জীবন মানে তুমি পর্ব-৫২

0
3708

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৫২

(১৭৬)

রাত দু’টা বাজে,হঠাৎ করে আবরারের ঘুম ভেঙে যায়।শ্যাডো ল্যাম্প জ্বালিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নেয়।এটা সঠিক সময় তাহাজ্জুদের নামায আদায় করার।খানিকটা আড়মোড়া ছেড়ে উঠতে যেয়ে বুকে আর পেটের উপর ভারি কিছু অনুভব করে।মুচকি হেসে তাকিয়ে দেখে ইয়ারাবী ওকে কোল বালিশ বানিয়ে ঘুমাচ্ছে।আবরার আস্তে করে ওকে বালিশে ঠিক ভাবে শুয়ে দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দেয়।তারপর ওয়াশরুমে যেয়ে অযূ করে বের হয়ে আসে।নামাযে দাঁড়ানোর আগে কী মনে করে একবার ইয়ারাবীর কপালে চুমু একেঁ দেয়।

আবরারের পরপর আট রাকাত নামায আদায় করা শেষ।হঠাৎ করে কারো চাপা গোঙানির আওয়াজ শুনতে পায়।ও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নামায আদায় করতে থাকে।রাবো রাকাত নামায আদায় করার পর মনে হলো ইয়ারাবী কিছু বলছে।ও দ্রুত নামায শেষ করে বেডের দিকে তাকিয়ে দেখে ইয়ারাবী ঘুমের ঘোরে ছটফট করছে।ও দ্রুত ইয়ারাবীকে ডাকে কিন্তু ও ঘুম থেকে জাগে না বরং বারবার একটা কথায় কলছে;”আমি যাবোন,আমি কোথাও যাবো।”উপায়ন্ত না পেয়ে আবরার পাশ থেকে গ্লাসের পানি নিয়ে ওর মুখের উপর ছিটিয়ে দিতে ও চিৎকার করে তাড়াতাড়ি উঠে বসে।সামনে তাকিয়ে আবরারকে দেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, ওর কাছে এই জায়গাটা বেশি নিরাপদ মনে হচ্ছে।এখানে থাকলে কেউ ওকে নিয়ে যেতে পারবেনা।এখনো ভয়ে কাঁপছে মেয়েটা আর বারবার বলছে,
-“নিয়ে যাবে নিয়ে যাবে আমাকে?আমি কোথাও যাবোনা।”

আবরার ওর মুখটা তুলে ধরে বলে,
-“কে নিয়ে তোমার?”
-“ও…ওহ নিবে…”
-“কে সে?কেউ তোমাকে নিয়ে যাবেনা।তুমি ভয় কেন পাচ্ছো,খারাপ স্বপ্ন দেখেছো।”
-“না না স্বপ্ন দেখেনি,সত্যি এখানে কেউ ছিলো।আমার হাত ধরে টানছিলো।”
-“এখানে আমি আর তুমি ছাড়া কেউ নেই ইয়ারাবী।অযথা ভয় পাচ্ছো তুমি।”

ইয়ারাবী রেগে আবরারকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
-“আমাকে কী পাগল মনে হয় আপনার?আমি বলছি কেউ ছিলো,সব সময় থাকে।আজ সুযোগ পেয়ে নিতে এসেছিলো।”
-“ইয়ারাবী আমার কথা শুনো….”
-“কোনো কথা শুনবোনা,আমি বলছি কেউ ছিলো এখানে।ওর হাতটা প্রচন্ড গরম ছিলো।আমার ডান হাত ধরে টানছিলো,এখনো ব্যাথা করছে।আপনি নিজেই দেখেন,তবে বিশ্বাস হবে।”

ইয়ারাবী কথাটা বলে আবরারের দিকে হাতটা এগিয়ে দিলো।আবরার বড় লাইটটা অন করে দেখে ইয়ারাবীর ডান হাতে তিন আঙ্গুলে গভীর দাগ বসে আছে লাল বর্ণ ধারণ করে আছে,মনে হচ্ছে কোনো অাগুনের ছ্যাকা লেগেছে।আবরার দাগটা দেখে কিছুটা চিন্তায় পরে যায়, দাগের উপর হাত রাখতেই ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে।আবরার ওর মুখটা দু’হাতে ধরে বলে,
-“তুমি দেখেছিলে কে ছিলো?”
-“না,ছ…ছায়া দেখেছি,বললো অনেক দিন পরে সুযোগ পেয়েছে আমাকে সাথে নিয়ে যাবে।আমি কোথাও যাবোনা আবরার।আমার ভয় করছে, প্লীজ আমাকে ধরে রাখুন। ”
-“একদম কান্না করবেনা,এখন শুয়ে পরো।সকালে তো আপুর বিয়েতে যেতে হবে তাইনা।আর কিছু হবেনা,আমি ধরে রেখেছি তোমাকে।”
-“কিন্তু ঘুমালে যদি আবার….”
-“হবেনা আমি আছিতো,কারো সাহস নেই তোমাকে নিয়ে যাওয়ার।”

আবরার ইয়ারাবীকে বালিশে শুয়ে দিয়ে ওর হাতে একটা মেডিসিন লাগিয়ে দেয় যাতে করে ব্যাথা চলে যায়।তারপর লাইট বন্ধ করে নিজেও ওর পাশে শুয়ে পরে।

পরদিন ভোর সকাল সাতটায় ইয়ারাবী উঠে আবরারকে তাড়া দিচ্ছে তৈরি হয়ে নেওয়ার জন্য।কিন্তু মহাশয় সোফায় বসে আরাম করে কফি খাচ্ছে আর ল্যাপটপ চালাচ্ছে।
-“আবরার,আপনি কী যাবেন না?”

ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমার কী মনে হয়?”
-“প্লীজ চলুন না,কাল রাতে কিন্তু ওয়াদা করেছিলেন।”

আবরার ল্যাপটপ থেকে চোখ উঠিয়ে ওর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আবরার কাজে মন দিয়ে বলে,
-“করেছিলাম নাকী?আমার তো এমন কিছু মনে পরছেনা।”
-“মুখে বলেননি কিন্তু মনে মনে ঠিক করেছিলেন।ও আবরার আপনি না ভালো ছেলে,ভাইয়ারাও যাচ্ছে,চলুন না মি.বর।”
-“উহু,আমি ব্যাড বয়….”
-“ওই আপনি নিয়ে যাবেন না তাহলে।হাতি কাঁদায় পড়লে চামচিকাও লাথি মারে….”

শেষেন কথাটা ইয়ারাবী মুখ ফুলিয়ে বিরবির করে বললেও আবরারের কান পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছায়।ও কিছুটা রাগী কন্ঠে বলে,
-“আমি চামচিকা?”
-“শুনে ফেলছেন?”

আবরার কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে চোখ রাঙিয়ে বলে,
-“তোমার কী মনে হয় আমি কানে শুনিনা।”
-“আ…আমি সেটা বলতে চাইনি।আপনি র..রেগে যাচ্ছেন কেন?আপনি জানেন তো মাঝে মাঝে উল্টো-পাল্টা বলি।”

আবরার ওর কথা শুনে রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।ওর চোখ দেখে ইয়ারাবীর ভয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে,মনে হচ্ছে এখনি কেঁদে দেবে।আবরার ওর অবস্থা দেখে এক মিনিট পরে হো হো করে হাসা শুরে করে দিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে গাল টেনে বলে,
-“আমি কী বলেছি আমি নিয়ে যাবোনা।কিন্তু যদি জার্নিতে বাই চান্স কিছু হয় তাহলে…”
-“কিছু হবেনা,”
-“দেখা যাবে,বসো আমি তোমার ড্রেস বের করে দেয়।গোসল করবে?”
-“জ্বি….”
-“অপেক্ষা করো।আমি মমকে ডেকে দেয়,ভাবী তো পারবেনা।”

আবরার কথাটা বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলে ইয়ারাবী ওর ল্যাপটপ দিয়ে অনুকে ভিডিও কল দেয়।অনু আজ কলেজে যায়নি,বাসায় বসে কম্পিউটারে মুভি দেখছে,যার জন্য রিসিভ করতে বেশি সময় লাগেনি।অনু কলটা রিসিভ করে জোরে চিৎকার করে উঠে,কেননা অনেকদিন পর প্রিয় বান্ধবীর চেহারা দেখছে।অনু অনেকটা উল্লাসিত কন্ঠে বলে উঠে,
-“কেমন আছসি ইয়ু,কতদিন পরে তোকে দেখলাম।কাজের চক্কোরে তোর বাসায় যেতেই পারিনা বলে রাগ করিসনা।তুই নেই তাই অনেক কিছুই এলোমেলো।আমরা সবাই তোকে মিস করছি শুধু মেঘ ছাড়া, কেননা ওতো ওই বাড়িতেই থাকে।কবে তুই ঠিত হবি আর কবে আসবি।জানিস ইয়ু….”
-“থাম আমার মা,সব কথা তো একাই বলছিস আমাকেও কিছু বলতে দে।আমি এখন কিছুটা ঠিক আছি,কাল সেলাই কাঁটছে।জানিস আজ যুহার আপুর গাঁয়ে হলুদ।”
-“হুম জানি,নিলয় এসেছিলো।রাতে গাঁয়ে হলুদ হবে।তুই কী এই অবস্থায় যাবি,জিজু কী বলেছে?”
-“আমার জান আমি যাচ্ছি।অবশ্য মানাতে খুব কষ্ট হয়েছে তাকে।আম্মু রাজী করিয়ে নিয়েছে।”
-“তোর শ্বাশুড়ির মতো যদি আমারও একটা শ্বাশুড়ি হতো…”

ইয়ারাবী আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
-“তোর বিয়ে হয়েছে?”
-“না তবে ভবিষ্যৎ শ্বাশুড়ি আরকী,জানিস কাল কী হয়েছে?”
-“কী?”

অনু কিছুটা হাই তুলে অালিস্যি ঝেড়ে বলে,
-“গ্রামে যেয়ে নাই বলবো যেহেতু যাচ্ছিস।খামোখা কথা খরচ ক্যান করবো।”
-“বিল্লির মা কোথাকার।আচ্ছা যেয়ে দেখা হবে,আর ট্রিট কিন্তু চায়।”
-“তোর বেলায় দিস….”
-“খাওয়ার পরে ভুলে যাও তাই না চাঁদু,দেখ তোর জিজু মনে হয় আসছে আমি রাখি।কথা বলতে দেখলে রাগ করবে।আল্লাহ হাফেজ।”
-“বাই,সাবধানে আসবি।”

ইয়ারাবী কলটা কাঁটতেই কেউ একজন ওর কাঁধে হাত রাখতেই কেঁপে উঠে ঘুরে তাকিয়ে দেখে আবরার।আবরার ওর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
-“এমন ভয় পাও কেন তুমি?”
-“আমি আশেপাশে অন্য কারো উপস্থিতি অনুভব করি।”
-“কে সে?”
-“আমি জানিনা,বাট্ প্রায়ই মনে হয়।”
-“আচ্ছা ছাড়ো এসব,ল্যাপটপে কী করছিলে তুমি?”
-“কিছুনা,এমনি দেখছিলাম।”
-“কথা শুনবেনা কখনো?বলো কোন ড্রেস পরবে?একবারে রেডি হয়ে তারপর খাবার খাবে।ওই তো মম্ এসে গেছে।”

মিসেস রায়হান আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুই বুঝি আবার মেয়েটাকে বকছিস?”
-“কখন বকলাম,আমি কখনো বকিনা শুধু শুধু।”
-“তাহলে মুখটা এমন হয়ে আছে কেন?”
-“সেটা তোমার বৌমাকে জিজ্ঞেস করো।”

আবরার কাবার্ড থেকে নীল রঙের জামাদানি কাপড়ের একটা গাউন বের করে ওর মায়ের হাতে দেয়।মিসেস রায়হান ইয়ারাবীকে নিয়ে ওয়াশরুমে যান।

(১৭৭)

মিসেস ইশানি ঘরের চাদর পাল্টাচ্ছেন তখনি য়ুহার রুমে ঢোকে।মিসেস ইশানি য়ুহারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ফাতেমা আন্টিকে ফোন দিয়েছিলে ফুপি?”
-“হ্যাঁ,রে করেছিলাম।কিন্তু ওরা কেউ আসতে পারবেনা।তারা এমনিতে ইয়ারাবীর অপারেশনের জন্য স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছিলো আর দিবেনা এখন।তাছাড়া ওর আব্বু বাইরে আছে,ফাতেমার বুটিক শপে প্রচুর কাজ।”
-“তারা আমাকেও তাই বললো।তাই ভাবলাম তোমাকে দিয়ে বললে হবে।”
-“তোর মায়ের বাড়ির থেকে কারা কারা আসবে?”
-“কী জানি?ওরা আসলেও কী না আসলেও কী?কোনোদিন খোঁজ নিয়েছে আমাদের।”
-“বাদ দেনা এসব,তোর হাসি-খুশি থাকা উচিত।বিয়ে বলে কথা।”

য়ুহার কথাটা শুনে মুচকি হেসে বাইরে চলে যেতেই আবার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলে,
-“ইয়ারাবী কিন্তু আসছে…”

মিসেস ইশানি কিছুটা অবাক হয়ে যান,উনার মতে আবরার কখনো এমন অবস্থায় ওকে আসতে দিবেনা।উনি য়ুহারের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“তোকে ফোন করেছিলো?”
-“উহু,আমি ওদের বাসায় কার্ড পাঠিয়েছিলাম, ফোনে কথা হয়েছিলো আবরারের সাথে।তখন বুঝলাম আসবেনা ওরা।কিন্তু ইরাক ভাইয়া বললো কাল রাতে আবরার ফোন করে বলছে আসবে।”
-“কিন্তু এই সময়…”
-“তোমার মেয়ের মাথায় কী চলে তা সেই ভালো জানে।আবরার কখনো আসতে চেয়েছিলোনা,ইয়ু হয়তো কোনো ভাবে মানিয়েছে।তোমার মেয়ে আসছে উপরের ঘরটা ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে ফুপু,ধোলা-বালিতে সমস্যা হবে ওর।”
-“তুই যা আমি দেখছি।”

য়ুহার কথাটা শুনে রুমে যেয়ে শৈলদের পাঠানো শাড়িগুলো দেখছে তখনি শৈলের ফোন থেকে ওর মোবাইলে কল আছে।ও ঘরের সবাইকে বাহানা দিয়ে ঘরের বাইরে নির্জন জায়গায় এসে কলটা রিসিভ করে বলে,
-“কী ব্যাপার বর মহাশয়,এখন ফোন করলেন কেন?”
-“বৌটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলো….”
-“তুমি কী পাগল শৈল,জানো কত মানুষের মধ্যে ছিলাম?”
-“তো কী হয়েছে?আমি কী প্রেম করছি নাকী?নিজের বৌকে ফোন দিয়েছি।”
-“ওহ্,তুমিও না।দেখবো যখন আমি থাকবো না তখন পাগলামিগুলো কোথায় করো।”
-“বলেছিনা এসব বলবেনা,আমি কোথাও যেতে দিবোনা।”
-“সত্যিটা মানতে মানুষের কষ্ট কেন হয় বুঝিনা।”
-“তুমি চুপ করবে,তোমাকে ফোন করাই আমার ভুল।”
-“তাহলে করলে কেন?এখন কলটা কাঁটো,আমি শাড়ি দেখছি।”
-“কোন শাড়ি পড়বে?”
-“গাঁয়ে হঁলুদে হঁলুদটাই পরবো।”
-“আরে সেটা নয়,অনেকগুলো আছে তাই শুনছি।”
-“আমি চাইছি হলুদ কালারের জামাদানি শাড়ি পরতে।”
-“ওইটা আমি পছন্দ করে কিনেছি।অনেক সুন্দর লাগবে তোমাকে।রাখি এখন,এমনি কপাল নিজের বিয়েতে নিজের কাজ করতে হচ্ছে।”
-“যাও,তুমি ব্যাস্ত থাকলে আমি বাঁচি।মিনিটে মিনিটে রিসিভ করার হাত থেকে তো রক্ষা পাবো।”
-“একবার নিজেরে কাছে পায়।তারপর দেখবো।

মিসেস ইশানি ঘর থেকে বের হচ্ছেন তখনি মিসেস জামান আদিবার সাথে কথা বলতে বলতে আসছিলো।আদিবা উনাকে দেখে বলে,
-“খালা কখন আসলেন?”
-“কাল রাতেই,য়ুহারদের সাথে।তুই কখন আসলি?”
-“এইতো কিছুক্ষণ আগে।তা ওরা কী আসবে?”

মিসেস জামান মুখ থেকে পানের পিক উঠানে ফেলে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-“কেন তুই জানিস না,ওর টিউমার অপারেশন করেছে?”
-“জানিতো মা,কিন্তু ইয়ামিলাকে বলতে শুনলাম আসবে হয়তো…”

মিসেস জামান মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,
-“এমন শুভ দিনে ওর মতো মেয়ের না আসায় ভালো।বাজা মেয়েরা এসব অনুষ্ঠানে থাকলে অমঙ্গল হয়।আমি ঠিক বলেছিনা ইশানি?”

মিসেস ইশানি রাগী কন্ঠে বলে উঠেন,
-“না,পুরোটাই ভুল বলেছিস।তোকে কে বললো আমার মেয়ে বাজা?ওর কিছু সমস্যা আছে যা তোর মতো মুর্খরা বুজবেনা।যার বিয়ে তার কোনো সমস্যা হচ্ছেনা তোর কেন সমস্যা তাহলে?”
-“বাবাহ্,এতো তেজ ক্যান দেখাচ্ছিস?জোর গলায় বললেও সত্য কোনোদিন পাল্টাবেনা,তোর মেয়ে একটা বাজা,যার মা হওয়ার ক্ষমতা নেই তার তো বেঁচে থাকায় উচিত নয়।”
-“তুই বড় বলে ছেড়ে দিবো এটা ভাবিসনা।”

আদিবা ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আম্মু মা হওয়া না হওয়া আল্লাহর ইচ্ছা।উনি ইয়ারাবীকে ক্ষমতা দেননি নিশ্চয়ই কোনো কারন আছে।উনি যা করেন সবার মঙ্গলের জন্যই করেন।আর অপয়া সেটা তো কুসংস্কার,যা আমার মানুষেরা বানিয়েছি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দেন, যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দেন। আবার কাউকে কন্যা ও পুত্রসন্তান উভয়টি দেন। যাকে ইচ্ছা তিনি বন্ধ্যা করেন। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছু জানেন এবং সব কিছুতে সক্ষম।’ (সুরা : আশ-শুরা, আয়াত : ৫০)
সন্তান আল্লাহর দান। আল্লাহ যাকে খুশি তাকে সন্তান দান করেন এবং যাকে খুশি দান করেন না। সন্তান হওয়া একধরনের পরীক্ষা এবং সন্তান না হওয়া একধরনের পরীক্ষা।আশাকরি বিষয়টা বুঝতে পেরেছো।”

মিসেস জামান এমন কথা শুনে কিছুটা চুপসে যান,তবুও উনি দমে যাওয়ার পাত্রী নন।কিছুক্ষণের মধ্যে হুংকার দিয়ে বলে উঠেন,
-“হ্যাঁ,মায়ের থেকে তো বেশি বুঝা শিখে গেছিস।আমরা তো মুর্খ আর তোরা শিক্ষিত।”

কথা বলে রাগে গজগজ করতে করতে ওখান থেকে চলে যান।মিসেস ইশানির কিছুটা খারাপ লাগে মেয়ের জন্য,কেননা ওর অক্ষমতার পিছনে কিছুটা উনারও হাত আছে।যা আজ পর্যন্ত কেউ জানেনা।উনার স্বামী যদি সত্যিটা জানে তবে উনাকে খুন করতে দ্বিধাবোধ করবেন না।ইরাক কোথাও থেকে ইয়ামিলাকে কোলে করে এসে বলে,
-“বাহ্,আদিবা একদম ফাঁটিয়ে দিয়েছিস।তোর মায়ের তবুও লজ্জা হবেনা।”
-“জানিনা ভাইয়া উনার এসব করে লাভ কী হয়?”

ইরাক একটা নিঃশ্বাস ফেলে মিসেস ইশানিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“কী জানি?আচ্ছা খালা শোনো,আমি আব্বুর সাথে বাজারে যাচ্ছি,ইয়ামিলাকে সাথে নিয়ে গেলাম।”
-“যা তুই,এতে প্রশ্ন করার কী আছে?”
-“আদিবা তোর জন্য কী কিছু আনবো?”
-“না ভাইয়া কিছু লাগবেনা।শুধু বাচ্চাগুলোর জন্য আনলেই হবে,আপনি যান।”
-“আচ্ছা আসি….”

ইরাক কিছু দূর যেতেই মিসেস ইশানি পিছন থেকে ডেকে উঠে বলেন,
-“আব্বু দ্বারা…”
-“কী হয়েছে খালা?”
-“পায়ের দিকে তাকালে বুজবি?দু’পায়ে দুই ধরনের জুতা পরেছিস,চেন্জ করেনে।”

ইরাক পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যিই তাই, ইয়ামিলা তো হো হো করে হাসতে থাকে।ইরাক একবার সবার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ভাব নিয়ে বলে,
-“হে হে এটা নতুন স্টাইল,অনেক মানুষ বুঝবেনা চেন্জ করেই নি।”

ইয়ামিলা চোখ ছোট ছোট করে বলে,
-“ভাইয়া বলেন ভুলে পায়ে দিয়েছেন,মিথ্যা বলার দরকার কী?”
-“ওই হাঁসের মতো প্যাক প্যাক করবিনা পুচকি।মিথ্যা কোথায় বললাম যা ঠিক তাই বলেছি।”
-“আমি জানি আপনি ভুলে পায়ে দিয়েছেন।”
-“তোকে তো পরে দেখবো….”

অনেকটা বিরক্ত নিয়ে বাসার মধ্যে যেয়ে পায়ে জুতা চেন্জ করতে থাকে।ইয়ামিলা,ইমন সোফায় বসে বসে বড় ভাইয়ের কাহিনি দেখে শুধু হাসছে আর কানে কানে কিছু বলছে।ইরাক চোখ রাঙিয়ে তাকাতে চুপ হয়ে যায় কিন্তু পরবর্তীতে আবার শুরু করে।

(১৭৮)

-“আহ্হ্,লাগছে তো…”
-“এইতো হয়ে গেছে,আর একটু।”
-“ব্যাথা পাচ্ছি….”
-“লাগবেনা আর,হয়ে গেছে।এবার দেখো…”
-“অনেক সুন্দর হয়েছে,ধন্যবাদ।”

এতক্ষণ ধরে আবরার ইয়ারাবীর চুল বেঁধে দিচ্ছিলো।যেহেতু একপাশ কাঁটা তাই বাতাসের জন্য ওখানে চুলের স্পর্শে চুলকাতে পারে বা কোনো জার্মস্ লাগতে পারে,তাই নিজে দাঁড়িয়ে নেট দেখে চুল বেঁধে দেয়।তারপর ওকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও গুছিয়ে নেয়।একটা ব্লাক টি-শার্ট তারপর ব্লু জ্যাকেট,ব্লাক প্যান্ট,ব্লাক ঘড়ি,সিল্কি চুল,চাপ-দাঁড়ি,সবুজ চোখ সব মিলিয়ে অনেকটা সুন্দর।ওরা নিচে নামার কিছুক্ষণ পর জারবা আর মেঘ আসে।মিসেস রায়হান জারবার দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“সব সময় ভাবীর সাথে থাকবে,একা কোথাও যাবেনা।মেঘ কোন বাদরামি নয়,মারামারি করবেনা কারো সাথে।আর আবরার ইয়ারাবীর দিকে খেয়াল রাখবী।আর আম্মু তুই কিন্তু ছোটাছুটি করবিনা,সুস্থভাবে ফিরে আসা চায়।যাত্রা যেন শুভ হয়,সাবধানে যাবি।”

ওরা আর কিছু কথা বলে বেড়িয়ে পরে।মেঘ গাড়ি চালাচ্ছে,পাশে জারবা বসেছে,পিছনে আবরার আর ইয়ারাবী।যেহেতু গাড়ি চালাতে পারে তাই ড্রাইভারকে সাথে নেয়নি।মোট নয় ঘন্টা পরে যেয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় পৌঁছালো রংপুরে।তবে ইয়ারাবী এর মাঝে প্রচুর অসুস্থ হয়ে পরে,ব্রেক নিয়েছিলো বলে বেশি সমস্যা হয়নি।

য়ুহার তো ইয়ারাবীকে দেখে দৌঁড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে অনেক কথা বলে।আবরার ইরাক, ইফাজের সাথে কুশল বিনিময় করে,বাকীদের সাথেও কিছু কথা-বার্তা বলে।তবে ইয়ারাবীর বাবা-মা মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইলে ও মুখ ঘুরিয়ে নেয়।জার্নি করে এসেছে ফ্রেস হওয়ার জন্য রুমে যায়,জারবা ওর রুম দেখে বলে,
-“ছোট ভাবী এটা তোমার নিজের ঘর?”
-“হ্যাঁ,কেন?”
-“জাস্ট অসাধারন,ছাদের উপর বাড়ি।ছোট ভাইয়া আমার এমন একটা ঘর চাই।”

মেঘ জারবার চুল টেনে ধরে বলে,
-“ওইতো কুটনার চাওয়া শুরু হয়ে গেলো।”
-“মেঘ খবরদার আমার কিউট ননদকে কিছু বলবিনা।”
-“হ আইছে আমার জজ সাহেব,চল ফুট….”
-“তোকে তো….”

আবরার একটা ধমক দিয়ে বলে,
-“চুপ,তোরা কী ভার্সিটিতে যেয়েও এসব করিস টম-জেরির মতো।”
-“আমি করিনা আপনার ভাই করে।”

মেঘ মাথা নাড়িয়ে ভদ্র ছেলের মতো বলে,
-“না ভাইয়া আমি করিনা,তোমার বৌ করে।”
-“যে যাই করুক না কেন এখন ফ্রেস হয়ে নাস্তা করে নাও।”

কথার আওয়াজে পিছনে তাকিয়ে দেখে মিসেস ইশানি আর অচলা নাস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ইয়ারাবী সোফা থেকে উঠে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপনি যেয়ে ফ্রেস হয়ে নেন,তারপর নই আমরা করবো।”
-“উহু তোমাকে আগে করতে হবে,বলাতে যায়না কত জার্মস্ এসেছে।”

সবাই ফ্রেস হয়ে হালকা নাস্তা করে নিয়ে মেঘ আর জারবা বাইরে বের হয়ে যায়।ইয়ারাবী বেশি খেতে পারছেনা,মিসেস ইসানি এটা-সেটা এগিয়ে দিচ্ছে।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“খাচ্ছোনা কেন?”
-“পারছিনা আর,বমি আসছে…”
-“আরেকটু জার্নি করো ভালো লাগবে।করবে নাকী এখন?হেব্বি মজা হবে কিন্তু।”

ইয়ারাবী মুখটা ফুলিয়ে বলে,
-“বকছেন কেন?”

ইরাক রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
-“আবরার তোর সাহস তো মন্দ নয় তুই পিচ্চিকে বকছিস?”

আবরার হাসতে হাসতে বলে,
-“আমার ঘাড়ে কটা মাথা যে তোদের বোনকে বকবো?”
-“তাও ঠিক,খালা তোমাকে বড় খালা ডাকছে।”

মিসেস ইশানি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলেন,
-“ও কেন ডাকছে আমাকে?”
-“তা জানিনা।ওহ্হ্ আপনি তালিব হুজুরের কথা বলেছিলেন উনি এসেছে।”
-“কোথায় উনি?”
-“আমাদের ঘরে বসিয়েছি।”
-“তোরা কথা বল আমি দেখা করে আসছি।”

ওরা কিছুক্ষণ কথা বলে ঘরের বাইরে বের হয়, আবরার ইয়ারাবীর হাত ধরে রেখেছে।য়ুহারের গায়ে হঁলুদের জন্য স্টেজে বসানো হয়েছে,য়ুহার ইয়ারাবীকে হাত দিয়ে ইশারা করে ওর পাশে বসতে বলে।আবরার ওকে য়ুহারের পাশে বসিয়ে দিয়ে ওর ভাইদের সাথে গল্প করছে চেয়ারে বসে।ইয়ারাবী এখন হঁলুদ কালারের জামদানি লম্বা হাতা,কলার দেওয়া গাউন পরেছে।আর মাথায় ওড়না দিয়ে কভার করা।য়ুহার ইয়ারাবীর সাথে টুকটাক কথা বলছে।জারবা মোবাইলে ছবি উঠাতে উঠাতে ইয়ারাবীর কাছে এসে বলে,
-“ছোট ভাবী,আমি একটু ওইদিকে যাবো।”
-“একা কোথাও যাবেনা সোনা,তুমি জারাকে সাথে নিয়ে নাও।”

জারবা মাথা নাড়িয়ে জারার সাথে বাড়ির পিছনের দিকে যায়।হঠাৎ করে ইয়ারাবীর সামনে এসে মিসেস রায়ীনা আর নিন্দু বলতে শুরু করে,
-“তোর তো এখানে আসা উচিত হয়নি।”
-“কেন?”
-“না মনে য়ুহারের এতো শুভ একটা অনুষ্ঠান যেখানে তোর মতো বাজা মেয়ের আসাটা মানায় না।এত বড় হয়েছিস জ্ঞান নেই নাকী?বোনের সর্বনাস করতে চলে আসলি।”

ইয়ারাবী কিছু বলতে যাবে তার আগে যুহার বলে উঠে,
-“ভদ্র ভাষায় কথা বলবেন নয়তো আমি ভুলে যাবো আপনারা কারা।আমার বোন আমার বিয়েতে এসে এতে আপনাদের কী সমস্যা?”

ইতোমধ্যে উপস্থিত সবার মধ্যে একটা কানাঘুষা তৈরি হয়ে গেছে ইয়ারাবীকে নিয়ে,এসব ওর একদমই ভালো লাগছেনা।মন চাইছে কড়া জবাব দিতে কিন্তু দুর্বলতার জন্য ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছেনা।মিসেস নিকি পায়েসের প্লেট টা স্টেজে রেখে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“তা তোর বর কী তোকে রাখবে না ছেড়ে দেবে?কোনো কথা হয়েছে তোদের মধ্যে?”

মিসেস রায়ীনা মুখ বাকিয়ে বলে,
-“আরে নিকি তুই ও না,এমন অক্ষম মেয়েকে কে রাখবে?”

-“সেটা আপনাদের কেন চিন্তা হচ্ছে বুঝছিনা।”
ইয়ারাবী ওর পাশে তাকিয়ে দেখে আবরার সবুজ কালারের পান্জাবি পরে হাতা গুটিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ইয়ারাবী ওকে দেখে চমকে যায়,কেননা মুখটা স্বাভাবিক থাকলেও চোখে অসম্ভব রাগ ভর করে আছে।মিসেস রায়হান কিছুটা মেকে হেসে বলে উঠে,
-“কিছু মনে করেনা বাবা,আসলে আমাদের তো আর এমনি এমনি বয়স হয়নি।কিছুটা হলেও পুরুষের মন বুঝি।তাই আমাদের মেয়ে নিয়ে একটু হলেও তো চিন্তা হয়,তুমি যদি ছেড়ে দাও তখন…”

আবরার খানিকটা হেসে মাথাটা দুলিয়ে বলে,
-“আন্টি আমিতো ছেড়ে দেওয়ার জন্য বিয়ে করেনি।আর যদি ছেড়ে দিতেই চাইতাম তবে বিয়ে করতাম না।মেয়েরা কোনো স্বস্তা বাজারের আদা,রসুন-পেঁয়াজ নই যে অক্ষম থাকলে সেটা ফেলে দিয়ে নতুনটা নিবো।আপনিও নারী,যে মা হয়ে গর্ব করে বেড়াচ্ছেন সেই মা হওয়ার ক্ষমতা কিন্তু একমাত্র আল্লাহ্ দিয়েছেন।
বহু নবী নিঃসন্তান ছিলেন। হজরত জাকারিয়া (আ.) বার্ধক্য পর্যন্ত নিঃসন্তান ছিলেন। অন্যদিকে হজরত মরিয়ম (আ.) বায়তুল মোকাদ্দাসে তাঁর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। একদিন তিনি দেখতে পেলেন আল্লাহ তাআলা ফলের মৌসুম ছাড়াই হজরত মরিয়ম (আ.)-কে ফল দিয়ে রিজিকের ব্যবস্থা করেছেন। তখন তাঁর মনে সন্তানের জন্য সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। তাই তিনি আল্লাহর দরবারে বিশেষ দোয়া করেন। তিনি বলেন, ‘রাব্বি হাবলি মিল্লাদুনকা জুরিরয়্যাতান ত্বাইয়্যিবাতান, ইন্নাকা সামিউ’দ দুআ। অর্থাৎ হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার পক্ষ থেকে আমাকে পূত-পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি প্রার্থনা কবুলকারী।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৩৮)
হজরত ইবরাহিম (আ.) একসময় নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে এ মর্মে দোয়া করেছেন—‘রব্বি হাবলি মিনাস সলেহিন অর্থাৎ হে আমার প্রভু! আমাকে সৎকর্মশীল সন্তান দান করো।’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ১০০)।
আল্লাহর খাঁটি বান্দাদের পরিচয় দিয়ে কোরআনে বলা হয়েছে, তাঁরা নেক স্ত্রী ও সন্তানের জন্য দোয়া করেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘রব্বানা-হাবলানা-মিন্ আয্ওয়াজ্বিনা ওয়া যুররিয়্যা-তিনা কুর্রতা আ’ইয়ুন ওয়া জা’আল্না-লিল মুত্তাকীনা ইমামা। অর্থাৎ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের আমাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর করো এবং আমাদের সংযমীদের আদর্শস্বরূপ করো।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৭৪)
মহান আল্লাহ যুগে যুগে তাঁর বহু নৈকট্যশীল বান্দাকে সন্তান নামক নিয়ামত না দিয়েও পরীক্ষা করেছেন, তাঁরা যথারীতি উত্তীর্ণও হয়েছেন। হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালামের স্ত্রী বন্ধ্যা ছিলেন, অনেক ধৈর্য ও দোয়ার পর মহান আল্লাহ শেষ বয়সে একজন সন্তানের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আছিয়া আলাইহিস সালাম নিঃসন্তান ছিলেন। আইয়ুব আলাইহিস সালামকে অনেক সন্তান-সন্ততি দিয়ে আবার তাদের কেড়ে নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের জীবনী থেকে জানা যায়, তাঁদেরও অনেক বছর নিঃসন্তান রাখা হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দুই কিংবা তিনজন স্ত্রী বাদে আর কারোই সন্তান ছিল না। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) নিজেই নিঃসন্তান ছিলেন। এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ পাওয়া যাবে। তাই সন্তান না হলে হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আর বিনা কারণে কারো সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা গোনাহের কাজ। কেননা মহান আল্লাহ কাউকে সন্তান দিয়ে পরীক্ষা করেন, আবার কাউকে না দিয়ে। আসলে মুমিনের গোটা জীবনই পরীক্ষা।
আর তাছাড়া ইয়ারাবী মা হতে পারবেনা এমন কোনো কথা বলাও ভুল।ওর সমস্যা আছে এই জন্য,প্রপার ট্রিটমেন্ট চলছে ঠিক হয়ে যাবে।”

আবরার এই পর্যন্ত কথা বলে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে দেখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ও আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-“আমি বাকী জামাইদের মতো নই যে বৌকে অপমান করবে আর আমি ভালো জামাইয়ের মতো চুপচাপ হজম করবো।স্যরি ফর দ্যাট,আমি ওমন ছেলে নই।আমার পার্সোনালিটি কেমন সেটা ইরাকরা খুব ভালো করেই জানে।সুতরাং,আমার শ্বাশুড়িরা আমার বৌকে কিছু বলার আগে দশবার ভেবে কথা বলবেন।আগে ও শুধু আপনাদের মেয়ে ছিলো কিন্তু এখন আমার বিবাহিত স্ত্রী।হ্যাঁ,আমি কথাগুলো বলতাম না যদি না ও অসুস্থ থাকতো।আর ওর অসুস্থতায় সুযোগ নিয়ে যা নয় তাই বলছেন।আবরার নিজের জিনিসের যত্ন খুব ভালো করেই করতে যানে কথাটা মাথায় রাখবেন।”

য়ুহার ওর চাচী আর ফুপুদের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।বেচারীরা ওর শান্ত কন্ঠের বলিষ্ঠ জবাবে ফাঁটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেছে।আবরার একবার আশেপাশে তাকিয়ে ইয়ারাবীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“ইয়ারাবী,জারবা কোথায়?তোমার কাছেই তো ছিলো?”
-“ও বাসার পিছনে পুকুরের দিকে গেছে।”
-“তুমি একা যেতে দিলে?”
-“আমার মাথা খারাপ নাকী?জারা সাথে আছে, আপনি মেঘের দিকে খেয়াল রাখবেন।”
-“হুম,এই ফোনটা কাছে রাখো।তোমারটা ড্রয়ারে রেখেই চলে এসেছি।আমারটা দিয়ে ছবি তুলো বাট্ ফোনে কথা বলবেনা।আর তোমার ফ্রেন্ড অনুর জার্নি করে অবস্থা খারাপ তাই কাল সকালে আসবে,ফোন করেছিলো।”
-“আপনার কাছে ফোন আছে তো?”
-“আমার কাছে সব সময় দু’টা থাকে।”

আবরার আশেপাশে কারোর বিবেচনা না করে ইয়ারাবীর মাথায় একটা চুমু দিয়ে নিজের মতো করে হেঁটে ইরাকদের কাছে যায়।ওর ভাব-ভঙ্গী দেখে মনেই হচ্ছেনা একটু আগে কিছু হয়েছে।ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়।ইমন য়ুহারের মুখে হলুদ লাগিয়ে বলে,
-“ফড়িং,মেইড ফর ইচ আদার।”
-“ভাইয়া…..”
-“আজকাল মানুষের সত্য বললেও রাগ হয়।”
-“মার খাবে কিন্তু আমার হাতে।”
-“তুই জায়গা থেকে শুধু উঠ দেখ তোর বরে কী করে।”

য়ুহার ইমনের কান টেনে বলে,
-“বাদরের হাড্ডি দিয়ে তৈরি নাকী তোরা?”
-“শুধু শুধু মাসুম কানের উপর নির্যাতন।দাঁড়াও তোমারও হচ্ছে।”

ইমন কথাটা বলে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই ওর দু’জন মিলে বাটি থেকে হঁলুদ নিয়ে ওর পুরো মুখের উপর লেপন করে দেয়।অনেক হাসি-তামাশার মধ্যে দিয়ে গায়ে হঁলুদ সম্পন্ন হয়।

(১৭৯)

রাতে জারার কাছে জারবাকে থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে,এমনিতেও জারার কাছে মেয়েটা থাকলে অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকবে ইয়ারাবী।আর মেঘ,ওর ইরাকরা আগে থেকে পরিচিত বলে তেমন একটা অসুবিধা হয়নি।সবাই খেয়ে যার যার ঘরে চলে গেছে, আবরার ইয়ারাবীর কাঁটা জায়গায় মেডিসিন লাগিয়ে দিচ্ছে আর বলছে,
-“আচ্ছা তোমার প্রিয় জারিকা আপুকে দেখলাম না যে?”

এই কথা শুনে ইয়ারাবী আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপনার যে অনেক চিন্তা হচ্ছে দেখছি।”
-“জ্বলছো কেন তুমি?”
-“আমি জ্বলছিনা,কাঁটা জায়গা জ্বলছে খুব।”
-“স্প্রীটের ঝাঁঝে এমনটা হচ্ছে।কিন্তু মনে হচ্ছে তোমার ভিতরে খুব জ্বলছে…”
-“আমি জ্বলিনা আর জানি আপনি কেন জানতে চাইছেন?”
-“অনেক চালাক হয়ে যাচ্ছো।”
-“আপনার সাথে থাকার ফল,আপু এসেছে ঘরের মধ্যে আছে।আর….”

ও কিছু বলতে যাবে তখনি ঘরের দরজায় কারো নক পরে।যেহেতু দরজা লক ছিলোনা আবরার ভিতরে আসতে বলে।তখনি দরজা ধাক্কা দিয়ে মিসেস ইশানি ঘরে ঢুকলে ইয়ারাবী কিছুটা বিরক্ত হয়।আবরার বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলে,
-“আম্মু এই সময়ে আপনি?”
-“আসলে বাবা আমার এক দূরসম্পর্কের চাচা অনেক ভালো হুজুর উনি এসেছেন তোমাদের সাথে দেখা করতে চান।মুরব্বি মানুষ সিঁড়ি বেড়ে উপরে উঠতে কষ্ট হবে তাই একটু….”

-“আবরার আমি কোথাও যাবোনা।”
-“আহ্,ইয়ারাবী আলেম মানুষের সাথে দেখা করতে সমস্যা কোথায়?আর তিনি তোমার নানা হন।”
-“আমার ভালো লাগছেনা।

মিসেস ইসানি ওর কথা শুনে বলেন,
-“দেখ মা একটু দেখা করে আয়,তালেব হুজুরের কথা বলছি।”
-“দেখুন আমি আপনার সাথে কথা বলছিনা।”

-“ইয়ারাবী মায়ের সাথে এভাবে কথা বলতে নেই।যদিও উনি তোমার সাথে সব সময় বাজে ব্যবহার করেছেন তবুও দশ মাস দশদিন পেটে ধারণ করে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে।আর সবকিছুর পিছনে একটা কারণ আছে।”
আবরারের উপরে ইয়ারাবী কোনো কথা বলেনা, তাই আজও ওর বিপরীত হয়নি।ইয়ারাবী পরনে একটা লম্বা গেন্জি আর প্লাজু ছিলো,তার উপর একটা বড় ওড়না দিয়ে মাথা কভার করে নেয়।আবরার ইয়ারাবীকে সাথে করে ওর মায়ের পিছু পিছু নিচে নেমে ইরাকের ঘরে যেয়ে দেখে একজন অত্যাধিক ফর্সা,লম্বা দাঁড়ি,পরনে সাদা পান্জাবি, পায়জামা,মাথায় পাগড়ী পরা,বিছানার উপর বসে হাতের কড় গুনে জিকির করে।ওরা যেয়ে হুজুরকে সালাম দিলে উনি চোখ খুলে উত্তর দেন।তারপর ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“আমাকে চিনতে পেরেছো,খুব ছোট ছিলে তখন একবার দেখা হয়েছিলো।”
-“জ্বি,চিনি আপনাকে।”
-“কেমন আছো তোমরা?বিবাহিত জীবন আল্লাহর রহমতে ভালো চলছে।”

হঠাৎ কী মনে করে উনি ইয়ারাবীর ডান হাতটা দেখতে চায়,এতে করে ও কিছুটা অবাক হলেও হাতটা বাড়িয়ে দেয়।হুজুর ওর হাতের দাগটা দেখে প্রশ্ন করে বলে,
-“এটা কখন হয়েছে?”

আবরার পাশ থেকে উত্তর দিয়ে বলে,
-“গতকাল মাঝরাতের দিকে,কেন?”
-“এগুলো কী মাঝে মাঝে হয়?”

আবরার কিছু একটা আঁচ করতে পেরে হুজুরকে সব খুলে বলতেই উনি চিন্তিত হয়ে বলেন,
-“একে দেখেই সন্দেহ হয়েছিলো আমার।মানুষ সাধারন রোগে আক্রান্ত হলে বোঝা যায় কিন্তু এধরনে জিনিস তেমন একটা ধরা যায়না।”
-“আমি ঠিক বুঝিনি।”
-“বাবা তুমি ডাক্তার মানুষ,এসবে বিশ্বাস নাও করতে পারো।তবে তোমার বিবিকে কালো জাদু করা হয়েছে জ্বিন দ্বারা।”

কথাটা শুনে উপস্থিত সকলে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।মিসেস ইশানি মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
-“আপনি কী বলছেন এসব?”
-“আমি ঠিকই বলছি…”

আবরার কিছুটা নড়েচড়ে বসে বলে উঠে,
-“জ্বি আমি জ্বিনে বিশ্বাস করি।কেননা স্বয়ং কোরআনে এসব বলা হয়েছে।”
-“আচ্ছা নানাভাই তোমার কখন থেকে এসব সমস্যা হয়।”

ইয়ারাবীর ভয়ে মুখ থেকে কথা বের হচ্ছেনা।আবরর ওর হাতটা শক্ত করে ধরে নির্ভয়ে বলার ইশারা করে।ইয়ারাবী সব ঘটনা বললে মিসেস ইশানি মাথায় হাত রেখে বসে বলেন,
-“হায় আল্লাহ,ইয়ারাবী কত সময় বলতো আম্মুনি আমার ভয় করে আমি কখনো শুনতাম না।”

আবরার উনার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আম্মু এভাবে ভেঙে পরবেন না।আচ্ছা নানাভাই যদি ওকে কলেজ থেকে করা হয় তবে এই পর্যন্ত ওর বড় ক্ষতি কেন হয়নি? আর যে করেছে সে কীসের মাধ্যমে করেছে?”
-“হতে পারে ওর আমলের পাল্লা ভারী আছে।আর যার দ্বারা করা হয়েছে সে কাল সুযোগ পয়েছে কাজটা করার।তুমি না থাকলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত।এসবের অনেক বড় হাদিস আছে, এমনিতে অনেক রাত হয়ে গেছে।ওর অনেক বড় অপারেশন হয়েছে,তোমরা না হয় ঘুমিয়ে পরো যদি আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখেন তবে কাল সব বলবো।আজ রাতে নজরে রেখো,ঘুমানোর আগে শরীর বন্ধ দিয়ো।”
-“জ্বি আমি খেয়াল রাখবো।ইয়ারাবী চলো …”

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here