#কাছে_দূরে ?
#muhtarizah_moumita
#পর্ব___৪৫
—-‘ তুমি মালিকাকার ছেলে! এটা কখনও বলোনি কেন? লুকিয়েছ! সবটা লুকিয়েছ! কিচ্ছু বলোনি! কেন?’
সিয়ামের বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। হীরের প্রশ্নের জবাব, ভয়ে সে কিছু বলেনি। যদি সঠিক মানুষ টার হদিস পাওয়ার আগেই শত্রুরা ওকে মেরে ফেলে। তাহলে তো অনেক রহস্য রহস্যই থেকে যাবে। শত্রুরা সর্বক্ষণ হীরকে মারার ফন্দি করেছে। মারতে চেয়েছে। সে যতটুকু পেরেছে হীরকে সেফ করেছে। কিন্তু কখনও পরিচয় দেওয়ার সাহস হয়নি। হীর যদি ওকে চিনে ফেলতো তাহলো তো অনেকই জেনে যেতো ওর পরিচয়। সেই সাথে জেনে যেতো তার প্ল্যান।
—-‘ কি হলো সিয়াম! চুপ করে আছো কেন?’
হীরের মনটা ছটফট করছে। সিয়ামের থেকে কোনো জবাব না পেলে যেন সে মরে যাবে। সাবাব হীরের মনের অবস্থা টা বুঝতে পেরে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে চাইলে হীর আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সিয়াম চুপ করে কেন আছে। কথা বলছেনা কেন?
—-‘ হীর আমি তোমাকে কিছু জানায়নি তার পেছনে কারন ছিলো। বিশ্বাস করো, আমি চেয়েছিলাম আমি যেটা জানি সেটা কোনো একজন সঠিক মানুষকে জানাতে। আমি চাইনি আমার জানা তথ্য গুলো সেই মানুষটাকে না জানিয়ে মরতে। তুমি হয়তো ভাববে আমি মৃত্যুর ভয়ে বলিনি। কিন্তু তেমন টা নয়। কারন আমি তো সেদিনই মরে গিয়েছিলাম যেদিন দেখলাম ওরা বাবাকে কতটা নৃশংস ভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে।’
সিয়ামের কথায় মনের ভেতর ঝড় উঠলো সবার। সাবাব শুঁকনো গলায় বলল,
—-‘ কুপিয়ে হত্যা করেছে!’
সিয়াম মাথা নুইয়ে ফেললো। হয়তো চোখের জল লুকানোর জন্য। ইনান এগিয়ে গিয়ে সিয়ামের কাঁধে হাত রাখলো। সিয়াম জড়ানো গলায় বলল,
—-‘ হ..হ্যাঁ স্যার! ওরা বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। সেটা আমার নিজের চোখে দেখা। বাবা যখন রিয়াদ স্যারের বাসায় মালির কাজ টা পায় তখন হীর একদম ছোট। আমার বয়স ছিলো ২বছর। আমার ২বছর থেকে ৬বছর পর্যন্ত বাবা রিয়াদ স্যারের বাসায় মালির কাজ করে আসছে। বাবার উপর রিয়াদ স্যারের এক অদ্ভুত টান ছিলো। অভাবের সংসার ছিলো আমাদের। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। বাবা কাজ কাজ করে রাত দিন হন্যে হয়ে ঘুরতো। গ্রামের মানুষের দোরে দোরে কাজের জন্য ভিক্ষা করতো। কিন্তু কেউ কোনোদিন বাবাকে কাজ দেয়নি। সবাই বলত, কাজ কাজ করে মরবি একদিন কিন্তু কাজ পাবিনা। এর থেকে ভালো ভিক্ষা করে খা। কিন্তু বাবা কখনও ভিক্ষা করে খাওয়ার জন্য রাজি হননি। সততার সাথে সবসময় কাজ খুঁজে গেছেন। তার বিশ্বাস ছিলো, আল্লাহ তার জন্য ঠিকই কোনো ফেরেশতা পাঠাবেন। বাবার দোয়া আল্লাহ কবুল করে রিয়াদ স্যারকে পাঠিয়েছিলেন রাঙামাটির এই পঞ্চগড়ে। স্যার খুব সম্ভবত এদিকে ডিউটিতে এসেছিলেন। তখনই আল্লাহর হুকুমে বাবার সাথে ঐ মহান মানুষ টার দেখা হয়ে যায়। বাবার কপাল খুলে যায়। স্যারের বাড়িতে মালির কাজ পেয়ে যায়। এ..এই যে বাড়িটা… এই বাড়িটাও ঐ মানুষ টারই দেওয়া উপহার। আমরা তখন বস্তিতে থাকতাম। ভাঙাচোরা একটা ঘর ছিলো। দমকা হাওয়া দিলেই টিনের ছাওনি উড়ে যেত। সেই বস্তুির ঘরটা রাতারাতি দোতলা বাড়িতে পরিবর্তন হয়ে যায়। বাবা আনন্দে স্ট্রোক করার দশা। বাবা শুধু কাঁদতেন আর বলতেন মানুষ টা এতো দয়ালু কেন? দুনিয়া কি তাকে এর প্রাপ্য কখনও দিতে পারবে? এসব বলে বাবা নামাজে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতেন। আমরা মাঝেমধ্যে ঢাকায় যেতাম বাবার সাথে দেখা করতে। আমার এখনও মনে পড়ে কনিকা ম্যাডামের মুখ। কতটা ভালোবাসতে পারেন মানুষটা। দেখলে মন প্রান ভরে যেতো। বাবা যে গার্ডেন টা দেখাশোনা করতো তার পাশেই বাবার জন্য আলাদা একটা ঘর ছিলো। আমরা গেলে সেখানে থাকতাম বাবার সাথে। কিন্তু কনিকা ম্যাডাম খুব রাগ করতেন। বাসার ভেতর আমাদের থাকতে বলতেন। বিলাসবহুল বাড়িতে পা রাখতেই কেমন মনের মধ্যে খচখচ করতো। সেখানে গিয়ে থাকার কথা আমরা ভাবতেও পারতাম না। লজ্জা লাগতো। কিন্তু কনিকা ম্যাডাম কখনও আমাদের অস্বস্তিতে পড়তে দিতেন না। উনি জোর করে আমাদের বাড়ির ভেতরে রাখতেন। নিজের হাতে রান্না করে সবাইকে নিয়ে এক টেবিলে বসে খেতেন। হীর তখন বেশ ছোট। হামাগুড়ি দিতো। মাঝেমধ্যে বাড়িতে নাজমা ম্যাডাম আর সাবাব স্যারকে আসা যাওয়া করতে দেখতাম। সাবাব স্যার দেখতে হুবহু রিয়াদ স্যারের মতো ছিলেন। আমার মনে হতো হীর নাজমা ম্যাডামের মেয়ে আর সাবাব স্যার রিয়াদ স্যারের ছেলে। দু’জনের গভীর ভালোবাসা অদ্ভুত ভাবে ক্রস কানেকশন ছিলো।
বেশ যাচ্ছিলো দিনগুলো। কতটা মায়া,ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলা একেকটা দিন। আমার মা বলতো ‘আমি স্বপ্ন দেখছি। জীবন যে এতোটা সুন্দর হতে পারে এই মানুষ দুজনকে না দেখলে হয়তো জানাই হতো না।’
রাতুল ভাবুক কন্ঠে বলে উঠলো,
—-‘ আজ থেকে প্রায় বারো বছর আগের প্রত্যেকটা কথা তুমি কি করে মনে রাখলে।’
সিয়াম আত্নবিশ্বাসের সাথে বলে উঠলো,
—-‘ বারো বছর ধরে প্রত্যেকটা লাইন কেবল মুখস্থ করে গেছি। ঠিক আজকের এই দিনটার জন্য। (সাবাবের দিকে তাকিয়ে)
সাবাব হীরের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
—-‘ তারপর বলো?’
সিয়াম মাথা নেড়ে বলতে আরম্ভ করল,
—-‘ সেদিন রাতটায় খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল। বাবার বাড়ি আসার কথা ছিলো। বাবা চিঠি পাঠিয়েছিলো কাল তিনি আসবেন। চিঠি একদিন পর হাতে পায় মা। তারমানে বাবা আজ আসছেন। কিন্তু বাবা আসলেন না। মা দুঃশ্চিন্তায় পড়লো। তারউপর বৃষ্টি। মা ঠিক করল পরদিন আমরা চলে যাবো বাবার কাছে। মা কেন জানিনা বারবার বলছিলো তার মনটা কেমন করছে। মনে হচ্ছে বাবা ভালো নেই। আর বাবা ভালো নেই মানে ঐ ফেরেশতার মতো মানুষ দুটোও ভালো নেই। মায়ের এতোটা অস্থিরতা আমি আগে কোনো দিন দেখিনি। পরদিন ভোরের আলো ফুটতেই আমরা রওনা দেই ঢাকার উদ্দেশ্যে। সারা পথ মা কেবল ছটফট করতে থাকলো। আমি মাকে শান্তনা দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সকাল ১১টার মধ্যে আমরা পৌঁছেছিলাম সেখানে কিন্তু ততক্ষণে বাড়িটা রক্তে ভাসছিলো। মা চিৎকার করে বাড়ির গেটেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। আমার কেবল মনে পড়ছিলো রিয়াদ স্যার আর কনিকা ম্যাডামের সেই হাস্যজ্বল মুখটা। আমি দৌড়ে গেলাম বাড়ির ভেতর। দেখি কালো পোষাক পরা কারা যেন একটা লোককে মাটিতে ফেলে কোপাচ্ছে। কেমন ফ্যাচফ্যাচ শব্দ হচ্ছিল। আমার পায়ের শব্দে উনারা থেমে যায়। হয়তো এবার আমাকে খুঁজতে আসবে। তাই আমি দৌড়ে পালাই বাবার ঘরটায়। ওখান থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি ওটা আমার বাবার লাশ। বাবার লাশটাকেই ওরা কোপাচ্ছিলো।’
হীর শরীরের ভার ছেড়ে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে। সিয়ামের কথা গুলোয় বুকে ব্যাথার সঙ্গে সঙ্গে গা গুলিয়ে উঠল তার। সাবাব দু’হাতে আষ্টেপৃষ্টে ধরতে গিয়েও পারলোনা। তার আগেই মেঝেতে লুটিয়ে গেলো হীরের শরীর। সাবাব আহত নয়নে তাকালো। দ্রুত বসে পড়ে হীরের মাথা তুলে নিলো তার কোলে। রাতুল, ইনান মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল,
—-‘ ভাই! হীরকে এসব না জানানোই ভালো ছিলো রে। দেখ ও এগুলা সহ্য করতে পারবেনা।’
সিয়াম দ্রুত গেলো পানি আনতে। পানি এনে সাবাবের হাতে দিতে সাবাব হীরের চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলো। কিন্তু কোনো ভাবান্তর হলো না হীরের। সিয়াম সাবাবের দিকে তাকিয়ে বলল,
—-‘ স্যার, আপাতত হীরকে আর না জানানোই ভালো। কারন আমি এরপর যা বলতে চলেছি সেটা ও কিছুতেই সহ্য করতে পারবেনা। আপনি ওকে কোলে নিয়ে আমার সাথে আসুন। আসুন।’
সাবাব সিয়ামের কথা অনুযায়ী হীরকে কোলে নিয়ে তার পিছু পিছু গেল। সিয়াম মাঝের একটা রুমে ঢুকলো। সেখানে বসে ছিলো সেই বাচ্চা ছেলেমেয়ে দুটো। সাবাবকে দেখতেই তারা ভড়কে গেলো। সিয়াম তাদের অভয় দিয়ে বলল,
—-‘ ভয় পাস না। উনি তোদের একটা আঙ্কেল। স্যার, হীরকে এখানে শুয়ে দিন। আলি, মায়া তোরা এই আন্টিটার পাশে থাকবি। যতক্ষনে না জ্ঞান ফিরে ততক্ষণ এখান থেকে এক পা-ও নড়বিনা।’
সিয়ামের আদেশে দু’জনে মাথা নাড়লো। সাবাব হীরকে বিছানার উপর শুয়ে দিলো। মাথায় হাত রেখে বলল,
—-‘ এতোটা নরম হলে চলবে না হীরপাখি। বাবাই ছোটমায়ের মৃত্যুর রহস্য উদ্ধার করা আমার দায়িত্ব, আমার ডিউটি। কিন্তু তাদের নিজ হাতে শাস্তি তো তোমাকেও দিতে হবে। হবে তো? তাহলে কেন অল্পতেই ভেঙে যাও তুমি।’
—-‘ হীর একদম আপনার মায়ের মতো হয়েছে। তাই না স্যার?’
সাবাব মৃদুহাসে। বলে,
—-‘ একদম।’
সিয়ামও হাসে সাবাবের ন্যায়। অতঃপর তারা পূনরায় চলে যায় আগের ঘরে। সিয়াম তিনজনকে বসার জন্য চেয়ার দেয়। সবাই বসে। তারপর আবারও সবাই তলিয়ে যায় অতীতে,
(ফেব্রুয়ারী ১৭)?
‘ মালিকাকা… ইঁদুর!!(মৃদু চিৎকার করে)’
আপন মনে গুনগুনিয়ে গান গাচ্ছিলো আর গাছের গোড়ায় জল দিচ্ছিলো মালিকাকা। আচমকাই ছোট্ট হীরপরির মুখে “ইঁদুরের” নাম শুনতেই ফড়িংএর মতো লাফিয়ে পড়ল উল্টো পাশে! ফাঁকা জমিনে ধরাম করে শব্দ করে হুমড়ি খেয়ে নীচে পড়ে, মেকি সুরে আর্তনাদ করে উঠল বেচারা। এদিকে, মালিকাকার এমন তিড়িং ফিড়িং লাফ দেখে জমিন কাঁপিয়ে হেসে উঠল হীরপরি। দু’হাতে মাখামাখি হয়ে থাকা শুকনো ধুল গুলোকে একঝাটকায় পরিষ্কার করে ছোট ছোট ধাপ ফেলে দৌড়ে গেলো তার কাছে। চোখ পিটপিট করে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে “ইঁদুরের প্রতি” মালিকাকার এই অজানা ভয়ের হদিশ চালালো! খুঁজতে গিয়ে বিশেষ কোনো লাভ না হতেই মালিকাকার মোটা হাত খানা টেনে ধরে দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল,
‘ ইঁদুর নেই গো। নেই গো! উঠো তুমি!’
মালিকাকা ভয়ার্ত চোখে দৃষ্টিপাত করলো চারিপাশ! “ইঁদুর নেই” কথাটা ঠিক কতটুক বাস্তব তারই সত্যতা যাচাই করতে লাগলো! চোখে তেমন কিছুই পড়লো না মালিকাকার। মিষ্টির ছোট্ট হাতজোড়া ধরে কাঁদো কাঁদো সুরে বলল,
—-‘ আইন্নে আমারে হুদাই ভয় দেহাইলেন আম্মা?’
হীর মালিকাকার হাত দুটো টেনে ধরে তাকে তুলবার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে বলল,
—-‘ তুমি উঠো না মালিকাকা! তোমাল ব্যাথা লাগবে তো!’
মালিকাকার ব্যাথা পাওয়ার চিন্তায় হীরের টলটল করা চোখ আর কুঁচকে থাকা কপাল খানা দেখতেই উচ্ছ্বসিত কন্ঠে হেসে উঠলো মালিকাকা। হীরের হাত খানা ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। জামা-কাপড়ে লেগে থাকা ময়লাগুলো ঝেড়ে ফেলে পূব আকাশে দৃষ্টিপাত করলো! সূর্যের তাপের প্রখরতার আন্দাজ চালিয়েই হীরের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বলল,
—-‘ আম্মা জলদি আইয়েন,,,মেডামে এতক্ষণে আফনের খুঁজ না পাইয়ে চিন্তায় পরি গেছে হয়তো! আফনের নাচের মেডামও আইবো এহুনি! সময় পার হইয়া যাইতাছে।’
মিষ্টি কুন্ঞ্চিত কপালে তাকালো। মালিকাকা কে অনুসরণ করেই সেও পুব আকাশে দৃষ্টিপাত করলো। কিন্তু মালিকাকার ন্যায় সঠিক কোনো জবাব মিলল না! তার ছোট্ট প্রশ্নের ভান্ডারটি উত্তরের আশায় শূন্য রেখেই ঠোঁট উল্টে তাকালো মালিকাকার দিকে। কিছু প্রশ্ন খুঁজে মালিকাকার ন্যায় ছুঁড়তে নিলে অগত্যাই মালিকাকার হাতে ভাজে নিজের হাতটা কে আঁটকে ফেলে বড় বড় ধাপে বাসার দিকে এগোতে হলো!
মালির প্রতি রিয়াদ আহমেদের মতোই অদ্ভুত টান এই ছোট মেয়েটির। হীর মালিকে কি ভীষণ ভালোবাসে তা কেবল সেই জানে। দু’জনের রোজকারের রুটিন এই সকালের দৃশ্য। রোজ মালিকাকাকে ইঁদুরের ভয় দেখিয়ে সে ভীষণ আনন্দিত হয়। আর মালিও হীরের খুশি ধরে রাখার জন্য ইঁদুরের প্রতি মিছে ভয় পেয়ে হীরকে আনন্দিত করে। ভীষণ মিষ্টি তাদের সম্পর্ক।
—-‘ হীররররর……’ (বিকট শব্দে)
বাসার ছাদ থেকে মায়ের আর্তনাদের চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়ালো হীর আর মালিকাকা। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সেদিক পানে তাকাতেই মায়ের রক্তাক্ত দেহটাকে অসার হয়ে শূন্য ভেসে পড়তে দেখেই হীরের ছোট্ট হৃদয়টা তাড়নায় কেঁপে উঠলো! তার ছোট্ট মাথাটাতে মায়ের অবস্থার সঠিক কোনো আন্দাজ না করতে পারলেও “অত উঁচু থেকে মা নীচে পড়লে যে আর বাঁচবে না” সেটুকু সে ঠিকই বুঝে নিলো! মালিকাকার হাত থেকে নিজের হাত টা ছাড়িয়ে নিয়েই “মা” বলে চিৎকার করে উঠলো হীর। মাকে ধরে রাখার মিছে স্বপ্ন বুনেই দৌড়ে গেলো সেদিকে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে হীরের জন্য বের হওয়া বুলেটটা তেড়েফুঁড়ে এসে মালিকাকার পাজরের হাড় ছিদ্র করে বেরিয়ে গেলো! মালিকাকা নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে লুটিয়ে পড়লো কর্দমাক্ত মাটির উপর। সেদিকে হীরের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে ছুটছে মাকে বাঁচাতে! কিন্তু মায়ের কাছে পৌঁছানোর আগেই কারোর হাতে হেঁচকা টান খেয়ে শূন্যে ভেসে উঠলো সে! মানুষ টার মুখ দেখা সে জরুরি মনে না করেই “মা” কে ডেকে চিৎকার করতে লাগলো! বিকট এক শব্দ করে মায়ের তপ্ত দেহটা নীচে পড়ে মুহুর্তেই নিথর হয়ে গেলো! মায়ের শেষ পরিস্থিতি দেখে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ছোট্ট প্রাণটির। মানুষ টার কোলেই জ্ঞান হারালো হীর! নিজে না বাঁচুক, এই নিষ্পাপ প্রাণ টা কে তাকে বাঁচাতেই হবে! সবকিছুর বিনিময়ে হলেও বাঁচাতে হবে। কিন্তু তার স্বপ্ন কে স্বপ্নই রেখে তার বুকটাকেও ঝাঝড়া করে দেওয়া হলো বন্দুকের প্রতি টা গুলিতে। নাচের মেডাম তাইয়্যেবা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তার কোলেই আঁকড়ে রাখা হীরের ছোট্ট শরীরটা ছিটকে পড়লো কয়েক হাত দূরে! নীচে পড়ে হাত পা কেটে রক্ত ঝড়তে লাগলো হীরের শরীর থেকে! তাইয়্যেবা হীরের ছোট্ট শরীরটার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো! সে জানে সে বাঁচবে না,তবুও এই বাচ্চা টা কে সে বাঁচাতে চায়! হীরের মাকে সে কথা দিয়েছে,সে নিজের জীবন দিয়ে হলেও হীরকে এই হায়নাদের কবল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। নিজের রক্তাক্ত শরীর নিয়ে দু’হাতে ভর দিয়ে উঠতে নিয়েও পারলো না তাইয়্যেবা। শরীরের ভারের কাছে অসহায় হয়ে মাটি আঁকড়ে ধরলো সে। তার শরীরও নিথর হয়ে যাচ্ছে। সে চেয়েও পারছেনা হীরের দিকে এগিয়ে যেতে! ঝাপসা হয়ে আসছে তার চোখ। আচমকা হীরকে কারোর কোলের মধ্যে আবিস্কার করতেই আঁতকে উঠল তাইয়্যেবা! তবে কি ওরা হীরের কাছেও পৌঁছে গেলো! শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দু’হাতে ভর দিয়ে মুখ উঁচিয়ে তাকাতেই দেখলো হীরের বাবা রিয়াদ তাকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টির রক্তে ভেজা শরীরে রিয়াদের সাদা শার্টটাও মাখামাখি হয়ে গেলো! তাইয়্যেবা স্বস্তিময় হাসলো। তার দৃঢ় বিশ্বাস হীর এই মানুষ টার কাছে থাকলে কোনো হায়নারাই তাকে আর স্পর্শ করতে পারবেনা! একদমই পারবেনা! তাইয়্যেবার এমন অবস্থা দেখে রিয়াদ তার পানে ছুটে আসতে নিলেই তাইয়্যেবা বাঁধা দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,
—-‘ স…স্যার!! হীরকে কে ন…নি,,,য়ে আ,,,আপনি চলে,,,, চ..চলে যান প্লিজ!! ও…ওরা ম,,,,মেম কে,,,, মেমকে খুব বাজে ভাবে মেরেছে!!…..(কাঁদতে কাঁদতে) ওরা হীরকেও বাঁচ,,,,তে দিব……’
তাইয়্যেবার দেহ অসার হয়ে এলো। তার বলা কথা গুলোর ইতি এখানেই টেনে সেও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো! মালি একহাত দিয়ে নিজের বুক চেপে ধরে অন্যহাতে আঁকড়ে রাখলো হীরের ছোট্ট শরীরটা। তাইয়্যেবা ঘোরের মাথায় তাকে রিয়াদ ভেবেছে। রিয়াদ একঘন্টা আগেই বেরিয়েছে নিজের ডিউটিতে। সে তো জানেইনা তার পাঁজরের হাড় গুলো এই হায়না গুলো কি করে ভেঙে ফেলছে। মালি হীরকে নিয়েই ছুটলো। সামনে কিছু দেখছে না তবুও ছুটছে। সে নিজে মরে যাবে কিন্তু এই ছোট্ট নিষ্পাপ প্রানটির কিছু হতে দিবেনা।
#চলবে_