#মেহের
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:৪
জ্ঞান ফিরতেই মেহের চোখ খুলে আশেপাশে তাকিয়ে নিজের বর্তমান অবস্থান বুঝতে পারল। তার চাচার বাড়ির রুমটাতেই সে শুয়ে আছে। আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে মাথায় কিছুর স্পর্শ পেল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখল আদ্রিশ তার শিয়রের পাশে বসে ঘুমাচ্ছে। তার এক হাত মেহেরের মাথায় ঠেকানো। আদ্রিশকে দেখেই হুট করে স্নিগ্ধর কথা মনে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মেহের নিজের মাথা থেকে আদ্রিশের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে এক লাফে উঠে বসল। মেহেরের ঝটকায় আদ্রিশের কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। সে চোখ কচলে মেহেরের দিকে তাকাতেই সঙ্গে সঙ্গে মেহের প্রশ্ন করল,
“স্নিগ্ধ কোথায়?”
আদ্রিশ কপাল কিঞ্চিত কুঁচকাল। আবার শুরু হলো মেহেরের পাগলামি। সে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কিছুটা জোরে বলে উঠল,
“চুপ করে আছেন কেন? আমার স্নিগ্ধ কোথায়? ওকে কি পুলিশ ছাড়েনি? প্লিজ বলুন না। আমি ওর কাছে যাব। থাকব না আমি এখানে।”
কথাগুলো বলতে-বলতে মেহের বিছানা ছেড়ে নেমে দরজার দিকে ছুট লাগাতেই আদ্রিশ দৌড়ে গিয়ে তার হাত টেনে ধরল। এতে করে মেহের তেতে উঠল। আদ্রিশের থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে ঝাঁজালো গলায় বলল,
“হাত ছাড়ুন। আমাকে আটকাচ্ছেন কোন সাহসে? বলেছিলাম না এই বিয়ে আমি করতে চাই না। তবুও তো করলেন। আর এখন স্নিগ্ধকে আটকানোর চেষ্টা করছেন। যা-ই করুন, আমি আপনাকে কোনোদিনও মানব না। আমি স্নিগ্ধকে ভালোবাসি। ওর কোনো ক্ষতি হলে আমি মরে যাব। হাত ছাড়ুন। কানে শুনতে পাচ্ছেন না?”
মেহেরের পাগলামিতে আদ্রিশের রাগ উঠে গেল। সে মেহেরের দুই বাহু চেপে ধরে কাছে টেনে ধমকে উঠল,
“মেহের, স্টপ ইট।”
আদ্রিশের ধমকিতে মেহের চমকে উঠে ভয় পেয়ে গেল। পরক্ষণেই সে ফুঁপিয়ে উঠল। অনুরোধের সুরে বলল,
“প্লিজ, আমাকে যেতে দিন। ওনাদের বলুন স্নিগ্ধকে ছেড়ে দিতে। আপনার পায়ে পড়ি, প্লিজ।”
আদ্রিশ মেহেরের বাহু আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে কঠিন গলায় বলল,
“তুমি আমার স্ত্রী মেহের।”
“মানি না আমি”, জোর গলায় বলল মেহের।
সঙ্গে সঙ্গে আদ্রিশ এক ধাক্কায় মেহেরকে দূরে সরিয়ে দিয়ে কর্কশ গলায় বলল,
“খবরদার, এই কথাটা দ্বিতীয়বার আর বলবে না আমার সামনে। ওই জানোয়ারের জায়গায় যদি তুমি অন্য কোনো ভালো ছেলেকে ভালবাসতে, তবু আমি তোমাকে আটকে রাখতাম না। ওই জানোয়ারের নামও আর উচ্চারণ করবে না আমার সামনে।”
মেহের স্তব্ধ হয়ে গেল। ভারি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল আদ্রিশের মুখের দিকে। লোকটার কোনো কথাই তার ঠাহর হচ্ছে না। স্নিগ্ধর সাথে যার পরিচয়ই নেই সে কেন স্নিগ্ধকে নিয়ে এমন কথা বলবে? আদ্রিশ মুখ দিয়ে ফোঁস করে একটা শব্দ করে এগিয়ে গিয়ে বালিশের পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে কাউকে ফোন করল। ওপাশের ব্যক্তি ফোন রিসিভ করতেই গম্ভীর গলায় বলল,
“কোনো প্রশ্ন করিস না। আমাদের রুমে আয়, কুইক। একা আসবি।”
ওপাশের ব্যক্তিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আদ্রিশ ফোন কেটে দিলো। মেহের কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দুই মিনিটের মাথায় দরজায় টোকা পড়ল। আদ্রিশ গিয়ে দরজা খুলে দিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে মেহের আরোহীকে দেখে অবাক হলো। আরোহী একবার আদ্রিশের দিকে, আরেকবার মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কী হয়েছে? তোদের মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?”
আদ্রিশ আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভেতরে আয়।”
আরোহী ভেতরে ঢুকতেই আদ্রিশ দরজা বন্ধ করে দিলো। আরোহী প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আদ্রিশ মেহেরের দিকে একবার তাকিয়ে আরোহীকে বলল,
“বলে দে সব।”
“এখন? এত রাতে!” অবাক হয়ে বলল আরোহী।
“হ্যাঁ, এসব নিয়ে ঝামেলা চাই না আমি।” বলেই আদ্রিশ হনহন করে হেঁটে বেলকনিতে চলে গেল। মেহের শুধু বিস্ময় নিয়ে দেখে চলেছে। আরোহী বেলকনির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মেহেরের হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও তার মুখোমুখি বসল। মেহের প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে আরোহীর দিকে তাকিয়ে আছে। আরোহী খানিক চুপ থেকে বলল,
“মেহের, এমন কিছু কথা আছে যা আমাদের জানা হলেও তোমার অজানা। আর সেসব শুনলে হয়তো তুমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে। তাই আগেই বলছি, স্ট্রং থাকার চেষ্টা করবে।”
মেহের ইতস্তত করে বলল,
“কী কথা আপু?”
“তুমি যাকে ভালোবাসো, মানে স্নিগ্ধ। ও আসলে তোমাকে বিন্দুমাত্র ভালোবাসে না।”
মেহের চমকে উঠল। প্রচন্ড বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ল। স্নিগ্ধর কথা আরোহী জানে কীভাবে বুঝতে পারল না। আমতা-আমতা করে বলল,
“এসব কী বলছেন?”
আরোহী মৃদু হেসে বলল,
“ঘাবড়িয়ো না। আমি সব জানি। গত সাত মাস ধরে স্নিগ্ধর সাথে তোমার রিলেশন ছিল, তা-ও জানি।”
মেহের বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। আরোহী পুনরায় বলল,
“কিন্তু স্নিগ্ধকে তুমি যা ভাবো, ও আসলে তা নয়। ও তোমাকে কেন, কোনোকালেই কোনো মেয়েকে মন থেকে ভালোবাসেনি। সবাইকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে।”
মেহেরের বুকটা ধক করে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলল,
“ম-মানে?”
“আজ তোমার সাথে যা ঘটতে চলেছিল, তা নতুন নয়। আট মাস আগে ঠিক একই ঘটনা আমার সাথেও ঘটেছিল। সিলেটেই আমার সাথে ওর পরিচয় হয়েছিল। আমি একদিন একটা বিপদে পড়েছিলাম। রাস্তায় এক বখাটে ছেলে আমাকে খুব জ্বালাতন করছিল। কোথা থেকে স্নিগ্ধ এসে আমাকে সেভ করেছিল। আর আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছেও দিয়েছিল। রাস্তায় নানা কথার মাঝেই সে বলেছিল যে, সে সিলেটে বেড়াতে এসেছে। কিন্তু পরদিনই তাকে আমার বাড়ির সামনে দেখতে পাই। আমি ব্যাপারটা নরমালি নিতে পারিনি, তবু মুখ ফুটে কিছু বলিনি। কিন্তু যখন দেখলাম প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটছে। ও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আর আমি বের হলেই আমার সাথে কথা বলতে চাইছে। এসব দেখে আমার মনে খটকা লাগে। কিন্তু ওর কথাবার্তা আর চালচলন দেখে আমি কিছু বলতেও পারিনি। এভাবে বেশ কয়েকদিন পর হঠাৎ ও আমাকে প্রপোজ করে বসে। আর আমিও ততদিনে ইম্প্রেসড হয়ে পড়েছিলাম। তাই ওকে একসেপ্ট করেছিলাম। ও বলেছিল ওর বাড়ি রাজশাহী। রাজশাহী ফিরেও ও আমার সাথে যোগাযোগ রেখেছিল। মাস দুয়েক পর সিলেট গিয়ে আবার আমার সাথে দেখা করেছিল। ঠিক সাড়ে তিন মাসের মাথায় ও আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন আমার অবস্থা পাগলপ্রায়। প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আমার অবস্থা দেখে আমার ফ্যামিলি দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমি কাউকে বলিনি, শুধু আদ্রিকে ছাড়া। টানা একমাস পর হঠাৎ একদিন ওর ফোন আসে। ও আমাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথা বুঝিয়ে বলে, আর আমিও বোকার মতো বিশ্বাস করি। তারপর ও সিলেট আছে শুনে আমি দেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। কিন্তু ও আমাকে বলে যে আমাকে নিয়ে ও কোথাও বেড়াতে যেতে চায়। আমি যেন ফ্যামিলিকে কিছু একটা বলে দুদিনের জন্য হলেও বাড়ি থেকে বেরোতে পারি। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই। বাড়িতে বলি যে ফ্রেন্ডদের সাথে ট্যুরে যাব। বাবা-মা আমাকে কখনও কোনো কিছুতে বাঁধা দিত না। তাই খুব সহজেই বাড়ি থেকে পারমিশন নিতে পেরেছিলাম। স্নিগ্ধর সাথে কক্সবাজার যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলাম। একমাস পর ওকে দেখে আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম। কিন্তু পথিমধ্যে আমি কারো সাথে ওর ফোনালাপ শুনতে পাই। ও ভেবেছিল আমি ঘুমিয়ে আছি। কিন্তু আমি সজাগ ছিলাম। ওর কথা শুনে আঁচ করতে পেরেছিলাম যে, ও আমাকে নিয়ে পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দিবে। মানসিকভাবে আমি খুব ভেঙে পড়লেও তখন আমার মাথায় চলছিল, আমাকে পালাতে হবে। এক বাসস্ট্যান্ডে বাস থামানোর পর ও আমাকে রেখে খাবার কিনতে গিয়েছিল। সেই ফাঁকে আমি বাস থেকে নেমে কোনোরকমে সেখান থেকে সরে পড়েছিলাম। ফিরতি বাসে সোজা সিলেট চলে আসার পর আমার মনের অবস্থা শোচনীয়। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে আমার এমন অবস্থা হয়েছিল যে, শেষমেষ বাবা-মাও জেনে গিয়েছিল।”
কথাগুলো বলতে বলতে আরোহীর গলা ধরে এসেছে। সে থামতেই মেহের আগ্রহী দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বুকের মধ্যে হাতুড়িপেটা হলেও পরের কথাগুলো শোনার জন্য মন ছটফট করছে। আরোহী নিজেকে সামলে আবার বলতে শুরু করল,
“আদ্রি এসব ঘটনা সহজভাবে নিতে পারেনি। ও খুব জেদি ছেলে। ওই ঘটনার পরপরই রাজশাহী গিয়ে স্নিগ্ধর খোঁজ করেছিল। রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল স্নিগ্ধর ছবি দিয়ে। মামলাও করেছিল, আর স্নিগ্ধ ধরাও পড়েছিল। কিন্তু পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে ও পালিয়েছিল। কোথায় পালিয়েছে তা ওর মামাও জানত না। আদ্রি ওর মামার থেকে ওদের গ্রামের ঠিকানা নিয়ে সেখানেও গিয়েছিল, কিন্তু পায়নি। তারপর থেকে প্রায় পাঁচ মাস পর্যন্ত আদ্রি সময় করে বিভিন্ন জায়গায় স্নিগ্ধর খোঁজ করেছিল। ও ভেবেছিল স্নিগ্ধ নিজের গ্রামে যাবে না, কারণ ওখানে খোঁজ করার সম্ভাবনা আছে। অথচ পাঁচ মাস পর খোঁজ নিয়ে দেখল ততদিনে ও তোমাকেও ফাঁসিয়েছে। আদ্রি পুলিশকে জানিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু স্নিগ্ধ টের পাওয়ার সাথে সাথে গ্রাম ছেড়েছিল। ততদিনে আমরা স্নিগ্ধর সম্পর্কে অনেক তথ্য জেনেছিলাম পুলিশের থেকে। তারা তদন্ত করে জেনেছিল স্নিগ্ধ এর আগে আরও অনেক মেয়ের সাথে এমন করেছে। এটাই ওর পেশা। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিভিন্ন মেয়েদের ফাঁদে ফেলে। এমনভাবে তাদের সামনে নিজেকে প্রমাণ করে, যেন তারা ওকে মন থেকে বিশ্বাস করে প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়। মেয়েরা যখন ওকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলে, ঠিক তখনই ও সরে পরে। মানসিকভাবে মেয়েরা ভেঙে পরার পর আবার হুট করে যোগাযোগ করে। তাদের ইমোশনকে ব্যবহার করে তাদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে বিক্রি করে দেয়। তোমার-আমার সাথেও ঠিক এটাই করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি।”
আরোহীর কথাগুলো মেহের স্তব্ধ হয়ে শুনল। তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরে চলেছে। বলার মতো কোনো কথাও সে খুঁজে পাচ্ছে না। হুট করে সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ধরা গলায় বলল,
“স্নিগ্ধ এমন কাজ কেন করবে? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ও এমনটা করতে পারে না।”
আরোহীও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“এটাই তো সমস্যা মেহের। ওই ধোঁকাবাজটা নিজেকে এমনভাবে প্রেজেন্ট করে যে, কেউ বিশ্বাসই করতে পারে না ওর মতো ছেলে এমন জঘন্য কাজ করতে পারে। আমি জানি তোমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আমারও হয়েছিল। মন থেকে কাউকে ভালোবাসলে, তার ব্যাপারে এমন কিছু শুনে কি এত সহজে বিশ্বাস করা যায়? তা-ও তো আমার নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। নিজেকে সামলে নিতে আমার অনেকটা সময় লেগেছে। তোমারও হয়তো কষ্ট হবে। কিন্তু তোমাকে সামলানোর মানুষ আছে। এখনও যদি তোমার বিশ্বাস না হয়, তবে আমার কাছে প্রমাণ আছে। ওয়েট।”
আরোহী নিজের ফোন ঘেঁটে কিছু খুঁজতে লাগল। মেহেরের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তার বুকের মধ্যে যে তোলপাড় চলছে। আরোহী মেহেরের সামনে নিজের ফোনটা তুলে ধরতেই সে সেদিকে তাকাল। এতক্ষণ ধরে চলতে থাকা নিঃশ্বাসটুকুও এবার বন্ধ হবার উপক্রম হলো। আরোহীর ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে স্নিগ্ধ আর আরোহীর হাস্যোজ্জ্বল মুখের একটা ছবি। এবার আর মেহের নিজেকে সামলাতে পারল না। নিঃশব্দ কান্নায় শব্দ যোগ হতেই সে দুহাতে মুখ চেপে ধরে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। আরোহী তাকে আটকাল না। মিনিট পাঁচেক চুপ মেরে দাঁড়িয়ে মেহেরকে কাঁদতে দিলো। এখন যে কোনো সান্ত্বনাই কাজে আসবে না, তা সে ভালোভাবেই জানে। মেহেরের কান্না থামাথামির নাম নিচ্ছে না, বরং বেড়েই চলেছে। পাঁচ মিনিট পর আরোহী গিয়ে মেহেরের পাশে বসল। মেহেরের কাঁধে হাত রেখে নরম কন্ঠে বলল,
“আমার কথা শেষ হয়নি। মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট কথাই বাকি রয়ে গেছে।”
মেহের মাথা দুলিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“আমি আর কিছু শুনতে চাই না আপু, প্লিজ।”
“এটা তোমাকে শুনতেই হবে, তাকাও আমার দিকে।”
মেহের তাকাল না। আরোহী ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি যখন জানতে পেরেছিলাম যে স্নিগ্ধ তোমাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টায় আছে। তখন আমি আদ্রিকে বলেছিলাম, ও যেন তোমার খবর নিয়ে তোমাকে বুঝিয়ে বলে। কারণ আমি চাই না আমার মতো অবস্থা আরও কোনো মেয়ের হোক। আদ্রি সময় করে তোমার খোঁজ নিয়েছিল। ভেবেছিল তোমার সাথে দেখা করে এ বিষয়ে কথা বলবে। গিয়েওছিল কথা বলার জন্য। কিন্তু তুমি না কি বাড়ি থেকেই বের হও না। আমার অনুরোধে ও তোমাদের গ্রামের একজনের থেকে তোমাদের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে অনেকবার তোমার বাড়ির সামনের রাস্তায় গিয়েছিল। যদি তোমার সাথে দেখা হয়ে যায়, তাই। সাথে করে তোমাদের গ্রামের এক ছেলেকে রেখেছিল, যাতে তোমাকে দেখামাত্র চিনতে পারে। ছেলেটাকে অবশ্য টাকা দিয়েছিল। তারপর একদিন তোমার সাথে ওর দেখা হয়। তুমি ওকে দেখনি, ও দেখেছিল। তোমার সাথে তোমার বড়ো বোন ছিল। কিন্তু আদ্রি এগিয়ে গিয়ে তোমার সাথে কথা না বলেই ফিরে এসেছিল। যাকে আমি এত অনুরোধ করে তোমাদের গ্রামে পাঠিয়েছিলাম। সেই-ই এসে আমাকে বলল, আপু, আমাকে তো অনেকদিন ধরে বিয়ের কথা বলছিলি। তো, এবার আমি রাজি। তবে আমি যাকে বলব, তাকে এনে দিতে হবে। আমি অবাক হয়েছিলাম। হ্যাঁ, আমি আসলেই ওকে বিয়ের কথা বলেছিলাম। কারণ আমি চেয়েছিলাম আমার আগে আদ্রি বিয়ে করুক। আমি চলে গেলে মা-বাবাকে দেখার কেউ নেই তো। তখন আদ্রি নারাজ ছিল। সেই আদ্রি যখন নিজের মুখে বলল বিয়ে করব। তখন অবাক হবারই কথা। তার ওপর যখন শুনলাম তোমার কথা, তখন তো আমি আরও অবাক। তুমি স্নিগ্ধকে ভালোবাসো জেনেও আদ্রি তোমাকেই বিয়ে করার জেদ ধরেছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমাকেই কেন বিয়ে করতে চায়। তখন ও বলল বিশেষ কোনো কারণ নেই। অজানা কারণেই তোমাকে ওর ভালো লেগে গেছে। আর ও চায় ওর ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে তোমার মিথ্যে ভালোবাসা ভোলাতে। আমি কিছু না ভেবেই হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম। কারণ আমার বিশ্বাস আছে ওর ওপর। আর আমি হ্যাঁ বলেছি মানে বাবা-মাও রাজি। তারপর তোমার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হলো। তোমাকে দেখে আমাদেরও ভালো লেগেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো অনেক সুন্দরী মেয়েদের দেখানো হয়েছিল আদ্রিকে। তাদের রেখে ও তোমাকে কেন বিয়ে করতে চায়? আত্মীয়-স্বজনরা কয়েকজন আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু আমার ভাই নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। সে তোমাকেই বিয়ে করবে। শেষমেষ তাই হলো। তোমার বাবা খোঁজ খবর নিয়ে জানালেন তিনিও রাজি আছেন। জানো? যেদিন তোমার সাথে আদ্রি দেখা করতে গিয়েছিল। সেদিন এসেই আমাকে বলেছিল, আপু, আমার বউটা কিন্তু মারাত্মক ভালো মেয়ে। আননোন নাম্বারে ফোন করে তোমাকে জ্বালিয়ে ও মজা পেত। ওর এসব কান্ড দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, নিজের অজান্তেই আমার ভাই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছে।”
মেহেরের কান্নার গতি কমলেও, একেবারে থেমে যায়নি। কান্নাভেজা চোখে সে ভীষণ বিস্ময় নিয়ে আরোহীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আরোহী সস্নেহে মেহেরের চোখের পানি মুছে দিয়ে গালে হাত রেখে বলল,
“নিজেকে সামলে নাও বোন। তোমার সাথে যা ঘটতে চলেছিল, তা ঘটে গেলে কী হত ভাবো একবার। আমি এটুকু বুঝতে পারছি যে, বিয়ের দুদিন হয়ে গেলেও আদ্রি আর তোমার সম্পর্কটা স্বাভাবিক না। একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ। আদ্রি তোমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। কয়েকদিন গেলে সেটা নিজেই বুঝতে পারবে দেখো। আর শোনো, আমি ছাড়া কেউ কিছু জানে না। তাই এটা নিয়ে ভেবো না। তুমি জ্ঞান হারানোর পর আদ্রিই তোমাকে বাইরে থেকে নিয়ে এসেছিল। বাড়ির সবাই জিজ্ঞেস করার পর বলেছে তোমাকে নিয়ে ও একটু বাইরে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই তুমি জ্ঞান হারিয়েছ। তাই এসব নিয়ে আর কেউ ঘাঁটেনি। কান্না থামাও, অনেক রাত হয়েছে। বাড়ির সবার খাওয়া হয়ে গেছে। তোমার জন্য আদ্রি এখনও না খেয়ে আছে। ওই দেখো, আরও আধ ঘন্টা আগে টেবিলে খাবার রেখে গিয়েছিল তোমার মা। আদ্রিকে ডেকে খেয়ে নাও। আমি আসছি, কাল আবার কথা হবে। গুড নাইট।”
মেহের কোনো উত্তর দিলো না। আরোহী উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে উঁচু গলায় বলল,
“আদ্রি, আমি চলে যাচ্ছি। দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দে।”
আরোহী চলে যেতেই মেহেরের কান্নাটা আবার বাঁধ ভাঙল। বুকের মধ্যের এই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করার মতো ক্ষমতা হয়তো তার নেই। জীবনের প্রথম যাকে সে এতটা ভালোবেসেছে, যে তাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, তাকে ভোলা কি এত সহজ? বিছানার চাদর খামচে ধরে মেহের হাঁটুতে মুখ গুঁজে সশব্দে কেঁদে উঠল। আদ্রিশ এতক্ষণ বেলকনি থেকে কথা না শুনলেও মেহেরের কান্নার শব্দ তার কানে পৌঁছেছে। রুমে ঢুকে মেহেরের দিকে চোখ পড়তেই তার বুকটা কেঁপে উঠল। মিনিট দুয়েক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে মেহেরের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর এগিয়ে গিয়ে দরজা আটকে বিছানায় গিয়ে বসল। মেহের টেরও পেল না। আদ্রিশ মেহেরের মাথায় হাত রেখে কোমল কন্ঠে ডাকল,
“মেহের?”
মেহের চমকে উঠে মাথা তুলে তাকাল। আদ্রিশের সাথে চোখাচোখি হতেই সে দ্রুত কিছুটা পিছিয়ে বসে মাথা নিচু করে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে লাগল। আদ্রিশ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেহেরের কান্নাভেজা মুখের দিকে। মনের ব্যথাটা হঠাৎ করেই হিংসায় রূপ নিল। তার নিজের স্ত্রী তারই সামনে অন্য এক পুরুষের জন্য কাঁদছে, ব্যাপারটা ঠিক মানতে পারল না। আদ্রিশ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কারণ মেহেরের মনের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। এদিকে মেহের কান্না থামাতে চেয়েও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। আদ্রিশের সামনে স্নিগ্ধর জন্য কাঁদতে অস্বস্তি লাগছে। আবার স্নিগ্ধর কথা ভেবেও কষ্ট হচ্ছে। মেহের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাথা নিচু করে আশ্রু বিসর্জন দিয়ে চলেছে। কিছু সময় পর আদ্রিশ বলল,
“কান্না থামাও। আমার সামনে এভাবে কাঁদবে না।”
মেহের আদ্রিশের দিকে তাকাতেও পারল না। আদ্রিশের মেজাজ চটে গেল। চেয়েও সে নিজেকে সামলাতে পারল না। মেহেরের হাত ধরে একটানে কাছে এনে শক্ত মুখে বলল,
“স্টপ ক্রাইং। আই সেইড, স্টপ ক্রাইং।”
মেহের চমকে উঠল। আদ্রিশের মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও সে ফুঁপিয়ে উঠল। আদ্রিশের রাগটুকু সঙ্গে সঙ্গে মোমের মতো গলে গেল। সে মেহেরের মুখটা দুহাতে তুলে ধরে বলল,
“সরি, আর বকব না। কান্না থামাও।”
মেহের ইতস্তত করে আদ্রিশের হাত দুটো সরিয়ে দিলো। আদ্রিশের মন খারাপ হলেও সে ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তা উড়িয়ে দিলো। উঠে গিয়ে ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে এল। তারপর টেবিলে রাখা খাবার থেকে একটা প্লেটে করে খাবার নিয়ে মেহেরের পাশে গিয়ে বসল। মেহের এখনও নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। আদ্রিশ ভাত মেখে মেহেরের মুখের সামনে তুলে ধরে বলল,
“হা করো।”
মেহের অবাক দৃষ্টিতে আদ্রিশের মুখের দিকে তাকাতেই আদ্রিশ চোখের ইশারায় খেতে বলল। মেহের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে একটা ঢোক গিলে শুকনো ঠোঁটটা জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিল। তারপর মৃদু কন্ঠে বলল,
“ক্ষুধা নেই।”
“সেই দুপুরে কোনোমতে খেয়ে উঠে পড়েছিলে। তারপর থেকে এখনও কিছু খাওনি। ক্ষুধা পায়নি মানে কি?”
মেহের চুপ করে রইল। আদ্রিশ আবার বলল,
“মেহের, খেয়ে নাও। আমার কিন্তু এত ধৈর্য নেই। রাগ উঠে যেতে পারে। জলদি হা করো। আমারও ক্ষুধা পেয়েছে।”
আদ্রিশের গম্ভীর কন্ঠে মেহের কিছুটা হলেও ভয় পেয়ে গেল। তার ঠিকই ক্ষুধা পেয়েছে, কিন্তু খাওয়ার মতো অবস্থায় সে নেই। আদ্রিশ পুনরায় খেতে বলতেই মেহের মাথা নিচু করে বলল,
“আমি হাত দিয়ে খেতে পারব।”
আদ্রিশ কিছুক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে প্লেটটা রেখে উঠে দাঁড়াল। আবার গিয়ে এক প্লেট খাবার এনে মেহেরের সামনে রাখল। মেহের বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে গেল। মুখে পানির ঝাপটা দিতেই পুনরায় নতুন উদ্যমে কান্নারা গলায় এসে দলা পাকাল। তারপর আবার মুখ চেপে ধরে কান্না শুরু হলো। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা চালাল সে। কান্না থামাতে গিয়ে অনেকটা সময় কেটে গেল। তারপর চোখে-মুখে ভালোভাবে পানির ঝাপটা দিয়ে রুমে এসে দেখল আদ্রিশ ওপাশে মুখ করে বিছানার একপাশে শুয়ে আছে। বিছানায় শুধু তার খাবারের প্লেটটা রাখা। আদ্রিশের প্লেটটা টেবিলে ঢেকে রাখা। বাটিতে হাত ধুয়ে শুয়ে পড়েছে সে। মেহের অবাক হলো। ক্ষুধা পেটে নিয়ে ঘুমাবে না কি লোকটা? সে একা খেলে তা কেমন দেখাবে? মেহের বিছানায় বসে দোটানায় পড়ল। স্নিগ্ধর কারণে মনের অবস্থা শোচনীয়, আদ্রিশের সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। এদিকে আদ্রিশের কান্ডর কথা শুনেও খুব অস্বস্তি লাগছে। স্নিগ্ধ তার জীবনে ভুল ছিল, আদ্রিশ তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। এখন তার কী করা উচিত, সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে থেকে নিজের প্লেটটা নিয়ে টেবিলে ঢেকে রেখে দিলো। তারপর ডিম লাইট জ্বালিয়ে চুপচাপ গিয়ে আদ্রিশের অপর পাশে শুয়ে পড়ল। আদ্রিশ চোখ বন্ধ করে সবকিছু টের পেয়েও কিছু বলল না। সে জানে আজ সারারাত মেহের ঘুমাবে না। হয়তো বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদবে। আজ কোনো স্বান্তনাও কাজে আসবে না। তার চেয়ে বরং নিজের মতো থাকুক একটা রাত। মনটা হালকা করুক। একদিন নিজের বোনকেও সে দেখেছে এমন কষ্ট পেতে। নিজের পাশে শুয়ে নিজেরই স্ত্রী অন্য এক পুরুষের জন্য কাঁদবে, ভেবেই আদ্রিশের বুকের কোথাও একটা পুড়তে শুরু করল। তবু নিজেকে এই বলে স্বান্তনা দিলো,“পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটা কেবলমাত্র আমারই ব্যক্তিগত সম্পদ। আমার মেহের। আজ না হোক কাল সে আমাকেই ভালোবাসবে।”
চলবে………………..?
(রহস্য ফাঁস করে দিলাম। পড়ে অবশ্যই রেসপন্স করবেন। হ্যাপি রিডিং।❤️)
পার্সোনাল গ্রুপ লিংক:
https://www.facebook.com/groups/935884643636506/?ref=share