#কাছে_দূরে ♥️
#muhtarizah_moumita ♥️
#পর্ব___৩২
সাবাব তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
—-‘ এখন ক’টা বাজে?’
হীর জবাব দিলো না। মুখভার করে মাথা নীচু করে রইলো। সাবাব আবারও বলল,
—-‘ প্রায় সাড়ে চারটা! সকালে কখন খেয়েছিস? নয়টা কি দশটা। একটা মানুষ এতগুলো ঘন্টা না খেয়ে কি করে থাকতে পারে? পেটে পাথর বেঁধে রেখেছিস?’
—-‘ হ্যাঁ পেটে আমি পাথর বেঁধে রেখেছি।’
সাবাব মেকি রাগ নিয়ে বলে উঠলো,
—-‘ মুখে মুখে কথা বলা হচ্ছে? একটা দেবো!’
হীর চমকে উঠে নত মাথাটা আরও নত করে ফেললো। আর কিছু বলার দুঃসাহস করতে পারল না। সাবাব হীরের কান্ড দেখে মনেমনে হাসছে। উপরে উপরে মেকি রাগ নিয়ে আবারও বলে উঠল,
—-‘ এই নে ধর। এটা এক্ষনি শেষ করবি।’
হীর অসহায় মুখ করে সাবাবের দিকে একবার তাকাতে নিয়েও তাকালো না। মনে হচ্ছে সাবাব তাতেও তাকে ধমকে বলে উঠবে, ‘তোর এত সাহস,তুই আবার মুখ তুলে দেখছিস আমায়?’ সবদিকে হলো জ্বালা। হীর মনের বিরুদ্ধে হাত বাড়িয়ে খাবারের প্লেটটা নিলো। সাবাবও হীরের হাতে প্লেটটা উঠিয়ে দিয়ে ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হীর প্লেটটা বিছানার উপর রেখে আসন করে বসল। অতঃপর পূনরায় প্লেটটা হাতে নিতে গেলেই সাবাব কি ভেবে প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিলো। হীর বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই সাবাব বলে উঠলো,
—-‘ মা তোকে খাওয়ানোর দায়িত্ব আমায় দিয়ে পাঠিয়েছে। তাই আমি কোনো রকমের রিস্ক নিতে চাইনা।’
হীর বিস্মিত কন্ঠে বলল,
—-‘ মানে?’
—-‘ আমি নিজ হাতে তোকে খাইয়ে দিবো। তারপর খালি প্লেট নিয়ে গিয়ে মাকে দেখিয়ে বলবো, ‘মা, এই দেখো। আমি আমার দায়িত্ব সম্পূর্নরূপে পালন করে এসেছি।’
হীর মুখ কুঁচকে তাকালো সাবাবের দিকে। বলল,
—-‘ কোনো প্রয়োজন নেই। আমি খাবার নিয়ে নীচে চলে যাচ্ছি। আর বড়মাকে বলছি খাইয়ে দিতে। তোমার এতো কষ্ট করতে হবেনা। দাও এদিকে?’
সাবাব অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
—-‘ মা তোকে কি করে খাইয়ে দিবে? মা পারবেনা বলেই তো আমাকে পাঠালো। আর তুই মায়ের হাতে প্রথম লোকমা খাওয়ার জন্য কাহিনি করবি বলে মা এই যে প্রথম লোকমা নিজের হাতে মুঠ করে দিয়েছে।’
হীর ভালো করে তাকিয়ে দেখলো প্লেটের পাশে এক লোকমা ভাত মুঠ করা। যা দেখে তার মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। এখন আর খেতে কোনো আপত্তি নেই তার। সুতরাং সাবাবের হাতেই খাওয়া যাবে।
হীরের ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা দেখে সাবাবের মনটাও হালকা হলো। বুঝলো হীর আর আপত্তি করবে না খেতে। তাই নিজের থেকেই ভাতের লোকমা তুলে তার মুখে দিলো। সেও আর বাঁধ সাধল না। চুপচাপ হা করে খেতে আরম্ভ করল।
সাবাব এবং হীরের ছোট্ট ছোট্ট ঝগড়া এবং মন কষাকষি সবটাই দরজার আড়াল থেকে শকুনি দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে গেলো কেউ। দরজার ওপাশে কারোর উপস্থিতি হীরের বোধগম্য না হলেও সাবাবের সুক্ষ্ম মস্তিষ্ককে এড়াতে পারলো না। পারলো না তার তীক্ষ্ণ নজরকেও এড়াতে। আগন্তুকের উপস্থিতি সে যেন মনে প্রানে চাচ্ছিলো। আগন্তুক এবার যত বেশি হুশিয়ারি করবে সে তত তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে।
হীর বাচ্চাদের মতো করে চিবিয়ে চিবিয়ে ভাত খেতে লাগল। তা দেখে সাবাব বলে উঠলো,
—-‘ এভাবে করে কেন খাচ্ছিস? আজ অব্দি কি ভাত খেতেও শিখিসনি!’
হীর চুপসে গেলো। শক্ত চোয়ালে ভাত চিবানো বন্ধ করে কপাল কুঁচকে তাকালো সাবাবের দিকে। সাবাব ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় আবারও একই প্রশ্ন করল। হীর সাবাবকে পাত্তা দিলো না। এমন একটা ভাব করে আবারও চিবাতে লাগল। হীরের বাচ্চামোতে সাবাব এবার না পেরে হেসে উঠলো। সাবাবকে হাসতে দেখে হীরের খুব অপমান বোধ হলো। মনে হলো সাবাব তার খাওয়া দেখে হাসছে। তাই কোনো রকমে খাবারটুকু গিলে নিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে উঠলো,
—-‘ তুমি হাসছো কেন?’
সাবাব হীরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিজের মতো করে হেসেই চলেছে। হীরের এবার বেশ রাগ হলো। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে আর সাবাবের হাতে খাবে না। এক লোকমা তো দূর একটা দানাও সে আর মুখে তুলবেনা। যেমন ভাবা তেমন কাজ। হীর রেগে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। মুখ ভার করে অন্যদিকে হেঁটে চলে যেতেই সাবাব অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,
—-‘ পানি না খেয়ে চললি কোথায়?’
হীর ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সাবাব আবারও বলে উঠল,
—-‘ খাওয়ার শেষে যে পানি খেতে হয় তাও জানিস না ইডিয়ট। জলদি এসে পানি খা। আর নয়তো মার পড়বে এবার।’
হীর থমকে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঁচকে সাবাবের দিকে ফিরে তাকালো। সাবাব তার মতোই ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বকার সুরে বলল,
—-‘ অন্তত খাবার খাওয়াটা তো ভালো করে শেখ।’
হীর বারবার অবাক হচ্ছে সাবাবের কথায়। সাবাব বারবার পানি পানি কেন করছে? একবারও খাবার নেওয়ার কথা কেন বলছেনা?
—-‘ কি হলো?’
হীর সাবাবের কথায় জবাব দিলো না। তার থেকে দৃষ্টি নামিয়ে প্লেটের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠে মুখ চেপে ধরলো। একি কান্ড! প্লেটে তো একটা দানাও অবশিষ্ট নেই। সে এতক্ষণে সব সাবাড় করে দিয়ে তবেই উঠেছে। লজ্জা! লজ্জা!
হীর কাচুমাচু করে সাবাবের দিকে তাকাতে সাবাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে দেখলো তাকে। হঠাৎ সে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত রিয়াকশন কেন দিচ্ছে। সাবাব হীরের ব্যাপার বুঝতে না পেরে এবার হীরের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। হীর বারবার খালি প্লেটের দিকে তাকাচ্ছে। তাই সে ভাবল হীরের এই খাবারে হয়তো পেট ভরেনি। সে আরও খেতে চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছেনা৷ তাই সে নিজেই বলে উঠলো,
—-‘ খাবার কি আরও নিয়ে আসবো?’
সাবাবের প্রশ্নে হীর যেন লজ্জার সাগরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল! আমতাআমতা করে কিছু বলতে নিয়েও বলতে পারল না। সাবাব হীরের আমতাআমতা করা দেখে কিছু বলতে নিলেই হীর দৌড়ে ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমের দরজাটা বেশ শব্দ করে লাগাতেই সাবাব চমকে উঠলো। মনে হলো হীর তার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো। মনে মনে ভাবল, ‘ওর কি ক্ষিধে মিটেনি? আরও খাবার নিয়ে আসা দরকার ছিলো?’
এসব ভাবতে ভাবতেই সাবাব নীচে চলে গেলো।
নাজমা বেগম অপেক্ষায় ছিলেন সাবাবের। সাবাবকে খালি প্লেট নিতে নেমে আসতেই দেখে তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। পূনরায় গরুর মাংসে লবন চেখে কষাতে মনোযোগী হলেন। সাবাব প্লেট টা টেবিলে রেখে বাসার বাইরে চলে গেলো। তরী ম্যাসেজ করেছে। সে বাসার কাছাকাছি তো এসে পড়েছে কিন্তু বাসা চিনতে পারছেনা। রোড ভুল করে ফেলেছে। সাবাব হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো রাস্তার দিকে।
এদিকে হীর ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে একদম পরিপাটি হয়ে নীচে নামল। সে নীচে নামতেই মন জুড়ালো সবার। মেহেন্দির অনুষ্ঠানে যেন প্রান ফিরে এলো। হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠলো বাড়ির প্রত্যেক কোনা কোনা।
—-‘ এতক্ষণে নামার সময় হলো?’
অভিযোগে মোড়ানো কন্ঠ সানিয়ার। হীর নিজের মেহেদী নিজেই পড়ছে। পড়ার ফাঁকে সানিয়ার প্রশ্ন কানের মধ্যে আওয়াজ দিতেই আঁড়চোখে তাকালো। দাঁত কেলিয়ে একখানা হাসি দিয়ে বলল,
—-‘ ভুল করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!’
সানিয়া মুখ কুঁচকে বলল,
—-‘ ভুল করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে কি করে?’
হীর ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলো,
—-‘ এই মনে করো তুমি তোমার বেডে চিত হয়ে বা কাত হয়ে শুলে। তারপর ঠাস করে ঘুমিয়ে পড়লে। সেটাকে বলে ভুল করে ঘুমিয়ে পড়া।’
সানিয়া বোবা চোখে তাকালো। জবাবে কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
—-‘ আচ্ছা। এই যে ঠাসস করে ঘুমিয়ে পড়া যায় জীবনে এই প্রথম শুনলাম। একটু অভিজ্ঞতা করা উচিৎ। কি বলিস?’
হীর সানিয়াকে হাসতে দেখে নিজেও হেসে ফেললো। উপর-নীচ করে মাথা নেড়ে বলল,
—-‘ নেহাল ভাইয়ার কাছে যাওয়ার আগে আগে আমি তোমাকে এই অভিজ্ঞতা করিয়ে দিবো। কেমন?’
সানিয়া হাসতে হাসতে বলল,
—-‘ ওকে।’
‘ এসো তরী। আমরা সবাই তোমারই অপেক্ষা করছিলাম।’
আকস্মিক তরীর নাম শুনতেই দৃষ্টি কুটিল হয়ে উঠলো হীরের। পাশ ফিরে বড় দরজার দিকে তাকাতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো তরীর ঝলমলে হাসিপূর্ণ মুখ। সেই একই রকম হাসি সাবাবের মুখেও বিদ্যমান। দু’জনেই ভেতরে ঢুকে আসল একসাথে পা ফেলে। যা দেখে মুহুর্তের মাঝেই যেন আগুন জ্বলে উঠলো হীরের গায়ে। সে মেহেদি পড়া বন্ধ করে থমকে রইলো। সাবাব তরীকে নিয়ে সোজা তার সামনে এসেই দাঁড়ালো। যদিও তার সামনে নয় সানিয়ার সামনে। কিন্তু সানিয়া তার সঙ্গে থাকায় তাদের দু’জনের ছায়া তার উপরই অধিকাংশ এসে পড়েছে।
সানিয়া তরীর উদ্দেশ্যে নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
—-‘ তরী? কেমন আছো?’
তরী সানিয়ার প্রশ্নে দুগুণ আন্তরিকতা নিয়ে জবাব দিলো,
—-‘ এতো মিষ্টি একটা মেয়ের বিয়েতে এলে কে না ভালো থাকে বলো? আমি তো বলবো তার ভীষণ ভালো থাকা উচিৎ। এস ইউজুয়াল আমিও ভীষণ ভালো আছি।’
সানিয়া লজ্জা পেয়ে রাঙা হাসলো। মাথা নীচু করে নিজেকে খানিক স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল,
—-‘ তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বসো না এখানে? মেহেদি পড়ো। আর একটু বাদেই নাচ হবে। অনেকে পারফরম্যান্স করবে। দেখবে এসো। বসো।’
তরী মৃদুহেসে ভদ্রতা দেখিয়ে তার পাশে বসল। সাবাব আর মেয়েদের মাঝে না দাঁড়িয়ে নিজের কাজে চলে গেল। তরী অনেক্ষন যাবত আঁড়চোখে নজর রাখছিলো হীরের উপর। সাবাব চলে যেতেই সে হীরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
—-‘ ওয়াও হীর! এই ডিজাইনের মেহেদি তুমি নিজে পড়েছো?’
ভালোই তো ছিলো সানিয়ার সাথে। আবার হঠাৎ তাকে নিয়ে কেন পড়ল এই শাঁকচুন্নি? হীর অনিচ্ছাকৃত হাসি দিলো। জবাবে অনিচ্ছুকস্বরে ছোট্ট করে বলল,
—-‘ হুম।’
তরী অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলে উঠলো,
—-‘ ওয়াও। ইট’স রিয়েলি ফেবুলাস। তোমার ডিজাইনটা আমাকে দিয়ে দিবে হীর? প্লিজ!’
হীর এক আকাশসম বিরক্তি নিয়ে তাকালো তরীর দিকে। কিন্তু নিজের বিরক্তি প্রকাশ করলো না। সবটাই মনের মধ্যে চেপে রেখে মনের বিরুদ্ধে বলল,
—-‘ হ্যাঁ। কেন নয়?’
—-‘ আও থ্যাংক্যু সো মাচ ডিয়ার।’
হীর মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা ধরে রেখেই নিজের হাতের ডিজাইনটুকু কমপ্লিট করলো। শেষ হওয়া মাত্র উঠে তরীর কাছে যেতে নিলেই তাকে পেছন থেকে টেনে ধরল মিলি আর এশা। হীর চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকাতেই মিলি ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
—-‘ এই তরী তো তীর মেরে তোর সব পছন্দের জিনিসগুলো নিয়ে যাচ্ছেরে দোস্ত।’
হীর বিরক্ত ভঙ্গিতে মিলির দিকে তাকাতেই এশা মিলির ন্যায় ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
—-‘ হ্যাঁ তাই তো। আচ্ছা হীর তুই কি হাঁদারাম বলতো? তরী তোর ইউনিক ডিজাইনটা দিতে চাইলো আর তুই ওমনি হ্যাঁ করে দিলি? বলতে পারলি না আমার ইউনিক ডিজাইন আমি কারো সাথে শেয়ার করিনা!’
হীর গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। দুই বান্ধবীকে পাত্তা না নিয়ে ভদ্র মেয়ের মতো তরীর সামনে গিয়ে বসল। তরী মুচকি হেসে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো হীরের দিকে। হীর মেহেদি পড়াতে আরম্ভ করে মনে মনে ভাবল,
—-‘ নেহাত আমি ভদ্র বলে। অন্যথা এই মেহেদি গুলিয়ে তোমায় আর সাবাবকে একসাথে সাথে করে জুস বানিয়ে খাওয়াতাম। তার সাথে মিক্স থাকতো ময়লা আবর্জনা যা যা আছে সব কিছু। আর সেগুলা স্পেশালি আদ্রকে বলতাম নিয়ে আসতে। ও একদম নামকরা ড্রেন থেকে কালেক্ট করতো সেগুলো। নেহাতই আমি ভদ্র মেয়ে বলে বেঁচে গেলে তোমরা। হুহ্।’
সাবাব দূরে বসে চুপিচুপি দেখে চলেছে হীরকে৷ আর দেখে চলেছে তার রিয়াকশন। সাবাবের মনে হচ্ছে হীর পারলে এক্ষনি তরীর মাথার একঝাঁক চুল সব টেনে ছিড়ে দিতো। কিন্তু পারছেনা কেবল ভদ্রতার খাতিরে। অন্যথা তার কাছে মেহেদি পড়তে চাওয়ার অপরাধে তরীর খুনও হতে পারতো। এসব ভাবতে ভাবতেই আনমনে হেসে উঠলো সাবাব। হাসত হাসতে নিজের ফোনে আবারও মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারলোনা। তার মনে হচ্ছে ঘরের কোনে চুপেচাপে হীরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। খুব করুন মৃত্যুর ভয়ানক ষড়যন্ত্র। বাড়ি ভর্তি মানুষ জনের বেশির ভাগ এখানেই আছেন। বাকিরা কেউ বাইরে কেউ ঘরে। কিন্তু মনি আর শিলাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ঐ তো শিলা। হাতে করে জুসের ট্রে নিয়ে যাচ্ছে।
শিলাকে জুস নিয়ে হীরদের দিকে এগোতে দেখে সাবাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল তাকে। সে কি করে? তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল সে। এক এক করে সবাইকে জুসের গ্লাস তুলে দিচ্ছে। কিন্তু হীরকে দিচ্ছে না। হীরের অবশ্য খেয়াল নেই শিলার উপস্থিতিতে। সে আপনমনে মেহেদি দিচ্ছে তরীর হাতে। তরী সাবাবের দিকে তাকালো। ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করল, এনি ডাউট?
সাবাব চোখের পলক ফেলে বুঝালো, ইয়েস। সাবাবের ইশারায় তরী সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল শিলার দিকে। শিলা এবার এক গ্লাস জুস উঠিয়ে তার হাতেও দিলো। সে তৎক্ষনাৎ মুখে দৃঢ় হাসির রেখা টেনে থ্যাংকস বলে জুসটা নিয়ে নিলো। সবাইকে দিতে দিতে বাকি রইলো একটি গ্লাস। সাবাব তরীকে ইশারা করে বোঝালে, এই গ্লাসে ভেজাল আছে। তরী চোখ ঝাপটে ভেতর ভেতর সম্পূর্ণ রেডি হয়ে নিলো। সাবাবও উঠে দাঁড়ালো। শিলা এই জুসের গ্লাসটা হীরকে দিবে। যদি এই গ্লাসে উল্টাপাল্টা কিছু থেকে থাকে তবে আজই হবে মনি এবং শিলার শেষ দিন। কিন্তু সাবাবকে ভুল প্রমান করে শিলা বাকি গ্লাসটা হীরকে না দিয়ে আরেকজনকে দিয়ে দিলো। যা দেখে সাবাব অবাক হলো বটে কিন্তু সে জানে এখানে গন্ডগোল কিছু অবশ্যই আছে। তাই সে রেডিই থাকল মনে মনে। কিন্তু তরী হাল ছেড়ে দিলো। ইশারায় বোঝালো, রিলাক্স। শিলা এতো মানুষের মধ্যে রিস্ক নেওয়ার মতো কিছুই করবেনা। সাবাব মানলো না তরীর কথা। সে মনেমনে প্রতীক্ষা করলো শিলা কিছু বলবে বলে। হ্যাঁ। এবার তাই হলো সাবাব যা ভাবলো। শিলা সবার দিকে একবার তাকিয়ে হীরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
—-‘ পরিজান? তোমায় জুস দিলাম না। বড় ম্যাডাম বলল তুমি নাকি একটু আগেই ঘুম থেকে উঠছো। তাই তোমার জন্য আলাদা কফি বানালাম। আমি এনে দিচ্ছি।’
হীর শিলার কথায় মুখ উঁচিয়ে তাকালো। শিলাকে যেতে বলে মুচকি হেসে আবারও মনোযোগী হলো মেহেদি পড়াতে। শিলা চলে যেতেই তরী উতলা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সাবাবের দিকে। সাবাব ইশারায় বোঝালো, ‘অপেক্ষা করো।’
দু’জনের ইশারায় কথপোকথন কারোর চোখে না পড়লেও হীরের নজর এড়ালো না। ইশারায় কথা বলতে গিয়ে তরী বারবার নড়েচড়ে উঠতে ব্যাঘাত ঘটছে মেহেদি দিতে। হীর তরীর দিকে বিরক্তিভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে দেখতেই পেলো দু’জনের ইশারায় ইশারায় কথা বলা। যা দেখে দুঃখে আর্তনাদ করে উঠলো তার মন। তাদের এতো ভালোবাসা যে দুই মিনিটের দুরত্বও সহ্য হয়না? হীর কিছু বলল না৷ বা মুখ তুলে দ্বিতীয়বারের জন্য তাদের ইশারায় প্রেমের সাক্ষীও হলো না। চুপচাপ নিজের কাজ করে যেতে লাগল।
এর মাঝেই কফি হাতে উপস্থিত হলো শিলা। মুখে শয়তানি হাসি এঁটে কয়েক সেকেন্ড কফিটার দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ স্বাভাবিক করে কফির মগটা এগিয়ে দিলো হীরের দিকে। বলল,
—-‘ পরিজান, তোমার কফি। আমি নিজের হাতে বিশেষ করে তোমার জন্য বানিয়েছি কিন্তু। খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।’
তরী ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে কফির দিকে। হীর মুখে মিষ্টি হাসির রেখা টেনে কফিটার দিকে তাকালো। হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে কফিটা নিতে হাত বাড়াতেই ছো মেরে কফিটা কেউ নিয়ে নিলো। যা দেখে চমকে উঠলো হীর এবং তরী দু’জনেই। কিন্তু শিলা চমকালো না। আকস্মিক ঘটনায় সে ঘাবড়ে গিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো সাবাবের দিকে। সাবাব কফিটা হাতে নিয়ে রাজ্য জয় করা হাসি দিয়ে বলল,
—-‘ অনেক অনেক ধন্যবাদ শিলা আপা। কফিটা এই মুহুর্তে আমার যে কতটা প্রয়োজন ছিলো তা তোমায় বলে বোঝাতে পারবোনা। অনেক অনেক ধন্যবাদ।’
শিলার আত্না শুঁকিয়ে এলো ভয়ে। সাবাব কফিটা মুখে নিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কি করে কফিটা তার থেকে নেওয়া যায় ভাবতে ভাবতেই চাপা আর্তনাদ করে বলে উঠলো,
—-‘ ত,,তুমিও খাবে ক..ফি? আমি। আ…আমি আরেকটা বানিয়ে নিয়ে আসি?’
সাবাব ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলো,
—-‘ আমার তো আর প্রয়োজন নেই। তুমি বরং হীরের জন্য আরেক মগ নিয়ে আসো।’
সাবাবের হঠাৎ উপস্থিতিতে তরী স্বস্তি পেলেও রাগে ফুঁসে উঠল হীর। নিজের কফি ফেরত পেতে প্রতিবাদি কন্ঠে বলে উঠলো,
—-‘ তুমি আমার কফি কেন নিলে? প্রয়োজন তো রুবিকে দিয়ে আরেক মগ আনিয়ে নাও না?’
হীরের কথায় সাবাব ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে রইলো। তরীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
—-‘ কফিটা দেখতে অসাধারণ লাগছে। আই থিংক খেতেও অসাধারণ হবে। তোমার খেতে ইচ্ছে হলে লজ্জা পাবেনা ডিয়ার। শিলা আপাকে বলবে উনি তৎক্ষনাৎ তোমাকেও বানিয়ে দেবে।’
সাবাবের কান্ডে রাগে দুঃখে কান্না পেয়ে গেলো হীরের। এদিকে সে তার কফি কেঁড়ে নিয়ে তাকে সরি না বলে উল্টে তরীকে অফার করচ্ছে। নাম্বার ওয়ান শয়তান,পাষান লোক একটা।
সাবাবের এহেম কান্ডে তরী জোরপূর্বক হাসছে।অন্যদিকে ভয়ে শিলার তো বারোটার ঘন্টা বেজে যাচ্ছে। না পারছে বারন করতে আর না পারছে কেঁড়ে নিতে। সব দিকেই তো সন্দেহের তীর রাখা আছে। যেকোনো ভাবে যেকোনো দিক থেকে ছুটে আসতে পারে সেই তীর। সাবাব কফিটা নিয়ে যেতে যেতে ডায়াল করল ইভানের নাম্বারে।
#চলবে_