#কাছে_দূরে ♥️?
#পর্ব_১১
হীর ফ্যাকাসে মুখে তাকিয়ে আছে। মাথা ভর্তি সাদা কাপড়ে মোড়ানো ব্যান্ডেজ। কপালটাও ঢেকে গেছে ব্যান্ডেজের কাপড়ে। ডান চোখের নীচ টা রক্তমুখো হয়ে আছে। একই ভাবে গালের প্রায় সব জায়গা গুলোতেই কালশিটে দাগ। ঠোঁটের বাম পাশে কালশিটে হয়ে ফুলে আছে। বাম হাতটা ব্যান্ডেজ করা। ডাক্তার বলেছেন হাতের কব্জির একটা হাড় আলাদা হয়ে গেছে। বেশি না সামান্যই। হীর বারবার চোখের পলক ফেলছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলো এখনও অনেকটাই ঘোলাটে তার কাছে। ডাক্তার তাকে চেক-আপ করছেন। ডাক্তারের চেক-আপ করা শেষ হতেই তিনি নার্সের হাতে হীরের রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশনের ফাইল গুলো তুলে দিয়ে সাবাবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—-” উনার সাথে বারবার গেদারিং করে দেখা করে চলবে না। দেখা করবেন শুধু একজন আর সময় যেন পাঁচ মিনিটের বেশি না হয়। এতে ওর শারীরিক কন্ডিশন বিগড়ে যেতে পারে। বুঝেছেন?”
সাবাব হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল,
—-” জি শিওর।”
ডক্টর বেরিয়ে যেতেই নাজমা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন,
—-” আ,,আমি থাকব আমার মেয়েটার কাছে। আ,,আমি থাকব।”
সাবাব মাকে আগলে ধরে বলল,
—-” মা,মা! মা শান্ত হও! প্লিজ শান্ত হও। হ্যাঁ তুমিই থাকবে হীরের কাছে। আমরা কেউ থাকবো না তুমিই থাকবে। কিন্তু এখন নয় মা। হীরকে আরেকটু সুস্থ হতে দাও তারপর না হয় থেকো। হীর আরেকটু সুস্থ হয়ে উঠলেই তুমি সারাক্ষণ ওর কাছে থাকবে। দেখলে না ডক্টর কি বলে গেলো? এই মুহুর্তে হীরের কাছে থাকাটা ওর জন্য রিস্ক মা।”
আজিম সাহেব বললেন,
—-” হ্যাঁ গো তুমি এভাবে পাগলামি করো না। দেখছো না মেয়েটার কি অবস্থা। এই অবস্থায় মানুষ জনের বেশি গেদারিং ওর জন্য ঝুঁকি!”
সানিয়া মাকে সামলে বলল,
—-” মা, তোমার মেয়ে একদম সুস্থ হয়ে যাবে বিলিভ মি। দেখো ও কিভাবে দেখছে আমাদের! এখন ও একটু রেস্ট নিক মা তারপর না হয় আমরা আবার এসে দেখা করব ওর সাথে। এখন প্লিজ চলো মা।”
নাজমা বেগম নড়লেন না। তিনি একই জিদ নিয়ে বসে পড়লেন হীরের পাশে। সে হীরকে ছেড়ে কিছুতেই যাবে না। তার ভয় সে হীরকে ছেড়ে এখান থেকে নড়লে হীরের আবারও বড় কোনো বিপদ ঘটবে। সে আর ঝুঁকি নিতে পারবেনা হীরকে নিয়ে! নাজমা বেগমকে বসে পড়তে দেখে একজন নার্স বাঁধ সেধে বলে উঠল,
—-” একি আপনি এখানে বসছেন কেন? আর আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন? প্লিজ সবাই এখন বাইরে যান। পেসেন্টকে আরেকটু সময় একা ছেড়ে দিন। সময় মতো আমরা আপনাদের ডেকে আনবো। এখন আপনারা সবাই বাইরে যান।”
নার্সের কথায় কপাল কুঁচকে এলো নাজমা বেগমের। তার বিপরীতে ধমক মেরে বলে উঠলেন,
—-” আমরা সবাই চলে যাবো আর সেই সুযোগে তোমরা আমার মেয়ের ক্ষতি করে দিবে তাই না। একদম কেউ আমার মেয়ের আশেপাশে আসার চেষ্টা করবেনা৷ আমি কিন্তু ওর মা হ্যাঁ? সবগুলোকে একদম কুপিয়ে হত্যা করে ফেলবো।”
নাজমা বেগমের বাজখাঁই গলায় চমকে উঠলেন উপস্থিত সবাই। নার্সরা একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,
—-” এ বাবা আপনি এসব কি বলছেন?”
সাবাব দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে মাকে ধরল। হীরের চিন্তায় নাজমা বেগম পাগল হয়ে যাচ্ছেন ঢের বুঝতে পারল সাবাব। তাই মাকে জড়িয়ে ধরে অসহায় কন্ঠে বলল,
—-” শান্ত হও মা। উনারা হীরের কোনো ক্ষতি করবে না। আমরা আছি তো আমাদের হীরের কাছে। এবার আর ওর কোনো বিপদ হবে না দেখো তুমি। বরং আমরা এখানে সবাই বসে থাকলে ওর অক্সিজেনের সমস্যা হতে পারে। কারন আমরা তো বাইরে থেকে এসেছি তাই না? তাই কি বলছিলাম বলো তো? তুমি এখন বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার এসো। ততক্ষণে হীরের রেস্ট নেওয়াও হয়ে যাবে আর এসে তুমি চটপট হীরের সাথে দেখাও করতে পারবে। প্লিজ মা…”
—-” যা যা, সবাই চলে যা এখান থেকে। দেখছিস না আমার মেয়েটার তোদের মাঝে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। সবাই বাইরে যা। আর এই যে সাদাজামা পড়া দু’জন? তোমরাও বাইরেও যাও। আমি আমার মেয়ের খেয়াল একাই রাখতে পারব।”
নাজমা বেগমের কথা শুনে সাবাব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাবার দিকে অসহায় চোখে তাকাতেই আজিম সাহেব না সূচক মাথা নাড়লেন। বুঝালেন, ‘নাজমা বেগমকে আপাতত কিছু বুঝিয়ে লাভ নেই! কারন সে বোঝার মানসিকতায় নেই’ সে এখন কিছুতেই এখান থেকে যাবেনা। তাই তাদের চলে যাওয়াই উত্তম।’ আজিম সাহেব সানিয়াকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। সাবাবও আর দাঁড়িয়ে না থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। নার্স দু’জন এখন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। নাজমা বেগমের কথায় তারা অবাক হয়ে রইল! সাবাব তাদের দিকে তাকিয়ে ইশারায় ছোট্ট করে সরি বলল। মায়ের এখন মাথার ঠিক নেই। কি বলতে কি বলে ফেলেছে হিসেব নেই। সাবাবের সরি বলায় কেউ আর রেগে রইল না। হা হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারাও ‘ইট’স ওকে’ বুঝাতো হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। সাবাব যেতে যেতে পেছন মুড়ে একবার তাকালো হীরের দিকে। কিছুক্ষণ আগে হীর ড্যাবড্যাব করে সবার দিকে তাকালেও এখন বেঘোরে পরে পরে ঘুমচ্ছে। ডাক্তারের দিয়ে যাওয়া হাইডোজের ইনজেকশন যথারীতি তার কাজ করছে। সাবাব ঘাড়টা আরেকটু বাকিয়ে মাকে দেখতেই দেখল চোখ ভর্তি জল নিয়ে মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে হীরের শুঁকনো মুখটার দিকে। কান্নার বেগে বারবার তার থুঁতনি কেঁপে উঠছে। ভেতর থেকে কান্নাটা চাপার বৃথা চেষ্টা চালাতেই গোঙানির মতো শব্দ হলো। তিনি এখনও পারছেন না হীরের অবস্থা মেনে নিতে। এই তো সকালেই মেয়েটা কতটা হাসিখুশি হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে ছিলো। যাওয়ার আগে তাকে জড়িয়ে ধরে কেমন বায়না ধরেছিলো? আর এখন? সেই হাসিখুশি বাচ্চা সুলভ মেয়েটা এই হসপিটালের শক্ত বিছানায় মরার মতো পরে আছে! এটা যে কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষও মেনে নিতে পারবে না।
মায়ের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে দেখেই বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল সাবাবের। আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে বড় করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বাইরে চলে গেলো সে। মাকে আর কিভাবে বোঝালে মা মানতে পারবে হীরের বিপদ কেটে গেছে। এবার ও আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে উঠবে।
সাবাবকে বাইরে বেরিয়ে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন আজিম সাহেব। সময়টা সঠিক না হলেও ছেলের থেকে তার অনেক জবাব চাওয়ার আছে। সে কার থেকে অনুমতি নিয়ে এমন একটা পেশা বেছে নিয়েছে তার জবাব তাকে দিতেই হবে। আর এক্ষনি দিতে হবে।
আজিম সাহেব সাবাবের দিকে পা বাড়াতেই সানিয়া অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,
—-” থাক না বাবা! আমাদের এমন একটা দুঃসময়ে তুমি ভাইয়ার প্রফেশনটা নিয়ে না হয় আর তর্ক নাই করলে। এটা নিয়ে আলোচনা করার জন্য সামনে অনেক সময় পাওয়া যাবে বাবা। প্লিজ…”
মেয়ের অনুরোধে ডেবে গেলো আজিম সাহেবের রাগ। মেয়ের পাশে বসে মেয়েকে বাহুডোরে আগলে ধরে বলল,
—-” মা রে, এই প্রফেশনটার জন্যই যে রিয়াদকে হারিয়েছিলাম আমি। যার জন্য এক কথায় আমি আমার কলিজা কেটে দু’ভাগ করে তার সামনে হাজির করতে পারতাম সেই ভাইকে হারিয়েছি এই নিষ্ঠুর পেশাটার জন্য! আর আজ দেখ আমার অবুঝ ছেলেটাও সেই পথেই হাঁটছে। ও রিয়াদের মতোই একই ভুল করছে!”
—-” আমি বুঝতে পারছি বাবা তোমার কষ্ট টা। কিন্তু বাবাইকে যারা মেরেছে তারা তো কেবল বাবাইয়ের এই প্রফেশনের জন্যই তাকে মারেনি তাই না? বাবাইকে মারার পেছনে আসল কারন তো আজও অজানা বাবা। তাহলে তুমি শুধু এই প্রফেশনটাকেই কেন দোষারোপ করছো?”
—-” না রে মা! অন্য কোনো কারন ছিলো না আমি জানি। ওর এই পেশার জন্যই ক্রিমিনালরা বরাবর ওর উপর ক্ষুব্ধ ছিলো। প্রতিশোধ নেওয়ার তাড়নায় একেকটা হিংস্র হয়ে উঠেছিলো। তাই তো প্রতিশোধের তাড়নায় আজও হীরকে মারতে চায় ওরা।”
—-” কিন্তু বাবা প্রফেশনের সূত্রে যদি বাবাইকে ওরা মেরেও ফেলে তাহলে ছোট মা আর হীরকে কেন মারতে চাইবে?”
—-” কারন ওরাও যে রিয়াদের অংশ। দু’জনেই ছিলো রিয়াদের প্রান ভোমরা।”
” তুমি ভুল বাবা!”
সামনে থেকে ভেসে আসল সাবাবের গলা। আজিম সাহেব এবং সানিয়া দু’জনেই বিস্মিত চোখে তাকালো সাবাবের দিকে। আজিম সাহেব সাবাবের কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন,
—-” মানে?”
সাবাব বাবার পাশের চেয়ারটাতে পিঠ ঠেকিয়ে বসল। বাবার দিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—-” বাবাইয়ের খুন কেবল এই পেশার জন্য হয়নি! বাবাইয়ের খুনের পেছনে লুকিয়ে আছে অসংখ্য রহস্য। যা বারোটা বছর ধরেও পরে আছে ধোঁয়াশায়। এই এরিয়াতে এই বারো বছরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিয়াদ আহমেদের কেস নিয়ে যত পুলিশ,জার্নালিস্ট বা গবেষক যারাই এসেছেন সবাই ব্যার্থ হয়ে ফিরে গিয়েছেন। তাই যেখান থেকে উপলব্ধি করো কতটা রহস্যে ডুবে আছে বাবাইয়ের খুনের ব্যাপারটা। পেশাটা বাবাইয়ের হলেও ছোট মা আর সেই ছোট্ট বাচ্চাটার কিন্তু কোনো দোষ ছিলো না বাবা। তবুও কিন্তু ছোটমাকেও মরতে হয়েছে। আর হীরকে আজও বারবার মৃত্যুর পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। সবচেয়ে ভাববার বিষয় হলো হীরের উপর এতোটা বিভৎস ভাবে এট্যাক হচ্ছে কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত। কেন? এখানেও রহস্য আছে বাবা। আর এই সব রহস্যের উদঘাটন যদি করতেই হয় তবে ঠিক বাবাইয়ের মতো করে ভাবতে হবে। বাবাইয়ের প্ল্যানে এগোতে হবে। আর প্রফেশন? সেটাও অবশ্যই বাবাইয়ের মতোই হতে হবে!”
আজিম সাহেব চোয়াল শক্ত করে বলে উঠলেন,
—-” তুমি কি চাও? তোমাকেও তোমার বাবাইয়ের মতো আমি হারিয়ে ফেলি?”
সাবাব মাথা নীচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—-” আমিও যে কোনো ভাবে হীরকে হারাতে পারব না বাবা! সেটা সেই বারো বছর আগেও বলেছি আর আজও বলছি।”
—-” সাবাব!”(রাগান্বিত হয়ে)
আজিম সাহেব চেতে উঠতেই সানিয়া হাত চেপে ধরল তার। অস্থির নয়নে একবার বাবার দিকে তো একবার ভাইয়ের দিকে তাকালো। করুন কন্ঠে বলল,
—-” কি করছো কি তোমরা? বাবা শান্ত হও তুমি! আর ভাইয়া তুই এখান থেকে যা তো প্লিজ। আর কথা বাড়াস না। যা!”
সাবাব উঠে প্রস্থান করল তৎক্ষনাৎ। আজিম সাহেব ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
—-” বারোটা বছরে ছেলেটা একটুও পরিবর্তন হলো না?”
______________________
মালয়েশিয়া থেকে কল এসেছে। নাজমা বেগম ফোন হাতে নিয়ে বোবা চোখে তাকিয়ে আছেন ফোনের দিকে। ফোন বেজে যাচ্ছে কিন্তু তিনি তুলতে পারছেন না। তার সাধারণ জ্ঞান শক্তি যেন লোপ পেয়েছে। আজিম সাহেব অবাক চোখে তাকালেন বউয়ের দিকে। তার গতিবিধি অস্বাভাবিক লাগতেই ফিচেল গলায় প্রশ্ন করলেন,
—-” কে ফোন করেছে গিন্নি?”
নাজমা বেগম স্বামীর কন্ঠ শুনে চমকে উঠলেন। নড়েচড়ে উঠতেই মনে হলো তার ফোন বাজছে। ঝটপট ফোনটা কানে তুলতেই ওপাশ থেকে কারোর বাজখাঁই গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো,
—-” মেয়েটাকে আপনারা না মেরে ক্ষান্ত হবেন না তাই না নাজমা আপা? ওকে ভালোবেসে আপনারা এতো আগলে রেখেছেন যে প্রতিনিয়ত ওর ওপর এট্যাক হয়েই যাচ্ছে আর আপনারা থামাতে পারছেন না!”
নাজমা বেগম শুঁকনো গলায় ঢোক গিললেন। কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন,
—-” সামান্য একটা ভুলে মেয়েটা আজ এতো বড় বিপদের সম্মুখীন হয়েছে মনিকা। কিন্তু বিশ্বাস করো আম…”
—-” সামান্য একটা ভুলে আজ মেয়েটা নিঃশেষ হয়ে যেতে পারত আপা! আমি সবসময় বলি মেয়েটাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন পাঠিয়ে দিন কিন্তু আপনারা কি করলেন? ওকে ভালো রাখবেন বলে জোর করে রেখে দিলেন! আরে দায়িত্ব যখন নিয়েছেন তখন ঠিক ভাবে পালন কেন করতে পারেন না?”
—-” তুমি আমাদের ভুল বুঝছো মনি…”
—-” ভুল বুঝছি না আপা। যা দেখছি যা শুনছি তাই বলছি! আপনি ভাবুন না আজ ওর মা বেঁচে থাকলে কি আপনারা ওকে আপনাদের কাছে রেখে দিতে পারতেন? দিনের পর দিন আপনারা ওকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারতেন?”
—-” আমি ওর মায়ের মতো মনি। তুমি কি এটা বিশ্বাস করো আমি ওকে বিপদের মুখে ঠেলে দেই?”
—-” দিচ্ছেনই তো। না দিলে মেয়েটা আজ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করত বলুন তো? আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না আপা! হীর একটু সুস্থ হতেই ওকে মালেশিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা করুন আপনারা! ভালো হোক মন্দ হোক আমার বোনের মেয়ে আমার কাছেই থাকবে। আশাকরি এখানে ওর কোনো শত্রু থাকবে না!”
নাজমা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে ঢোক গিললেন। তার গলা কাঁপছে। হীরের মনির বিরুদ্ধে আর কিছু বলার শক্তি সে পাচ্ছে না৷ তবুও নিজের মাঝে শক্তি জুগিয়ে কিছু বলতে নিলেই মনে হলো তার কানে ফোনটা নেই। তিনি চমকে উঠে হাতের দিকে দেখতেই বুঝল ফোনটা এতক্ষণে অন্য কারোর হাতে চলে গিয়েছে। নাজমা বেগম পাশ ফিরে তাকাতেই আবিষ্কার করল তার ছেলেকে। তার ফোনটাও সাবাবের মুঠোবন্দী হয়ে আছে। ছেলেকে ডাকবেন উদ্দেশ্যে নিয়ে তাকাতেই সাবাব শক্ত গলায় বলে উঠলো,
—-” হীর যতটা তার বড়মায়ের কাছে নিরাপদ ততটা সে তার মায়ের কাছেও নিরাপদ নয় মনি। সো মাকে ব্লেম করা বন্ধ করো। আর যারা হীরকে এট্যাক করেছে তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য হীরকে মেরে ফেলা! তাই হীর কে যদি নিয়ে পাতালপুরীতেও লুকিয়ে রাখা হয় তবুও ওরা সেখানেও পৌঁছে যাবে। তাই তুমি নিজেও শিওর জানবে না হীর তোমার কাছে গেলে সেফ থাকবে কি না! আর সবচেয়ে বড় কথা, হীরের বড়মা তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। হীর যদি কখনও জানতে পারে হীরের অসুস্থতার জন্য তার মনি মালেশিয়া থেকে কষ্ট করে কল দিয়ে তার খোঁজ না নিয়ে শুধু তার বড়মাকে অপমান করেছে তখন আমার মনে হয়না হীর কখনও তোমায় আপন ভেবে কাছে টেনে নিবে। আমার মনে হয় হীরের ন্যাচার তোমার অনেকটাই জানা।”
হীরের মনি চুপসে গেলো সাবাবের কথা গুলো শুনে। মুহুর্তেই গলার স্বর মিইয়ে নিয়ে বলল,
—-” কি করব বলো বাবা? মেয়েটার এই অবস্থা শুনে তো আমার মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। পাগলের মতো অবস্থা হয়েছে আমার। পারলে তো আজই চলে আসতাম আমার মেয়েটার কাছে৷ কিন্তু আজই আশা তো সম্ভব নয় কিন্তু আসব। খুব শিঘ্রই আসব। মেয়েটার প্রতি খেয়াল রেখো তোমরা। ওর দায়িত্ব কিন্তু তোমাদের উপর সাবাব।”
সাবাব বাঁকা হেসে বলল,
—-” একদম নিশ্চিন্ত থাকো মনি। হীর এবং তার শত্রু দুটোর প্রতিই আমার তীক্ষ্ণ নজর। একজনকে সেফ করতে পারলে অন্যজনকেও থাবা মেরে ধরতে আমার সময় লাগবে না।”
ওপাশ থেকে মনির আর কোনো শব্দ পাওয়া গেলো না। কল কাটার শব্দ ভেসে আসল কেবল। সাবাব ফোনটা কান থেকে নামিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। নাজমা বেগমের চোখে জল এখনও বিদ্যমান। সাবাব ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ঘুমন্ত হীরের দিকে ইশারা করে বলল,
—-” যে যাই বলুক মা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হীর তোমাকে ছেড়ে কোনোদিনও কোথাও যাবে না। কারন সে তার বড়মাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে।”
নাজমা বেগম ফুঁপিয়ে উঠে মুখে হাত চাপলেন। আজিম সাহেব একগাল হেসে বললেন,
—-” আমিও সেটাই বিশ্বাস করি। আর এও বিশ্বাস করি আমার গিন্নি তার দুই সন্তানের চেয়েও হীরকে বেশি ভালোবাসে।”
নাজমা বেগম কান্না ভেজা গলাতেই হাসলেন। সাবাবের গালে হাত রেখে বললেন,
—-” হীরটা যে আমার প্রান বাবা। ওর কিছু হলে আমার কলিজা ফেটে যায়।”
সাবাব মায়ের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
—-” চিন্তা নেই রাজমাতা। আপনার রাজ্যের সবচেয়ে দামী জিনিসটা কেউ কখনও আপনার থেকে কেড়ে নিতে পারবেনা। এই আপনার চ্যালা। সর্বদা তাকে প্রটেক্ট করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে।”
নাজমা বেগম তৃপ্তিময় হাসলেন। চোখের জল মুছে হীরের দিকে তাকাতেই দেখল হীর পিটপিট করে দেখছে তাকে। তার বুকের ভেতরটায় শীতল হাওয়া বয়ে গেলো যেন। অস্থির হয়ে উঠে হীরের আরেকটু কাছে এগিয়ে যেতেই হীর শুঁকনো মুখে ডেকে উঠলো,
—-” বড়মা…. ত,,তুমি এস,,এসেছো?”
হীরের প্রশ্নে যেন তীর বিঁধে গেলো সবার বুকের ভেতর। আটঘন্টা অবজারভেশনে রাখার পর এই প্রথম কথা বলল হীর। এর আগে চোখ খুলে তাকালেও কাউকে ডাকেনি সে৷ চিনতেও পারেনি কাউকে। কিন্তু এখন চিনতে পেরেছে দেখে যেন খুশির জোয়ারে ভেসে উঠল সবাই। নাজমা বেগম মুখে হাত চেপে আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলেন। হীর যে সর্বপ্রথম তাকেই ডাকবে সেটা যেন তার কল্পনাতীত ছিলো। সাবাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাকে বলল,
—-” দেখো মা? তোমার হীরপরি চোখ খুলে সর্বপ্রথম কিন্তু তোমাকেই ডাকল।”
নাজমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়লেন। হীরের হাতের উপর হাত রেখে কান্না ভেজা গলায় বললেন,
—-” এই তো মা। বড় মা এসেছে তো তেমার কাছে। দেখো? এই তো বড় মা।”
হীর ঢোক গিলল। ফ্যাকাসে মুখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ ভীত কন্ঠে বলে উঠলো,
—-“ও,,ওরা আমায় মার,,তে এসেছি,,লো বড়মা…”
সাবাবের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল হীরের কথা শুনে। হীর এখনও সেই মুহুর্তটা নিয়ে পরে আছে৷ ভয় পাচ্ছে কিন্তু ভয় পেলে তো হীরের শারীরিক মানসিক দুটোরই অবস্থা খারাপ হয়ে উঠবে। না, হীরকে বোঝাতে হবে। ঐ ঘটনা থেকে হীরকে বের করতে হবে।
—-” হীর লুক এট মি? দেখ আমার দিকে? আমি কিন্তু ওদের সবগুলোকে একদম মেরে থানায় ভরে দিয়ে এসেছি! ওরা কিন্তু কেউই আর বাইরে নেই। সবাই থানায় বসে এখন কান্নাকাটি করছে। ওরা আর তোর কাছে আসতে পারবেনা। বুঝতে পেরেছিস আমি কি বলছি? ওরা কিন্তু কেউ আর তোর আশেপাশে আসতে পারবেনা। শুধু আজ কেন? আর কখনই আসতে পারেনা!”
হীর ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে সাবাবের কথা গুলো গিলে নিলো। হয়তো বুঝল আবার হয়তো বুঝল না! শুধু তাকিয়ে থেকে বলল,
—-” সত্যিই আসবে না?”
সাবাব মিষ্টি হেসে বলল,
—-” গড প্রমিজ সত্যি আসবে না। আর আসলেও আমি মুখোমুখি হয়ে লড়াই করব তাদের সাথে। চলবে না?”
হীর চোখ ঝাপটে মুচকি হাসল। নাজমা বেগম স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
—-” চলো আমরা বাইরে গিয়ে ডাক্তারের সাথে একটু কথা বলে আসি। মেয়েটার তো ক্ষিদে পাবে। তা ক্ষিদে পেলে ওকে কি খাবার দেওয়া যাবে সেটা জানতে হবে না?”
আজিম সাহেব ভাবুক কন্ঠে বললেন,
—-” হ্যাঁ হবে তো। চলো।”
নাজমা বেগম আর আজিম সাহেব বের হয়ে যেতেই সাবাব হীরের পাশে বসল। হীরের হাতের উপর হাত রেখে মনে মনে ভাবল,
—-” তুমি এখন ইনজেকশনের হাই পাওয়ার ডোজের ঘোরে আছো হীরপাখি। জানি এখন তোমার সাথে যে কথাই হবে তার সবাটাই কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে ভুলে যাবে তুমি। তাই আপাতত তোমার সাথে কথা বলতে কোনো সংকোচ নেই। তোমায় মন ভরে দেখলেও তোমার ভ্রু কুঁচকে ফেলা দৃশ্যটার আর দেখা মিলবে না। তুমি সন্দিহান গলায়ও প্রশ্ন করবে না ‘কি দেখছো এভাবে তাকিয়ে?”
—-” কি দেখছো এভাবে তাকিয়ে?”
সাবাবের ভাবনার মাঝেই হীর প্রশ্ন ছুড়ল সাবাবের দিকে। তবে তা সন্দিহান গলায় নয়। বাচ্চাসুলভ গলায়। সাবাব মুচকি হেসে হীরের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে বলল,
—-” তোমাকে দেখছি।”
হীর ঠোঁট উল্টে বলল,
—-” আমাকে দেখে কি হবে?”
—-” তোমাকে দেখে আমার মনের শান্তি মিলবে। প্রশান্তি পাবো আমি। বেঁচে থাকার আরেকটা কারন উদঘাটন করতে পারব। সারাজীবন ভালো থাকার কারন খুঁজে পাবো। সবটা,সবটা এই তোমার মাঝেই লুকিয়ে রেখেছো তুমি। সেটাই তাকিয়ে থেকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।”
“এক্সকিউজ মি স্যার।”
পেছন থেকে ভেসে আসল নার্সের গলা। সাবাব বিরক্তিতে চোখ বুঁজে ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। হীরের হাতটা আস্তে করে নামিয়ে রেখে ঘাড় ফিরিয়ে নার্সের দিকে তাকাতেই নার্স দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিলো। অতঃপর লজ্জা পাওয়ার ভান করে ছুটে চলে গেলো বাইরে। এইবার নিয়ে এই একই কাজ মেয়েটা সাতবার করে ফেলল। সাবাব এবার চরম বিরক্ত। মেয়েটাকে বাদ দিতে একটা রিপোর্ট তাকে করতেই হবে।
#চলবে____________________