জীবন মানে তুমি পর্ব-৬৫

0
3769

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৬৫

(২২০)

-“আমি তোমাকে বিয়েটা বাধ্য হয়ে করেছি কেননা আমার মায়ের ইচ্ছা ছিলো,তারপর বাবার মাথায় হাত রেখে ওয়াদা করেছি তাই তোমাকে বিয়ে করেছি।এজন্য আমাকে নািয়ে কোনো স্বপ্ন মনে বুনার চেষ্টা করবেনা।আমি অতোটা উদার নই যে তোমার মতো ধর্ষিতাকে বৌ হিসাবে গ্রহণ করবো।বাকী পাঁচটা মানুষের মতো জীবন সাজাতে পারবোনা তোমার সাথে।আর আমি কিছুদিন পরেই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি।”

ইফাজ ঘরের ঢোকার পর তারা ওকে সালাম দিতেই কথাগুলো বলে উঠে।কথাগুলো শুনে তারা স্তব্ধ হয়ে যায়,ভাবেনি ইফাজের মুখ থেকে এমন কিছু শুনবে।কান্না ভেজা কন্ঠে বলে উঠে,
-“আমিতো ইচ্ছা করে ধর্ষিতা হয়নি ইফাজ,তাহলে কেন আমি শাস্তি পাবো।আপনাকে অন্য মস্তিষ্কের মানুষ ভেবে ছিলাম কিন্তু আপনিও…..”
-“হ্যাঁ,আমি জঘন্য ব্যাক্তির কাতারে পরি।ধর্ষিতাদের জন্য হাতে প্লাকার্ড নিয়ে লড়াই করা আর তাদেরকে বিয়ে করে আপন করে নেওয়া অনেক আলাদা।”
-“তাহলে আগে কেন বলেননি এসব?বিয়েটাতে আপনি কখনোই রাজী ছিলেন না সেটা বললেই আমি নিজে বিয়েটা ভেঙ্গে দিতাম।”

তারার এমন কথায় ইফাজ তখন চুপ হয়ে যায়,কী বললে?তার কাছে যে উত্তর নেই।কখনো কখনো পরিস্থিতি এমন তৈরি হয় যে ভালোবাসার মানুষ দুইটা একসাথে হলেও ভালোবাসতে পারেনা।মনে হয় তার জন্যই অনেকেই বলে,কল্পনার মতো করে বাস্তবটা কেন সুন্দর হয় না।রংহীন বাস্তবতার মাঝে মানুষ রঙীন কল্পনাকে খোঁজে যায় বোকার মতো, ঠিক তেমনি তারাও খুঁজছিলো হয়তো।কিন্তু ইফাজ তো সেটা ভাবেনি আর না মন থেকে মানতে পারছে তারাকে।

আজ ঈদের দ্বিতীয়দিন,তারা-ইফাজের বিয়েটা অনেক ধুমধাম করে হয়েছে।সকলের সামনে পাত্র-পাত্রী নিজেকে হাসিখুশি দেখালেও আসলে কেউ খুশি নয়।বিয়েটা শেষ হওয়ার পরে বরযাত্রী বাড়িতে ফিরে এসেছে।মিসেস রহমান না থাকায় সকল নিয়ম রোজ নিতে হাতে পালন করে তারাকে ইফাজের ঘরে দিয়ে আসে।আর প্রথানুযায়ী আজ তাদের বাসর রাত,তাই বাকী সব মেয়েদের মতো সেও ইজাযের জন্য অপেক্ষা করছিলো।তবে জানতো বাকীদের মতো তাদের সহজ সম্পর্ক হবেনা কিন্তু কখনো এটা ভাবতেও মনে হয় পারেনি ইফাজ এসেই তাকে কথাগুলো বলবে।আগে তারার নিজের প্রতি ঘৃণা লাগতো, মরে যেতে ইচ্ছা করতো,তাইতো আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলো।কিন্তু বেঁচে ফেরার পর থেকে পরিবার,শুভাকাঙ্ক্ষী আর বিশেষ করে ভালোবাসার মানুষের জন্য নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো।কিন্তুু ইফাজ আজ যা করলো সেটাই ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে,মনে হচ্ছে কোনো এক স্বপ্ন দেখছে।তবুও নিজেকে শক্ত করে ইফাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
-“আজ আমি নোংরা হয়ে গেছি তাইনা,পঁচে গেছি আমি?আমার ভালোবাসার কী কোনো দাম নেই ইফাজ?তাহলে বাঁচালেন কেন আবার?”
-“ডাক্তার হিসাবে আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি শুধুমাত্র।তাছাড়া আমি কোনোদিন তোমাকে বলিনি,আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
-“কর্তব্য!হায়রে মানুষ,আচ্ছা পরিবারের সবাই জানে আপনার এই দ্বিতীয় রুপ সম্পর্কে?আর না জানলে তাদের তো জানাতে হবে,কেননা এই বিয়ে তো আর টিকবে না।আর টিকে থাকার জন্য শক্ত একটা খুঁটি দরকার,সেটাই তো নেই আমাদের মধ্যে।তাই পরবর্তীতে যাতে ঝামেলা না হয় তার জন্য আগে জানিয়ে দেওয়া ভালো নয় কী?”

কথাটা বলে তারা দুই পা সমানে বাড়াতেই ইফাজ চমকে উঠে।মনে মনে ভয় ঝেকে বসে যে তারা আবার বাড়ির সবাইকে সব বলে না দেয়।তাই ইফাজ দ্রুত তারার হাত ধরে আটকে দিয়ে বলে,
-“বেশি বাড়াবাড়ি করবেনা।এসব বিষয়ে বাসার কেউ যেন কিছু জানতে না পারে আর বিশেষ করে পিচ্চি।তার সাথে তোমার একটু বেশিই ভাব।আর যদি জানে তাহলে…..”

ইফাজকে পুরো কথা শেষ না করতে দিয়ে তারা বলে উঠে,
-“কেন জানলে কী হবে?একজন আদর্শ ছেলের সত্য বাইরে আসবে,একজন ভাইয়ের মহৎকর্ম প্রকাশ পাবে?”
-“তোমার কী মনে হয়?এসব বললে তোমার সত্য সবাই জানবে না,যা তুমি লুকিয়েছো সবার থেকে।”

তারা হাসতে হাসতে বলে,
-“জানবে!জানুক সবাই,আমিতো নিজ ইচ্ছায় ধর্ষণ হইনি।কিন্তু আপনি যেটা করছেন সেটাও অন্যায় ইফাজ।পারিবারের কথা রাখতে যেয়ে জীবনটা যে বরবাদ করে দিলেন সেই বেলায় কী হবে?নিজেকে খুব মহৎ বানান সবার সামনে,কিন্তু আপনিও একজর কাপুরুষ।আপনার আর ওই নিকৃষ্ট লোকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।আর সেটা পরিবারের লোকদের জানানো উচিত।”

ইফাজের তারার দিকে তাকিয়ে বুঝতে বাকী রইলোনা যে ও মিথ্যা বলছেনা।ও তারাকে অনেক অনুনয় করে বললো,
-“দেখ তারা,বাসার সবাই ব্যাপারটা জানলে কষ্ট পাবে।ঘরের ভিতর কী হচ্ছে সেটা বাইরের লোকে কেন জানবে।বিয়ে যেহেতু হয়েছে একই ছাদের নিচে থাকবে,তবে অধিকার ফলাতে আসবেনা।আজ আমার সাথে বিয়ে না হয়ে যদি অন্য কারোর সাথে হতো তবে সেই লোকটা পরবর্তীতে জানতেই পারতো কথাটা।দোষটা সে তোমাকেই দিতো, যদিও তোমার নিজের কোনো দোষ নেই আমিও মানি।বাদ দাও এসব,সারাদিন অনেক ধকল গেছে।দুই রাকাত নামায আদায় করে ঘুমিয়ে পড়ো।”
-“বাহ্ ইফাজ!যেখানে বিয়েটা মন থেকে করেননি, আমাকে স্ত্রী হিসাবে মানতে পারেননি সেখানে বিষয়টা হাস্যকর হয়ে যায়না।”
-“দেখ,তোমার কোনো কথার জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।আর নামায নিয়ে কোনো প্রকারের হেয়ালি আমার পছন্দ নয়।তুমি তোমার মতো এই বাড়িতে সব করতে পারবে তবে সঠিক সময়ে নামায না পড়লে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবেনা।”

হঠাৎ করে তারার মনে এক প্রকারের ভালো লাগা কাজ করে,কেননা ইফাজ একটু হলেও ওর উপর অধিকার দেখাচ্ছে।কিন্তু পূর্বের কথা মনে পরে এক প্রকারের ঘৃণাও সৃষ্টি।তবে ওর আর কোনো কথা না বলে ওযূ করে এসে একত্রে নামায আদায় করে নেয়।নামায শেষে তারা মন থেকে একটা আল্লাহর কাছে দোয়া করে,কিন্তু ওর জানা নেই দোয়া কবুল হবে কীনা,তবে আশা ছাড়েনা।

ইফাজ নামাযের পাটির থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তারাকে শুয়ে পরতে বলে ঘরে থেকে বের হয়ে যায়।তখন ঘড়িতে বারোটা পঞ্চাশ বাজে,ইফাজ সোজা ছাদের দিকে পা বাড়াই।আজ সবাই খুব ক্লান্ত,কালকের বৌ ভাতের জন্যও সকাল সকাল উঠতে হবে বলে কম-বেশি সবাই ঘুমিয়ে পরেছে।বলতে গেলে বাড়ির লাইটগুলো সব বন্ধ,চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার।আর এই অন্ধকারের মধ্যে ইফাজ সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে পূর্ব পাশের রেলিংএর উপর বসে।তারপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে লাইটার বের করে হাতের সিগারেটটা ধরিয়ে দুইটা টান দেয়।হঠাৎ করে কানে কারোর কাঁশির শব্দ ভেসে আসতেই ইফাজ চমকে উঠে।কেননা এই সময়ে ছাদে কারো থাকার কথা নয়, তাছাড়াও ওযে স্মোক করে এটা বাসার কেউ জানেনা।

ইফাজ হাতের সিগারেটটা না ফেলেই রেলিংএর উপর থেকে নেমে এদিক-সেদিক তাকিয়ে শব্দের শব্দের উৎস খুঁজতে থাকে।ইফাজদের ছাদটা পুরো গোলাকার আকৃতির,একপাশ খোলা আর দক্ষিণ পাশে দুইটা পানির ট্যাংকি।ছাদের মাঝামাঝিতে উঁচু করে চিলেকোঠা বানানো হয়েছে,তাই দক্ষিণ পাশের সবকিছু দেখা তেমন যাচ্ছে।তাই ইফাজ মোবাইলের আলো অন করে দক্ষিণ দিকে যেয়ে দেখে ইয়ারাবী ট্যাংকির উপর বসে মুখে হাত দিয়ে কাঁশছে।এটা দেখার সাথে সাথে ইফাজ সিগারেটটা ছুড়ে নিচে ফেলে দিয়ে ইয়ারাবীর কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“তুই এত রাতে এখানে কী করছিস তাও একা?আর এই অবস্থায় উপরেই বা কেন বসেছিস?যদি কিছু হয়ে যায়,নাম এখান থেকে।”

ইয়ারাবী ভাইয়ের হাতটা সরিয়ে সামনের চুলগুলো কানের পাশে গুজে বলে,
-“আগে বলো ঘরে বৌ রেখে এখানে কী করো?”

ইফাজ কিছুটা থতমত খেয়ে বলে,
-“না মানে তারা খুব ক্লান্ত তাই ঘুমিয়ে পরেছে,আর আমার ঘুম আসছিলোনা এজন্য ছাদে হাঁটতে এসেছি।”
-“স্টারপু ঘুম!ভাবা যায়?আর প্রিয়সীকে পেয়ে তোমার ঘুম উড়ে গেছে?”

ইয়ারাবী চোখ দুইটো বড় বড় করে মুখে দুই হাত দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাটা বলে উঠে।ইফাজ হেসে ওর নাকটা টেনে বলে,
-“ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস তুই,আমি বড় সেটা ভুলে যাসনা।”
-“হ্যাঁ বাপু জানি।আগে বলো সিগারেট খাওয়া কবে থেকে শুরু করলে?”
-“সি…সিগারেট মানে?”
-“ওমাগো,ভাইয়া তুমি সিগারেট চিনোনা?খালু,বড় ভাইয়া জানে তুমি সিগারেট খাও?”

ইফাজ কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা,ইয়ারাবী আবার বলে উঠে,
-“তুমি তো স্মোকার নও,তবে এসব কী?তুমি ডাক্তার,জানোনা সিগারেট খেলে ফুসফুসের ক্ষতি হয়।”
-“জানি,ওই মাঝে মাঝে করি।ট্রাস্ট মি এসব ছেড়ে দিবো তবুও কাউকে বলিসনা লক্ষী বোন আমার।”
-“ঠিক আছে, আর করবেনা।”
-“হ্যাঁরে বোন,আর করবোনা।এখন বল,রাতে তুই একা এখানে এসেছিস কেন?জানিস না,প্রেগন্যান্ট মেয়েদের অনেক কিছু মেনে চলতে হয়।তাছাড়া তোর সাথে একবার দুর্ঘটনা ঘটে গেছে,তাও একা ছাদে এসেছিস।তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় দে।”

ইয়ারাবী মাথায় কাপড় দিয়ে বিরক্তের দৃষ্টিতে ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমরা সব সময় জ্ঞান কেন দাও বলতো?তোমার কী মনে হয় আমার বর একা একা ছাদে আসতে দিবে?ঘুমাতে পারছিলাম না,অস্বস্তি হচ্ছিলো তাই খোলা বাতাসে এসেছি।”
-“আবরার কোথায়?”
-“চিলেকোঠার ওয়াশরুমে গেছে।”
-“তুইও রুমে যেতিস,সেটা না করে একা একা ট্যাংকির উপর বসে আছিস।”

ইফাজ অনেকটা রেগে কথা বলে উঠলে ইয়ারাবী মুখ বাঁকিয়ে বলে,
-“যে গরম,চিলেকোঠার ফ্যানটা নষ্ট তাই বাইরে বসে আছি।আর ট্যাংকির উপর বসা আমার অভ্যাস,সহজে পরবোনা।”
-“অভ্যাস আর এখনকার ব্যাপার আলাদা।আগে তুই একা ছিলি,এখন তোর ভিতর আরো একজন আছে।তোকে সাবধান থাকতে হবে পিচ্ছি,ছোট থেকে ছোট আঘাতে তোর প্রাণ যেতে পারে।আর আমরা কখনো চাইনা তোর ক্ষতি হোক।”
-“হি হি হি,ভাইয়া তুমিও না।আমার পুচকুগুলো ঠিক আছে পেটের ভিতরে।”
-“পুচকুগুলো মানে?”

ইফাজের এমন প্রশ্নে আবরার চিলেকোঠা থেকে বেড়িয়ে বলে,
-“ম্যাডাম যেদিন থেকে জেনেছেন বেবী হবে সেদিন থেকে টুইন্স টুইন্স করে লাফাচ্ছেন।”
-“পাগলি একটা।”

হ্যাঁ,ইয়ারাবী তিনমাসের প্রেগন্যান্ট।আর সেদিন পার্টির রাতেই শুভ সংবাদ জানতে পারে।আসলে সেদিন জুন আর মিলোডির ব্যাপারটা অনেকটা পরিষ্কার ভাবে মিক ওকে বুঝিয়ে বলে।জুনের ব্যাপারটা বুঝলেও আবরারের সত্যিকার অর্থে প্রেমিকা ছিলো এটা শুনে অনেকটা রেগে যায়।ইয়ারাবী আবরারের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-“একজন ইসলামিক মাইন্ডের মানুষ হয়েও এমন কাজ কীভাবে করলেন?আপনি জানেন না ইসলামে এর পরিনতি কী?আর একটা হলেও মানতে পারতাম তবে পাঁচটা প্রেমিকা কীভাবে হতে পারে?”

আবরার মিক,মার্টির সামনেই ইয়ারাবী কাছে বসে কানে ধরে বলে,
-“আমি জানি আমি ভুল করেছি,আর এইসব মেডিকেলের প্রথম বর্ষে থাকার সময়ের ঘটনা।যেদিন পড়ে জানলাম,রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের কারো মাথায় লোহার পেরেক ঠুকে দেয়া ওই নারীকে স্পর্শ করা থেকে অনেক ভাল, যে নারী তার জন্য হালাল নয়।’ (তাবারানি)।তাছাড়া
আল্লাহ বলেন -“তোমাদের জন্য হালাল সতী-সাধ্বী মুসলমান নারী এবং তাদের সতী-সাধ্বী নারী, যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তোমাদের পূর্বে, যখন তোমরা তাদেরকে মোহরানা প্রদান করো তাদেরকে স্ত্রী করার জন্যে, কামবাসনা চরিতার্থ করার জন্যে কিংবা গুপ্ত প্রেমে লিপ্ত হওয়ার জন্যে নয়। ” (সূরা আল-মায়িদা : ৫)।এসব জানার পর থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলি, তওবাও করেছি,আল্লাহর কাছে মাফ চেয়েছি।তারপর থেকে কখনো তুমি ব্যাতিত অন্য মেয়ের সাথে প্রণয় করিনি।”
-“আচ্ছা,সবকিছু থেকে সরে এসেছেন বুঝলাম, শয়তানের ধোঁকায় পরে এসব করেছিলেন সেটাও বুঝলাম।তবে এলিডি না মিলোডি কেন আবার আপনাকে নিজের প্রেমিক বলছে?কেন বলছে আপনাদের মধ্যে সম্পর্ক আছে?ও জানেনা আপনি বিবাহিত।আর আপনিও তো এখানে আসার পর থেকে খারাপ ব্যবহার করছেন আমার সাথে।”

আবরার ইয়ারাবীর হাত দুইটো নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলে,
-“সবার মুড সব সময় ভালো থাকেনা ইয়ু,অনেক ঝামেলার মধ্যে আছি যার জন্য না চাইতেও এসব করে ফেলি।আর মিলোডির সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো আর এটাকে ও এখনো ধরে রেখেছে।সত্যি বলছি ইয়ু,ল্যাবে কাজ করার সময় আমি ওর দিকে ঠিকমত তাকাইওনা।হ্যাঁ,দুইবার ওর বাসাতে ওকে নামিয়ে দিয়েছিলাম হতে পারে এই সূত্র ধরে নিজেকে আবার আমার প্রেমিকা মনে করছে।ও জানে আমি বিবাহিত আর ও তোমার ছবিও দেখেছে।তবুও মিথ্যাচার সৃষ্টি করছে,তুমি চেনো আমাকে, তোমার ভাইয়েরা আমাকে চেনে।এই ঘটনাগুলো আমার মমও জানে,প্রয়োজন হলে তার সাথে কথা বলো।”

কেন যেন ইয়ারাবীর মনে হচ্ছে আবরার যা বলছে সম্পূর্ণ সঠিক,কেননা ওর চোখে মিথ্যার কোনো অভাস নেই।তাই যা হয়েছে তার জন্য নিজেও আবরারের কাছে ক্ষমা চায়,কেননা ও নিজেও বাজে আচারণ করেছে স্বামীর সাথে।সবকিছু ঠিক চলছিলো,কিন্তু হঠাৎ করেই ইয়ারাবী প্রচুর অসুস্থ হয়ে পরে সেই সময়।তাই মিক দেরি না করে ওকে পরীক্ষা করে,এত বছরের ডাক্তারি অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারে ইয়ারাবী সত্যিই মা হতে চলেছে।কথাটা শুনে ইয়ারাবী খুশিতে সেদিন কান্না করে দিয়েছিলো,ও অশ্রুসিক্ত চোখে নিজের পেটে হাত দিয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আবরার,আমার সন্তান এখানে আছে।আমিও মা হবো,কেউ আর খারাপ কথা বলবেনা আমাকে।কোনো নতুন বাচ্চাকে কোলে নিতে গেলে কেউ অপয়া বলে বাচ্চাকে কেড়ে নিবেনা,না আমাকে বাজা বলবে তাইনা।আমিও সবাইকে বলবো, আমিও মা হয়েছি।তার কচি কচি হাত পা ধরে খেলা করবো,তাকে হাঁটতে শিখাবো,আমাকে মা বলে ডাকবে।”

আবরার ও চোখ মুছে দিয়ে ওর কপালে একটা চুমু দেয় আর ভাবতে থাকে সেই সময়ের কথা যখন আদিবার বেবী হয়।সেদিন শুক্রবার থাকায় সবাই বাসাতেই আছে,ইয়ারাবী বেশির ভাগ সময় ইকরার দুই বাচ্চার সাথেই কাঁটাই।ইকরাও কিছু বলেনা ওকে,ওর মুখের হাসি দেখে বরং সবাই খুশি হয়।সেদিন ইয়ারাবী আহনাফকে কোলে নিয়ে হাঁটছিলো,এমন সময় ওর ফোনে ইতি কল করে বলে আদিবার ক্লিনিকে বেবী হয়েছে,ও যেন এসে দেখে যায়।আবরারের সেদিন শরীর খারাপ থাকায় জারবাকে সাথে নিয়ে হাসপাতালে যায় বেবীকে দেখতে।সেখানে অনেকই উপস্থিত ছিলো,তার মধ্যে মিসেস ইশানিও।ইয়ারাবী কেবিনে ঢুকে দেখে আদিবা বেবীকে কোলে নিয়ে বসে আছে,ওকে দেখেই বেবীকে ওর দিকে এগিয়ে দেয়।তখনি মিসেস জামান বেবীকে কেড়ে নিজের দিকে নিয়ে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“আরে করিস কী তুই?তুই জানিস না বাজাদের কাছে বাচ্চা দিতে দিয়ে।এরা অপয়া হয়,না জানি আমার নাতনির সাথে খারাপ কিছু না হয়।”

ইয়ারাবী কী প্রতিবাদ করবে?কথাটা শুনার সাথে সাথে ওর অস্তিত্ব মনে হচ্ছে মাটিতে মিশে যাচ্ছে, হৃদয় ভেঙে কান্না এসে চোখে জমা হয়েছে।মিসেস ইশানি মেয়ের দিকে তাকিয়ে নিজেকে ঘৃণা করতে থাকেন।কেননা আজ তার জন্য মেয়ের এই পরিস্থিতি।আদিবা আর চুপ করে না থেকে মায়ের হাত থেকে বাচ্চা নিয়ে বলে,
-“মা তুমি কী জীবনে মানুষ হবেনা?তোমাকে এতো শিখিয়েও কোনো লাভ হলোনা।নিজেকে কীভাবে মুসলিম দাবী করো।আল্লাহর কালাম ভুলে গেলে।”
-“চুপ কর হারামজাদি,মায়ের মুখে মুখে তর্ক করিস।হাদিস-কালাম আমাকে শিখাতে আসবিনা, তোর থেকে ভালোই জানি।”
-“ফালতু কথা বলবেনা মা,আল্লাহ বাঁচিয়েছে যে আমার শ্বশুড়বাড়ি কেউ এখানে নেই।তুমি একটা কথাও বলবেনা,নয়তো পল্লবী আপুর মতো আমিও সম্পর্ক শেষ করে দিতে বাধ্য হবো।ইস্মা,আমার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একটু দোয়া করে দিবেনা?মায়ের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে।”

মিসেস জামান মেয়ের হুমকিতে গুটিয়ে যায়, জারবা অবাক হয়ে দেখছে সবাইকে।ইয়ারাবী চোখের পানি মুছে ব্যাগ থেকে একটা আংটি বের করে আদিবার হাতে দিয়ে বলে,
-“আপু,আবরার অসুস্থ তাই যেতে হবে।এই আংটিটা তোমার মেয়েকে দিও,ভয় নেই আংটিটা আমি ছুঁইনি।আবরার উনার এ্যাসিস্টেন্টকে দিয়ে এনে দিয়েছেন,আমি শুধু খাপটা ধরেছি।তোমার মেয়ে পরলে কোনো ক্ষতি হবেনা,আসি আপু।”

সেদিন অনেকটা স্বাভাবিক ভাবে ইয়ারাবী ননদকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসে আর ওকে বারবার বলে এই বিষয়ে আবরারকে কিছু না বলতে।কিন্তু জারবা তো জারবা,ঘরে এসেই সব কথা ভাইকে বলে দেয়।আর আবরারও সবটা শুনে ইয়ারাবীর ওই বাড়ির সাথে যোগাযোগ একেবারে বন্ধ করে দেয়।আসলে সন্তান যাদের নেই তারাই জানে বেদনা কী?

সু সংবাদ পাওয়ার পর থেকে আবার নিজেও খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় কিন্তু আরেকদিন থেকে মনে ভয়গুলো দানা বেঁধে হানা দিচ্ছে।কেননা ইয়ারাবী শরীর বাকীদের মতো সুস্থ নয়, কিন্তু সব আল্লাহর উপর ভরসা করে ছেড়ে দেয়।সেদিন মিকরা ওদেরকে ফিরতে দেয়না,পরবর্তী দিন ওরা বাড়িতে আসে।ইয়ারাবী কিছু খেতে পারছেনা দেখে আবরার নিজে ওর জন্য সকালে রান্না করে নিজ হাতে অল্প হলেও খাইয়ে দেয়।নিজে যত ঝামেলায় থাক ফোন করে কথা বলে সময় দেয়।আর এজেন্সি থেকে মিয়ো নামের এক মেইডকে বাড়িতে সর্বক্ষণের জন্য নিযুক্ত করে।এই সময়ে ইয়ারাবী কম জ্বালায়নি আবরারকে,মাঝে মাঝে আবরারের প্রচুর রাগ উঠলেও কন্ট্রোল করে নেয় নিজেকে।

ইয়ারাবীর কথায় আবরার বাস্তবে ফিরে আসে।ওর দিকে তাকিয়ে দেখে ইয়ারাবী ভেংচি কেটে বলছে,
-“দেখবে সবাই আমার টুইন্স হবে।আচ্ছা ভাইয়া, স্টারপুকে পেয়ে ফিলিংস্ কেমন হচ্ছে তোমার?যাকে ভালোবাসো তাকে পেলে সত্যিই তুমি খুব লাকী,দুই জনেই খুব খুশি।এটা বলো স্টারপুকে কী গিফ্ট দিলে?”
-“গিফ্ট?”
-“হ্যাঁ,তুমি দাওনি।কতবার বলে দিলাম আমি?”
-“ওহ্হ্ হ্যাঁ হ্যাঁ,আসলে দৌঁড় ঝাপে মনে ছিলোনা।কাল সকালে দিবো।”
-“স্টারপু তোমাকে কেন পছন্দ করে তা ভাব্বেনা।পরিবর্তে, কীভাবে তোমাকে আরও বেশি ভালবাসতে শুরু করবে তা শিখতে সময় দিবে, বুঝেছো?তোমাকে কেন বলছি বলতো?তুমিতো সব বুঝো আর তুমিও স্টারপুকে ভালোবাসো।যাকে বলে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা,যার জন্য এসব হওয়ার পরও তুমি স্টারপুর হাত ছাড়োনি।বরং আরো শক্ত করে ধরেছো,আমি সত্যিই গর্ববোধ করি তোমার মতো ভাইয়া পেয়ে।”

কথাটা বলে ইফাজকে হাসিমুখে জড়িয়ে ধরে, ইফাজও কৃত্রিম হাসি দেয় ওকে।তারপর বেশি কিছুক্ষণ কথা বলে আবরার স্ত্রীকে নিয়ে নিজেদের ঘরে চলে আসে।

(২২১)

সব ভালোবাসা পূর্নতা পায়না,কিছু ভালোবাস পূর্নতার স্পর্শ পাওয়ার আগেই দুর্ঘটনায় হারিয়ে যায় গহীনে।আবার কিছু ভালোবাসার কাল হয়ে যায় নিজ পরিবার।ঠিক তেমনি অনু,প্রত্যয়ের সাথে ঘটছে।যদিও অনুর পরিবার মেয়ের বিয়ের সব সমন্ধ পাকা ভাবে করলেও হঠাৎ প্রত্যয়ের পরিবার থেকে তার বাবা বেঁকে বসে।তাই আজ সকালে পত্রিকা পড়তে পড়তে ওর বাবা একটা কথা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-“এমন মেয়েকে আমি ঘরের বৌ করবো না,যে মেয়ে ভালো নয়।”

এই কথা শুনে প্রত্যয় রেগে যায়,ও একজন আর্মি অফিসার আর বরাবরই ওর রাগটা বেশি।তাই ডাইনিং সব কিছু ভাংচুর করতে থাকে।প্রাপ্ত,মা, দাদা-দাদী ওকে অনেক জোর করে আটকার।প্রাপ্ত ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভাই প্লীজ শান্ত হ।”
-“কীসের শান্ত হবো?এই লোকটা কোনোদিন আমাদের ভালো দেখতে পেরেছে?মা মারা যাওয়ার পর থেকে কোনোদিন খোঁজ নিয়েছে আমরা কেমন আছি?আজ যখন একটা সুখের হাতছানি পেতে গেছি তখনি উনার সমস্যা।এতদিন অধিকার ফলাতে না এসে আজ আসছে বলতে মেয়ে ভালোনা।আরে অনু কেমন মেয়ে সেটা আমি জানি।”

প্রত্যয় বাবা রেগে ছেলের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে ধমকে বলে উঠলেন,
-“বেয়াদবির একটা সীমা থাকে প্রত্যয়,ভুলে যেওনা আমি তোমার বাবা।আর এতোদিন ধরে অধিকার দেখাতাম বলেই তোমরা ঠিক ভাবে লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হয়েছো।কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলেছি তোমাদের পিছনে সেটা ভুলে যেওনা।”

প্রত্যয় পাশে থাকা অ্যাকুরিয়ামটা রাগে লাথি মারে, যার ফলে অ্যাকুরিয়ামের কাঁচ ভেঙে ফ্লোরে পরে যায় আর ভিতরের মাছগুলো পানির জন্য ফ্লোরে লাফালাফি করতে থাকে।ফিলা পর্দার পিছন থেকে দৌড়ে এসে ছোট একটা বোলের পানির মধ্যে মাছগুলো উঠিয়ে ঘরে দৌঁড় দেয়।ও এতক্ষণ ধরে সবার কথা কাটাকাটি দেখছিলো,ছোট বলে সবার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো।এত বড় ঝগড়া আগে কখনো ফিলা দেখেনি,আজ বড্ডো ভয় পাচ্ছে মেয়েটা।

মিসেস কিয়ামো স্বামীর সাথে সাথে থাকতে থাকতে এতো বছরে বাংলা ভাষা ভালো ভাবে রপ্ত করেছেন।উনি স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-“তুমি এমন কেন করছো?মেয়েটাকে আমারও মনে দরেছে (ধরেছে),ড্যাড নিজে অানুর বাবাকে কথা দিয়েছে সামনের সপ্তাহে আশীবাদ (আশীর্বাদ) হবে।তাহলে তুমি একন (এখন) রাগ করছো কেন?”
-“কিয়ামো মেয়েটা ভালো নই,যদি ভালো হতো তবে অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক থাকতো না আর সেই সম্পর্কের কথা পুরো রংপুর জানতো না।”

মিসেস কিয়ামো স্বামীর কথা শুনে হেসে বলেন,
-“ছোট বিষয়ে তুমি রাগছো?”
-“তোমার এটা ছোট বিষয় মনে হলো।”
-“ইয়েস,বিকজ্ এটা তো কমন বিষয়।আর এটা নিয়ে রাগ করাটা তোমার ঠিক নয়।”
-“তোমাদের দেশে এসব কমন বিষয় হতে পারে কিন্তু এখানে নয় কিয়ামো।আমাদের সমাজে বসবাস করতে গেলে সব দিক বিবেচনা করতে হয়।”
-“সব দিক বিবেচনা করতে যেয়ে নিজের ছেলের ফিউচার নষ্ট হবেনা?তুমি চাওনা ছেলে হ্যাপি হোক?তুমি আমাকে বলছিলে,তোমাদের কালচারে কোনো মেয়ের বিয়ে ফিক্সড্ হওয়ার পর বেঙে (ভেঙে) গেলে সেই মেয়ের নাম খারাপ হয়।যদি প্রত্যয়ের কোথাও এমন কোনো রিলেশন থাকতো তকন (তখন) কী করতে?”
-“ছেলেদের থাকতেই পারে,এটা সাধারণ ব্যাপার কিয়ামো।তোমার চিন্তা-ধারনা এদেশি মেয়েদের মতো এমন অদ্ভুত হলো কীভাবে?”
-“মেয়ে দেশি হোক বা বিদেশি,একটা মেয়ে ককনো (কখনো) অন্য মেয়ের সম্মান হানি করার পক্ষে নয়।যকনি (যখনি) মেয়েদের অপমান করা হয় তকন (তখন) সেই অপমান একটা মেয়ে নয় গোটা মেয়েকে করা হয়।দেকো (দেখো) পলাশ আমি আনুকে বৌ করতে চাই মানে চাই।”
-“এই বিয়ে সম্ভব নয়,আমি আজই ভেঙে দিবো সে তোমরা যাই বলো।আর প্রত্যয়ের বিয়ে সুরেশের মেয়ের সাথেই হবে।”

প্রত্যয় এতক্ষণ ধরে মাথা ঠান্ডা করে রেখেছিলো, কিন্তু বাবার কথা শুনে তা আর সম্ভব হলোনা।ও চিৎকার করে বলে উঠে,
-“আমি বিয়ে করলে অনুকে করবো,নয়তো কাউকে নয়।আর আপনি কীসের ভালোবাসার মর্ম বোঝেন?যে মুমূর্ষু স্ত্রীকে বাড়িতে একা রেখে বন্ধুদের সাথে মজা করতে যায়,যেই লোক জীবনে টাকা ছাড়া আর কিছুই বুঝলোনা,যেই লোক নিজের টাকার পরিমাপ করে ছেলেকে বলে ভালোবাসা ভুলে যেতে।আপনি ভুলে যাবেন না আমি প্রত্যয়,একজন আর্মি অফিসার।বিয়ে করে বৌকে ভালো খাওয়ানো আর রাখার যথেষ্ট পরিমান টাকা আমারও আছে।”

কথাটা বলে প্রত্যয় বাসা থেকে বের হয়ে যায়,প্রাপ্ত অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু কথা শোনেনা।অন্যদিকে অনু এই মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে তাও মায়ের বকাবকিতে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে কেবল মাত্র সকাল আটটা বাজে, অনেকটা বিরক্ত নিয়ে উঠে বসে।ফ্লোরে স্যান্ডেলের খোঁজে পা রাখতেই নরম কিছুর স্পর্শ পায়, তাকিয়ে দেখে ওর বিড়াল হালুয়া মুখে কালি মেখে বসে আছে।যা দেখে অনুর বুঝতে বাকী রইলোনা তার আদরের বিড়াল মায়ের হাড়িতে আবার মুখ দিয়েছে।অনু হালুয়ার দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,
-“হালুয়া কাল তোকে গোসল দিলাম,ফ্রিতে দুইটা খামছিও খেলাম।আজ আবার মায়ের হাড়িতে মুখ দিয়ে মুখ কালো করে এসেছিস।বলি তোকে কী খারাব দেয়না যে চুরি করিস।ওদিকে মা যদি টের পায় লঙ্কা-কান্ড বাঁধিয়ে দিবে।”

হালুয়া অনুর কথা শুনে ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।ওর চাহনি দেখে মনে হচ্ছে ওর মতো ভদ্র আর একটাও নেই।অনু হালুয়াকে কোলে তুলে কিছু বলতেই যাবে ঠিক তখনি প্রত্যয়ের নাম্বার থেকে কল আসে।অনু মুচকি হাসি দিয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পায়।অনু অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বলে,
-“কী হয়েছে প্রত্যয়,তুমি এমন করছো কেন?ঠিক আছো তো তুমি?”

প্রত্যয় নিজেকে সামলে বলে,
-“কিছু ঠিক নেই অনু,সবটা এলোমেলো হয়ে গেছে।”
-“আরে কী হয়েছে সেটা বলবে তো?”

অনু অনেকটা চিন্তিত হয়ে কথাটা বলে উঠতেই প্রত্যয় সকালের ঘটনাটা খুলে বলে।অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে,ওর মনে হয়েছিলো এমন কিছু হতে পারে।অনু হালুয়াকে বিছানায় রেখে বেলকনিতে যেয়ে বলে উঠে,
-“এবার কী করবে?”
-“মানে?দেখ আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো আর সেটা হবেও।আমার পুরো পরিবার তোমাকে চাই,শুধু ওই ব্যাক্তি…”
-“প্রত্যয় সম্মান দিয়ে কথা বলো।মানো আর না মানো উনি তোমার জন্মদাতা পিতা।হ্যাঁ,উনি তোমাদের সাথে যা করেছেন সেটা ঠিক করেননি।তবে উনি ছিলেন বলেই তোমরা প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছো।যখন বাবা থাকবেনা তখন বুঝবে বাবার কী মর্ম ছিলো জীবনে।”

প্রত্যয়ের এসব কথা শুনে রাগ উঠে যায়।কেননা যে ব্যাক্তির জন্য আজ ওদের বিয়ে ভাঙতে চলেছে আর ও সেই ব্যাক্তির হয়েই সাফাই গাইছে।তবুও রাগকে কন্ট্রোল করে বলে,
-“রহমত আলী কে?”

অনু অনেকটা অবাক হয়ে বলে,
-“কেন?”
-“যেটা জানতে চাইছি সেটা বলো?”
-“আমাদের প্রতিবেশি,বাবার সাথে পুকুর পাড়ের জমি নিয়ে কিছু ঝামেলা চলছে।তুমি চিনলে কোথার থেকে?”
-“আমি চিনিনা বলেই শুনলাম।ওই ব্যাক্তির যত নাটের গোরা।বাবা উনার বোনকে তোমার ব্যাপারে খোঁজ নিতে বললে পিসি তোমাদের আশেপাশে যেয়ে খোঁজ নেন।তখন রহমত আলী আর উনার স্ত্রী সেই পুরানো বিষয় নিয়ে কথাটা বলে উঠেন।”
-“তোমার বাবা তো মানতে চাইবেনা,এখন কী হবে?”
-“বাবা ছাড়া পুরো পরিবার তোমাকে মেনে নিয়েছ।বিয়ের পর উনিও কিছু বলতে পারবেনা।”

অনু বাম হাত দিয়ে চোখের পানি মুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-“তোমার বাবার পরিচিত মেয়েকে বিয়ে করে নাও, আঙ্কেল কোনোদিন আমাকে মেনে নিবেনা প্রত্যয়।”
-“পাগল হয়ে গেছো তুমি,কী বলছো এসব?”
-“যা সত্য সেটাই বলছি,যদি উনার অমতে বিয়ে করি তবে সারাজীবন আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ বয়ে আসবে।জানো দিগন্ত শেষ বার একটা ম্যাসেজ দিয়েছিলো,আর সেই ম্যাসেজে ছিলো “কিছু কিছু ভালোবাসা অপূর্ন থেকে যায়।”প্রত্যয় কল্পনার মতো করে বাস্তবটা কেন সুন্দর হয় না বলতে পারো?হয়তো আমার ভাগ্য তুমি নেই, ভগবান মনে হয় আমাদের এক করতে চান না।আমি বাবাকে বলে….”

প্রত্যয় না পেরে একটা ধমক দিয়ে বলে,
-“চুপ!নিজেকে কী মহাজ্ঞানী মনে করো।”
-“সেটা ভাবা আমার সাজেনা।তবে একটা জিনিস চিন্তা হচ্ছে খুব।আগের বারও আমার জন্য বাবা-মা অনেক কষ্ট,অপমান সহ্য করেছিলো আর এবারও তাই হবে।প্রথমবার ধোঁকা খেয়ে আমি নাই শক্ত হয়ে গেছি কিন্তু….”
-“অনু চুপ করবে তুমি,দেখবে আমরা একসাথে থাকবো।একটা বিয়ে ভাঙা এতোটাই সোজা নাকী?উনি যতই না করুক,দাদা যেখানে হ্যাঁ বলে সেটা হ্যাঁতেই থাকে।তাই তোমার পরিবারকে এসব কিছু বলতে যাবেনা।আমি সবটা জেনেই সম্পর্কে এগিয়েছি অনু,যেখানে আমার সমস্যা নেই যেখানে উনার কী?
-“তুমি সবকিছু জেনেও আমাকে ভালোবাসলে কেন?প্রশ্ন করলে সর্বদা নিশ্চুপ থাকো।”
-“হুমায়ূন আহমেদ একটা বলেছেন,কথাটা কী জানো?উনি বলেছিলেন-প্রেম হয় শুধু দেখা ও চোখের ভাল লাগা থেকে, রাগ থেকে প্রেম হয়, ঘৃণা থেকে প্রেম হয়, প্রেম হয় অপমান থেকে, এমনকি প্রেম হয় লজ্জা থেকেও। প্রেম আসলে লুকিয়ে আছে মানবসম্প্রদায়ের প্রতিটি ক্রোমসমে। একটু সুযোগ পেলেই সে জেগে উঠে।আচ্ছা তুমি কী ঢাকাতে?”

অনু নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,
-“না,রংপুর চলে এসেছি কাল তো বলেছিলাম।”
-“আজ বৌ ভাতে তাহলে দেখা হবেনা।”
-“না গো,আমার অবস্থা খুব কাহিল।তাছাড়া এক সপ্তাহ পরে আমাদের আশীর্বাদ ছিলো তাই বাবা একবারে এখানে এসেছে।কিন্ত কে জানতো যে ভাগ্যে…..”
-“দোহায় লাগে চুপ করো,যেদিন আশীর্বাদের কথা হয়েছিলো সেদিনই হবে।চিন্তা করোনা,আমি সব ঠিক তরে দিবো।আসলে মনটা ভারী লাগছিলো তাই তোমার সাথে বললাম,রাখছি এখন।”

কথাটা বলেই প্রত্যয় ফোনটা কেঁটে দিয়ে ভাবতে থাকে সবকিছু কীভাবে ঠিক করবে সে।কারণ ওর বাবা যেভাবে বেঁকে বসেছে তাতে সহজে উনি বিয়ে হতে দিবেন না।কিছু মাথায় আসছেনা প্রত্যয়ের নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে।অন্যদিকে অনু নিঃশব্দে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কান্না করছে।হঠাৎ মায়ের ডাকে চোখ মুছে বাইরে বের হয়ে দেখে ওর বাবা ভ্যানে করে প্রচুর শুকনা বাজারসহ মাছ,মাংস এনেছেন।অনুর বাবা ভ্যান থেকে নেমে অনুর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে,
-“দেখতো মা,তোর মা যা যা বলেছিলো তার সব আনা হয়েছে নাকী?একটা কিছু কম পরলে বাড়িকে কুরুক্ষেত্র বানাবে।”
-“বাবা পাগলে হলে নাকী?আশীর্বাদ এক সপ্তাহ পরে আর তুমি…..”
-“আরে একমাত্র মেয়ের আশীর্বাদ বলে কথা।যেসব নিন্দুকেরা আমার মাকে কথা শুনিয়েছিলো তাদের দেখাতে হবেনা।”

অনু প্রতিত্তুরে আর কিছু বলেনা,শুধু নিরবে চেয়ে থাকে বাবার দিকে।ওর মাও অনেক হাসি মুখ করে লিস্ট দেখে দেখে কাজের মেয়েকে দিয়ে ঘরে জিনিস তুলছে।একবার অনুর মনে হয়েছিলো সবটা জানিয়ে দিবে কিন্তু সবাই খুশি দেখে সেটা আর করতে পারলোনা।মনে প্রাণে নিজের ভগবানের কাছে এটাই প্রার্থনা করছে যেন সব ঠিক হয়ে যায়।

(২২২)

রোজ সাথির সাথে খুব সকালে নাস্তার টেবিল সাজাচ্ছে।হঠাৎ করে ওর চোখ যায় ফলের ঝুড়ির উপরে,সেখানের বেশির ভাগ কলাই জমজ।রোজ ঝুড়িটা হাতে নিয়ে ফরিদ চাচাকে ডেকে বলে,
-“চাচা কলাতো ভালো এনেছো,তবে বাজারে জুমকা কলা ছাড়া কী আর পাওনি?”
-“আমারে কেন বলছো বৌ?মা আমারে যা আনতে বলেছে তাই এনেছি।তুমি জানো কত কষ্ট করছি, বাজারে কী এতো সহজে পাওয়া যায়?তিন-চার ফলের দোকান থেকে এনেছি।”

রোজ অবাক চোখে সোফায় বসা ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে দেখে ওদের কথা শুনে মিটমিট করে হাসছে আর আইসক্রিম খাচ্ছে মেয়েটা।রোজ মৃদু হেসে ওর কাছে যেয়ে বলে,
-“তো ননদিনী,জমজ কলা খেলে জমজ বাচ্চা হয় নাকী?”
-“জানিনা,তবে খেতে তো সমস্যা নেই।”
-“পাগলি,সব সময় আইসক্রিম কেন খাও?এটা রাখো,এখন নাস্তা করবে।তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা অথচ শরীরের এই অবস্থা।”

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here