#কাছে_দূরে ♥️
#muhtarizah_moumita
#পর্ব_১৩
কান্নার প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো হীরের। মাথায় খুব বিশ্রী রকমের ব্যাথা হতে এতক্ষণ ধরে কেবল ছটফট করল বিছানায় শুইয়ে। ডাক্তারের পরামর্শে অল্প পাওয়ারের একটা ঘুমের ইনজেকশন দিতেই যথারীতি ঘুমিয়েও পড়েছিলো সে। কিন্তু আচমকাই তার কেবিনের বাইরে মরা কান্না জুড়ল কেউ। যার শব্দে তার ঘুম হারাম হয়ে উঠলো। কাঁচা ঘুম হঠাৎ করে ভেঙে যেতে মাথাটা আরও বাজে ভাবে ব্যাথা করতে আরম্ভ করল। হীর চোখ খুলে পুরো কেবিনে নজর বুলালো। পুরো কেবিন ফাঁকা পড়ে আছে। কেউ কোথাও নেই। কিছুক্ষণ আগে সবাই ছিলো এখানে। হঠাৎ কোথায় চলে গেলো? আর বাইরে এভাবে হাউমাউ করে কাঁদছেই বা কে? হীর বিছানা ছেড়ে উঠতে চেষ্টা করল। কিন্তু হাতের আর মাথার তীব্র যন্ত্রণায় উঠতে পারল না। মাথাটা ব্যান্ডেজের কাপড়ে ভারী হয়ে আছে। মনে হচ্ছে মাথায় ভারী কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। উঠে বসতে ব্যার্থ হতেই আবারও ঠেসে রইল বিছানায়। বাইরের মরা কান্নায় তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। মনে মনে ভয়ও হচ্ছে। কে যে স্বজন হারিয়ে এভাবে কাঁদছে কে জানে? একবার বাইরে গিয়ে দেখতে পারলে হয়তো স্বস্তি পেতো। হীর কান সজাগ করে শুনতে চেষ্টা করল কার গলা। বুঝল পরিচিত নয়। কিন্তু মনে হচ্ছে কান্নার মাঝেই একটা পরিচিত নাম ভেসে আসছে। দু’জন মহিলা আর একজন পুরুষ লোক আর একটা ছোট্ট বাচ্চার কান্নার শব্দ পাচ্ছে হীর। বাচ্চা তাদের থেকে বেশি কাঁদছে! মনে হচ্ছে বাচ্চাটাকে সামলানোর মতো কেউ নেই! একজন মহিলা আর একজন পুরুষ বারবার একটা নাম নিচ্ছে, ‘ও রে বাবা তুই ক্যান আইলি এই শহরে,ক্যান আইলি বাবারে! ও ফিরোজ আমার বাবারে!’ ‘আমি এহন কারে নিয়া বারি যামু! ও ফিরোজ রে! তোর মাইয়াডারে এবা অনাথ কইরে কেন গেলি বাবা রে!’
‘ফিরোজ’ এর নামটা শুনতেই হোঁচট খেলো হীর। মাথার মধ্যে টনটনে ব্যাথা করে উঠল। হৃৎস্পন্দনও খুব দ্রুত বেড়ে গেলো। মস্তিষ্ক অনবরত প্রশ্ন করতে লাগল কি হয়েছে ‘ফিরোজ ভাইয়ের?’ বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ বেড়ে উঠতেই আবারও এক প্রশ্নের উত্তর চাইল তার মস্তিষ্ক, ‘ফিরোজ ভাই কি আর বেঁচে নেই?’ হীরের ভেতরটা কেঁপে উঠল। চোখের পাতা হঠাৎই ঘোলাটে হয়ে উঠল তার। চোখ জোড়া ভরাট হয়ে মুহুর্তেই জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। বাইরে থেকে এখনও কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। ঐ বাচ্চাটার কান্না পূনরায় হীরের কানে বাজতেই ছটফটিয়ে উঠল হীরের মন। বাচ্চাটা পিতৃহারা হয়ে গেলো। শুধুমাত্র তার জন্য! একটা সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চা এভাবে অনাথ হয়ে গেলো? কেবল তার নিকৃষ্ট জীবনের জন্য। তাহলে তো ফিরোজের মরে যাওয়ার পেছনে শুধু সেই দায়ী। ফিরোজের বউ এই বয়সেই সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে হারিয়ে ফেললো! তার গোটা জীবনটা তো এখনও সামনেই পড়ে রইল। পুরো জীবনটা নরক হয়ে গেলো কেবল তার জন্য। নিজের উপর ঘৃনা হচ্ছে হীরের। এমন একটা অভিশপ্ত জীবন নিয়ে সে আর কতগুলো জীবননাশ করতে চলেছে আর ভাবতে পারছে না হীর। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। নিজেকে অন্ধকার একটা জগতে নিয়ে গিয়ে খুব বিভৎস ভাবে নিজের হাতেই খুন করতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে নিজেরই মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। ফিরোজের এতো সুন্দর একটা জীবন সে নিজ হাতে শেষ করে দিলো। ফিরোজ তার জন্যই নিজের জীবন উৎসর্গ করে চলে গিয়েছে। নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোর কথা একবারও ভাবেনি সে। ফিরোজ যেহেতু মরে গিয়ে নিজের বিশ্বস্ততার প্রমান দিয়েছে সেহেতু তারও তো উচিৎ ছিলো মরে গিয়ে ফিরোজের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তাহলে সে কেন বেঁচে আছে?
কথা গুলো মনের মধ্যে উথালপাতাল ঝড় তুলতেই পাগলামি শুরু হয়ে গেলো তার। মাথায় পাহাড় সমান ভার নিয়ে পেঁচিয়ে থাকা ব্যান্ডেজের কাপড়গুলো ডানহাত দিয়েই টান মেরে খুলতে শুরু করল। একটা টান মারতেই মাথার মধ্যে ছটাক করে কিছু একটা ছিঁড়ে গেলো মনে হলো। আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেলো ভয়ংকর রকমের ব্যাথা। কিন্তু হীর এই ব্যাথাকে গায়ে মাখল না। তার শুধু মনে পরছে কতটা যন্ত্রণা পেয়ে ফিরোজ ভাই মরেছে! তাই আবারও লেগে পড়ল মহান কাজ সম্পন্ন করতে। শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়ে আরেকটা টান দিতেই তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলো অবশেষে। ঠিক তখনই ট্রলিতে সন্ধ্যার নাস্তা নিয়ে ভেতরে ঢুকছিলো হীরে জন্য ঠিক করা নতুন নার্স। সাবাব এবার আর নিজের প্রতি ঝুঁকি বাড়ালো না। তাই নতুন নার্স হিসেবে তার টিম মেম্বার কিরনকেই নার্স সাজিয়ে নিয়ে এলো হীরের দেখভাল করার জন্য। কিরনই ট্রলি নিয়ে ঢুকছিলো কেবিনে। আচমকা তার বুক কেঁপে উঠলো হীরের পাগলামি দেখে। সে হাত থেকে ট্রলি ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েই দৌড়ে গেলো হীরের কাছে। ‘ম্যাডাম আপনি এসব কি করছেন?’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেই দৌড়ে কেবিনে এসে ঢুকল সাবাব। আর তার পেছন পেছন ঢুকে এলো মাহদী এবং আভিক। সবাই হীরের এমন পাগলামি দেখে হতবাক। সাবাব ছুটে গিয়ে হাত চেপে ধরল হীরের। কিরন দু’হাত দিয়ে হীরকে চেপে ধরেও যেন আটকাতে পারছিলো না। হীর কান্নায় ভেঙে পড়ে চেঁচাতে লাগল। ‘আমায় ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও’ বলে আরও চেঁচাতে লাগল। সাবাব ভীত চোখে কিরনের দিকে তাকাতেই কিরন শঙ্কিত কন্ঠে বলল,
—-” আমি খাবার নিয়ে আসছিলাম কেবিনে। হঠাৎ দেখি এমন অবস্থা।”
সাবাব বুঝে উঠতে পারল না হঠাৎ কি হলো হীরের। কেন এমন পাগলামি। সাবাবও হিমশিম খাচ্ছে হীরের পাগলামির কাছে। তাই হীরকে ধরে উঠিয়ে বসালো। কিরন হীরের মাথার বালিশটা হীরের পিঠের সাথে লাগিয়ে দিতেই সাবাব হীরের পিঠ ঠেকিয়ে বসালো। হীরের পাগলামির জন্য কেউই কোনো প্রশ্ন ঠিক করে করতে পারছে না তাকে। সাবাব হীরের পাশে বসে হীরের ডান হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
—-” হীর কি হয়েছে? এমন পাগলামি করছিস কেন? কি হয়েছে হীর? বল আমায়! তাকা আমার দিকে! বল কি হয়েছে? এমন পাগলামি কেন করছিস বলতো? নিজকে হঠাৎ এভাবে আঘাত কেন করছিস?”
হীর কান্নাভেজা চোখে সাবাবের দিকে তাকালো। কান্নায় ভেঙে পড়া কন্ঠে বলল,
—-” আমার জন্য ফিরোজ ভাইটা মরে গিয়েছে গো! আমার জন্য মরে গিয়েছে।”
কথাটা বলে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল হীর। হীরের এমন কান্না দেখে সাবাবের বুকে তীর গেঁথে যাচ্ছে! বুকের ভেতরটায় তীব্র ব্যাথার সূচনা ঘটছে। মেয়েটা ফিরোজ ফাইয়ের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছে না। ও ভাবছে ফিরোজ ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য ও নিজে দায়ী। কিন্তু এটা ভুল!
সাবাব কাঁপা কাঁপা হাত দুটো হীরের গালে আলতো করে রাখল। কান্নায় ভিজে যাওয়া হীরের চোখ দুটোতে হাত রাখতেই হীর সাবাবের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো গালে। আবারও ডুকরে কেঁদে উঠে ঝাপটে পড়লো সাবাবের বুকে। সাবাব নড়ে উঠল কিছুটা। হীরের কান্নার শব্দে তার ভেতরটা নড়বড়ে করে দিচ্ছে। মেয়েটা এভাবে কেন কাঁদছে? কেন সামলাতে পারছেনা নিজেকে।
কিরন জড়ানো গলায় ঢোক গিলল। হীরের এমন কান্না দেখে তার চোখ জোড়াও টলমল করছে। কান্না যেন না আসে সেই ভাবনা নিয়েই গাল ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিরনকে নিজেকে সামলাতে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো মাহদী এবং আভিক। দু’জনে কিরনের দু’পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখল। কিরন ঢোক গিয়ে তাদের দিকে মুখ উঁচিয়ে তাকাতেই তারা চোখের ইশারায় বুঝালো ‘প্লিজ ডোন্ট ক্রাই।’ কিরন জোরপূর্বক হেসে দু’হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে ফেললো। আবারও গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে হীরের দিকে তাকালো। হীর সাবাবের বুকে পড়ে কেঁদেই চলেছে। সাবাবের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। হীরকে সামলাতে গিয়ে সে নিজেও যেন কেঁদে ফেলবে এবার। তবুও নিজেকে শক্ত করার বৃথা চেষ্টা চালালো সাবাব। হীরের মাথায় তার থরথর করে কাঁপা হাতটা রেখে জড়ানো গলায় বলল,
—-” এভাবে কাঁদিস না প্লিজ লক্ষিটি। দেখ, এভাবে ভাবতে নেই কারোর মৃত্যু কারোর জন্য হয়। মানুষের মৃত্যু তো তখনই হয় যখন তার আয়ু শেষ হয়ে যায় তাই না? তাহলে মানুষ কেন ভাববে আমার জন্য ও মরে গিয়েছে? এটা ভাবা ঠিক না হীর। শোন আমার কথা? দেখ ফিরোজ ভাই মারা গিয়েছে কারন তার আয়ু ঐটুকুই ছিল। অন্যথা তার সাথে ওমন একটা দুর্ঘটনাও হতো না আর সে মারাও যেতো না। এই এক্সিডেন্টটা তার মৃত্যুর ছোট্ট একটা মাধ্যম! সে মারা যাবে বলেই কিন্তু ওমন একটা পরিস্থিতিতে সে পরেছিলো। আচ্ছা তুই ভাবতো? এর আগেও বাইরে থেকে তোর উপর যে এট্যাকগুলো হয়েছিলো সেগুলোর সময় কি ফিরোজ ভাইয়ের কোনো সমস্যা হয়েছে? সে কি মারা গিয়েছে? সামান্য এক্সিডেন্ট হয়ে হাত-পা কেটেছে। এইতো? আর তো কিছু হয়নি তাই না? তাহলে আজ কেন হলো? কারন তার আয়ু এই টুকুই ছিলো! আর তার মৃত্যুর কারন হয়তো এটাই হওয়ার ছিলো! তাহলে তুই কেন ভাববি ফিরোজ ভাইয়ের মৃত্যু তোর জন্য হয়েছে? হীর ফিরোজ ভাইয়ের মৃত্যুর এই কারন টা কেবল এক উছিলা। একটা মাধ্যম! আজ তোর জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও ফিরোজ ভাইয়ের মৃত্যুটা হতো! কারন তার ভাগ্যে এটাই ছিলো।”
হীর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
—-” না! আ,,মি কিছু জানিনা! ফিরোজ ভাই আমার জন্য মারা গিয়েছে। ওর বউ বাচ্চা সবাই আমার জন্য ফিরোজ ভাইকে হারিয়েছে। ওরা আমাকে কোনো দিনও ক্ষমা করবেনা ভাইয়া। কোনো দিনও ক্ষমা করবেনা।”
‘সাবাব! কি হয়েছে হীরের!’
দরজার কাছ থেকেই ভেসে আসলো নাজমা বেগমের গলা। মায়ের গলা কানে ভাসতেই স্বস্তি পেলো সাবাব। মাকে ডাকবে বলে পেছন তাকাতেই হাওয়ার বেগে ছুটে এলেন নাজমা বেগম। হীরের এমন অবস্থা দেখে তার বুকটা কেঁপে উঠলো। হীরকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন,
—-” কি হয়েছে মা? কি হয়েছে? কাঁদছো কেন তুমি? কি হয়েছে!”
বড়মাকে কাছে পেয়ে হীরের দুঃখটা যেন আরও মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠল। আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে বড়মাকে জড়িয়ে ধরে একই কথা বলতে লাগল। ‘আমার কারনে ফিরোজ ভাই চলে গেলো বড় মা! ওর বাচ্চাটা অনাথ হয়ে গেলো বড় মা! ওর বউ তার সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে হারিয়ে ফেললো।’
নাজমা বেগমও অসহায় হয়ে পড়লেন। সাবাবের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন কষ্টে তার পুরো মুখ রক্ত বর্ন ধারন করেছে। চোখের ভেতরটায় টগবগ করছে রক্তিম আভায়। গলার দুটো রগ ফুলে উঠে সাবাবের চাপা কষ্টের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
মাহদী এবং আভিক কিরনকে ছেড়ে সাবাবের কাছে এসে দাঁড়ালো। সতর্কতার সহীত গলার স্বর নীচু করে আভিক বলল,
—-” স্যার, ডক্টরকে ডেকে নিয়ে আসবো? ম্যাম এভাবে পাগলামি করতে থাকলে কিন্তু তার মেন্টাল প্রেশার বাড়তে থাকবে।”
সাবাব মাথা ঝুঁকিয়ে ফেলল হঠাৎ। ভেতরের চাপা কষ্টটাকে গিলে খেয়ে গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। আভিকের কাঁধে হাত রেখে বলল,
—-” তাড়াতাড়ি যাও।”
অনুমতি পেয়ে মাহদী এবং আভিক দু’জনেই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো। সাবাব আর টিকতে পারল না হীরের কান্না দেখে। তাই সেও হুড়মুড় করে বেরিয়ে চলে গেলো বাইরে। কিরন পেছন থেকে হাত রাখল হীরের মাথায়। ছোট্ট শব্দে বলল,
—-” এভাবে কাঁদবেন না ম্যাডাম। এভাবে কাঁদলে আপনার মেন্টাল স্ট্রেস বাড়বে। পরে আপনাকেই আবার সাফার করতে হবে।”
নাজমা বেগম মুগ্ধ হলেন কিরনের স্বভাব সূলভ আচরণে। হীরকে আগলে ধরে বললেন,
—-” ওর মাথার কাছের বালিশটা একটু ঠিক করে দাও তো মা। আমি ওকে শুইয়ে দেই।”
কিরন মিষ্টি হেসে মাথা দুলালো। হীরের মাথার কাছের বালিশ টা ঠিক জায়গা মতো ফিট করে বলল,
—-” ম্যাডাম আপনি উনাকে আস্তে করে ধরুন আমি আপনাকে সাহায্য করছি উনাকে শুইয়ে দিতে।”
নাজমা বেগম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। হীরকে আস্তে আস্তে করে শুইয়ে দিয়ে তার পাশে বসলেন। হীর কাঁদতে কাঁদতে দুর্বল হয়ে পড়েছে কিন্তু এখনও শান্ত হতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতে বিরবির করে এখনও বলেই চলেছে ফিরোজের কথা। নাজমা বেগম নিজেকে শক্ত করলেন হীরকে সামলানোর জন্য। কিন্তু তার কোনো কথাই যেন হীরকে শান্ত করতে পারছেনা। এরই মধ্যে ডাক্তার নিয়ে হাজির হলো মাহদী আর আভিক। তারা ভেতরে ঢুকে সাবাবকে দেখতে না পেয়ে কিরনকে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করতেই কিরনও চোখের ইশারায় বোঝালে ‘সাবাব’ বাইরে চলে গিয়েছে। তাই তারাও আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে সাবাবের খোঁজে তারাও বাইরে চলে গেলো।
ডাক্তার হীরের এমন অবস্থা দেখে বোবা চোখে তাকালেন নাজমা বেগমের দিকে। কিরনের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন,
—-” পেসেন্টকে একা রেখে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?”
কিরনও বোবা চোখে তাকালো। কি বলবে বুঝতে না পেরে আমতাআমতা করে বলল,
—-” সরি স্যার।”
ডাক্তার কিরনের দিকে আর না তাকিয়ে হীরের হাতে ইনজেকশন পুশ করতে করতে আবারও বললেন,
—-” আপনার সঙ্গে আরেকজন যিনি ছিলেন উনি কোথায়?”
কিরনের সঙ্গে সাবাব আর কাউকেই ঠিক করেনি। তাই কিরন মিনমিনে গলায় বলল,
—-” আমি নিউ স্যার। উনারা আমাকে একাই নিয়োগ দিয়েছেন। আমার সঙ্গে আর কেউ নেই।”
ডাক্তার বিরক্ত মুখে তাকালেন। নাজমা বেগম দিকে একবার তাকিয়ে বললেন,
—-” এমন পেসেন্টের জন্য একজন নার্স কি করে ঠিক করেন আপনারা? মিনিমাম তিনজন হলেও তো আমরা মনে করি কম হয়ে যাবে। আজই উনার জন্য আরও একজন নার্স রাখার ব্যাবস্থা করুন। অন্যথা রিসেপশনে জানান তারাই ঠিক করে দিবেন।”
নাজমা বেগম হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন। ডাক্তার হীরের মাথার ব্যান্ডেজটার দিকে ইশারা করে বললেন,
—-” নতুন করে ব্যান্ডেজ করতে হবে। ব্যাবস্থা করুন?”
কিরন দ্রুত বেগে মাথা নেড়ে বলল,
—-” ওকে স্যার।
ব্যান্ডেজের কাপড় আর ম্যাডিসিন সবটা ডাক্তারের হাতে হাতে তুলে দিতেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই হীরের মাথায় নতুন করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন ডাক্তার। ততক্ষণে হীর শান্ত হয়েছে ইনজেকশনের ডোজে। আপাতত বেঘোরে ঘুমচ্ছে। কেবিনের ভেতর দ্রুত পায়ে ঢুকে এলো সাবাব। আর তার পেছন পেছন মাহদী আর আভিক। সাবাব হীরের ঘুমন্ত শান্ত মুখটা দেখে যেন স্বস্তি পেলো। মনের সব শঙ্কা দূর করে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
সাবাবকে ভেতরে আসতে দেখে ডাক্তার গম্ভীর মুখে তাকালেন। হীরের প্রেশার চেক করতে করতে বললেন,
—-” আপনারা পেসেন্টকে নিয়ে আরেকটু সিরিয়াস হন মি. সাবাব। উনাকে এভাবে একা রাখলে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে। আই নো দ্যট বাইরের লোকে পেসেন্টের লাইফ রিস্ক আছে! তাই আপনাদের চেনাজানা থাকলে, আই মিন বিশ্বস্ত কোনো মহিলা নার্স থাকলে পেসেন্টের জন্য নিয়ে আসুন। দেখুন, আমি কিন্তু বারবার বলছি পেসেন্টের মেন্টাল কন্ডিশন কিন্তু খুবই বাজে। একা থাকলে যেকোনো মুহুর্তে সে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। সো,বি সিরিয়াস।”
ডাক্তারের কথায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল সাবাব। ডাক্তার সম্মতি পেয়ে স্বস্তিময় হাসলেন। প্রেশার মাপার যন্ত্রটা গলার উপর থেকে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলন তিনি। ডাক্তারের যাওয়ার পানে তাকিয়ে নাজমা বেগম অসহায় কন্ঠে বললেন,
—-” সকাল থেকে তো সবটা ঠিকই ছিলোরে বাবা। হঠাৎ ফিরোজের কথা মেয়েটা শুনল কি করে? কে বলেছে ওকে?”
সাবাব হীরের দিকে একবার তাকালো। অতঃপর মায়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,
—-” ফিরোজ ভাইয়ের কথা ওকে কেউ বলেনি মা। ও নিজেই শুনেছে।”
—-” নিজেই শুনেছে!”
—-” হ্যাঁ নিজেই শুনেছে। তুমি যখন মাগরিবের নামাজ পড়বে বলে নামাজের রুমে গেলে তখনই ফিরোজ ভাইয়ের বাড়ির লোক এসে উপস্থিত হলো হসপিটালে। ফিরোজ ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে বলে তাদের খবর দেওয়া হয়েছিলো। সরাসরি জানানো হয়নি যে ফিরোজ ভাই মারা গিয়েছেন। তাদের বাড়ি থেকে এখানে আসতে প্রায় একদিনেরও বেশি সময় লেগে গেলো। আর এসে যখন জানতে পারলেন ফিরোজ ভাই আর নেই! ফিরোজ ভাইয়ের লাশ নিয়ে ফিরতে হবে তখন তারা আর নিজেদের সামলাতে পারলেন না। এই কেবিনের বাইরে বসেই তারা কান্নাকাটি শুরু করলেন! আর হীর সেটাই শুনতে পেয়েছিলো। ওদের কান্নাকাটি দেখে আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো হীর রুমে একা আছে।”
নাজমা বেগম কপালে হাত ঠেকালেন। বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—-” যার যায় সেই বোঝে হারানোর কি যন্ত্রণা।”
—-” ফিরোজ ভাইয়ের বৃদ্ধ বাবা-মা। সংসারে ইনকাম করার লোক একমাত্র ফিরোজ ভাই ছিলো মা! ওর বাবাকে দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল! কেমন করে কাঁদছিলেন বৃদ্ধ লোকটি।”
ছেলের অসহায়ত্বে ঘেরা মুখটি দেখে নাজমা বেগম হাত রাখলেন তার হাতের উপর। স্বান্তনা দিয়ে বললেন,
—-” আমরা তো আর ফিরোজকে ওদের কাছে ফেরাতে পারব না রে বাবা! কিন্তু ওদের সাহায্য তো করতে পারব বল? তুই এগুলো নিয়ে একদম মন খারাপ করিসনা! আমরা এই দুঃসময়ে ওদের পাশে দাঁড়াবো। আমরা যেভাবে পারি যতটুকু পারি ততটুকু দিয়ে ওদের সাহায্য করব। কেমন?”
সাবাব জড়ানো গলায় ঢোক গিলল। মাকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—-” হীর তো নিজেকে অপরাধী ভাবছে মা!”
নাজমা বেগম জোরপূর্বক হাসতে চেষ্টা করলেন। ছেলেকে আগলে ধরে বললেন,
—-” হীরের বড় মা এখনও বেঁচে আছে বুদ্দু। হীর কখনও কোনো কিছুতে নিজেকে অপরাধী ভাববে না! আমিই ভাবতে দিবো না বুঝলি।”
—-” তুমিই পারবে মা ওকে সামলাতে।”
—-” আমাকে যে পারতেই হবে বাবা।”
#চলবে____________________