ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব_৩৬

0
1789

ভালোবাসি_প্রিয়
পর্ব_৩৬
#সুলতানা_সিমা

ছয় বছর পর❤


কলকাতার একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে, দিহান নীল ও শাওন। তিন বন্ধু এখন এস এন অ গ্রুপ অফ কোম্পানির মালিক। একটা প্রজেক্টের জন্য তাঁরা তিনজনই কলকাতা এসেছে। তাদের সাথে এখানে আরও কয়েকজন বসে আছেন। তবে সব থেকে বিরক্তিকর যিনি আছেন। তিনি মোটাতাজা টাকলা একজন অভদ্রলোক। আপাতত দিহান নীল শাওনের কাছে এটাই মনে হচ্ছে। উনার নাম রঞ্জিত চ্যাটার্জি। আর বি গ্রুপ অফ কোম্পানির এমডি তিনি। সেই কখন থেকে কার সাথে যেন কথা বলে যাচ্ছেন। বার বার ঠাট্টা দিয়ে হাসছেন। আর কথা বলার সাউন্ড, মনে হয় মাইক নিয়ে কথা বলছেন। বিরক্ত হয়ে দিহান উঠে গেলো একটু অন্য পাশে। থাই গ্লাসের উপর হাত রেখে তাকালো রাস্তার দিকে। একটি মেয়ে আর ছেলে একটা ছোট বাচ্চাকে ধরে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটা বার বার বাচ্চাটাকে কোলে নিতে চাইছে কিন্তু বাচ্চাটা হাঁটতে চায়, সে কোলে উঠবেনা। কত সুন্দর একটা পরিবার, কত সুখী তাঁরা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ দিহানেরও এমন একটা পরিবার থাকতো। বুক ছিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো দিহানের।

সময়ের স্রোতে ভেসে চলে গেলো ছয়টা বছর। আজও নেই অরিনের কোনো খোঁজ। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে খোঁজেনি দিহান অরিনকে। বাংলাদেশের প্রতিটি কোণায় কোণায় খোঁজেছে সে অরিনকে। কিন্তু ফলাফল বরাবরই শূন্য পেয়েছে। অরিন চলে যাওয়ার পর টানা তিনদিন দিহান না খেয়ে না ঘুমিয়ে শুধু অরিনকেই খোঁজছিলো, যার কারণে সে অসুস্থ হয়ে যায়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সুস্থ হতে তিন চার দিন সময় লাগে। তার সাপ্তাহখানেক পরে লুপা সবাইকে সবকিছু খুলে বলে। সবকিছু শুনে তাদের পরিবারে অনেক বড় ঝগড়াও হয়। ঘরের মানুষ ঘরের সম্মান নষ্ট করেছে শুনলে তো ঝগড়া হবেই। সেই ঝগড়ার রেশ ধরে শান্তি নীড়ের এক পরিবার তিন পরিবারে পরিনত হয়। দিহান লুপাকে দুই-তিনটা থাপ্পড় মারে, বার বার বলে তোর জন্য আমি অরিনকে হারিয়েছি। লারার প্রতিও তাঁর অনেক রাগ হয়, কিন্তু অন্যের বউ মারার,বা তাকে ধমক দেওয়ার মতো শিক্ষা সে পায়না। সেদিন তাঁর বাবা মাকে নিয়ে শান্তি নীড় থেকে বেরিয়ে আসে। লুপার বাবাও সেদিন উনার বউ বাচ্চা নিয়ে নিজের ইচ্চায় বাসা থেকে বেরিয়ে যান। কারণ লুপার বড় চাচ্চু বার বার বলছিলেন তোরা ঘরের দুষমন। ছেলে হারানোর ব্যথা এখনো তিনি ভুলতে পারেননি। তবুও ভাইদের দিকে তাকিয়ে চুপ থাকেন। তারপরও যদি ভাইয়ের কাছে শুধু অবহেলা পান কেমন লাগবে? তারপর দুদিন পর দিহানের বড়মারাও চলে যান শান্তি নীড় ছেড়ে। শান্তি নীড়ে এখন আর কেউ থাকেনা। শখের গড়ে তোলা বাড়িটা এখন মানব শূন্য।

পাগলের মতো অরিনকে খোঁজতে খোঁজতে দিহান প্রায় পাগল হয়ে। মেন্টাল হসপিটালে ছিলো ছ’মাস। তারপর সুস্থ হওয়ার পরে সে অন্য রকম হয়ে যায়। আগের দিহানের সাথে এখনের দিহানের কোনো মিল নেই। সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকে। কারও সাথে মিশে না প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা। হাসি গুলো যেন সব উধাও হয়ে গেছে। ভুল করেও তাকে হাসতে দেখা যায়না। প্রতিরাতে তার ঘর থেকে গিটারের সুর ভেসে আসে। কোনো রাতই যে তার ঘুম হয়না গিটারের সুরই তার সাক্ষী। হানিফ চৌধুরী আর সুমনা চৌধুরী দুই বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন দিহানকে আবার বিয়ে দিতে,কিন্তু উনারা বার বারই ব্যর্থ হয়েছেন। অরিন যদি সেদিন পালিয়ে না যেতো তাহলে হয়তো পরের দিন তার জন্য সব থেকে সুখের দিন হতো। আজ সবকিছুই স্বাভাবিক থাকতো। কিন্তু আফসোস একটাদিন অপেক্ষা করে দেখেনি অরিন।

লুপা নীল শাওন দিশা কেউ ভালো নেই আজ। লুপা সবকিছু বলার পরে নীল লুপার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। লুপা এর দু’তিন সাপ্তাহ পরে নীলের সাথে দেখা করে জানায়, সে নাকি নীলকে ভালোবাসে।নীল লুপাকে রিজেক্ট করে দেয়। সে লুপাকে বলে “যে নিজের পরিবারের সম্মান নষ্ট করে, সে আমার পরিবারের সম্মান কীভাবে রক্ষা করবে? যার কাছ থেকে তাঁর সব থেকে কাছের বন্ধু ঠকে তাঁর কাছে যে আমি ঠকবো না তাঁর কী গ্যারান্টি আছে?” সেদিনের পর থেকে নীল লুপার সাথে একেবারেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। লুপা নামটা শুনলেও নাকি তাঁর ঘৃণা লাগে। কিন্তু লুপা বার বার নীলের সাথে দেখা করার জন্য বলার জন্য বেহায়ার মতো বার বার নীলের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে থাকতো। কিন্তু পাষাণ নীল বিরক্ত হয়ে বাসা বদলে দেয়। সমাপ্তি ঘটে লুপার পাগলামির। এখন হয়তো লুপা জানেও না নীল কই আছে।

এদিকে দিশার বরের পরিবারের কানে তাদের আলাদা হওয়ার ঘটনা পৌছে যায়। তারপর বর নিজেই বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। আর হয়নি বিয়ে দিশার। এখনো দিশাকে বিয়ে দিতে পারেনি তাঁরা। বিয়ের কথা শুনলেই দিশা না বলে দেয়।

দিহানের হাতের আঙুলে টান পরতেই ধ্যান ভাঙ্গে তাঁর। চোখের পানিটা মুছে নিচে তাকিয়ে দেখে চার পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে হাতে একটা আইসক্রিম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাটা অনেক কিউট গোলাকার মুখ,টানাটানা চোখ,চোখের পাপড়ি গুলা ঘন,গাঢ় কালো। কপাল ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট চিল্কি চুল। মাথায় আবার দুইটা ঝুটি বাঁধছে। বাচ্চাটাকে দেখে দিহানের চোখ জুড়িয়ে গেল। কলিজা ঠান্ডা করার মতো সুন্দর্য নিয়ে জন্মেছে এই বাচ্চাটা। দিহান মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে ভ্রু নেড়ে জিজ্ঞেস করলো” কী।” বাচ্চাটা আইসক্রিম বাড়িয়ে দিলো দিহানের দিকে। দিহান মুচকি হাসলো তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল” তুমি খাও।” মেয়েটা কয়েকবার না সম্মতি মাথা নাড়িয়ে আবার বাড়িয়ে দিলো। দিহান বলল” আমি এসব খাই না,তুমি খাও।” বাচ্চাটা পুনরায় দিহানের দিকে বাড়িয়ে দেয়। দিহানের মায়া হয়, ইস বাচ্চাটা মনে হয় কথা বলতে পারেনা। এবার না বলতে ইচ্ছে করলোনা, সে একটু নিচু হয়ে এক বাইট আইসক্রিম খেলো। বাচ্চাটা চোখ বড় বড় করে তাকালো, তারপর ভ্যা করে কেঁদে দিলো। দিহান বোকা হয়ে গেল। বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতে হাতের আইসক্রিম ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তারপর ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদতে লাগল। পুরো রেস্টুরেন্টের মানুষ এক হয়ে গেলো। সবাই জিজ্ঞেস করছে কী হইছে। বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতে আঙুল দিয়ে দিহানকে দেখিয়ে বলে “আমি হিসু করতে যাব বলে এর হাতে আইস্ক্রিম দিয়ে যাচ্ছিলাম। এই লোকটা আমার আইসক্রিম খেয়ে ফেলছে।” বাচ্চাটার কথাশুনে দিহান হাঁ হয়ে যায়। সবাই দিহানের দিকে অবাক হয়ে থাকালো। দিহানের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে আইস্ক্রিম লেগে আছে। মানে পরিষ্কার, দিহান সত্যিই খেয়েছে। দিহান বলল” আরে না না আমি খাইনি, আসলে,,,” আর কিছু বলতে পারলোনা দিহান একটা মেয়ে বলল” আপনি না বলছেন কেন? আমি নিজের চোখে দেখেছি আপনি খেয়েছেন” আরেকজন বলল” আপনার মুখে তো আইসক্রিম লাগানো।” দিহান লজ্জায় মরে যাচ্ছে। নীল দাঁতে দাঁত চেপে দিহানকে কিঞ্চিৎ স্বরে বলল” দিহান এটা কী করেছিস তুই?” দিহান রাগি লুকে তাকালো। মেয়েটা নিজেই খাওয়ালো আবার বলছে দিহান খেয়ে ফেলছে। এই মেয়েটারে বোবা ভাবছিলো সে?

মেয়েটার কান্না থামছেই না। ম্যানেজার একটা আইসক্রিম হাতে দিয়ে বলল “এই নাও আইসক্রিম কেঁদনা”। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলল ” না আমি এইখানের আইসক্রীম খাবোনা আমার ওই আইসক্রিম খাবো।” একজন কর্মচারী এসে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বলল” আসো আমি তোমাকে আগের জায়গা থেকে আইস্ক্রিম কিনে দিবো কান্না থামাও।” বাচ্চাটা হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল “না ওই লোকটাকে দিতে হবে” কর্মচারী দিহানকে বলল “এটা আমাদের মালিকের মেয়ে। উলটা পালটা হলে খবর করে ছাড়বে,আপনিও আসেন।” না পারতে দিহানও গেলো পিছু পিছু, মেয়েটা কান্না করেই যাচ্ছে। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হবে তখন একটি মেয়ে বলল” আরে মেয়েটা এভাবে কাঁদছে কেন?” কর্মচারী দিহানকে দেখিয়ে বলল” আসলে এই স্যারের কাছে ও আইস্ক্রিম রেখে হিসু করতে গেছিলো। হিসু করে আসতে আসতে স্যার আইসক্রিম খেয়ে ফেলছে,তাই কাঁদছে।” দিহান মনে হয় এবার কেঁদেই দিবে। লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। কী মসলা মিশ্রিত কথা বলছে লোকটা। না জানি আর কাকে কী বলে। একটা আইসক্রিম ওয়ালার কাছে এসে থামলো লোক, দিহান আল্লাহ আল্লাহ করছে কেউ যেন জিজ্ঞেস না করে কেন কাঁদছে। কিন্তু না, দিহানের দোয়ায় পানি ঢেলে আইসক্রিমওয়ালা জিজ্ঞেস করে ফেলল “আরে কান্দে ক্যান মাইয়াটা?” লোকটা বলল” আসলে ও আইসক্রিম দিয়ে হিসু করতে গেছিলো এই স্যার ওর আইসক্রিম খেয়ে ফেলছে।” আশেপাশের সবলোক দিহানের দিকে কেমন জানি চোখে তাকাচ্ছে। লজ্জায় দিহানের মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কী বজ্জাত মেয়ে আল্লাহ জানে এর মা কেমন বজ্জাত।

চলবে……।

মাথা ব্যথা নিয়ে লেখছি জানিনা কেমন হইছে। ভুল ক্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here