জীবন মানে তুমি পর্ব-৪৯

0
3955

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৪৯

(১৬৬)

কালো একটা গেন্জি আর একটা ট্রাউজার পরে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সোফায় বসলো ইরাক।এই কয়েকদিন ধরে খুব ব্যাস্ততায় কাঁটছে,একটু আরাম করে বসার সময়টুকু নেই,বাসায় ও তেমন ভাবে যোগাযোগ করতে পারছেনা।ছোট ভাইটার কী অবস্থা আল্লাহ জানে?নানা কথা চিন্তা করছিলো তখনি কেউ ওর রুমের দরজায় নক করে।সারাদিনের ক্লান্তি আর অনেকটা বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ভেসে উঠে।কেননা দরজায় দন্ডমান ব্যাক্তিটি আর কেউ নয় স্বয়ং রোজ।ইরাক দরজায় বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে কিছুটা ভ্রু কুচকে বলে,
-“এই সময়ে তুমি এখানে?”
-“ভিতরে কী আসতে দিবেন না স্যার?”
-“যদি বলি না….”

রোজ কিছুটা মুচকি হেসে বলে,
-“সিনিয়ারের অর্ডার কিভাবে ফেলতে পারি?”
-“ভিতরে এসো…..”

ইরাক হাসতে হাসতে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো রোজ ভিতরে ঢোকে সোফায় বসে।বলতে গেলে ইরাক এখন কোয়াটারে থাকে,তাই থাকার মতো সব আসবাবপত্র আছে এখানে।রোজ চারদিকে চোখ বুলিয়ে ঘরের সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করছিলো।হঠাৎ কিছুর শব্দে সামনে তাকিয়ে দেখে ইরাক দু’কাপ কফি টেবিলে রেখে বসে আছে।রোজ একটা কফির মগ উঠিয়ে বলে,
-“এসে বিরক্ত করলাম?”
-“আরে না,তুমি তো জানো আমার একটু পর পর কফির অভ্যাস আছে।”
-“আপনি কী কাল বাসায় যাবেন?”
-“হ্যাঁ,ভোরের দিকে বেড়বো।তোমার ছুটি তো ক্যান্সেল হয়ে গেলো,এটার জন্য খুব দুঃখীত।”
-“ইটস্ ওকে,তাছাড়া ঈদের ছুটি পেলে তো যাওয়া হবে।”
-“আমার তো ইমার্জেন্সি জানো।মা নেই, ইরাক-ইমন কেমন আছে খোঁজ নেওয়া হচ্ছেনা,আব্বুর ও ছুটি নেই,তাছাড়া বোনটার অপারেশন হলো সব মিলিয়ে যদি যেতে না পারি….।তুমি জানো আমি পরিবারের বড়,জানি দেশ আগে তবে পরিবারকে একটু সময় দিতেই হয়।”
-“সেটা ঠিক বলেছেন।তাহলে আমি উঠি,আপনার ঘুমাতে হবে।”

রোজ দাঁড়াতেই ইরাক মুচকি হেসে বলে উঠে,
-“শুধু কী এটার জন্য এসেছিলে?নাকী কিছু বলতে চেয়েছিলে?”
-“না মানে অন্য একদিন বলবো।আজ যেতে হবে,সকালে আমার ডিউটি আছে।”
-“কথা কাঁটিয়ে দিতে চাইছো?”
-“স্যার আমি….”
-“আব্বু আসুক….”

ইরাক হেসে কথাটা বললে রোজ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
-“আঙ্কেলকে দিয়ে কী করবেন?”
-“যা তুমি চাও।”

রোজ কিছুটা লাজুক ভাবে বলে উঠে,
-“স্যার আপনাকে দেখলে বোঝা যায়না আপনি এত খারাপ।”
-“এখানে খারাপের কী হলো?”
-“জানি না।”

কথাটা বলেই রোজ তাড়াহুড়ো করে হাতের আধা-খাওয়া কফিটা টেবিলে রেখে দ্রুত পায়ে ফ্লাট থেকে চলে যায়।ইরাক ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে যেয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয়।হাতের কফিটা শেষ করে ব্যাগটা গুছিয়ে নেয়,তারপর মি.রহমানের সাথে কথা বলে বিছানায় শুয়ে পরে।

(১৬৭)

-“আবরার আপনি কী ঘুমিয়ে পরেছেন?আবরার প্লীজ উঠুন না।”

ইয়ারাবী আস্তে করে ডান পাশে ফিরে আবরারকে ডাকছে।অন্যান্য দিন আবরারের হালকা আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় কিন্তু আজ উঠছেনা।আর উঠবে বা কেমন করে?সারাদিন প্রচুর খাটুনি করতে হচ্ছে, ঠিকমত হাসপাতালে বা ল্যাবে সময় দিতে পারছেনা তাই বাড়িতে বসে কাজ করতে হচ্ছে।ইয়ারাবী ধীরে ধীরে ডানপাশে ফিরে ওকে হাত দিয়ে ডাকতে থাকে।সমস্যার জন্য ইয়ারাবী বামপাশ হয়ে ঘুমাতে পারছেনা,তাই আবরার ওর জায়গা ইয়ারাবীকে দিয়ে নিজে বিপরীত পাশে ঘুমায়।অনেক ডাকাডাকির পর আবরার হালকা চোখ খুলে বলে,
-“কী হয়েছে?না ঘুমিয়ে ডাকছো কেন?দেখ আমি প্রচুর টায়ার্ড,কাল অনেক কাজ ও আছে।”
-“স্যরি,কিন্তু প্লীজ একটু উঠুন না।আমার ভয় করছে,মনে হচ্ছে ঘরে আমরা ছাড়া কোনো তৃতীয় ব্যাক্তি আছে।”

আবরার ওর দিকে ফিরে বলে,
-“রাতে পাগলামি করছো কেন?রুম লক করা, কেউ নেই।এসব তোমার মনের ভুল।দেখি আমার কাছে এসো।”
-“আপনি বুঝছেন না কেন?আমার ভয় করছে,প্লীজ একবার বেলকনিটা দেখে আসুন না।”

ইয়ারাবী ভয়ে ভয়ে কথাটা বলে উঠে।আবরার খুব সাবধানে ওর বাম হাত দ্বারা ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে আধো আধো কন্ঠে বলে উঠে,
-“কেউ নেই,চুপ করে ঘুমাও।সাবধানে বাম হাতটা রেখো,টান লাগলে ব্যাথা পাবে।”
-“আবরার?”
-“হুশশ,একটা কথাও নয়।মাথায় কেন চাপ নাও বলতো?এগুলো এমনি তোমার খেয়ালে আসছে।লক্ষ্মী মেয়ের মতো চুপ করে ঘুমাও।”
-“আমি….”
-“কী বলেছি আমি?এমনিতে খুব খারাপ লাগছে ইয়ারাবী,সকালে শুনবো তোমার কথাগুলো।”

আবরার অনেকটা রাগী কন্ঠে কথাটা বললে ইয়ারাবী গুটিশুটি মেরে চুপ করে ওর বুকের সাথে মিশে ঘুমানোর চেষ্টা করে।আবরারও অনেকটা সাবধানে ও নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে ঘুমাতে থাকে।কিন্তু ইয়ারাবী ঘুমাতে পারছেনা,বারবার তৃতীয় ব্যাক্তির উপস্থিত ওর মনোযোগ নিজের দিকে টানছে।এটা কোনো হ্যালুসিনেশন নয় সেটা ও সহজেই বুঝতে পারছে।বেলকনিতে কারো মুভমেন্ট বোঝা যাচ্ছে তবে দেখা যাচ্ছেনা।ও এবার আবরারকে ডাকতে যেয়েও পারেনা।ওর নিজের কাছেই খারাপ লাগে,কেননা মানুষটা ওর জন্য প্রচুর করে যা ও সারাজীবন দিয়েও শোধ করতে পারবেনা।তাই এই মাঝ রাতে তার ঘুমকে আবার ভাঙানোর মতো দুঃসাহস ওর নেই।

(১৬৮)

সময়ের পরিক্রমায় সবকিছু বদলে যায়।থেকে যায় চেনা মুখ তবে হয়ে উঠে তাদের অচেনা পরিচয়।এমন এক ব্যাক্তিত্ব যাদের সাথে আগের কোনো মিল নেই।আসলে কিছু কিছু মানুষ গিরগিটির মতো রং বদলায়।আসলে তারা নিজেরাও জানেনা কখন তারা গিরগিটির রুপ ধারন করে হয়ে উঠে পৈশাচিক ব্যাক্তি।এদের এরুপ আচারনে মাঝে মাঝে মনে হয় মারা যায়।কিন্তু মরলে কী সব সমস্যার সমাধান হয়?খালামনি বলে হয়না,বরং মৃত্যুর পর অনন্তকাল ধরে পুরতে হয় জাহান্নামের আগুনে।আচ্ছা বাবা-মা যে দোয়া করে তা ফলে যায়,তাদের সন্তানের জন্য মুখ থেকে এক একটা বুলি কবুল করে নেয় আল্লাহ।তাহলে তো আমি এমনিতেও জাহান্নামে যাবো।কেননা তারা তো উঠতে বসতে এমন কী নামাযেও এই বলে দোয়া করে,আমি যেন সুখি না হয়।মৃত্যুর পর যেন জাহান্নামে যায়।

এই পর্যন্ত লিখে চোখের পানিগুলো মুছে ডাইরিটা বন্ধ করে দেয় ইয়ারাবী।কেননা ওর মা যদি দেখে না পড়াশোনা করে লিখছে তবে ওর কপালে দুঃখ আছে।বলতে গেলে কিছুক্ষণ আগেও মার খেয়েছে,বোনকে কোলে নিয়েছে সেই কারনে।ওর কী দোষ?বোন কাঁদছিলো,আশেপাশে কেউ ছিলোনা বলেই তো কোলে নিয়েছিলো।কতটা সুন্দর দেখতে বাচ্চাটা,কচিকচি হা-পা,ঠোঁট ফুলিয়ে অদ্ভুতভাবে সবার দিকে অবাক নয়নে চেয়ে থাকে।ওনিজেও দেখতে ছোটবেলায় ঠিক এমন ছিলো,তবে বোনের মতো অতো ফর্সা নয় বরং শ্যামলা।কাল বোনের মুখে ভাত,তার জন্য অনেক সাহস করে আজ নিজের বাবার কাছে একটা নতুন জামা চাইবে ভাবছে ইয়ারাবী।যদি ওর বাবা ছোট মেয়ের মুখে ভাতের খুশিতে একটা জামা কিনে দেয় এই আশায়।ওর যা আছে সব পুরানো জামা আর বেশির ভাগই গেন্জি,পার্টিতে পরার মতো যা ছিলো সেগুলো জারিকার ছোটবোনকে দিয়েছে ওর মা।

সব চিন্তা একপাশে ফেলে রেখে ইংরেজি বই খুলে পড়তে বসে ইয়ারাবী।মনটা বেশ ফুড়ফুড়ে আছে, যদি মায়ের কাছে বিনা দোষে মার খেয়েছে তবুও নতুন জামার আশায় মনটা ভালো হয়ে গেছে।

মিসেস ইশানি ইয়ামিলাকে কোলে নিয়ে ফিডার খাওয়াচ্ছিলেন ঠিক তখনি মি.ফুয়াদ বাইরের থেকে হন্তদন্ত হয়ে এসে স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠেন,
-“ইস্মাকে কেন মেরেছো?”

মিসেস ইসানি উনার দিকে তাকিয়ে কোনো হেলদোল না দেখিয়ে বলে উঠে,
-“আজকাল যে দেখছি মেয়ের প্রতি খুব দরদ বেড়েছে।”
-“ফালতু কথা না বলে আসল কথা বললে খুশি হবো।”
-“কেন নালিশ করেছে নাকী তোমাকে?”
-“ইশানি!!!”

অনেকটা উচ্চস্বরে ধমকে উঠলে উনার স্ত্রী কিছুটা থতোমতো খেয়ে যায়।ছোট মেয়েকে দোলনায় শুয়ে দিয়ে ফিডারের ঢাকনাটা খুলতে খুলতে বলে,
-“চেঁচাবেনা,সাধে তোমার মেয়েকে মারিনি।কত বড় সাহস ও ইয়ামিলাকে কোলে নেয়।”
-“শুধু কোলে নিয়েছে বলে মারছো।বাড়িতে মানুষ আর তুমি,যা করার করো।যতসব অশান্তি…”

মি.ফুয়াদ খানিকটা রাগ দেখিয়ে ঘরের বাইরে চলে যান।উনার স্ত্রী কিছুক্ষণ উনার দিকে তাকিয়ে থেকে কাবার্ড থেকে চারটা শপিং ব্যাগ বের করে রুম থেকে বের হয়ে গেস্টরুমের দিকে যান।সেখানে মিসেস নিন্দু আরাম করে পা ছড়িয়ে বসে তার তিন মেয়ের সাথে গল্প করছেন আর মুড়ি খাচ্ছেন।উনাকে ঘরে ঢুকতে দেখে মিসেস নিন্দুর তিন মেয়ে দৌঁড়ে যেয়ে বলে,
-“ফুপু আমাদের জন্য জামা কিনছো নাকী তোমার মেয়ের পুরাতন জামা।”
-“উহু,ওর পুরাতন জামা তোদের কেন দিতে যাবো।কাল মার্কেটে গেছিলাম তাই তোদের জন্য নিয়ে এসেছি।দেখতো পছন্দ হয় নাকী?না হলে পাল্টিয়ে আনবো।”

ওরা তিনবোন উনার হাতের ব্যাগগুলো নিয়ে বিছানার উপর উঠে বসে।জারিকা সব ব্যাগগুলো খুলে দেখে দু’টা নীল রঙের লং থ্রী-পিচ,মিষ্টি কালারের একটা গাউন আর সবুজ রঙের একটা স্কার্ট আছে।ওরা জামাগুলো দেখেই বুঝতে পারছে কোনটা কার জন্য।মিসেস নিন্দু জামায় হাত বুলিয়ে নিয়ে বলে,
-“আপা,কাপড়টা তেমন ভালোনা।”
-“কেন?দামী কাপড়ই কিনেছি।”
-“না তারপরও কেমন একটা যেন।থাক যা দিয়েছেন ভালোই হয়েছে।তা মনিদের জন্য কী কিনলেন?”

মিসেস ইশানি হেসে বলেন,
-“পাঁচ-ছয়টা বেবী ড্রেস কিনেছি।বাচ্চা তো কাপড় লাগে।”
-“আর বড়টার জন্য?”
-“ওর জন্য কী কিনবো?সবই তো আছে ওর।আচ্ছা তোরা থাক,আমি রান্নার ব্যবস্থা করি।”

মিসেস ইসানি হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরতেই দেখেন তারা-য়ুহার বাসার মধ্যে ঢুকছে।বলা বাহুল্য যে তারা আর য়ুহার একসাথেই লেখাপড়া করে।তাই তাদের মধ্যে অাত্মীয়তা কিছুটা বন্ধুত্বে পরিনত হয়েছে,তবে ওতটা গভীর বন্ধুত্ব নয়।
-“কীরে তোদের এত দেরী কেন হলো?”
-“আর বলোনা,মলে এত পরিমান ভীড় ছিলো কী বলবো।আচ্ছা পুতুল কই মামী?ওর জন্য ফুসকা নিয়ে এসেছি।”
-“ওর জন্য আবার কেন আনতে গেলি।জারিকাদের জন্য এনেছিস,ওরাও কিন্তু এসেছে।”

তারা জানতো না যে ইয়ারাবীর ওই তিন মামাতো বোন আজ আসবে।তাই ও কিছু বলার আগেই য়ুহার বলে উঠে,
-“ইয়ারাবী ছোট বলে নিয়ে এসেছি।তাছাড়া জানা ছিলোনা যে ওরা আসবে।”

মিসেস ইশানি য়ুহারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“একজনকে দিলে আরেকজন মন খারাপ করে।তাছাড়া দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক নিয়ে এসেছিস।তুই বরং জারিকাদের…..”
-“দাঁড়াও ফুপু,এনেছি ইয়ারাবীর জন্য আর ওকেই দিবো।ওদের দিতাম এর মধ্যে থেকে তবে তোমার এক্সট্রা কেয়ার দেখে আর দিচ্ছিনা।আর তুমি জানো আমি যা বলি সেটাই করি।আসো তারা,ও মনে হয় নিজের ঘরে।”
-“তোদের যা করার তোরা কর,মেয়েটাকে ওতো আদর দিয়ে মাথায় তোলার কোনো মানে হয়না।”

উনি কথাটা বলে রাগে গজগজ করতে করতে কিচেনের দিকে পা বাড়ান।তবে উনার কথার কোনো প্রতিক্রিয়া ওদের উপর হয়না বলে মনে হচ্ছে।নিজেদের মতো গল্প করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ইয়ারাবীর রুমে ডুকে দেখে নিজের মতো করে টেবিলে বসে পড়ছে।তারা যেয়ে ওর পিছনে দাঁড়িয়ে মাথায় একটা গাট্টা মারে।ইয়ারাবী মাথা ঢলতে ঢলতে পিছনে তাকিয়ে ওদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঝাঁপ মেরে ওদের জড়িয়ে ধরে।য়ুহার ওকে কোলে নিয়ে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে,
-“গেলে কী হতো আমাদের সাথে?”
-“আব্বুর সাথে জামা কিনতে যাবো একটু পর।তাই পড়া গুছিয়ে নিলাম,তোমাদের সাথে গেলে তো হতোনা।”
-“জামাই জামা কিনতে নিয়ে যাবে তোকে।কখন যাবি?”
-“জানিনা,এখনো বলিনি আব্বুকে।ভয় করছে যদি বকে।”

ওর কথা শুনে য়ুহার আর কিছু বলেনা।তারা প্যাকেটের জিনিসগুলো টেবিলে রাখতে রাখতে বলে,
-“পুতুল কোল থেকে নেমে এগুলো খেয়েনে।তোর জন্য নিয়ে এসেছি।”
-“ইয়াহু,ফুসকা খাবো।দাঁড়াও শুভ আর নিলয়কে ডাক দাও,ওরাও খাবে আমার সাথে।”

নিলয় চুল ঝাকাতে ঝাকাতে শুভর হাত ধরে বলে,
-“আমরা চলে এসেছি আপু।”
-“পাগলগুলো,আয় আমি বানিয়ে দিচ্ছি।”

তারা একটা একটা করে ফুসকা বানিয়ে দিচ্ছে আর ইয়ারাবী একগালে পুরে খেয়ে নিচ্ছে।এই একটা জিনিস যার জন্য ইয়ারাবী কখনো মানা করেনা।ওদের খাইয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে ওরা দু’জন নিজেদের ঘরে চলে যায়।ইয়ারাবী কী মনে করে যেন ঘর থেকে বেড়িয়ে রান্নাঘরে ওর মায়ের কাছে যায়।মিসেস অচলা আর ফাতেমা ওর মায়ের সাথে রান্না ঘরেই ছিলো।ইয়ারাবী যেয়ে ওর মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
-“আম্মুনি আব্বু কোথায়?”
-“কেন?ফুয়াদকে কীসের দরকার তোর?নিজের ঘরে যেয়ে পড়তে বস যা…”
-“আমি সব পড়া শেষ করে তবেই এসেছি।”

ইয়ারাবী হেসে কথাটা বলে।মিসেস অচলা ইয়ারাবীর হাতে ছানার মিষ্টি দিয়ে বলে,
-“তুমি এটা খেয়ে দেখতো কেমন হয়েছে?তোমার মামা নিয়ে এসেছে।”

ইয়ারাবী একটু গালে দিয়ে বলে,
-“অনেক ভালো।বাকীটা রেখে দাও রাতে খাবো।”
-“ওমা সেকী কথা,তুমি খাবেনা কেন?তোমার তো পছন্দের …”
-“না মামী,আপুরা এতগুলো ফুসকা খাইয়ে দিয়েছে।এখন কিছু খাবোনা।”

ইয়ারাবী দু’হাত দিয়ে পরিমাপ করে দেখায়।ওর মা কথা শুনে ভ্রু কুচকে বলে,
-“সব একা খেয়ে নিয়েছিস।তোর আপুদেরও দিলিনা।”
-“আমি তো জানিনা আম্মুনি।আর সব একা কেন খাবো,আমার সাথে শুভ আর নিলয়ও খেয়েছে।আচ্ছা তোমাকে বিরক্ত করছিনা,আমি আব্বুর কাছে যায়।”

কথাটা বলে ও যেই দৌঁড়ে রান্নাঘর থেকে বেরতে যাবে সেই মুহুর্তে মিলিস্তার সাথে ওর ধাক্কা লাগে।মিলিস্তা বড়-ছোট না মেনে ওকে থাপ্পড় মেরে নিচে ফেলে দেয়।ওর মামী আর ফুপি অবাক চোখে মিলিস্তার দিকে তাকিয়ে দেখে মিলিস্তা রাগে ফুসছে।মিসেস ফাতেমা ইয়ারাবী উঠিয়ে মিলিস্তার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভুলে ধাক্কা লেগেছে বলে ছোট বোনকে মারতে হবে।”

মিলিস্তা কিছু না বললেও মিসেস ইশানি উনার ননদকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
-“বড় তাই শাসন করেছে,এখানে দোষের তো কিছু নেই ফাতেমা।”
মিসেস ফাতেমা কথাটা শুনে মিলিস্তাকে একটা থাপ্পড় দিয়ে ভাবীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেন,
-“আমিও বড়,তাই ছোট মেয়েকে শাসন করলাম।”

মিলিস্তা গালে হাত দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওর মায়ের কাছে চলে যায়।আসলে যতটা ব্যাথা না পেয়েছে তার থেকে বেশি অপমান হয়েছে উনার কথাতে।আর মিসেস ইশানি ননদের এরুপ কথায় কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে কাজের মধ্যে ব্যস্ত দেখান।

বিকালের দিকে মি.ফুয়াদ ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছেন ওর সাথে।আর উনার ছোট মেয়ে অবাক নয়নে হাত-পা নেড়ে নেড়ে আ-উ করে কথা বলার চেষ্টা করছে।ইয়ারাবী অনেকটা ভয়ে দরজায় নক করে।ওর বাবা পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে ইয়ারাবী দরজার কাছে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে।ওর বাবা ইয়ামিলাকে বিছানায় বসিয়ে ইশারা করে ওকে ভিতরে ডাকে।ইয়ারাবী অনেকটা ভয়ে ভয়ে ভিতরে ঢুকে ওর বাবার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়।ওর বাবা বিছানায় বসে বলে উঠে,
-“কী হয়েছে ইস্মা?কিছু বলবে…”
-“আব…আব্বু,একটা কথা বলতে আসছিলাম।”
-“কী বলো?”
-“না মানে,কাল তো ওর মুখে ভাত করবে।”
-“হুম তো,এতে করে তোমার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”

কথাটা অনেকটা গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলে ইয়ারাবী চমকে যায়।দ্রুত ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“না না,আমার সমস্যা কেন হবে।তু..তুমি শোনো।”
-“বলো কী বলবে?”
-“বলছি আমার একটা জা..জামা কিনে দিবে আব্বু।”

কথাটা চোখ-মুখ বন্ধ করে অনেকটা ভয়ে বলে উঠে।আসলে ছয় বছর বয়স থেকে যা চেয়েছে তার জন্য অনেক সময় ওকে মার পর্যন্ত খেতে হয়েছে।তাই সাধারণত ও কোনো কিছু চাইনা ওর বাবা-মায়ের কাছে।মি.ফুয়াদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে ডান হাত দিয়ে ওকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলেন,
-“আম্মুনি না তোমার জন্য কাল কাপড় কিনে নিয়ে এলো।সেটা কোথায়?”

অনেকটা ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ওগুলো আম্মুনি আমার জন্য নয় বরং জারিকা আপুদের জন্য কিনে এনেছে।”
-“জানি,কিন্তু সবুজ স্কার্ট তো আমি তোমার জন্য কিনেছিলাম।”
-“ওটাও আম্মুনি ওদের দিয়ে দিয়েছে আর বলেছে আগের জামা পড়তে।কিন্তু আব্বু আমার তো আগের জামা অনেক পুরানো।সবাই নতুন জামা পরবে আর আমি।তুমি কিনে না দিলে জোর করবো না তাও মারবেনা।আমি সত্যি আর কিছু চাইবো না…”

মি.ফুয়াদ মেয়েকে কোলের ভিতর নিয়ে বলে,
-“তুমি ভুল করো তাই তোমাকে…আচ্ছা বাদ দাও।ঘরে যেয়ে গুছিয়ে নাও,তোমার জামা কিনতে যাবো।”
-“সত্যি…”
-“হ্যাঁ,তিন সত্যি।”

ইয়ারাবী অনেকটা খুশি হয়ে ওর বাবার গলা জড়িয়ে ধরে,তারপর ঘর থেকে খুশি হয়ে দৌঁড়ে বের হয়ে যায়।মি.ফুয়াদ প্যান্ট-শার্ট ইন করে গুছিয়ে নিচ্ছে,উনার স্ত্রী ঘরে ঢুকে ব্যাগ থেকে রাগে রাগে টাকা বেড় করে দেয়।
-“এমন করে টাকা নষ্ট করার কোনো মানে নেই ফুয়াদ।এক দিনের জন্য,নবাবজাদীর কাপড় দিতে হবে।”
-“এসবের কিছুই হতো না যদি তুমি ওর স্কার্টটা ওদের না দিতে।”
-“ওইটা ইয়ারাবীর থেকে ওকে বেশি মানাবে তাই আমি দিয়েছি।কিন্তু তোমার ডাইনি মেয়ের সহ্য হয়নি।”
-“মেয়েটা কী শুধু আমার একার?”

এমন কথা শুনে মিসেস ইশানি চুপ করে যান।উনি টাকা নিয়ে ইয়ারাবীকে ওর ঘর থেকে নিয়ে বেরিয়ে পরে।আজ ইয়ারাবী অনেক খুশি,অনেকদিন পরে বাবার সাথে বের হয়েছে।অনেক দোকান ঘুরে একটা কালো রঙের গাউন কিনে দেয় ওকে।কেননা ও অন্য বাচ্চাদের মতো লাল রঙের কিছু পড়তে চাইনা।

পরদিন সকাল ধরে বাড়িতে নানা ধরনের আয়োজন করা হচ্ছে।তবে মিসেস ইশানির নিষেধ আছে ভুলেও যেন ওর বোনের আশেপাশে না যায়।তাই ইয়ারাবী তারার হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।অনুষ্ঠানে সবাই এসেছে তবে বিশেষ কারনে ওর মেজো খালা আর তার পরিবারের কেউ আসতে পারেনি।তাই ইয়ারাবীর মনটা অনেক খারাপ।তারার ফোন আসায় ও ইয়ারাবীর কাছে থেকে উঠে চলে যায়।ও বাচ্চা মেয়ে ওরও মন চায় বাবা-মায়ের কাছে থাকার,ছোট বোনের অনুষ্ঠানে তাকে কোলে নেওয়ার।কিন্তু সব চাইলেই তো হয়না,ওর ভাগ্যটাই আসলে অনেক খারাপ।এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে ওর নিন্দু মামীর সাথে ধাক্কা লাগলে উনার কোল থেকে ওর বোন পরে যায়।ফোমের উপর পরেছিলো তাই বেশি ব্যাথা পায়নি তবে মিসেস ইশানি আর ফুয়াদের কাছে নিজের দোষ স্বীকার না করে সম্পূর্ন দোষ ইয়ারাবীকে দেয়।আসলে ভুলটা ওর নয় বরং মিসেস নিন্দুর,উনি এমনভাবে ইয়ামিলাকে কোলে নিয়েছিলো যে ওর ঝুল ঠেকাতে না পেরে ফেলে দেয়।

কিন্তু ওর বাবা-মার মনে হয় ইয়ারাবী ইচ্ছা করে ইয়ামিলাকে মারতে চাইছে।উনাদের ধারনা,ও নিজের বোনকে সহ্য করতে পারেনা।ওর মা ইয়ামিলাকে কোলে উঠিয়ে ইয়ারাবীকে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে।ইয়ারাবী অনেক করে ওর মাকে বলছে ওর জন্য বোন পড়েনি তবুও কেউ ওর কথা শুনছেনা।ওর বাবা প্রচুর রেগে যায়,পাশে রান্নাঘরে বটি থাকায় ওটা হাতে উঠিয়ে কোপ মারতে চায় মেয়েকে।তবে হালকা ভাবে একটা কোপ ওর ঘারের কিছুটা নিচে লেগেও যায়,ও চিৎকার করে উঠে।

অতীতের স্মৃতিগুলো মস্তিষ্ক ওকে পুনরায় দেখাচ্ছে।ভয়ে ওর আবরারের বাহুডোরে ছটফট করছে।হঠাৎ করে বিকট চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে পরে।ওর চিৎকার শুনে আবরারও লাফ মেরে উঠে বসে দেখে ইয়ারাবী ওর ডান হাতটা বারবার ওর ঘাড়ের নিচে দিচ্ছে আর ভয়ে অনাবরত কাঁপছে।আবরার ওর বাহু ধরে বলে,
-“কী হয়েছে ইয়ারাবী?এমন করছো কেন?”
-“আমি ইচ্ছা করে করিনি,আমি ফেলিনি ইয়ামিলাকে আমাকে মারবেনা।”
-“কী বলছো তুমি?কী হয়েছে তোমার?”
-“আমি ফেলিনি ওকে,তাও মারছে আমাকে।”
-“কেউ মারবেনা তোমাকে,তুমি স্বপ্ন দেখেছো সোনা।এখানে আমি ছাড়া কেউ নেই আর।”
-“না দেখো,আব্বু মারছে আমাকে।আমি বলছি আমি করিনি তবুও মারছে।মেরে ফেলবে আমায়…”

ইয়ারাবী কিছুক্ষণের জন্য হয়তো ভুলে গেছিলো,ও স্বপ্নে যা দেখেছে সেটা অতীতের ঘটে যাওয়া মুহুর্ত।আবরার বেশ ভালোই বুঝতে পারছে আসলে ইয়ারাবীর সাথে যা হয়েছে সেটাই বর্তমানে ওর উপরে ইফেক্ট ফেলছে।আবরার পাশে থেকে পানি নিয়ে ওর মুখে ছিটিয়ে দিতেই ইয়ারাবী বাস্তবতা অনুভব করতেই ও আবরারকে ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।একমাত্র আবরারের বুকেই ও শান্তি অনুভব করছে,ওর কাছে এটাই যেন একটা নিরাপদ স্থান।আবরারও পরম যত্মে ওকে নিজের কাছে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে থাকে।
-“কী হয়েছে ইয়ারাবী,বলবেনা আমায়?”
-“আবরার আমি..আমি…..”
-“বলো আমাকে,তাহলে নিজের কাছে হালকা লাগবে।”

ইয়ারাবী পুর্বের ন্যায় ওর বুকে মাথা রেখেই পুরোটা খুলে বললে আবরার যেন থম মেরে যায়।এমন কোনো বাবা-মা কী আদেও হয় বলে ওর জানা যায়।ও জীবনে অনেক কেস দেখেছে তবে এমন কিছু দেখেনি।আসলে ওর কাছে যতই মনে হচ্ছে ও ইয়ারাবীকে সুস্থ করতে পারবে ততই ওর কাছে কেসটা জটিল হয়ে যাচ্ছে।আবরার ওকে কোনো ভাবে সামলে নিয়ে বিছানায় ঠিকভাবে বসিয়ে দেয়।তারপর খেয়াল করে দেখে ওর স্যালাইনটা শেষ,তাই সাবধানে ওর হাত থেকে ক্যানেলটা বেড় করে নেয়।যদিও ব্যাথা লাগে তবে মনের ব্যাথার কাছে এই ব্যাথা কিছুই নয়।

(১৬৯)

-“ডিপ্রেশনে থেকে ওঠা মানুষগুলোকে সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখবিনা বরং তাদেরকে সারাদিন হাসতে দেখবি। নিজের মন যত ক্ষত-বিক্ষত হোক না কেন অন্যের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে ঠিক সাপোর্ট করবে।”

কথাটা আবরার সামনে বসা ইরাককে উদ্দেশ্য করে বলে।আজ সকাল নয়টায় ও বাসায় পৌঁছেই বোনকে দেখতে চলে এসেছে।তবে ইয়ারাবীকে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পারিয়ে রেখেছে আবরার,কেননা স্বপ্নটা দেখার পর থেকে মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছিলো।

ইরাক ওর কথা শুনে বলে উঠে,
-” জীবনে হোঁচট খাওয়া খুব দরকার-ওর বাবা-মায়ের মতে।তারা আরো বলে এতে করে ম্যাচুরিটি আসে, বুঝতে শেখে কাদের সাথে মিশবে।তবে তারা ভাবেনা,এরা যদিও আবার হোঁচট খায় তবে আরো শক্ত হয়।নিজেকে শান্ত করার মতো শক্তি এরা রাখে।প্রাণ খুলে হাসার অভিনয়টা পুরোদমে শিখে ওঠে।কিন্তু মন আর মস্তিষ্ক মরে যায়।”

আবরার কফির কাপটা টেবিলে রেখে বলে,
-“নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হিসেবে সবার কাছে নিজের হাসি দিয়ে পরিচয় করায়।এরা একা কাঁদে লুকিয় খুব গোপনে।গভীর রাতে এরা যখন খুব মানসিকভাবে টায়ার্ড হয়ে পরে কখনো কখনো অতীত ওদেরকে বাজে ভাবে তাড়া করে।কখনো তো মনে হয় ওদের কাছে যে অতীত নয় বরং সেই জিনিসটা প্রেজেন্ট ওদের সামনে হচ্ছে।
সারাদিন অক্লান্ত সুখী হবার অভিনয়ের পরিশ্রম করার পর রাতে যখন একা হয় তখন একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো কাছে ঠাঁয় হয়না। চিৎকার করে এরা কাঁদতে চায়,তবে প্রয়োজন হয় ভরসার একটা হাত।
তবে কী জানিস,তোর বোন তার বিপরীত।ও এতটাই শক্ত হয়েছে যে হাসতে ভুলে গেছে, প্রয়োজন ব্যাতিত কথা বলেনা।মানুষ ভাবে ডিপ্রেশন শুধু প্রেম ঘটিত কারন বা পড়াশোনার কারনে ঘটে থাকে।তবে পরিবার থেকে যে অবহেলা সেটা কাঁটিয়ে উঠা সম্ভব নয়,আর সেখান থেকে শুরু হয় ডিপ্রেশন।”

ইরাক আবরারের দিকে ভ্রু কুচকে বলে,
-“কতটা ইম্প্রুভমেন্ট হয়েছে?”
-“স্যরি ইরাক,কিন্তু ওর কেসটা আমার কাছে জটিলের থেকে জটিল মনে হচ্ছে।ও আজ যা করলো সেটাই বেশি ঘাবলা লাগছে।”
-“কী করেছে ও?”

আবরার কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইকরা এসে জানায় ইয়ারাবী ঘুম থেকে উঠে পরেছে।আবরার আর ইরাক দ্রুত ড্রয়িংরুম থেকে উঠে ঘরে যেয়ে দেখে ইয়ারাবী উঠে বসার চেষ্টা করছে।আবরার দৌঁড়ে যেয়ে ওর হাত ধরে বলে,
-“কী করছো তুমি?ওয়াশরুমে যাবে বললে তো হতো।”
-“কাবার্ড থেকে একটা ড্রেস বের করে দিবেন।আসলে এই গেন্জিটা ঘেমে গেছে।”
-“তুমি পারোও বটে,বসো আমি ড্রেস বের করে দিচ্ছি।”
-“ভাইয়া…কখন আসলে তুমি?”

ইয়ারাবী অনেকটা অবাক সাথে খুশি হয়ে কথাটা বলে উঠলে ইরাক হেসে ওর কাছে যেয়ে মাথায় একটা চুমু দিয়ে বলে,
-“আজ সকালেই এসেছি,তা আমার পিচ্চিটা কেমন আছে?”
-“আলহামদুলিল্লাহ্,তুমি বসোনা এখানে।”
-“না সোনা,বসতে পারবোনা।একটু ধানমন্ডির দিকে কাজ আছে যেতে হবে।আমি পরে এসে আবার দেখা করবো।”
-“না,কাজ পরে।তুমি থাকো কিছুক্ষণ।”
-“জেদ করেনা পিচ্চি,আমি এমনিতেও একমাসের ছুটিতে আছি।সামনের সপ্তাহে আব্বুও আসবে, সুতরাং যখন খুশি আসতে পারবো।আবরার আমি বেড় হবো,খেয়াল রাখবি সব সময়।”
-“ওটা না বললেও করবো,তুই চিন্তা করিস না।”

আবরার হেসে মাথা হেলিয়ে কথাটা বলে উঠে।এদিকে ইয়ারাবী মুখ ফুলিয়ে আছে,ওর ভালো লাগছেনা ইরাকের এত দ্রুত চলে যাওয়া।ইরাক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়,তবে এদিকে কিছুতেই মিসেস রায়হান যেতে দিবেনা।কেননা একে তো ছেলের ছোটবেলার বন্ধু তার উপর আবার আত্মীয়,তবে ইরাক অনেক বুঝিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

দুপুরের দিকে ইয়ারাবী আবরারের বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে।আজ সকাল ধরে আবরার হাসপাতালে যেতে পারিনি,কোনো কাজেই যেতে পারছেনা ওকে এই অবস্থায় রেখে।দু’জায়গা থেকে ঘনঘন ফোন আসছে,তবুও ওর যাওয়ার মতো অবস্থা নেই।আজ ইয়ারাবীও ওকে নিজের কাছ থেকে যেতে দিচ্ছেনা,এজন্য মিসেস রায়হানও ছেলেকে নিষেধ করে বাইরে বেড় হতে।তার উপর ওর গুনধর মামীরা আছে,ইকরা স্কুলে চলে গেছে, জারবা কলেজ,মেঘ ভার্সিটিতে আর মা কতটা সময় খেয়াল রাখতে পারবে।

নানা ভাবনা ভাবছিলো আর ইয়ারাবীর চুলে হাত বুলাচ্ছিলো আর এদিকে ইয়ারাবী ওর গেন্জির বোতাম নিয়ে টানাটানি করছে।হঠাৎ ওর ঘোর ভাঙে ইয়ারাবীর কথায়।
-“আবরার আমি মা হতে চাই?”
-“কী বললে তুমি?”
-“আমি মা হতে চাই….”
-“বয়স হোক তারপর বাচ্চা নিবে।এখন নয়….”
-“আমি বলিনি এখন হবো,আমি বলছি আমি মা হতে চাই।”
-“আমিও তাই বলেছি।”

ইয়ারাবী ওর বুকের উপর হাতটা স্ত্রীর করে রেখে বলে,
-“কিন্তু আমিতো কখনো হতে পারবোনা।আচ্ছা আমার জীবনটা এমন কেন আবরার?শুধু কষ্ট আর কষ্ট।”
-“আমি কী তোমাকে কষ্ট দেয়?”
-“উহু….”
-“তাহলে এটা কেন বললে?দেখো আল্লাহ তার কোন বান্দাকে নিরাশ করেনা।তার জন্য সর্বদা উত্তম কিছু তৈরি রাখে।”
-“আবরার আমিও বেবী চাই,তাদের ছোট ছোট হাত-পা নিয়ে খেলতে চাই,তাদের মুখে মা ডাক শুনতে চাই।তাদের…”

আবরার ইয়ারাবীকে বসিয়ে মুখে হাত রেখে বলে,
-“হবে সোনা,সব হবে।তুমিও বেবীদের সাথে খেলতে পারবে।কে বলেছে তুমি মা হতে পারবেনা?তোমার জাস্ট কিছু সমস্যা আছে,ট্রিটমেন্ট করলে ঠিক হয়ে যাবে।এখন বলো কিছু খাবে?”
-“উহু,শুধু আপনি আমার কাছে থাকবেন।জানেন আপনি সাথে থাকলে নিজেকে সেফ ফিল করি।”

আবরার ওর কথা শুনে কিছু বলেনা তবে বিপরীতে শুধু হাসে।
-“আচ্ছা আবরার,আপনার পিঠে ওইটা কীসের চিহ্ন?কাল রাতে গেন্জি পরেছিলেন না বলে দেখেছি তবে আবছা আলোয় বুঝতে পারিনি।”

কথাটা শুনার সাথে সাথে ওর হাসি মিলিয়ে যায়।ও ভাবতে পারিনি ইয়ারাবী এটা দেখে ফেলবে।কাল রাতে এসি বন্ধ করে রেখেছিলো ওর জন্য, তাই খুব গরম লাগছিলো এজন্য গেন্জি খুলে রেখেছিলো তবে ইয়ারাবী সেটা দেখে নেয়।ওই বা জানবে কী ভাবে?ইয়ারাবীর রাতে ঘুম ভেঙে যাবে।ইয়ারাবী ওকে হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে আবার বলে,
-“কী হলো বলুন?”
-“ত..তুমি….”

কিছু বলার আগেই মিসেস রায়হান ইয়ারাবীর বাবা-মাকে সাথে করে রুমে ঢুকে বলে,
-“আম্মু তোর বাবা-মা এসেছে তোকে দেখতে।”

ইয়ারাবী সামনে তাকিয়ে দেখে মি.ফুয়াদ ইয়ামিলাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তারপাশে মিসেস ইশানি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।হঠাৎ কেন যেন ইয়ারাবী উনাদের দেখে রেগে যায়।পাগলের মতো বিহেভ করতে শুরু করে।ও চিৎকার করে বলতে থাকে,
-“এরা বাবা-মা নয়,এখনি বেড়িয়ে যেতে বলুন।আমি এদেরকে সহ্য করতে পারছিনা।”
-“ইয়ারাবী কী বলছো এসব?বাবা-মার সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?প্লীজ তুমি শান্ত হও…”
-“না আবরার এদেরকে বেড়িয়ে যেতে বলেন।আমি আমি….”

আবরার ইশারা করে উনাদেরকে রুমের বাইরে যেতে বলে।মিসেস রায়হান উনাদের নিয়ে রুমের বাইরে চলে যায়।আজ ইশানি-ফুয়াদের চোখ থেকে বৃষ্টির ধারার মতো পানি পরছে,আজ সত্যিই তারা অনুতপ্ত।নিজেদের কলিজাটা যেন ছিড়ে যাচ্ছে মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে।আসলে সকালে ইরাক এসে সবটা শুনার পর উনাদের ফোন করে সবটা জানায়,কারন বুঝায় যে আপনাদের মুর্খতার জন্য ফুলের মতো মেয়ের জীবন অন্ধকারে পরিপুর্ন।

বিশ মিনিট পর আবরার আসে উনাদের সামনে।মিসেস রায়হান বসে কথা বলছিলেন উনাদের সাথে।আবরার ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মম্ কিছু মনে না করলে একটু ওর কাছে যেয়ে বসবে।বুঝতেই তো পারছো কী বলতে চাইছি।”
-“তুই কথা বল আব্বু আমি যাচ্ছি।”

মিসেস রায়হান চলে যেতেই আবরার উনাদের সামনে বসে বলে,
-“আব্বু-আম্মু আপনারা জানেন আমি একজন সাইক্রেটিস।আমার পেশা রোগীকে ট্রমা থেকে বের করে সুস্থ করা।আপনারা আজ নিজের চোখে দেখলেন নিজের মেয়ে অবস্থা,শুধু এসব নয় রাতে এর থেকে বেশি পাগলামি করে মেয়েটা।অনেক কষ্টে সামলাতে হয়।আলহামদুলিল্লাহ্‌ আজ পর্যন্ত আমি অনেক কেসে জয়ী হয়েছি তবে ইয়ারাবীর মতো এমন কোনো কেস দেখিনি।আমি প্রথম থেকে ওকে ঠিক করার চেষ্টা করছি কিন্তু হচ্ছেনা,কারন একটাই ও নিজের সম্পর্কে কিছু বলেনা।মেয়েকে যদি বাঁচাতে চান তবে আমাকে সত্যিটা বলুন, ডাক্তার হিসাবে নয় ওর হাসবেন্ড হিসাবে জানার অধিকার আছে।”

মি.ফুয়াদ সবটা শুনে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সবটা বলবো আজ,কারন আমিও আর মেয়ের অবহেলা নিতে পারছিনা।তোমাকে সবটা বলবো….”

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here