গল্পের নামঃ #প্রণয়
#পর্বসংখ্যা_১৬
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত
পৃথিশা শান্ত স্বরে বলে, “দাদী! আমি আপনাকে অনেক সম্মান করি,অনেক।এইযে এই সংসারটা আপনি নিজে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন।আপনারই এসবে সবচেয়ে বেশি অধিকার,আমার কিংবা আম্মু-চাচীর থেকেও বেশি। বয়সের ভাড়ে সংসারে এখন তোমার কাজ-কর্ম কমে গেলেও গুরুত্ব কমে যায়নি।দাদা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাসার অনেক খরচ দাদা নিজের পেনশনের টাকা দিয়ে করতো।দাদা মারা যাওয়ার পর বড় চাচা,ছোট চাচা আর আব্বু সংসার সামলায়। এতজন মানুষের খরচ চারটি খানি কথা নয়।মাঝে-সাঝেই হিমশিম খেতে হয়।সংসারে ছোট চাচা একটু বেশিই খরচ করে,যার কারনে তুমি ছোট চাচীকে একবারে মাথায় তুলে রাখো।এটাতে আমার সমস্যা নেই,তোমার যা ইচ্ছা তুমি তাই করবে। আমার চাকরি হওয়ার পর বাসার কারেন্ট বিল,পানি বিল সহ আরও কিছু অংশে আমি টাকা খরচ করি। ফ্রিজ টা কারেন্ট দিয়েই চলে,আমি কি একবারো বলেছি আমার টাকায় চলা ফ্রিজের খাবার তোমরা খাবে না?আমি তো বলিনি।পরিবারের সব সদস্যই ফ্রিজ ব্যবহার করতে পারবে, তাহলে তুমি কেন বললে আমি ফ্রিজ থেকে কিছু নিতে পারব না।আমি কি এই পরিবারের সদস্য না?
দাদী ছোট থেকে, একেবারে ছোট থেকে তুমি প্রতিনিয়ত আমার বিরোধিতা করতে।কেন করতে?তার উত্তর হলো আমি মেয়ে,আমি ছেলে হতে পারিনি তাই আমার কোন মূল্য নেই।ছোটবেলায় যখন তুমি ভাইয়াকে আদর করতে,তাকে খায়িয়ে দিতে আমিও আগ্রহ নিয়ে তোমার কাছে যেতাম।কিন্তু তুমি আমাকে বকা দিয়ে তাড়িয়ে দিতে।আমার বান্ধবীরা এসে তাদের দাদী-নানী নিয়ে গল্প করত।আমি চুপচাপ বসে শুনতাম।ছোটবেলায় ভাবতাম একদিন তুমি ম্যাজিকের মতো আমার সাথে সবার দাদীর মতো আচরণ করবে।আমায় আদর করবে,খায়িয়ে দিবে।কিন্তু তুমি পাল্টাও নি দাদী। আগের মতোই আছো।
চাকরি পাওয়ার পর মনে হয়েছিলো তুমি আমাকে এবার অন্তত একটু ভালোবাসবে।কিন্তু তোমার আচরণ আমাকে আবারো আশাহত করেছে দাদী।অনেক কষ্ট পেয়েছি আমি এবার,অনেক।মাঝরাতে চিৎকার করে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করতাম কেন আমি ছেলে হলাম না?কেন আমাকে মেয়ে বানানো হলো?উত্তর পাইনি একটারও। তুমি যখন কর্ণ ভাইয়ার সাথে সকাল সকাল গল্প করো তখনও আমার মনটা দুঃখে ভরে যায়।
কিন্তু দাদী তুমি হয়তো ভুলে গেছো তুমিও মেয়ে,কোন ছেলে না।তোমার দাদী যদি তোমার সাথে এরকম ব্যবহার করতো তখন কি করতে তুমি?
পৃথিশার দাদী কোন কথা না বলে চুপ করে পৃথিশার দিকে তাকিয়ে আছে।পৃথিশার চোখে অশ্রুতে টইটুম্বুর। শান্ত স্বরে আবারো বলতে শুরু করলো, “তোমায় বেশিদিন এই ঝায়মেলার মধ্যে থাকতে হবে না দাদি।খুব তাড়াতাড়িই তোমার থেকে দূরে সরে যাব যতটা দূরে সরে গেলে আর ফেরানো যায় না!”
পৃথিশা মাথা নিচু করে নিজের রুমে চলে গেলো। পৃথিশার দাদী থমথমে মুখ করে বাহিরে বসে আছেন।পৃথিশার চাচীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ধীর পায়ে নিজের রুমে চলে যান তিনি।
বর্তমান কিংবা অতীত যেটাই বলি না কেন সমাজে একটা প্রথা আছে।মেয়েকে অবহেলার চোখে দেখার প্রথা।আগেরকালের প্রথা অনুসরণ করে একালের ‘কিছু’ দাদী-নানীরাও মেয়ে হওয়া নিয়ে আক্ষেপ করে। তাদের কাছে ছেলে মানেই মহামূল্য ধন আর মেয়েরা ফেলনা বস্তু।যদিও কালের বির্বতনে চিন্তা-ভাবনা,মন-মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে।কিন্তু কিছু মানুষের এসব ধারণা এখনও আছে।তেমনি মেয়ে হওয়ার জন্য ছোট কাল থেকেই পৃথিশাকে দাদীর অপবাদ,কটু কথা শুনতে হয়েছে।পড়াশোনায় বাধা থেকে শুরু করে নিজের প্রতিভাগুলোও বিসর্জন দিয়েছে মানুষের কথায় গুরুত্ব দিয়ে। যখন থেকেই মানুষের কথায় গুরুত্ব দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সেদিন থেকেই নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে সে।
পৃথিশার সৌভাগ্য যে তার মা-বাবা সবসময় তার সাথে ছিলো।নাহলে পৃথিশার এতটা পথ পাড়ি দেওয়া,প্রতিনিয়ত নিজের বাড়ির অন্যান্য সদস্যগুলোর বিরোধিতা করা সহজ হতো না।পৃথিশার মনে আছে তার দুরস্পর্কের চাচাতো বড় বোনটাকে খুব অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল ভালো ছাত্রী থাকা সত্ত্বেও।বিয়ের দিন কেঁদে চোখ ফুলিয়ে পৃথিশাকে এক কোণায় ডেকে বলেছিলো, “আর যাই শিখিস না কেনো!মানুষের মুখের উপর ‘না’ বলাটা ভালো মতো শিখিস।নিজের ইচ্ছাটাকে,নিজের স্বপ্নটাকে গুরুত্ব দিতে শিখিস।নাহলে দিনশেষে তোর মনে হবে তুই একটা জীবিত লাশ।”
পৃথিশা সেদিন কথাগুলোর মূল অর্থ না বুঝলেও এখন খুব ভালোভাবেই বুঝে কথাগুলোর মূল্য।
পৃথিশা হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসতে দেখল সুমিতা বেগম খাবার নিয়ে বিছানায় বসে আছেন।ভেজা তোয়ালেটা চেয়ারে বসে মায়ের কোলে মুখ গুজে দিল পৃথিশা।
সুমিতা বেগম পৃথিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “মন খারাপ নাকি?”
পৃথিশা ঘুম ঘুম চোখে বলল, “না, আম্মু আমাকে একটু খায়িয়ে দিবে?”
সুমিতা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পৃথিশা বালিশে কিছুক্ষণ পর উঠে বালিশে হেলান দিয়ে পৃথিশা মোবাইলে অফিসের কাজ দেখতে থাকলো আর সুমিতা বেগম এই ফাঁকে তাকে খায়িয়ে দিলেন।
পৃথিশাকে খাওয়ানো শেষ করে সুমিতা বেগম চলে যান। কিছুক্ষণ পর এসে পৃথিশা ঝাঁকিয়ে বলেন, “এ্যাই,মারুফের নাকি জ্বর।”
পৃথিশা মোবাইল থেকে মুখ তুলে বলল, “হ্যাঁ মা,তুমি কীভাবে জানলে?”
সুমিতা বেগম রেগে বললেন, “তোর মনে কি মায়া-দয়া নাই নাকি।ছেলেটার জ্বর আর তুই এখানে বসে বসে মোবাইল গুতাচ্ছিস।কেমন মেয়ে রে তুই?”
পৃথিশা নিচু স্বরে বলে, “আমাকে তো জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দিলো,আমি কি করবো!”
সুমিতা বেগম কপাল চাপড়ে বললেন, “হায়রে গাধী মেয়ে। মারুফের মা আমাকে না বললে তো জানতেই পারতাম না। আমি তোকে খাবার দিয়ে দিচ্ছি তুই নিয়ে যা।ওর জ্বর না কমা পর্যন্ত আসবি না। তাড়াতাড়ি এসব টি-শার্ট,প্লাজো পাল্টে থ্রিপিস পড় যা!”
পৃথিশা কথা না বাড়িয়ে উঠে চলে গেল।তাড়াতাড়ি জামা পাল্টে একটা হলুদ রঙের সুতি থ্রিপিস পড়ে সুমিতা বেগমের কাছে চলে গেল।সুমিতা বেগম টিফিন কারিতে তরকারি ভরে দিচ্ছেন।পৃথিশা মন খারাপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।ঠিকই তো,মারুফের জ্বর আর সে এখানে বসে বসে আরাম করছিলো!ভাবতেই নিজের উপর রাগ হলো পৃথিশার।
সুমিতা বেগম সবকিছু ঠিকঠাক করে পৃথিশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “সাবধানে যাবি।আর বেশি রাত হয়ে গেলে আসার দরকার।”
পৃথিশা মাথা নাড়লো। সুমিতা বেগম আশপাশটা ভালো করে দেখে পৃথিশার ওড়নাটা মাথায় দিয়ে দরজা খুলে বাহিরে পাঠিয়ে দেয়।অতি ধীর গতিতে নিঃশব্দে দরজা লাগিয়ে রুমে চলে যায়।
_________________
মারুফদের বাসায় দুই-তিনবার কলিংবেল বাজানোর পরও কেউ দরজা খুলছে না।পৃথিশা বাহিরে বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রাগে একসাথে আরও তিন বার বেল বাজালো,কিন্তু এবারও কেউ দরজা খুলল না।রাগী মনোভাব বদলে ধীরে ধীরে পৃথিশার মস্তিষ্কে চিন্তা ভর করলো।বাসায় মারুফ ছাড়া তো কেউ নেউ,আর মারুফ এখনো দরজা না খুলে বসে আছে কেন! চিন্তিত হয়ে বাসার দাঁড়োয়ানের কাছে গিয়ে চাবি চাইলো পৃথিশা।রাত হওয়ায় দাঁড়োয়ান ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল।পৃথিশার ডাকে ঘুম থেকে উঠে বিরক্তি নিয়ে তাকালো।দাঁড়োয়ানকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিকৃষ্ট ভঙ্গিতে নিজের দিকে তাকাতে দেখে রাগ চেপে বসে পৃথিশার উপর।
রাগী স্বরে জিজ্ঞেস বলে, “কি হলো আপনাকে চাবি দিতে বললাম না!”
দাঁড়োয়ান পকেট থেকে চাবির গোছা তুলে মারুফদের বাসার চাবিটা খুঁজতে থাকে।কিছুসময় পর চাবিটা তুলে পৃথিশার হাতে দিয়ে দেয়।চাবি দেওয়ার সময় পৃথিশার হাত বাজে ভাবে স্পর্শ করায় পৃথিশা নিজের জুতার দিকে ইশারা করে বলে, “বেশি বাড়লে জুতাটা আপনার গালের উপর বসবে!”
কথাটা বলেই পৃথিশা ধুপধাপ শব্দ করে উপরে উঠে যায়।দাঁড়োয়ানের দিকে একবার তাকাও না।
ফ্ল্যাটের সামনে এসে তাড়াতাড়ি চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে চলে যায়। দরজা আঁটকে খাবারের ব্যাগটা টেবিলে রেখে মারুফের রুমে ঢুকে পড়ে।
রুমে ঢুকতেই পৃথিশার চোখে দৃশ্যমান হয় রুমের অবস্হা। বিছানার এককোণে মারুফ গায়ে কাঁথা জড়িয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। ভেজা গামছাটা বিছানার এক পাশে পড়ে ঝুলছে।কাঁথাটা অর্ধেক গায়ে আর অর্ধেক মাটিতে ঝুলছে। বাহিরের জামাটা চেয়ারে ঝুলন্ত অবস্হায় আছে,যেকোন মূহুর্তে পড়ে যেতে পারে।আলনার কাপড়গুলো খানিকটা এলোমেলো, যেনো কোন জিনিস খুঁজার উদ্দেশ্যে কেউ হামলা চালিয়েছিল।বিছানার পাশের ছোট টেবিল-টাতে ভাঙা পানির গ্লাসের ছোট ছোট টুকরা পড়ে আছো, আর বাকি অংশ মাটিতে। পৃথিশা অতি সাবধানে ভাঙ্গা গ্লাসের টুকরোগুলো তুলে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে আসলো। রান্নাঘর থেকে ঝাড়ু নিয়ে এসে ময়লা হয়ে থাকা ঘরটা ঝাড়ু দিলো।ভেজা গামছাটা বারান্দায় মেলে দিয়ে মারুফের পাশে এসে বসলো। মারুফের কপালে হাত ঠেকাতেই বুঝতে পারলো আবারো তুমুল বেগে জ্বর এসে পড়েছে।ঔষধ খায়িয়েও কোন কাজ হয়নি।ধীর কন্ঠে মারুফকে ডাকা শুরু করলো সে। পৃথিশা ডাকাডাকিতে বেশ কিছুক্ষণ পর আস্তেধীরে চোখ খুলে তাকালো মারুফ। তার চোখগুলো লাল হয়ে আছে। পৃথিশা তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।তারপর দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে একটা প্লেট নিয়ে মারুফের জন্য অল্প খাবার বেড়ে নিলো। এখন জ্বর মুখ তাই মারুফ বেশি কিছু খাবে না এটা পৃথিশা ভালোমতোই জানে। পৃথিশা এসে দেখে মারুফ আবারো ঘুমিয়ে গেছে।আবারো জোর-জবরদস্তি করে তাকে তুলে বালিশে হেলান দিয়ে বসালো।প্লেটে ভাত মেখে ছোট ছোট লোকমা করে তার মুখে তুলে দিতে লাগলো।পেটে খিদে থাকায় মারুফ কোন উচ্চবাক্য না করে পৃথিশার হাতেই খেতে থাকলো। খাওয়ানো শেষ করে মারুফকে ঔষুধ খায়িয়ে শুয়িয়ে দিলো পৃথিশা।কিন্তু জ্বরটা কমলো বরং আরো বাড়লো।মারুফের দিশেহারা হয়ে গেলো পৃথিশা।
বিছানায় চাদর বিছিয়ে মারুফের মাথায় পানি ঢালতে শুরু করলো সে।অনেকক্ষণ পর তার মনে হলো জ্বরটা কমে এসেছে। মারুফকে ঠিকভাবে শুয়িয়ে দিলো সে। মারুফের মাথার পাশে হেলান বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।
কিছুটা সময় পর মারুফ ঘুমের ঘোরে পৃথিশার কোলে মাথা রেখে তার কোমড় জড়িয়ে ধরলো।লজ্জায় গুটিয়ে গেলো পৃথিশা কিছুসময়ের জন্য। ধীরে ধীরে মারুফের চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো সে।
________
সকালের রোদটা পর্দা ভেদ করে রুমের ভেতর এসে পড়ছে।বাহিরে কিছু পাখি একযোগে ডাকাডাকি করছে। সেই সাথে একটা কাকও কর্কশ গলায় শব্দ শুরু করেছে সে।উপরের তলার কেউ মনে রান্না বসিয়েছে,কেমন যেন পোড়া পোড়া গন্ধ বেরুচ্ছে। পাশের মেইন রাস্তায় রিকশাগুলো জোরে জোরে বেল বাজিয়ে যাতায়াত করছে।
মুখের উপর রোদ এসে পড়ায় মারুফের ঘুম ভেঙে গেলো।চোখ খুলে পৃথিশাকে দেখে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মাথায় কিছুটা চাপ দিতেই রাতের কথা মনে পড়লো ওর। মুচকি হেসে আবারো পৃথিশার দিকে তাকালো সে।ঘুমালে পৃথিশার গালগুলো অদ্ভুতভাবে ফুলে যায়।মারুফের এই বিষয়টা ভীষণ পছন্দ।পৃথিশার গালে আলতো করে চাপ দিতেই তা আরোও ডেবে যায় গালটা।শব্দ করে হেসে ফেলে মারুফ।
কারো হাসির শব্দ শুনে পৃথিশার ঘুম ভেঙে যায়।মারুফকে হাসতে দেখে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে সে।
মারুফ ইশারায় জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”
পৃথিশা মাথা নেড়ে না বোঝায়।কোমড়ের নিচ পর্যন্ত লম্বা চুলটা খোপা করে দরজা খুলে রুম থেকে বের হতেই শায়েলা রহমানকে দেখতে পায়!
চলবে,,