গল্পের নামঃ #প্রণয়
#পর্বসংখ্যা_০৬
লেখনীতেঃ #ফারিহা_জান্নাত
ছোট চাচীর সামনে মিষ্টির বক্সটা শব্দ করে রেখে পৃথিশা বাম পাশের সোফায় পা তুলে বসল।পৃথিশার ছোট চাচী টিভিতে সিরিয়াল দেখছিলেন।পৃথিশা মিষ্টির বক্সটা তার সামনে তিনি রাগে গর্জে উঠলেন।
চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ওই তুই দেখতে পারতেছিস না আমি টিভি দেখতেছি।তাও কেন এটা আমার সামনে রাখলি।”
পৃথিশা নিকাব খুলে মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “এটা আপনার জন্য এনেছি চাচি।খুলে দেখেন তো পছন্দ হয় নাকি।”
পৃথিশার ছোট চাচী ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বক্সটা খুলতেই দেখতে পেলো নানারকম মিষ্টি।বরাবরই মিষ্টি তিনি বেশ পছন্দ করেন।খুশিতে গদগদ হয়ে তিনি পৃথিশাকে বললেন,”বাবাহ্,তুই আমার মিষ্টি এনেছিস।তোর সুমতি হয়েছে তাহলে।এবার তো বুঝতে পারছিস আমি তোর ভালোই চাইতাম।”
পৃথিশা দাঁত বের করে একটা হাসি দিলো তার দিকে।তার চাচী যেই মিষ্টি মুখে নিতে যাবে পৃথিশা জোরে বলে উঠলো, “এটা আমার চাকরি হওয়ার উপলক্ষ্যের মিষ্টি চাচী।”
তার ছোট চাচী তৎক্ষনাৎ থেমে গেলেন।হতভম্ব স্বরে বললেন,”কিহ্!”
পৃথিশা এবার বড় একটা রসোগোল্লা মুখে নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলল,”আরে,টিভিতে যে কিছুদিন আগে একটা চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে কর্ণ ভাইয়া পরিক্ষা দিলো না!”
কর্ণ হলো ছোট চাচীর বড় ছেলে।পৃথিশার ছোট চাচী ছোট ছোট চোখ করে বললেন,”হে,অনেক বড় কম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়েছিলো।”
পৃথিশা মিষ্টিটা খেয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল,”ওই কম্পানিতে তো ভাইয়ার চাকরি হয়নি তাইনা?”
ছোট চাচী মুখ ছোট করে বলল,”আরে বলিস,এসব কম্পানিতে টাকা দেওয়া লাগে চাকরির জন্য।আমার ছেলে মেধাবী,সে টাকা দিয়ে ভর্তি হবে কেন!”
পৃথিশা তার সামনে গিয়ে মুখে ঠেসে একটা মিষ্টি ঢুকিয়ে বললো,”ওই কম্পানিতেই কোন টাকা ছাড়া উচ্চ পদে আমার চাকরি হয়েছে।নাও এই উপলক্ষ্যে তোমার প্রিয় মিষ্টি এনেছি আমি।মন ভরে খাও।”
পৃথিশা সেখান তাকে সেখানে রেখেই বাটিতে করে দুইটা মিষ্টি নিয়ে দাদীর রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। পৃথিশার দাদী রুমে শুয়ে ছিলেন।পৃথিশাকে আসতে দেখে তিনি হুংকার দিয়ে বলেন,”ওই মাইয়া তুই আমার রুমে কি জন্যে আইছোস?”
পৃথিশা মিষ্টির বাটি থেকে একটা মিষ্টি তার মুখে দিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলল,”এটা মোর চাকুরির মিষ্টি।আপনের জন্য মুই আনছি।নেন আপনে খান!”
পৃথিশা মিষ্টিটা তার মুখে ঢুকিয়েই ছুটে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।সে জানে তার দাদী এখন অনেক চিৎকার-চেঁচামেচি করবে,কিন্তু তাতে তার কি যায় আসে!
?
মায়ের মুখে মিষ্টি তুলে দিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো পৃথিশা।পানি ভরা চোখ নিয়ে পৃথিশার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন সুমিতা বেগম।তার মেয়ে এখনো আত্মনির্ভরশীল। যেটা তিনি করতে পারেননি সেটা তার মেয়ে করে দেখিয়েছে।
বাহির থেকে পৃথিশার দাদীর চিৎকার শুনলে পৃথিশার মা কপাল চাপড়ে বলে উঠেন, “কেন যে তুই ওদের সাথে লাগতে যাস আমি বুঝি না।জানিসই তো তারা সবসময় এরকমই করে,তাহলে তুই একটু মানিয়ে চলবি না!”
হিজাব খুলতে খুলতে পৃথিশা জবাব দিলো,”এসব মানিয়ে-টানিয়ে চলতে পারব না আমি মা।তুমি তো সবসময় মানিয়ে চলেছো,কই তারা তো তোমার নিরবতা দেখে থেমে থাকেনি।উল্টো আরো উৎসাহ পেয়েছে। মানিয়ে চলতে বললে ওদের বলো,আমার দ্বারা ওসব হবে না!”
সুমিতা বেগম পৃথিশাকে বললেন, “তুই আসলেই একটা জেদী।আচ্ছা যা এবার গোসল করে ভালো মতো ফ্রেশ হয়ে টেবিলে খেতে আয়।”
পৃথিশা বলল,”আজ বাবার সাথে খাবো মা।এখন খাবো না!”
?
বাবা এসেছে শুনে পৃথিশা দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।দিনশেষে ক্লান্ত শরীরে বাবাকে দেখতে পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে যায় পৃথিশার।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আজ থেকে বাবাকে এক্সট্রা সময় কাজ করতে নিষেধ করে দেবে।
বাবার জন্য আনা শার্ট আর মায়ের জন্য আনা চুড়িটা পৃথিশা ব্যাগে করে লুকিয়ে নিয়ে গেলো সবার থেকে। রুমে ঢুকতেই দেখতে পেলো বাবা পানি খাচ্ছে আর মা তাকে পাখা দিয়ে বাতাস করছে।তাদের ঘরটা রান্নাঘরের পাশেই তাই এই ঘরটা একটু বেশিই গরম থাকে।
ব্যাগটা টেবিলে রেখে মায়ের কাছ থেকে পাখাটা নিয়ে বলল বাবার জন্য ফ্রিজ থেকে মিষ্টি নিয়ে আসতে। সুমিা বেগম মেয়ের হাতে মাখা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পৃথিশা হাতপাখা দিয়ে বাবাকে বাতাস করতে থাকলো।
পৃথিশার বাবা রহমান সাহেব মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললেন,আম্মাজান রুমে ফ্যান আছে তো।”
পৃথিশা অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু ফ্যানটা তে বেশ পুরোনো আব্বু,তেমন বাতাসও হয়না।ফ্যানটা পাল্টাচ্ছেন না কেন?”
রহমান সাহেব মৃদু হেসে বলল, “এটাই বেশ ভালো চলছে।অকারণে ফ্যান পাল্টিয়ে টাকা নষ্ট করবো কেন!”
পৃথিশা বুঝতে পারলো মাস শেষে সংসারিক কাজে টাকায় টান পড়বে বলে বাবা ফ্যান পাল্টাচ্ছে না।মনে মনে ঠিক করলো কালই ফ্যানটা পাল্টাবে।
তাদের ভাবনার মাঝেই সুমিতা বেগম শরবত আর মিষ্টি নিয়ে আসলেন।
রহমান সাহেব অবাক হয়ে বললেন, “বাসায় হুট করে মিষ্টি কে আনলো!কোন অনুষ্ঠান আছে নাকি?”
সুমিতা বেগম হেসে বললেন,”তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করো।”
রহমান সাহেব পৃথিশাকে কিছু বলার আগেই সে লাফিয়ে বলে উঠল, “আমার চাকরিটা পার্মানেন্ট ভাবে হয়ে গেছে আব্বু।কিছুদিন আগে ছোট চাচী কর্ণ ভাইয়ার একটা কম্পানিতে ইন্টারভিউ দিবে বলে পুরো মানুষকে চিল্লিয়ে জানালো না!সেই কম্পানিতেই আমার চাকরি হয়েছে কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং পোস্টে। তাই আপনার জন্য আমি মিষ্টি নিয়ে এসেছি বাড়ি আসার সময়।”
পৃথিশা জোরে একটা শ্বাস নিয়ে বলল,”আমার স্যালারিটা ছয় অঙ্কের আব্বু,এখন থেকে আপনাকে ওভার টাইম কাজ করতে হবে না।প্রতি মাসে সংসারের টাকায় কমতি হবে না আর।”
রহমান সাহেব ছলছল চোখে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলেন।চোখের পানি আটকানোর এক বৃথা চেষ্টা। পৃথিশা আবারো উৎফুল্ল স্বরে বলল, “আপনার জন্য আরেকটা উপহার আছে আব্বু।দাড়ান দেখাচ্ছি।”
টেবিল থেকে ব্যাগটা এনে পৃথিশা রহমান সাহেবের হাতে দিয়ে বলল, “দেখেন তো ভিতরে কি আছে?”
প্যাকেট খুলতেই দেখতে পেলো একটা সাদা রঙের পাঞ্জাবি আর একটা শার্ট। পৃথিশার দিকে তিনি অবাক হয়ে তাকালে পৃথিশা হেসে বলে,”এগুলো তোমার জন্য আমি এনেছি।”
সুমিতা বেগম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই টাকা কোথায় পেলি?”
পৃথিশা হেসে বলল, “ফ্রিল্যান্সিং করে মা।আমি কি এতদিন হাত গুটিয়ে বসে ছিলাম নাকি!”
পৃথিশা উঠে গিয়ে সুমিতা বেগমের জন্য আনা চুড়িটা তার হাতে দিয়ে বলল,”দেখো তো তোমার মন মতো হয়েছে নাকি!”
সোনার চুড়ি দেখে চমকে উঠলো সুমিতা বেগম।কয়েকদিন আগে আনিকার এনগেজমেন্টের রিং কিনার জন্য দোকানে গিয়ে তার চুড়িটা বেশ পছন্দ হয়েছিল।পরে আর কেনা হয়নি।
পৃথিশা মুচকি হেসে বলল, “তোমার পছন্দ হয়েছিল বলেই আগেভাগে বলে রেখেছিলাম আমার জন্য রেখে দিতে।আজ আসার সময় নিয়ে আসলাম।”
ডুকরে কেঁদে উঠলেন সুমিতা বেগম।পৃথিশা চুড়িগুলো প্যাকেট থেকে খুলে যত্ন নিয়ে মায়ের হাতে পড়িয়ে দিলো।
বাবা-মায়ের মুখে তৃপ্তির হাসি নিজেকে আজ সফল মনে হলো পৃথিশার।এই হাসিটুকুর জন্যই তো এত প্রচেষ্টা।
?
সবকিছু থাকা সত্ত্বেও কেমন যেনো খালি খালি লাগছে সবটা।আকাশে বুকে রাত নেমে এসেছে।বৃষ্টি বৃষ্টি গন্ধ আসছে বাতাসে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজেদের বাড়ির পাশের মারুফদের বাসার মারুফের রুমটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পৃথিশা।আজ সব ঠিক থাকলে মারুফ ও তার সাথে থাকতো।তার খুশিতে খুশি হতো।পৃথিশার মনে আছে মারুফ তাকে বলেছিলো ‘যেদিন পৃথিশা পড়াশোনা শেষ করে নিজ পায়ে দাঁড়াবে সেদিন নাকি সে পুরো পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ করবে!’
মনে মনে বিড়বিড়িয়ে পৃথিশা বলল,
-“আপনি আপনার কথা রাখেননি মারুফ ভাই।আপনি সত্যি একটা খারাপ লোক।খুব খারাপ।ছয়টা বছর পেরোতে চলছে আপনার নিরুদ্দেশ হওয়ার।আপনি এখনও আসলেন না।আর কত অপেক্ষা করাবেন আমায়?”
চলবে,