কাছে_দূরে ??পর্ব___৬৯

0
1925

#কাছে_দূরে ??
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৬৯

ছ’মাস পর। সময় সকাল ১০টা।

সানিয়া গত কয়েকমাস যাবত বেশ স্বাভাবিক হয়েছে। বাবার মৃত্যুশোক কাটিয়ে নতুন অতিথির আগমনের প্রতিক্ষার প্রহর গুনছে। নেহাল আহমেদ ভিলায় থেকেই অফিস সামলাচ্ছে। মেয়েরা প্রথমবার গর্ভবতী হলে নাকি মায়ের কাছেই বেশি থাকে। তাই সানিয়ারও আবদার, বাবু আসার পুরোটা সময় সে তার মায়ের সাথে কাটাতে চায়। সানিয়ার এমন আবদারে নেহালও না করেনি। সানিয়া যেভাবে খুশি হয় সেভাবেই সে সবটা করতে রাজি। নতুন অতিথি সবার মাঝে আসার আর কেবল মাস তিনেক বাকি। সবার মাঝেই তার আসার আগমনে অদ্ভুত ভালালাগার খুশি।

ড্রয়িং রুমে আড্ডা বসেছে মেয়েদের। এরই মাঝে বার কয়েক কলিং বেল চাপল কেউ। হীর মুখ উঁচিয়ে একবার দেখল দরজার দিকে। এমন সময় কে আসবে? সাবাব,নেহাল দু’জনেই বাইরে। মাত্র দশ মিনিট হলো দু’জনে বেরিয়েছে। কোনো জিনিস ফেলে গেলো নাকি?

—-‘ আমি দেখছি।’

এই বলে শ’খানিক প্রশ্ন মনে চেপে রেখে দরজা খুলতে চলে গেলো হীর। দরজার কাছাকাছি আসতে আসতে কোত্থেকে দৌড়ে এসে হীরের আগেই দরজা খুলে দিলো রুবি। রুবি যদিও প্রথমে হীরকে খেয়াল করেনি। দরজা খুলতে খুলতে মনে হলো হীর তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই আগন্তুকের মুখ ভেসে উঠল। দরজার ওপাশে আদ্রিক আর তার বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের দেখতেই হীর অমায়িক হাসল। রুবি তাদের অবশ্য চিনেনা। তবে হীরকে হাসতে দেখে ভাবল হয়তো পরিচিতই হবে। তাই সেও হীরের ন্যায় হেসে তাদের ভেতরে আসার পথ দিলো। দরজার এপাশে হীরকে দেখে স্বস্তি ময় হাসল আদ্রিক। মা-বাবার মুখ পানে স্বস্তি মূলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করার মাঝেই হীরের উৎসাহ ঘেরা কন্ঠটি ভেসে উঠলো,

—-‘ আদ্রিক বাবু যে। উনার নিশ্চয়ই আঙ্কেল আন্টি?’

আদ্রিক হীরের দিকে তাকিয়ে লজ্জা মিশ্রিত হেসে বলল,

—-‘ জ্বী আপু।’

—-‘ আরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতর এসো। আঙ্কেল-আন্টি প্লিজ ভেতরে আসুন?’

হীরের হাস্যজ্বল মুখে এবং অমায়িক ব্যবহারে সন্তুষ্ট আদ্রিকের বাবা-মা। তারাও ঠোঁট টেনে হেসে ভেতরে প্রবেশ করলেন।

দরজার কাছে হীর কাদের সাথে কথা বলছে সেটা জানারই তুমুল আগ্রহ জাগল সবার। মেয়েদের আড্ডায় যোগ হয়েছে অনেকই। তরী,এশা,মিলি আর সানিয়ার দুটো মেয়ে ফ্রেন্ড। সবাই এক এক করে উঠে এলো। রোজ আগ্রহ নিয়ে হীরের কাছে যেতেই যেন থমকে গেলো। আদ্রিককে দেখেই তার বুকের ভেতরটা শীতল হয়ে উঠল। টানা ছ’টা মাস বাদে আদ্রিককে দেখছে সে। আশেপাশে কে আছে না দেখেই সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল আদ্রিক কে। সবার মাঝে রোজের আকস্মিক এমন কান্ডে উপস্থিত সবাই মোটামুটি রকমের নির্বাক শ্রোতা হয়ে গেলো। হীর চোখ জোড়া বড়বড় করে কেবল আদ্রিকের বাবা-মায়ের মুখের রিয়াকশন দেখছে। শত হোক, গুরুজনদের সামনে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এভাবে জড়িয়ে থাকতে পারেনা! কারন এটা বাঙালির ন্যাচার না। তারা এক কথাকে শত কথাতে রূপ দিয়ে দিবে। আদ্রিকের মনোভাবও আপাতত এমন। তার বাবা-মায়ের সামনে রোজ যে তাকে হঠাৎ টাইট হাগ করে বসবে সেটা তার ধারনায়ও ছিলো না। তবে রোজের ন্যাচারে এসব খুবই স্বাভাবিক।

হীর গলা খাঁকারি দিয়ে রোজের উদ্দেশ্যে মিনমিনিয়ে বলতে লাগল,

—-‘ ব-বোন! করছিস কি? পাশে দেখ আদ্রিকের বাবা-মা আছেন!’

হীরের কথা রোজের মস্তিষ্ক মোটামুটি ভাবে স্পর্শ করতে পারল। সে হঠাৎ নিজের কর্মের উপর লজ্জিত ভাব পোষন করে আদ্রিককে ছেড়ে দ্রুত হীরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। হীর জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে কিছু একটা বলার মাঝেই রান্নাঘর থেকে নাজমা বেগমের গলা পাওয়া গেলো,

—-‘ কে এসেছে রে রুবি?’

নাজমা বেগমের হাক পড়তেই রুবি সেদিকে ছুটে গেলো। যেতে যেতে বলল,

—-‘ মেহমান আইছে খালাম্মা।’

হীর রান্নাঘরের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অনুমান করে নিলো বড়মা তার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছে। এখন মেহমানদের নিয়ে বসানোর ছোট্ট ফর্মালিটিটা তাকেই পূরন করতে হবে।

—-‘ আপনার দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন আন্টি। আসুন না। ভেতরে আসুন।’

এই বলে হীর রোজের হাত ধরে তাদের আসার পথ দেখিয়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এসে বসালো। রোজ নিজের কান্ডে এখনও বেশ লজ্জিত। তাই বারবার আঁড়চোখে দেখছে আদ্রিককে। আদ্রিক অবশ্য বেশ মজা পেয়েছে। সে বারেবারে মিটমিট করে হাসছে। আদ্রিককে হাসতে দেখে রোজ ভ্রু কুঁচকে নিঃশব্দেই ঝাড়ি দিলো আদ্রিককে। যার দরুন আদ্রিকের মুখের হাসি উধাও। আদ্রিকের বাবা-মা বসতে বসতে সানিয়াকে খেয়াল করলেন। আদ্রিকের মা হীরের দিকে একবার তাকিয়ে পূনরায় সানিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

—-‘ ক’মাস চলে?’

সানিয়া স্মিত হেসে জবাব দিলো,

—-‘ জি,ছ’মাস।’

—-‘ আচ্ছা আচ্ছা।’

এই বলে চুপ হয়ে গেলেন আদ্রিকের মা। কিছুক্ষন চুপ থেকে পূনরায় বললেন,

—-‘ ক’মা চলে গো?’

ভদ্রমহিলার ফের এমন প্রশ্নতে সবাই একটু অবাক হলো। সানিয়া আঁড়চোখে হীরের দিকে তাকালো। হীর জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল,

—-‘ আন্টি ছ’মাস চলে। বলল না?’

—-‘ আচ্ছা আচ্ছা।’

হীরে ঠোঁটের হাসিটাকে আরেকটু প্রসারিত করার চেষ্টা করল। ভদ্রমহিলা আবারও চুপ হয়ে গেলেন। খানিক সময় পেরোতে তিনি আবারও হা করলেন কিছু বলবেন বলে। যা বুঝতে পেরে হীর তার কথা আঁটকে দিয়ে বলল,

—-‘ আন্টি- আপনারা কিছু নিবেন চা বা কফি?’

আদ্রিকের বাবা ভদ্রলোক বউয়ের এক কথা বারবার বলার যন্ত্রণায় বেশ অস্বস্তিবোধ করছেন। বারবার ছেলের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিচ্ছেন। আদ্রিকও আছে বেশ জ্বালায়। সবার মনোভাব পড়ে হীর মুখে হাসির রেখা টেনে বলল,

—-‘ আমি আপনাদের জন্য একটু চা-নাশতার ব্যবস্থা করছি। আর বড়মা কে ডেকে দিচ্ছি।’

ভদ্রমহিলা হাসি মুখে ঘাড় কাত করলেন। হীরও তার সহিত মাথা নাড়ল। রান্নাঘরের দিকে পা রাখতেই ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করল,

—-‘ আচ্ছা, বড় মা-টা কে?’

উনার প্রশ্নে হীর যেতে নিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল। সানিয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে কিছু একটা ইশারা করতেই সানিয়া মৃদু হেসে জবাব দিলো,

—-‘ আমার মা।’

—-‘ আচ্ছা আচ্ছা।’

হীর ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে ভদ্রমহিলার পরের প্রশ্নের অপেক্ষা করল। কিন্তু তিনি আর কিছুই বললেন না। হীর মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল এই ভেবে যে তিনি হয়তো আবার একই প্রশ্ন করবেন না। যখন নিশ্চিত হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো ভদ্রমহিলা ফের একই প্রশ্ন করল,

—-‘ আচ্ছা, বড় মা-টা কে?’

রোজ এবার আর নিজের হাসিটাকে দমাতে পারলো না। ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,

—-‘ আন্টি আপনার কি এক কথা বারবার বলার রোগ আছে?’

রোজের এমন প্রশ্নে ভদ্রমহিলার কপাল চওড়া হয়ে গেলো। তিনি বড়বড় চোখ করে রোজের দিকে তাকাতেই কপাল চাপড়ালো হীর। এই মেয়ের মুখে কোনো কথাই যে আঁটকায় না। আদ্রিক আঁতকে উঠে মুখে হাত চাপলো। আদ্রিকের বাবা মনে হয় মজা পেলেন রোজের এমন প্রশ্নে। তিনি বউয়ের দৃষ্টির অগোচরে রোজকে থ্যাংক্যু বলে মুখ টিপে হাসলেন।

হীর চলে গেলো রান্নাঘরে। নাজমা বেগম হাতের কাজ সারছেন দ্রুত গতিতে। মেহমান এসেছে শুনেও সেখানে একবারও যেতে পারলেন না সেটা যেন অসম্মানের লিস্টে পড়ে। হীর এসে তাকে দ্রুত ভঙ্গিতে কাজ করতে দেখে বলল,

—-‘ এটা আমাকে দাও,আমি করে দিচ্ছি। তুমি বরং ওদিকে যাও। আদ্রিকের বাবা-মা এসেছেন।’

রান্নাঘরে হীরকে দেখে নাজমা বেগম চোখ কপালে তুলে বললেন,

—-‘ ওমা তুমি আবার এখানে আসতে গেলে কেন মা? আমি তো এক্ষনি আসতাম।’

হীর চুলোয় তরকারি দেখে আগ্রহী কন্ঠে বলল,

—-‘ বড় মা এটা রুই মাছের মুড়িঘণ্ট না? তোমায় কতদিন বললাম আমাকেও একটু শেখাও,শেখাও! তুমি শেখাচ্ছোই না।’

হীরের বাচ্চাসুলভ আচরনে হাসলেন নাজমা বেগম। চুলোর আচটা একদম কমিয়ে দিয়ে হাতের কাজ সম্পূর্ণ করে বললেন,

—-‘ সময় হলে সব শিখিয়ে দিবো। এবার চলো মেহমানের কাছে যাই।’

হীর মুখ বাঁকিয়ে বলে,

—-‘ কবে যে সময় হবে!’

—-‘ হবে হবে। এবার চলো।’

নাজমা বেগম ড্রয়িং রুমে আসতেই আদ্রিক দাঁড়িয়ে গিয়ে সালাম করল তাকে। নাজমা বেগম অমায়িক হেসে আদ্রিককে বসতে বলে নিজেও বসলেন। আদ্রিক ছ’মাস আগে মালয়েশিয়া ফিরে যাওয়ার আগে একবার এসেছিলো এ বাড়িতে। রোজের সাথে দেখা করে গিয়ে বাকি সবার সাথে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলো। আজ হঠাৎ ছ’মাস বাদে পড়াশোনা বন্ধ রেখে হঠাৎ তার চলে আসার কারনটা সবারই অজানা। রোজ আর যায়নি মালয়েশিয়া। হীর বলেছিলো পড়াশোনা শেষ করে আসতে। কিন্তু রোজ আর যেতে চায়নি। সে জানিয়েছে পরিবার বলতে এখন শুধু তার বোন আর এই বাড়ির মানুষ গুলো। সে মালয়েশিয়া ফিরে গেলে তার কালো অতীত তাকে সর্বদা তাড়া করে বেড়াবে৷ তাই সে আর মালয়েশিয়া যেতে চায়না। তার বাকি পড়াশোনা সে এখানে থেকেই করবে। তাই সাবাব তাকে হীরের ভার্সিটিতেই ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। সেখানেই শুরু হয়েছে তার নতুন জীবন।

—-‘ আপনিই তাহলে রোজের বড় মা?’

আদ্রিকের বাবা প্রশ্ন করলেন। নাজমা বেগম হাসিমুখে জবাব দিলেন,

—-‘হ্যাঁ ভাইজান। আমি রোজ আর হীরের বড় মা।’

ভদ্রলোক স্মিত হেসে বললেন,

—-‘ আমি আদ্রিকের বাবা। আর এই হলো আদ্রিকের মা।’

—-‘ আচ্ছা। তা আপা কেমন আছেন আপনি?’

নাজমা বেগমের প্রশ্নে ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,

—-‘ আমি আদ্রিকের মা।’

ভদ্রমহিলার জবাবে নাজমা বেগম অকস্মাৎ জবাব খুঁজে পেলেন না। আদ্রিক এবং তার বাবা বাদে বাকিরা সব মুখ টিপে হাসতে লাগল। নাজমা বেগম জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললেন,

—-‘ জি আপা।’

আদ্রিকের বাবা বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

—-‘ আপা, আপনার কাছে আমরা একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমরা আশাবাদী আপনি আমাদের এই প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিবেন না। আমরা খুবই সাধারণ পরিবারের। আপনাদের মতো এতো উচ্চ বিলাস বহুল অবস্থা আমাদের কোনো কালেই ছিলো না আর হওয়াও সম্ভব না। তবুও অনেক স্বপ্ন ছেলেকে ভালো একটা লাইনে পড়িয়ে কিছু স্বপ্ন পূরন করা।’

নাজমা বেগম ঠোঁট টেনে হেসে জবাব দিলেন,

—-‘ এমা ছি ছি ভাইজান এসব আপনি কি বলছেন। আপনি বলুন কি প্রস্তাব?’

ভদ্রলোক কাচুমাচু করতে করতে বললেন,

—-‘ আসলে আপা,আমরা চাই পড়াশোনা শেষ করে আমাদের একমাত্র ছেলের জন্য রোজকে বউ করে নিতে। জানি আমাদের আবদারটা নিতান্তই তুচ্ছ আপনাদের কাছে। তবুও ছেলের মুখের দিকে চেয়ে একটা দুঃসাহসিক কথা পেড়ে বসলাম।’

—-‘ ভাইজান আপনি এভাবে কেন বলছেন? ধ্বনি-গরিব সবটাই তো আল্লাহর নেয়ামত বলুন? এখানে আমাদের কি হাত থাকে? আর বিয়ের কথা বললে বলব, ছেলে-মেয়েরা যদি নিজেদের ইচ্ছেয় জীবনসঙ্গীনী বেছে নেয় সেখানে আমাদের হস্তক্ষেপ করা বোকামো। রোজ আদ্রিক দু’জনেই খুব ছোট। আর ওদের পড়াশোনা তো সবটাই বাকি। আগে পড়াশোনা শেষ করুক তারপর আমরা একত্রিত হয়ে আমাদের মেয়ের সাথে আপনাদের ছেলের বিয়ে দিবো। কথা দিলাম ভাইজান।’

ভদ্রলোক আনন্দে ফেটে পড়ে বললেন,

—-‘ অনেক অনেক ধন্যবাদ আপা। ছেলে তো আমাদের পাগল করে দিয়েছে প্রায়…..

_____________

সারাদিনের টগবগে রোদ মিইয়ে পড়ে বিকেল থাকতেই। তারপর শুরু হয় ভ্যাপসা গরম। যাতে শরীর মন দুটোই বেশ খিটখিটে হয়ে থাকে। বেশ কয়েক দিন যাবত হীরের মনটা বেশ খারাপ হয়ে আছে। ভ্যাপসা গরমে তা যেন আরও কঠিন আকার নিচ্ছে। তার মন বলে সাবাব ইদানীং কাল বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাকে সকালের গুড মর্নিং আর রাতে গুড নাইট বলা ছাড়া বাড়তি কোনো কথা বলারই সময় পায়না। পাশাপাশি শুয়ে থেকেও কিসব আকাশ-পাতাল হিসেব করতে করতে ঘুমোয় সে। হীর কথা শুরু করতে চাইলেও সাবাব হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলে। ইশারায় বোঝায় তার হিসেবে গোলমাল পেকে যাচ্ছে তার জন্য। হীর অভিমানে বালিশ ভিজিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায়। সাবাব সেকথা আন্দাজও করতে পারেনা। সে তার হিসেব নিয়েই থাকে। সাবাবের এহেম আচরনে হীরের অভিমানের পাল্লা দিনকে দিন বাড়তেই থাকে। হীর গতকাল থেকে সাবাবের সাথে কথা বলছে না। অথচ সাবাব জানেই না। আজ সকালে নাস্তার টেবিলে বসে হীরের শুঁকনো মুখখানা দেখে নাজমা বেগম কিছু একটা আন্দাজ করেছেন। হীরকে প্রশ্ন করায় হীর মলিন মুখে জবাব দিলো,

—-‘ সব ঠিকাছে বড় মা।’

নাজমা বেগম হীরের জবাব পেয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন না। তবে মনেমনে কিছু একটা আন্দাজ করে নিলেন। হীরের মন খারাপের সাথে তিনি আরও একটা পরিবর্তন লক্ষ করলেন। তবে সেটাও মনেমনেই রাখলেন। সময় বুঝে ছেলের কান টেনে জিজ্ঞেস করতে হবে!

রাত ৯টা বেজে ১০ মিনিট। সাবাব ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে ঢুকল। হাতের ব্যাগটা বিছানায় রেখে ইউনিফর্ম খুলতে খুলতে কথা চালাতে লাগল। হীর ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যান্য দিন এমন সময় হীর সব কাজ ফেলে সাবাবের কাছে এসে উপস্থিত হতো। তার ইউনিফর্ম খুলতো সাহায্য করত, এক গ্লাস ঠান্ডা পানি সাবাবের জন্য রেডি রাখত, অতঃপর ফ্রেশ হওয়ার জন্য আলমারি থেকে জামাকাপড় বের করে দিতো! তবে গত দু-দিনে এসবের কিছুই করলো না। কিন্তু তবুও সাবাবের মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই। হীর যেতার আশেপাশে কোথাও থাকেনা সে ব্যাপারে সে পুরোপুরি উদাসীন।

হীরের বুক ফেটে কান্না পেলো। একটা মানুষ আকস্মিক এতটা পরিবর্তন কি করে হতে পারে? হীরের চোখ টলমল করে দু-ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। যা দ্রুত মুছে নিয়ে অন্ধকার আকাশে মুখ তুলে তাকালো। সে কাঁদতে চায়না তবুও যেন বারবার ঠোঁট কেঁপে কান্না পাচ্ছে।

—-‘ মা? (চেঁচিয়ে) মা? হীরকে একটু রুমে পাঠাও তো?’

সাবাব চেঁচিয়ে হীরকে রুমে পাঠানোর কথা নাজমা বেগম অব্দি পৌঁছোতেই তার জবাব এলো,

—-‘ ভালো করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখ, হীরপরি রুমেই আছে।’

মায়ের জবাবে সাবাব সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাতের বড় গিফটের প্যাকেটটা আর হসপিটাল থেকে নিয়ে আসা তার রিপোর্ট টা হীরের অগোচরেই লুকিয়ে ফেলল। অতঃপর আশেপাশে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে নিলো হীর কোথায় আছে। ব্যলকনির দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখল মনমরা হয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে হীর। নিশ্চয়ই অভিমানে মুখভার করে আছে।
সাবাব মনেমনে হেসে পেছন থেকে গিয়ে হীরের কোমড় জড়িয়ে দাঁড়াল। হীর চমকে উঠতেই সাবাব তাকে আরেকটু কাঁপিয়ে তুলে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো। হীর কেঁপে উঠলো। ভেতরে তোলপাড় শুরু হতেই তার অভিমানের ঢিবি গলে পড়তে লাগল। কিন্তু সে তো এতো সহজে সাবাবকে ক্ষমা করবে না। তাই সাবাবকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে রুমের ভেতরে চলো যেতে লাগল। সাবাব আচমকা হীরের হাতে ধাক্কা খেয়ে নিজেকে সামলাতে পারলো না। চমকে উঠে মুখটা হা করে নিলো। হীরকে চলে যেতে দেখে ফের তাকে টেনে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। চোখ দুটো গোলগোল পাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবুক কন্ঠে বলল,

—-‘ মাই গুডনেস! রাগীবতী এতো রেগে আছে?’

হীর চোখের মাঝে সূর্য এঁটে সাবাবের দিকে তাকালো। সাবাব ভয় পেয়ে ছেড়ে দিলো হীরকে। মাথা চুলকে আমতাআমতা করতে করতে বলল,

—-‘ কয়েকটা দিন সত্যিই খুব বিজি ছিলাম হীরপাখি। ট্রাস্ট মি-

—-‘ আমি তোমার থেকে কোনো সাফাই চেয়েছি?’

—-‘ না! মানে! সা-সাফাই তো চাও নি-

—-‘ তাহলে? আমার কাছে কেন এসেছো? আমি তোমার সাথে কোনো কথা বলতে চাইনা। বুঝেছো?’

—-‘ রেগে আছো-

—-‘ রাগ? আর আমি? কেন রাগবো? কিসের জন্য রাগবো? রাগ করার মতো কিছু করেছো তুমি?’

সাবাব মুখে হাত চেপে ইনোসেন্ট মুখ করে তাকালো। হীরপাখি হেব্বি রেগেছে। এখন যদি সে ভালো কথাও বলতে চায় তবে সে নির্ঘাত তার খুন করে ফেলবে। এর চেয়ে বেটার সে তার জন্য আনা সারপ্রাইজ টা তাকে দিয়ে দিক। সাবাব দ্রুত ভেতরে গিয়ে ডক্টরের ফাইল থেকে রিপোর্ট টা বের করে হীরের সামনে এসে দাঁড়ালো। হীর কপাল কুঁচকে সাবাবের কান্ড দেখছে। সাবাব চোখেমুখে উত্তেজনার হাসি ফুটিয়ে তুলে রিপোর্ট টা খুলে হীরের সামনে ধরলো। হীরটা রিপোর্টটার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে সাবাবের পানে চেয়ে বলল,

—-‘ কি এটা?’

সাবাব চমৎকার হেসে বলল,

—-‘ নিজেই দেখো।’

হীর উৎসুক নয়নে রিপোর্ট টা হাতে তুলে নিয়ে পড়তে লাগল। খানিক বাদেই তার মুখের রং পাল্টে। চোখ জোড়া টলমলিয়ে উঠল অজানা সুখে। বুকের ভেতর শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। অদ্ভুত উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপতে লাগলো। সাবাবের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,

—-‘ র-রিপোর্ট পরজিটিভ!’

সাবাব হেসে উঠে বলল,

—-‘ ইয়েস ম্যাম। আর এই রিপোর্টের পিছেই আমাকে টানা তিনদিন এতো সময় ব্যয় করতে হয়েছে। উনারা বলেছিলেন আরও তিনদিন আগে রিপোর্ট দিবেন। অথচ দেখো তিন তিনটে দিন আমাদের এভাবে অপেক্ষা করালো। যাকগে,এটলাস্ট রিপোর্ট আমাদের হাতে।’

হীর আর কিছু বলতে না পেরে মুখে হাত চেপে কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরলো সাবাবকে। সাবাব হীরকে আগলে ধরে বলল,

—-‘ নাউ উই আর কমপ্লিট হীরপাখি। উই আর কমপ্লিট।’

—-‘ আ-আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না আমি.. আমি মা হতে চলেছি।’

কাঁদতে কাঁদতে বলল হীর। সাবাব হীরকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে কাপালে ভালোবাসার পরশ একে বলল,

—-‘ থ্যাংক্যু হীরপাখি। থ্যাংক্যু আমাকে পরিপূর্ণ করার জন্য। থ্যাংক্যু আমার জীবনে আসার জন্য। থ্যাংক্যু আমাকে এতো সুন্দর একটা মুহুর্তে দেওয়ার জন্য। থ্যাংক্যু ফর এভরিথিং হীরপাখি।’

হীর ফোঁপাতে ফোপাঁতে মিষ্টি হাসল। ফের সাবাবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

—-‘ থ্যাংক্যু আমাকে এতো ভালোবাসার জন্য। থ্যাংক্যু আমাকে মা হওয়ার পবিত্র সুখ দেওয়ার জন্য। থ্যাংক্যু আমাকে সারাজীবন আগলে রাখার জন্য, আমাকে প্রটেক্ট করার জন্য। থ্যাংক্যু ফর এভরিথিং আমার বাবুর বাবাটা।’

সাবাবও মিষ্টি করে হাসল। ফের হীরকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিলো নিজের।

#চলব___

[ [ বিঃদ্রঃ এতদূর কষ্ট করে পড়ে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করবেননা। যদি ছোট্ট একটা মন্তব্যে আপনার মতামত জানাতে কষ্ট হয়। ধন্যবাদ। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here