বিবর্ণ_বসন্ত বিশ পর্ব

0
578

#বিবর্ণ_বসন্ত
নুসরাত জাহান লিজা
বিশ পর্ব

আটাশ.
আবিদের এরকম প্রাণোচ্ছল হাসিতে অন্বেষা এতটা বুঁদ হয়ে রইল যে অবচেতনেই বলে ফেলল,
“এত সুন্দর হাসিটা লুকিয়ে রাখেন কেন আপনি? এই হাসিতে চেয়ে চেয়ে তো সহস্র বছরও কাটিয়ে দেয়া যায়!”

ওর দৃষ্টি তখন স্থির হয়ে আছে ওই উচ্ছ্বসিত মুখটাতে! হাসি মুখের বুঝি এক অদ্ভুত শক্তি থাকে, নিমিষেই আশেপাশের মানুষের মনও ভালো করে দেয়, আর নিজের ভেতর জমে থাকা পাথর ভারকেও হালকা করে দেয় এক নিমেষে কোনো এক মায়াবলে!

আবিদ সহসা নিজেকে আবৃত করে নিল গাম্ভীর্যের চাদরে। এত বছরের অনভ্যাসে কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছিল, কিছুটা অস্বস্তিকরও লাগছে, অন্বেষার এমন কথায় আর মুগ্ধ দৃষ্টিতে তা বেড়েছে কয়েকগুণ! বহুবছর এভাবে প্রাণ খোলা হাসি হাসতে পারেনি ও, মাঝে পেরিয়ে গেছে যুগেরও অধিক সময়। এখনও কী তবে কিছুটা প্রাণ, কিছুটা রং ওর মধ্যে অবশিষ্ট আছে? ক্ষয়ে যায়নি সবটা, চাপা পরে রয়েছে হয়তো হৃদয়ের গহীন প্রকোষ্ঠে! দ্বিধান্বিত হয় ওর মন!

আবিদের অভিব্যক্তি বদলে যেতেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নিজের ভুলটা অনুধাবন করতে পারল অন্বেষা, বিশাল বড় ব্লান্ডার করে ফেলেছে! কোথা থেকে যেন একরাশ লজ্জা এসে ভর করল, কিছুক্ষণ তো চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারল না! নিজেকে মনে মনে খুব করে চোখ রাঙিয়েছে ও সাথে কিছু উপদেশ বাণী,
“ছিঃ! এসব বলার কী দরকার ছিল! কী না কী ভাবলেন উনি! এতটা নির্লজ্জ কেউ হয়!”

সাথে চোখকেও শাসায়, বেহায়ার মতো ওভাবে তাকিয়ে ছিল বলে। এই সাতাশ বসন্ত পেরিয়ে আসা জীবনে এরকম লজ্জা কখনোই পায়নি ও, এতটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েছে বলেও মনে করতে পারল না! কী লজ্জা! কী লজ্জা! মাথা কাটা গেল একেবারে!

এখন যদি আবিদ ওকে ভুল বোঝে, ভীত হয় অন্বেষা! আবিদ কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেও নির্বিকার বসে রইল। অন্বেষার মনোভাব টের পেয়ে কিছুটা সময় দিল ধাতস্থ হবার জন্য।

ততক্ষণে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে টকটকে লালচে সূর্য, দিগন্ত জুড়ে তখন গোধূলির সাজ। লালচে কণে দেখা আলোতে চারপাশটা বড্ড মায়া মায়া! মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে পত্র পল্লব। আজ বিকেলটা সত্যিই ভীষণ মিষ্টি। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ছেয়ে আছে অন্বেষার পুরো মন, সমস্ত সত্তা! আসলেই সবটা এত সুন্দর নাকি ওর দেখার চোখ বদলে গেছে! ভেবে পায় না ও!

আড়ষ্টতা কাটিয়ে অন্বেষা বলল, “আপনি আমার উপর এখনও রেগে নেই তো? এইসব এলেবেলে কথা মনে রেখে কষ্ট পাবেন না, প্লিজ।”
আবিদ নিজের চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “আমি মোটেও রেগে নেই। আমি সত্যটা সহজভাবে নিতে পারি, তা যতই কঠিন হোক।”

“আপনি কিন্তু আবারও আগের কথাগুলো তুলছেন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমাকে কেউ ভুল বুঝলে অসম্ভব কষ্ট হয়। ভুলে যান না…”

আর কিছু বলতে পারল না, তার আগেই গলাটা ভেঙে আসল, চোখের কোনে পানি জমল, উথলে উঠা কান্নার জল প্রাণপণ চেষ্টায় গড়িয়ে পড়া থেকে রক্ষা করছে ও, কতক্ষণ পারবে জানে না। আজকাল হঠাৎ হঠাৎ এত কান্না পায় কেন? ছিঁচকাঁদুনে তো কখনো ছিল না সে! তবে এখন চোখ বেয়ে এত সমুদ্র জল নামে কী করে?

অন্বেষার ব্যকুলতা আবিদকে স্পর্শ করল, তাই আস্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, “আচ্ছা, পুরনো কথা বাদ দিই না-হয়, তুমিই কিন্তু এখন রামগরুড়ের ছানা হয়ে গেছ!”

সহসা হাসল অন্বেষা কিছুটা, কয়েকদিনের জমানো জগদ্দল পাথরটা যেন সহসা সরে গেল। কিছুটা শান্তি লাগছে এখন। ওকে হাসতে দেখে আবিদ আস্বস্ত হলো কিছুটা।

“আপনি এরকম হালকা চালের কথাও বলতে পারেন? ” গলায় বিস্ময় ফুটিয়ে অন্বেষার প্রশ্ন।

আবিদ আবারও কিছুটা হাসল, আর অন্বেষা আবারও বিমুগ্ধ নয়নে ডুবে গেল সে হাসিতে। অতসী ঠিকই লিখেছিল, এই ছেলের অদ্ভুত সৌন্দর্য হলো ওর হাসিতে সারল্য মাখা, শিশুর সারল্য! ঘোর লেগে যায়! যা কিছু সরল তাই ভীষণ সুন্দর!

“আমি কীভাবে বুঝতে পারব যে আপনি আমার স্যরি এক্সেপ্ট করেছেন?” ঘোর থেকে বেরিয়ে প্রশ্ন করে অন্বেষা।

“তুমিই না হয় বল তোমার গিল্টি ফিলিংটা কাটানোর জন্য আমাকে কী করতে হবে?”
মেয়েটার মধ্যে কোন কিছুতে লেগে থাকার আশ্চর্য একটা প্রবণতা আছে, কিছুতেই হাল ছাড়ে না! এই স্বভাবটা আবিদ এতদিনে পড়ে ফেলেছে, তাই জানে পাশ কাটিয়ে পার পাওয়া যাবে না।

কিছুক্ষণ ভেবে অন্বেষা প্রচন্ড দ্বিধা, সংকোচ আর একবুক ঢিপঢিপানি নিয়ে সাহসে ভর করে প্রস্তাব করে বসল,

“আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে, যদি বন্ধুত্বে রাজি থাকেন তবেই মনে করব আপনি আমার বলা কথাগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন।”

এরকম প্রস্তাবে আবিদ যেন বিস্ময়ের শেষ সীমা অতিক্রম করেছে, এরকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কতক্ষণ, এরপর বলল,
“আমাদের বয়সের কত ফারাক তোমার জানা আছে? চল্লিশের কোটা পেরিয়েছি এক বছর আগে।”

“তাতে কী, আমারও তো সাতাশ, ত্রিশের কোটা পেরোব আর তিনবছর পরেই।” আবিদের ভঙ্গি অনুকরণ করল ও।

“মন যদি সজীব থাকে তবে বয়স শুধুই সংখ্যা। আর এটা এমন বড় কোন ডিসট্যান্স নয়! তাছাড়াও শুনেছিলাম লেখকরা মনের দিক থেকে চিরতরুণ হয় আর মুক্তমনা হয়। কী জানি! আমি হয়তো ভুল শুনেছি তবে!” আবারও বলে ও।

“কেউ কি এর আগে তোমাকে বলেছে যে তোমার মাথায় বিশাল বড় রকমের গন্ডগোল আছে?” আবিদের চোখে স্পষ্ট রাগ।
“হ্যাঁ, সবাই বলে। আর আমিও জানি যে আমার মাথায় ছোটখাটো গন্ডগোল আছে। আরে, আমিতো শুধু বন্ধুত্বই করতে চেয়েছি, কিন্তু আপনার এক্সপ্রেশন দেখে মনে হচ্ছে আপনার সব সহায় সম্পত্তি বুঝি আমি কেড়ে নিচ্ছি!” হেসে বলল অন্বেষা।
থেমে ভ্রু নাচিয়ে চিন্তিত গলায় বলল, “নাকি এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি আমাকে?”

“এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, আমি তোমার সাথে ভাল করে কথা বলি এর মানে এই নয় যে বন্ধুত্ব করতে হবে নাকি? সবকিছুর একটা লিমিট থাকা উচিত।” কিছুটা কড়া গলায় আবিদ বলল।

ক্ষণেই অন্বেষার হাসিমুখ ম্লান হলো, ওর ব্যক্তিত্বে লাগল আবিদের কথাগুলো। আজকের পরে আবিদের কাছে আসার আর কোন উপায়ই থাকবে না, এটা ভেবেই চিন্তিত ছিল ও। তাই সাতপাঁচ না ভেবেই বাড়িয়ে দিয়েছিল বন্ধুত্বের হাত। কখনোই কারো কাছে এতটা কাতর আর্তি জানায়নি ও, শুধু বন্ধুত্বের আহবানই তো ছিল কেবল, নির্জলা বন্ধুত্ব! তাতেই এতটা! সাত সমুদ্রের ঢেউ একসাথে আছড়ে পড়ে ওর ভেতরের অনুভূতি দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে যেন! ভালোবাসার আহবানে আবিদের প্রতিক্রিয়া কী হবে ভাবতেই শিউরে ওঠে অন্বেষা! কিন্তু এখন তো ওর কিছু করার নেই, আবিদে তো ও একেবারে আকণ্ঠ ডুবে গেছে! ওরও কি তবে পুড়তে হবে ভালোবাসা না পাবার দহন জ্বালায়!

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “আসি আমি, আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি। শেষবারের মতো বলছি, স্যরি।”

ঘুরে দাঁড়াতেই আবিদের ডাকে থমকে গেল, “অন্বেষা, তুমি বুঝতে ভুল করছ। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি বলেই আমার একেবারে গহীনে লুকায়িত যন্ত্রণা তোমার সাথে শেয়ার করেছি। আজ পর্যন্ত যেটা কখনো করিনি আমি। আজ থেকে আমরা বন্ধু। এবার খুশি তো?”

অন্বেষার অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো অতসীর কান্নাভেজা আহবানকে মনে করিয়ে দিয়েছিল মুহূর্তের জন্য। কোন এক সময়ের বন্ধু অন্ত প্রাণ, আড্ডা মাতানো আবিদের সেই সত্তা মরে গেছে সেই কবে! প্রাণোচ্ছল উদ্ভাসিত ছেলেটি কবেই অন্তর্মুখী হয়ে গেছে, নিজেকে আবৃত করে নিয়েছে বিষন্নতার খোলসে! এই খোলসে এখন বড্ড বেশিই হাঁসফাঁস লাগে। মনটা এতটাই বুড়িয়ে গেছে যে সবটা বড্ড বর্ণহীন, একেবারে ধূসর!

দেড়যুগ পরে কেউ বাড়িয়ে দিয়েছে বন্ধুত্বের হাত, প্রথমে দ্বিধা থাকলেও সম্মতি জানাল এই ভেবে যে শুধুই বন্ধুত্ব এটা। তাছাড়াও একাকিত্বের ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেছে হৃদয়, ক্লান্তি ওকে জড়িয়ে নিয়েছে আষ্টেপৃষ্টে! মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে খুব। হোক না একজন যার সাথে হাসি কান্না ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়!

অন্বেষার খুশি যেন ততক্ষণে আকাশ ছুঁয়েছে, অসাধ্য সাধন করে ফেললে যে এতটা আনন্দ হয় ওর জানা ছিল না! ‘কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’ এই লাইনটাই গুনগুন করে কানে বাজতে লাগল অনবরত। আবিদের দুর্বোধ্য মনের খোঁজ করতে পারবে এবার। দুঃখ কখনো কারো জীবনে চিরস্থায়ী হয় না, কিন্তু এই লোক সেটাকে লালন করছে পরম যত্নে। যেন পণ করে নিয়েছে বিষাদের শহরে বাস করার, চিরকাল!

বিষাদপুত্রের মনের রুদ্ধ দরজা ও খুলবেই, এরপর তাতে ঢুকে পড়ে কষ্টগুলোকে সহস্র আলোকবর্ষ দূরে ছুড়ে ফেলবে আর চিরতরে বন্ধ করে দেবে সকল প্রবেশপথ আর যত ফাঁকফোকর! যাতে আর কক্ষনও ওরা বিষাদপুত্রের মনের নাগাল না পায়। অতসীর সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলোর পাশাপাশি আরও কিছু সুন্দর মুহূর্ত তৈরি করবে ও! এই পণ করল মনে মনে! শুদ্ধ হৃদয় হবে চির আনন্দময়, দুঃখ, যন্ত্রণা, বিষাদ শুদ্ধ সত্তায় বড্ড বেমানান!

আজকের দিনটা এত সুন্দর হবে, এতবড় প্রাপ্তি ধরা দেবে তা অন্বেষার কল্পনাতেও ভাবার সাহস পায়নি। মানুষ ঠিকই বলে হয়তো, একটা সুন্দর সকাল ঝলমলে দিনের প্রতিশ্রুতি দেয়। আবিদের বাসা থেকে বিদায় নেবার আগে ওর পারসোনাল নাম্বারটাও নিয়ে এসেছে। ওর তো সারাক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু তা কোনভাবেই সম্ভব নয়। পরে দেখা যাবে যেটুকু এগিয়েছে তাও নষ্ট হয়ে যাবে। তাই ধৈর্য ধরতে হয় ওকে।

ঊনত্রিশ.
পরের দিন অফিসে কাজ করার সময় মনোযোগ রাখতে পারছিল না কাজে, বারবার মন চলে যাচ্ছিল মাইল কয়েক দূরে বাস করা বিষাদপুত্রের কাছে! ভাবনায়, চিন্তায়, মস্তিষ্কে আবিদকে অনুভব করতে লাগল। কাজের কাজ কিচ্ছু হলো না! এরকম কোনদিন হয়নি। কারণ অন্বেষা কাজের প্রতি ভীষণ প্যাশনেট। তবে আজ কেন এসব হচ্ছে? ভালোবাসলে বুঝি এরকম হয়! কিশোরী সুলভ আবেশে ভাসতে থাকল পুরোটা সময় ধরে।

বাসায় ফেরার পথে রোজকার মতোই জ্যামে আটকা পড়ে অন্বেষা এফএম রেডিও চালিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল। হঠাৎ বেজে উঠল পুরনো সেই বিখ্যাত গান,

“সারাদিন তোমায় ভেবে হলো না তোমাকে পাওয়া
হলো না আমার কোন কাজ,
দিন যে বৃথাই গেলো আজ!”

আশ্চর্য! এই লিরিসিস্ট কী করে এত আগে ওর আজকের মনের অবস্থাটা বুঝে ফেলেছিল! ওর সমস্ত সত্তা জুড়েই যে এখন বিষাদপুত্রের বিচরণ! যার জন্য ওর এই আকুলতা, ব্যাকুলতা, উৎকণ্ঠা সে কবে বুঝবে? আদৌ বুঝবে তো! এ কী অনিশ্চয়তায় ডুবল ও! আবারও ভিজে আসছে চোখ, ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল দৃষ্টি!
……….
বাকিটা পরের পর্বে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here