জীবন মানে তুমি পর্ব-৫৯

0
3671

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৫৯

(২০৪)

আসরের আযানের পর ইয়ারাবী ঘর থেকে বের হয়ে নিচে নামতেই দেখে আবরার ওর ভাইদের সাথে নামায শেষে ফিরে সোফায় বসে গল্প করছে।ও ওদের বিরক্ত না করে কিচেনের দিকে যেয়ে দেখে ওর মা আর মিনা মিলে ইফতার বানানোর আয়োজন করছে।সামনের বড় জানালা দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় জারবা আর ইয়ামিলা মিলে খরগোশ আর বিড়াল নিয়ে খেলছে।ওদের মুখের হাসি দেখে বোঝা যাচ্ছে কতটা আনন্দ করছে ওরা।কিন্তু ও যখন ইয়ামিলার বয়সে ছিলো তখন আনন্দ কী জিনিস সেটা আদেও বুঝতো না, আসলে সুখ কোনোদিন উপলব্ধিই করতে পারেনি।ওর জীবনে আনন্দের প্রতিটা মুহুর্তের জিনিসগুলো বাবা-মা বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।যার জন্য রাতের অন্ধকার চোখের জলে বালিশ ভিজাতো।আবরার আশার পর অন্ততপক্ষে রাতে চোখের জলে বালিশ ভিজাতে হয়না।আসলে ইয়ামিলার মতো ওর বাবা-মায়ের সাথে বন্ধুর সম্পর্ক ছিলোনা,ছিলো কাঁচের মতো সম্পর্ক।যা হাজার বার উনারা নিজ হাতে ভেঙে অজস্র টুকরো করতেন কিন্তু জোরা লাগাতেন না।অতীতের জীবন ওর জন্য এক বিভিষিকাময় অধ্যায়।কিচেনের দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ইয়ামিলার দিকে তাকিয়ে নানা কথা ভাবছিলো ইয়ারাবী,ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে প্রহরগুলো।

-“ও আপা,খালাম্মা ডাকছে শুনতাছেন না।বলছি দোলাভাই ইফাতারিতে কী খায়?”
হঠাৎ মিনার ডাকে ওর ধ্যান ভাঙে,কথাটা শুনে ইয়ারাবী একবার ওর মায়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মিনাকে উদ্দ্যেশ করে বলে,
-“বাসায় রুহ্ আফজা আছে?”
-“না,কাল শেষ হয়ে গেছে,তুই তো খাসনা।তুই আসবি শুনে তোর আব্বু ট্যাং নিয়ে এসেছে।”

মিসেস ইশানি মেয়ের দিকে তাকিয়ে গ্যাসের উপর পাতিলে দুধ চড়িয়ে কথাটা বলেন।ইয়ারাবী ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে দুই ঢোক খেয়ে মিনাকে বলে,
-“মিনা,ছোট ভাইয়াকে যেয়ে বল রুহ্ আফজা আনতে।তোর দোলাভাই ইফতারের সময় খায়।”

মিসেস ইশানি মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন, কতটা জেদী মেয়ে তার।হয়তো ভুল করেই ফেলেছ তাই বলে কী মাফ করা যায়,উনি বুঝলেন মেয়ের তার সাথে কথা বলবেন না।তাই উনি আর কথা বাড়ান না,চুপ করে কাজ করতে থাকেন।মিনা বাসন ধুঁতে ধুঁতে বলেন,
-“আর কী বানামু আপা?”
-“উমম,পায়েশ আর সেমাই কর।উনি মিষ্টি খুব খায়,তবে শরবতে খায়না,আর ছোলার বুট সিদ্ধ কর,ফালুদা,টুনা কাবাব,দই,খেজুর,ফল, জিলাপিএগুলো করলেই হবে।আর শোন একটু হালিম করিস,মেজ ভাইয়া তো এটা খায় আর জারবার তো সব সময় লাগবে।”

মিনা অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে গালে হাত দিয়ে বলে,
-“হায় আল্লাহ!সব সময় শুনছি,মেয়েদের বিয়ের পর অভ্যাস বদলায় যায়,এহন দেখতাছিও।”
-“মানে?”
-“মানে হইলো আপনি মিষ্টিই খাননা,আর ওই বাড়িতে তো মনে হয় ভাজাপুরা হয়না।কারন দোলাভায়ের খাওয়া শুনাই বুঝলাম।”

ইয়ারাবী মিনার মাথায় একটা হালকা চাটি মেরে বলে,
-“গাধী?তোকে কে বললো হয়না।হয় তবে উনি রোজ এইগুলোই খায়,তেলের জিনিস কিছুটা কম খায় বুঝলি।”
-“হ বুঝছি।আপনার জন্য কী করমু?”
-“মাংসের কোফতা কারি করিস,অনেকদিন খায়না।”

ইয়ারাবী কথাটা বলে বাইরের দিকে পা বাড়াবে ঠিক তখনি মিনা বলে উঠে,
-“আর রাতে কী রানমু আপা?খালাম্মা বললো আপনার কাছে শুনতে?”

ইয়ারাবী পিছন ফিরে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“চিকেন দম বিরিয়ানি,মাটন কোরমা আর বিহারি কাবাব করিস মিনা।আর শোন বড় চিংড়ি থাকলে একটু ভেজে দিস।”

হেসে কথাগুলো বলে কিচেন বের হয়ে যেতেই মিসেস ইশানি মাথায় হাত দিয়ে ঢুলে বসে পরেন।মিনা উনার দিকে আতঙ্ক গলায় তাকিয়ে বলেন,
-“খালাম্মা আপনার খারাপ লাগতাছে?”

উনি একরাশ বিরক্ত নিয়ে মিনার দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“ধুর!খারাপ কেন লাগবে?আমি তো মেয়ের কান্ড দেখে হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছিনা।”
-“কেন আপা আবার কী করলো?”
-“তুই বুঝিসনি?ও ভালো করে জানে তুই এসব বানাতে পারিসনা,ও তোকে দিয়ে ইনডাইরেক্টলি আমাকে করতে বললো।তবুও নিজে মুখ ফুটে বললোনা আম্মুনি এটা করতে হবে বা করে দাও।ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে একটা।দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি কাজে হাত লাগা,তার আগে ওর বাপকে যেয়ে বল,রুহ্ আফজা আনতে।”

মিনা রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে চলে যায় মিসেস ফুয়াদকে কথাটা বলতে।ইয়ারাবী ডাইনিং এসে একবার চারজনের দিকে চোখ বুলিয়ে সামনের সোফায় বাবু হয়ে বসে টিভি ছেড়ে রিমোটটা ঠাস্ করে টেবিলে রাখে।শব্দে সবাই ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিজেদের কাজে মনোযোগ দেয়।এটা দেখে ইয়ারাবী মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।তাই একপা নিচে নামিয়ে সোফার সাথে গুতা দিয়ে জোরে জোরে শব্দ করছে যাতে কেউ একটু হলেও ওর দিকে নজর দেয়।কিন্তু কেউ একটু তাকাচ্ছেনা পর্যন্ত,ওর মা রান্নাঘর থেকে মেয়ের কান্ড দেখছে আর হাসছে।আবরার তো ভাইদের সাথে মনে হয় দুনিয়ার যতগল্প আছে সব করছে,ভাবখানা এমন এগুলো না করলে পুরো পৃথিবী উল্টো যাবে।

ইমন এবার ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে জোরে একটা ধমক দিয়ে বলে,
-“বান্দরের মতো লাফাচ্ছিস কেন?চুপ কর বসে টিভি দেখ নয়তো বাইরে যেয়ে খেলা কর ওদের সাথে।”
-“ওই আমি বাচ্চা নাকী যে হাড়ি-পাতিল খেলবো।আমি লাফাই না বসি সেটা তোমাদের না দেখলেও চলবে।নিজেদের চরকায় তেল দাও,হু বড় আসছে আমারে ধমকাতে।”

এখন ইয়ারাবী কাঁদছে ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কিন্তু পারছেনা।এর মধ্যে মিনি দৌঁড়ে বাসার ভিতর ঢুকে ইয়ারাবীর পায়ের কাছে এসে মুখ ঘষতে থাকে।ও মিনিকে কোলে তুলে নিয়ে আড়চোখে সবার দিকে তাকিয়ে গাঁয়ে হাত বুলিয়ে বলতে থাকে,
-“জানিস মিনি,এখানে কতগুলো বদলোক আছে।ভুলেও তাদের কাছে যাবিনা বুঝলি।ওইযে গ্রামের ভাষায় গায়ে বাতাস লাগা বলেনা সেটাই তোর লেগে যাবে।”

মিনি কী বুঝলো কে জানে?চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে মিউ আওয়াজ তুলে।ইরাক ওর কান টেনে বলে,
-“অনেকক্ষণ ধরে তোর ড্রামা দেখছি।”
-“আহহ ভাইয়া,কান ছাড়ো।আর আমি ড্রামা করি,এটা বলতে পারলো ভাইয়া?দেখলি মিনি আজ এটাও দেখতে হলো,আসলে অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়।”

অনেকটা কাঁদো কাঁদো সুরে মিনির দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো।আর বলবে নাই বা কেন?আজ যে একটা বিশেষ দিন?এই দিনে ওর বাবা-মা কিছু না করলেও হাতে গুনা কয়েকজনের কাছ থেকে কিছু আশা করে থাকে।কিন্তু আজ সবার কী হয়েছে বুঝতে পারছেনা,এসে ধরে অন্য রকম পরিবেশ দেখছে।তার উপর ওর বন্ধুদের মধ্যে কেউ ওকে একটা ম্যাসেজ বা কল করেনি,কেউ না করলেও অনুতো করতে পারতো।

ইরাক ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
-“বলবি তো কী হয়েছে?”
-“কিছু হয়নি?কী হবে?যার হয়েছে তার কাছে যাও তোমরা।”

অনেকটা রেগে কথা বলে উঠে,ইরাক ঠোঁট চেপে হাসতে থাকে।আরবার এবার ওর দিকে কিছুটা বিরক্তভাবে তাকিয়ে বলে,
-“তোমাকে জোরে কথা বলতে নিষেধ করেছিনা?আর এটা কেমন ব্যবহার বড় ভাইয়ের সাথে?”
-“আবরার তুই আমার সামনে বসে আমার বোনকে ধমক দিচ্ছিস?”

ইয়ারাবী মিনিকে সুন্দর করে কোলে নিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
-“এটা তো কিছু না,এর থেকেও বড় বড় ধমক দেয় তোমার ফ্রেন্ড।”
-“বাহ্ ভাই,এতক্ষণ দেখলাম তুমি ইরাককে ছেড়ে কথা বলছিলেনা আর এখন এত মিল।”
-“তো আপনার কী?”
-“আবার?”

আবরার চোখ গরম করে ওর দিকে তাকাতে ও বিরক্ত নিয়ে মিনিকে নিয়ে নিজের ঘরে দিকে বকবক করতে করতে চলে যায়।ও চলে যেতেই চারজনে একসাথে হেসে ফেলে,অনেক কষ্টে হাসি আটকে রেখেছিলো।ইমন হাসি থামিয়ে বলে,
-“ভাইয়া রমজানের মধ্যে,এমন অভিনয় করা কী ঠিক হলো?”

ইফাজ ওকে থামিয়ে বলে উঠে,
-“লাস্ট সাত বছর আগে করা হয়েছিলো।আর তুই জানিস ওর এসব পছন্দ নয়।আসলে রেগে আছে যে কারণে তাহলো আমরা এখনো কেউ ওকে শুভেচ্ছা জানায়নি আর না কিছু দিয়েছি প্রতিবারের মতো।”
-“কিন্তু রাতে অনুর উপরে যে ঝড়টা যাবে সেটাই ভেবে চিন্তা হচ্ছে।”
-“আবরার সবটা তোর দোষ,বেচারী শুধু শুধু ফেঁসে গেলো।”

-“কে ফাঁসছে ভাইয়া?”
কথাটা বলতে বলতে জারবা সোফায় ইনিকে নিয়ে বসলো।এদিকে ইয়ামিলা খরগোশ নিয়ে দৌঁড়ে রান্নাঘরে চলে যায় কী বানানো হয়েছে তাই দেখতে।মেয়েটা এই প্রথম রোযা রাখছে,আজ ওর পনের তম রোযা।থাকতে কষ্ট হয়,তবুও জোর করে রাখে।

আবরার বোনের চুল টেনে বলে,
-“তোকে বললে তুই তোর ছোট ভাবীকে জানিয়ে দিবি।তাই তোকে বলা যাবেনা।”
-“তুমি সব সময় এমন করো,আর চুল ছাড়ো।”
-“মাথা এতো গরম কেন?রোদে বসে ছিলি দু’জনে, একটা কথাও শুনিসনা তোরা।”
-“কী বলো তুমি?গরমের সময় তো গরম লাগবেই।আচ্ছা মিনি কই?”
-“তোর ভাবীর কাছে আছে।”

(২০৫)

যথারীতি সন্ধ্যার সময় সবাই ইফতার করতে বসে।ইয়ারাবী কারোর সাথে কথা বলছেনা শুধু জারবা ছাড়া,তাও হ্যাঁ,হু উত্তরে।ইফতারের পর সবাই মাগরিবের নামায আদায় করে,টুকিটাকি কথা বলছে।ওর মা আর মিনা রান্না করছে,জারবাতো ইয়ামিলার সাথে এসে ধরে খেলা করছে।ইয়ারাবী নিজের ঘর থেকে বের হয় তিন-চারবার ডাইনিংএর চক্কর কেঁটেছে,কিন্তু কেউ একবার ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি।এবার না পেরে ইফাজের পাশে আদুরি চেহারা বানিয়ে বলে,
-“ভাইয়া,তোমরা আজ কিছু ভুলে যাওনি তো?”

ইফাজ একটা টুনা কাবারের অর্ধেকটা মুখে দিয়ে তৃপ্তি সহকারে শেষ করে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
-“কী ভুলে গেছি?”
-“বারে ওইটাতো ভুলেই গেছো।”
-“ওইটা কোনটা?”
-“আরে ভাইয়া!আচ্ছা বলোতো আজ কী?”
-“পনের রোযা আবার কী হবে?”
-“ধুর ধুর….”

ইয়ারাবী মুখ ফুলিয়ে ফোন চেক করতে থাকে,কিন্তু আফসোস না কোনো ম্যাসেজ না কোনো ফোন কলস্।কিছুক্ষণ পর এশার আযান দিয়ে দেয়, যেহেতু মসজিদ পাশে রমজান মাস তাই ওরা সবাই মসজিদের উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেই।আবরার নিজের ফোনটা পকেট থেকে বের করে ওর হাতে দিয়ে বলে,
-“কেউ কল করলে রিসিব করবে আর ছাদে কিন্তু একা যাবেনা।ঘরে একা থাকার দরকার নেই, আম্মুর কাছে যাও।”
-“আমি…”
-“কোনো কথা নয়,এই বিষয়ে বাসা থেকে আমাদের কথা হয়েছিলো মনে নেই।”

কী আর করবে ইয়ারাবী?তাই চুপ হয়ে যায়।সবাই নামায পড়তে চলে গেলে ও নিজের ঘরে যেয়ে একটু কাত হয়ে শুয়ে চোখটা বন্ধ করে।বাড়িটা বেশ নিরিবিলি লাগছে এখন,মনে হচ্ছে ও ছাড়া আর কেউ নেই বাড়িতে।আসলে ওরা চলে যাওয়ার পর বাড়ির মেয়েরাও নামাযে দাঁড়িয়েছে।কানে হেডফোন লাগিয়ে সূরা-ইয়াসীন শুনছে তবে বেশ ভয় ভয়ও করছে।গত কয়েকদিনের কথাগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।ও ফোনটা অফ করে দ্রুত ইয়ামিলার ঘরে যেয়ে দেখে সবাই নামায আদায় করছে।মিসেস ইশানি সালাম ফিরিয়ে মেয়েকে দেখে বুঝতে পারেন ওর মনের অবস্থা, তাই কিছু দোয়া পড়ে ওর মাথায় হাত রেখে ফুঁ দেয়।কিন্তু ইয়ারাবীর কাছে এটা এক ধরনের ন্যাকামি ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে।হয়তো ওর মা বুঝতে পেরেছে তাই বলে উঠলেন,
-“জানি আমাকে সহ্য হচ্ছেনা তোর,এসব ন্যাকামি মনে হচ্ছে।হওয়াটাই স্বাভাবিক,তবে একটা কথা শোন,যতক্ষণ পর্যন্ত নামায শেষ না হচ্ছে এখানে শুয়ে থাক।বলাতো যায়না,কখন কী হয়?”

নামায শেষে সবাই ঘরে ফিরে এলো,ইয়ামিলা মায়ের আঁচল ধরে বলে,
-“আম্মু,খাবার দাও সবাই চলে এসেছে।”
-“হ্যাঁ,হ্যাঁ দিচ্ছি।তোরা সবাই বস,আমি খাবার বাড়ছি।”

আবরার ঘরে ফ্রেস হয়ে এসে সোফায় বসে এক দৃষ্টিতে ইয়ারাবীকে দেখছে,আর ইয়ারাবী বিছানায় বসে ইনিকে নিয়ে গল্প শুনাচ্ছে।এবার ও কিছুটা খুকখুক করে কেশে বলে উঠে,
-“সারাদিন বিড়াল নিয়ে পরে না থেকে বরকেও একটু সময় দাও।”
-“এরা বিড়াল নয়,এদের নাম ইনি-মিনি।দেখলি ইনি তোদের বাবা কত পঁচা?”
-“আজকাল না বড্ডো বেশি বোঝো,মেডিসিন নিছো।”
-“হ্যাঁ….”
-“ইনিকে রেখে চলো খাবে।”

ইয়ারাবী ভদ্র মেয়ের মতো আবরারের সাথে নিচে নামতেই অবাক হয়ে যায়।কেননা ওদের বাসায় বড়।সোফাটায় অনু বসে আছে,ওকে আসতে দেখেই দৌঁড়ে জড়িয়ে ধরে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়,আর বাকী সবাইও।সবার মুখে হাসি লেগে আছে আর হাতে একটা করে গিফট্।ইরাক ওর মাথায় চুমু দিয়ে বলে,
-“বারোটা বাজার আগেই শুভেচ্ছা জানিয়েছি।”

ওর অবাক চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমাদের মনে ছিলো?”
-“না থাকার কী আছে?বর্তমান সমাজের মুসলিমদের একটি অসাধারন বৈশিষ্ট হলো ইসলামবিরোধী রীতি বা অনুষ্ঠানগুলো না বুঝে পালন করা,কিন্তু তোর সেটা কখনই পছন্দ ছিলো।কেক কাঁটা তোর পছন্দ না হলেও কিন্তু জন্মদিনের গিফট্ ঠিকই আদায় করে নিস।”
-“আমার জন্মগত অধিকার এটা।আচ্ছা তোমাদের মনে থাকলে আমাকে আগে বলোনি কেন?”

ইমন পিছন থেকে চুল টেনে বলে,
-“যদি আগে বলতাম তাহলে উনিশ বছরের ফড়িংকে বিকাল থেকে পাগলামি করতে দেখতে পেতাম।”
অনু হেসে বলে উঠে,
-“সব জিজুর প্লান মতো,তাই কাল রাতে তোকে কোনো উইশ করেনি।”
-“পঁচা,কী আছে এর ভিতরে?”
-“তোর পছন্দের জিনিস।”

মি.ফুয়াদ মেয়ের মাথায় হাত রেখে একটা চেন দিলে ও কিছু বলতে গেলেই আবরার পাশ থেকে ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“অনেক হয়েছে ইয়ারাবী,স্বয়ং আল্লাহ সমুদ্রের ফেনা সমান পাপীবান্দা কে ক্ষমা করে দেন তার কাছে ক্ষমা চাইলে।আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আর মন্দের প্রতিফল মন্দ। অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপস নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না। ’ (সুরা শুরা, আয়াত: ৪০)।এছাড়াও পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,’অতপর তারা যদি নিরস্ত হয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সূরা: বাকারাহ, আয়াত: ১৯২)।আরেকটা আয়াতে বলা হয়েছে,‘আর যারা মন্দ কাজ করে ফেলে তারপর তাওবা করে নেয় ও ঈমান আনে, তোমার প্রতিপালক সেই তাওবার পর (তাদের পক্ষে) অতি ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।'(সূরা: আরাফ, আয়াত: ১৫৩)।আর তুমি তার বান্দা হয়ে ক্ষমা করতে পারবেনা।এনারা তোমার জন্মদাতা, এমনটা নয় যে শুরু থেকে তোমাকে ঘৃণা করতো।তোমাকে কী বুঝিয়েছি বাসায়?তুমিতো জানো এখন সবটা।”

ইয়ারাবী একটা তাছ্যিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
-“আপনি কত সহজে কথাগুলো বলে দিলেন,হ্যাঁ ক্ষমা মহৎ গুন,কিন্তু এনারা যা করেছে আমার জায়গায় আপনি হলে মন থেকে কোনদিন পারতেন না ক্ষমা করতে।”
-“ইয়ারাবী!”

মিসেস ইশানি মেয়ের সামনে এসে হাত জোর করে বলেন,
-“দেখ তোর বাবা আর আমি যা করেছি সেটা অন্যায়।তবুও তোর সামনে হাত জোর করছি দয়া করে আমাদের ক্ষমা করে দে।তোর এই ইগনোর আমরা কেউ সহ্য করতে পারছিনা।কত বছর ধরে আদুরে “আম্মুনি” ডাকটা শুনতে পারিনা,তোর বাবাকে তো আব্বু বলে ডাকিসনা আর।প্রয়োজন হলে তোর পায়ে ধরবো তবুও…..”

ইয়ারাবী এবার চিৎকার করে সরে যেয়ে বলে,
-“ইহকালকে কম নরকে পরিনত করেননি আমার জীবনটা,তাই পরকালটাও শেষ করতে চাইছেন।মা হয়ে সন্তানের পায়ে হাত দেওয়া,সেই সন্তানের জন্য কত বড় গুনাহ্ সেটা নিশ্চয়ই জানেন।চিৎকার করে বললেও সত্যটা পাল্টাবেনা,কেননা আপনারা আমার জন্মদাতা বাবা-মা।তবে এটাও ঠিক ক্ষমা করে দিয়েছি,কেননা যেখান আল্লাহর কাছে মাফ চাইলে তিনি ক্ষমা করে দেন সেখানে তো আমি তার বান্দা।কিন্তু কোনোদিন মন থেকে সেই সম্মান-ভালোবাসাটা আসবেনা আপনাদের জন্য যেটা ছয়-সাত বছর বয়সে ছিলো।”মা” এমন একটা শব্দ যা অন্তরের সাথে মিশে থাকে,পুরো দুনিয়া সন্তানের বিপক্ষে গেলেও মা কোনোদিন জায়না।আর “বাবা” মানে জীবনের প্রথম হিরো, এক ভরসার হাত।কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কী সেটা আদেও ছিলো?আচ্ছা বলুন তো,রাতে কেন চিৎকার করে কাঁদতাম?প্রতিটা রাতে কী আমি আদেও ঘুমাতে পারতাম,জানতে চেয়েছেন কখনো?জীবনের আনন্দের শেষ হাসিটা কবে হেসেছি?আমার কীসে সমস্যা?আমার কী প্রিয়?কী করতে ভালোবাসি?আছে উত্তর আপনাদের কাছে।অভিনয় করে হাসা যায়, চোখের পানি লুকানো যায় তবে ভালো থাকা যায়না।যখন শুনলেন খালামনির কাছ থেকে আমি ডিপ্রেশন আছি,তখন আপনার বড় বোন বলল,আমি নাকী প্রেম করে বেড়াই তার জন্য।আর আপনারাও সেটা বিশ্বাস করলেন,আসলে কী জানেন ডিপ্রেশন শুধু প্রেম সংঘটিত কারণে হয়না কখনো কখনো পরিবারের কারণে হয়ে থাকে।”

এইটুকু বলে ইয়ারাবী থেমে যায়,চোখের পানি মুছে আমার বলতে শুরু করে,
-“আপনার মনে আছে,ছয় বছর বয়সে নিজের পরিবারের জন্য ঈদের কাপড় কিনলেও আমার জন্য নাকী আপনাদের টাকা ছিলোনা।কিন্তু যখন আপনার ভাইয়ের মেয়েরা কাপড় চাইলো তখন আপনার কাছে গায়েবি ভাবে টাকা চলে এলো, কতটা হাস্যকর বিষয় তাইনা?নিজের ছোট বাচ্চা আপনার হাতে খেতে চেয়েছিলো বলে ধাক্কা দিয়ে সিড়িতে ফেলে দিয়েছিলেন,কাপড় পুরে গেছিলো বলে গরম স্ত্রি দিয়ে ছ্যাকা দিয়েছিলেন,আপনার ছোট মেয়েকে আপনার ভাইয়ের বৌ ফেলে দিয়েছিলো কিন্তু আপনার স্বামী বটি দিয়ে আমাকে কোপ মেরেছিলো।কয়েকজন তাদের লোলুপ দৃষ্টি আমার দিকে ছুড়ে মলেস্ট করার চেষ্টা করেছিলো সেই বয়সে যখন আমি বুঝতাম না এসবের মানে কী?কিন্তু আপনারা তাদের কিছু না বলে মেয়েকে মেরেছিলেন।।আপনার বড় মেয়ের খুনিকে না খুঁজে আমাকে মেরেছিলেন,পুরো একটা বছর মানসিক ভাবে আহত ছিলাম তখন না আপনি এসেছিলেন না আপনার স্বামী।বাইরে পড়তে যেতে চেয়েছিলাম বলে কাগজ ছিড়ে ফেলেছিলেন,আর কী বলবো, এমনতো হাজারটা অপরাধ আছে আপনাদের।মা-বাবা মানে কী সেটা অর্থ কোনোদিন খুঁজেই পায়নি,তবে আমার একটাই মা আর সে এখন মৃত আর বাবা সে বর্তমানে কোনো নৌপথে।তাই মন থেকে কোনোদিন শ্রদ্ধা আপনাদের জন্য আসবেনা।”

(২০৬)

বেলকনিতে বসে একটা ছবির দিকে একধ্যানে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছে ইয়ারাবী।মানুষের জীবনে কী থেকে কী হয়ে যায় কেউ বুঝতে পারেনা।কারো জীবন সুখেই ছোঁয়ায় ভাসে আবার কারো জীবন ভরে কষ্ট নিয়ে কাঁদতে হয়।জীবনটা কত অদ্ভুত তাইনা।দেখতে দেখতে তিন মাস পার হয়ে গেছে।আর এই তিনমাসে অনেক কিছু বদলে গেছে,যা হওয়াটা আদেও সঠিক ছিলোনা কারোর জন্য।

বর্তমানে ইয়ারাবীর এখন লন্ডনে আছে,রোযার পরে আসার কথা থাকলেও কুরবানির পরে আসতে হয়েছে দুর্ঘটনার জন্য।কেননা রমযানের ঈদ যেমন বাকীদের কাছে খুশির ছিলো তেমন ছিলো ওদের পরিবারের কাছে কষ্টের।ইয়ারাবী এবার প্রথমবারের ঈদ শ্বশুড়বাড়িতেই করবে,রাতে সবাই ডিনার করে হাতে মেহেদী লাগাচ্ছে আর গল্প করছে।এমন সময় আবরারের ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল আসে।ও সবার থেকে সরে কিছুটা দূরে যেয়ে ফোনটা রিসিব করতেই অপর পাশের ব্যাক্তির থেকে যেটা শুনে তাতে ওর কপাল খানিটা ভাজ পরে।অপরপাশের ব্যাক্তির সাথে কথা বলছে আর বারবার নিজের স্ত্রীর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে,মেয়েটা কত সুন্দর করে হেসে হেসে ওর খালাতো বোন টুসির হাতে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছে।মেয়েটা এসব শুনলে কী করবে বুঝতে পারছেনা আবরার,তাছাড়া আজকের দিনে এমন কিছু শুনবে বলে আসা করেনি।ও ফোনটা কেঁটে ইয়ারাবীর সামনে যেয়ে বলে,
-“ইয়ারাবী দ্রুত গুছিয়ে নাও,য়ুহার অসুস্থ হাসপাতালে।”

ইয়ারাবীর কথাটা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।ও সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপু কেন হাসপাতালে হবে,ইফাতারির পরে তো কথা হলো।কী হয়েছে আপু?”
-“স্যরি কথাটা তোমাকে বলতে পারবোনা এখন।তুমি দ্রুত যেয়ে গুছিয়ে নাও নয়তো….”
-“নয়তো?”
-“কিছুনা যাও।”

ইয়ারাবী আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে দ্রুত ঘরে যেয়ে বোরখা পরে নেয়।আবরারকে ওর বাবা প্রশ্ন করে,
-“কী হয়েছে আবরার?”
-“বাবা য়ুহার ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে আছে, অবস্থা খুব খারাপ।শৈল ভাইয়ার কথা বলার মতো শক্তি নেই, নিলয়রা প্রচুর কান্না করছে।ইমনের কল ছিলো।”
-“কী বলো?আমরাও যাবো।”
-“উহু,তোমরা বাসায় থাকো।আমি ফোন করে জানাবো।”

ওর মা ওর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে,ট্রিটমেন্ট করায়নি নিজের।ওতো বুদ্ধিমান মেয়ে,এমনতো নয় যে টাকা নেই,তাছাড়া ও যে অসুস্থ তা কোনোদিন বোঝা যায়নি আর না শুনা গেছে।”
-“একমাত্র শৈল ভাইয়া জানতো,আর যখন থেকে জেনেছে ট্রিটমেন্ট করছে কিন্তু ওর শরীর নিতে পারেনি।ইমন বললো,নিজেই অবহেলা করেছে।”
-“ফুলের মতো মেয়েটার কী থেকে কী হয়ে গেলো?এইতো সেদিন ওদের বিয়ে হলো?আল্লাহ যেন এই যাত্রায় মেয়েকে বাঁচিয়ে দেয়।”
-“বুঝতে পারছিনা কী হবে?সবাই খুব চিন্তায় আছে,অচলা আন্টিও হাসপাতালে এডমিট মেয়ের অবস্থা দেখে।ওইতো ইয়ারাবী চলে এসেছে,আমরা বের হচ্ছি।”

আবরার বেশি কথা না বাড়িয়ে ওকে নিয়ে বেরিয়ে পরে।ড্রাইভ করতে করতে শুধু একটা কথাই বলে,
-“দেখ ইয়ারাবী,তুমি নিজে অসুস্থ।তাই যাই ঘটুক না কেন প্লিজ মনকে শান্ত রাখবে আর ভাববে আল্লাহর ইচ্ছা।মাথায় বেশি প্রশার দিবেনা।”

ইয়ারাবী অনেকটা কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে,
-“আচ্ছা আপুর কী শরীর খুব খারাপ?আপুর কিছু হবেনা তো?”
-“সত্যি বলতে তোমাকে দেওয়ার মতো কোনো জবাব আজ আমার কাছে নেই।”

ইয়ারাবী ওর জবাব শুনে বুঝতে পারে ওর বোন আর বাঁচবেনা।তবুও আল্লাহর কাছে মনে মনে প্রার্থনা করছে যাতে বেঁচে যায়,সুস্থ হয়ে উঠে।প্রায় তিনঘন্টা লেগে যায় জ্যামের কারণে হাসপাতালে পৌঁছাতে,কেবিনের দিকে যেয়ে দেখে বাইরে সবাই কাঁদছে।শৈল দেওয়ালে সাথে ঠেস দিয়ে ফ্লোরে বসে কাঁদছে,লোকটাকে দেখার মতো অবস্থা নেই, নিলয় তো চিৎকার করে কান্না করছে আর হাত-পা ছুড়ছে,আর বাকীরা কে কাকে শান্তনা দিবে বুঝতে পারছেনা।কারণ সবাই বুঝতে পারছে আজ য়ুহারের দিন ফুঁরিয়ে এসেছে,তার নামের পাতাটা শুকিয়ে গাছ থেকে ঝড়ে যাবে।য়ুহারের বাবা চিৎকার করে বলছে,
-“হে আল্লাহ!তুমি আমার বদলে আমার মেয়েকে বাঁচিয়ে দাও।বাপ হয়ে সন্তানের খাটিয়া ধরতে চাইনা।আমার মেয়েটা কারোর ক্ষতি করেনি ওকে তুমি উঠিয়ে নিয়োনা।আমার কোলটা শূন্য করোনা আল্লাহ।”

ইয়ারাবী ইমনের কাছে যেয়ে বলে,
-“ভা…ভাইয়া আপুর কী হয়েছে?”
-“ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে আছে আপু,ডাক্তাররা চেষ্টা করছে বাঁচানোর কিন্তু বাঁচানোর মালিক তো আল্লাহ।”
-“আপু বলেনি কেন?আপু কী জানতো না।”

প্রাণো চোখ মুছে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“য়ুহার জানতো সবটা,কিন্তু কাউকে জানায়নি।অর্কভের সাথে যেদিন সম্পর্ক শেষ হয় সেদিন সকালে সবটা জেনেছিলো।কিন্তু অর্কভ সবটা জেনে সম্পর্ক শেষ করে দেয় তার জন্য নিজেকে নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন আর দেখিনি।তাই আবহেলা করেছে এতগুলো বছর।কিন্তু শৈল সবটা জানার পর ওর ট্রিটমেন্ট শুরু করাই।কিন্তু সব শেষ হয়ে গেলে কী আর ফিরে পাওয়া যায়।ও কখনো চাইনি নিজের আপন মানুষগুলোকে কাঁদাতে।”

সবটা শুনে ইয়ারাবী চেয়ারে ধপ করে বসে পরে, হয়তো মানুষের কাছে মামাতো বোনের জন্য চোখের জল ফেলা একটা লোক দেখানো হতে পারে,কিন্তু ও জানে য়ুহার ওর জন্য কী ছিলো।মনে হচ্ছে কলিজা টেনে কেউ বের করে নিচ্ছে,আবরার এসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই ও ওর পেট জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।আবরার কী শান্তনা দিবে বুঝতে পারছেনা?কাছের মানুষ দূরে চলে যাওয়ার কষ্টটা ঠিক কী সেটা ও নিজেও জানে।অনেকক্ষণ পরে ডাক্তাররা ওর কেবিন থেকে বের হয় আর সাথে ইফাজও আছে।তবে সবার মুখটা কালো হয়ে গেছে।সিনিয়র ডাক্তার সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“দুঃসংবাদ আমাদেরও দিতে কষ্ট হয়,কিন্তু এটাই আমাদের দায়িত্ব।পেসেন্টেন হাতে সময় বেশি নেই, আপনারা যেয়ে শেষ দেখাটা করে নিন।”

কথাটা শুনার পরে সবাই আরো বেশি কান্না করতে থাকে।শৈল এক মুহুর্ত দেরি না করে ভিতরে ছুটে যায়।মিসেস অচলাও ছেলেকে ধরে ধরে ভিতরে আসেন।য়ুহারের অক্সিজেন চলছে,অনেক কষ্ট ও শৈলের চোখের পানি মুছে বলে,
-“প্রফেসর,তোমাকে এভাবে কাঁদলে মানায়।তোমার ছাত্ররা শুনলে কী ভাব্বে বলোতো?”
-“তুমি কথা দিয়েছিলে ছেড়ে যাবেনা।আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম একসাথে পাকাচুলের সময় হাত ধরে অতীতের কথা ভাব্বো।বুড়াবুড়ি একসাথে নদীর পারে সময় কাটাবো।”
-“তুমি পাগল প্রফেসর,তুমি বরাবরই জানতে আমার হাতে সময় বেশি নেই।তারপরও তুমি ছাগলামি করলে।”
-“ছাগলামি?”

শৈল কথাটা বলে হাওমাও করে কেঁদে দেয়,য়ুহার ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে,
-“আজ যে কথাটা শুনে মুখ ফুলালেনা?সময়টা বরং অদ্ভুত,পারলাম না পাগল বরটাকে আচলে বাঁধতে।পারলামনা তোমার সাথে শেষ বয়সে এক সাথে কাঁটাতে।জানো শৈল অন্ধকারে আমার ভয় করে,কবরটাও তো খুব অন্ধকার হয় তাইনা?একটা কাজ করবে রোজ আমার কবরে সন্ধ্যায় বাতি জ্বালাবে।”
-“কিছু হবেনা তোমার,তুমি চলে গেলে কে আমাকে প্রফেসর বলবে?তুমি ঠিক হয়ে যাবে।”
-“মিথ্যা তুমি বলতে পারোনা সেটা জানো?তবে অাফসোস একটাই পারলাম না তোমাকে স্বামীর অধিকার আদায় করাতে।মাফ করো আমার।”
-“শরীর থেকে বেশি বড় আত্মার মিলন,আমার আত্মা-তোমার আত্মা এক বন্ধনে বাঁধা।ভালোবাসি তোমার প্রিয়।”
-“একপারে এক হতে পরেনি কিন্তু পরপারে অপেক্ষা করবো আমার প্রফেসারের জন্য।”

শৈল আর কিছু বলতে পারেনা,কান্নায় ভেঙে পরে। য়ুহার ওর বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলে,
-“মা-বাবা তোমরা একদম কাঁদবে,জানোনা তোমাদের চোখের পানি দেখলে আমার কষ্ট হয়।আমি কী চলে যাচ্ছি নাকী?আমিতো তোমাদের ভালোবাসার মধ্যে বিদ্যমান থাকবো।তোমরা খুব বোকা,কীভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদছো।আমি মারা গেলে কেউ উচ্চস্বরে কাঁদবেনা আর রাতেই আমাকে দাফন করবে।বাবা আর শৈল তোমরা আমাকে কবরে নামাবে।”

মিসেস অচলা মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বলে,
-“তুমি তো জানো আমি মুর্খ,নরম মনের।তাই সবাই ফাঁকি দেয়,কিন্তু তুমি কেন ফাঁকি দিলে আম্মা।আমার ঘরে জান্নাত এসে আবার চলে যাচ্ছে।তোমারে ছাড়া কীভাবে থাকবো?জানো আম্মা এবারের ঈদে তোমার পছন্দের জিনিস তোমার বাবার দিয়ে আনছি,মেয়ে আমার বাড়িতে প্রথমবার বরকে নিয়ে ঈদ করতে আসবে।কিন্তু এবাবে বুক ভাঁসিয়ে চলে যাবে কে জানতো?”
-“মা আবার কাঁদছো?বাবা তুমি তো আমার বোকা ছেলে,তোমাকে কী বলবো?এবার কিন্তু রাগ লাগছে আমার।আমার বাঁদরটা কই?”

নিলয় ওর পায়ের কাছে কথাটা শুনার সাথে সাথে আপু বলে কেঁদে উঠে।

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here