#চারুলতা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৫
একটু সামনে যেতেই গা টা শিউরে উঠল। চারপাশে কাটা মাথার বিস্তরণ। আশ্চর্যজনক ভাবে প্রতিটি মাথার সাথে শরীর না থাকলেও মাথাগুলো জ্যান্ত। মৃধা এবার একটু বিচলিত হলো। আমার দিকে তাকিয়ে বলল
– পেছনের রাস্তাটাও সংকীর্ণ হয়ে গেছে আর সামনে জ্যান্ত কাটা মাথা। এ পরিস্থিতিতে সামনে কী করে এগুবে? ভয়ে তো শরীর কাঁপছে।
আমিও এবার ভয় পেয়ে গেলাম। ভয়টা মোটেও দমাতে পারছি না। শরীর কাঁপতে লাগল। কাঁপুনিটা ক্রমেই বেড়ে চলছে আমার। তবুও সাহস করে বললাম
– এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে এভাবেই মারা যাব। এর চেয়ে বরং লড়াই করে মরি। সামনের দিকে এগুনো ছাড়া তো কোনো উপায় দেখছি না। সামনের দিকেই বরং এগিয়ে চলো।
মৃধা আমার হাতটা শক্ত করে ধরল। আমিও মৃধার হাতটা শক্ত করে ধরলাম। মৃধা না থাকলে হয়তো এ পথ পাড়ি দেওয়া আরও কষ্ট হত। দুজন দুজনের হাতটা ধরে সামনের দিকে এগুতে লাগলাম। সামনে পা বাড়াতেই কাটা মাথাগুলো কামড়ে ধরল পায়ে। বিভৎস পচা রক্তের গন্ধও নাকে আসলো। বমিও করতে পারছি না। পেটে কিছু থাকলে তো বমি করতে পারব। পেট খালি তাই বমিও করতে পারছি না। পা দুটো দুজনেই টেনে টেনে কাটা মাথার কামড় ছুটাচ্ছিলাম আর সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম। গন্ধে পেট ফুলে যাচ্ছে দুজনেরেই। আর পায়ের যন্ত্রণার বর্ণণা দেওয়া দুস্কর। শরীর হিম শীতল হয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা বাতাসে। চারপাশে কোথাও কোনো ফাঁকা জায়গা নেই,নেই কোনো ছিদ্র তবুও কোথায় থেকে এত হিম শীতল বাতাস আর গন্ধ ধেয়ে আসছে বুঝা যাচ্ছে না। শরীরের রক্ত চলাচল যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একদিকে কাটা মাথার কামড় অন্যদিকে বাতাস, সব মিলিয়ে দম বন্ধকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম। তবুও আশাহত হলাম না। দুজনেই এগুতে লাগলাম। কখনও মাথাগুলো হাত দিয়ে ধরে টেনে পা থেকে ছুটিয়ে সামনের দিকে যাচ্ছি আবার কখনও এক পা দিয়ে অন্য পায়ে লাথি দিয়ে কাটা মাথা গুলো ছুটাচ্ছি। শ্বাস প্রশ্বাস আর চলছে না। প্রায় পনেরো মিনিট এমন দম বন্ধকর পরিস্থিতি পার করে একটা খালি জায়গা পেলাম। জায়গাটা এবার বেশ প্রশস্ত মনে হলো। হিম শীতল ঠান্ডা ভাবটাও এ জায়গায় আসার পর চলে গেল। কিছুটা স্বস্তি যেন মিলল।
জায়গাটায় বসে দুজনেই দম নিতে লাগলাম। পা দুটো ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। আর ব্যথায় টনটন করছে। পা দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল অভিরাম। মৃধা পাশে ফুটে উঠা ধূর্বা ঘাস চিবিয়ে আমার পায়ে লাগিয়ে দিল। পায়ের ক্ষতে ঘাসের রসটা লাগতেই জ্বলুনী ভাব শুরু হলো। মৃধা আমার পায়ে ঘাসের রস দেওয়ার পর নিজের পায়েও লাগিয়ে নিল। রসটা দেওয়ার পর কিছুক্ষণ জ্বললেও পরে আস্তে আস্তে জ্বলা কমে রক্ত বন্ধ হলো। আগের মতো রক্তক্ষরণ এখন হচ্ছে না আর হলেও খুব অল্প পরিমাণে। পায়ের অবস্থাটা যখন একটু উন্নতির দিকে তখনই দুজনের মাথায় আবার এ প্রশ্ন জাগল আমরা কোথায় এসেছি আর কোনদিকে যাব। মৃধা একটু আশপাশ তাকিয়ে বলল
– সুরঙ্গ থেকে হয়তো বের হয়ে গেছি নাহয় এত প্রশস্ত জায়গায় কী করে আসলাম। সুরঙ্গতে আছি নাকি সেখান থেকে বের হয়েছি বুঝতে পারছি না। সব যেন গোলক ধাঁধা মনে হচ্ছে।
আমি চুপ হয়ে বসেই আছি। ওষ্ঠযুগল নাড়িয়ে কোনো কথা আমার মুখ থেকে বের হচ্ছে না। সাড়হীন এ শরীরটা বেশ তিক্ততায় ভরে গেছে এখন। মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটছে ক্রমেই। মামার অত্যচার থেকে বের হতে গিয়ে নতুন অত্যাচারে পতিত হলাম। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আমার মাঝে নেই। এটা যদি দুঃস্বপ্ন হত অনেক ভালোই হত। তবে বিষয়টা দুঃস্বপ্ন না বিষয়টা সম্পূর্ণ বাস্তব। আর বাস্তবতা সামলাতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। নীরবতা কাটছে না আমার। হয়তো পরিস্থিতিটার আমার নীরবতা সহ্যই হলো না। তাই আচমকা শূন্য থেকে ছোট বাচ্চা মাটিতে আচড়ে পড়ে থেতলে গেল আমাদের দুজনের সামনে। উপুর হয়ে বাচ্চাটা পড়েছে যার ফলে বাচ্চার নাকটা থেতলে গিয়েছে প্রথমে। খাড়া নাকটা যেন বোঁচা হয়ে গেল। বাকি বর্ণণা দিতে গেলেও শরীর কাঁপছে। এত নির্মমতার সাক্ষী কেন হচ্ছি জানি না। আমি জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম।
মৃধা আমার হাতটা ধরে আমাকে বসা থেকে টেনে তুলে দৌড় লাগাল সামনের দিকে। আমিও দৌড়াচ্ছি। চারপাশে কিছুই দেখছি না শুধু দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। দৌড়ের এক পর্যায়ে দুজনেই শক্ত কিছুতে ধাক্কা খেয়ে থুবরে পড়লাম। তবে সরাসরি কোনো কুয়োর মধ্যে পড়ে গেলাম দুজনেই। কুয়ায় হালকা রক্তে পূর্ণ। আর মাটি থেকে বেশ গভীর। আমাদের হাঁটু পর্যন্ত কুয়োটার রক্ত পরিপূর্ণ। রক্তের পচা গন্ধে গা গুলিয়ে যাচ্ছে। এ কুয়ো থেকে কী করে উপরে উঠব সে চিন্তা পিছু ছাড়ছে না৷ হয়তো এ কুয়োতেই পচে মরতে হবে।
এসব চিন্তা করতে করতে নিস্তব হয়ে গেছি আমি। আমার নিস্তবতা আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এর মধ্যে পায়ে হেঁচকা টান অনুভব করলাম। টানটা আমাকে নীচের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি পা টা উপরের দিকে যতই তুলার চেষ্টা করছিলাম ততই কিছু যেন আমাকে পেঁচিয়ে ধরে নীচের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি ভয়ে মৃধার হাতটা চেপে ধরে বললাম
– কে জানি আমার পা ধরে নীচের দিকে টানছে আমি তো উপরের দিকে পা তুলতে পারছি না। এ টান তো সামলানো যাচ্ছে না। আমি কি তাহলে এ পচা রক্তে তলিয়ে পড়ব।
মৃধা আমার কথা শুনে বিমর্ষ গলায় একই জবাব দিয়ে বলল
– চারুলতা একই টান আমিও অনুভব করছি । আমাদের হয়তো জীবন এখানেই শেষ। একবার তলিয়ে পড়লে বাঁচতে পারব না। আর এ টান সামলানোও সম্ভব না। অপরদিকে কুয়ো যতটা গভীর উপরে উঠাও সম্ভব না। আমি অভিশপ্ত হওয়ায় সাপ রূপ ধারণ করতে পারব না। নাহয় সাপ রূপ নিয়ে উপরে উঠতে পারতাম।
কথার শেষ হতে না হতেই কুয়োর গা ঘেষে কিছু অদ্ভুত প্রাণী বেয়ে বেড়াতে লাগল। কিছুক্ষণ আগেও এ প্রাণীগুলো ছিল না হুট করে কোথায় থেকে উদয় হলো বোধগম্য হচ্ছে না। প্রাণীটার একটা চোখ। ঠোঁট গুলো মানুষের মতো আর চোখ গুলো গোলাকৃতি। আকৃতি ছোট কচ্চপের মতো। চারপাশে কয়েকটা হাত। হাতগুলো অবিকল মানুষের মতো তবে একদম ছোট ছোট। হাতগুলো একবার প্রসারিত করছে আরেকবার সংকোচিত করছে। কালো কুচকুচে দেখতে। সব মিলিয়ে অবস্থা খারাপ দিকে মোড় নিল।
পায়ের নীচের দিকে টান বাড়তে লাগল আর এদিকে প্রাণী গুলোর সংখ্যাও বাড়তে লাগল। মৃধা আর আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম আমাদের হাতে সময় নেই। হয়তো তলিয়ে পড়ব এ রক্তের স্রোতে আর মরে পচে যাব। এটাই হয়তো গন্তব্য ছিল। গন্তব্য বললে ভুল হবে নিষ্ঠুর গন্তব্য।
আচমকা টানটা প্রখর হলো আর দুজনেই তলিয়ে পড়লাম পঁচা রক্তের স্রোতে।