ভালোবাসি_প্রিয়
বোনাস_পার্ট
#সুলতানা_সিমা
★
অভিমান হচ্ছে খুব খারাপ একটা জিনিস। না স্বাভাবিক হতে দেয় না কঠিন হয়ে থাকতে দেয়। হাজারো অভিযোগ মনের মধ্যে চেপে রেখে ধুকে ধুকে মেরে ফেলে। অভিমানের সবথেকে খারাপ দিক হলো চুপ থাকা। আমরা যখন কারো উপর রেগে যাই, তখন রাগটা খুব সহজেই ঝেড়ে ফেলতে পারি। গালি দিয়ে হোক চিল্লাচিল্লি করে হোক ভাংচুর করে হোক অথবা মারামারি করে হোক। রাগ ঝেড়ে ফেলাটা খুব সহজ। কিন্তু অভিমান? অভিমান এমন একটা বিষাক্ত কাটা যেটা গলায় আটকে থাকে। গলা থেকে কলিজা পর্যন্ত। কলিজা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় কিন্তু গলা দিয়ে তাঁর আর্তনাদ বের হয় না। ভিতরে ভিতরে শেষ করে দেয় নিজেকে। খুঁড়ে খুঁড়ে খায় কলিজাটা। কিন্তু প্রকাশ পায় না কিছুই। মন বলে পোড়ে যাই তবুও কোনো অভিযোগ করবো না আমি চুপ থাকবো। চুপ থাকেও সে।
ছাদের রেলিং ধরে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে অরিন। অভিমানের পাহাড়কে বার বার প্রশ্ন করে যাচ্ছে “তুমি এতো শক্ত কেন? কেন তোয়ায় ভাংতে পারিনা আমি? কেন পারিনা তোমার সাথে লড়ে জিততে? কেন বার বার তোমার জিত হয়।”
আজ লুপার বিয়ে। সবাই কত আনন্দ করছে সবাই। চারদিকে হৈ চৈ উল্লাস, কিন্তু অরিনের মনে কোনো আনন্দ নেই। ভিতরটা পোড়ে যাচ্ছে তাঁর। মন বলে একবার লুপাকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছে মতো পিঠিয়ে বলতে” শয়তান তুই কেন আমার সাথে বেইমানি করেছিলি।” কিন্তু পরক্ষণে মনে হয়, না! লুপা আমার কেউ না, কেন আমি অভিযোগ করবো তাঁর কাছে?
অরিন।” চির চেনা কন্ঠস্বর কানে আসতেই তৎক্ষণাৎ পিছন ঘুরে তাকাল অরিন। লাল রংয়ের একটা লেহেঙ্গা পরে আছে লুপা। কোনো সাঁজগোঁজ নেই। ওড়নাটা একপাশে রেখে আছে। কোঁকড়ানো চুল গুলা খুলা। অতিরিক্ত কান্না করার ফলে চোখ ফুলে আছে। চোখগুলা রক্তলাল। গাল বেয়ে তাঁর চোখের পানি পড়ছে। মূর্তির মতো চেয়ে আছে অরিনের দিকে। অরিন চোখ ফিরিয়ে নিলো। লুপা চট করে বসে অরিনের পা জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। অরিন পা ছাড়াতে চেষ্টা করে কিন্তু লুপা ছাড়েনা। “আমাকে ক্ষমা করে দে অরিন প্লিজ। আমি মরে গিয়েও শান্তি পাবো নারে যদি তুই আমাকে ক্ষমা না করিস। তোর দুটি পায়ে ধরি প্লিজ ক্ষমা করে দে। তোর সাথে অন্যায় করেছি আমি। যা শাস্তি দিতে হয় দে আমি মাথা পেতে নিবো, তবুও ক্ষমা করে দে প্লিজ।” কাঁদতে কাঁদতে লুপার হেঁচকি ওঠে গেছে। অরিনের কান্না থামাতেই পারছে না। কোনো রকম লুপার থেকে পা ছাড়িয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়।
লুপা বসে বসে কান্না করে যাচ্ছে। অরিন ছাদ থেকে চলে যেতে লাগলে, লুপা আবার পা আঁকড়ে ধরে। লুপা কাঁদতে কাঁদতে বলে “বন্ধুত্বের দাবীতে ক্ষমা চাইনা অরিন। বন্ধু নামের কলঙ্ক আমি। শুধু একজন অপরাধী হিসাবে ক্ষমা চাইছি প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দে। প্লিজ অরিন।” লুপার থেকে পা ছাড়িয়ে নেয় অরিন। কথা বলতে চাচ্ছে সে,কিন্তু পারছে না। অদৃশ্য একটা হাত তাঁর গলা টিপে ধরে আছে। কান্না আটকাতে চেষ্টা করেও পারছেনা আটকাতে। চোখের পানি মুছে লুপা কান্নাজড়িত গলায় বলল”
আমি ক্ষমা যোগ্য নই অরিন৷ ক্ষমা না করাটাই স্বাভাবিক। তোকে টর্চার করা,তোর উপর এট্যাক করা। কী না করেছি বল? সব করেছি আমি। আমি শুধু অপরাধী নয় রে। আমি পাপী। নিকৃষ্ট একটা মানুষ। জানিস আমার বোকা মা টাও মাঝে মাঝে আমায় কুকুরের সাথে তুলনা করে। আমার থেকে নাকি কেউ কোনোদিন ভালো শিক্ষা পাবেনা। সত্যিই তো বলে, আমি আবার কাকে কী শিক্ষা দেবো রে। আমি যে নিজেই খারাপ। জানিস অরিন, যখন এটা জানতে পারলাম তুই আর ভাইয়া একজন আরেকজনকে ভালোবেসে ফেলছিস,তখন আমি আর মুখোশধারী হয়ে তোর সামনে আসলাম না। আমি চাইলাম তুই থাক ভাইয়ার কাছে। ভাইয়ার সাথে সুখী হ এটার জন্য খোদার কাছে প্রার্থনা করতাম। আমি ধুকে ধুকে মরতাম তোর সাথে হওয়া অন্যায়ের জন্য। আমি শান্তি পেতাম না। নীলকে কতবার বলতে চাইলাম কিন্তু নীল শুনলো না। আমার কথা এড়িয়ে যেতো। কাউকে বলতে পারতাম না মনের কথাগুলা। জানিস অরিন,মনের চাপা কথা বলতে না পারার যন্ত্রণা থেকে কঠিন যন্ত্রণা দ্বিতীয় নেই। তোর সামনে যেতে লজ্জা করতো। ঘরের এতো অশান্তি ভালো লাগতো না। দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইলাম,কিন্তু আব্বু দেয়নি। জানিস, ওইদিন তোকে এটা বলতে ডেকেছিলাম, যে তুই মুক্তি আজ থেকে। তোর শেষদিন মানে এটা বুঝিয়েছিলাম, যে তোকে আর ব্ল্যাকমেইল করবো না। ”
এইটুকু বলে চোখের পানি মুছে লুপা। তারপর ছোট এক টুকরো কাপড়ে মোড়ানো কী একটা বের করলো। অরিনের দিকে বারিয়ে দিয়ে বলল”তোর ভালোবাসা অরিন। গত ছ’বছর ধরে আগলে রেখেছি।” লুপার কথায় কোনো ভাবান্তর ঘটেনা অরিনের। সে আগের মতোই আছে। লুপা অরিনের হাত ধরে হাতে এটা দিলো। অরিন হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়। লুপা আরো আঁকড়ে ধরে। লুপার চোখ তাঁর কোনো বাধা মানছে না। মুছার সাথে সাথে আবার ভিজে যাচ্ছে।
চোখের পানিটা মুছে একটা ঢোক গিলে লুপা বলল,” বন্ধুর যোগ্য নই আমি। বন্ধু বলে নিজেকে কখনো পরিচয় দিবোনা। দিহান ভাইয়ের একজন চাচাতো বোন হিসাবে অনুরোধ করছি,আমার বিয়ের সাঁজ টা সাজিয়ে দিবি? সরি আমার তো তুই বলারও অধিকার নাই রে৷ সাজিয়ে দেওয়া যাবে আমায়? রিকুয়েষ্ট করছি আমি প্লিজ।”
অরিন কিছু বলতে পারছে না। কান্নাটাও যেন আজ না থামার প্রতিক্ষা করেছে। অরিনের হাতে একটা চুমু খেলো লুপা। লুপার চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে এসে অরিনের হাতে পড়লো। অরিনের কান্নাটা আরো বেড়ে গেলো তাঁরও ইচ্ছে লুপাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে, কিন্তু পারছে না। নিষ্ঠুর অভিমানের কঠিন পাহাড় তাকে বাধা দিচ্ছে। লুপা বলল,”আমি অপেক্ষায় থাকবো। অন্যকারো হাতে সাজবো না আমি।”
চোখের পানি মুছতে মুছতে লুপা চলে গেলো। লুপা যেতেই অরিন হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। লুপা যেটা হাতে দিয়ে গেছিলো ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ছুঁড়ে ফেলতেই কাপড়ের পেচ থেকে বেরিয়ে এলো একজোড়া দুল। দুইটা দুইদিকে ছিটকে পড়েছে৷ অরিন দৌঁড়ে গিয়ে দুলজোড়া হাতে নেয়। এগুলা তো তাঁর মায়ের দুল বিক্রি করে দিয়েছিলো সে। তাহলে কী লুপা এগুলা আবার কিনে আনছে?
দুলজোড়া হাতে নিয়ে খুশিতে কেঁদে দেয় অরিন। বেদনাশ্রুর সাথে আনন্দশ্রু মিশে যায়। দুলজোড়ায় অনেকগুলা চুমু খায় অরিন। মায়ের একটা স্মৃতিও ধরে রাখতে পারিনি বলে কতো কাঁদতো সে। এতো এতো টাকা পয়সা কামাই করেও সে গরিব ছিলো শুধুমাত্র মায়ের এই দুলজোড়া নেই বলে। টাকা দেখলেই কান্না আসে তাঁর। ভাবে এইটাকার জন্যই সে দুলজোড়া বিক্রি করে দিয়েছিলো আজ এত টাকার মালিক সে কিন্তু মায়ের দুল আর নাই।
চোখের পানি মুছে দৌঁড়ে নিচে যায় অরিন। এভাবে দৌঁড়াতে দেখে দিহান বলে “আরে আরে এভাবে দৌঁড়াচ্ছো কেন? পড়ে টড়ে হাত পায়ে ব্যথা পাবা তো।” অরিন শুনেনি দৌঁড়ে গিয়ে কনেদের রুমে ঢুকে। দিহান আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থাকে। রুমে ঢুকে অরিন লুপাকে পায়না। দিশাকে বিউটিশিয়ানরা সাজাচ্ছিলো। অরিন বারান্দায় যায়। লুপা বারান্দায় ছিলো। কান্নাজড়িত গলায় ডাক দেয়।
“লুপা।” অরিনের ডাকে লুপা পিছনে থাকায়। অরিনকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে সে। অরিনও কান্না করছে। অরিন লুপাকে একটা থাপ্পড় দেয়। গালে হাত দিয়ে কেঁদে কেঁদে লুপা তাকায় অরিনের দিকে। অরিন আবার অন্যগালে থাপ্পড় দেয়। লুপা কাঁদছে অরিনও কাঁদছে। আবার আরেকটা থাপ্পড় দেয় অরিন। দিয়েই লুপাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে বসে। লুপা কাঁদতে কাঁদতে বলে “আমায় মেরে দে অরিন প্লিজ। আমায় মুক্তি দে এমন জীবন থেকে।
কান্না শুনে দিশা আর শামু দৌঁড়ে আসে বারান্দায়। দুই বন্ধুর মিল দেখে খুশিতে তাঁরাও কেঁদে দেয়। দিশার মনে পড়ে গেলো ইশির কথা। সে চলে আসলো রুমে। আজ ইশি থাকলে কতো মজা হতো। বুকে জড়িয়ে হয়তো সেও কাঁদতো। তবে ইশির কান্নাটা হতো দিশার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এই কষ্টে। চোখের পানি মুছে দিশা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো।
অরিন দুলজোড়া বের করে লুপাকে বলল,”এগুলা কই পেলি তুই।” লুপা কিঞ্চিৎ হেসে বলল,”যার কাছে বিক্রি করেছিলি তাঁর কাছ থেকে কিনেছি।” অরিন লুপাকে জড়িয়ে ধরে বলল” থেনক্স। এটা আমার জীবনের কতো মূল্যবান তা বলে বুঝাতে পারবো না। এত টাকা এত কিছু আমার হওয়ার পরেও আমি শূন্য ছিলাম, কারণ আমার কাছে আমার মায়ের কিছুই ছিলোনা। আজ নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে আজ আমি সত্যিই পরিপূর্ণ। কারণ আজ আমার মায়ের স্মৃতি ফিরে পেয়েছি। এটা শুধো আমার মায়ের স্মৃতি নয় এটা আমার বাবারও স্মৃতি। কারণ এটা আমার বাবা আমার মাকে দিয়েছিলো।
_______________________
রুহান দিয়ার উপর প্রচন্ডরকম রেগে আছে। দিয়া একটা শাড়ি পড়েছে খুব পাতলা। কালো শাড়ির নিচে তাঁর ফর্সা পেট আগলে আছে। রুহানের ইচ্ছে করছে দিয়াকে মাথার উপর তুলে আছাড় মারতে। রুহান ভাবলো দিহানকে বলে গিয়ে দিহানকে দিয়ে দিয়াকে বকা শুনাতে। দিহানের খোঁজে যাচ্ছিলো তখন দেখলো দিয়ার দিকে একটা ছেলে কীভাবে যেন তাকিয়ে আছে। রুহান তো এবার মাথা আরো বিগড়ে যায়।
রুহান দিয়াকে ডাক দেয়। দিয়া শুনেনা। দিয়া কয়েকটা মেয়ের সাথে গল্প করছে। দিয়ার পাশে গিয়ে বলে,”দিয়া তোকে বড় ভাইয়া ডাকছে। আমার সাথে আয়।” দিয়া রুহানের পিছে পিছে যায়। দিয়া এখনো বুঝেনি রুহান তাঁকে এমনি বলছে জিহান ডাকছে। একটা রুমের সামনে এসে রুহান থামে। দিয়া চারদিকে তাকিয়ে বলে,”কই বড় ভাইয়া? এখানে তো কেউ-ই নেই।
_আছে ভিতরে যা।” দিয়া ভেতরে যায়। সাথে সাথে রুহান রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। দিয়া কপাল কুঁচকে তাকাল।
_দরজা বন্ধ করলি কেন?
_কারণ তোকে আদর করবো তাই।
_তুই থাক তোর আদর নিয়ে। আমি যাচ্ছি। “দিয়া যেতে চাইলে রিহান হেচকা টানে দিয়াকে তাঁর দিকে ঘুরিয়ে আনে। দিয়া নিজেকে ছাড়াতে চাইলে রুহান ছাড়েনা। দিয়ার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। প্রথম দিকে দিয়া ছটফট করলেও পরে তাঁর ছটফটানি বন্ধ হয়ে যায়। রুহানের সাথে যখন দিয়াও ডুব দেয় গভীরে, তখন রুহান দিয়ার শাড়ীর আঁচল টান দিয়ে ফেলে দেয়। দিয়ার হুস নেই। রুহান দিয়ার কোমর থেকে শাড়ী খুলে পুরো শাড়ীটা খুলে হাতে নিয়ে নেয়। তারপর দিয়াকে কিঞ্চিৎ ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দেয়। ধাক্কা খেয়ে দিয়ার হুস আসে। তাকিয়ে গায়ে শাড়ী না দেখে হাত দিয়ে বুক ঢাকে। রুহান বলে “তুই থাক আমি যাচ্ছি আমার কাজ আছে।” দিয়া চেঁচিয়ে বলে”তুই আমার শাড়ী নিয়ে যাচ্ছিস কেন আমার শাড়ী দে।
_শাড়ী পড়বি কেন? শাড়ী পড়লে তোর শরীরের সুন্দর সুন্দর কার্ভ গুলা ছেলেরা দেখবে কেমনে? যা এভাবেই যা গিয়ে দেখা,তুই কতটা সেক্সি।
_ছিঃ রুহান। তোর মুখের ভাষা এতো খারাপ? দে, আমার শাড়ী দে।” রুহান কিছু না বলে চলে গেলো। দিয়া দরজা খুলতে চাইলে দেখে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। রাগে দিয়ার মাথা ফেটে যাচ্ছে। অনেক্ষণপরে একটা মেয়ে একটা ব্যাগ এনে দিয়ে গেলো। মেয়েটা যাওয়ার পরে দিয়া ব্যাগের ভিতরে থাকিয়ে দেখলো কাপড় দেখা যাচ্ছে। খুশিতে তাঁর মন নেচে উঠে। ব্যাগের ভেতর থেকে কাপড় হাতে নিয়েই সে চোখ কপালে তুলে ফেললো। একটা সুতির সেলোয়ার কামিজ। ব্যাগের ভেতর একটা চিরকুট আছে। দিয়া সেটা বের করে পড়লো। “এইটা পড়ে বের হ। আর কোনো ছেলের সামনে যেন না দেখি। যদি ভুল করেও কারো কথায় ড্রেস চেঞ্জ করবি। তাহলে তোর খবর আছে।” লেখাটা পড়ে রাগে দিয়া কাগজ মুড়িয়ে ছুঁড়ে ফেলে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে “আমার একমাত্র বোনের বিয়েতে আমি এমন সেলোয়ার কামিজ পড়বো? লাইক সিরিয়াসলি?”
চলবে,,,,,,,,।