ভালোবাসি_প্রিয়
পর্ব_৫১
#সুলতানা_সিমা
লুপার পায়ে অনেক আঘাত পেয়েছে। মনে হচ্ছে পায়ের কোনো একটা হাড় আলাদা হয়ে গেছে। অসয্য ব্যথা নিয়ে চেয়ারে বসে আছে সে। একটু পর পর দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শক্ত করছে। ব্যথাটা তো শুধু তাঁর পায়ে নয়, বুকেও ব্যথা করছে অনেক। ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার ব্যথা এটা। অরিন দূর থেকে একটু পর পর লুপার এসব দেখছে। খুব কষ্ট লাগছে তাঁর। ইচ্ছে করছে একবার গিয়ে লুপাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু পুরনো কথাগুলো মনে পড়লেই, লুপার থেকে অরিনের চোখ আপনাআপনি সরে যায়।
অনেকগুলা ছেলে মেয়ে একসাথে তালি দিয়ে উঠল। লুপা তাকিয়ে দেখে, নীল স্টাজে এসে বসছে। নীলের চোখ দুটো অনেক ফুলা। অস্বাভাবিক লাগছে তাকে। যেন সে বর নয়, কোনো জেল থেকে পালিয়ে আসা আসামী। নীলকে দেখে লুপার বুকের আগুন আরো দাউদাউ করে উঠল। চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। যে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই, মায়া কাটতে শিখতে হয়৷ নীলের আর শামুর স্টাজ আলাদা ভাবে করা হয়েছে। শামু একটু আগে উপরে গেছিলো এখনো উপরে আছে। এতোক্ষণ ধরে উপরে কী করছে কে জানে।
হলুদ লাগানো শুরু হলো। একে একে সবাই নীলের গায়ে হলুদ লাগিয়ে গেলো। নীলের মাঝে কোনো
প্রতিক্রিয়া নেই৷ অনুভূতি শূন্য মানুষদের মতো বসে আছে সে। বরাবরই লারা খুব দ্বায়িত্ববান। এখানেও তাঁর দ্বায়িত্ব কম নয়। অনেক বিষয় খেয়াল করে করছে সে। লারা এসে লুপাকে বলল “লুপা সবাই হলুদ লাগিয়েছে, যাও তুমিও লাগিয়ে দাও।” লুপা জোরপূর্বক হেসে বলল “না না ভাবী আমি আর কেন এসব দেবো।” লারা শুনলো না জোর করে নীলের সামনে নিয়ে গেলো।
নীলের সামনে লুপা বসতেই চোখ তুলে উপরে চাইলো সে। এখানে বসার পরে এই প্রথম চোখ তুললো উপরে। লুপাকে দেখে নীলের দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। বুক ফেটে কান্না আসছে তাঁর। সেদিনে কথাটা কানে বেজে উঠল ” দেননা একটা বাচ্চা আমায়। একটা রাত ভিক্ষে চাইছি আমি। প্লিজ।” নীল শুকনো একটা ঢোক গিললো। কান্না আটকাতে খুব কষ্ট হচ্ছে তাঁর। বুকের পাজর ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে হলুদ হাতে নিলো লুপা। লারার ফোনে কল আসতেই ফোনে নিয়ে চলে গেলো অন্যপাশে। লুপার হাত প্রচন্ডরকম কাঁপছে। নীল ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাতে পারলো না,টুপ করে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো।
নীলের ডান গালে হলুদের হাত রেখে জল ভর্তি চোখে তাকাল নীলের চোখে। দুজনের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। নীলের চোখে অসহায়তা ভেসে উঠছে। চোখ বন্ধ করে নিলো লুপা। চোখে ভেসে উঠল নীলের দুষ্টুমির কিছু দৃশ্য ” সকাল সকাল মানুষের বাড়িতে চলে আসেন লজ্জা করেনা?
_আমার না একটুও লজ্জা করেনা,এই শাওন তোর করে?” চট করে চোখ খুলে নিলো লুপা। চোখ থেকে তাঁর জল বেয়ে এসে থুতনি ছুঁয়ে পড়লো। কান্নাজড়িত গলায় নীল বলল” কেমন আছো এখন?” লুপা কিছু বলল না।
ডান গাল থেকে হাত এনে বাম গালে হলুদ লাগালো। তাঁর মনে পড়লো শপিংমলের সেই কথাটা ”
পাগলামি করছো তুমি লুপা। তোমাকে আমি ভালোবাসি না। আর আম্মুও তোমাকে মেনে নিবেনা। কারণ তুমি তোমার সুন্দর পরিবারকে নিজ হাতে ধ্বংস করে দিয়েছ। সেখানে কীভাবে কোনো মা রাজি হবে তাঁর ছেলের জন্য তোমাকে নিতে? তুমি বিয়ে করে নাও লুপা সব ঠিক হয়ে যাবে।”
কথাটা মনে হতেই কান্না বেড়ে গেলো লুপার। কান্না চেপে রাখতে গিয়ে বার বার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে। গালে হলুদ লাগিয়ে কপালে হাত নিলো লুপা। নীল এতোক্ষণে খেয়াল করলো লুপার ঠোঁট ফুলে আছে। নীল বলল “ঠোঁটে কী হয়েছে তোমার?” লুপা জবাব দিলোনা। নীল আবার বললো, “লুপা বলছো না কেন ঠোঁটে কী হয়েছে তোমার? রক্ত জমে আছে কেন?”
লুপা চোখ মুছে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে লাগলো। এক পা টেনে টেনে হাঁটছে। নীল চট করে উঠে দাঁড়িয়ে জোরে ডাক দিলো “লুপা।” নীলের ডাকে শুধু লুপা নয়, সবাই থেমে যায়। সবার চোখ নীলের দিকে। নীল দৌঁড়ে লুপার পায়ের কাছে বসে। লুপার পায়ে ধরতেই তাঁর হাতের হলুদ লেগে যায় লুপার পায়ে। পা ধরে দেখলো পা অনেকটা ফুলে আছে। রক্ত জখম হয়ে আছে। বৃদ্ধা আঙুলের নক ফেটে রক্ত শুকিয়ে আছে। নীল অস্থির হয়ে বলে “কী হইছে তোমার? এটা হলো কী করে? মনে তো হচ্ছে এক্সিডেন্ট করেছো।”
লুপা পা ছাড়াতে চায়। নীল ধমক দিয়ে বলে “বলনা কেন কী হইছে পায়ে?” দিহান সহ তাঁদের পরিবারের সবাই বোকার মতো তাকিয়ে আছে। নীলের মা এসে দাঁতে দাঁত চেপে নীলকে চাপা গলায় বলেন “নীল সবাই দেখছে।” নীল খুব চেঁচিয়ে বলে “হ্যাঁ দেখছে, তো কী হয়েছে? এখন সবাই তোমাকে অপমান করবে?” নীলের ধমকে তাঁর মায়ের মুখ ছোট হয়ে যায়। ছলছল চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। লুপা বুঝতে পারছেনা নীল কেন এমন করছে? মায়ের চোখে পানি দেখে নীল দাঁতে দাঁত চেপে মাথা চেপে ধরলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে স্টেজে গিয়ে বসলো।
সবার জিজ্ঞাসুক চোখ লুপার দিকে আর নীলের মায়ের তীক্ষ্ণ চোখ। লুপার মাথা ঘুরে উঠে। রুহান এসে লুপাকে ধরলো। লুপা রুহানকে ক্ষীণ গলায় বলে “বাসায় চল রুহান।” লুপা রুহান চলে যেতে লাগে। শামু ডাক দেয় “দাঁড়াও লুপা।” শামুর ডাকে লুপা দাঁড়ায়। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে শামু। এক হাতে ফোন এক হাতে ডাইরী। ডাইরীটা নীলের উপর ছুঁড়ে মেরে নীলকে টাস করে একটা থাপ্পড় মেরে দিলো।
উপস্থিত সবার চোখ এখন কপালে উঠে গেছে। এসব হচ্ছে কী এখানে কারো মাথায় ঢুকছে না। শামুর মা শামুকে ধমক দিয়ে বললেন “শামু এটা কী করলি তুই?” শামু কিছু বলেনা। রাগে ফোঁস ফোঁস করছে সে। নীলের ফুপি এসে বললেন “এই মেয়ে তুমি ওকে মারলা কেন? ও কী করেছে?” শামু এবারও কিছু বলল না। নীলের মা শামুকে বললেন “শামু রিসোর্টের সবাই এখানে। এসব কী তামশা করছিস।”
শামু এবার নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। হাতের ফোন খুব জোরে ফ্লোরে আছাড় মেরে ফেলে, চিৎকার করে বলল”
_চুপ করেন আপনি। তিন তিনটা জীবন নিয়ে খেলা করে আমায় বলছেন আমি তামশা করছি? আরে তামশা তো আপনি করছেন। নিজের ছেলের জীবন থেকে শুরু করে আমার আর লুপার জীবন নিয়ে।”
লুপার নামটা শুনে লুপা আঁতকে উঠল। লুপার পরিবারের সবাই শামুর দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছেন। উনাদের চোখ জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে লুপার জীবন নিয়ে কেমনে খেলছেন উনি। নীল ডাইরি দেখেই বুঝে গেছে শামু কীভাবে সব জানলো। একমাত্র এই ডাইরি তো তাঁর মনের কথাগুলো জানে।
শামু ফ্লোর থেকে ডাইরিটা তুলে আনে। কয়েকটা পৃষ্ঠা খুঁজে একটা পৃষ্ঠা বের করে নীলের মায়ের সামনে তুলে ধরে বলে “দেখুন আপনার ছেলের যন্ত্রণাগুলো কীভাবে চেপে রেখেছে মনে। আপনার নিষ্ঠুরতার কথা কীভাবে লিখেছে, পড়েন একবার। আপনি তো একজন মা হন, তাও শিক্ষিত মা। আপনি কীভাবে নিজের পছন্দকে ছেলের উপর চাপিয়ে দিতে চাইলেন? এমন কাজ তো মূর্খ মায়েরাও করবে না। সন্তান কার সাথে ভালো থাকবে সেটা সন্তানকে জিজ্ঞেস করবেন, নিজেকে নয়। লুপাকে কেন আপনি খারাপ বলেন? ওর পরিবারের সাথে এমন করেছে বলে? কখনো ভাই হারিয়েছেন আপনি? বাবা মায়ের অবহেলিত চেহারা দেখেছেন আপনি? দেখেন নি। তাহলে কেমনে বুঝবেন ওর অবস্থাটা। আপনার ছেলে আপনায় সম্মান করে ও ভালোবাসে। তাই সে আপনার অনুমতি ছাড়া চায়নি তাঁর ভালোবাসাকে। আর আপনি কিনা নিজের ছেলের জীবন নিয়ে খেলছেন?
শামুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই। লুপা বুঝতে পারছে না শামু এসব জানলো কেমনে। নীল কী সবকিছু ডাইরিতে লিখে রেখেছে? নীল তাচ্ছিল্য চোখে তাঁর মায়ের দিকে তাকালো। উনার মুখ ছোট হয়ে আছে। দিহান নীলকে জিজ্ঞেস করলো “নীল তুই লুপাকে ভালোবাসিস?” নীল ভেজা চোখে তাকাল দিহানের দিকে। নীলের মুখটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে। দিহানের দিকে তাকিয়ে চোখ থেকে বর্ষণ করলো আরেক ফোঁটা জল। দিহান বুঝে গেলো নীলের চাপা কষ্টটা কোথায় ছিলো। শামু নীলকে বলল”
কেমন মানুষ তুমি? একটা মানুষ তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে, আর তুমি তাকে খারাপ বলে দূরে ঠেলে দিচ্ছো? ও যা করেছে ওর জায়গায় যে কেউ হলেই এটা করতো। আরে সাত খুন ওতো মাফ হয়। ও তো কাউকে খুনও করেনি। তারপরও কেন ওর সাথে এমন করছো? যুবক নির্দোষ ভাই হারিয়ে বেচারি পাগল হয়ে গেছিলো। ও তো অনুতপ্ত। ও তো বলছে ও ভুল করেছে। তবুও কেন ওর সাথে এমন করছো?”
দিহানের বড়মা লুপার পাশে দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন “লুপা তুই নীলকে ভালোবাসিস?” লুপা মাথা নিচু করে ফেললো। চোখ থেকে শুধু বেদনাশ্রু ঝরে পড়ছে। শামু চেঁচিয়ে বলল” আপনিই তো লুপার বড়মা তাইনা? আপনাদের করা অন্যায় সয্য করতে না পেরেই তো আজ ওর এমন হাল। নিজের মেয়েকে হারিয়েছিলেন বলে চিৎকার করে কেঁদেছিলেন। তাহলে ভাবুন ওর ভাই হারিয়েছে ও। বাবার পরের ছায়া হারিয়েছে। ও কীভাবে সয্য করতো এটা?”
লুপা শামুর দিকে অবাক হয়ে তাকালো। এসব তো সে তাঁর ফেসবুক ফ্রেন্ডকে বলেছে। তাহলে কী শামুই সে? শামু লুপার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ধরা গলায় বলল” আমি জানতাম না লুপা তুমি নীলকে ভালোবাসো। নয়তো কখনো এ বিয়েতে আমি রাজি হতাম না।” চোখের পানিটা মুছে নীলকে বলল”
তুমি আমাকে বলতে পারতে নীল। আমি খারাপ হলেও এতোটা খারাপ নই। হ্যাঁ আমার চলাফেরা,চাওয়া পাওয়া সবার থেকে আলাদা। কিন্তু আমি জোর করে কিছু চাইনা। আমি কোনো সম্পর্কের ৩য় ব্যক্তি হতে চাইনা নীল। আমি চাইনা আমি এমন কারো জীবনে থাকি, যার জীবনে অন্যকেউ আছে। বাবা মা অনেক সময় সন্তানের জন্য ভুল সিদ্ধান্ত নেন। শুধু সন্তানরা আবেগের বশে কিছু চেয়ে বসেনা। মাঝে মাঝে বাবা মাও চায়। তাই মাঝে মাঝে বাবা মায়ের অবাধ্য হতে হয়।
রিসোর্টের উপস্থিত সবাই শামুর দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই নিরব দর্শক। কে কী বলবে? এই অবস্থায় কার কী বলা উচিৎ সেটা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। শামুর মায়ের গর্ব হচ্ছে শামুকে নিয়ে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে পারে উনার মেয়ে। যাক সম্মান,বলুক লোকে কথা। তবু তো কারো সাথে অন্যায় হলোনা। শামু অরিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। যেহেতু লুপা তাঁকে অরিনের কথা বার বার বলতো। তাই অরিনকে কিছু বলার আছে তাঁর। অরিনকে শামু বলল ”
_লুপাকে ক্ষমা করে দাও অরিন।” শামুর কথায় অরিন কিছু বলল না। শামু আবার বলল”প্লিজ অরিন ক্ষমা করে দাও। আর কত রাগ থাকবে?” অরিন চোখের পানিটা মুছে বলল”
_রাগ তো তখন হয়, যখন পর কেউ ধোঁকা দেয়। কিন্তু যখন আপন মানুষ ধোঁকা দেয়,তখন রাগ হয়না। মন ভেঙে যায়। বিশ্বাস ভেঙে যায়। মানুষের মন পাথর হয়ে যায়।
_তোমার কষ্টটা আন্দাজ করছি অরিন। কিন্তু লুপার কষ্টটাও কম নয়। আজ তুমি দিহান ভাইয়ের ভালোবাসা। দিহান ভাইয়ের সন্তানের মা। ইন্ডিয়ার একজন নাম করা ডক্টর। সবকিছুর পিছনে কিন্তু লুপার হাত আছে। একবার ভাবো অরিন, লুপা তোমায় ব্যবহার না করলে তুমি দিহান ভাইকে পেতানা। ওর জন্যই আজ তোমরা স্বামী স্ত্রী। ক্ষমা করতে শিখো অরিন। ক্ষমা হচ্ছে একধরণের হারপিক। যেটা মনের সব ক্ষোভ, রাগ, অভিমান, মনের মরিচা,সব। মন থেকে মুছে দেয়। তুমি যতদিন লুপাকে ক্ষমা করতে পারবেনা, ততদিন পুরনো দিনের কথাগুলো মনে পড়বে তোমার। আর যত এটা মনে পড়বে তত তোমার অভিমানের পাল্লা ভারি হবে। ক্ষমা করে দেখো। লুপাকে আর অপরাধী মনে হবে না তোমার। একবার ওর অবস্থানে নিজেকে ভাবো সবাই। দেখবে লুপা অপরাধী নয়,লুপা হচ্ছে সব থেকে অসহায় মেয়ে। যে মনের কষ্টটাও বলার মতো কাউকে পায়না।
এইটুকু বলে থামলো শামু। লুপার সামনে দাঁড়ালো, তারপর লুপাকে বলল” যে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে তাকে কখনো অন্ধ প্রমাণ করনা। নয়তো সে সত্যিই অন্ধ হয়ে যাবে। তাঁর চোখে আর তোমার কষ্ট পড়বেনা। ”
শামু চোখের পানিটা মুছে নিলো। সবার চোখেই পানি। শামু যেন সবার চোখ খুলে দিছে। দিহান অরিনের হাত ধরে অনুরোধের চোখে তাকাল অরিনের দিকে। অরিন ডুকরে কেঁদে উঠল। সত্যিই তো শামু বলেছে, দিহানকে পেয়েছে তো লুপার জন্যই। লুপা তাকে ব্যবহার না করলে কীভাবে সে তাঁর এই প্রাণের স্বামীকে পেতো। নীল লুপা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে নিরবে কেঁদে যাচ্ছে। নীলের মা এখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি ভেবেছিলেন লুপা উনার ছেলেকে এক সময় ধোঁকা দিবে। তাই তিনি চেয়েছিলেন শামুর সাথে বিয়ে দিয়ে লুপার ব্যাপারটা নীলের মাথা থেকে ঝেড়ে দিতে।
মেহমানদের মধ্যে দুজন চলে যাচ্ছিলেন। শামু বলল “দাঁড়ান কেউ যাবেন না। হলুদের অনুষ্ঠান হবে আজ।” শামুর কথায় নীল ধাক্কা খেলো। এতোক্ষণ কী বলল আর এখন কী বলছে? লুপার রুহানকে আস্তে করে বলল “রুহান চল।” শামু বলল “তুমি যেওনা লুপা। হলুদ তোমার আর নীলের হবে।”
শামুর কথাটা শুনে লুপা অবিশ্বাস্য চোখে শামুর দিকে তাকায়। শামু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। লুপা ছলছল চোখে হাসতে হাসতে রুহানের দিকে তাকায়। রুহানেরও চোখে পানি। বোনের খুশিতে সেও কেঁদে দিয়েছে। নীল একবার তাঁর মায়ের দিকে ছলছল চোখে তাকাল। শামু বলল” কারো অবিভাবকের কোনো মতামত চাইবোনা আমি। বিয়ে আমি দিবো।” নীলের মা তাঁর দিকে তাকিয়ে সম্মতি জানালেন। নীল আর এক মূহুর্ত দেরি করলোনা। দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো লুপাকে। লুপাও যেন নীলের সাথে লাজ লজ্জা ধুয়ে ফেলছে। নীলকে আঁকড়ে ধরে সে কেঁদে দেয়। খুব শক্ত করে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। কত পাগল দুজন দুজনের জন্য সেটা তাঁরা নিজেরা ছাড়া আর কেউ জানেনা।
দিহান শাওন নীলের খুশি দেখে কাঁদছে। আর অরিন লুপার। নীলের মা আজ বুঝতে পারলেন উনি আসলেই ভুল করতে যাচ্ছিলেন। কই এভাবে তো ছেলেকে কখনো খুশি হতে দেখেন নি।
শামু চোখের পানিটা মুছে নিলো। এতোদিন লুপার সাথে সে ফেসবুকে কথা বলতো। সে জানতো এটা লুপা। কিন্তু নিজের পরিচয় দিতোনা। আজ যখন লুপার লাস্ট মেসেজ সিন করলো,তখন তাঁর পায়ের নিচের মাটি সরে যায়। লুপা নীলকে ভালোবাসে এটা সে জানতোইনা। ফোন নিয়ে দৌঁড়ে যায় নীলের রুমে। কিন্তু ততক্ষণে নীলকে স্টেজে আনা হয়। রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখলো নীলের বালিশের নিচে ডাইরির অর্ধেক বেরিয়ে আছে। ডাইরিটা পড়ে তাঁর পৃথীবি ওখানেই থমকে যায়। লুপার জন্য মায়া হয় তাঁর। এতদিনে সে এটা খুব আন্দাজ করেছে, লুপা জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। নীলকে হারিয়ে ফেললে তো সে মরেই যাবে। আর নীলের ডাইরির প্রতিটি পৃষ্ঠা জানান দিচ্ছে, লুপাকে নীল কতটা ভালোবাসে। শামুর এক ফ্রেন্ড এসে তাকে বলল”
_শামু তুই না নীলকে ভালোবাসিস, তাহলে এসব কী করছিস?” শামু ম্লান হেসে বলল, “আমি নীলকে ভালোবাসি। নীলকে পেলে আমি ভালো থাকবো। কিন্তু নীল যখন আমার সাথে সুখে থাকবে না তখন আমিও ভালো থাকতে পারবো নারে। ও সুখে থাকুক৷ আমি আমার জীবনে কাউকে মানিয়ে নিতে পারবো, কিন্তু ওরা পারবে না।
নীল লুপাকে ছেড়ে লুপার কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক চেপে কাঁদতে থাকে দুজন। শাওন দিহানকে ফিসফিসিয়ে বলল” এই বেটা এখন কী করতে চায়। হুস বুদ্ধি সব খেয়ে ফেলছে মনে হয়।” দিহান ওই দিকে থাকাচ্ছেনা। এদিকওদিক তাকাচ্ছে শুধু। নীলের লুপার কোনোদিকেই হুস নেই। ওরা যেন হারিয়ে গেছে অন্য কোথাও। আশেপাশের এতো হৈ চৈ যেন ওদের কানে ঢুকছে না। লুপার কাটা ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে ঠোঁটে চুমু খায় নীল। সাথে সাথে সবাই ওইদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
চলবে…..।
সবাই শামুকে বকলেও আমি কিন্তু তোমাদের উপর রাগতাম না। কারণ আমি জানতাম শামু কতটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র।?