গল্পের নামঃ #প্রণয়
#পর্বসংখ্যা_০৭
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত
সময়ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না,কথাটি পুরোপুরি সত্য।অফিসের কাজের চাপে কয়েকটা মাস কিভাবে পার হয়ে গেছে পৃথিশা বুঝতেই পারেনি।এর মাঝে আবার নতুন করে যুক্ত হয়েছে এনজিও এর কাজ।অনেকদিন ধরেই পৃথিশার ইচ্ছা ছিল ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য কাজ করবে।একটু খোঁজ লাগাতেই বাড়ির কাছে একটা এনজিও এর খোঁজ পায়।প্রতিমাসে বেতনের কিছু অংশ এনজিওতে দান করে দেয়।ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখের হাসির কাছে এই টাকার পরিমাণটা অনেক তুচ্ছ মনে হয় তার কাছে।অফিস থেকে প্রতিদিন নিয়ম করে এক-দুই ঘন্টা বাচ্চাদের সাথে কাটিয়ে আসে সে।শুক্রবারটা তাদের সাথেই বেশি থাকে।তবে এতকিছুর পরও নিজের মা-বাবাকে সময় দিতে ভুলে যায় না সে।
সকাল সকাল অফিসের জন্য বের হওয়ার সময় সে দেখল দুইজন মহিলা তাকে দেখে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলা শুরু করেছে।মানুষ বরাবরই কৌতুহলী প্রাণী।তাই পৃথিশাও নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে দরজার পেছনে আড়ি পেতে দাঁড়িয়ে রইলো।
পৃথিশা শুনতে পেলো একজন বলছে, “কিছুক্ষণ আগে একজনকে দেখলেন না?আমাদের পাশের বাড়ির রহমান সাহেবের মেয়ে।মেয়ের বয়স পঁচিশ থেকে ছাব্বিশে পড়বে।শুনেছিলাম মেয়ে নাকি বিশ বছর বয়সেই দেশের বাহিরে গিয়ে পড়াশোনা করেছে।তারপর আবার এসে বিয়েও করেনি।চাকরি করছে।প্রতিদিন তো সন্ধ্যার পর ঘরে ফেরে জানেন,আমি দেখি।একা একাই আসে,কে জানে কি করে বাসায় ফিরে।”
পৃথিশা আবারো শুনল আবারো কেউ একজন বলছে, “তাই নাকি!মেয়ের তো তাহলে বয়স হয়ে গেছে।এখনও বিয়ে করছে না কেন?”
প্রথম মহিলাই হয়তো আবার বলছে,”মেয়ে তো দেখতে কালো আপা,তাই হয়তো বিয়ে হচ্ছে না।আবার বিদেশ ফেরত মেয়ে তো কে জানে তলে তলে কিছু হয়েছে নাকি।হিজাবী হলে কি হবে,আজকাল তো সবাই ভন্ডামি করে!”
রাগে, ঘৃণায় পৃথিশার গা গুলিয়ে উঠলো এতটা নিয়ে নিম্ন মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ হতে পারে কেউ।এতটা নিচু মনের চিন্তা-ভাবনা কিভাবে করে মানুষ!
নিজের ফোনটা কানে ধরে জোরে জোরে কথা বলার অভিনয় করতে লাগল সে।মহিলা দুটিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল, “আপু রে!আজকাল কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। জিনিসের মতো এখন মানুষের মধ্যেও ভেজাল হয়ে গেছে।আমাদের পাশের বাসার এক মহিলা আছে না,তার ছেলে দুইদিন আগে দ্বিতীয় বিয়ে করে আনছে।প্রথমে নিজের পছন্দে বিয়ে করছিলো।ওইটা থাকাকালেই দ্বিতীয় বিয়ে করে গোপনে রাখছিলো।তারপর দুইদিন আগে বাড়িতে আনছে।প্রথম বউ এখন ডির্ভোস চাচ্ছে কিন্তু মোহরানা শোধের ভয়ে ডির্ভোস না দিয়ে বাড়ি থেকে লাপাত্তা হয়ে গেছে।”
পৃথিশার কথা শুনে মহিলাটির মুখ থমথমে হয়ে গেলো।মুখ ছোট করে তিনি নিজের বাসায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।অপর মহিলাটিও মুখ টিপে হেসে নিজের বাসায় চলে গেলেন।
কান থেকে মোবাইল নামিয়ে দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিয়ে হাঁটতে লাগলো।সকাল সকাল এমন একটা শোধ নিতে পেরে তার মুডটা আজ বেশ ভালো!
?
অফিসে ঢুকতেই প্রতিদিনকার মতো দাড়োয়ানটা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো পৃথিশাকে।প্রতিউত্তরে পৃথিশাও হাসিমুখে তার ভালো-মন্দের কথা জিজ্ঞেস করলো।এই কয়েকমাসে বেশ ভালোই খাতির হয়েছে তার দাড়োয়ানের সাথে।
এখন পর্যন্ত অফিসের কারো সাথে কোন ধরনের ঝামেলা না হলেও ম্যানেজারের সাথে বেশ কয়েকবার কথা কাটাকাটি হয়েছে।লোকটা অতিরিক্ত রকমের গায়ে পড়া স্বভাবের।অনেকবার নিষেধ করা সত্ত্বেও গা ঘেঁসে দাঁড়াবে।
পৃথিশার নিজের কেবিনে বসার কিছুক্ষণ পরই ম্যানেজার রফিকুল এলো তার কাছে কয়েকটা ফাইল নিয়ে।পৃথিশার দিকে ঝুঁকে বললো, “মিস পৃথিশা এগুলো আপনাকে চেক করে দিতে বলেছে স্যার।”
পৃথিশা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কিপ ডিস্টেন্স ফ্রম মি,ইট উইল বি বেটার ফর ইউ।”
রফিকুল এবার নিজের সীমা অতিক্রম করে পৃথিশার হাত ধরলে পৃথিশা জোরে তার গালে থাপ্পর বসিয়ে দেয়।
পৃথিশার হাতে থাপ্পর খেয়ে ক্রৌধ মিশ্রিত চাহনি দেয় রফিকুল তার দিকে।দুহাত শক্ত করে ধরে পৃথিশার নিকাবটা জোরে টেনে ধরে।ফলস্বরূপ পৃথিশার মাথার দুইপাশে নিকাবে লাগানো থাকা দুইটি পিন তার মাথায় লেগে যায়।পিন লাগানো থাকায় নিকাবটা খুলতে অসমর্থ হয় রফিকুল।ব্যাথায় পৃথিশা চিৎকার দিয়ে উঠে।রুমটা সাউন্ড প্রুফ হওয়ায় বাহিরে কেউ কোন শব্দ শুনতে পেলো।
রফিকুলের সাহস যেন দ্বিগুন বেড়ে গেলো।পৃথিশার হিজাবের দিকে হাত বাড়ালো সে।তার আগেই মাথায় তীব্র কিছুর আঘাতে শরীরের সব শক্তি যেন চলে গেলো।ঝাপসা চোখে দেখতে পেলো পৃথিশা তার দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে।গালে আবারো থাপ্পর পড়লো রফিকুলের,পৃথিশা আবারো থাপ্পর মেরেছে তাকে।
রফিকুলের কলার ধরে পৃথিশা বাহিরে নিয়ে আসল।অফিসের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মাটিতে ফেলে দিলো তাকে।অফিসে থাকা বাকিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে।
রফিকুলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে অফিসের এক ছেলে কলিগ দাঁড়িয়ে বলে, “এসব কি মিস পৃথিশা,আপনি স্যারকে এভাবে মাটিতে ফেলে রেখেছেন কেন?এটা কেমন অসভ্যতা!”
পৃথিশা চেঁচিয়ে বলে উঠে, “আমাকে এসব সভ্যতা-অসভ্যতা না শিখিয়ে আপনার মহামান্য স্যারকে শিখান।আমি নাহয় সভ্যতা জানি না,কিন্তু আপনাদের স্যার সভ্যতা জেনে কি করে একটা মেয়েকে একা রুমে হয়রানি করতে পারে?হাউ?”
অফিসের সবাই চুপ হয়ে গেছে।কেউ মাথা তুলে তাকাচ্ছে না।পৃথিশা আবারো বলে উঠে, “আমার মনে হয় না আমিই প্রথম।এর আগেও মনে হয় অনেক মেয়েকে হ্যারাস করেছেন তিনি। বলুন তো কে কে তার এমন ভালোমানুষির শিকার!”
কেউ কিছু না বলে আবারো মাথা নিচু করে রইল।একজন মেয়ে বলে উঠল, “ম্যাম ছেড়ে দিন,ছেলে মানুষ ত।এবারের মতো ক্ষমা করে দিন।”
পৃথিশা কড়া কন্ঠে বলে উঠল, “আমি কাউকে ছাড় দেইনা।অনেকবার ওয়ার্নিং দেওয়ার পরও তিনি শুনেনি।নিজের সীমা অতিক্রম করে গেছে।আর আপনিই বা কোন মুখে তাকে ছেড়ে দিতে বলছেন একজন মেয়ে হয়ে।”
সব আবার নিস্তব্ধ।রফিকুল মাটিতে বসে হাঁপাচ্ছে।মাথায় ভারী ফুলদানি দিয়ে আঘাত খাওয়ার ফলে মাথা থেকে গড়িয়ে রক্ত পড়ছে।হুট করে একজন মেয়ে বলে উঠল, “ম্যাম তিনি আমার সাথেও এমন বাজে আচরণ করেছে।পরে আবার ব্ল্যাকমেইলও করেছে আমায়।”
মেয়েটার পর ধীরে ধীরে আরও কিছু মেয়ে নিজেদের ঘটনা বলতে শুরু করলো।পৃথিশা শান্ত স্বরে সবটা শুনে একসময় সবাইকে থামিয়ে দিলো।একজন মেয়েকে নিজের কাছে এনে বলল, “নিজের জুতা খুলে তার গালে থাপ্পর লাগাও।”
মেয়েটা হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকালো।পৃথিশা হুংকার দিয়ে বলল, “কি হলো আমি কি বলেছি শুনতে পাওনি?”
মেয়েটা কাঁপা হাতে জুতা খুলে রফিকুলের মুখে থাপ্পর মেরে দিলো।পৃথিশা এবার রফিকুলের দিকে তাকিয়ে কাঠ কাঠ স্বরে বলল, “দুইদিন পর যখন আপনার নিজের বোন বাড়িতে বিদ্ধস্ত অবস্থায় বাড়িতে আসবে ফিজিক্যালি মলেস্ট হয়ে সেদিন বুঝতে পারবেন আপনার কাজটা কতটা জঘন্য ছিল একজন মেয়ের কাছে!”
ততক্ষণে অফিসের বস আমিরুল ইসলাম চলে এসেছেন।অফিসে এভাবে সবাইকে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হচ্ছে এসব।”
তার অ্যাসিসটেন্ট তাকল সব ঘটনা খুলে বলল।পৃথিশা এবার তার সামনে গিয়ে বলল, “অফিসে এখন থেকে শুধুমাত্র এডুকেশনাল সার্টিফিকেট না দেখে তার চরিত্রের সার্টিফিকেট-টাও যাচাই করে নিবেন।”
?
নিজের কেবিনের দেয়াল ঘেঁষে বসে হাটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছে পৃথিশা।আজকের ঘটনা তার মনে বেশ প্রভাব ফেলেছে।ছোট বেলার ঘটনাটা বারবার মস্তিষ্কে ভেসে উঠছে।
পৃথিশা যখন ছোট,বয়স সাত বছর চলছে।তখন তার ছোট চাচীর ভাই আসত তাদের বাড়িতে বেড়াতে।আসার সময় পৃথিশার জন্যও চিপস-চকলেট নিয়ে আসত।কিন্তু শর্ত একটাই ছিল পৃথিশা আনা খাবারগুলো তার কোলে বসে খাবে।পৃথিশা বসতে চাইত না তার কোলে,কেমন যেন অস্বস্তি লাগতো তার স্পর্শে।সুমিতা এই কথা বলার পর তিনি আর পথিশাকে ওই লোকের কাছে যেতে দেয়নি।এনিয়েও ঝামেলা করেছিল ছোট চাচী।তখন না বুঝলেও এখন পৃথিশা বুঝতে পারে লোকটা কতটা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের বাড়িতে আসতো।
আজ আবারো অনেক বছর পর এমন জঘন্য পরিস্হিতির শিকার হয়েছে সে!
চলবে,