ্ট দিতে চাইনা আর না প্রত্যয়কে ছাড়া থাকতে পারবে।প্রত্যয়ের সাথে বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে সেখানেও কষ্ট পাবে ওর পরিবার।প্রত্যয় অনুর কাধে হাত রেখে বলে,
-“ভরসা রাখো আমার উপর।”
-“করি,কিন্তু বিয়ের পরে যে তোমার বাবা কিছু করবেনা সেটার কোনো প্রত্যাশা আছে?”
-“সেই ভয় তোমাকে পেতে হবেনা।”
-“আমার ভয় করছে প্রত্যয়,সব ঠিক থাকবে তো।”
প্রত্যয় কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর ফোনে প্রাপ্তের কল আসে।ও ফোনটা কেঁটে দিয়ে বলে,
-“প্রাপ্ত ফোন করছে,আমাদের যেতে হবে চলো।”
অনুর আর কিছু না ভেবে নিজের ওড়না সামলে প্রত্যয়ের বাইকের পিছনে বসে পরে।জানেনা, বাড়ির লোকদের কী বলবে?তবে প্রত্যয়কে পাওয়ার জন্য আর পরিবারের সম্মান বাঁচানোর জন্য কাজটা করতে হচ্ছে।
(২৩৫)
ইয়ারাবী চোখগুলো পিটপিট করে খুলে সামনে তাকিয়ে বুঝতে পারে ও হাসপাতালের একটা কেবিনে আছে। বাম হাতে স্যালাইন চলছে,ডান হাত পেটে রেখে ও চমকে যায়।’আমার বেবীরা’ বলে চেঁচিয়ে উঠেতেই পাশের থাকা নার্স চমকে তাড়াতাড়ি ওর কাছে যেতেই ও নার্সকে ইংরেজিতে আবার প্রশ্ন করে,
-“আমার বেবীরা কোথায় সিস্টার?”
-“ম্যাম আপনি শান্ত হোন,আপনার বেবীরা ডাক্তারের অবজারভেশনে আছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাকে দেওয়া হবে।আমি সবাইকে জানিয়ে আসি আপনার জ্ঞান ফিরেছে।”
নার্স কথাটা বলে বাইরে যায়,কিন্তু ইয়ারাবীর অবজারভেশনে রাখার কথা শুনে চমকে উঠে।তার মানে কী ওর বেবীরা ঠিক নেই,সময়ের আগে হওয়াতে কোনো সমস্যা হয়েছে।নানা কথা ভাবতে ভাবতে কেবিনে সবাইকে ঢুকতে দেখে।আবরার ওর পাশে বসে ওর ডানটা নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।ডা.মিক ওকে চেক আপ করে বলে,
-“এখন কেমন অনুভব করছো ইয়া?”
-“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো।আমার বেবীরা কোথায়?অবজারভেশনে কেন রাখা হয়েছে?ঠিক আছে ওরা,সমস্যা হয়নি তো?আমি দেখবো আমার বেবীদের?”
ডা.মিক মুদৃ হেসে বলে,
-“শান্ত হও,উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয় তোমার জন্য।দেখ তুমি ডাক্তারি পড়ছো জানো অনেক কিছু,সময়ের আগে হওয়ায় ওদের ওজন কিছুটা কম।তাছাড়া তোমার ছেলে বেবীর শ্বাসকষ্টের একটু সমস্যা আছে।তাছাড়া মেয়েটার এখনো কোনো সমস্যা আমরা পায়নি।”
-“কী?আবরার দেখুন কী বলছে উনি?আমার বেবী বলে অসুস্থ।আমি বেবীদের দেখবো এনে দিন আমার কাছে?”
ইয়ারাবী কান্না শুরু করে দিয়েছে,মিসেস রায়হান ওর মাথায় হাত দিয়ে বলে,
-“দেখ মা বাচ্চারা ঠিক আছে,কাঁদছিস কেন পাগলি?আর শ্বাসকষ্টের সমস্যাটা এমন নয় যে ঠিক করা যাবেনা।”
ওরা কথা বলতে বলতেই নার্সটা তোয়ালেতে পেঁচিয়ে দুইটা বাচ্চাকে নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে ইয়ারাবীর পাশে শুইয়ে দেয়।ইয়ারাবী এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে,বুঝতে পারছে পুরোটা বাপের কার্বণ কপি হয়েছে।তবে ওর বিশ্বাস হচ্ছেনা এত সুন্দর সন্তানরা ওর ছোট পেটের ভিতর ছিলো।যাদেরকে কয়েক ঘন্টা আগে ছুঁতে পারেনি তবে উপলব্ধি করতে পারতো।বেবীরাও ওর দিকে তাকিয়ে কচি কচি হাত-পাগুলো নাড়াচ্ছে।ও বেবীর মুখে,তারপর হাত-পাগুলো ছুঁয়ে দেয়।এ যেন এক পরম তৃপ্তি, এই তৃপ্তির কাছে সব কিছু ফিকা।ওর চোখের কোনে জলের অাভাস।ওর আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমার বেবীরা?আমাকে এরা মা বলে ডাকবে, ছোট ছোট হাত-পা দিয়ে খেলা করবে?”
-“হুম,তোমার বেবীরা।ওদের কী শুধু দেখবে নাকী কোলেও নিবে?”
ইয়ারাবী মুচকি হেসে দুইজনকে কোলে তুলে নেয়, আবরার এতে সাহায্য করে।হাসপাতালে ছয়দিন থাকার পর ওকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়,ও মোটামুটি এখন হাঁটাহাঁটি করতে পারে।পরিবারের সবাই খুব খুশি,আবরারের বন্ধুরা বাড়িতে এসে বেবীদের দেখে যায়।মি.রায়হান তৃতীয় দিনেই বাংলাদেশে ফিরে যেয়ে সপ্তমদিন অর্থাৎ আজ আকিকার ব্যবস্থা করেন।ইয়ারাবী এতক্ষণ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের নাম ভাবছিলো, হঠাৎ কিছু মনে পরতেই ঘরে এসে দেখে ইনি,মিনি,
চেলসি বাবুদের চারপাশে খানিকটা দূরত্ব রেখে বসে চোখ বড় বড় দেখছে আর বাবুরা নিজেদের হাত-পা ছুড়ে খেলা করছে।অবশ্য এটা নতুন নয়,যেদিন বাসায় এসেছে সেদিন থেকেই এরা তিনজন বাবুদের সাথে থাকে।বাবুরা কান্না করলে দোলনা দুলিয়ে দেয়,রাতে বাবুদের দোলনার পাশে কাউচে ইনি-মিনি ঘুমায়।হাজার চেষ্টা করেই ওদের ঘরে দিয়ে আসা যায়নি,আসলে অনেক পশু আছে যারা মানুষকে বুঝিয়ে দেয় ভালোবাসা কী?ইয়ারাবীর মুচকি হেসে বাবুদের গালে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।এর মাঝেই আবরার ঘরে ঢুকে বলে,
-“মেডিসিন নিয়েছো?”
-“জ্বি,”
আবরার বাবুদের বেডের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠে,
-“তিন বডিগার্ড বুঝি পাহারায় ব্যাস্ত?”
-“জ্বি,কাল থেকেই চাকরিতে নেমে পরেছে।আচ্ছা শুনুন,আজ সাতদিন হয়ে গেছে বেবীদের নাম কী দিবো?সবাইতো ডাক নাম দিয়েছে,আম্মুর সাথে এই বিষয়ে কথা বললে উনি বলছেন আমাদের ঠিক করতে?”
-“আমি দুইটা ভেবেছি,তুমি কিছু ভেবেছো কী?”
-“জ্বি,একটু আগেই মনে পরলো।”
মিসেস রায়হান ঘরে ঢুকে বলেন,
-“এক কাজ কর,একজন নাতির নাম বল আরেকজন নাতনির নাম বল।”
আবরার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
-“মম্ একদম ঠিক বলেছো।”
-“জানি সেটা।এই ইয়ারাবী তুই বল আগে।”
ইয়ারাবী মুচকি হেসে বলে,
-“তাহলে আমি ছেলেরটা বলি আপনি মেয়েটা বলুন।”
-“হামম বলো।”
-“ইব্রাহীম আবরার আইদ চৌধুরী,কেমন হয়েছে নামটা?”
আবরার মুচকি হাসে,মিসেস রায়হান হেসে বলে উঠে,
-“মাশাল্লাহ্ অনেক সুন্দর নাম।এবার আবরার নাতনির নামটা বলে ফেল দেখি।”
-“হ্যা বলছি, আয়েশা আবরার ইয়ামিনা চৌধুরি।”
-“মাশাল্লাহ্,তোদের দুই জনেই নামই অনেক সুন্দর।আমি তোর বাবাকে ফোন করে নাম দুইটা বলে দেয়।ও হ্যাঁ শোন ওদের আকিকা দেওয়া হয়ে গেছে।”
-“আলহামদুলিল্লাহ্।”
মিসেস রায়হান নিজের স্বামীকে কল করতে করতে ঘরের বাইরে চলে যান।মেয়ে বাবুটা ঘুমিয়ে পরাই ওকে নিয়ে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে ছেলে বাবুকে কোলে নিয়ে আস্তে করে হাঁটতে হাঁটতে গুনগুন করে গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে থাকে।
“আয় ঘুম আয় ঘুম
চাঁদের কণার চোখে ঘুম দিয়ে যা
আয় ঘুম আয় ঘুম
সাত রাজা মানিকের চোখে ঘুম দিয়ে যা”
(২৩৬)
আল্লাহ চাইলে যেমন সবকিছুতে মুহুর্তের মধ্যে সুখে ভরিয়ে দিতে পারে তেমনি সবকিছু এক মুহুর্তের মধ্যে কালোর মেঘের বর্ষণে পরিনত করতে পারেন।ঠিক তেমনি হয়েছে,সবকিছুু যে স্বপ্নের মতো হবে তা কিন্তু নয়।মাঝে মাঝে এমন কিছু বাস্তবতা আসে যা আমাদের শুধু ক্ষণিকের জন্য নয় বরং পুরো জীবন ধরে কাঁদানোর জন্য হয়।চৌধুরী বাড়ির বাগানটার পাশে অনেকটা পাকা করে একটা কবর গাথা হয়েছে,দেখে মনে হচ্ছে এই সাত-আট দিন হবে হইতো।আর ঠিক সেই করবের সামনে বাইশ বছরের একজন তরুনি বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের সাথে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে আছে।চুলগুলো এলোমেলো,চোখের নিচে কালো দাগ, দেখেই মনে হচ্ছে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে, কাঁদার আর কোনো শক্তি নেই তার,মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
#চলবে_____