জীবন মানে তুমি পর্ব-২৮

0
4163

#জীবন মানে তুমি
#লেখিকা:H.B.Rini (Irini Ori)
#পর্ব:২৮

(১০১)

-“আপনি আমাকে ম্যানিপুলেডেট করার চেষ্টা করছেন,সেটা মনে হচ্ছে আমি বুঝতে পারছিনা?”

-“তুই আমাকে এভাবে বলতে পারলি,মা হই আমি তোর?আর এই কী আপনি আপনি লাগিয়ে রেখেছিস?”

ইয়ারাবী হেসে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“ভাঙা কাঁচ কখনো জোড়া লাগেনা।মিসেস ইশানি আমার চরিত্র কখনো ‘অপরিচিতা’ কল্যাণী হতে পারেনি কিন্তু আপনারা আমাকে অনুপম একটু হলেও মনে করেছেন।মা,মামারা যেটা বলবে সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো,এটা যদি ভেবে থাকেন তবে ভুল।”

-“দেখ আমি তো ওর কথাটা বলেছি যাতে তুই…”

-“ওয়েট,নিশ্চয় এর মধ্যে আপনার কোনো স্বার্থ লুকিয়ে আছে।কেননা আমার দ্বারা আপনারা যা করতে চান সেগুলো নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়।”

মিসেস ইশানি অবাক হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অষ্টাদশী মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।আজ যেনো চোখ সরাতে পারছেন মেয়েটার দিক থেকে,প্রায় চারমাস পর আজ মেয়েটার দিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।অনেক সুন্দয় হয়েছে এই কয়মাসে,সময়ের সাথে আরো বেশি চমৎকার হয়েছে।স্নিগ্ধপূর্ন শ্যামল চেহারা,হালকা গোলাপী ঠোঁট,পরনে পার্পেল কালারের জামাদানি কাপড়ের ফুলহাতা গাউন, গায়ে বিদেশী ব্রান্ডের একটা দামী শাল,হালকা ব্রাউন কালারের চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া,হাতে গলায় সেই আগের পরিহিত জিনিসগুলো,শুধু অতিরিক্ত কানের দুলটা।আজ মেয়েটাকে চশমাবিহিন ভালোই লাগছে,কেন জানি আজ খুব মন টানছে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে।মেয়েটা তার বরাবরই সাহসী,যুক্তিবাদী, রহস্যময়ী মেয়ে।মনের ভিতর কী চলে সেটা কাউকে বুঝতে দেয়না।

ইয়ারাবী ফোনটা টেবিল থেকে উঠিয়ে ডিসপ্লে অন করে সময়টা দেখে নেয়।কেননা ও হাত ঘড়ি পরেনা।এই হাত ঘড়ি না পরার পেছনেও অনেক বড় কাহিনি আছে।ইয়ারাবী ইয়ামিলার দিকে তাকিয়ে বলে,

-“তোর ভাইয়া কোথায়?এখনো ফেরেনি?”

ইয়ামিলা চেয়ারে বসে মাশরুমের স্যুপ খেতে খেতে বলে,

-“ভাইয়া অনেক আগেই ফিরেছে,বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।স্যুপ খাবে তুমি?”

-“তুই জানিস না মাশরুমে আমার এলার্জি আছে।”

মিসেস ইশানি,তার ননদের সাথে রান্নাঘরে কাজ করছিলেন।ওনার বোনগুলো এক একজন পায়ের উপর পা তুলে খেতে পারে।যদিওবা ওনার মেজো বোন সাহায্য করতো কিন্তু কাল ওনাকে নিজ বাসায় যেতে হয়েছে।ওনার এ্যাপার্টমেন্টের কিছু লোকজন ভাড়া নিয়ে সমস্যা করছে,ওনার স্বামী এখানে নেই তাই ছোট ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে যান।মিসেস ফাতেমা ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলেন,

-“দাঁড়িয়ে আছিস কেন আম্মু,বস তোকে নাস্তা দিচ্ছি।”

-“না,মনি কিছুক্ষণ পরে করবো।”

-“আরে পাগলি,ওদের নাস্তা করতে অনেক লেট হয়ে যাবে।বুঝতে পেরেছি বরকে ছাড়া করতে চাইছিস না।দেখেছো ভাবী,আমাদের মেয়েটা কেমন বর পাগল…”

মিসেস ইশানি ওনার ননদের কথা শুনে হেসে দেন।ইয়ারাবী ওর ফুপির দিকে তাকিয়ে বলে,

-“তুমি সব সময় একটু বেশি বুঝো মনি,এমন কিছু নয়।মেডিসিন নিয়েছি তাই একটু লেট করে খাবো।”

-“বুঝেছি,আর বলতে হবেনা।তুই যেয়ে তোর আপুদের উঠাতো।না তারা উঠেছে না য়ুহার,দু’টা মিলে সারারাত গল্প করেছে..”

ইয়ারাবী ওদের ডাকতে যাওয়ার আগে দেখে ওরা দু’জন সিড়ি দিয়ে গল্প করতে করতে নামছে।তারা ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“পুতুলটা দেখছি উঠে পড়েছে?”

ইয়ারাবী গ্লাসগুলোতে জুস ঢালতে ঢালতে বলে,

-“তোমাদের মতো নাকী?আর্লি টু বেন্ড এন্ড আর্লি টু রাইজ্,মেকস্ এ ম্যান,হেল্থদি,ওয়েলদি এন্ড ওয়াইজ্।ছোটবেলায় মনে হয় কবিতাটা পড়লেও এর মর্মার্থ বুঝোনি।”

-“হরে বোন,শুধু পড়েই গেছি কোনোদিন বুঝিনি।”

য়ুহার ওর হাত থেকে জগের গ্লাস নিয়ে বলে,

-“তোকে এসব কে করতে বলেছে?আমাকে দে আমি করছি।”

ইয়ারাবী একবার সোফায় বসা ওর খালা আর বোনদের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“কখনো তিনটা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এতোগুলো মানুষের আয়োজন করা।আর এনারা কেউ পার্ফেক্ট শেফ নন যে একহাতে দশ কাজ করতে পারবে।”

জারিকা নীরাকে জামা পরিয়ে দিতে দিতে বলে,

-“তুই কী ইন্ডাইরেক্টলি আমাদের অপমান করছিস।”

-“ডাইরেক্টলি করেছি,আর কিছু।”

মিসেস নিকি সোফা থেকে উঠে ডাইনিং এ এসে এক গ্লাস জুসে চুমুক দিয়ে বলেন,

-“এটা কী বানিয়েছিস তুই,না আছে মিষ্টি না আছে স্বাদ।”

-“আনফোরচুনেটলি খালা ওই গ্লাসটা আবরারের ছিলো, আর আবরার জুসে চিনি খাইনা।”

-“ছিঃ এভাবে মানুষ খায়?”

ইয়ারাবী হালকা হেসে বলে,

-“ও নিজের হেল্থের প্রতি খুব সচেতন।মিনা তোমার ভাইয়ার জন্য আরেকগ্লাস জুস বানিয়ে আনবে?”

মিনা টেবিলে প্লেটগুলো রেখে বলে,

-“যাইতাছি আপা,কিন্তু ভাইজানের জুসে কী কী দিমু সেটা কইয়া দ্যান?”

-“বেশি কিছুনা,শুধু চিনিটা বাদ দিবে আর আইস্ কিউব দু’টার বেশি দিবেনা।আর কিচেনে দেখো হাফ বয়েল ভেজিটাবল আর গ্রীন সালাদ আছে ওটাও নিয়ে এসো।”

মিসেস নিকি কিছুটা অবাক হয়ে বলে,

-“হ্যারে,ওকী রোজ সকালে এগুলো খাই?”

-“হ্যাঁ,সকালে নামায পড়ে রানে বের হয়,বাসায় জীম কন্টেটগুলো থাকলেও একবারে বাইরে থেকে করে আসে।তারপর এক মগ কফি আর দশ-পনের মিনিট পর ব্রেকফাস্ট।”

-“এই কারনে এত ফিট।”

-“আপনি আমার ভাসুর-দেবর-শ্বশুড়কে তো দেখেছো,এই বয়সে উনিও প্রচুর ফিট।আসল কথা হলো ওনাদের সবার খেলাধুলার প্রতি খুব আগ্রহ।বাবা এখনো প্রায় হলিডে তে ফুটবল খেলতে যান।আর ভাইয়া তো প্রায় মেঘদের সাথে বাস্কেটবল ম্যাচ খেলে।”

-“বড়লোক মানুষদের শখের কোনো শেষ নেই…”

-“ভুল বললেন খালা,বড়লোক আর গরীব বলে কিছু নেই।মানুষ মন থেকে চাইলে সব করতে পারে।আরো বরং ধনী লোকদের এই বয়সে টাকার চিন্তা করে ব্লাড প্রেশার,হাই-প্রেশার বানায় সেটা আমার শ্বশুড়ের আলহামদুলিল্লাহ্‌ একটা রোগও নেই।”

মিসেস জামান অনেকক্ষণ ধরে সবার কথা শুনছিলেন।এবার চুপ করে না থেকে বলে ফেলেন,

-“খুব যে শ্বশুড়বাড়ির সুনাম করছিস,মনে হচ্ছে আমরা জানিনা শ্বশুড়বাড়ি কেমন হয়।ওতো লোক দেখাতে হবেনা তোকে…”

ইয়ারাবী কিছু বলার আগেই য়ুহার খালার দিকে তাকিয়ে বলে,

-“নিজে সারাজীবন শ্বশুড় বাড়িতে মার খেয়ে এসেছেন বলে যে অন্য কারোর শ্বশুড়বাড়ি এমন হবে সেটা ভাবলেন কীভাবে?তাছাড়া আবরারের পরিবার অনেক শিক্ষিত,অশিক্ষিতদের মতো করো গায়ে হাত তোলেনা।”

-“দেখ তুই কিন্তু বারাবারি করছিস খুব…”

-“আমার বাচ্চাকে নিয়ে কথা বললে যে ওর মায়ের মতো খোলা ছেড়ে দিবো তা কিন্তু নয়,আর খালা ভুলেও কিন্তু ওর পিছন লাগতে যেয়েন না,নয়তো কথায় আছেনা,”কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হবে।”

পরের কথাগুলো য়ুহার ওর খালার কানে কানে বলে।ওর খালা সাথে সাথে ওখানে থমকে যায়।ওনি ভালো বুঝতে পারছেন য়ুহার কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে।ওর খালার চুপসে যাওয়া দেখে ইয়ারাবী তারার দিকে ইশারায় প্রশ্ন করে।কিন্তু তারা ওকে বলতে পারেনা য়ুহার মিসেস জামানকে কী বলেছে?

আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা,,
কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে,,

নিলয় গান গাইতে গাইতে বাসায় ঢুকছে।ইয়ারাবী ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

-“প্রকৃতিতে বসন্ত আসতে এখনো বাকী,কিন্তু তোমার মনে ঠিকই এসে গেছে।”

নিলয় জিব কেঁটে বলে,

-“নাউজুবিল্লাহ্ আপু,এসব কী বলেন?আপু জানলে মার একটা মাটিতে পরবেনা।আমিতো গানটা সকালবেলা শুনছি তাই মাথার ভিতরে ঘুরছে।”

-“বুঝি বুঝি সব বুঝি।”

য়ুহার এসে দু’টোর কান টেনে বলে,

-“এখানে কী বোঝাবুঝি হচ্ছে,চল ব্রেকফাস্ট করবি।”

-“আহ্,আপু লাগেতো।”

-“লাগুক,নিলয় যেয়ে আবরারদের ডেকে আন।”

-“কাউকে ডাকতে হবেনা আমরা এসে গেছি।”

পিছন থেকে ইফাজ কথাটা বলে।ইয়ারাবী আবরারের দিকে তাকিয়ে দেখে ও কেমন একটা খুঁড়িয়ে হাঁটছে,তেমন বেশিও না তবে ডান পায়ে বেশি ভর দিচ্ছেনা।

-“আপনার পায়ে কী হয়েছে?”

আবরার খানিকটা হেসে বলে,

-“কী হবে,কিছুই হয়নি।”

-“মিথ্যা বলবেন না,বলেন কী হয়েছে?”

-“আরে বেশি কিছুনা,জুতার ভিতর দিয়ে একটা পিন ঢুকছিলো তাই একটু পায়ে ব্যাথা।”

ইয়ারাবী ইফাজের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে,

-“তুমি পিন ঢুকাকে সামান্য বলছো,পাগল হয়ে যাওনিতো।”

-“আরে রেগে জাচ্ছিস কেন পিচ্চি,ওর পা থেকে পিনটা বের করে পার্কের গার্ডকে দিয়ে একটা এন্টিসেপটিক মলম লাগিয়ে দিয়েছি।”

-“আবরার জুতা খুলুন…”

আবরার সোফায় বসে আড়মোড়া ছেড়ে বলে,

-“জুতা কেন খুলবো?”

-“বির্সজন দিবো,অসহ্য আপনি কী খুলবেন?”

ইফাজ আবরারের পিঠে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলে,

-“ভাই খুলে ফেলো,বোন আমার হেবি ক্ষেপেছে।”

-“ভাইয়া…”

-“আচ্ছা আমি কিছু বলছিনা।”

আবরার জুতা খুলার সাথে সাথে পায়ের গোরালির পাশ থেকে রক্ত পরতে থাকে।ইয়ারাবী রাগী দৃষ্টিতে আবরার আর ইফাজের দিকে তাকায়।ইয়ারাবী পাশে তাকিয়ে খেয়াল করে দেখে জারিকা আবরারের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ক্ষত চিহ্ন দেখে এমনিতে রাগ লাগছে যে ডাক্তার মানুষ এতো বড় ক্ষতে সামান্য বলছে অপরদিকে জারিকার কামনার দৃষ্টি…মেজাজ পুরোটা বিগড়ে যায় ওর।ও জারিকার দিকে রাগী দৃষ্টিতে চেঁচিয়ে বলে,

-“এখানে কোনো কমিডি চলছেনা,দাঁড়িয়ে না থেকে আমার রুম থেকে ফাস্টএইড বক্সটা নিয়ে আসো।”

তারা কেবল মুখে পানি দিচ্ছিলো ওর ধমক শুনে পুরো পানিটা মিসেস জামানের উপর যেয়ে পরে।মিসেস জামান কিছু বলতে যেয়েও না বলে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দেন।জারিকা ইয়ারাবীর চিল্লানো শুনে দৌঁড়ে রুম থেকে বক্সটা এনে দেয়।আবরার ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে দেখে রাগে মুখটা একদম লাল হয়ে গেছে।

ইয়ারাবী প্রথমে রক্ত মুছতে গেলে আবরার পা টান দিয়ে বলে উঠে,

-“নিচে বসতে হবেনা,পেটে চাপ লাগবে।তাছাড়া আমি নিজে করে নিতে পারবো।”

-“ভাইয়া এনাকে বলে দাও আমি কিন্তু রেগে আছি, আর রাগ হলে কী করি সেটা তুমি ভালো করে জানো।”

ইফাজ আবরারের দিকে ইশারা করলে আবরার বলে,

-“ওকে,যা করার করো বাট্ উপরে বসে।”

ইয়ারাবী সোফায় বসে ওর পা নিজের কোলের উপর নিয়ে প্রথমে রক্ত পরিষ্কার করে জায়গাটাতে স্প্রে করে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়।মি.ফুয়াদ রুম থেকে বের হয়ে জামাইয়ের এরুপ অবস্থা দেখে তিনি নিচে এসে বলেন,

-“আবরারে কী হয়েছে পায়ে?”

ইয়ারাবী বক্সটা বন্ধ করতে করতে আবরারের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,

-“পায়ে পেরেক ফুঁটিয়ে বলছে পিন ফুটেছে।”

-“ও এখন কেমন?”

-“ডাক্তারের ডাক্তারি শেষ হলে যা হয় আরকী,ভালো আছে।”

আবরার জুতা পায়ে দিয়ে বলে,

-“দেখো একদম ফিট আছি,ইটস্ নরমাল।”

মিসেস ফাতেমা ডাইনিং এ খাবার রাখতে রাখতে বলেন,

-“ওর সবটা জুড়েই এখন তুমি বিরাজমান,তোমার তুমিতে যে আটকে গেছে মেয়েটা।চিন্তা তো হবেই বাবা।”

কথাটা শুনে আবরার বাঁকা হেসে আড়চোখে তাকায় ইয়ারাবীর দিকে।ইয়ারাবীর এখন মাটি ফাঁকা করে ঢুকে যেতে ইচ্ছা করছে ফুপির কথাগুলো শুনে।ওর মা ফাতেমার কাধে চাপড় দিয়ে বলেন,

-“মেয়েটাকে আর লজ্জা দিসনা।”

ইয়ারাবী একবার ওর পরিবারের সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারলো সবাই ওকে পঁচাবে।তাই সবার মাইন্ডটা অন্যদিকে ঘুরানোর জন্য ও চেঁচিয়ে বলে,

-“মনি খুদা লেগেছে,খাবার দাও।”

-“ওহ্ কানটা পুরো ফাঁটিয়ে দিলি,আমিতো কানে শুনি তাইনা।সবাই বসে পরো,খাবার দিচ্ছি।”

খেতে বসে ইয়ারাবীর খালারা অনেকটা চমকে যায়।কতটা বদলে গেছে মেয়েটা যাকে সুযোগ ওর বাবা-মায়ের সামনে অপমান করতো,তবে আগেও ওর প্রতি হওয়া অপমানের প্রতিবাদ করতো,এটা সেই মেয়ে যার গলা দিয়ে খাবার নামতো না,আর আজ সত্যিই সময় মানুষকে অনেক কিছু বদলে দেয়।শেষবার যখন ইয়ারাবীর সাথে ওর মা-খালাদের দ্বন্দ বেঁধেছিলো তখন ওর মেজো খালা বলেছিলো,

-“সময় মানুষকে তার সঠিক কর্মফলের জবাব দেয়।এই পৃথিবীতে ভালো মানুষগুলো সঠিক সময়ে আসে।তোরা যে পাপ করেছিস সেগুলোর উত্তর পেয়ে যাবি।দুঃখ,আঘাত,অবহেলা এগুলো মানুষকে কখনো গুড়িয়ে দেয়না নতুন করে স্বপ্ন দেখায়,একজন সাকসেস মানুষ হতে সাহায্য করে।
আজ তোরা মেয়েটার সাথে যা করেছিস একদিন দেখবি এই মেয়েটার পাশে এমন কেউ দাঁড়াবে ওর ঢাল হয়ে যাকে ভেদ করে যেয়ে তোরা কিছুই করতে পারবিনা।”

সত্যিই মিসেস রহমান ঠিক বলেছিলেন।আজ ইয়ারাবীর পাশে এমন কেউ দাঁড়িয়ে আছে যাকে ভেদ করা কঠিন।কেননা ওনারা বিয়ের পর ইয়ারাবীকে দুর্বল করতে যা যা করতে গেছিলেন ও প্রতিত্তুরে কিছু বলার আগেই আবরার এমন এমন কঠিন জবাব দেয় যার পরে কিছু বলার মুখ থাকেনা।

খাওয়ার টেবিলে আবরারের কেয়ার দেখে মনে হচ্ছে ইয়ারাবী কতটা সুখে আছে।সত্যি ভাগ্য করে একটা জামাই পেয়েছেন মি.ফুয়াদ।তবে উনি আজও বুঝতে পারলেন না মেয়ের সামান্য প্রশংসা শুনে ওনার অফিসের বস ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।আবরার ইয়ারাবীর প্লেটে একটার পর একটা হাফ বয়েল করা সবজি দিচ্ছে।

-“দেখুন আজ আমি এসব কিছুই খাবোনা,এগুলো সব আপনার জন্য করেছি।”

আবরার একটা বয়েল করা ডিমের অর্ধেক চামচ দিয়ে নিজের মুখে পুরে খেয়ে বলে,

-“তুমি নিষেধ করলে আমি কোনদিন শুনবোনা সেটা তুমি খুব ভালো করে জানো।অযথা জিদ না করে খাবারটা ফিনিস করো।”

-“ওকে খাবো,কিন্তু তার আগে ক্যাবেজ রোলটা খায়,দেখুন কতটা গোলুমোলু হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।”

-“উহু,কেউ গোলুমোলু হয়ে তাকিয়ে নেই।যদি হাত দিয়ে খেতে না চাও তবে আমি খাইয়ে দিচ্ছি,আর তুমি জানো বৌ-এর কেয়ারের ব্যাপারে মানুষজন কিছু মানিনা।”

ইয়ারাবীর এখন নিজের মাথা ফাঁটাতে ইচ্ছা করছে,বরাবরই আবরার এমন।ওর মতে বৌয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে কোনো বাঁধা নেই।বন্ধের একদিন লান্চে খেতে চেয়েছিলোনা তবে ওর বাড়ির সবার সামনে জোর করে নিজে হাতে খায়ে দিয়েছিলো।স্ত্রীকে খাইয়ে দেওয়া সুন্নত তাই বলে সব সময় কাজটা করবেন।ইয়ারাবী আবরারের দিকে তাকিয়ে দেখে,আবরার খাবার খাচ্ছে আর ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।ইয়ারাবী মনের সাথে সকল দ্বন্দ্ব করে ওই হাফ সিদ্ধ করা সবজি খেতে থাকে।

(১০২)

ভালোবাসা কখন ,কীভাবে আর কার সাথে হবে সেটা কেউই বলতে পারে না আর না বুঝতে পারে। তবে ভালোবাসা যে শুধু সঠিক মানুষের সাথেই হয় এমনটা কিন্তু নয়। আর যার জন্য কষ্ট পায় কিছু মানুষ। লড়তে লড়তে একসময় হেরে যায় তারা। আর হেরে যাওয়া মানুষগুলো কেউ বেছে নেয় মৃত্যুর পথ আর কেউ বেঁচে থাকলেও হয়ে যায় জিন্দা লাশ।

অনুর ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। ভুল মানুষকে ভালোবেসে ওর জীবনটা হয়ে গেছে এলোমেলো। মরতে মরতে বেঁচেছে অনেকবার। ওই যে বলে না হায়াত যতদিন আছে মৃত্যু আসবে না। হাসতে প্রায় ভুলেই গেছিল। যদিনা ইয়ারাবী ওর জীবনে আসত তাহলে হয়ত কবেই শেষ হয়ে যেত। অনু খুব করে চায় ওর অতীতকে ভুলে যেতে। কিন্তু কিছু অতীত চাইলেও ভোলা যায় না। বার বার কড়া নাড়ে স্মৃতির পাতায়।

আজকে খুব মনে পড়ছে সেই বেইমানটার কথা। চোখটা বার বার ভিজে উঠছে নোনা জলে। কিন্তু ওকে মনে করা যে ওর ক্ষতগুলোকে আরো তাজা করে তুলছে। তাই অনু সিদ্ধন্ত নিল বাইরে গিয়ে একটু ঘুরে আসবে। তাতে মনটাও ভালো হবে আর ওই বেইমানটাকেও ভুলে থাকতে পারবে। তাই অনু ওর বিড়াল মোটাকে কোলে নিয়ে বাইরে পার্কের দিকে গেল। অনুর বাসার পাশেই পার্ক। ছোট ছোট বাচ্চারা এই সময়ে খেলতে আসে। অণু একটা জায়গায় বসল। মোটা অনুর কোল থেকে নেমে গেল ঘোরাঘুরি করার জন্য।অনু বসে বসে বাচ্চাদের খেলা দেখছিল আর ভাবছিল বড় না হলেই হয়ত ভালো হতো।

-“ভালো তো হতোই। কিন্তু কি আর করার বলো। আমরা তো বড় হয়েই গেছি। ছোট হওয়ার তো কোনো উপায় নেই।”

হঠাৎ গলা শুনে পাশে তাকিয়ে দেখল প্রত্যয় বসে সামনের বাচ্চাগুলোকেই দেখছে।অনু ওর দিকে তাকিয়েছে এটা বুঝতে পেরে প্রত্যয় অনুর দিকে ঘুরে তাকালো। অনু কিছুটা অবাক হলো প্রত্যয় কে দেখে। আরো অবাক হলো এটা ভেবে যে অনু কি ভাবছিল সেটা প্রত্যয় অবলীলায় বলে দিল। কিন্তু কিভাবে?

-” আমি কিভাবে জানলাম সেটা তোমার না জানলেও চলবে। আর এটা সাইকোলজি দ্বারা যে কেউই বুঝতে পারবে।”

অনু খানিকটা ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“আপনিতো আর্মি তাহলে সাইকোলজি কীভাবে বোঝেন?একমিনিট আপনি হঠাৎ এখানে?”

প্রত্যয় খানিকটা পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে বলে,

-” আজকে তেমন একটা কাজ নেই। তাই একটু ঘুরে বেড়াচ্ছি।”

অনু খানিকটা বিরক্তবোধ হয়ে বললো,

-“আমার বাড়ির পাশের পার্কেই আসতে হলো।”

প্রত্যয় কিছুনা বলে মৃদু হাসল। কিছু একটা ভেবে অনুর দিকে তাকিয়ে বললো,

-“অতীতকে ভুলে নতুনকে আপন করে নেওয়াই উত্তম।”

-“কী পাগলের মতো বকবক করে যাচ্ছেন বলুন তো?”

-“কথা বলবেনা, শুধু অভিনয় করো।শোনাবেনা, শুধু দেখাও। প্রতিশ্রুতি দেবেনা, কেবল প্রমাণ করো।তুমি যদি সফল হতে চাও তবে ব্যর্থতা হতে হবে তোমার সেরা বন্ধু!”

-“ওহ্,শান্তি নেই কোথাও…”

প্রত্যয় হেসে গলা ছেড়ে মজার ছলে গান ধরে বলে,

-“শান্তির মা মরে গেছে অশান্তির মা মরে নাই।
শান্তির মা মরে গেছে অশান্তির মা মরে নাই।”

-“ওহ্,প্লীজ একটু দয়া করে থামবেন।”

-“ওকে,আচ্ছা বাদাম খাবে তুমি?”

-“আমি আপনার প্রেমিকা নই যে পার্কে এক বেন্ঞ্চে বসে বাদাম খাবো।”

-“তবে অনেক সময় বাদাম দিয়েই প্রেমটা শুরু হয়।”

-“হ্যাঁ,ইতিহাসে তো লিখা আছে।”

অনু কথাটা বলেই সামনে তাকিয়ে দু’টো চেনা মুখ দেখতে পেয়ে আপনা-আপনি মুখ থেকে বের হয়ে যায়,

-“আরে ওটা জারা না?”

-“হামম,ইরাকের কাজিন বিয়েতে দেখেছিলাম।”

-“এখানে কী করছে ওরা?আর পাশেরটা তো পরী,পল্লবী দিদির মেয়ে,চলুন তো যেয়ে দেখি।”

অনু মোটাকে কোলে নিয়ে প্রত্যয়ের সাথে সামনে এগিয়ে যায়।এদিকে পরী,জারার সাথে পার্কে বল নিয়ে দৌঁড়ে খেলা করছে।অনু এসে জারার পিছনে দাঁড়িয়ে ওর নাম ধরে ডাকে।পরিচিত গলার আওয়াজে জারা ঘুরে তাকিয়ে দেখে অনু দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে প্রত্যয়।অনুকে ও ইয়ারাবীর মাধ্যমে চিনেছে আর প্রত্যয়কে বিয়েতে ইরাকের মাধ্যমে।তবে সম্পূর্ন ভিন্ন চরিত্রের ব্যাক্তিকে একসাথে দেখে চমকে যায়।নিজেকে সামলে নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,

-“আপনারা এখানে তাও আবার একসাথে?”

-“আরে আমার বাসা এখানে সেটাতো তুমি জানো, বাট্ ইনি এখানে ঘুরতে এসেছে।তুমি এখানে তাও পরীর সাথে?”

-“আরে আপু আর বলোনা,ভ্যাকেশন চালু হয়ে গেছে,ফ্রেন্ডরা ঘুরতে গেছে,আপিপুরও বিয়ে হয়ে গেছে…তাই টাইম স্পেন্ড করার জন্য পরীকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।তা প্রত্যয় ভাইয়া আপনি এখানে কেন?”

প্রত্যয় মৃদ্যু হেসে পরীকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,

-“আমি এখনো লিভ এ আছি,আসলে অনেকদিন পর ছুটি পেয়েছিতো তাই ঘুরছি।ইরাকেরও ছুটি ছিলো কিন্তু ও ক্যান্সেল করে চলে গেলো।”

-“ভাইয়া কাজ নিয়ে একটু বেশি সিরিয়াস।”

ওরা বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে নিজ নিজ গন্তব্যের ফিরে যায়।

(১০৩)

-“অবহেলা,যন্ত্রনা,আঘাতের পাল্লাটা যখন খুব ভারী হয়ে যায়, তখন আমাদের চারপাশটা হয় অন্ধকার।সারারাত জেগে থাকি,দু’টো চোখের পাতা এক করতে পারিনা, ইনসোমেনিয়া জাপ্টে ধরে,প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে বাইরে বের হয় হাজারো না বলা কথা,দু’টো চোখ শ্রাবণের বারিধারার মতো নিজের ভিতরের জমানো কষ্টটাকে বের করে দেয়।শ্বাস নিতে কষ্ট হয়,মাঝে মাঝে মনে হয় মরে যায়,কিন্তু মৃত্যুই কী সবকিছুর সমাধান।আমার উত্তর হবে,”না”।কেননা মৃত্যু যদি একমাত্র সমাধান হতো তবে পৃথিবীটা অর্ধেক জনমানব শূন্য হয়ে যেতো।

বড় ভাইয়া সব সময় বলতো,”সহজ জীবনের জন্য প্রার্থনা করবেনা; একটি শক্ত জীবন সহ্য করার জন্য শক্তি প্রার্থনা করুন।আমরা সবাই মরে যবো, তুমি যে লক্ষ্যটি স্থীর করবে সেটা চিরকাল বেঁচে থাকার নয়, তবে লক্ষ্যটি দ্বারা এমন কিছু তৈরি করা যা চিরকাল বেঁচে থাকবে।”

হ্যাঁ,ভাইয়া ঠিকই বলেছিলো।যন্ত্রনা মানুষকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পারেনা,আরো শক্ত হতে সাহায্য করে।চোখের প্রতিটা পানির বিন্দু মনে দৃঢ় এক সংকল্প তৈরি করে।তোমার চিন্তার কথা অন্য কাউকে বললে সেটা মজা করবে,তোমাকে মাঝপথে থামানোর জন্য তোমাকে আটকানোর চেষ্টা করবে।তাই কাউকে তোমার পরিকল্পনা না বলে দেখিয়ে দাও তুমি কী পারো।

আমিও পারি,সেই আগের তেজটা আবারো আমার মধ্যে এসেছে কেননা আবরার…..”

-“মে আই কাম ইন ম্যাম?”

ইয়ারাবী ডাইরিটা বন্ধ করে দারজায় দিকে তাকিয়ে দেখে একজন ফিমেল সার্ভেন্ট দাঁড়িয়ে আছে।ইয়ারাবী ওনার দিকে তাকিয়ে বলে,

-“কিছু বলবে?”

-“ম্যাম,বড় স্যার আপনাদের নিচে যেতে বলেছে।আপনার মামাশ্বশুররা এসেছেন।”

-“ওহ্,আসছি।তুমি যাও…”

ইয়ারাবীর পরনে একটা হালকা ম্যাজেন্টা কালারের ফুলহাতা গাউন।ও উপরে একটা জ্যাকেট পরে মাথায় কাপড় দিতে যাবে এমন সময় আবরার ওয়াশরুম থেকে এসে ওকে পিছন থেকে কোমর বন্ধন করে নেয় নিজের বাহুডোরে।ইয়ারাবী খানিকটা চমকে যেয়ে কেঁপে উঠে।আবরার তাড়াতাড়ি ওকে ছেড়ে দিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,

-“পুরো চার মাস থেকেও সহজ হতে পারোনি।”

-“কোনোদিন পারবোও না।”

-“পারবে,কিন্তু তুমি সব কিছুকে নিয়ে নিজের কল্পনাতে এক এমনভাবে প্রেজেন্ট করো যার জন্য তুমি সহজ হতে পারোনা।এখন বলো কী করছিলে..”

-“কিছুনা,আব্বু নিচে ডেকেছে।আপনার মামারা এসেছে তাই..”

আবরার বেড থেকে একটা পাতলা জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা ভেবে বলে,

-“আমার মামীর সাথে বেশি একটা কথা বলবেনা, ওরা যতদিন এখানে থাকবে কখনো ওদের সাথে একা কোথাও যাবেনা।”

-“বুঝেছি,এবার চলুন…”

ওরা নিচে নেমে দেখে সোফায় ওর শ্বশুড়ের বয়সি খুব ফর্সা একজন লোক ফর্মাল স্যুটে বসে আছেন, তার পাশে খয়েরী কালারের জামাদানি শাড়ি পরে মাঝারি বয়সি একজন মহিলা বসে আছেন।সিঙ্গেল সোফায় মেঘের সাথে হেসে হেসে ওর বয়সি একজন ছেলে কথা বলছে।আরেকটা মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করার আগেই সেই দ্রুততার সাথে আবরারকে জড়িয়ে ধরে।মেয়েটাকে আল্টা-মর্ডার্ন বললেই বেশি চলে।ইয়ারাবী তার সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে দেখে মেয়েটা এই প্রচন্ড শীতের মধ্যেও পালতা হাতাকাটা একটা টপস্ আর হাটুর নিচ পর্যন্ত একটা স্কার্ট পরেছে,চুলগুলো সবুজ আর নীলের মিশ্রণে কার্ল করা,তবে মেয়েটা প্রচুর ফর্সা,পাতলা লাল রংঙের একটা চাদর হাতে।

আবরার মেয়েটাকে সকলের সামনে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সাইড কেটে ওর মামার সাথে কথা বলে।ইয়ারাবীর শ্বাশুড়ি ওকে ওর মামা-মামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।ওর মামা একটা ডায়মন্ডের নেকলেস উপহার স্বরুপ দেয়,আর ইকরার প্রেগন্যান্সির জন্য ওকেও দু’জোড়া বালা, আর গলার হাড় উপহার দেয় সাথে নিউ বেবীর জন্য অনেক কিছু।তবে ওর মামী ইয়ারাবীকে দেখে বেশি খুশি হননি ওনার আচারনে বোঝা যায়।কেননা উনি ইয়ারাবীকে উদ্দেশ্যে করে ওর ভাবীকে বলেন,

-“মনে হচ্ছে তোমাদের বৌ কানা তার ওপর তো আবার শ্যামলা।দেশে কী মেয়ের অভাব পরেছিলো নাকী?ছেলে এতো কষ্ট করে বাইরে পড়াশোনা করে এসেছে,নাম করা ডাক্তার তার ওপর তোমরা ওকে একটা ব্যাকডেটেড মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছো।”

-“আফসানা মেয়ে ব্যাকডেটেড নয় ল’পড়ছে।আর কী বললে শ্যামলা আর কানা?ওটা আমাদের আমরা বুঝবো।”

ইয়ারাবীর কিছুটা সময়ের জন্য মন খারাপ হলেও ওর শ্বাশুড়ির কথা শুনে মনটা ভালো হয়ে যায়।আসলে ও অনেক কপাল করে এমন শ্বাশুড়ি পেয়েছে।ফাইকার খুব রাগ হয় তার ফুপুর ওপর তবুও আবীর আর আবরারের ভয়ে চুপ করে থাকে।ওর বাবা সবটা শুনেও না শোনার ভান করে বাকীদের সাথে কথা বলতে থাকে।ফারহান ইয়ারাবীর সামনে এসে হাত বারিয়ে বলে,

-“হ্যালো,ভাবী…আমি ফারহান সম্পর্কে তোমার দেবর।তবে বয়সে তোমার বড়,তাই পিচ্চি ভাবী বলেই ডাকবো তোমাকে।”

ইয়ারাবী আবরারের দিকে তাকায়।ও মাথা নাড়িয়ে হাত মিলানোর জন্য বলে।ইয়ারাবীও হাত মিলিয়ে মৃদ্যু হেসে বলে,

-“ঠিক আছে,ভাইয়া…”

সবাই কথাবার্তা বলে রুমে ফ্রেস হতে চলে যায়।বিকালের দিকে রুমে আবরারের বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে ইয়ারাবী।কেননা ওর অসম্ভব মাথা ব্যাথা করছে।আজকাল ব্যাথাটা ওকে বেশিই জেকে বসেছে।ও স্লিপিং পিলস্ নিতে গেছিলো তবে আবরার ওকে নরমাল মেডিসিন দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে বলে।তবে ঘুম ওর আসছেনা,ওর প্রচুর খারাপ লাগছে।না চাইতেও চোখ থেকে বৃষ্টির ধারার মতো পানি পরছে।আবরার ওকে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে মাথায় বিলি কাঁটতে কাঁটতে বলে,

-“কান্না করলে আরো বেশি খারাপ লাগবে,একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।”

-“আসছেনা,মনে হচ্ছে মাথায় কেউ ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করছে।”

-“দেখো ঔষধ তো দিয়েছি,একটু চেষ্টা করো তাহলে হবে।তুমি ভুলার চেষ্টা করো যে তোমার মাথা ব্যাথা করছে,কোনো বিউটিফুল মোমেন্ট…এমন কোনো মোমেন্ট যেটা অনেক ফানি এমন কিছু আমার সাথে সিয়ার করো। দেখবে ভুলে যাবে…”

-“সত্যি ঠিক হয়ে যাবে তো….”

-“এর আগে মিথ্যা বলেছি…”

-“না,..”

-“তাহলে,এবার বলো..”

-“আচ্ছা শুনেন বাট্ কাউকে বলতে পারবেন না,প্রমিস”

-“হামম বলবোনা,প্রমিস…”

-“ওকে,তবে শুনুন।তখন আমার বয়স তেরো বছর ছিলো,বেশির ভাগ সময় খালামনির ওখানে থাকতাম।যে সময়ে ভাইয়ারা সবাই বাসায় থাকতো।কিচেনে খালামনি সাথী আপুর সাথে রান্না করবে বলে সবজি কাটছিলো।এমন সময় ফোন আসে সাথী আপুর দাদী মারা গেছে, যেতে হবে তাকে।আপু ঢাকার কিছু চিনতো না বলে খালামনিও আপুর সাথে বের হয়।যাওয়ার আগে বড় ভাইয়াকে বলে,বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করতে।তবে ভাইয়ার কানে হেডফোন থাকায় ভাইয়া খাবার অর্ডারের যায়গায় বেগুন রান্না করার কথা শোনে।ভাইয়াও খুব ডিসিপ্লিন মেইনটেইন করতো তবে সেটা আমার বেলায়।শুধুমাত্র বেলপুরি,চটপটি আর ফুসকা ছাড়া বাইরের কিছু খেতে দিতোনা।তাই নিজেই রান্না করবে বলে কিচেনে যায়।আমরা রুম থেকে বের হয়ে দেখি ভাইয়া কিচেনে যেয়ে সবজি কাঁটছে।আমরা ডাইনিং এ বসে রান্না দেখছি আর ট্রু-ডেয়ার খেলছি।ভাইয়া বেগুন রান্না করার সময় যখন পানি দেয় অন্য তরকারির মতো সেটা ডুবেনা।তাই ভাইয়া পানি দিতেই থাকে কিন্তু বেগুন পানির উপরে ভাসতেই থাকে।কেননা ভাইয়ার মতে সব তরকারি পানির নিচে সিদ্ধ হয় উপরে নয়।বেগুন তো বাদই দিলো একটা কিছুই ঠিকমতো রান্না করতে পারছিলোনা,পরে ফ্রিজের খাবার গরম করে খেতে হয়েছিলো।খালামনির সাধের কিচেনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলো সেবার।”

বেগুনের কাহিনি শুনে আবরারও হেসে দেয়।তারপর কিছু একটা ভেবে ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,

-“তুমি গ্যাস জ্বালাতে ভয় পাও কেন?”

ইয়ারাবীর হাসি থেমে যায়।ও আবরারের বুকে ভালো করে মাথা গুজে দিয়ে বলে,

-“ঘুমাবো…”

-“ওকে,ক্…তুমি এখানে?”

-“সরি জানতাম না যে তোমরা রুমে বসে রোমান্স করছো।তাছাড়া দোষটা তোমাদের বাড়িতে এতো মানুষ আর তোমরা রুমে এমন করছো।তাছাড়া তোমার বৌয়ের কোনো ম্যানার্জ নেই নাকী?”

ইয়ারাবী ওকে দেখে উঠলে গেছিলো কিন্তু আবরার ওকে আরো শক্ত করে ধরে রাখে।এমন অবস্থা যে ইয়ারাবী নড়তেও পারছেনা,আর ওর যা শক্তি তার কাছে ইয়ারাবী কিছুই নয়।আবরার ফাইকার দিকে তাকিয়ে বলে,

-“এটা আমাদের পার্সোনাল রুম,আর কারো রুমে আসার আগে তার পারমিশন নিতে হয় সেটা নিশ্চয় জানিস?এখন বল অসময়ে তুই কেন এখানে এলি?”

-“আসলে মম্ তোমার স্ত্রীর হাতের রান্না খেতে চেয়েছিলো,তাই ভেবেছিলো রাতের ডিনারটা যাতে ও করে এজন্য ডাকতে এসেছিলাম যে মেনু কী কী হবে।”

-“লিসেন্স ফাইকা,তোর ভাবী রান্না করতে পারেনা।আর বাড়িতে এতো সার্ভেন্ট থাকতে আমার বৌয়ের এত দরকার কেন পড়লো বুঝলাম না।এখন যা এখান থেকে।আমি আমার রুমে কাউকে এলাও করিনা,তাছাড়া ওর ঘুমের ডিস্টার্ব হচ্ছে।সো,ইউ্ ক্যান গো নাও।”

#চলবে_____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here