জীবন মানে তুমি পর্ব-৫৭

0
3568

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৫৭

(১৯৮)

তারা কথাটা বলে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে।ইফাজের কিছু বলার শক্তি নেই,প্রিয় মানুষের এমন অবস্থা দেখে কেউ ঠিক থাকতে পারেনা।ইফাজের খুব খারাপ লাগছে,ও দ্রুত তারার থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে উঠে দরজার কাছে যেতেই তারা বলে উঠে,
-“স্বপ্ন ছিলো আপনার বৌ হওয়ার,কিন্তু সেটা আর হলোনা।স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেলো।জানেন আপনাকে প্রথম ভালো লেগেছিলো যখন পুতুলের বারোতম জন্মদিন আপনাদের বাসায় করেছিলেন।ফর্সা শরীরে আপনার গায়ে খঁয়েরী পান্ঞ্জাবিটা বেশ মানিয়েছিলো,সেদিন প্রথম আপনার সাথে কথা বলেছিলাম।মনের অজান্তেই আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।কখন কীভাবে সেটা জানিনা,কিন্তু সবার চাওয়াতো আর পূর্ন হয়না।এসবের কিছুই বাবা-মা জানেনা,উনারা জানেনা বলেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে সত্য যাতে কোনোদিন সামনে না আসে আর না আপনার কাছে খারাপ হতে হয়।”

ইফাজ উল্টো ঘুরেই বলতে থাকে,
-“রবার্টহোল্ডেন এর একটা কথা আছে-“গন্তব্য আসক্তি থেকে সাবধান থাকুন – এই ধারণাটি নিয়ে একটি ব্যস্ততা যে সুখ পরের জায়গায়,পরের কাজ এবং পরবর্তী সঙ্গীর সাথে। যতক্ষণ আপনি এই ধারণাটি ত্যাগ না করেন যতক্ষণ না সুখ অন্য কোথাও রয়েছে, এটি আপনার কখনই থাকবেন না।”আশাকরি বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি কথাটা।”
-“জানেন পুতুলের কষ্টা অনুভব করতে পারছি আমি,হয়তো আপনারা ওকে বাঁচানোর জন্য তখন ছিলেন ফেরেসতার মতো।তবে আমার বেলায় কেউ ছিলোনা।আচ্ছা বলুনা,মেয়েদের সাথেই এমন কেন হয়?মেয়েরাতো মায়ের জাত,যে মায়ের পেট থেকে জন্ম নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখেছে সেই মায়ের জাতকে কষ্ট দিতে,তাদের সাথে জঘন্য ব্যবহার করতে একটাবারও অনুতপ্ত হয়না।এই জীবন রেখে লাভই বা কী,যখন সবটা শেষ হয়ে গেলো।”
-“জীবন আমাদের দশ শতাংশ হয় এবং বাকী নব্বই শতাংশ আমরা এর প্রতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া সেটার।”
-“আর জীবন!”

অনেকটা তাছ্যিল্যের সুরে কথাটা বলে উঠে তারা। ইফাজ আর এক মুহুর্ত ওখানে দাঁড়ায়না,সাথে সাথে নিজের কেবিনে যেয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে।শনিবারের দিনটা এমনিতেই অনেক ব্যাস্ত কাঁটে,তার উপর এসব ভালো লাগছেনা।মাথার ভিতরে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চিনচিন ব্যাথা করছে,চোখ বদ্ধ অবস্থায় তারার বলা কথাগুলো কানে বাজছে।এর মধ্যে একজন নার্স দ্রুত এসে বলে,
-“স্যার,তেরো নাম্বার কেবিনের পেসেন্টের অবস্থা খারাপ।আপনি দ্রুত আসুন…”
-“কী?এটা কীভাবে সম্ভব?”
-“জানিনা স্যার।”
-“একটু আগে চেকআপ করে এলাম যে।আপনি ডা.মূর্ছনাকে ডাকুন আমি আসছি।”
-“জ্বি স্যার।”

নার্সটা দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে যেতেই ইফাজ চেয়ার থেকে উঠে বাথরুমে যেয়ে হাত-মুখে পানি দেয়।তারপর এপ্রোনটা গায়ে জড়িয়ে বেড়িয়ে পরে।

(১৯৯)

-“ধুর,সেদিন জারা-টিকলিকে পরিয়ে দিলাম কিন্তু নিজে পারছিনা।আমার সাথেই এমন কেন হয়?অন্যকে কত সুন্দর করে দিতে পারি কিন্তু নিজের বেলায় অকর্মার-ঢেকি।”

কথাটা অায়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকটা বিরক্তি সহকারে কথাটা বলে উঠে ইয়ারাবী।প্রায় একঘন্টা ধরে শাড়ির পরার চেষ্টা করছে তবে মনমতো সুন্দর করে পরতে পারছেনা।হয়তো আঁচল ছোট হয়ে যাচ্ছে,নয়তো কুচিগুলো বাজে হয়ে যাচ্ছে,নয়তো পরলে পেটের কাছে মোটামোটা লাগছে।শাড়ি জিনিসটা চরম বিরক্তির মনে হয় ইয়ারাবীর কাছে,তবুও কিছু করার নেই এখন।কেননা ওর শ্বাশুড়ি সাদা-সোনালি রঙ মিশ্রণের ভারি একটা শাড়ি কিছুক্ষণ আগে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন,
-“মা শোন,এই বাড়িটা তোর নিজের বাড়ি।এখানে কী পরবি কীভাবে চলবি কখনো জোর করবোনা।কিন্তু তোর নানীশ্বাশুড়ির ধারণা হলো ‘শাঁড়ি মানে বাঙালি নারী।”উনি বাড়ির প্রত্যেক বৌকে শাঁড়িতেই দেখতে চাই,তাই মা যে কয়েকটা দিন এখানে থাকে কষ্ট করে শাড়িটা পরিস।”
-“কিন্তু আম্মু আমার তো শাড়ি নেই।”
-“এইটা পর,আমি কিনেছিলাম আর পরা হয়নি।ব্লাউজটা পরো কোমর পর্যন্ত,লম্বা হাতা,কলার দেওয়া,ফিতা লাগানো ফিট হবে তোর।আর আবরারকে বলিস এনে দিবে।”
-“জ্বি আম্মু….”
-“একটু কষ্ট কর এই কয়দিন,আমি আসি।”

তখন থেকে ইয়ারাবী শাড়ির সাথে যুদ্ধ করছে কিন্তু সফল হচ্ছেনা।একে তো ভারী শাড়ি তার উপর কুচিগুলো ধরার মতো কেউ নেই।বিয়ের আগে যদি শাড়ি পরার হতো তবে ওর খালামনির কাছে যেতে হতো।আর এটা নিয়ে মিসেস শিখা হেসে বলতেন, -“সবাইকে করে দিস বিউটিশিয়ান কিন্তু নিজে পারিসনা।”
-“বারে এটা পারিনা বলেই তো তুমি পরিয়ে দাও।তাছাড়া বিয়ের পর বরের কাছে থেকে শিখবো।”

কথাটা বলার সাথে সাথে দু’হাত দিয়ে লজ্জায় মুখ ডেকে ফেলতো।এখন ঘটনাগুলো মনে পরতেই হাসি এসে যায়।কিন্তু হাসলে চলবেনা,দ্রুত ওকে শাড়িটা পরতে হবে কেননা ঘন্টাখানিকের মধ্যে ওর নানীশ্বাশুড়ি বাড়িতে আসবে।লজ্জার জন্য শ্বাশুড়িকে বলতেও পারছেনা,তার উপরে ইকরা জারবাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছে।বেশি কিছু না ভেবে আর শাড়ির কুচিগুলো দিতেই নিচের দিকে টান অনুভব করে।নিচে তাকিয়ে দেখে আবরার শাড়ির কুচি ধরে আছে।ইয়ারাবী কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবরার ধমক দিয়ে বলে,
-“অনেকক্ষণ ধরে দেখছি শাড়ি নিয়ে কাহিনি করছো।তুমিতো সুন্দর করে শাড়ি পরাতে পারো, তাহলে নিজের সময় সমস্যা হয় কেন?”

ইয়ারাবী মুখটা কালো করে বলে,
-“জানিনা।”
-“শাড়ি পরছো ভালো কথা,তবে সামলিয়ে রাখবে।উনিশ-বিশ কিছু দেখলে কপালে দুঃখ আছে বলে রাখলাম।নানীর সাথে উনার ভাইয়ের দুই নাতি আসছে,ধারে কাছেও ঘেষবেনা।আমি চাইনা আমার বৌয়ের সৌন্দর্য কোনো পরপুরুষ দেখুক, মনে রাখবে।”
-“আপনি এভাবে বলছেন কেন?আমিতো আপনার সব কথায় শুনি,আর নানীর জন্যই শাড়ি পরছি।”
-“আমি একবারও বলেছি তুমি আমার কথা শুনোনা?যা বলছি সেটা মাথায় রাখবে,মুখটা হুতুম পেঁচার মতো না বানালেও চলবে।আর জেদ করে তো রোজা রাখলে….”
-“কিছু হয়নি এখনো,পারবো আমি।”

ইয়ারাবী অনেকটা উৎফুল্ল মনে কথা বলে একটা মৃদু হাসি দেয়,যার জন্য আবরার আর কিছু বলেনা।তবে অনেকটা গম্ভীর মুখ করে দুই মিনিটে শাড়িটা সুন্দর করে পরিয়ে দেয়।এতে ইয়ারাবী অনেকটা অবাক হয়,কেননা প্রফেশনাল ছাড়া এতো সুন্দর করে দ্রুত শাড়ি পরানো সম্ভব নয়।তার মানে উনি আগে কাউকে শাড়ি পরিয়েছেন, কথাটা মাথায় ঘুরতেই ও আবরারের দিকে ভ্রু কুচকে বলে,
-“আপনি শাড়ি….”
-“জারবা যখন ছোট ছিলো আমিও ওকে শাড়ি পরিয়ে দিতাম।কেননা মম্ তখন চাকরি করতো।আর জারবার ছোটবেলায় শাড়ির প্রতি ঝোক ছিলো।তাছাড়া কাল রাতে ইউটিউব থেকে দেখছি।”

ইয়ারাবী শেষের কথা শুনে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলে,
-“ছিঃ আপনি মেয়েদের শাড়ি পরা দেখেন?আমি ভাবতেও পারিনা…”

আবরার ওর মাথায় হালকা করে চাটি মেরে বলে,
-“গাধী,ম্যানিকুইনকে পরানো দেখেছি।কেননা আমি জানতাম নানী আসছে বলে তোমাকে শাড়ি পরতে হবে।তাছাড়া এতোদিনে এতটুকু চিনি তোমাকে।”
-“বুঝেছি,একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম আপনাকে।”
-“বলো,শুনছি….”

কথাটা বলেই আবরার সোফায় বসে গায়ের কোটিটা খুলতে থাকে।খয়েরি শার্টের উপর কালো কোটি,আবরারকে বেশ মানায়।ইয়ারাবী এক ধ্যানে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে,ওর চাপ দাঁড়ি এতো পছন্দ কেন নিজেই জানেনা।বিয়ের আগে সব সময় ভাবতো ওর বরের যেন মুখে চাপ দাঁড়ি থাকে,আর বাস্তবে সেটাই হলো।ইয়ারাবীর এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে বলে উঠে,
-“বরটা তোমারি,জীবন ধরে দেখতে পারবে।”
-“না মানে কোথায় দেখছিলাম?”

ইয়ারাবী কথাটা আমতা আমতা করে বলতেই আবরার গম্ভীর সুরে ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
-“রোযা রেখে মিথ্যা বলতে নেই জানো নিশ্চয়ই?এখন বলো কী বলতে চেয়েছিলে?”
-“আসলে নানীতো অনেকদিন থাকবে।”
-“হামম,রোযার সময় উনি পনের-বিশদিন আমাদের সাথে কাটান।তোমার কোনো সমস্যা?”
-“ছিঃ ছিঃ,আমার কেন সমস্যা হতে যাবে।”
-“তো?”
-“না মানে আমার তো কোনো শাড়ি নেই।এই শাড়িটা আম্মু দিয়ে গেলেন, তাই বলছিলাম আপনি যদি দু’টা শাড়ি কিনে দিতেন….”
-“কাল শপিং-এ যেয়ে যা যা লাগবে নিবে।আর এখন তো তোমার প্রয়োজনীয় জিনিস আমিই দিবো,তাই সরাসরি বললে খুশি হবো।ওই বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই দেখছি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছো আমার থেকে।”
-“না না,এমন কিছু নয়।বলছিলাম যদি আপনি এনে দিতেন ভালো হতো,আসলে আমি তেমন কিনতে পারিনা।”
-“ঠিক আছে নিয়ে আসবো।”

ইয়ারাবী চুলগুলো হাত খোপা করে বলে উঠে,
-“আচ্ছা আপনি বারোটার দিকে বাসায় কেন?”
-“তেমন কিছুনা,মাথাটা খুব ধরেছিলো তাই।”
-“ওহ্হ্,আপনি ফ্রেস হয়ে এসে শুয়ে পরুন,আমি আপনার কপালে মলম দিয়ে মালিশ করে দিচ্ছি।”

আবরার মুচকি হাসি দিয়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে চেন্জ করে শুয়ে পরে।ইয়ারাবী ড্রয়ার থেকে মলমটা বের করে হালকা হাতে নিয়ে ওর পাশে বসে কপালে লাগিয়ে মালিশ করতে থাকে।এতে করে আবরারের অনেকটা আরাম লাগে,চোখবন্দ করে হেসে বলে,
-“মাঝে মাঝে অসুস্থ হলে ভালোই হয়,বৌয়ের সেবা পাওয়া যায়।”
-“আমিতো চাই কিন্তু আপনার মন মতো করতে পারিনা।”
-“করার অনেক সময় আছে,পড়তে গেছিলে?”
-“হ্যাঁ,আজ জানেন কী হয়েছে?”

আবরার বুঝতে পারছে ইয়ারাবীর মনটা আজ খুব ভালো,তাই ও নিজেও একটা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠে,
-“কী?”
-“আজ যখন স্যারের কাছ থেকে পড়ে বের হচ্ছিলাম তখন মেঘ আর হিয়া নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে আসছিলো।ঠিক তখনি একটা মেয়ে দু’টা গোলাপ নিয়ে এসে মেঘকে দিয়ে বলে,
“মেঘ আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি,বিয়ে করবে আমার।”বেচারা মেঘ পুরো ওখানে ফেসে যায়, কেননা মেয়েটা ছিলো বলে মেঘের স্কুলের ক্লাসমেট আর অপরদিকে হিয়া রনচন্ডীরুপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মেঘ মেয়েটাকে কোনো উত্তর না দিয়ে ব্যাগ ফেলেই দৌঁড় দেয়।”

কথাটা বলে ইয়ারাবী হাসতে থাকে,ওর হাসি দেখে মনে হচ্ছে আজ অনেকদিন পরে হাসছে ও।আবরার কিছু একটা ভেবে উঠে বসে ওর খোঁপাটা খুলে দিয়ে বলে,
-“আমার সামনে যখন থাকবে চুলটা খুলে রাখবে শুধু রাতে বাঁধবে।আর আমি ব্যাতিত অন্য কেউ থাকলে মাথায় কাপড় দিবে।”

ইয়ারাবী কথাটা শুনে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।আবরার ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে নাড়তে নাড়তে কিছু একটা মনে হতেই ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এক মিনিট,এই হিয়া ডা.নিজামের মেয়েনা?”
-“জানিনা,তবে ওর বাবা বলে মেডিসিনের ডাক্তার।”
-“ইয়েস,বাট্ মেঘের সাথে কীসের সম্পর্ক?এই কোনো রিলেশন নেই তো ওদের?”

আবরার অনেকটা গম্ভীর মুখে কথাটা বলে উঠে। ইয়ারাবীর এতক্ষণে টনক নড়েছে যে ও কী বলে ফেলেছে।আসলে মেঘ ওকে নিষেধ করেছিলো বাড়িতে হিয়ার সাথে রিলেশনের কথা জানাতে।ইয়ারাবী চুপ হয়ে যায়,বুঝতে পারছেনা কী উত্তর দিবে?
-“কী হলো বলো?”
-“না মানে আমা…আমাদের ফ্রেন্ডসার্কালের মধ্যে হি…হিয়া মেঘকে পছন্দ করে কিন্তু মেঘ পাত্তা দেয়না তাই।”

আবরার ওর দিকে বাম ভ্রুটা উঁচু করে তাকিয়ে বলে,
-“মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার বুদ্ধির জন্য তোমাকে ঠাস-ঠুস করে নোভেল দেয় কিন্তু আফসোস সেটা দিতে পারিনা।”

ইয়ারাবী ওর কথার মানে বুঝতে পারেনা,তাই ওর দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকলে আবরার ওর কোলে মাথা রেখে বলে,
-“লিটিল ডল,এতো ভাবলে মাথায় চাপ পরবে।বাদ দাও…ভাবী কোথায় বলতো?”
-“উনি তো ডাক্তারের কাছে গেছে,ভাবীর তো মনে হয় পাঁচ মাস তাইনা।”
-“উহু,ছয় মাস হবে।কেননা আমাদের বিয়ের দেড় মাসের মাথা ভাবী প্রেগন্যান্ট হয়েছে।আমাদের সাড়ে সাত মাস চলছে…”

এর মধ্যে এক সার্ভেন্ট এসে দরজায় নক করে বলে,
-“স্যার,বড় ম্যাডাম আপনাদের ডাকছেন।”

আবরার উঠে বসে বলে,
-“নানী এসেছে নাকী?”
-“জ্বি…”

সার্ভেন্ট কথাটা বলেই চলে যেতে আবরার উঠে ইয়ারাবীকে ছোট হেজাব দিয়ে মাথাটা কভার করে দিয়ে বলে,
-“শাড়ির আচল পরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, হেজাব ছাড়া যেন না দেখি।এসো আমার সাথে,নানী একটু খুতখুতে দাদীর মতো ওতোটা নরম নয়।মানিয়ে চলবে।”
-“জ্বি।”

ওরা ঘর থেকে বের হয়ে নিচের হলরুমের দিকে তাকিয়ে দেখে মিসেস রায়হানের সামনে একজন বৃদ্ধা নারী সাদা জামদানি শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বসে আছেন,হাতে একটা লাঠি,দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে মহিলাটা বৃদ্ধা হলেও শক্তপোক্ত মানুষ।উনার পাশে দুইটা ছেলেও বসে আছে,তবে ইয়ারাবী উনাদের চেহারার দিকে দেখেনি।আবরার ইয়ারাবীর হাত ধরে নিচে নামতেই মহিলাটা ওর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“ওইতো আমার সোয়ামি চলে আসছে।বিয়া করছো দেখে মনটা খারাপ হলেও পুরাই রাজ-ঝোটক লাগছে।”

ওরা এসে নানীকে সালাম দিয়ে আবরার হাসতে হাসতে সামনের সোফায় বসে বলে,
-“তুমিতো আমার বড় বৌ,ভালোবাসা সব সময় বেশি তোমার জন্য।”
-“যাহ যাহ,তুই ওই বুড়িরেও কস আমি জানি।”
-“তুমিও না নানী,দেখো আমার বৌ মানে তোমার সতীন কেমন হয়েছে?”

আবরারের নানী বাতাসি বানু ইয়ারাবীকে দেখে মুখটা গম্ভীর করে কিছু চিন্তা করলেন,তার মুখে হাসির রেখা টেনে নিজের কাছে ডেকে বসতে বললেন।উনার পাশে বসা ছেলে দু’টাকে উঠিয়ে দিয়ে বলেন,
-“তোরা ওইদিকে বস।”

ওরা উঠতেই মহিলাটা ওকে টেনে পাসে বসিয়ে দিয়ে হাত দিয়ে মুখটা ধরে বলেন,
-“মেয়ে তো দেখি শ্যামলা,তবে চেহারাটা সুন্দর মাশাল্লাহ্।চোখ দুইটাও সুন্দর,চশমাটা খোলতো বৌ।”

ইয়ারাবী চশমাটা খুলতেই নানী মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
-“একদম ইলার মতো দেখি চোখে দুইটাই তিল।তা কোরআন পড়তে পারিস?”
-“জ্বি।”
-“আলহামদুলিল্লাহ্‌,রোযা রাখছিস?”
-“জ্বি।”
-“রান্না পারিস?”
-“কিছুটা পারি…”
-“জানতাম,আজকালের শহরের মেয়েরা রান্না-বান্না পারেনা।পড়ালেখা কতদূর?”
-“জ্বি,আইন নিয়ে পড়ছি,প্রথম বর্ষ।”

নানী উনার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“মেয়ে দেখি লেখাপড়া করে?দেখতেও বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।”
-“হ্যাঁ,মা।আসলে ওর বয়সটা কম,আবরারের থেকে আট বছরের ছোট।”
-“ভালো ভালো,ছেলে মানুষের বয়স বেশি হলেই ভালো।তবে হেনা ফরিদা কষ্ট পাইছে,ওর মেয়ের সাথে বিয়া দিতে চাইছিলো।”
-“মা এসব বাদ দাও।”

আবরার ওর নানীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তো বৌ,বিয়ে করেছি তা কিছু দিবেনা তোমার সো…য়া…মিকে।”
-“ফাজিল পোলা,তোর দিবো ক্যান?দিবোতো নাত বৌকে।ওই সজল তোর ভাবীর জন্য যে বালা আনছি সেটা দে।”

সজল নামের ছেলেটা ব্যাগ থেকে ছোট একটা বক্স বের করে ওর নানীর হাতে দিয়ে বলে,
-“নানী তোমাকে না বলেছি আবরার আর আমার বয়স একই।তাহলে ও আমার ভাবী হয় কী করে?”

আবরার সজলের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“একদিনের বড় তোর থেকে ভুলে যাবিনা।তবে তুই চিটাগাং থেকে কবে আসলি?”
-“সামনের সপ্তাহে,সিলেটে যাবো তাই ভাবলাম বাড়ি থেকে ঘুরে যায়।তোর বৌয়ের সাথে দাদীকেই কেই পরিচয় করিয়ে দিবি,আমাদের দিবিনা?”
-“আসলে কী বলতো সজল?ও ছেলেদের সাথে বেশি কথা বলেনা,এই বাড়িতে আব্বু-ভাইয়া-মেঘ এদের ব্যাতিত ছেলে আত্মীয়-স্বজনদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখি।আর আমিও চাইনা,ও কোনো বেগানা পুরুষের সামনে যাক।কেননা পর্দা ইসলামের সার্বক্ষণিক পালনীয় অপরিহার্য বিধান।
আল্লাহ তায়ালাই এ বিধানের প্রবর্তক। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তোমরা তাদের নিকট কিছু চাইবে তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এ বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ’। (সূরা আহযাব: ৫৩) ।
এ বিধানকে হালকা মনে করা কিংবা এ বিধানকে অমান্য করার কোনো অবকাশ নেই। কেননা ইসলামী শরীয়তের সুস্পষ্ট বিধানের বিরোধিতা করার অধিকার কারো নেই।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ এবং তার রাসূল কোনো বিষয়ের নির্দেশ দিলে কোনো মু’মিন পুরুষ কিংবা কোনো মু’মিন নারীর জন্য সে বিষয় অমান্য করার কোনো অধিকার থাকে না। আর যে আল্লাহ ও তার রাসূলকে অমান্য করে সে অবশ্যই পথভ্রষ্ট।’ (সূরা আহযাব: ৩৬)।
আশাকরি বুঝতে পেরেছিস।”
-“তোর এই হাদিস অনুযায়ী কথা বলা বাদ যাবেনা।”
-“অবশ্যই নয়,কেননা আমি একজন মুসলিম।
তো,বিয়ে করবি কবে?”

সজল হেসে আড়চোখে ইয়ারাবীকে দেখে বলে উঠে,
-“তোর বৌয়ের মতো কাউকে পেলে বিয়ে করে নিবো।”

আবরারের কথাটা ভালো লাগেনি,আর না সজলকে ভালো লাগে।ওর স্বভাব-চরিত্রের একটা গন্ডোগোল আছে।সজলের চোখ ইয়ারাবীর দিকে, ইয়ারাবী খেয়াল না করলেও ওর বেশ অস্বস্তি হচ্ছে যা মুখে প্রকাশ পাচ্ছে,এটা মনে হয় জন্ম থেকে মেয়েদের এক বিশেষ গুন।নানী বালাটা ইয়ারাবীর হাতে দিয়ে বলে,
-“ইকরারে একটা বালা দিচ্ছি।তাই তোরেও এই বালা দিলাম,আসলে আমি আমার ছেলে-মেয়েদের আলাদা দেখিনা,দুইটারে তো পেটে ধরেছি তাই।সামলে রাখিস জিনিসটা।”
-“জ্বি।”

এদিকে আবরার বেশ কিছুক্ষণ ধরে সজলকে খেয়াল করছে,ওর রাগ লাগছে এই।এবার না পেরে কিছুটা জোরে বলে,
-“ইয়ারাবী,ঘরে যাও।”

ইয়ারাবী নানীর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতেই আবরার উঠে দাঁড়ায়।নানী আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সোয়ামি,রাতে নাতবৌ ঘুমাই গেলি আমার ঘরে আসবি,আর হেনা তুইও।

(২০০)

সন্ধ্যা ছয়টা বাজে,ছয়টা বাজে তেত্রিশ মিনিটে ইফতার।আবরার ঘরে কোরআন পরছিলো, ইয়ারাবী নিচ থেকে এসে ওর পাশে বসে পরে।আবরার একবার ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আবার কোরআন পড়ায় মনোযোগ দিয়ে আয়াতটা শেষ করে বন্ধ করে।তারপর কোরআন শরীফ যথাযথ স্থানে রেখে দোয়া পরে নিজেকে ফুঁ দিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে ওকেও ফুঁ দেয়।ইয়ারাবী করুন চোখে ওর দিকে তাকাতেই ও একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
-“বললাম না কষ্ট হবে,দুপুরে খারাপ লাগছিলো তখনি ভেঙে দিতে কিন্তু জেদ করলে।”
-“আবরার আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগছে,মাথা যন্ত্রনা করছে,পেটেও ব্যাথা হচ্ছে।”
-“জাস্ট থার্টি মিনিট,যখন কষ্ট করেছো তখন এতটুকু করো।চলো নিচে যায়,সবাই অপেক্ষা করছে…”

আবরার বের হতে গেলেই ইয়ারাবী ওর হাত টেনে ধরে।আবরার ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকাই ও বলে উঠে,
-“আপনার ওই দুইটা ভাই কী আপনার থেকে ছোট?কবে যাবে উনারা?”
-“কেন বলতো?খারাপ কিছু করেছে?”
-“আসলে মেঘ আম্মুকে মিট চপ বানাতে বলেছিলো,তাই আম্মু নিজেই চপ বানাচ্ছিলো কিচেনে।তাই আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আর তখন…তখন একটা ছেলে কিচেনে এসে আমার আমার…”

আবরার শান্ত চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে।আবরার একহাত দিয়ে ওর হাতটা ধরে আরেকহাত ওর মুখে রেখে বলে,
-“কী হয়েছে বলো?বাজে কিছু করেছে?”

ইয়ারাবী মাথা নাঁড়ায়,আবরার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত রেখে বলে,
-“কী করেছে আর কে করেছে?”
-“আমি জানিনা উনি কে?কেননা দুপুরে আমি সেভাবে খেয়াল করিনি।উনি এসে বা…বাজে ভাবে আমার কো..কোমরে হাত দিয়েছিলো।আমি ঘুরে তাকাতেই উনি স্যরি বলেছিলো।কিন্তু ফ্রিজ থেকে পানি বের করে বের হওয়ার সময় উনি আমার পেটে হাত দিয়েছিলো।যদিও উনি আম্মুর সামনে বলেছে ভুল করে হয়েছে তবুও একজন মেয়ে হিসাবে আমি বুঝতে পারি এগুলো ইচ্ছাকৃত।আমার সাথে আগেও হয়েছে এসব আপনিতো জানেন,আবরার আমার ভয় করছে।উনার চোখে সেই জিনিসটা দেখেছি যা পিয়াসের চোখে ছিলো।”

ইয়ারাবী কেঁদে আবরারকে জড়িয়ে ধরে।আবরারের বুঝতে একটুও সমস্যা হয়না ছেলেটা কে ছিলো?ও ইয়ারাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,
-“সোনা,এসব যেন বাসার কেউ না জানে।স্বাভাবিক হও,নিচে চলো ইফতারের সময় হয়ে গেছে।আর আমি আছিনা,একদম ভয় পাবে।তুমি কে ভুলে গেছো?গ্রামে পিয়াসের ভাইকে কীভাবে মেরেছিলে,সুতরাং এভাবে কাঁদার কোনো অর্থ হয়না।তোমার স্বামী যতক্ষণ তোমার সাথে আছে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ কিছু করতে পারবেনা।”

ইয়ারাবী মাথা ঝাঁকিয়ে চোখের পানি মুছতেই আবরার ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে সাথে করে নিচে নেমে আসে।ওর নানী টেবিলে বসে জিকির করছিলো,ওদের কে দেখেই বলে,
-“নাতবৌ,আয় আমার পাশে বোস।আজ দুই নাতবৌ আমার সাথে বসবে।”

জারবা মুখ লটকিয়ে বলে,
-“আম্মাজানের আম্মাজান,নাতনি বুঝি কেউ না।”
-“থাম,নাটকের বস্তা।মনে হয় শেষ তোর দশবছর বয়সে মুখ থেকে নানী ডাক শুনছি।”
-“থাক,বসমুনা তোমার লগে।আমি বাবজানের কাছেই ঠিক আছি তাইনা আব্বুজান।”

টেবিলের সবাই হেসে দেয়,মি.রায়হান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।এই মেয়েটা আসার পরে তার স্ত্রীর সাথে সাথে বাড়িটাও একটা নতুন রুপ পেয়েছে।সবাই টেবিলে বসে দোয়া পড়ে মোনাজাত করে,তারপর অাযান দিলে ইফতার করে।সাফি শান্তভাবে ইফতার করলেও সজলের চোখ বারবার ইয়ারাবীকে দেখছিলো যা আবরারের চোখ এড়ায়নি।আবরার কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসি দেয়।
সবাই ঘরে যেয়ে মাগরিবের নামায আদায় করে নেয়।যথা সময়ে এশার আযান দিতেই আবরার ওযূ করে এসে ইয়ারাবীকে কাছে ডেকে ওর কপালে চুমু দিয়ে বলে,
-“মসজিদ থেকে নামায আদায় করে আসি,তুমি নানুদের সাথে নামায আদায় করে যদি ক্ষুদা পায় খেয়ে নিবে।আমি এসে মেডিসিন দিয়ে দিবো।”
-“মসজিদ কী দূরে?”
-“এইতো দশ-পনের মিনিটের দূরত্ব,আব্বুরা দাঁড়িয়ে আছি আমি আসি।”
-“সাবধানে যাবেন,”ফি আমানিল্লাহ।”

আবরার মুচকি হেসে টুপিটা পরে ঘরে থেকে বের হয়ে যায়।নানীর সাথে মহিলারা সবাই উনার ঘরে নামায আদায় করে নেয়।নামাযের পর ইকরা-জারবা বসে চালতার আচার খাচ্ছে,নানী গ্রাম থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছে।ইয়ারাবী চুপচাপ বসে আছে, আসলে অসুস্থ শরীরে রোযা থেকে কাহিল হয়ে পরেছে।হঠাৎ কেউ ওর সামনে খারাবের প্লেট ধরে।সামনে তাকিয়ে দেখে ওর শ্বাশুড়িমা,উনি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,
-“খেয়েনে,অসুস্থ হয়ে পরেছিস তো।কাল থেকে আর থাকবিনা।”
-“হেনা রোযা থাকতে ওকে নিষেধ কেন করছিস?”
-“আর বলোনা মা,ওর শরীর পুরো খারাপ,এই মাস দু’য়েক আগে অপারেশন হয়েছে।তিনবেলা ঔষুধ-খারাব খেতে হয় সে রেখেছে রোযা।”
-“ছোট নাতবৌ,এসব একদম ঠিকনা।হাদিস তো জানিস তাহলে এমন করলে কেন?তুই জানিসনা আল্লাহ কী বলেছেন?”

ইয়ারাবী নিচু স্বরে বলে উঠে,
-“জানি নানী,ভেবেছিলাম পারবো।কাল থেকে আর রাখবো।”
-“ভালো,এখন খাবারটা খেয়ে নে।”

ইয়ারাবী নানীর ঘরে বসে খুব সীমিত আকারের লুকমা নিয়ে ভাত খাচ্ছে।আসলে পুরো বছর সকাল-রাতে যে খাবারই হোক না কেন বাতাসি বানু এলে তিনবেলাতেই ভাত চলবে।তার কথা বাঙালি মানে মাছে-ভাতে ।উনি যেমন মনে প্রানে বাঙালি তেমনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক।উনি আর উনার স্বামী দুইজনই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।উনি ইয়ারাবীর খাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলেন,
-“ছোট নাতবৌ তুই কী কিছু দেখিস?”

ইয়ারাবী অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী দেখবো নানী?”
-“মানে মানুষ বাদে কিছু দেখিস বা মনে হয় থাকে সাথে।বড় নাতবৌ তুই জারবাকে নিয়ে তোর ঘরে যা।”

ইকরা তার ননদকে নিয়ে ঘর থেকে চলে যেতেই ওর শ্বাশুড়ি ইয়ারাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
-“যদি এমন কিছু হয় তাহলে বল,মা অনেক কিছু জানে।”
-“আম্মু আমি…”
-“সবটা বল…”

ইয়ারাবী শেষ লুকমাটা গালে তুলে খাবার শেষ করে প্লেটে হাত ধুয়ে নেয়।একজন সার্ভেন্ট এসে প্লেট-গ্লাস নিয়ে যেতেই ইয়ারাবী সবটা শুরু থেকে বলে।বাতাসি বানুর পুরোটা শুনে মুখে গম্ভীরতা ভর করে।তারপর কিছু একটা ভেবে বলেন,
-“তুই যেয়ে ঘুমিয়ে পর,সারাদিন ধকল গেছে।আর তোদের হুজুর যা বলেছে সেগুলো পরে ঘুমাবি,যাহ এখন।”

ইয়ারাবী ওর শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে চলে যায়।বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে আসে।প্রায় আধাঘন্টা পরে বাড়ির ছেলেরা বাড়িতে আসে।আবরার ঘরে ঢুকে দেখে ইয়ারাবী শাড়ি পরেই ঘুমিয়ে আছে,টেবিলে দুধের গ্লাসটা ঢেকে রাখা।আবরার গ্লাসে হাত দিয়ে বুঝতে পারে দুধটা গরম।নিজে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে এসে ইয়ারাবীকে ডাকতে থাকে।ইয়ারাবীর হালকা ঘুম ভাঙতেই ও জোর করে ওকে চেন্জ করতে পাঠায়।তারপর বের হয়ে এলে মেডিসিন দিয়ে দুধটা খাইয়ে দেয়।ইয়ারাবী আধোঘুমে আছে,ক্লান্তি সারা শরীরে ভর করেছে তাই চুপচাপ আবরার যা বলছে সেটা করে নিজের জায়গায় শুয়ে পরে।আবরার ওর কান্ড দেখে হেসে দেয়।

রাতে ডিনারের পরে বাতাসি বানু নিজের ঘরে বসে আছেন,আর তার সামনে মিসেস হেনা আর আবরার বসে আছে।আবরার ওর নানুর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুমি এভাবে কেন ডাকলে বলবে?”
-“ছোট নাতবৌরে কেউ সিহর করছে।”
-“ওহ্হ্,তুমি যখন প্রথম ওকে দেখে মুখ গম্ভীর করে ফেললে তখনি বুঝেছিলাম কিছু হয়েছে।তবে এখন বুঝলাম তুমি এই বিষয়ে বলবে?”
-“তোমারে কিছু হাদিস কই,মন দিয়ে শুনবে যদিও মনে হয় জানো।কোরআনে অনেক যায়গায় যাদুর কথা আছে।এর মাঝে অধিকাংশ আয়াতে এরকম আইছে,কোনো নবী কওরেম কাছে দাওয়াত নিয়ে গেছেন, আর তাঁরা নবীর ওপর যাদুকর হওয়ার অপবাদ দিয়েছে, অথবা বলেছে তোমাকে কেউ যাদু করেছে তাই তুমি এসব বকছো!(নাউযুবিল্লাহ) এরথেকে বুঝা যায়, মানব সভ্যতার শুরুর থেকে যাদু একটি ঘৃণার বিষয়;একটি অভিশপ্ত।আল্লাহ তা’আলা কি বলছেন- ১. “এমনিভাবেই তাদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনই কোন রসূল এসেছে, তারা বলেছেঃ যাদুকর, না হয় উম্মাদ!” (সুরা যারিয়াত, আয়াত ৫৬)
২. “যদি আমি ওদের সামনে আকাশের কোন দরজাও খুলে দেই আর তাতে ওরা দিনভর আরোহণ ও করতে থাকে। তবুও ওরা একথাই বলবে যে, আমাদের চোখ ভুল দেখছে? না আমরা যাদু আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। (সুরা হিজর, ১৫)
তবে যাইহোক না কেন.. যাদু দ্বারা এমন অস্বাভাবিক কাজ করা যায়, যা বাহ্যদৃষ্টে অবিশ্বাস্য।এরপর মুসা আ. এর ঘটনা বিভিন্ন সুরায় আসছে, যেমনঃ সুরা আরাফ, সুরা ইউনুস, সুরা ত্বাহা। সুরা আ’রাফের একটি আয়াত শুনো-
৩. “তিনি (মুসা আ.) বললেন, তোমরাই নিক্ষেপ কর। যখন তারা নিক্ষেপ করল তখন তাদের যাদু লোকদের চোখগুলোকে ধাঁধিয়ে দিল, ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলল এবং তাঁরা বিরাট যাদু প্রদর্শন করল। তারপর আমি মূসাকে ওহী পাঠালাম, তোমার লাঠি নিক্ষেপ কর। এরপর, যাদু দিয়ে তারা যা বানিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে সেটি (লাঠি) সবকিছু গিলতে লাগল।” (সুরা আরাফ, ১১৫, ১১৬) আমাদের রাসুল(স.) এর ওপরেও যাদু করা / বান মারা হয়েছিলো। তখন আল্লাহ দুয়া শিখিয়ে দিলেন রাসুল স.কে- ৪. “বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের পালনকর্তার, তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে, আর অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগত হয়, এবং গ্রন্থিতে ফুঁৎকার দিয়ে জাদুকারিনীদের অনিষ্ট থেকে…” (সুরা ফালাক, ১-৪)
রাসুল ﷺ এর ওপর যাদু করার কারণে তিনি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। যাদু দ্বারা মানুষের ক্ষতি করা যায় তাঁ অন্য আরেক আয়াতেও স্পষ্ট বুঝা যায়, খেয়াল করলে বুঝবা- ৫. “…অতঃপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন যাদু শিখত, যদ্দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তারা আল্লাহর আদেশ ছাড়া তদ্দ্বারা কারও অনিষ্ট করতে পারত না…” (সুরা বাকারা, ১০২ আয়াতের অংশ)
১. হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সাতটি ধ্বংসকারী জিনিস থেকে দূরে থাকো। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! সে জিনিসগুলো কি? তিনি বললেনঃ আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শরীক করা, যাদু বিদ্যা শেখা ও তার চর্চা করা, যে জীবনকে হত্যা করা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন, তাকে অবৈধভাবে হত্যা করা, সূদী লেনদেন করা, ইয়াতীমের ধন আত্মসাৎ করা, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া, পবিত্র চরিত্রের অধিকারী মুমিন নারীর ওপর অপবাদ দেয়া। (বুখারী, মুসলিম) ২. আবু বাকর ইবন আবি শায়বা রহ. সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে সাতটি করে আজওয়া খেজুর (মদীনা শরীফে উৎপন্ন এক জাতীয় উৎকৃষ্ট মানের খেজুর) আহার করে, সেদিন তাকে কোন বিষ বা যাদু ক্ষতি করতে পারে না । (মুসলিম) ৩. এরপর রাসুল স.কে যাদু করার ব্যপারে বুখারীর দীর্ঘ হাদিসটি তো আছেই, হাদিসের সারকথা এই রকম “আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, লাবীদ ইবনে আসাম নামক এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে যাদু করে। একরাত্রে রাসুল স. বারবার দু‘আ করতে থাকেন। তারপর তিনি বলেনঃ হে ‘আয়েশা! তুমি কি বুঝতে পেরেছ, আমি আল্লাহর কাছে যা জানতে চেয়েছিলাম, তিনি আমাকে তা জানিয়ে দিয়েছেন। আমার নিকট দু’জন লোক এসেছিলো। তাদের একজন আমার মাথার কাছে এবং অপরজন দু‘পায়ের কাছে বসেন। একজন জিজ্ঞেস করলোঃ এ লোকটির কি ব্যথা? আরেকজন বললো, যাদু করা হয়েছে। প্রথমজন বলেনঃ কে যাদু করেছে? দ্বিতীয়জন বলেনঃ লাবীদ ইন আ‘সাম। প্রথমজন জিজ্ঞাসা করেনঃ কি দিয়ে? দ্বিতীয়জন উত্তর দেনঃ চিরুনী, মাথা আচড়ানোর সময় উঠা চুল এবং পুরুষ খেজুর গাছের খোসার মাধ্যমে….” (বুখারিতে বর্ণিত এই হাদিসটি বেশ দীর্ঘ) ৪. আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ যে ব্যক্তি জ্যোতিষ বিদ্যার কিছু শিক্ষা করলো, সে যেন যাদু বিদ্যার একটা শাখা আয়ত্ত করলো, এখন তা যত বাড়ায় বাড়াক। (আহমাদ, আবূ দাউদ) ৫. ইমরান বিন হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল স. বলেছেন- যে কুলক্ষণ নির্ণয় করে, আর যার জন্য নির্ণয় করা হয়।যে যাদু করে,আর যার জন্য যাদু করা হয়। এবং যে গণকের নিকট এলো এবং তাঁর কথা বিশ্বাস করলো..। এরা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (মুসনাদে বাযযার, সনদ হাসান) ।
ইবনে ক্বুদামা রহ. বলেন- এর দ্বারা হত্যা করা হয়। যাদুর প্রভাবে মানুষ মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। যাদুর প্রভাবে স্বামীস্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে। (এরপর ইবনে ক্বুদামা রহ. তাঁর কথার স্বপক্ষে কোরআন হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দেন) [আল মুগনী, ১০/১০৬ দ্রষ্টব্য]।ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন- সুরা ফালাক্বের ওয়া মিন শাররিন্নাফফাসাতি… আয়াত এবং আয়েশা রা, এর হাদিস দ্বারা প্রমাণ হয় যাদু নিঃসন্দেহে সত্য। [বাদাইউল ফাওয়ায়েদ, ২/২২৭]।”

আবরার এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনছিলো।বাতাসি বানু একজন হুজুরের মেয়ে ছিলেন,তাছাড়া সেকালের মানুষ হওয়ায় ধর্মের ব্যাপারে একটু জ্ঞান তার বেশিই আছে।আল্লাহর রহমতে ত্রিশ পারা কোরআন তার মুখস্ত বাংলা অর্থসহ।আবরার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে,
-“ইয়ারাবীর মেডিকেল রিপোর্ট ওকে যত দুর্বল দেখায় তার থেকে আরো বেশি দুর্বল থাকে।মাঝে মাঝে তো ঠিকভাবে হাঁটতে পর্যন্ত পারেনা।ওদের সেই তালেব হুজুরকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ইয়ারাবী আক্রান্ত কীভাবে হলো?কিন্তু উনি কিছু বলার আগেই চলে যান।”
-“যাদুর অনেক ধরণ আছেরে ভাই,প্রচলিত যাদুকে দুইভাগে ভাগ করে- ১. যেসব যাদুতে শয়তান পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে।২. যেসব যাদুর জন্য জিন-শয়তানদের কাছে সরাসরি সাহায্য চাওয়া হয়।”
-“ইয়ারাবীর তো তাহলে…”
-“হ্যাঁ,দুই নম্বরটা।কর্মপদ্ধতির দিক থেকে চারভাবে করা যায়- ১.যাকে যাদু করা হবে তাঁর ব্যবহৃত কোনো জিনিশ / কাপড় অথবা শরীরের কোন অংশ,২. কখনো যাদুকর নিজে পারেনা, তখন জিন দিয়ে যাদু করায়,৩. কখনো নিজে যাদু করে, সাথে জিনও পাঠায় ক্ষতি করার জন্য,৪. কখনো ব্যবহারের জিনিশ না পেলে মন্ত্র পড়া পানি বাড়ির সামনে ফেলে যায়, ওর ওপর দিয়ে হেটে গেলে যাদু লেগে যায়।তবে এসব করাও সহজ নয়,কীভাবে করে কী মূল্য দিতে হয় জানিনা।তুমি কালই ভালো হুজুর ডাইকে সিহরের জন্য রুকইয়া করে দিবা।মেয়েডা যে ডরাই দেখছো তুমি,কী হয়ে গেছে?আমার সামলে খাইছে,দেখলাম তো বিল্লির মতো খাবার খায়।”

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here