প্রস্থান — ৩২তম পর্ব।

0
460

প্রস্থান — ৩২তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৪০.
কারোর ডাকাডাকিতে নড়ে উঠল সুব্রত। চোখ ডলতে ডলতে ওঠে বসল। রুশার ছবিটা বুকের উপর ছিল, সে ওঠে বসাতে ওটা নিচে নেমে এলো। হাতে তুলে নিলো ছবিটা। রুশার দিকে তাকিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল তখন! দুই চোখে অন্ধকার নেমে আসছিল ক্রমশ। এরপর এই দীর্ঘ ঘুম!
দরজায় আবারও শব্দ হতে লাগল, বেশ জোরে জোরে। সুব্রত ছবিটা নামিয়ে রেখে, বেশ বিরক্তিভরা চাহনিতে তাকাল দরজার দিকে। মনেমনে বলল, “নিশ্চয়ই চিত্রা। মেয়েটা আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবে না।”
সত্যিই চিত্রা! গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। সুব্রত দরজাটা খুলতেই ফোঁস করে বলে উঠল, “এত সময় লাগে? এক্ষুণি ভাবছিলাম দরজা ভাঙার জন্য লোকজন খবর দেব। বাপরে!”
সুব্রত বিরক্তির শ্বাস ফেলে বলল, “হুম, এছাড়া তো আর কাজই নেই তোমার।”
“তা ঠিক।”
সুব্রত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে বিছানার কাছে যেতে যেতে বলল, “এখন আবার কেন এসেছো বলো তো?”
“ভিতরে এসে বলি?”
“আজ না শুক্রবার? তোমার স্বামী তো বাড়িতে। যদি দেখে তুমি আবার এদিকে এসেছ, তবে আবার ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে তোমার উপর দিয়ে।”
“ঘূর্ণিঝড় তো এখন উল্টো বইছে। আপনার ভাইয়ের হাল বে-হাল!” মুখ টিপে হাসতে হাসতে ঘরের ভেতরে এলো চিত্রা। বলল, “আমরা এখন সাময়িক বিচ্ছেদে আছি। কনার ঘরে অবস্থান করছি আমি।”
“তাই নাকি?” বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে, বিস্মিত চোখে তাকালো সুব্রত। “বাহ্! চমৎকার কাজ করেছ।”
চিত্রা সুপ্রসন্ন হয়ে বলল, “থ্যাংকিউ, সুব্রত ভাই।”
বিছানায় পড়ে থাকা একটা বই তুলে নিলো সুব্রত। হাই তুলে, পাতা উল্টিয়ে বলল, “কী যেন বলবে? বলো দ্রুত।”
“বলছি, বলছি!” একটা টুল টেনে সুব্রত ভাইয়ের সামনে বসল চিত্রা। ফ্যানের বাতাসে চোখের সামনে চলে আসা চুলগুলোতে পিছনে এলিয়ে দিয়ে বলল, “আসলে, একটা কথা আপনি স্বীকার করুন আর না-ই করুন, রশ্মিকে প্রত্যাখ্যান করে আপনি ঠকেছেন।”
সুব্রত ভড়কে গেল। তাজ্জব বনে বলল, “ঠকেছি মানে?”
“ঠকেননি বুঝি? শতবার ঠকেছেন! আরে, ওর মতো ভালো মেয়ে আপনি ক’টা পাবেন?”
সুব্রত হেসে উঠল চিত্রার কথা শুনে! ঠোঁট টিপে বলল, “তুমি জানো, রশ্মি সিগারেট খায়?”
“কী?” চিত্রা থমকে গেল।
সুব্রত দৃঢ় গলায় বলল, “হ্যাঁ। আমি নিজের চোখে দেখেছি, ও সিগারেট কিনছে। অথচ বলছ ও ভালো মেয়ে।”
চিত্রা প্রতিবাদী গলায় বলল, “সিগারেট তো আপনিও খান। তাছাড়া এটা বড় বিষয় না। বড় বিষয় হলো, ওর মনটা খুব সুন্দর। এর থেকেও বড় কথা, ও আপনাকে পছন্দ করে। এতকিছু একসাথে পেয়েও ফিরিয়ে দিলেন আপনি। এবার বলুন, আপনি ঠকেননি?”
“তোমাকে কে বলল ও আমাকে পছন্দ করে? শোনোনি, সবার সামনে ও বলেছে, ও আমাকে সহ্য করতে পারে না।”
চিত্রা হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলে উঠল, “আরে, গলায় ছুরি ধরে রাখলে যে-কেউই বলবে, মীরজাফর খুব ইমানদার লোক ছিল। কিন্তু আসলে কী তাই? আপনি যেভাবে জিজ্ঞেস করেছেন, তাতে কে বলবে, সে আপনাকে পছন্দ করে?”
সুব্রত বই নামিয়ে রাখল হাত থেকে। ঈষৎ রাগ করে বলল, “এইসব আজেবাজে কথা বলা বন্ধ করো তো। আমার ভালো লাগছে না এইসব শুনতে। অসহ্যকর!”
“সে তো লাগবেই।” সুব্রতর সামনে গিয়ে দাঁড়াল চিত্রা। আকুতির সুরে বলল, “আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, সুব্রত ভাই; আপনাদের বিয়েটা হলে আপনারা সুখী হবেন। এখনো সময় আছে। যদি নিজেকে বাঁচাতে চান, তবে একটু ভাবুন।”
সুব্রত মলিন সুরে বলল, “আমি রুশাকে কখনোই ভুলতে পারিনি, চিত্রা। কখনো পারবোও না। রুশা আজও আমার হৃদয়ে বিরাজমান। আমি ওকে অনুভব করি সর্বক্ষণ। সেখানে অন্য কাউকে কীভাবে আনবো?”
চিত্রা জোর দিয়ে বলল, “আপনাকে আনতে হবে, সুব্রত ভাই। রুশা ভাবিকে ভুলে যেতে হবে আপনাকে। মানুষের জীবনটা হলো সময়ের মতো; যতদিন থাকবে, চলতেই থাকবে। আপনি এটাকে থামানোর বৃথা চেষ্টা করছেন, সুব্রত ভাই।”
“আমি কিছু থামানোর চেষ্টা করছি না, চিত্রা। সময় যেভাবে চলছে, তেমনি আমার জীবন চলছে। কিছুই থেমে নেই।”
“তাহলে আপনি কেন নতুন করে কিছু ভাবতে পারছেন না?”
“কারণ আমার জীবনে রুশার উপস্থিতি আজও একইরকম আছে। ওর দেহটা নেই, কিন্তু আমি ওর অস্তিত্ব টের পাই। ওর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোই আমার অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যৎ! এর বাইরে আমি অন্য কিছুই ভাবতে পারি না।”
“সবাই তো পারে, সুব্রত ভাই।”
সুব্রত চিত্রার চোখে চোখ রেখে বলল, “সবাই তো আর আমার মতো করে কাউকে ভালোবাসেনি!”
চিত্রা চমকে উঠল। সুব্রতর চোখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল।
সুব্রত আবারও গাঢ় স্বরে বলল, “সত্যি বলছি, আমি রুশাকে যতটা ভালোবাসি, এই পৃথিবীতে কেউ হয়তো কাউকে ততটা ভালোবাসতে পারবেও না কখনো।”
চিত্রা শক্ত গলায় বলল, “তবে আপনি এখনো বেঁচে আছেন কেন? উনার সাথে সাথে মরে যেতেন।”
“বেঁচে আছি এই কারণেই, যেন এই পৃথিবী থেকে ওর অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে না যায়।”
চিত্রা চড়াও হয় সুব্রতর উপর; দাঁড়িয়ে-চেঁচিয়ে বলে, “আপনি বোকার শহরে বাস করছেন, সুব্রত ভাই। আপনি নির্বোধ। মানুষ মরে যাওয়ায় সাথে সাথেই বিলুপ্ত হয়ে যায়।”
“তাঁদের তো আমার মতো কেউ নেই, যে তাকে সারাজীবন মনে রাখবে; যতদিন বাঁচবে, ততদিন তাঁর কথা ভেবে কাঁদবে। তাই বিলুপ্ত হয় ”
হাল ছেড়ে দিলো চিত্রা। দরজার দিকে অগ্রসর হয়ে বলল, “তবুও আমি বারবার বলব, আপনি ভুল। তাঁর স্মৃতি আপনাকে শুধু কাঁদাবেই। কখনো শান্তি দিবে না। জীবনের একটা সময় যখন আপনি দুর্বল হয়ে পড়বেন, যখন আপনার মস্তিষ্ক থেকে এই সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে যেতে শুরু করবে, তখন আপনি নিঃসঙ্গবোধ করবেন।”
সুব্রত বলল, “সেই দিনের আগে যেন আমার মৃত্যু হয়!”

চিত্রা জানে না সুব্রত ভাই রুশাকে কতটা ভালোবাসে। সে এটাও জানে না, এত ভালোবাসার পরেও কেন আগলে রাখতে পারল না ওই মানুষটাকে। কিন্তু এইদিনের পর তাঁর ধারণা হলো, সুব্রত ভাই একটা ভুল ধারণা নিয়ে জীবনযাপন করছে। উনি বিশ্বাস করে, উনি যেমন রুশার ভালোবাসা অনুভব করতে পারে, তেমনি উনার এই ত্যাগ, এই ভালোবাসা কোথাও না কোথাও থেকে রুশাও অনুভব করতে পারছে! তাই নিজের জীবনের সাথে আর কারোর জীবন জড়াতে চায় না। অথচ চিত্রা নিশ্চিত, এমন বিশ্বাস অযৌক্তিক!

এরপর কিছুদিন কেটে গেল, সুব্রতর ঘরে গিয়ে কথার ছলে চিত্রা বারবার রশ্মির প্রসঙ্গ তুলতে লাগল। যেন রশ্মিকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে সুব্রত। সে বলতে লাগল, “আমি আপনাদের ভালো চাই, সুব্রত ভাই। আমি চাই সবাই সুখে থাকুক।”

৪১.
বেশ কিছুদিন ধরে বাড়িতেই অবস্থান করছেন রুমানা বেগম। ইতোমধ্যে চাকরির জন্য যোগাযোগ করেছেন কয়েক জায়গায়। কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি। ইন্টারভিউ এর জন্য পর্যন্ত ডাকেনি। এদিকে আর্থিক অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এভাবে আর ক’দিন? পূর্বেই টানাটানির সংসার ছিল তাঁর। এখন তো সম্পূর্ণ নিঃস্ব। দু’বেলা ঠিকমতো খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নেই!

এক বিকেলে বসে বসে ভাবছিলেন রুমানা বেগম, তখনই হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। তাঁর মনে হলো রশ্মি এসেছে, তাই ভাবনা ভঙ্গ করে ওঠে গেলেন সোফা থেকে। দরজা খুলে দিলেন।
দরজার বাইরে রশ্মি নয়, মিস্টার মুজিবর দাঁড়িয়ে আছেন। রুমানা বেগম আঁতকে উঠলেন উনাকে দেখে। তাঁর মুখ থেকে ছিটকে পড়ল, “আপনি এখানে?” কথাটা!
মিস্টার মুজিবর হাসলেন রুমানা বেগমকে এভাবে ভড়কাতে দেখে। তিনি চঞ্চল গলায় বললেন, “ভিতরে আসতে বলবেন না? এতদিন পর এলাম।”
“কে-কেন?” রুমানা বেগমের গলা কেঁপে উঠল ভয়ে!
মিস্টার মুজিবর একই সুরে আবার বললেন, “আহা! আপনিও না; খালি ভয় পান! বলেছিলাম না, উপরওয়ালা চাইলে আমাদের আবার দেখা হবে।” উচ্চস্বরে একবার হাসলেন তিনি। আরও বললেন, ” ওপরওয়ালা চাইছে বলেই আমাদের আবার দেখা হলো। এবার অন্তত ভিতরে ঢুকতে দিন। আমার কিন্তু কিছু প্রাপ্য ছিল। এখন অস্বীকার করতে পারবেন না আপনি। আমি আমার প্রতিজ্ঞানুযায়ী আপনাকে জেল থেকে মুক্ত করেছিলাম। ভুলে গেছেন?”
ভুলে যাননি রুমানা বেগম। বরং এই ব্যাপারটা তাকে সারাক্ষণ দমিয়ে রাখতো। মিস্টার মুজিবরের দিক থেকে চোখ সরিয়ে তিনি বললেন, “আসুন।”
মিস্টার মুজিবর আবারও উচ্চস্বরে হাসলেন। ভিতরে পা রেখে বললেন, “আহা! মনে হচ্ছে খুব কাছের কারোর বাড়িতে এলাম। বাড়িটাও নিজের মনে হচ্ছে। কেন বলুন তো?”
রুমানা বেগম গম্ভীরমুখে বললেন, “ভাববেন না আপনি আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। বরং আমার দূর্ভাগ্য, আপনাকে বাড়িতে ঢুকতে দিতে হচ্ছে।” ড্রয়িংরুমের মাঝখানে আসতেই রুমানা বেগম আবার বললেন, “বসুন।”
মিস্টার মুজিবর বসলেন সোফাতে। হেলান দিয়ে, রুমানা বেগমের দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গ সুরে বললেন, “আপনার তেজ দেখি আগের মতোই আছে। এবার তেজটা একটু কমান। একটু সেবা করার সুযোগ দিন। এতগুলো বছর একা একা কাটিয়ে দিলেন। হে হে হে!”
হাসির আওয়াজে যেন রুমানা বেগমের কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে লাগল। তিনি চোখ বুজে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর মিস্টার মুজিবর হাসি থামিয়ে বললেন, “আপনাকে বড় কোনো শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে ভাবলাম, শুধু শুধু আপনাকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ? বরং এমন কিছু করি, যাতে আপনারও লাভ হয়, আর আমারও।”
“লাভ মানে?” রুমানা বেগমের কপালে চওড়া ভাজ পড়ল সহসা। “আপনার শর্ত ছিল, শুধুমাত্র ক্ষমা চাইতে হবে। আমি আগেও একবার চেয়েছি। আবারও বলছি, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দিন।”
মিস্টার মুজিবর চোখ বড় বড় করে দেখলেন রুমানা বেগমকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ফিক করে হেসে বললেন, “আপনার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি আমাকে শাসাচ্ছেন, ক্ষমা চাচ্ছেন না৷”
রুমানা বেগমও একই সুরে বললেন, “কুত্তার তো ব্যাস খানা চাই। খানা পরিষ্কার না এঁটো, এতে ওর সমস্যা হওয়ার কথা না।”
“মিসেস রুমানা।” গর্জে উঠলেন মিস্টার মুজিবর। ওঠে দাঁড়িয়ে, নাক-মুখ খিঁচিয়ে তাকিয়ে রইলেন রুমানা বেগমের দিকে।
রুমানা বেগম সকৌতুকে বললেন, “উত্তেজিত হবেন না, স্যার। পানি খাবেন? অপেক্ষা করুন, আমি নিয়ে আসছি।”
জবাবের অপেক্ষা না করেই পানি আনতে গেলেন রুমানা বেগম। ফিরে এসে দেখলেন, মিস্টার মুজিবর সোফায় বসে কিছু ভাবছেন। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে গেলেন তিনি।
পানির গ্লাসটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালেন মিস্টার মুজিবর। হাতটা গ্লাস পেরিয়ে চলে গেল আরও সামনে; সাথে সাথে খপ করে রুমানা বেগমের ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে নিলেন।
ধমকে উঠলেন রুমানা বেগম, “কী করছেন আপনি?।”
মিস্টার মুজিবর দাঁত বের করে হেসে বললেন, “খুব অহংকার, তাই না?”
এ-কথা বলে হ্যাঁচকা টানে রুমানা বেগমকে নিজের কাছে নিয়ে ফেললেন মিস্টার মুজিবর। তাকে পাশে বসিয়ে একহাতে জড়িয়ে রাখলেন।
রুমানা বেগম কেবলই নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করবেন, কিন্তু অকস্মাৎ দরজার দিকে চোখ পড়তেই তিনি মূর্তিমান হয়ে গেলেন৷ তাঁর শ্বাস থমকে গেল। চোখ বড় বড় হয়ে যেন বেরিয়ে আসতে চাইল কোটর থেকে। দরজার কাছে রশ্মি দাঁড়িয়ে আছে! তিনি সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে দরজার দিকে ছুটে গেলেন, কিন্তু ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে রশ্মি। তিনিও বেশিদূর যেতে পারলেন না। তাঁর সারা শরীর অসাড় হয়ে এলো হঠাৎ করেই। তাঁর মনে হলো, গলাটা কেউ চেপে ধরেছে। ছটফট করতে করতে মেঝেতে পড়ে গেলেন তিনি।

মিনিট দশেক পর; চিত্রার বাড়ির ছাদের, রেলিঙের উপর বসে আছে রশ্মি। চিত্রা পাশেই। পড়ন্ত বিকেলে। মৃদু বাতাস চারিদিকে। চিত্রা থমথমে মুখ করে রশ্মির দিকে তাকিয়ে আছে। রশ্মি নির্লিপ্ত।
বেশ অনেকটা সময় পেরোনোর পরেও যখন রশ্মির কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা গেল না, তখন চিত্রা খানিক বিরক্ত হয়েই বলল, “কী ব্যাপার রশ্মি? এইভাবে ছাদে টেনে এনে চুপচাপ থাকলে হবে? কিছু বলো।”
রশ্মি কিছু না বলে তাকাল চিত্রার দিকে। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। এরপর হঠাৎ ব্যাগ থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করল; এবং তৎক্ষনাৎ সিগারেট ধরাল।
চিত্রা চোখ বড় বড় করে দৃশ্যটা দেখল কিছুক্ষণ ভরে৷ রশ্মির হাতের সিগারেটটা অর্ধেক হয়ে যাওয়ার পর সিগারেটের প্রতি বড্ড লোভ জন্মাল তাঁর! সহসা ঠোঁট টিপে বলল, “কেমন?”
রশ্মি পাশ ফিরে, ভুরু নাচিয়ে বলল, “কী?”
চিত্রা ইশারায় সিগারেটটা দেখিয়ে বলল, “কেমন?”
“খারাপ না। দারুণ ফিল। নিজেকে পুরুষ পুরুষ মনে হয়!”
“পুরুষ?” চিত্রা হতবাক!
রশ্মি হেসে উঠল, “সরি। পুরুষ না। ঠিক বলতে পারব না। বাট কিছু তো হয়। নইলে কেন খাবো?”
চিত্রা ঢোক গিলল। এরপর ইতস্তত করে, একটা হাত সামনে বাড়িয়ে বলল, “আমারও মন চাচ্ছে।”
“সিগারেট খেতে?” অবিশ্বাসের সুরে জানত চাইল রশ্মি।
মাথা ঝাঁকাল চিত্রা। রশ্মি থুতনিতে হাত রেখে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে পরখ করল চিত্রাকে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল, “এভাবে হাত পেতে কেউ সিগারেট চায়? এভাবে করো।”
রশ্মি যেভাবে দেখাতে লাগল, সেভাবে প্রথমেই ডান হাতের দুটো আঙ্গুল সামান্য ফাঁকা করল। তখনই টুপ করে আঙ্গুলের ফাঁকে একটা সিগারেট গুজে দিলো রশ্মি। সাথে সাথে বলল, “এবার এটা মুখে রাখো।”
চিত্রা মুখে রাখল সিগারেটটা। ঠোঁট দিয়ে নয়, দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল ওটাকে। রশ্মি বলল, “আহা! এভাবে না। এইভাবে।” নিজের হাতের সিগারেটটা দুই ঠোঁটের মাঝে ধরে দেখাল রশ্মি।
চিত্রা সিগারেটটা ঠোঁটের মাঝে রাখতেই রশ্মি আগুন ধরিয়ে দিলো। সাথে সাথে বলল, “এবার টানো।”
চিত্রা চমকে ওঠে বলল, “আবার টানতেও হবে?”
“তবে কি গন্ধ শোকার জন্য এটা?” কিছুটা চেঁচিয়ে উঠল রশ্মি। এমন টাইপের মানুষ সে জীবনে দেখেনি৷ এত সরল!
যেই না সিগারেটটা টানল চিত্রা, অমনি তাঁর নাক-মুখ ধোঁয়ায় ভরে উঠল। তাঁর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ৭০ বছরের মুরুব্বিদের মতো খ্যাঁকখ্যাঁক করে কাশতে শুরু করল। সাথে সাথে ঠোঁটের মাঝ থেকে সিগারেটটা বের করে ছুড়ে মারল দূরে। ওদিকে চিত্রার অবস্থা দেখে হেসে কুটিকুটি হলো রশ্মি!
চিত্রা নাক সিঁটিয়ে বলল, “ছি! কী বাজে গন্ধ! ধোঁয়ায় কী দুর্গন্ধ!”
রশ্মি কাচুমাচু হয়ে বলল, “সত্যিই এত জঘন্য?”
“আমি কি মিথ্যা বলব? এর থেকে বিষ অনেক সুস্বাদু।”
চিত্রার কথা শুনে সিগারেটটার দিকে তাকাল রশ্মি। হঠাৎ তাঁর সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠল। মুখটা বিকৃত করে আরও একটা টান দেওয়ার জন্য উপরে উঠাতে লাগল। মুখের সামনে আনতেই আবার ছুড়ে মারল চিত্রার মতো করে।
চিত্রা হেসে বলল, “কী হলো?”
রশ্মি বলল, “মুডটাই নষ্ট করে দিলে।”
এরপর কিছুক্ষণ হাসল চিত্রা আর রশ্মি। একসময় হাসি থামিয়ে চিত্রা রশ্মির কাঁধে হাত রেখে বলল, “আমরা তো খুব ভালো বন্ধু, তাই না?”
‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা ঝাঁকাল রশ্মি।
চিত্রা আবার বলল, “তাহলে একে অপরের সমস্যার কথাও শেয়ার করা উচিত।”
রশ্মি চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজ একেবারে স্পষ্ট করে মায়ের সাথে কথা বলব। একেবারে সোজাসাপটা আলোচনা।”
চিত্রা বিস্মিত হয়ে বলল, “কী ব্যাপারে?”
“ওই লোকটার ব্যাপারে। মা যদি চায় ওই লোকটাকে বিয়ে করে বাকি জীবন কাটাতে, তাহলে আমার অসুবিধা হবে কেন? সবারই অধিকার আছে আরামদায়ক ভাবে জীবনযাপন করার। আমার জন্য কেন সবকিছু বিসর্জন দিতে হবে? আমি মা-কে আজকে সোজাসোজি বলব, তুমি ওই ওই লোকটাকে বিয়ে করতে পারো, আমি বাধা হয়ে দাঁড়াব না।”
“হঠাৎ এইসব কথা কেন বলছ, রশ্মি? আন্টি তো এখন চাকিরিটা করছে না। উনার সাথে দেখাও হচ্ছে না।”
রশ্মি হাসল। বলল, “দেখা হচ্ছে না আবার! লোকটা আমাদের বাড়িতে এসেছে।”
“সেকি? কখন?” চিত্রা সাথে সাথে লাফিয়ে নামল রেলিং থেকে।
রশ্মি নির্বিঘ্নে বলল, “আমি একটু আগে বাড়িতে ফিরেছি। দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে গিয়েই দেখলাম, আমার মা আর ওই লোকটা সোফায় বসে আছে, একেবারে গা ঘেষে। লোকটা মা-কে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।”
চিত্রা আঁতকে উঠল। বলল, “এরপর?”
মুখ চেপে কান্না আটকাল রশ্মি। ধরা গলায় বলল, “এরপর তো আমি চলে এলাম এখানে।”
“আরে গাধি!” চিত্রা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল।
হঠাৎ সাইরেনের আওয়াজ শুনতে পেলো দুজনে। রশ্মি লাফিয়ে নামল রেলিং থেকে। বলল, “সাইরেনের আওয়াজ! আবার পুলিশ!”
চিত্রা ভীতসন্ত্রস্ত মুখ করে বলল, “বোধহয় এম্বুলেন্স এর আওয়াজ।”
ছাদের অন্যপাশে ছুটে গেল চিত্রা আর রশ্মি। হ্যাঁ, এম্বুলেন্স। ওটা রশ্মিদের বাড়ির সামনেই থামল। সাথে সাথে দুটো লোক বেড নিয়ে ছুটে গেল ভিতরে।
চিত্রা আর রশ্মি যখন দৌড়ে গেল বাড়ির কাছে, তখন রুমানা বেগমকে ভেতর থেকে বের করে আনা হলো। তিনি ছটফট করছেন তখনও। রশ্মি ছুটে গেল মায়ের কাছে। মায়ের সাথে এম্বুলেন্স এ উঠল। সাথে চিত্রাও৷

হাসপাতালে গিয়ে রুমানা বেগমকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ডাক্তাররা। রশ্মি কাঁদতে লাগল বাইরে বসে। খবর পেয়ে সবাই ছুটে এলো হাসপাতালে। দীর্ঘক্ষণ নিরলস পরিশ্রমের পর একসময় খ্যান্ত হলেন ডাক্তাররাও। মাঝরাত্রিতে সবাইকে ছেড়ে পরলোকগমন করলেন রুমানা বেগম!

৩২তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=847064556238246&id=100028041274793

বিঃদ্র: পর্বটা কেমন লাগল গঠনমূলক মন্তব্যের মাধ্যমে জানাবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here