জীবন মানে তুমি পর্ব-৪২

0
3704

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৪২

(১৪২)

ইয়ারাবীর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে, কাঁপাকাঁপা হাতে বারবার নাম্বারটা ডায়াল করছে কিন্তু বরাবরই ফলস্বরুপ শূন্য মিলছে।ইকরা ভ্রু কুচকে মেঘের দিকে তাকায়।ওরা কেউ বুঝতে পারছেনা আসলে হয়েছে কী?ইকরা আর মেঘ ওর দিকে এগিয়ে যায়।ইয়ারাবী চোখগুলো লাল হয়ে গেছে,চোখের কর্নার থেকে জলের বাঁধ ভাঙছে। ইকরা ওর মুখে হাত দিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে,
-“কী হয়েছে ইয়ারাবী?হঠাৎ এভাবে কাঁদছো কেন?”

ইয়ারাবী কথা বলতে পারছেনা,কান্না করেই যাচ্ছে।মেঘ ওর কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকিয়ে বলে,
-“আরে বলবি তো কী হয়েছে?দেখ আমাদের এবার খুব টেনশন হচ্ছে।কার ফোন ছিলো?”

ইয়ারাবী অনেক কষ্ট করে বললো,
-“আব্…আবরার অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, মেডিকেলে আছে..”
ইকরা আর মেঘ অনেকটা শক খেয়ে যায় কথাটা শুনে,ইকরা ওর দুই কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“কী?কখন?আল্লাহ্ আমরা তো কিছুই জানিনা…”
-“কী হলো ইয়ু?তোকে কে বললো ভাইয়ার কথা?”

ইয়ারাবী চোখের পানি মুছে বলে,
-“বিহান ভাইয়া ফোন করেছিলো,কিন্তু পুরোটা বলার আগে কল কেঁটে গেলো।আপু মেডিকেলে যেতে হবে।প্লীজ দেরি না করে চলো…”
-“হ্যাঁ,চলো…”

ওরা আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে গাড়িতে উঠে মেডিকেলের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে।মেঘ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বলে,
-“মেডিকেল সেটা নয় বুঝলাম কিন্তু কোথায় আছে?”
-“জানিনা,বলার আগেই মনে হয় ওনার ফোন বন্ধ হয়ে গেছে।”
-“আচ্ছা,ব্যাপার না।ভাইয়াতো ডাক্তার সহজে পেয়ে যাবো।ওহ শিট্…”
-“কী?”
-“তোর ভাইয়ার না মেডিকেলে কিছু কাজ ছিলো।সকালবেলা তো কথা বললি,ভাইয়া হয়তো কিছু জানে।”
-“দ্বারা আমি ফোন করছি।”
-“মনে হয় ফোন করতে হবেনা,সামনে দেখ বিহানদা দাঁড়িয়ে আছে….”

কথাটা বলেই মেঘ পার্কিং সাইডে গাড়ি পার্ক করে।সবাই গাড়ি থেকে বের হয়।বিহান মনে হয় কোথাও যাবে,সেজন্য কেবল গাড়িরর দরজা খুলতে গেছে ওমনি জারবা ওকে ডাক দেয়।
-“বিহানদা?”
-“আরে জারবা,ওহ্ তোমরা এসে গেছো।স্যরি ম্যাম আসলে ফোনের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছিলো তাই আরকী…”
ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আবরার কোথায়?কেমন আছে?”
-“আলহামদুলিল্লাহ্‌,বেশ ভালো আছে…”
-“নিয়ে চলুন…”

বিহান একটা শুকনো ঢোক গিলে বলে,
-“নিয়ে যাবে কিন্তু স্যার আমাকে যেভাবে উত্তম-মাধ্যম দেবে সেটা ভেবে ভয় পাচ্ছি।”
-“মানে?”
-“গেলেই বুঝতে পারবেন ম্যাম,আমার সাথে আসুন….”

বিহান ওদেরকে সাথে নিয়ে মেডিকেলে ঢুকে দো’তালার এক কেবিনে নিয়ে যায়।সবাই তো খুব ভয়ে আছে,কারন অ্যাক্সিডেন্ট মানে অবস্থা অনেকটা খারাপের পর্যায়ে।কিন্তু কেবিনে ঢুকে সবার চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম।কেননা আবরার বেডের উপর হেলান দিয়ে বসে পা ঝাঁকাচ্ছে,হাত দিয়ে ফোন স্ক্রোল করছে আর গুনগুন করে গান গাইছে।হ্যাঁ,তবে কপালের বামপাশে ব্যান্ডেজ করা,ডান হাতের কনুই কিছুটা ছুঁলে গেছে।রুমে কারো ঢুকার শব্দ পেয়ে সামনে তাকিয়ে ও অবাক।কারণ ওর জানা মতে কারোর আসার কথা নয়,তবে..।ওদের পিছনে তাকিয়ে দেখে বিহান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।ওর যা বুঝার ও বুঝে গেছে।ইকরা আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“দেখ যার জন্য কাঁদছিলি সেতো দিব্যি বসে আছে।”
-“কেন,কী হয়েছে?”
-“আর বলোনা,বিহান ওকে ফোন করে বলেছে তোমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।আর অবস্থা খুব, এরপর আর কিছুই বলতে পারেনি।মেয়েটা সেই তখন থেকে কাঁদছে।”

আবরার কথাটা শুনে ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসে।তারপর ইয়ারাবীকে ইশারায় নিজের কাছে ডাকে।ইয়ারাবী ওর পাশে যেয়ে মাথা নিচু করে বসে।আবরার বিহানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“বিহান আমার অবস্থা এতটাও খারাপ হয়নি।”
-“স্যার,আসলে আমি ভয় পেয়েছিলাম যখন শুনি আপনি হাসপাতালে।তাই….”
-“তাই তুমি এমন কাজ করবে।যদি কথাটা শুনে ওর পেইন অ্যাটাকের মতো কিছু হয়ে যেতো।”

বিহান চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।ও জানতো যে বড়সরো ‘আইলা ঝড়’ওর উপর দিয়ে যাবে,তবে এই ছোটখাটো ঝটকাতে ও বেশ খুশি হয়েছে।কেননা আবরার রেগে গেলে ওর হাত থেকে নিস্তার নেই,ওর রাগের সামনা খুব কম মানুষই করেছে।তবে বিহান ওর সব সময়ের সঙ্গী তাই সব জানে।ইয়ারাবী আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপনি উনাকে বকছেন কেন?যা করেছে ঠিক করেছে,আমি ছাড়া কী আপনার আর কোনো দশটা-পাঁচটা বৌ আছে যে তাকে ফোন করবে।”
-“আরে আমি তো…”
-“চুপ কোনো কথা বলবেন না,মাথা-হাত কেঁটে বসে আছেন আর বলছেন কিছু হয়নি।বিহান ভাইয়া,আপনি না কোথাও যাচ্ছিলেন সেখানে যান।আর আপনার স্যার আপনাকে কিছু বলবেনা।বললে আমাকে বলবেন?”

শেষের কথাটা ইয়ারাবী আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে।বিহান ইয়ারাবীর কথা শুনে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়।আবরার ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
-“তুমি কী ইন-ডাইরেক্টলি আমাকে শাষন করছো?”
-“আমার ঘাড়ে কটা মাথা যে আপনাকে শাষন করবো?ওসব বাদ দেন,বলুন এসব কী করে হয়েছে?”
-“তুমি আবার কাঁদছো?”
-“কই কাঁদছিনা তো..”
-“কাঁদছোনা,কিন্তু একটু পর চোখ থেকে টুপটুপ করে বৃষ্টির ধারার মতো পানি পরবে।চোখ পুরো লাল হয়ে আছে।”

ইয়ারাবী কিছু বলেনা।জারবা আবরারের হাত ধরে বলে,
-“ভাইয়া এসব কী করে হলো,বলোনা…”
-“আরে তেমন কিছুনা,আমি আমার স্প্রীডে গাড়ি চালাচ্ছিলাম।হঠাৎ একটা ট্রাক খুব জোরে আমার গাড়ির সামনের আসছিলো।গাড়িতে থাকলে অবস্থা খুব খারাপ হতো বা মারা যেতাম,তাই যখন বুঝতে পেরেছি দ্রুত সিলবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে লাফ দিয়েছি।সম্ভাবত ট্রাকটার ব্রেক ফেল হয়েছিলো।কপালে একটু কেঁটে গেছে,কনুই আর পায়ে একটু লেগেছে।তাছাড়া বাকী সব আলহামদুলিল্লাহ্‌,অনেক বড় ক্ষতির হাত থেকে আল্লাহ বাঁচিয়েছে।”

ইয়ারাবী উত্তেজিত হয়ে বলে,
-“কী আপনার পায়েও লেগেছে,কোথায় লেগেছে?ডাক্তার কী বলেছে?”
-“আমি একদম ফিট আছি,আর ঘন্টা দু’য়েক পরে রিলিজ দিবে।এতক্ষণ তোমার ভাইয়া বসে ছিলো, তোমরা আসার আগে জরুরি কাজে বের হলো।”

মেঘ বাকীদের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমরা নাই বাসায় যাও,আমি ভাইয়াকে নিয়ে আসবো।”
-“আমি কোথাও যাচ্ছিনা।আপু,জারবা তোমরা চলে যাও…”

আবরার পানি খেয়ে বলে,
-“আরে বাবা তেমন কিছু হয়নি,তাছাড়া বিহান আসবে।”
-“আপনি বেশি কথা বলবেন না।”

আবরারের কথায় ইকরা,জারবা আর মেঘ বাসায় চলে যায়।কারন সাথে করে ড্রাইভার এনেছিলোনা, কারন মেঘ গাড়ি ড্রাইভ করবে তাই।থাকার মধ্যে আবরারের কাছে ইয়ারাবী ছিলো,কোনো ভাবেই ওকে পাঠানো গেলোনা।আবরার বেডে ঠিক করে বসে বলে,
-“মুখটা একদম শুকিয়ে ফেলেছো,কিছু খাওনি..”
-“খেয়েছি…”
-“রেগে আছো আমার উপর?”
-“না খুশি হয়েছি..”

আবরার হেসে বলে,
-“আজব তো।আমি হাসপাতালে ভর্তি আছি আর তুমি খুশি হয়েছো।তাহলে তো তোমার খুশির জন্য রোজ রোজ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।”

ইয়ারাবী আবরারকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা গুজে কেঁদে দিয়ে বলে,
-“জানেন এক সেকেন্ডের জন্য আমার শ্বাসটা আটকে গেছিলো।কোনো আইডিয়া আছে আপনার,আপনার কিছু হলে আমার কী হতো?আপনি জানেন না আমি…”
-“কী হতো সেটা তো দেখতেই পারছি।তবে একটা কথা না বললেই নয়,এই অ্যাক্সিডেন্টটা হয়ে বেশ ভালোই হয়েছে।”
-“আপনার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
-“উহু,এটা যদি না হতো তবে কী তুমি নিজে থেকে জড়িয়ে ধরতে।তার মানে তুমিও আমাকে ভালোবাসো।”
ইয়ারাবী ওকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
-“সেটা কখন বললাম?”
-“না বললেও বুঝতে পারি…”
-“আপনার মনে হয়না,আপনি একটু বেশি বোঝেন।”

ওর কথা শুনে আবরার বাঁকা হাসি দেয়,তবে কিছু বলেনা।মেয়েটা যে ওকে ভালোবাসে তবে স্বীকার করেনা।না করলেই বা কী?বৌটাতো ওর,ওর কাছে থাকলেই যথেষ্ট।

(১৪৩)

একটা জীবনকে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়ার জন্য তার অতীত টাই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে জীবনকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করায় যেখান থেকে পিছু হাটা যায় না। দু’টো রাস্তা খোলা থাকে,হয় নিজেকে শেষ করে দাও না হলে রুখে দাঁড়িয়ে নতুন করে বাঁচতে শেখো। অণুর কাছে এখন দু’টো রাস্তাই কঠিন মনে হচ্ছে। আত্মহত্যা মহাপাপ সেটা ও ভালো করেই জানে। আর অন্যকারো জন্য ও সবাইকে কষ্ট দিতে পারবে না। তাই দ্বিতীয় রাস্তাটাই খোলা আছে ওর জন্য। কিন্তু রুখে দাঁড়াবার শক্তি যে ও পাচ্ছে না। ওর পাশে যে কেউ নেই। ইয়ারাবী একমাত্র ব্যাক্তি যার কাছে সব বলে ও নিজেকে হালকা রাখে। কিন্তু ও তো একটা ট্রমার ভিতরে আছে। তাই নিজের পেইন গুলো ও বুকে চাঁপা দিয়ে রাখছে। আচ্ছা ওর জীবনে কী এমন কেউ আসবে যে ওকে আগলে রাখবে? যেভাবে আবরার ইয়ারাবীকে রাখে।ঘরের সাথে লাগানো বেলকনির গ্রিল ধরে আকাশের দিকে মূখ করে কথাগুলে ভাবছিল অনু। বাইরে সন্ধ্যার ঠান্ডা বাতাস ভালোভাবেই অনুভূত হচ্ছে। তাই গায়ের ওড়নাটা ভালে ভাবে জড়িয়ে নিল। এমন সময় ওর ফোনটা বেঁজে উঠল। বেলকনিতে রাখা টেবিলটার উপর ফোনটা রাখাছিলো,তাকিয়ে দেখল একটা আননোন নাম্বার থেকে কল্ আসছে। এত সময়ে কোনো আননোন নাম্বার থেকে কল্ এসেছে দেখে ও রিসিভ করল না। কিন্তু ফোনটা ক্রমাগত বেজেই চলেছে। অনুর রাগ চরম সীমায় পৌঁছে গেছে।কেননা আট ঘন্টা জার্নি শেষে রংপুর থেকে বাসায় ফিরেছে অনু।কারোর সাথে কথা বলতে একটুও ভালো লাগছেনা,তাই বাড়িতেও কোনো কল্ করেনি।একরাশ বিরক্তি নিয়ে কল্ রিসিভ করে অপর পাশের লোকটাকে কিছু বলতে না দিয়েই অনু বলা শুরু করল,
-“এই কে রে তুই? এই ভরসন্ধ্যায় একটা মেয়েকে ফোন দিয়ে জ্বালাতন করছিস। খেয়ে দেয়ে আর কাজ পাস না তাইনা। এইজন্য এইসব অকাম করিস। বাড়িতে মা বোন নেই হ্যাঁ? সামনে আসলে টেংরি ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেব অসভ্য ছেলে কোথাকার?”

ওপাশের মানুষটা অনুর কথার ধরণ শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা। ওপাশের মানুষটা কথা না বলায় অনুর রাগটা আরো বেড়ে গেল। ও আবার বলল,
-“কি রে কথা বলিস না ক্যান? মুখে কি সুপারগ্লু লাগিয়েছিস নাকী?”

ওপাশের মানুষটা নিজের রাগটাকে শান্ত করে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
-“অনু আমি প্রত্যয়।”

অনু প্রত্যয়ের নাম শুনে জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে,
-“স্যরি স্যরি। আসলে বুঝতে পারিনি।”
-“এত জোরে জিহ্বায় কামড় দিও না,তাহলে নিজেই ব্যাথা পাবে। আর এই সময়ে তুমি বেলকনিতে কেন? ঠান্ডা লাগতে পারে। নিজের কেয়ার করা শেখো।”
-“আমি জিহ্বায় কামড় দিয়েছি সেটা আপনি জানলেন কি করে?তাছাড়া আমি যে বেলকনিতে সেটাই বা জানলেন কি কীভাবে?এখন আবার বলবেন না আপনি অন্তর্যামী।”
-“না,সেটা বলবোনা।তবে বাসার নীচে তাকাও।”
-“কেন? নীচে কি আছে?”
-“আহা তাকাও তো আগে।”

অনু নিচে তাকিয়ে দেখে প্রত্যয় ওর গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে অনুর দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা দেখে ও প্রত্যয়কে বলে-
-“আপনি এখানে কেন? আচ্ছা দাঁড়ান আমি আসছি।”

অনু নীচে গিয়ে প্রত্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলে-
-” আপনি এখানে কেন এসেছেন? ”
-“তার আগে বলো আমাকে ফোনে যেন কি বলছিলে? আমার টেংরি ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবে। কিন্তু টেংরিটা কি?”
-“ওটা তো আমি ভেবেছিলাম যে কোনো ফালতু ছেলে ফোন দিছে তাই। আর টেংরি মানে হচ্ছে পা।”
-“তুমি এইসব ওয়ার্ড ব্যাবহার করো ভাবাই যায় না।”
-“না ভাবার কি আছে? আমি এমনই। ইয়ারাবীর মতো এতটা ভালো নই। আমি যেমন,সবার সামনে নিজেকে সেভাবেই প্রেজেন্ট করি।ও নিজেও করে তবে পরিবারের সামনে বেশি নয়।”
-” অনু পৃথিবীতে কেউই খারাপ বা অসুন্দর নয়। সবাই নিজের নিজের জায়গা থেকে ঠিক। কিছু কিছু সময় আমরা মানুষেরা ভুল করে ফেলি। তবে ভুল গুলে যদি কারোর ক্ষতির কারণ হয় তবে সে নিঃসন্দেহে একজন খারাপ মানুষ। তুমি তো কারো ক্ষতি করনি। তাহলে?”
-“জানিনা আমি। হয়তো করেছি বা হয়তো করিনি, অনেক রাত হয়েছে। আপনি বাসায় যাবেন না?”
-“হুম যাবো।”
-“এক মিনিট আপনি এখানে কেন?আপনার তো..”
-“বর্তমানে ঢাকাতে আছি,আর এক সপ্তাহের ছুটি।তাই আরকী…”
-“আচ্ছা সাবধানে যাবেন।”

অনু পিছনে ঘুরে ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই প্রত্যয় বলে ওঠে-
-“সবকিছু ভুলে কি আবার নতুন করে শুরু করা যায় না? আমাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না অনু?”

অনু পিছন ঘুরে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
-“কাল টিএসসির মোড়ে চলে আসবেন। কিছু কথা বলার আছে আমার। তারপর ভাবা যাবে না হয়। এখন বাসায় চলে যান। অনেক রাত হয়েছে। বাসায় সবাই চিন্তা করছে। আশা করি সবার কথা চিন্তা করবেন।”

অনু আর কথা না বাড়িয়ে বাসার ভিতরে চলে যায়। প্রত্যয়ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দেয়। তবে ওর ভালো লাগছে যে অনু ওর সাথে নিজে দেখা করতে চেয়েছে। কিন্তু কি বলবে অনু?ওকে ফিরিয়ে দিবে নাকী গ্রহণ করবে?প্রত্যয় অনুকে পটানোর জন্য যা যা করার তাই করেছে।আর এসব করতে অনুর সবচেয়ে কাছের মানুষ ওকে সাহায্য করছে।সেই মানুষটাকে একবার কল দিয়ে জানালে মন্দ হয়না।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ড্রাইভ করছিলো প্রত্যয়।ফোনটা বের করে আবার কী ভেবে পকেটে ঢুকিয়ে রাখে।

(১৪৪)

ইয়ারাবীর ডাইনিং টেবিলের উপর মাথা রেখে বসে আছে।মিসেস রায়হান কোনো এক কারনে হয়তো কিচেনে যাচ্ছিলেন ওকে দেখে ওর মাথায় হাত রেখে বলেন,
-“কীরে মা?খারাপ লাগছে তোর?”

ইয়ারাবী মাথা উঁচু করে ওড়নাটা ঠিক করে দিয়ে বলে,
-“হ্যাঁ,আম্মু।প্রচুর মাথা ব্যাথা করছে…”
-“তো এখানে কী করছিস?রুমে যেয়ে শুয়ে থাক, আমি সোনালিকে কড়া করে কফি করতে বলছি…”
-“না আম্মু,এই টাইমে শোয়া ঠিক হবেনা।”
-“বেশি বুঝিস কেন?আচ্ছা আবরার কোথায়?”
-“রুমে,ল্যাপটপে বসে কাজ করছে,রেস্ট নিতে বলছি শুনছেনা।”
-“ও এবার বুঝতে পেরেছি।আবরারকে বলবিনা বলে এখানে বসে আছিস।”
-“আম্মু আপনি জানেন উনি কেমন?তার উপর উনার এই অবস্থা।”
-“ছেলেটা যে তুই বলতে পাগল।রুমে যা,সোনালি কফি নিয়ে যাবে…”

মিসেস রায়হান ওকে ঠেলে ঠেলে রুমে পাঠায়।ইয়ারাবী রুমে এসে দেখে আবরার ওয়াশরুম থেকে একটা কালো ট্রাউজার আর সাদা গেন্জি পরে মাথা মুছতে মুছতে বের হচ্ছে।
-“কোথায় ছিলে তুমি?”
-“আপনি শাওয়ার নিয়েছেন?”
-“উহু,ব্যান্ডেজের জন্য করতে পারলাম কোথায়।তাই হালকা পানি নিয়েছি।তোমার কী খারাপ লাগছে।”
-“কই নাতো,আপনার কিছু লাগবে?”

আবরার কিছু একটা ভেবে বলে,
-“আজকের ডিনারটা রুমে দিয়ে যেতে বলো।আর মমকে এক কাপ কফি দিতে বলো।”
-“সোনালি আপু দিয়ে যাবে।”
-“বই কোথায় তোমার?পড়া নেই নাকী?”
-“আছে,কিন্তু আজকে পড়বোনা।”
-“কেন?”
-“না মানে….”

-“স্যার,আসবো?”
আবরার পিছনে তাকিয়ে দেখে সোনালি কফির ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আবরার ওকে ইশারায় ভিতরে আসতে বলে।সোনালি এক কাপ কফি আবরারকে আরেকটা ইয়ারাবীকে দিয়ে চলে যায়।আবরার ইয়ারাবীর কফির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মাথা ব্যাথা করছে?”
-“হ্যাঁ,মানে…”
-“বললেই হতো,কফি খেয়ে শুয়ে থাকবে।”

ইয়ারাবী কফি খেতে খেতে বলে,
-“জানেন আবরার,আদিবা আপুর বেবী হবে।”
-“আলহামদুলিল্লাহ্,খুব ভালো।”
-“আপুর বিয়ে আমাদের পরে হয়েছে?”
-“একদিন পরে…”
-“আমার না নিরার জন্য চিন্তা হচ্ছে।”
-“এসব চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করোনা।আচ্ছা শোনো সামনের সপ্তাহ থেকে তো ক্লাস চালু, আমি চাইছি সামনের সপ্তাহে যেতে।”
-“ক্লাস মিস যাবে,যাওয়াটা কী খুব জরুরি আমার?”
-“হ্যাঁ,”
-“আমি যেয়ে কী করবো?”
-“সামনের সপ্তাহে ফাইকারা এখানে আসবে।তার তিনদিন পরে অস্ট্রেলিয়া ব্যাক করবে।আমি চাইনা ও তোমার কিছু করুক।”
-“ভালো কথা মনে করেছেন।উনারা এতোদিন কোথায় ছিলো?”
-“ফাইকার নানুবাড়িতে,রাজশাহী।কেন?”
-“আপু আপনাকে সত্যিই পছন্দ করে।”
-“ওটাকে পছন্দ নয় আকর্ষন বলে।”
-“নিউটনের কত নাম্বার সূত্র যেনো?”
-“দুষ্টু হয়ে যাচ্ছো,এর মধ্যে নিউটনকে কোথায় পেলে…”
-“আকর্ষনের কথা শুনলেই আমার নিউটনকে মনে পড়ে।”
-“পড়াকু স্টুডেন্ট তো তাই…”
-“আপনার মতো নই,জীবনে তো প্রথম থেকে দ্বিতীয় আসেননি।আমিতো দু’বার লাড্ডুও পেয়েছি,ম্যাথে।”

আবরার হেসে হালকা মাথা নাড়িয়ে বলে,
-“উহু,এইট-নাইনে হয়েছিলাম।তবে বাসা থেকে কিছু বলেনি…”
-“আম্মু বলেছে আপনি খুব দুষ্টু ছিলেন।”
-“এটাও বলে দিয়েছে তোমাকে?”
-“হু,আরো অনেক কিছু বলেছে।আপনি আর ভাইয়া মিলে পাশের বাসায় বাগানে খরগোশ ছেড়ে দিতেন,যাতে করে তাদের বাগানের চারা থেকে ভালো ফুল না হয়।মানুষের ঘরের কারেন্টের তার কেঁটে দৌড় দিতেন।তবে কোনোদিন ধরা পরেননি কেন?”

আবরার কফির মগটা রেখে ওর মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
-“ম্যাজিক,যা সবাই পারেনা।আচ্ছা একটু রেস্ট নাও।আমি দেখে আসি,জারবা আর মেঘ কী করছে?দু’টায় পড়াচোর…”

আবরার বেড়িয়ে যেতেই ইয়ারাবী একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।মানুষ কতটা ব্যাতিক্রম,একজন আরেকজনের সম্পূর্ন বিপরীত।ইয়ারাবী কাউকে ভালোবাসতে চাইনা,তবে আবরারের প্রতি সব সময় এক মায়ার টান কাজ করে। প্রচলিত কথা আছে,প্রতিটি স্ত্রী তার স্বামীর পা পাজড়ের হাত দ্বারা সৃষ্টি।তাছাড়া বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ।তাই মনে হয় এমন টান অনুভব করে।

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here