#বেলা_শেষে
#প্রথম–পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি
গোধুলীলগ্নে গলির সামনে ফারাবীর মুখে সজোরে চড় বসিয়ে দেয় মেহুল। ছেলেটার সাহস হয় কি করে তার মতো বিবাহিত নারীকে প্রেম নিবেদন করার। বলা নেই, কওয়া নেই, আকস্মিক ভাবেই ছেলেটা তার পথ আটকেছে। শুধু তাই নয় কি সাহস তার! সে কি না বলে,
— “মেহুল, আমি আপনাকে ভালোবাসি”
মেহুল রাগে কাঁপছে। সে ক্ষীপ্র দৃষ্টি তাক করে আছে সে ফারাবীর দিকে। অদৃশ্য লহমান শিখা বের হচ্ছে তার দৃষ্টি থেকে। যেনো ছেলেটিকে দৃষ্টি দিয়েই পুড়িয়ে দিবে মেহুল। তীব্র রোষের সাথে বলে সে,
— “তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। সাহস হয় কি করে আমাকে আজেবাজে প্রস্তাব দেবার?”
— “স্পর্ধা তো অন্যায় করতে লাগে মেহুল, আমি তো অন্যায় করি নি। আমি কেবল আপনাকে ভালোবেসেছি। তাও নিস্পাপ, নিষ্কলুষিত ভালোবাসা। এতে কোনো অন্যায় নেই নিশ্চয়ই?”
ছেলেটির নির্লিপ্ত কথা আরো ক্ষিপ্র করে তোলে মেহুলকে। নিস্পাপ ভালোবাসা! একজন বিবাহিত নারীকে ভালোবাসা নিস্পাপ হয় কি আদৌ? অসম্ভব। মেহুল দ্বিগুন ক্ষিপ্ত স্বরে বলে,
— “কোনটাকে নিস্পাপ ভালোবাসা বলে ফারাবী? একজন বিবাহিত নারীকে ভালোবাসাটা নিস্পাপ? নিষ্কলুষিত?”
মেহুলের প্রশ্নে কিছুক্ষণ মাথা চুলকায় ফারাবী। তারপর নির্বিকার চিত্তে বলে,
— “আমার ভালোবাসা নিস্পাপ; তার যুক্তি হলো, পূর্বে যখন রাজিব ভাই বেঁচে ছিলেন আমি কখনোই আপনাকে এমন নজরে দেখি নি। রাজিব ভাই মারা গেছেন তিন বছর হয়ে গিয়েছে। অথচ আপনাকে আমি এই ছয় মাস যাবৎ ভালোবাসতে শুরু করেছি। তাই আমার ভালোবাসাকে অসম্মান করবেন না দয়া করে।”
ফারাবীর কন্ঠের দৃঢ়তা অবাক করলো মেহুলকে। ছেলেটা কতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাটা বলছে, যেনো দোষটা মেহুলের। মেহুল ভ্রু কুঞ্চিত করে, মুখ খিঁচিয়ে মনোযোগ দিয়ে কিছুক্ষণ ফারাবীর দিকে চাইলো। একই গলিতে থাকার দরুন ফারাবীকে সে ভালো করেই চিনে। রাজীব অর্থাৎ তার স্বামীর গলির আড্ডামহলের একজন ফারাবী। রাজীবের সাথে তার সম্পর্কটাও ছিলো খুব মিহি। রাজীবের মৃত্যুর পর ছেলেটা তাদের পরিবারকে নানা ভাবে সাহায্য করেছে। রাজীবের পরিবারে আয়ের উৎস কেবল রাজীব ই ছিলো। তার অকাল মৃত্যুতে পরিবারটি একেবারেই তাল হারিয়ে ফেলে। বৃদ্ধ শ্বশুরের পেনসনের টাকায় সংসার এবং ননদ রিমির পড়াশোনা যেনো হিমসিম খাচ্ছিলো। তখন মেহুল ফারাবীর কাছে সাহায্য চেয়েছিলো যেনো একটা ছোট খাটো চাকরীর ব্যাবস্থা করে। বি.এ পাশ বিধায় একটা এন.জি.ও তে চাকরির ব্যাবস্থা ফারাবী করে দেয়। ফারাবীর প্রতি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে মেহুল। কিন্তু তার এই অন্যায়, অযৌক্তিক আবদারখানা কোনো সময় ই মেনে নিবে না। মেহুল রুদ্ধশ্বাস ফেলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে ফারাবী শান্ত গলায় বলে,
— “উত্তর খানা বাকি রয়ে গেলো কিন্তু মেহুল। সমস্যা নেই, আমি অপেক্ষা করবো”
মেহুল উত্তর দিলো না। ক্রোধিত চিত্তে হনহন করে গলির পানে হাটা শুরু করলো। ফারাবী ব্যথিত নয়নে মেহুলের দিকে চেয়ে রইলো। তার ভালোবাসাটা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সে জানে এই ভালোবাসা সে দূর আকাশের রুপালি চাঁদটির ন্যায়। যাকে দূর থেকে দেখা যায় ঠিক ই, মুগ্ধ নয়নে তাকে নিয়ে হাজারো রঙ্গতুলির আঁকিবুঁকির রেখা টানা যায় কিন্তু সেই চাঁদকে ছোয়া যায় না। আলিঙ্গন তো দূরে থাকুক। মেহুলের প্রতি তার ভালোবাসাটা নোংরা নয়। ভালোবাসা তো নোংরা হয় না; সেটা নিস্কলুষ, দাগহীন, স্বচ্ছ। হ্যা মেহুল বিবাহিত, সে তার বন্ধুসুলভ পাঁড়ার ভাই এর বিধবা স্ত্রী। কিন্তু ভালোবাসায় তো কোনো জোর নেই। নেই কোনো জবরদস্তি। প্রেম এমন ই এক অনুভূতি যা ক্রর, কঠিন হৃদয়কেও মোমের ন্যায় গলিয়ে দেয়। মেহুলকে ঠিক কবে থেকে ভালোলাগা শুরু হয়েছে জানে না ফারাবী। তবে এটুকু জানে মেয়েটার স্বচ্ছ চোখজোড়ায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে তার খুব ভালো লাগে। ইচ্ছে হয় সেই জোড়া কেবল তাকে দেখবে। শুরু তাকেই চাইবে। ফারাবী আকাশের পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নীল আকাশটা কমলা রঙ্গে নিজেকে রাঙ্গিয়েছে। একটু পর ই তীব্র অন্ধকারে তা নিকষকৃষ্ণ হয়ে উঠবে। হাজারো তারা জোনাকীর ন্যায় জ্বলজ্বল করে উঠবে তখন। থালার ন্যায় রুপালী চাঁদটা উম্মোচিত হবে গগণে। প্রতিনিয়ত আকাশ বদলায়, প্রকৃতি বদলায় তবে মানুষের বদলাতে কি দোষ! ফারাবী জানে মেহুল একা, ফারাবী জানে মেহুলের ও কষ্ট হয়। কত বা বয়স মেয়েটির! পঁচিশ বা ছাব্বিশ বড় জোর। একাকীত্ব তাকেও গ্রাস করে প্রতিনিয়ত। নিঝুম নির্ঘুম রাতে সে যখন ছাঁদের রেলিং ঘেষে বাতাসে চুল ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, হয়তো তার ও ইচ্ছে হয় কেউ তাকে নিজের উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করুক, কেউ তার চুলে হাত ঘুরাক, কেউ জিজ্ঞেস করুক —- “তুমি ভালো আছো তো কাজললতা?_________
মেহুলের ক্লান্ত পা জোড়ার সিড়ি বেয়ে উঠতে কষ্ট হচ্ছে। হাতে থাকা পলিথিনের ব্যাগটার ভারে বান হাতটা ব্যাথা করছে ঈষৎ। আর ডান হাতটা জ্বলছে। ফারবীকে হয়তো একটু জোড়েই আঘাত করেছিলো সে। মেহুল হাতটা অবলোকন করে, লাল হয়ে গিয়েছে অনেকটা। আচ্ছা, ছেলেটি এতোটা নির্বিকার কিভাবে ছিলো! তার কি একটু ও ব্যাথা লাগে নি? একটুও কি বিচলিত হয় নি হৃদয়? ফারাবীর কথা ভাবতেই নিজেকে জোরে বকে দিলো মেহুল। অসম্ভব! সে কখনই একটা বেয়াদব ছেলের কথা চিন্তা করবে না। যে ছেলে তার বন্ধুর স্ত্রীকে নির্লজ্জের মতো বলে ভালোবাসে তার প্রতি আবার কি দরদ! মেহুল মাথা ঝাকিয়ে কলিংবেল বাজালো। দরজা খুললো রিমি। রিমির মুখে অসন্তোষের ছাপ। তিক্ততা মুখ চুয়ে পরছে যেনো। মেহুল যেদিকে লক্ষ্য না করেই ভেতরে চলে যায়। বাজারের পলিথিনটি খাবার টেবিলে রেখে চেয়ারে আয়েশ করে বসে সে। রিমির সূচালো দৃষ্টি এখনো মেহুলকেই দেখে যাচ্ছে। মেহুল পানির গ্লাসটা হাতে নিতে নিতে বললো,
— “কিছু বলবে রিমি?”
— “ভাবী, তুমি যা করছো তা বাবা-মা জানলে তাদের মুখ দেখাতে পারবে তো?”
মেহুল পানিটুকু খেতে যেয়েও খেলো না। ভ্রু কুচকে তাকালো রিমির দিকে। অবাক স্বরে বললো,
— “আমি কি করছি?”
— “ভাইয়া নেই বলে ভুলে যেও না যে তুমি একজন বিবাহিতা। ফারাবী ভাই এর সাথে তোমার মেলামেশাটা বেশ চোখে লাগছে। ভুলে যেও না আমাদের গলিটা কিন্তু খুব ছোট।”
রিমি এতোটুকু বলেই ভেতরে চলে গেলো। মেহুলের বুঝতে বাকি রইলো না ঘটনা কি! রিমি তাকে এবং ফারাবীকে একসাথে দেখেছে। তাই তাকে সর্তক করে গেলো। মেহুল সেখানেই বসে থাকে। ক্লান্ত শরীরটা যেনো অনড় হয়ে রয়েছে। ভালো লাগছে না কিছুই। কি দরকার ছিলো ফারাবীর আজ এমন কিছু করার! সব তো ঠিক ই ছিলো, মেহুল তো ভালোই ছিলো। বেঁচে ছিলো_________
তিনদিন পর,
জামান সাহেব অর্থাৎ মেহুলের শ্বশুর বিকালের হাটাহাটি শেষ করে বাড়ি ফিরলেন খুশি মনে। তার খুশি মুখটি দেখে তার স্ত্রী মুনমুন বেগম আপ্লুত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
— “কি গো! এতোটা খুশির কারণ কি?”
— “খুশির খবর আছে গিন্নী। বসো বলছি”
মুনমুন বেগম পাশে বসলেন। জামান সাহেব গদগদ কন্ঠে বললো,
— “আজ করিম ভাই এর সাথে দেখা হলো জানো তো! কথায় কথায় ফারাবীর কথা তুললেন। ছেলেটা বেশ ভালো চাকরী করছে। ভালো মাইনেও পায়। আমাদের রিমি ও কম বড় হয় নি। তাই উনি ফারাবীর জন্য রিমির কথা বলছিলো। আমি উনাদের আগামীকাল বিকেলে আসতে বলেছি”
— “বাহ! এতো খুব ভালো কথা, রাজীব যাবার পর ছেলেটা আমাদের খুব সাহায্য করেছে। ভালোই হলো। একটা ভালো ছেলের সাথে রিমির বিয়ে হলে আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারি। ছেলেটা তো হুট করেই চলে গেলো। এখন মেয়েটা খুশি থাকলেই হয়”
মুনমুল বেগমের আক্ষেপের কন্ঠ জামান সাহেবকেও আবেগপ্রবণ করে তুললো। ছেলেটা সত্যি অকালেই তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। কি স্বাদ করে ঘরে বউ তুলেছিলো। অথচ হুট করেই হৃদরোগে আক্রান্ত হলো ছেলেটা। চিকিৎসা করার ও সুযোগ দিলো না সে। তাদের কথা গুলো মেহুলের কান অবধি ঠিক পৌছালো। খুশির সংবাদ বটেই কিন্তু কেনো যেনো অস্বস্তিতে হৃদয় ভরে উঠলো। কারণটা সত্যি তার জানা নেই।
পরদিন,
বিকালের দিকে ফারাবী এবং তার পিতা মাতা আসলো মেহুলদের বাড়ি। জামান সাহেব এবং মুনমুন বেগমের আপ্পায়নের কমতি রইলো না। করিম সাহেব অর্থাৎ ফারাবীর বাবা উৎফুল্ল স্বরে বললেন,
— “ভাই এতো আয়োজনের কি দরকার ছিলো? আর আমাদের মেয়েটা কোথায়? রিমি মা কে ডাকুন”
মুনমুন বেগম হাসি মুখে বললেন,
— “মেহুল নিয়ে আসছে ভাই। আপনারা সিঙ্গারা নিন।”
ফারাবী শক্ত হয়ে বসে রয়েছে। তার মুখশ্রীতে কোনো ভাবলেশ মাত্র নেই। হাজার বার মানা করবার পর ও আজ জোর করে তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। মা মাথার কসম না দিলে সে কখনোই আসতো না। এর মাঝেই মেহুল রিমিকে দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। হালকা বাদামী সালোয়ার কামিসে চমৎকার লাগছে মেহুলকে। মাথায় ঘোমটা দিয়ে রয়েছে সে। কোনো সাজগোজের বালাই নেই। শ্যাম মুখখানায় মলিনতা এটে রয়েছে। ফারাবী মুগ্ধ নয়নে মেহুলকে দেখছে। তার হৃদয়টা বিচলিত হয়ে আছে। মেহুলের একটি বার ও খারাপ লাগছে না? সে তো জানে ফারাবী রিমি নয় তাকে ভালোবাসে! কথাগুলো ভাবতেই হৃদয়ের যন্ত্রণাটা তীক্ষ্ণ রুপ নিলো। ফারাবী চোখ নামিয়ে নিলো। হাট মুষ্টিবদ্ধ করে বসে রইলো। এদিকে, বিয়ের কথা এগুতে লাগলো। ফারাবীর মা শেফালী বেগম রিমির পাশে গিয়ে বসলেন। তার কপালে চুমু একে বললেন,
— “মেয়ে আমাদের বরাবর ই পছন্দ, আমি তো আজ ই রিমিকে আংটি পড়াতে চাই ভাই। কি মত আপনার?”
জামান সাহেবের মুখে প্রসন্নতার হাসি। এদিকে ফারাবী আড়চোখে চাইলো মেহুলের পানে। মেয়েটির মুখে বিস্তৃত হাসিটি দেখে তার রাগ হলো। নিজেকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারলো না সে। শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
— “আমার কিছু কথা ছিলো মা……..
চলবে