#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:৩৬
(১২৪)
ইমন ঘুমিয়ে আছে,পাশে বসে ওর বাবা নিজের স্ত্রীর ছবির দিকে চেয়ে আছেন এক ধ্যানে।পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলেও ভালোবাসার কোনো অভাব ছিলোনা দু’জনের মধ্যে।মিসেস রহমান সব সময় বলতেন,
“তোমার আগে যেন আমি উপরে যেতে পারি।কেননা তোমার মৃত্যু সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।”
উনি ছবিটা হাতে স্পর্শ করে বলেন,
-“স্বার্থপর তুমি সব সময় ছিলে,কতটা কষ্ট হচ্ছে জানো তুমি?চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে, শুধুমাত্র পারছিনা বাচ্চাদের জন্য।রাতেও কত সুন্দর কথা হলো আমাদের মাঝে কিন্তু কখনো বুঝতে পারিনি ওইটা ছিলো শেষ কথা।যদি জানতাম তবে ছুটে চলে আসতাম তোমার কাছে।তুমি বলেছিলে তোমার কবরটা যেনো বাড়ির পাশে দেওয়া হয়,আমি সেটাই করেছি।সব সময় তোমাকে চোখের সামনে রাখছি,বাড়িতে যখন থাকবো সারা রাত বসে দু’জনে কথা বলবো।ও তুমি তো কথা বলতে পারবেনা,শুধু আমি বলবো তুমি শুনবে।নিয়তি এমন কেন হলো শিখা, তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকবো?খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু বলতে পারছিনা,আমি তো জানি তোমার বড় দু’ছেলে যত শক্ত দেখাক না কেন ভিতর থেকে পুরে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে,তবু শক্ত রাখছে নিজেদেরকে।তোমার মেয়েটাও খুব কাঁদছে জানো,তুমি তার জন্মদাত্রী মা না হলেও মায়ের জায়গা নিতে পেরেছো।আর তোমার ছোট ছেলে, কীভাবে থাকবে তোমাকে ছাড়া? তুমি শুধু একজন মমতাময়ী মা নও,একজন আদর্শ স্ত্রী রণবীর সৈনিক আর ভালো বন্ধুও ছিলে।জানি রাগ করছো,কিন্তু সত্যিটাই বললাম।এরপর থেকে যখন ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরবো তখন তোমাকে আর কাছে পাবোনা,পাশে এসে বসে কথা বলবেনা,কখনো নালিশ করবেনা তোমার ছেলে-মেয়েরা কেমন বিরক্ত করেছে।কেন চলে গেলে তুমি না ফিরার দেশে।জানি জন্ম-মৃত্যুর উপর কারো হাত থাকেনা, তবে আল্লাহ কেন তোমার দোয়া কবুল করলো?”
মি.রহমান ছবিটাকে বুকে আকড়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকেন।কিছু ভালোবাসার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয়না,আদেও কী ব্যাখ্যা হয় এই আটত্রিশ বছরের সংসার জীবনের ভালোবাসার।অনেকের কাছে মনে হতে পারে বৃদ্ধ বয়সে কীসের ভালোবাসা?কিন্তু ভালোবাসা কখনো বয়সে বিবেচনা হয়না।জোড়া পাখির মধ্যে যখন একজন মারা যায় তখন দ্বিতীয় জনের বেঁচে থাকা খুব জটিল হয়ে যায়।ওনারা ছিলেন ঠিক তেমন জোড়া পাখির মতো।চাইলেও তিনি আজ চিৎকার করে কাঁদতে পারছেন না,কেননা উনি যদি ভেঙে পরেন তবে বাচ্চাদের সামলাবে কে?উনি ছবিটা টেবিলের উপর রেখে ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত রাখেন,জিম করা বডি হলেও একদিনে কতটা কাহিল হয়ে পরেছে ছেলেটা।
ইরাক সোফায় বসে মাথা নিচু করে দু’হাত দিয়ে চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে আছে।ওর পাশে আবরার বসে ওর পিঠে এক হাত দিয়ে রেখেছে।সামনের বেডে ইয়ারাবী শুয়ে আছে,ওর পাশে য়ুহার বসে ওর মাথায় হালকা জলপট্টি দিচ্ছে।আবরার ইরাকের পিঠে হাত ঢলে বলে,
-“তুই প্লীজ এভাবে ভেঙে পরিস না?”
-“তুই জানিস আবরার,আমি কখনো আর্মি হতে চেয়েছিলাম না।কিন্তু আম্মু সব সময় আমাকে সাহস জুগিয়েছে।জানিস আম্মুর সাথে যখন কথা হলো তখন আম্মুকে বলেছিলাম,এবার বেশি করে ছুটি নিয়ে এসে আম্মুর সাথে সময় কাঁটাবো।কিন্তু তা আর হলোনা।কষ্ট হচ্ছে,মনে হচ্ছে বুকের ভিতরটা ফেঁটে যাচ্ছে কিন্তু কী করব বল?আমি যে বড়,আমি যদি ভেঙে পরি বাকীদের সামলাবে কে?ইমনের অবস্থা ভালোনা,আব্বুও ভেঙে পরছে, ইফাজ আম্মুর কবরের পাশে বসে আছে,আর এর অবস্থা আরো খারাপ।”
-“মামা-খালারাও ভেঙে পরেছে তবে…”
-“খালাদের কান্না হলো লোক দেখানো,আপদ বিদায় হয়েছে ওনারা বেঁচেছে।আবরার এর পরে বাড়িতে এসে আর মাকে পাবোনা,আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিবেনা।মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে পারবোনা,আর কখনো ফোন আসবেনা মায়ের।সব সময় অপেক্ষা করতাম কখন সময় পাবো আর মায়ের সাথে কথা বলবো,কিন্তু আজ থেকে সেই অপেক্ষার প্রহর আর গুনতে হবেনা।”
-“প্লীজ কাঁদিসনা ইরাক,সামলা নিজেকে।মৃত ব্যাক্তির জন্য কাঁদলে তারা কষ্ট পায়।মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘কুল্লু নাফসিন যা-ইকাতুল মাওত’ অর্থাৎ : ‘প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করতে হবে।’
মৃত ব্যক্তির জন্য কান্না করলে যে, মৃত ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হবে, সেদিকে কারো খেয়াল নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই মৃত ব্যক্তিকে তার পরিবারের অধিক মাত্রায় কান্নাকাটির জন্য শাস্তি দেয়া হবে।(বুখারী-১২২৬ নম্বর হাদিস)।
এই হাদিস দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় মৃত ব্যক্তির জন্য কাঁদলে মৃত ব্যক্তিকেই শাস্তি দেয়া হবে। যখন কোনো জীবিত ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির জন্য উচ্চস্বরে কান্না করে, তখন এই জীবিত মানুষদের কি শাস্তি দেয়া হবে, এ ব্যাপারে হাদিসে স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
হজরতে আবু মালিক আশইয়ারী (রা.) নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে চারটি জাহিলিয়াতের অভ্যাস রয়েছে, যা তারা ত্যাগ করবে না। আর তা হচ্ছে, স্বীয় বংশের গৌরব করা, অন্যের বংশকে দোষারোপ করা, তারকার মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করা এবং মৃত ব্যক্তির জন্য উচ্চস্বরে চেঁচামেচি করে কান্নাকাটি করা। এই হাদিসের শেষ অংশে বলা হয়েছে, মৃত ব্যক্তির জন্য উচ্চস্বরে ক্রন্দনকারী ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে তওবা না করলে কিয়ামতের দিন তাকে দুর্গন্ধযুক্ত পায়জামা এবং শরীরের পচন সৃষ্টিকারী পোশাক পরানো হবে। (মুসলিম: কিতাবুল জানায়েজ)।
এছাড়া নবী করিম (সা.) আরো বলেছেন, ‘যারা মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশ করতে গিয়ে গাল চাপড়ায়, জামার বোতাম ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহিলিয়াতের যুগের মতো চিৎকার করে কান্না করে। তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (বুখারি- ১২২০)।
এই হাদিস দু’টি থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, যারা আহাজারি করে মৃত ব্যক্তির জন্য কান্না করবে তারা নবী করিম (সা.) এর দলভুক্ত না। মৃত্যুর ওপর বিলাপকারিণী যদি মৃত্যুর পূর্বে তওবা না করে, তাহলে তাকে কিয়ামত দিবসে এমন অবস্থায় উত্থান করা হবে যে, তার ওপর আলকাতরাযুক্ত ও মরিচাযুক্ত পোশাক থাকবে। (মুসলিম- ৯৩৪)।
তুই জানিস তো এসব,তাহলে কেন করছিস?”
-“কী করবো বল?মনতো মানতে চাইছেনা, স্বপ্নেও ভাবিনি কখনো।”
-“আমি তোর কষ্ট অনুভব তো করতে পারবোনা, তবে তোকে এতটুকু বললো শক্ত হ।”
ইরাক য়ুহারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুই রুমে যেয়ে শুয়ে পর,রাত অনেক হয়েছে।”
-“প্রয়োজন নেই,এমনিতে ঘুম আসবেনা।”
-“শৈল আছে নাকী চলে গেছে?”
-“থাকার তো কথা,মনে হয় আছে।”
-“যেয়ে দেখ কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাকী?”
-“তোমার অতো ভাবতে হবেনা,ও ম্যানেজ করে নিতে পারে।কিন্তু তোমার ঘুমের প্রয়োজন,তুমি ঘুমিয়ে নাও।”
-“আসবেনা আজ,আমি যেয়ে দেখি ইফাজ কী করছে।”
ইরাক কথাটা বলে চোখ মুছে বাইরে বেরিয়ে যায়।আবরার য়ুহারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমার সাথে কিছু কথা বলার প্রয়োজন।”
-“বলো…”
-“জানি তোমার মন-মানষিকতা ভালো নেই,কিন্তু যখন দু’জনে জেগে আছি সুতরাং কথাতো বলা যায়।”
য়ুহার ইয়ারাবীর চুল থেকে হাত সরিয়ে ওর গায়ে ব্লাঙ্কেটটা ভালো করে টেনে দেয়।তারপর আবরারের মুখোমুখি হয়ে বসে বলে,
-“ঘুমাবেনা তুমি?”
-“না,তোমার বোন যখন সিক থাকে আমার ঘুম হারাম হয়ে যায়।তাছাড়া এমনিতেও ঘুম আসবেনা, কেননা শিখা আন্টি আমার খুব কাছের মানুষ ছিলো।যখন আসতাম উনি খুব আদর করতেন।”
-“ফুপু অনেক ভালো মানুষ ছিলেন,উনার চিন্তা-ভাবনা সবকিছু ছিলো পার্ফেক্ট।বিশেষ করে অনেক স্ত্রীরাই আছেন যারা নিজের আপনজন, পরিবার থেকে খ্যাতি,প্রতিপত্তি,অর্থের মূল্য দেয়।শুধুমাত্র নিজের স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে ব্যাস্ত থাকে কিন্তু ফুপু তেমন মানুষ কখনো ছিলেন না।উনি সর্বদা ভালোর সাথে ভালো আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন।”
-“সেটা সম্পূর্ন ঠিক,অনার মতো মানুষ খুব কম হয়।”
-“তুমি যেন কী বলতে চেয়েছিলে?”
-“দশ বছর আগের ঘটনা,,তুমি জানো কেসটা রি-অপেন হয়েছে।”
য়ুহান নিজের মুখে ‘চ’ টাইপের আওয়াজ তুলে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“হয়েছে হবে না করেছো বলো,ইলা তোমার কাজিন ছিলো তাইনা।”
-“হ্যাঁ,বলতে পারো আমরা সমবয়সী ছিলাম।”
-“কাছের মানুষ চলে যাওয়ার কষ্ট তারাই অনুভব করতে পারে যারা হারিয়েছে।কিন্তু আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?তোমাকে শুধু একজন মানুষ সাহায্য করতে পারে সে হলো ইয়ারাবী।”
আবরার হালকা হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সেটা খুব ভালো করে জানি আমি,কিন্তু পুরানো রেকর্ডসগুলো বের করতে তোমার সাহায্য লাগবে।”
-“আমি আমার যথা সম্ভব চেষ্টা করবো।তবে কেঁচো খুঁড়তে যেন সাপ না বেড়িয়ে পরে।”
-“মানে?”
-“অনেকটা বুদ্ধিমান ছেলে,বোঝাতে হবেনা নিশ্চয়ই।”
-“তবে বাগানটাকে সুন্দর করতে হলে শুধু আগাছা নয় বরং কিছু গাছ গোরা থেকে উপড়ে ফেলা ভালো।”
-“যতদিন বেঁচে আছি সাহায্য করবো।”
আবরার কিছুটা সন্দেহ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মানে?”
-“আরে মৃত্যু কার কখন হয় কেউ তো বুঝতে পারেনা তাই বললাম আরকী।খুব খারাপ লাগছে বাচ্চাটার জন্য,মায়ের আদর-ভালোবাসা সব ফুপুর কাছে থেকে পেয়েছে।চার বছর আগের ইয়ারাবী আর এখনকার ইয়ারাবীর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত,একে শক্ত-সামর্থ্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সবকিছু ফুপু শিখিয়েছে।হতে পারে ইশানি ফুপু ইয়ারাবীকে জন্ম দিয়েছে কিন্তু ওকে গড়ে তুলেছে শিখা ফুপু।”
(১২৫)
আযানের পর থেকেই বাড়িতে শোরগোল শুরু হয়ে গেছে।ইমন ঘুম থেকে উঠেই চিৎকার করে কাঁদছে, ইরাক ওকে বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরে রেখে শান্তনা দিচ্ছে।নিজের মনের ভিতর যে তুফান চলছে কিন্তু সেটা কাউকে বুঝাতে পারছেনা।
-“আচ্ছা এমন করে কাঁদলে আম্মুর আত্মা কষ্ট পাবে তো ইমু।দেখি তাকা আমার দিকে,তুই তো ছিচকাদুনি স্বভাবের ছিলিনা।”
-“ভাইয়া,আম্মু আর নেই।আমি।কার কাছে থাকবো?”
-“কেন,আমরাও কী মরে গেছি?কান্না থামা,এদিকে তুই এমন করছিস ওই দিকে পিচ্চি।মায়ের কবরের পাশ থেকে তো সরানো যাচ্ছেনা।তোরা কী আমাদের কেউ মারতে চাস?”
মিসেস নিন্দু ইরাকের দিকে তাকিয়ে নাক টেনে কাঁদার সুরে বলে,
-“আব্বু পরের মেয়েই কথা কেন ভাবছো?নিজের কথা ভাবো এখন থেকে,ও পরের মেয়ে দু’দিনে ভুলে যাবে।দেখলেনা আপা যখন ওকে দেখতে চাইলো তখন ওকী কথা বলেছিলো?…”
ইরাকের এত কষ্টের মধ্যেই শরীরে আগুন জ্বলে উঠে।কতটা নিকৃষ্ট মানুষ হলে এমন সময় এই কথাগুলো উচ্চারন করে।মি.রহমান ইচ্ছা করে মিথ্যা বলেছিলেন যে ইয়ারাবীর ফোন বন্ধ।কেননা তখন আবরার ওকে নিয়ে রেডি হচ্ছিলো বাংলাদেশে আসার জন্য।আর এই মানুষগুলো কথাগুলোর আগামাথা না বুঝে,পরিস্থিতি বিবেচনা না করে তিলকে তাল বানাতে প্রস্তুত।ইরাক অনেকটা রাগী কন্ঠে ধমক দিয়ে উঠে,
-“চুপ!একদম চুপ,আমি যেন একটা বাজে সাউন্ডও না শুনি।আপনার সাহস কী করে হয় এসব বলার।ভাববেন না এখন মা নেই,তার জন্য নিজেদের ইচ্ছামত আমাদের কান ভাঙ্গানি দিতে পারবেন।এক কথা কান খুলে শুনে রাখুন,আমার মায়ের তিন ছেলে আর এক মেয়ে আছে,সুতরাং উল্টো-পাল্টা কথা যেন না শুনি।”
মিসেস নিন্দু চুপ হয়ে যান কথাটা শুনে।তিনি হয়তো কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেছেন উনি কার সাথে কথা বলছেন।ভাগ্য ভালো যে মায়ের মৃত্যু শোকে আছে তাই ইরাক বেশি কথা বলেনি।মি.রহমান বাকীদের সাথে মসজিদে গিয়েছিলেন নামায পড়তে এখনো ফিরেননি।ইরাক ওর ফুপু দোলেনের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“ফুপি,একটা প্লেটে একটু ভাত নিয়ে আসবে।”
মিসেস দোলন কথাটা শুনার সাথে সাথে রুম থেকে বেড়িয়ে যেয়ে ভাতের ব্যাবস্থা করতে থাকেন।নুসরাতের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন মিসেস দোলনের স্বামী রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাকের সাথে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান।তখন থেকে মিসেস দোলন এক হাতে স্বামীর সব কিছু সামলে এসেছেন।অবশ্য ওনার শ্বশুড়বাড়ির মানুষ বলেছিলো নতুন করে সংসার করতে তবুও উনি হার মানেননি।স্বামীর শেষ চিহ্নটুকু আকড়ে ধরে বেঁচে আছেন উনি।মিসেস শিখা ননদকে অনেক সাহায্য করতেন যার জন্য উনি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবেন।
ইফাজ,তারা,য়ুহার কেউ ইয়ারাবীকে কবরের পাশ থেকে উঠাতে পারছেনা।ইয়ারাবী কবরের মাটি আকড়ে ধরে কান্না করছে।আবরার ওর খালুদের সাথে নামায পড়তে গেছেন।ইয়ারাবী চিৎকার করে কান্না করছে,ওর আহাজারি শুনলে যে কোনো মানুষের চোখের জল পরতে বাধ্য ।এটাই প্রথম যে ইয়ারাবীর হৃদয়ভাঙ্গা কান্না মানুষ দেখতে পারছে।
-“ও খালামনি তুমি কেন চলে গেলে?তুমি সব সময় বলতে,রক্তের সম্পর্ক না হলেও তুই আমার মেয়ে।এখন আমার কেউ থাকলো নারে…তুমি তো বলেছিলে,তুমি সব সময় আমার সাথে থাকবে তাহলে ফাঁকি কেন দিলে?”
ইফাজ চোখের পানি মুছে দু’হাত দিয়ে ওকে উঠানোর চেষ্টা করে বলে,
-“পিচ্চি প্লীজ কাঁদিসনা,তোকে এভাবে কাঁদতে দেখলে ইমুও ভেঙে পরবে।ভুলে যাসনা তুই অসুস্থ, শেষে এমন না হয় যে তোর জন্যও কবরখুঁড়তে হবে।”
-“ভাইয়া,খালামনি কেন চলে গেল?তুমি না ডাক্তার কত মানুষকে ভালো করেছো তবে খালামনিকে কেন পারোনি?”
ইয়ারাবীর কথা শুনে ইফাজ মুহুর্তের মধ্যে থমকে যায়।নিজেকে নিজের কাছে অপরাধী লাগছে এখন?ও জানে ওর করার কিছু ছিলোনা কিন্তু… তারা ইয়ারাবীর হাত ধরে বলে,
-“পুতুল এটা কী কথা?তুই ভাইয়াকে কেন দোষারোপ করছিস?তোর যেমন কষ্ট হচ্ছে ভাইয়ারও তেমন হচ্ছে,তবে তোর এই কথায় কষ্ট আরো বারিয়ে দিয়েছে।তুই এমন কিছু বলবি সেটা ভাবতেও পারেনি….”
ইয়ারাবী কথাটা শুনে তারার দিকে তাকায়।ওদের থেকে কিছুটা দূরে ইফাজ উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে,চোখ দিয়ে বর্ষনের ন্যায় পানি ঝড়ছে।ইয়ারাবীর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বুঝতে পারে ও ইফাজকে কী বলেছে?ও নিচে থেকে উঠে চোখের পানি মুছে দৌঁড়ে ওর ভাইয়ের কাছে যেয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“স্যরি ভাইয়া,মাফ করে দাও।আমি বুঝতে পারিনি আমি কী বলেছি?আমি সত্যি এমন কিছু বলতে চাইনি ভাইয়া।”
ইফাজ ইয়ারাবীকে আকড়ে ধরে বলে,
-“পাগলি কাঁদছিস কেন?আমি কিছু মনে করিনি পিচ্চি,মায়ের কথা মনে পরছে তাই।শুধু কাঁদিস নারে সোনা,অসুস্থ হয়ে পরবি।কিছু খাসনি,এমন করলে কী চলে?”
-“ভাইয়া,খালামনি আমাদের ছেড়ে চলে কেন গেলো?”
-“আম্মুর হায়াত যতদিন পর্যন্ত ছিলো ততদিন বেঁচে ছিলেন উনি।এখন কান্না না করে দোয়া কর আর ভিতরে চল,কিছু খেয়েনে নয়তো আবরার রাগ করবে।”
-“ভাইয়া আমি যে বাড়ির ভিতর যেতে পারছিনা, দমবন্ধ হয়ে আসছে।এখানের প্রতিটা জিনিসের ছোঁয়ায় খালামনির শূন্যতা পাচ্ছি।”
-“এমন বললে হবেনা লক্ষী,চল কিছু খাবি।”
ইফাজ শার্টের বাম হাতায় চোখ জোড়া মুছে পিছনের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“য়ুহার,তারা তোমরাও ভিতরে এসে।কিছু মুরব্বি আছেন উনাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”
(১২৫)
মিসেস জামান রুমের মধ্যে বেশ কিছু মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে হাক-ডাক ছেড়ে কান্না করতে শুরু করেন।মিসেস ইশানিও চোখের পানি ফেলছেন, তবে উনার দু’ভাইয়েরা প্রচুর শোক পাচ্ছেন।মিসেস জামানের এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় উনার কাছে বসে বলেন,
-“বোনকে হারিয়েছো,কিন্তু তাই বললে কান্না করলে হবে।”
-“কী করবো?আমার বোনটা যা কত ভালো ছিলো, ওর মতো দ্বিতীয় কোনো মেয়ে নেই।”
কথায় আছে,”জীবিত ব্যাক্তির প্রশংসা যতটা না পাওয়া যায় তার থেকে মৃত ব্যাক্তির প্রশংসা বেশি পাওয়া যায়।কেননা মৃত ব্যাক্তির প্রশংসা শত্রুরাও একবার হলে করে।”মিসেস রহমানের ক্ষেত্রে তাই হচ্ছে,কেননা মিসেস জামান কখনো তার মেজো বোনকে সহ্য করতে পারতেন না।
একজন মাঝারি বয়সের মহিলা সম্পর্কে মিসেস নিকির খালা শ্বাশুড়ি,পান চিবাতে চিবাতে নিকির পাশে বসে বলেন,
-“বৌ তুমি তো কইতে তোমার মেজো বোনের তিন পোলা তাহলে ওই মাইয়াটা কেডা?দেখলাম খুব কানতাছিলো।”
মিসেস নিকি নাক টেনে ওনার খালা শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“ওটা আমার ইশানি আপুর মেয়ে,সেই পিচ্চি ওই কুন্দনের বিয়েতে গেছিলো।আসলে ছোটবেলা থেকে ওকে শিখা আপু নিজের কাছে রাখতো তাই একটু বেশিই মায়া।”
-“কি কও বৌ?ওই মাইয়া এতো বড় হইয়া গেছে,তিন বছর আগে দেখছিলাম।তা ওর কী বিয়া হইয়া গেছি নাকী?এক পোলারে দেখলাম ওর লগে।”
-“হ্যাঁ,এই তো চারমাস হয়ে গেছে বিয়ের।আপনাদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিলো,কিন্তু আপনাদের নতুন দোকানে মাল উঠানোর জন্য আসেত পারেননি।”
-“হায় হায়!ওইটুক মাইয়া বিয়া হইয়া গেছে, লেখাপড়া কী করে এহোনো?বর কী করে ওর?”
মিসেস নিকি মাথার কাপড়টা আরেকটু টেনে দিয়ে বলেন,
-“হ্যাঁ,এখনো পড়ছে আইন নিয়ে।আর ওর স্বামী একজন ডাক্তার।”
-“মাইয়াডারে মনে ধরছিলো,ভাবলাম তোমার ভাসুরের পোলার লাইগা ওরে নিমু।কিন্তু বিয়া হইয়া গেছে তো নাক ফুল তো দেখলাম না।”
-“নোজ পিন ওর পছন্দ নয়,তাছাড়া ওর স্বামীরও নয়।কেননা বিয়ের চিহ্ন হিসাবে এসব জিনিস ব্যবহার করা হাদিসে নেই তা ওরাও মানেনা।আজকালকের ছেলে-মেয়ে তো তাই…”
-“হ,ঠিকই কইছো।এরাই তো হাদিস কালাম জানে, আমরা তো আর কিছুই জানিনা।”
ইয়ারাবীকে রুমে নিয়ে যেয়ে ইফাজ গরম ভাতের এক লোকমা ওর মুখে তুলে ধরে।ইয়ারাবী ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুমি খাও,আমি জানি তুমিও খাওনি।”
-“আমি খাবো আগে তুই খা,তারা ওর ব্যাগে দেখো মেডিসিন আছে ওগুলো বের করো।”
ইয়ারাবী খেতে চাইনা তবে ইফাজ ওর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে বলে,
-“দেখ একজনের মৃত্যু দেখার সহ্য ক্ষমতা আছে, কিন্তু দু’জনের নয়।তুই যদি এখন না খাস তবে তোকে হাসপাতালে ভর্তি ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবেনা।তাই কথা না বারিয়ে খেয়েনে লক্ষী…”
ইয়ারাবীর ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুখে খাবার তুলে নেয়।ইফাজও ওকে আদর করে খাওয়াতে থাকে।তবে হঠাৎ ইয়ারাবীর হালকা পানি নিয়ে হাতটা ধুয়ে এক লোকমা ভাত ইফাজের মুখে তুলে ধরে।ইফাজ ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকালে ও বলে,
-“আমি খাচ্ছি তুমিও খাবে,কোনো কথা না।”
-“আচ্ছা…”
ইফাজের হাজার দুঃখের মধ্যে ওর কাজে হাসি আর ভালো লাগা দুটাই পায়।ও মৃদ্যু হেসে ওর হাত থেকে খাবার মুখে নেয়।মি.রহমানরা মসজিদ থেকে ফিরে রুমে যাওয়ার পথে এই অপূর্ব দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ান।আপন মায়ের পেটের না হয়েও যে এত মধুর সম্পর্ক হয় তা এদের না দেখল বুঝা যায়না।তৌফিক মি.রহমানের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
-“বোনের আরেক রুপ মা,দেখলেন দুলাভাই কতটা মধুর সম্পর্ক।”
-“জানো তৌফিক যখন এরা খাবার খেতে চাইতো না, তখন শিখাও ঠিক এভাবে ওদের যত্ন করে খাইয়ে দিতো।”
-“দুলাভাই,ইয়ারাবীর মধ্যে কিন্তু শিখা আপুর একটা তেজ আছে।”
-“হ্যাঁ,ঠিক বলেছো।তোমরা কেউ খাওনি মনে হয় আমি দোলনকে বলে খাবার দিতে বলি।”
-“আপনিও তো কিছু খাননি?”
-“আরে আমার…..”
-“খালু…”
হঠাৎ আওয়াজ শুনে মি.রহমান ইয়ারাবীর ঘরের দিকে তাকালেন।আসলে ওরা যখন খাচ্ছিলো তখন ইয়ারাবীর চোখ ওর খালুর উপর পরে।ইয়ারাবীর গলা ভেঙে যাওয়ার কারনে ঠিকভাবে কথা বলতে পারছেনা,হাতের ইশারা করে আবার ভিতরে ডাকে।মি.রহমান ভিতরে যেয়ে অনেক কষ্টে স্বাভাবিক হয়ে বলে,
-“কিছু বলবি মা?”
-“খেয়েছো তুমি?”
-“আ আমি এখন খাবোতো…”
-“মিথ্যা বলবেনা,মিথ্যা পছন্দ না আমার জানো তো।এখানে বসো,প্লেটে অনেক খাবার এখান থেকে হয়ে যাবে।হা করো,আমি খাইয়ে দি….”
-“এই না না,আমি সত্যি খেয়ে নিবো।তুই কষ্ট করিস না মা…”
-“কষ্ট নাকী আমার হাতে খেতে ঘৃনা করছে?”
-“পাগল হয়েছিস,ছেলে কখনো মায়ের হাতে খেতে ঘৃনা পায়না।তাছাড়া তুই আমার সোনা মা,তোকে কেন ঘৃনা করবো?”
-“তাহলে খেয়ে নাও,আমার বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে…”
-“আচ্ছা, ঠিক আছে…আমি মায়ের হাতেই খায়।”
ইয়ারাবী ইফাজ আর ওর খালুকে খাইয়ে দিয়ে ওড়নার কোনা দিয়ে মুখ মুছে দেয়।মি.ফুয়াদ দূর থেকে এই দৃশ্য দেখলে আপনা-আপনি চোখ থেকে পানি বের হতে থাকে।হঠাৎ উনি কাধে কারো স্পর্শ টের পেয়ে পিছনে ঘুরে দেখেন আবরার প্যান্টের পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।উনি আবরারের দিকে তাকিয়ে বলেন,
-“কিছু বলবে বাবা?”
-“এমন ভাগ্য কিন্তু আপনারও ছিলো কিন্তু নিজে হাতে সেটাকে নষ্ট করেছেন।হাতের লক্ষী পায়ে ঠেলে দিয়েছেন,সমুদ্রের স্রোতের সাথে যেমন পাড়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা মিশে হারিয়ে যায় গহীনে ঠিক তেমনি আপনার মেয়ের ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলেছেন সাথে সাথে ওর প্রতিটা হাসি, চাওয়া-পাওয়া কেউ।”
-“এসব কী বলছো তুমি?”
-“আমি সবটাই জানি,তাই প্লীজ আমার সামনে এসব না বললেও হবে।আম্মুকে আপনার ভীষণ প্রয়োজন আব্বু।”
কথাটা শুনার সাথে সাথে মি.ফুয়াদ দ্রুত স্ত্রীর রুমে দিকে যান।আবরার ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদ্যু হাসে ঠিক তখনি ওর চোখ পড়ে মেইন দরজার দিকে।প্রত্যয়-প্রাপ্তের সাথে ওদের কিছু ফ্রেন্ড এসেছে।কাল কাজের জন্য আসতে পারেনি তাই আজ এসেছে।প্রত্যয়রা ওকে দেখে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে বলে,
-“ইরাকরা কোথায়?”
-“ইরাক ইমনের সাথে ওর ঘরে আছে,আর ইফাজ আমার বৌয়ের কাছে।”
প্রাপ্তরা ইমনের ঘরের দিকে যায়,কিন্তু প্রত্যয় হঠাৎ কী মনে করে ইফাজের দিকে যায়।যেয়ে দেখে ইয়ারাবী মেডিসিন নিয়ে ইফাজের কোলে মাথা রেখে শুতে যাবে তখন প্রত্যয়কে রুমে ডুকতে দেখে উঠে পরে।প্রত্যয় লক্ষ্য করে দেখে ইফাজের চেহারা অতটা বিধ্বস্ত না দেখালেও ভিতর থেকে অনেকটা ভেঙে পরেছে,তবে ইয়ারাবীকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতটা কষ্ট হচ্ছে।ইফাজ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তুই?”
-“তুই নই হবে তোরা,কেননা আমরা সবাই এসেছি।স্যরিরে কাজের জন্য আটকে গেছিলাম,তাই আসতে পারিনি।”
-“কোনো ব্যপার না,তোরা এসেছিস তাই যথেষ্ট।”
-“কাকীমা অনেক ভালো ছিলেন।”
ইফাজ ইশারায় প্রত্যয়কে চুপ করতে বলে,কেননা ইয়ারাবী অন্যমনস্ক হয়ে পরেছে।
-“মেয়েটার শরীর খুব খারাপ ওর ঘুমের প্রয়োজন আমরা ইমনের রুমে যেয়ে কথা বলি।পিচ্চি তুই একটু ঘুমা….”
-“ঘুম আসবেনা,তোমরা কথা বলো আমার সমস্যা হচ্ছেনা।”
প্রত্যয় ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি কত ক্লান্ত, জানি ঘুম আসবেনা তবে একটু রেস্ট নাও।আচ্ছা তোমার সেই বন্ধুকে দেখছিনা যে..”
-“কাউকে বলা হয়নি ভাইয়া,আসলে আমিও কিছু জানতাম না।আবরারের ফোনে সকালে ভাইয়া ম্যাসেজ করলে উনি মিথ্যা বলে এখানে নিয়ে আসেন,কখনো ভাবতে পারিনি এমন কিছু হবে।”
-“একদম কাঁদবেনা,তোমাদের ধর্মে শুনেছি মৃত ব্যাক্তির জন্য উচ্চ স্বরে কাঁদতে নেই।আমার থেকে তো তোমরা ভালো জানো।”
-“জানি কিন্তু মন যে মানতে পারছেনা,না চাইলেও প্রচুর কষ্ট হচ্ছে।”
ইফাজ ওর মাথায় হাত রেখে বলে,
-“এত কাঁদলে শ্বাসকষ্ট হবে,কাঁদিসনা।আমি আবরারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি,তুই একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর।অনেক ভেঙে পরেছিস,আবার সমস্যা হবে।”
-“উনি কোথায়?”
-“এখানে হবে হয়তো ,মসজিদ থেকে তো সবাই চলে এসেছে।”
-“তোমরা যাও,আমি আছি …”
সবাই দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে আবরার ভিতরে ঢুকছে।ইফাজ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“খেয়েছো তুমি…”
-“আমারটা চিন্তা করোনা,তোমরা যাও।তোমার বন্ধুরা খুঁজছে।”
ওরা চলে যেতেই আবরার দরজাটা হালকা দিয়ে ওর পাশে এসে বলে,
-“বসতে কষ্ট হচ্ছে,শুয়ে পরো।কান্না-কাটি তো খুব করেছে আমি চলে গেলে…”
-“উনি যে আমার মা ছিলেন…”
-“আবার কাঁদছো…..”
আবরার ইয়ারাবীকে শুইয়ে দিয়ে ওর মাথাটা নিজের বুকেনিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
-“মনে পরছে…”
-“আপনি আমাকে মিথ্যা কেন বললেন?আমাকে যদি সত্যিটা বলতেন তাহলে দূর থেকে হলেও এক নজর খালামনিকে দেখতে পেতাম।”
-“একটা সত্য কী জানো ইয়ারাবী?”
-“কী?”
-“তোমার ব্রেনে সমস্যা আছে,আমি হুট করে কথাটা তোমাকে বলতাম তবে তুমি সহ্য করতে পারতেনা।তাছাড়া আব্বু যখন ফোন করে তখন বলেছিলো আইসিইউতে,তাই ভেবেছিলাম ইমার্জেন্সি ফ্লাইটে চলে আসতে পারবো।কিন্তু ঘন্টাখানিক পরে তোমার ভাইয়ার ম্যাসেজ আসে…”
-“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে,আচ্ছা বলুন না আমার সাথে এমন কেন হয়?আমার কাছের মানুষগুলো এভাবে দূরে সরে যায় কেন?জানেন আমার আজও মনে আছে,ওইদিন মিসেস ইশানি আমাকে খুব মেরেছিলো তাই খালামনি আমাকে বলেছিলো, “আজ থেকে আমি তোর মা,তোর সকল আবদার জুড়ে আমি আছি।কখনো কারো কাছে কিছু পাওয়ার আশা করবিনা,যা লাগবে এই মাকে বলবি।”তখন আমি একটা কথা বলেছিলাম, “আম্মুনির মতো ভালোবাসলেই চলবে..”উনি সেদিন হেসেছিলেন,সেদিন থেকে আমার হাত শক্ত করে ধরেছিলেন,বিপদে সব সময় ছায়া হয়ে পাশে থেকেছেন,সুখের সময়ও ছিলেন উনি।তবে আজ কেন মাঝ পথে ছেড়ে চলে গেলেন?”
-“ইয়ারাবীর দেখো,তোমার শরীর খুব খারাপ কাল দু’বার জ্ঞান হারিয়েছো,ভোমিট হয়েছে এখন জ্বরও আছে।আমার তো সব কথা তুমি শুনো,তাহলে এখন আরেকটু শুনো..প্লীজ ঘুমাও।”
-“আসবেনা ঘুম,চোখ বন্ধ করলে খালামনির মুখ ভেসে উঠছে।”
-“একটু চেষ্টা করো…”
(১২৬)
দেখতে দেখতে চারদিন পার হয়ে যায়,আজ মিসেস রহমানের জন্য ছোট করে দোয়া করা হবে।ইয়ারাবী এখনো পর্যন্ত ওই বাসাতেই আছে,কেননা কেউ ওদের যেতে দেয়নি।রোজ নিয়ম করে নামাযের পর যেয়ে খালামনির কবর জিয়ারত করে,পাশে বসে কোরআন শরীফ পড়ে।কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে,ইমনও তাই।ইয়ারাবী ফজরের নামায পড়ে খালার কবর জিয়ারত করে রুমে ঢুকতেই ইমন জোরে চিৎকার করে বলছে,
-“ফড়িং,ফড়িং কোথায় গেলি বলতো?”
শব্দ শুনে ইয়ারাবী দ্রুত ইমনের রুমে যেয়ে বলে,
-“এইতো ইমু ভাইয়া,বলো কী বলবে?”
-“তোর ফোন কোথায়?”
-“জানিনা,মনে হয় কোথাও রেখেছি মনে পড়ছেনা।”
-“আবরার ফোন করেছে,আসতে দেরী হবে।কাল রাতে তো বেড়িয়েছি ঠিকই কিন্তু বৌয়ের চিন্তায় অসস্থির।রাত থেকে কল করছে তোর ধরার নাম নেই।”
-“আসলে ভাইয়া,হাই পাওয়ারের মেডিসিন নিয়েছিলাম তাই ঘুমিয়ে পরেছিলাম।তাছাড়া ফজরের সময় স্টারপু এসে ডাক দিয়েছে তাই উঠতে পেরেছি।”
ইরাক মসজিদ থেকে এসে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
-“স্যরি রে পিচ্চি,আসলে দোয়া আর মানুষের খাবার ব্যবস্থা করতে যেয়ে আমরা কেউ তোর খেয়াল রাখতে পারিনি।”
-“ভাইয়া আমি বড় হয়ে গেছি…”
ইফাজ সোফায় বসে আড়মোড়া ছেড়ে বলে,
-“ওই তো আঠারে বছরের মাঝামাঝি চলছে কয়েকমাস পর উনিশ।”
-“এটা ঠিক না ভাইয়া,তুমি সব সময় আমাকে কাটি করো।”
-“সাথিকে বলে চার কাপ কফি পাঠাতে বল।”
-“তোমরা মানুষ তিনজন,তাছাড়া খালু চা খায়।তোমাদের মতো কফিখোর না।”
-“তুই তো নিজেও কফিখোর আবার আমাদের বলিস…”
ইরাক ইফাজের মাথায় এক চাটি মেরে বলে,
-“সব সময় ওকে জ্বালাস কেন?আর চার কাপের এক কাপ তোর জন্য।”
ইয়ারাবী চোখের চশমাটা ঠিক করে বলে,
-“আমি খাবোনা,তোমাদেরটা পাঠিয়ে দিচ্ছি।আমি ফুপু,মনিদের সাহায্য করি যেয়ে।দেখছোনা কোনো খালারা নেই কাজের ভয়ে এমনকি মিসেস ইশানিও….”
-“বাদ দে ওদের কথা,তবে তুই কিচেনে ঢুকবিনা।”
-“অকালে শহীদ হওয়ার ইচ্ছা আমার কোনো কালে নেই।মি.মুড যদি শুনে তবে রামধমক দিয়ে আমাকে মেরে ফেলবে।”
ইমন কিছুটা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“মি.মুড মানে?”
-“আর কে,তোমাদের প্রাণপ্রিয় দুলাভাই যার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছো।জানো ভাইয়া উনি না আমাকে সব সময় বকেন।”
-“তোর জন্যই তো বকা দেয়।”
ইয়ারাবী রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
-“শিয়ালরে বলছি মুরগি পাহাড়া দিতে,”
তিন ভাইয়া ওর কথা শুনে হেসে দেয়।তবে যে ওরা শোক কাঁটিয়ে উঠতে পেরেছে তা নয়,তবে নিজেদের স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।
দুপুর তিনটা থেকে মানুষ আসা শুরু করেছে কেননা আসরের পরে দোয়া খায়ের করা হবে।ইরাক ইয়ারাবী রুমে নক করে ঢুকে বলে,
-“হয়নি তোর…”
-“আমি তো অনেক আগেই রেডি,কেন?”
-“আব্বুর কলিগরা এসেছে,তোর সাথে দেখা করতে চায়।”
-“আমার সাথে কেন?”
-“তোকে আব্বু নিজের মেয়ে ভাবে,তাই তার মেয়ের সাথে তো মানুষ দেখা করবে সেটাই স্বাভাবিক।”
-“আচ্ছা তুমি যাও,আমি বিছানাটা ঠিক করে আসছি।”
ইরাক চলে যেতেই ইয়ারাবী সবকিছু পরিপাটি করে রুম থেকে বের হয়।ফোনটা হাতে নিয়ে চোখে চশমাটা পারে সিড়ি দিয়ে নামে। হঠাৎ কোনো লোকের পায়ে পারা লেগে যাওয়ায় ওনাকে স্যরি বলে চলে আসতে যেয়ে আবার কী মনে করে ওনার মুখের দিকে তাকায়।আর যা দেখে,সেটাই ইয়ারাবীর শরীর কেঁপে উঠে। কোনোদিন ভাবতেও পারেনি এটা হবে।কেননা এই চেহারার মানুষকে ভুলা কখনো সম্ভব না
#চলবে_____