জীবন মানে তুমি পর্ব-৫৪

0
3833

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৫৪

(১৮৩)

আবরার আর কিছু না ভেবে একটান দিয়ে ওকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।ইয়ারাবী ভয়ে কাঁপছে আর ওর কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য যতো ছোটাছুটি করছে,ঠিক আবরার ততো শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে।এক পর্যায়ে আবরার শক্ত গলায় বলে উঠে,
-“এমন করলে কিন্তু আবার মারবো।”

ব্যাস ইয়ারাবী ভয়ে আর কিছু করেনা,শান্ত হয়ে যায় তবে নিঃশব্দে কান্না করছে।আবরার ওকে ছেড়ে দিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলে,
-“কান্না থামাও,তোমাকে বলেছিনা আমাকে মিথ্যা বলবেনা।তাহলে কেন বললে?আমি ফোন করলে কেন বললে তুমি অনুর বাসায় এসেছো।”

ইয়ারাবী কোনো কথা বলছেনা,ভয়ে গুটিয়ে বসে হিচকি তুলে কান্না করছে।আবরার খানিকটা ধমক দিতেই ইয়ারাবী কেঁপে বলে উঠে,
-“ভ…ভয়ে।”

আবরার কিছু উচ্চ শব্দে হেসে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-“ভয়ে বলোনি তাইতো!কিন্তু মিথ্যা বলার আগে এই ভয়টা তোমার মধ্যে কাজ করেনি যে আমি জানতে পারলো ঠিক কী করবো তোমার?বুঝতে পারোনা, আমার রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকেনা তবুও করো।ইচ্ছা তো করছে…..”

ইয়ারাবী চাদরটা দু’হাতে শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে বলে,
-“আ…আর করবোনা এমন।”
-“আর করবোনা,এই কথাটা মোট কতবার বলেছো বলোতো।আসলে আমারই ভুল,বেশি স্বাধীনতা দিয়েছি তোমাকে যার জন্য কথা শোনা বন্ধ করে দিয়েছো।নাউ লিসেন্ ইয়ারাবী,কাল থেকে ভার্সিটি-প্রাইভেট-বাসা এই তিনটা জায়গা ছাড়া কোথাও যেতে পারবেনা তুমি,আর যে কাজগুলো করো সেগুলোও করতে পারবেনা আজ থেকে।”

শেষের কথাটা ফ্লোরে দাঁড়িয়ে অনেকটা জোরে চিৎকার করে বলে উঠে আবরার।ইয়ারাবী দ্রুত বিছানা থেকে নেমে ওর পা ধরে বলতে থাকে,
-“প্লিজ এমন করবেন না।আমি আপনার সব কিছু মানবো….”
-“পা ছাড়ো ইয়ারাবী,এসব আমার একদম পছন্দ নয়।”
-“আপনি বললে আজ থেকে কারো সাথে কথা বলবোনা,তবুও আমার এইটুকু খুশি কেড়ে নিবেন না।”
-“দেখি তুমি আগে উঠো,জানো তো আমার পা ধরা একদম পছন্দ নয়।উঠো বলছি….”

কথাটা বলতে বলতে আবরার জোর করে উঠিয়ে দাঁড়ান করিয়ে দু’বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
-“ডু ইউ রিমেম্বার?কী বলেছিলাম আমি,আমার কথা না শুনলে এর ফল খারাপ হবে।”
-“আমি সব শুনবো তবুও….”
-“তুমি আজ বলছো কাল ভুলে যাবে।জানো তোমাকে নিয়ে কতটা ভয়ে থাকি।ওই পিয়াসের সাথে দেখা করতে যেয়ে খাওয়া আর মেডিসিন সব বাদ পরে গেছি।প্রতিমুহূর্ত চিন্তা হয় তোমাকে নিয়ে,আর তুমি…আমাকে জ্বালিয়ে মজা পাও।কী হলো চুপ করে আছো কেন?”

-“আবরার কী হচ্ছে এগুলো?”
মিসেস রায়হান গরম দুধ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে এই অবস্থা দেখে চেঁচিয়ে উঠেন।ইয়ারাবী করুন চোখে ওর শ্বাশুড়ির দিকে তাকাতেই উনি ইয়ারাবীকে টান দিয়ে নিজের কাছে আড়াল করে আবরারকে উদ্দেশ্য করে রাগী গলায় বলেন,
-“যা হয়েছে হয়েছে,এখানে এতো রিয়্যাক্ট করার তো কিছু দেখছিনা।আর ইয়ারাবী ঠিক সেইভাবে চলাফেরা করবে যেভাবে আগে করতো।কেননা বিয়ের আগে এমন কথায় হয়েছিলো।”
-“মম আমি শুধু বলেছি সোস্যাল কাজগুলো না করতে,পড়াশোনা তো বাদ দিতে বলিনি।পড়া শেষ হলে তারপর জব করবে।আর ও আমাকে পিয়াসের সাথে থেকে ফোনে মিথ্যা বলেছে,তাই একজন স্বামী হিসাবে রাগ করাটা স্বাভাবিক মম্।”
-“ও কাজগুলো অবশ্যই করবে।তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস?”

অাবরার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-“নো মম,গুরুজনদের সাথে বেয়াদবি করার শিক্ষা তোমরা কখনো দাওনি।”
-“বৌকে মারার শিক্ষাটাও তোকে কোনোদিন দেয়নি।তোর আব্বু-আবীর কথাটা জানলে কী হবে ভেবেছিস?মেয়েটার গায়ে জ্বর চলে এসেছে,কেমন পাষান্ড তুই এরপরেও আরো ধমক দিচ্ছিস?”
-“মম্ আমি…”

মিসেস রায়হান ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,
-“তোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছা নেই আমার।আর ইয়ারাবী তোর বাবা আজ সকালে বিজন্যাসের কাজে রাজশাহী গেছে,ফিরে আসা পর্যন্ত তুই আমার সাথে থাকবি।”

ইয়ারাবী কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে চোখের জল আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে।মিসেস রায়হান ওকে ধরে বিছানার একপাশে বসিয়ে দিয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মানলাম ও ভুল করেছে,তোকে মিথ্যা বলেছে।তোর কী উচিত ছিলোনা ভালো করে বিষয়টা শুনে ওকে বোঝানো,আলাদাভাবে কথা বলা।সেটা না করে তুই ছোট-বড় মানুষের সামনে মারবি।রাগটাকে সংযত কর আবরার,ও বাচ্চা মেয়ে যতই বলুক মানিয়ে নিতে পেরেছে কিন্তু সত্যি এটাই তোর সাথে আজও মানাতে পারেনি।”
-“মম আমার ভুল হয়ে গেছে,কী করবো আমি তুমিই বলো?ওকে প্রথম থেকে বলেছি মিথ্যা বলবে না আমাকে,ও জানেনা এক মিথ্যাকে ঢাকতে হাজার মিথ্যা বলতে হয়?আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘মিথ্যা তো তারাই বানায়, যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের ওপর ঈমান রাখে না। বস্তুত তারাই মিথ্যুক।’ (সুরা নাহাল, আয়াত: ১০৫)
মিথ্যা বলার অনুমতি রয়েছে যেসব কারণে
এক. যুদ্ধে মিথ্যা বলা বৈধ।
দুই. দু’পক্ষের মাঝে সমঝোতা করার জন্য মিথ্যা বলা বৈধ।
তিন. স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা ও মিল তৈরির করার জন্যও মিথ্যা বলা বৈধ।
আসমা বিনতে ইয়াজিদ বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তিন জায়গা ব্যতীত মিথ্যা বলা বৈধ নয়। স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য মিথ্যা বলা, যুদ্ধে মিথ্যা বলা এবং দু’জনের মাঝে সমঝোতা করার জন্য মিথ্যা বলা বৈধ। (তিরমিজি, হাদিস নং : ১৯৩৯; সহিহ আল-জামে : ৭৭২৩)
ও জানেনা এইগুলো?তবুও কেন করবে?বিয়ের দিন থেকে আমি ওকে বলেছি যে কোনো পরিস্থিতি হোক না কেন আমাকে জানাবে,মিথ্যার আশ্রয় নিবেনা।তবুও আমার কথা শোনেনা মেয়েটা।”

মিসেস রায়হান তাকিয়ে দেখে মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।উনি ইয়ারাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
-“আর কোনো হাদিসেও স্ত্রীকে প্রহার অর্থাৎ মারধোরের কথা বলা হয়নি সেটা ভুলে যাবিনা।”
-“মম্ আমার ভুল হয়েছে আমি জানি ইসলাম এটাকে সামর্থ্য করেনা,যে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলবে অযথা তার শাস্তি আল্লাহ্ দিবে।আর মারাও উচিত নয় কিন্তু রাগকে সংযত করতে পারিনা।ইয়ারাবী প্লিজ মাফ করে দাও, আমি চাইনা হাত তুলতে কিন্তু উঠে যায়।”

ইয়ারাবী কথাটা শুনে আবরারের দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যিই ওর মধ্যে এক অপরাধবোধ কাজ করছে।ওর চোখে-মুখে হারানোর ভয় ঝেকে বসেছে,তবে কী হারানোর সেটা ইয়ারাবী বুঝতে পারছেনা।আবরার ওর চুপ থাকা দেখে ওর সামনে যেয়ে ওকে ছুতে গেলেই ইয়ারাবী ভয়ে সরে যেয়ে ওর মায়ের পিছনে দাঁড়ায়।আবরারের এইটা দেখে বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে,মিসেস রায়হান ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মাফ করা আর না করা সেটা পুরো তোর ব্যাপার।এখানে তুই যা বলবি সেটা হবে…”
-“আম্মু,আমি জানি অপরাধ আ…আমার।হ্যাঁ, মেরেছেন সেটাই কষ্ট লেগেছে কিন্তু উনাকে ক্ষমা চাইতে নিষেধ করুন।উনি আমার স্বামী,উনার হক আছে আমাকে শাষন করার।”

আবরার শান্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছে।মিসেস রায়হান আড়চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আবার বলেন,
-“হ্যাঁ,শাষন করার হক আছে তাই বলে মারধোর নয়।তুই সহজে ক্ষমা করে দিবি।”
-“আম্মু উনি অন্যায় করেছেন ঠিকই আর আমি কোনো অভিমান করেনি যে ক্ষমা করতে হবে।তবে উনাকে বলুন উনি যেন আমাকে না মারে,ভুল করলে শাষন করুক।আর এমনটা নয় যে উনি আমাকে শুধু মারেন,ভালোও তো বাসেন আর কেয়ার করেন।এগুলো এই মারের কাছে কিছু নয়।”

উনি ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন মেয়েটা ভালোবাসার কাঙ্গাল।যে ভালোবাসাটা পরিবার থেকে পায়নি সেটা আবরারের কাছ থেকে পেয়েছে,তাই কোনো রিয়্যাক্ট করছেনা।অথচ ওর জায়গায় অন্য মেয়ে হলে তুল কালাম বাঁধিয়ে দিতো।তবে উনার ভয়ও হচ্ছে মেয়েটাকে নিয়ে,পরবর্তীতে আবরার যদি একই কাজ করে।পারবে তো মেয়েটা সামলাতে তার রাগী-মেজাজি ছেলেকে।আবরার ইয়ারাবী সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-“আমি সম্পূর্ন চেষ্টা করবো এসব জঘন্য কাজ না করতে।কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে পরবর্তীতে আমাকে না জানিয়ে কিছু করবেনা আর মিথ্যার আশ্রয়ও নিবেনা।”

ইয়ারাবী কথা না বলে মাথাটা নাড়ায়।ওর মা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে,এই ছেলেটা যে এতো রগচটা কীভাবে হলো সেটায় বুঝতে পারেননা।উনি ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ইয়ারাবী তোকে ক্ষমা করেছে বলে বেঁচে গেলি।”
-“মম্ তুমি আব্বু,ভাইয়াকে কিছু বলোনা প্লিজ।ভুল করেছি এমনটা আর করবোনা।”

আবরার দু’হাত জোরো করে ওর মাকে কথাটা বলে।উনি প্রতিত্তুরে জবাব না দিয়ে শুধু বলেন,
-“ওকে খাবারটা খাইয়ে দুধটা দিবি,আর যেন কোনো গোন্ডগোল আমি না দেখি।চৌধুরি বাড়িতে বৌদের গায়ে হাত তোলা কারোর পছন্দ নয়।ইয়ারাবী এ কিছু বললে ভয় পাবিনা সোজা আমাকে ডাকবি।”

মিসেস রায়হান কথাটা বলে ছেলের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই ইয়ারাবী জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে ওকে বিছানার এক কোনে বসিয়ে নিজে সামনে বসে। হাতটা ধুঁয়ে প্লেটের ভাত মাখাতে মাখাতে বলে,
-“আমাকে ঘৃণা হচ্ছে তোমার?”

ইয়ারাবী মাথা তুলে ওর দিকে নিষ্পাপ চাহনিতে তাকাতেই আবরার হেসে দেয়।ওর মুখের দিকে এক লুকমা ভাত তুলে ধরতেই ও মুভে নিয়ে নেয়।আবরার একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ছোট-বড় সবার সামনে আঘাত করেছি,কষ্ট দিয়েছি।এমনটা করবো না বলেও করেছি,ঘৃণা করাটা স্বাভাবিক।তার হাতে খেতে রাগ হচ্ছেনা?

ইয়ারাবী মুখের খাবারটুকু শেষ করে মৃদু স্বরে বলে উঠে,
-“কষ্ট হচ্ছে কিন্তু ঘৃণা-রাগ লাগছেনা।আমি জানি আপনি রাগী,আমার ভুল আপনাকে মিথ্যা বলা।ঘৃণা তো তাদের করে যারা ভালো না বেসে শুধু আঘাত করতে জানে।কিন্তু আপনিতো আমাকে ভালোবাসেন,আপনার জন্য ওই নরকের থেকে মুক্তি পেয়েছি,একটু শান্তিতে আছি।আমি জানি আপনি যেটা করেছেন সেটা রাগের বসে,কিন্তু আপনার এই রাগটাকেই বড্ডো ভয় পায়।”

আবরার এতোক্ষণ ওর কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলো তবে জবাবে ওকে কিছু না বলে খাবারটুকু খাইয়ে দেয়।তারপর গরম দুধের সাথে মেডিসিন দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়ে নিজেও খাবার খেয়ে নেয়।ইয়ারাবী বিছানায় ঘুমাচ্ছে,মুখটা অনেক ফুলে গেছে,আবরার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছে।এই সময় চেলসি রুমে ঢুকেই ইয়ারাবীর পায়ের কাছে মুখ ঘেষতে শুরু করে,আবরার হেসে বিছানা থেকে উঠে ওকে কোলে নিয়ে বেলকনিতে চলে যায়।তবে আরবার যে স্বাভাবিক আছে সেটা নয়,ইয়ারাবীকে মেরে ওর নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে।

(১৮৪)

সময় সময়ের মতো বয়ে চলে। সময়কে আটকে রাখার ক্ষমতা কারো নেই। আজ প্রায় একমাস পেরিয়ে গেছে প্রত্যয় আর অনুর দেখা হয়েছিল। অনু প্রায় ভুলে গেছে সেসব দিনের কথা। অনু ভাবছে প্রত্যয়ও হয়ত ওর কথা ভুলে গেছে। অনু এসব বিষয় নিয়ে এখন ভাবে না। কারণ ও এটা ভালো করেই জানে পৃথিবীতে এমন মানুষ খুব কম যে অনুর অতীত জেনেও ওকে ভালোবেসে গ্রহণ করবে।বারান্দায় খোলা হাওয়ায় দাড়িয়ে এসবই ভাবছিল।
একটু আগে পাশের বাসায় এক আন্টি এসে ওকে বলে গেল এত বয়স হয়ে গেল ও বিয়ে কেন করছে না,মানুষতো বিয়ের পরও পড়তে পারে।বেশি বয়স হলে বাচ্চা হতে সমস্যা হবে আবার জামাইও ভালো পাবেনা।ও অবশ্য ওই আন্টিকে বেশ কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিয়েছে।তাই আন্টি কথা না বাড়িয়ে চলে যায়।কিন্তু কতদিন আর মানুষের মুখ বন্ধ করা যায়।আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে মানুষ মানুষের সমালোচনা করতেই বেশি ব্যাস্ত থাকে। কেউ কারো বিপদে এগিয়ে আসে না বা কাউকে কোনো কাজে উৎসাহ দেয় না। সব সময় অন্যকে নীচে নামানোর চিন্তায় বিভোর থাকে।এই আন্টিও তাদের কাতারেই পরে।এসব নিয়ে বেশি ভাবতে চায় না অনু। কিন্তু এই অসুস্থ সমাজ অনুকে ভাবতে বাধ্য করে। হঠাৎ অনু নিজের পায়ে টান অনুভব করল। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর বিড়াল মোটা ওর পায়জামা ধরে টানাটানি করছে। যেন ভিতরের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। অনু মোটার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলে উঠে,
-“এভাবে টানছিস কেন? এভাবে টানাটানি করলে তো পড়ে যাব। আর ভিতরের দিকে কি আছে বলতো?”

মোটা কিছুতেই টানাটানি বন্ধ করছে না দেখে অনু মোটাকে কোলে নিয়ে ভিতরের দিকে পা বাড়াল। অনু যে ভিতরে গিয়ে এতবড় ঝটকা পাবে সেটা ও ভাবতেই পারেনি।কেননা ওর ডাইনিংএর বড় সোফাটায় প্রত্যয় আরাম করে বসে আছে। আসলে ওই আন্টি যাওয়ার পর মেজাজ এত খারাপ ছিল যে দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছিল। তাই হয়ত প্রত্যয় চলে এসেছে ভিতরে।এই ভাবছিলো যখন তখন মোটা অনুর কোল থেকে নেমে প্রত্যয়ের কোলে গিয়ে বসল। প্রত্যয় মোটাকে আদর করতে করতে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে অনু অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সব তো শেষ হয়ে গেছিল তাহলে আবার কেন এলো প্রত্যয়?অনুর এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে প্রত্যয় মোটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“আমি জানি আমি দেখতে সুন্দর। তাই বলে এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাবে?”

প্রত্যয়ের কথায় অনুর হুশ ফিরে,ও হালকা কেশে অবাক চোখে প্রত্যয়কে বলে উঠে,
-” আপনি এই সময় এখানে?”
-“আসতে নেই বুঝি?”

অনু কিছুটা থতোমতো খেয়ে বলে,
-“আমি ঠিক তা বলিনি।হঠাৎ করে তো,এই এক মাসে তো একবারো আসেননি। আজ হঠাৎ তাই আরকি….”
-“এতদিন আমাকে মিস্ করছিলে নাকি?”
-” আপনাকে মিস করার মতো কোনো কারণ নেই। আচ্ছা বসুন আমি একটু আসছি।”
-“আমি এখন কিছু খাব না। তোমার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে। বসো এখানে।”

অনুর প্রত্যয়ের সামনে রাখা বেতের গোল চেয়ারটার উপর বসলে বললো,
-“বলুন কি বলবেন?”
-“অনু আমি তোমার সাথে আমার বাকি জীবনটা কাটাতে চাই।”

অনু কিছুটা অবাক হয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠে,
-“আপনি এসব কী বলছেন?সবকিছু জেনে বুঝে….”
-“অণু অতীত নিয়ে যত ঘাটাঘাটি করবে, সেখানে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাবে না। অতীত শুধু আমাদের কাঁদায়।কেন সেটা ভেবে এখনও বসে থাকবে? সব কিছু ভুলে কি শুরু করা যায় না?”
-“করুণা করছেন?”
-“অণু ভালোবাসার মানুষকে আর যাই হোক করুণা করা যায় না।”
-“তাহলে এই একমাস আসেননি কেন?”

প্রত্যয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে,
-“সেদিন তোমার কথা শুনে পুরুষজাতির ওপর প্রচন্ড রাগ হয়েছিল। সবাই শুধু মেয়েদের দোষ দেয়। আসলে আমরা পুরুষজাতি যদি নিজেদের কন্ট্রোল না করতে পারি তাহলে মেয়েদের কখনই সুরক্ষিত করতে পারব না। মাথায় রাগ উঠে গেছিল। তোমার জীবন যে অতিষ্ঠ করে তুলেছে তাকে শাস্তি না দিয়ে শান্তি পাব কি করে বলতো? তবে ওকে ধরাটা সহজ ছিল না। ওকে ধরতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। সিলেটের একটা প্রত্যন্ত গ্রামে গা ঢাকা দিয়েছিল জানোয়ারটা। ওকে ধরার পর কোর্টে চালান করা হয়েছিল। ক্ষমতার জোরে হয়ত বেঁচে যেত কিন্তু ওকে সেই সুযোগ আমি দেইনি তিন বছরের সাজা হয়েছে ওর। জীবনে আর এরকম কিছু করার সাহস দেখাবে না।তাছাড়া তুমি জানো আমার পোস্টিং এই ঢাকাতে হলেও প্রচুর কাজের চাপ,অনেক বড় একটা অপারেশনও ছিলো।অনেকদিন থেকে বড় ধরনের ছুটির জন্য এপ্লাই করেছিলাম আমি সহ আরো তিনজন।আলহামদুলিল্লাহ্ আমার আর ইরাকের ছুটি মন্ঞ্জুর হয়েছে।একবারে ঈদের পরে যাবো,তবে ছয়মাসের আগে আর ছুটি হবেনা।”

একবারে কথাগুলো বলে থামল প্রত্যয়।অনুর দিকে তাকিয়ে দেখল অনুর চোখে জল টলমল করছে। প্রত্যয় তাড়াতাড়ি অনুর কাছে গিয়ে ওর গালে হাত রেখে বলল,
-“কাঁদছো কেন তুমি? ও আর কোনোদিনও তোমার জীবনে ফিরে আসবে না। ভুলে যাও তোমার কালো অতীতকে।”

অনু প্রত্যয়কে আচমকা জড়িয়ে ধরে বলল,
-“I am sorry.আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম আপনিও অন্য সবার মতো। আমার জীবনে হয়তো ভালো কিছু ঘটবে না। আমি হয়তো নতুন করে জীবনটা সাজাতে পারব না আর।”
-“এখন তো আমি এসে গেছি। এবার কি আমরা নতুন করে শুরু করতে পারি?”
-“হুম,কিন্তু আপনার পরিবার?উনারা কী মেনে নিবেন আমাকে?”

প্রত্যয় ওকে বুক থেকে সরিয়ে বলে,
-“ব্যাস অনু অনেক কেঁদেছ। আমি আর তোমার কান্না দেখতে চাইনা। এখন থেকে তুমি শুধু হাসবে।আর আমার পরিবার সেই চিন্তা করার দরকার নেই তোমার।আমার ভাই প্রাপ্ত তোমাকে ভাবী হিসাবে মেনে নিয়েছে,আমার আমার মা কিয়াকো তোমার ব্যাপারে জানে উনি বাবাকে ম্যানেজ করে নিবে।”

অনু অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে বলে,
-“আপনি আপনার মায়ের নাম ধরে ডাকেন?আর নামটা এমন অদ্ভুত কেন?”
-“কারন উনি বাঙ্গালি না,আমাদের বায়োলজিক্যাল মা জন্মের সময়ই মারা যায়।বাবা ব্যবসার কাজে বিদেশে অনেকবার যেতে,তখন উনি আসেন তার জীবনে।প্রথমে আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিলো কিন্তু উনার ব্যবহারে মেনে নিতে বাধ্য হলাম।এই তোমাকে বলা হয়নি আমাদের একটা ছোট বোন আছে,ফিলা।যদিও আমাকে দেখে ভয় পায় তবে প্রাপ্তের সাথে খুব মিল।এবার দেশে আসলে দেখা করিয়ে দিবো।”
-“বয়স কতো ফিলার?”
-“এবার তোরোতে পরবে।মা বলেছে বিডিতে বার্থডে সেলিব্রেট করবে।”

অনু মুচকি হেসে প্রত্যয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। প্রত্যয়ও তার ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গিনীকে দুই’বাহু দ্বারা আবদ্ধ করে নেয়।তাদের মধ্যে কেউ আর বাঁধা হয়ে দাড়াবে না।

(১৮৫)

সন্ধ্যার দিকে ইয়ারাবীর ঘুম ভাঙে,পাশে চোখ যেতেই দেখে চেলসি মাথা নিচু করে শুয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ওর দৃষ্টিতে অভিমান ভর করেছে,বোবা প্রানীরা কথা না বলতে পারলে আচরনে বুঝিয়ে দেয়।ইয়ারাবী চেলসির গায়ে হাত বুলিয়ে বলে,
-“কী হয়েছে আমার চেলসির,এভাবে অভিমান করে আছে কেন?”

আদর পেয়ে চেলসি ওর কোলে গুটিয়ে যেয়ে বসে।সচারচর চেলসি এমন আচারন করেনা,কিন্তু আজ এমন করাতে কিছুটা অদ্ভুত লাগলো ওর।ও চেলসিকে কোলে নিয়ে বেলকনিতে যেয়ে দেখে একটা ছোট ঝুড়ির মধ্যে গোলাপী কাপড়ের উপর দু’টা ছোট পার্সিয়ান সাদা আর বাদামী রঙের বিড়ালের বাচ্চা,আর ঝুড়ির হাতলের সাথে বড় একটা স্যরি কার্ড ঝুলানো।ওর হেসে সামনে তাকিয়ে দেখতেই অবাক হয়ে যায়,কেননা আবরার কান ধরে হাটু ভাজ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ইয়ারাবী না চাইতেও শব্দ করে হেসে ফেললো,তখনি পাশের বেলকনি থেকে মেঘ ঘটনাটা ক্যামেরাতে বন্দী করে নিয়ে শিস বাজিয়ে চলে যায়।আবরার কিছু অপরাধী সুরে ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে,
-“মাফ করবেনা আমাকে?”
-“আবার কী করেছেন যে মাফ চাইছেন আপনি?”
-“কেন তোমাকে আঘাত করেছি?”
-“আমি রাগ করিনি তাই মাফ করার তো কোনো প্রশ্নই অাসেনা।আর যদি রাগ করার কথা হতো তবে আপনার হাতে খেতাম না।”

আবরার কথাটা শুনে হেসে ফেলে,তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-“ইয়ারাবী তুমি মুখে না বললেও তোমার চোখ দেখি বুঝতে পারছি অভিমান অনেক জমে আছে।আর দুপুরের কথা সেটা তুমি এক প্রকার ভয়ে করেছো সেটাও আমি জানি।আমার উচিত হয়নি তোমার গায়ে হাত তোলা,নিজের ভিতর কুঁকড়ে যাচ্ছি অপরাধে।”

আবরার যেটা বলছে সেটা সম্পূর্ন ঠিক,ইয়ারাবীর মনের কোনে অভিমানের মেঘ জমে আছে।ওর ব্যাবহারের কথাটা মনে পরলে ভয়ে শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে সাথে কষ্টও হয়।ও আবরারকে কিছু বলেনা,চেলসিকে কোল থেকে নামিয়ে বিড়াল ছানা দু’টাকে হাতে নিয়ে চেলসির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“এখন বুঝেছি আপনার অভিমানের কারণ কী?কিন্তু আব্বুর তো বিড়াল পছন্দ নয়,উনি দেখলে রাগ করবেন।”
-“আব্বুর বিড়াল পছন্দ নয় এটা ভুল,আর এই দু’টা বাচ্চা পটি ট্রেন্ড।তাই তোমাকে চিন্তা করতে হবে।য়ুহারের সাথে প্রথম দেখায় বলেছিলো তোমার বিড়াল পছন্দ।ভয় পাওয়ার কারণ নেই, এই কেউ তোমার বাচ্চা দু’টাকে মেরে ফেলবেনা আর চেলসি বিড়ালকে আক্রমণ করেনা।অভিমান করেছে ওর ভালোবাসায় ভাগ না পরে যায় তাই।”

ইয়ারাবীর মায়ের আচারনটা মনে পরতেই কষ্ট লাগে,নিজেকে সামলে ফ্লোরে বসে তিনটাকে আদর করতে থাকে,তবে চেলসি বিড়াল দু’টাকে দেখে ইয়ারাবীর কোলে মাথা রেখে বোঝায়,আমার আরো আদর চায়।

রাতে ডিনার শেষ করে ঘরে যাবে এমন সময় মিসেস রায়হান বলেন,
-“ইয়ারাবী,রাতে আমার কাছে থাকবি।”

ইয়ারাবী কথাটা শুনে আবরারের দিকে তাকাতেই ও বলে,
-“মম্ ওর গায়ে জ্বর এসেছে,রাতে সমস্যা হবে।”
-“মেয়েটার কষ্টতো তোর জন্যই হচ্ছে।”

আবীর পানির গ্লাস রেখে বলে,
-“মম্ ইয়ারাবীর ওর জন্য কষ্ট…কিছু বুঝলাম না।আর ইয়ারাবী তোমাকে মুখে এভাবে দাগ কেন?মনে হচ্ছে কেউ মেরেছে।”
-“কে আবার?তোমার এই ভাই মেরেছে মেয়েটাকে?মানলাম ভুল করেছে তাই বলে ছোটবড় সবার সামনে মারতে হবে।”
-“কী?আবরার তোর থেকে এসব আশা করিনি।”

আবরার মাথাটা নিচু করে বলে,
-“ভাইয়া আমার ভুল…”
আবীর আর কোনো শুনেনা,প্রচুর বকে ওকে।এমন রাগতে সচারচর আবীরকে দেখা যায়না।ইয়ারাবী বারবার থামতে বলছে আবীরকে,কিন্তু কে শোনে কার কথা।আবীরের রাগ দেখে ইকরাও কোনো কথা বলেনা,জারবা-মেঘতো ভয়ে ঘরে দৌঁড় মেরেছে,আবরার চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের বকা হজম করছে।অনেক কষ্টে ওদের মা যেয়ে থামায়।ইয়ারাবীকে নিজের কাছে রাখতে চাইলে ইয়ারাবী শ্বাশুড়িকে মানা করে দেয়।

রোজ রাতের মতো আবরারের বুকের উপর মাথা রেখে ঘুমাতে যায় ইয়ারাবী।কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসছেনা,চোখ বন্ধ করলে আবারের রাগী চেহারাটা ভেসে উঠেছে।হঠাৎগালের উপর আবরারের হাতের আলতো স্পর্শ অনুভব করে যেখানে মেরেছিলো ওর।আবরার দীর্ঘ করে শ্বাস নিচ্ছে, মনে হচ্ছে কান্না করছে।ইয়ারাবী শ্যাডো আলোতে মাথাটা হালকা ঘুরিয়ে দেখে,হ্যাঁ আবরার কাঁদছে।চোখগুলো বন্ধ থাকলেও কর্নার দিয়ে পানি পরে বালিশ ভিজছে।

(১৮৬)

আবরার তড়িঘড়ি করে ইয়ারাবীকে ডাকছে,কিন্তু মেয়েটার উঠার নাম নেই।নামাযের পর ঘুমিয়েছে, আসলে দুর্বলতার জন্য এমন হয়েছে।তবুও অনেক ইয়ারাবী কষ্টে ঘুম ছুটিয়ে উঠে দেখে বসে বলে,
-“ক…কী হয়েছে?আপনাকে এমন কেন দেখাচ্ছে,আমি কিছু ভুল করেছি?”
-“সব সময় এমন কেন মনে হয় তুমি ভুল করেছো?উঠে দ্রুত গুছিয়ে নাও।”
-“কী হ…হয়েছে?এখন তো সাড়ে ছয়টা বাজে,কোথায়…”

আবরার ওকে থামিয়ে দিয়ে,ইয়ারাবীর ড্রেস আর বোরখা কাবার্ড থেকে বের করে দিয়ে বলে,
-“তোমার মনি ফোন করেছিলো,তারা সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলো কাল।ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে,মেডিকেলে আছে…”

ইয়ারাবী কথাটা শুনে দ্রুত লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,
-“কী বলছেন আপনি?কাল সকালে স্টারপুর সাথে ক…কথা হয়েছে।স্টারপু এমন…কেন করবে?”
-“ইয়ারাবী তুমি নিজে অসুস্থ উত্তেজিত হবেনা প্লীজ,আর আপু এখন ঠিক আছে।তুমি তৈরি হয়ে নাও সোনা।”

ইয়ারাবীর ওর খালার সময়ের কথা মনে পরে,ঠিক এমন স্বাভাবিক ব্যাবহার করে আবরার বুঝিয়ে ছিলো খালার কিছু হয়নি।কিন্তু পরে শোনা গেল আবরার সবটা জেনে ওকে মিথ্যা বলেছিলো।ইয়ারাবী ভীতু চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আ…আপনি সত্যি বলছেন?স্টারপুর সত্যিই কিছু হয়নিতো?”

আবরার ওর দু’গালে হাত রেখে বলে,
-“একদম সত্য সোনা,তোমার আপু ঠিক আছে।কাল বিষ খেয়ে গলায় দঁড়ি দিয়েছিলো,মানে বাঁচানোর কোনো চান্স রাখতে চেয়েছিলোনা।কিন্তু তোমার বাবাই দেখে ফেলেছিলো তাই বেঁচে গেছে।তৈরি হয়ে আসো….”

ইয়ারাবীর মাথা কাজ করছেনা,কাল যখন কথা বলছিলো তখন ওর গলার স্বর কেমন একটা লাগছিলো।কিন্তু ও জিজ্ঞেস করলে বলেছিলো, গলা ভেঙে গেছে।এখন বুঝতে পারছে গলা ভাঙেনি,আসলে ওর বোন কাঁদছিলো।ইয়ারাবী ড্রেস পরে বাইরে আসতেই আবরার ওকে তৈরি হতে সাহায্য করে।

তারপর বাসার সবাইকে বলে মেডিকেলের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে।গাড়িতে কেউ কোনো কথা বলেনি,ইয়ারাবী শুধু আল্লাহকে ডেকেছে যে ওর আপুর যেন কিছুনা হয়।জ্যাম না থাকায় ঘন্টাখানিকের মধ্যে ওরা হাসপাতালে পৌঁছায়, আবরারের কাছে সম্পূর্ন তথ্য ছিলো বলে খুঁজে পেতে সমস্যা হয়না।তারার কেবিন নাম্বার শুনে ওই জায়গায় যেয়ে দেখে মিসেস ফাতেমা উনার স্বামী বসে কান্না করছেন,সাথে ইরাক আর তারার এক চাচাতো ভাই আদ্র আছে।আর কেবিনের মধ্যে ইফাজসহ আরো একজন ডাক্তার আর নার্স তারার ট্রিটমেন্ট করছে।মিসেস ফাতেমা ইয়ারাবীকে দেখার সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন, একমাত্র মেয়ে উনাদের,সাত রাজার ধন।আবরার তারার বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী হয়েছে আঙ্কেল?”
-“আসলে আমি ব্যাবসার কাজে বাইরের থেকে দুপুরে বাসায় আসি,এসেই দেখি মেয়ে মনমরা হয়ে বসে আছে।সচারচর এই সময় ও দু’টো বাচ্চাকে পড়াতে ওদের বাসায় যায়,আমি না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলে আর যাবেনা।বিকাল ছয়টার দিকে ও বাইরে থেকে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়।টমিকে ঘুরাতে নিয়ে যায় বাগানে কিন্তু যায়নি।তাই আমি ওকে ডাকতে যায়, কিন্তু মেয়ে ঘরের দরজা খোলেনা।মনটা কু ডাকছিলো তাই আদ্রকে ডেকে ঘরের দরজা ভেঙে দেখি ফ্যানের সিলিং এর সাথে গলার ওড়না নিয়ে ফাঁস দিয়ে ছটফট করছে আর মুখ থেকে ফ্যানা উঠছে।দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে জানতে পারি বিষ খেয়েছে, ওরা ওয়াশ করলেও অবস্থা ভালো ছিলোনা তাই ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়।”

ইয়ারাবী চোখ মুছে ওর ফুপার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“বাবাই স্টারপু এমন কেন করবে?”
-“তা জানিনা মা,একমাত্র তারা নিজেই বলতে পারবে কথাটা।”

আবরার উনাকে বলে,
-“আম্মু-আব্বু জানেনা?”

ইরাক ওর পিঠে চাপর দিয়ে বলে,
-“উনারা মাঝরাত থেকে এখানেই ছিলো, ইয়ামিলার খুব জ্বর,তাই তোরা আসার আগে চলে গেছে।পিচ্চি কাঁদিস না ও ঠিক আছে, মুখটা খুলে ফেল,গরম বসে যাবে ঘামে।”

ইয়ারাবীর মুখ খোলার কথা শুনে চমকে উঠে,ওর মুখে এখনো মারের দাগ বোঝা যাচ্ছে।নেকাবের কারনে কপালের ব্যান্ডেজ বোঝা যাচ্ছেনা,কিন্তু খুললে ইরাক এক মিনিটে বুঝে যাবে।ইরাক ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কী হলো খোল?অনেকদিন ধরে তোকে দেখিনা, দেখবো তো কেমন রেখেছে আবরার আমাদের জানের টুকরোকে?আর তারা একদম ঠিক আছে, ইফাজরা জাস্ট চেকআপ করার জন্য ভেতরে গেছে।”

কথা বলতে বলতে ইফাজেরা বের হয়।উনারা বলে, তারা ঠিক আছে তবে কথা বলতে কয়েকদিন কষ্ট হবে।কেননা দঁড়ির জন্য গলায় চাপ লেগেছে তাই ওয়াশ করাতে আরো খারাপ অবস্থা।দেখা করার অনুমতি দেওয়ার সাথে সাথে সবাই ভিতরে ঢুকলো,কিন্তু ইয়ারাবী ভিতরে ঢুকতে গেলে ইফাজ ওর টান দিয়ে আড়ালে নিয়ে যায়।
-“কী হয়েছে ভাইয়া?”
-“কী হয়েছে সেটা তুই বলবি?তারা সুইসাইড কেন করতে গেছিলো?তোর সাথে তো সব কথা হতো?”

ইফাজ চোখ রাঙিয়ে কথাটা বললে ইয়ারাবী মাথা নিচু করে বলে,
-“বিশ্বাস করো ভাইয়া,স্টারপুর সাথে দুপুরে কথা বললেও স্টারপু এমন কিছু বলেনি।শুধু বলেছিলো নিজের খেয়াল রাখতে আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা শুনতে।আর একটা কথা বলেছিলো।”
-“কী কথা?”
-“বলেছিলো,মনে হয়ে ইফাজ ভাইয়ার বৌ হওয়ার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে।আমি কারণ জানতে চাইলে বলে সময় হলে বুঝবি,কষ্ট পাবিনা।”

ইফাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলে,
-“চল,তারার সাথে কথা বলবি।তোর গায়ে জ্বর কেন?”
-“না মানে বেশি পানিতে গোসল করার জন্য হয়েছে।তুমি চলো…”
-“সত্যি তো?আচ্ছা চল….”

(১৮৭)

ইয়ারাবী তারার পাশে বসে বলে,
-“স্টারপু এমন কেন করলে?আমাদের কথা একটা বারও ভাবলেনা?”

তারা ইয়ারাবীর নেকাবের উপর দিয়ে মুখে হাত বুলিয়ে চোখের পানি ছেড়ে কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলে,
-“তোদের কথা ভে…বেছি বলেই করে…ছিলাম সোনা।”
-“মানে?”

ইরাক ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“পিচ্চি,আপুকে না হয় পরে জিজ্ঞেস করিস।দেখছিসনা আপুর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।”
-“আমি ঠিক আছি ইরাক ভাইয়া,আমার জন্য বাকীদের কষ্ট হচ্ছে আজ।”
-“সেটা তো হচ্ছেই,তুমি জানো তোমার বাবা-মা কতটা কষ্ট পেয়েছে।কিছু করার আগে একটা বার ভাবলে না।এখন জানতে চাইবোনা কী হয়েছে?তবে নিজের অনুমান থেকে একটা কথাই বলবো,
কেউ যাবে তো কেউ আসবে,এটাই পৃথিবীর নিয়ম।তবে একজনের অপকর্মের জন্য নিজেকে বলি দেওয়া কী ঠিক হবে?একদিনের জঘন্য অন্যায় নিজে মনের কোঠায় গেথে ২৫ বছরের ভালোবাসাগুলো বিসর্জন দিয়ে এভাবে চলে যাবে?”

তারা বুঝে ইরাক কিছুটা বুঝতে পেরেছে,তাই কোনো জবাব দেয়না।শুধু ইয়ারাবীর মুখে হাত রেখে বলে,
-“কেঁদে তো চোখ লাল করেছিস,বলেছিনা কষ্ট পাবিনা।নেকাব খোল,পুতুলটাকে দেখি।”

কথাটা শুনে ইয়ারাবী আবরারের দিকে তাকিয়ে দেখে ও বন্ধুদের সাথে কথা বলছে।ওর এদিকে মুখ খুললেও বিপদ আবার না খুললেও সমস্যা,বুঝতে পারছেনা কী করবে?শেষমেষ মুখটা খুলতেই তারা চমকে উঠে বলে,
-“পুতুল তোর মুখে আঙ্গুলের দাগ কেন?আর কপালে কী হয়েছে?”

ইরাক,ইফাজ এমন কথা শুনে ওর মুখের দিকে তাকিয়েই যা বুঝার বুঝে যায়।দু’জনের তো রাগে শরীর ফেঁটে যাচ্ছে,ইয়ারাবী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তারাকে বলে,
-“স্টারপু ওটা কিছুনা,পরে যেয়ে কপালে ব্যাথা পেয়েছি।”

ইরাক রাগী কণ্ঠে ওকে উদ্দেশ্য করে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“পরে কপালে আঘাত পেয়েছিস সেটা না হয় বুঝলাম কিন্তু মুখের দাগ?এটা তো আর পরে গেলে হয়না।আমাদের কী বাচ্চা পেয়েছিস যে যা বোঝাবি তাই বুঝছো?আবরার তোর সাহস কী করে হয় ওর গায়ে হাত তোলার,তুই জানিস না ও অসুস্থ?সব যেনেশুনে ওকে মারতে তোর একটুও লজ্জা করলোনা,ভুল করলে মারবি এটা কোন নিয়ম?”

ইফাজ ওর দিকে বলে,
-“এবার বুঝেছি জ্বরের কারণটা,আর এর জন্যই তুই মুখ খুলছিলিনা।আবরার?”

এক-দুই কথায়,ইরাক-ইফাজ মিলে আবরারকে প্রচুর কথা শোনায়।ইয়ারাবী,মনি অনেক চেষ্টা করছে ওদের থামাতে কিন্তু থামছেনা।আবরার ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“দেখ আমার ভুল হয়ে গেছে,আমি ক্ষমা চেয়েও নিয়েছি।”
-“তোর ক্ষমার…..কী করেছিস মেয়েটাকে?”
-“রাগের বসে হাত উঠে গেছে…..”
-“চুপ একদম চুপ,আমরা জানি তোর রাগ অনেক।তাই বলে এভাবে মারবি,পইপই করে তোকে বলেছি ভুল মানে শাষন তবে মারবিনা।বারো বছর তো অবহেলা-অত্যাচারে কেঁটে গেছে।ভাবছিলাম তোর কাছে থাকলে একটু ভালোবাসা পাবে,শান্তি পাবে কিন্তু তুই?”

ইরাক আবরারের শার্টের কলার ধরে চিল্লিয়ে কথাটা বলে,ইয়ারাবী দ্রুত ওকে ছারিয়ে দিয়ে বলে,
-“ভাইয়া ভুলটা আমার ছিলো,প্লীজ উনাকে কিছু বলেনা।তাছাড়া এমন নয় উনি খারাপ আচারন করেন।”
-“তুই চুপ থাক,এখনি আমার সাথে বাসায় যাবি।”
-“আমি ওই বাড়িতে যাবো তুমি ভাবলে কী করে?আবরার আমার স্বামী,উনাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা।উনি প্রমিজ করেছেন,এমন আর করবেন না।”
-“তোর বাসা একটা নয়।চল আমার সাথে….”

আবরার নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে,কিন্তু দু’ভাই মানবার পাত্র নয়।ইয়ারাবী যেতে চাইছেনা, যদিও অভিমান আছে কিন্তু সন্ধ্যার ক্ষমা চাওয়াটার জন্য মাফ না করে পারেনি।ইরাক ওর আপত্তি দেখে নিজের কসম দিয়ে দিলে ইয়ারাবী করুন চোখে একবার স্বামীর দিকে তো একবার ভাইদের দিকে তাকাই।শেষমেষ যেতে হয় ভাইয়ের সাথে।ইরাক ওকে সাথে নিয়ে আগে মেডিকেল থেকে বেড়িয়ে গাড়ির কাছে চলে যেতেই আবরার করুন চোখে চেয়ে দেখে।বুকটা ভেটে যাচ্ছে ওর, ইফাজ ওর দিকে একটা লম্বা হাসি দিয়ে আলিস্যি ছেড়ে বলে,
-“বোঝ বেটা,বৌ দূরে গেলে কেমন লাগে?”
-“মানে?আমি তো বলেছি….”

ইফাজ কিছুনা বলে হাসতে হাসতে চলে যায় কেবিনের দিকে।আবরার ওর দিকে কিছুটা অবাক চোখে চেয়ে হঠাৎ করে নিজেই ফিক করে হেসে মাথায় চাপড় মারে।আর তারা,মনি এদের পাগলামির কিছু বুঝতে না পেরে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে।

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here