-“এ্যাই পৃথিশা জানিস,আমাদের মারুফের বিয়ে ঠিক হয়েছে।মেয়েতো একেবারে লক্ষ্মীমন্ত, দুজনকে একসাথে দারুণ মানাবে।”
মায়ের কথা শুনে পৃথিশার বুক কেঁপে উঠলো।লোকটা তাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবে,তবে কি অন্য সবার মত তার ভাগ্যেও ভালোবাসার বদলে ধোঁকা জুটবে!
মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে পৃথিশা দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পেছন থেকে পৃথিশার মা অবাক চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ঢাকেন।কে জানে কি হয়েছে,এই মেয়ের তো কোন কিছুর ঠিক নেই।
ছাদে গিয়ে মারুফকে এককোণে বসে থাকতে দেখে পৃথিশা দৌড়ে তার কাছে গেল।
কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলে উঠল, “আপনি কি সত্যি বিয়েতে রাজি হয়ে গেছেন?আমায় রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলবেন।”
মারুফ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে পৃথিশার দিকে তাকিয়ে বলল,”জানিস,পৃথিবীতে কিছু মানুষ আসে কষ্ট পাওয়ার জন্যই।তাদের ভাগ্যে সুখ থাকে না।তারা কখনো ভালো থাকেনা।আমিও হয়তো তাদের মাঝে একজন।”
পৃথিশা ছলছল চোখে মারুফের দিকে তাকালো।ধরা গলায় বলে উঠল,”আ–আপনি তাহলে বিয়তে রাজি?”
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মারুফ।ভরাট কন্ঠে বলল, “নিরুপায় আমি,পুরোপুরি নিরুপায়।একটা চাকরির অভাবে আজ তোর বাড়িতে প্রস্তাবও নিয়ে যেতে পারছি না।আর এই সুযোগে কাকী মা-কে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে নেহাকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিতে চাইছে।আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।”
পৃথিশা ফুঁপিয়ে কান্না করে দেয়।মাথার ওড়নাটা ভালো করে টেনে ধরে বলে,”আপনি বিয়েতে না করে দিন।”
মারুফ সিগারেটে আবারো টান দিয়ে বলে,”সম্ভব না।বিয়ের সব কাজকর্ম ঠিক হয়ে গেছে।কালই হয়তো বিয়ে পড়িয়ে দেবে।”
পৃথিশা থম মেরে বসে পড়ে মাটিতে।চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবাধ্য নোনাজল। মারুফ হাত দিয়ে নিজের চুলগুলো টেনে হুট করে পৃথিশার হাত দু’টো ধরে বলল,”পৃথি,চল পালিয়ে যাই।পালিয়ে বিয়ে করে ফেলবো তারপর আমি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ফিরে আসবো।তখন আর কেউ কিছু বলতে পারবে না।”
পৃথিশা ঝট করে নিজের হাত দুটো ছাড়িয়ে নিলো।কঠোর স্বরে বলল,”আপনি বিয়ে করবেন।আমার কসম!খালাকে কোনরকম কষ্ট দেবেন না।”
মারুফ পৃথিশার দুইহাত ঝাঁকিয়ে বলল,”কসম কেন দিলি তুই? কসম দিতে নিষেধ করেছি না তোকে?তাও কেন কসম দিলি তুই?কসম তুল?”
পৃথিশা ফুপিয়ে কেঁদে উঠল,”উঠাবো না আমি।আপনাকে আমি চিনি।আপনি যা জেদি আমি কসম উঠিয়ে নিলে আপনি বিয়েতে রাজি হবেন না।এতে খালাম্মা কষ্ট পাবে,আপনার কাকীর কাছে সারাজীবনের জন্য তার সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে।”
মারুফের হাত শিথিল হয়ে গেলো।অসহায় স্বরে বলল,”কেন এত অন্যদের কথা ভাবিস তুই?কেন?নিজের কথাও তো ভাবতে পারিস!”
পৃথিশা মৃদু হাসি দিয়ে বলল,”মানুষের উপকার করার পর তাদের মুখে থাকা তৃপ্তির হাসিটুকুই আমার ভালো থাকার জন্য যথেষ্ট।”
মারুফ কিছু একটা ভেবে পৃথিশার সামনে এসে তার কপালে ঠোঁট ছুয়িয়ে বলল,”ভালোমতোই জানিস,আমি এসব কসম কাটাতে বিশ্বাসী না।কিন্তু ব্যাপারটা যখন তোকে নিয়ে সেখানে আমি দুর্বল।তোর এই অতি দুঃসাহসিক কাজের জন্য তোকে শাস্তি পেতে হবে।তোকে আমার বিরহের দহনে পুড়িয়ে মারব মনে রাখিস!”
মারুফ কথাগুলো বলে আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল।পৃথিশা পেছন হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ধীরে ধীরে নিজের হাতটা কপালে ঠেকিয়ে কেঁদে ফেললো।আজ হয়তো তার কাঁদার দিন।
সেদিন রাত্রেই পৃথিশা খবর পেলো মারুফের নাকি আগামীকাল কোর্ট ম্যারেজ হয়ে যাবে।খবরটা শুনে তার মনে হলো তার বুকে পাথরের মতো ভারী কোন জিনিস রাখা হয়েছে।একবার মন চাইলো মারুফের সাথে পালিয়ে যাবে,কিন্তু নিজের বাবার মুখটা দেখে সেটা করার সাহস হলো না। রাগের বসে সেদিন রাত্রেই কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো।মা-বাবাকে না জানিয়েই চট্টগ্রামে নিজের মামাতো বোনের বাড়িতে চলে যায়।তার কিছুদিন পরই স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায় নিজের সব মায়া কাটিয়ে।পৃথিশার বাবা-মা খবর পেয়ে খুবই কান্নাকাটি করে।তবে পৃথিশা তাদের সামলিয়ে নেয়।মারুফের কোন কথা উঠলেই সুন্দরমত এড়িয়ে যায় সে।আর মায়া বাড়াতে চায় না,অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছে পৃথিশা।বলা যায় ঠিক সামলাতে পারিনি,মারুফ নামটা শুনলেই তার চোখ ভিজে আসে।
পৃথিশার মনে পড়ে,অনেক আগে নিজের নানির বলেছিলেন,
-“প্রকৃতি অনেক সময় তোমার বিপরীতে চলবে।এই বিপরীতে চলার কারনে তুমি তোমার অনেক প্রিয় জিনিস হারাবে।একসময় তুমি এই হারানোতেই অব্যস্ত হয়ে যাবে!”
পৃথিশা তখন না বুঝলেও আজ বুঝেছে তার নানী কি বুঝাতে চেয়েছিলো।কথাগুলোকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছে সে।
??
দীর্ঘ পাঁচবছর পর আবারো দেশের মাটিতে পা দিয়েছে পৃথিশা।নিজেদের এলাকায় ঢুকার সাথে সাথে তার হৃদপিণ্ডের গতি দ্বিগুণ হয়ে গেল।আচ্ছা!কোথায় আছে মানুষটা,কেমন আছে?তাকে কি ভুলে গিয়েছে নাকি এখনও ভালোবাসে!এরকম নানা প্রশ্ন উদয় হচ্ছে পৃথিশার মনে।গত পাঁচ বছর হাজার চেষ্টা করেও মারুফ নামের অগোছালো ছেলেটিকে এক মূহুর্তের জন্যও ভুলতে পারেনি সে।বরং আরো বেশি মনে পড়েছে।মারুফ ঠিকই বলেছিল,তার বিরহের দহনে পৃথিশা পুড়েছে।প্রতিনিয়ত পুড়েছে!
অনেকদিন পর নিজের বাড়িতে এসে পৃথিশা পুরোপুরি আবেগআপ্লুত হয়ে গিয়েছিল।দুপুরে পেট ভরে মায়ের হাতে খেয়ে নিজের রুমে এসে বসল।তার কিছুক্ষণ পর তার মামাতো বোন তার পাশে এসে বসলো।পৃথিশা আর মারুফের বিষয়টা জানতো একমাত্র তার মামাতো বোন নিশী।
নিশী পৃথিশাকে জিজ্ঞেস করলো, “কিরে বিয়ে শাদী করবি না নাকি?অতীত আঁকড়ে ধরে আর কতদিন থাকবি?”
পৃথিশা উত্তর দিল না।তার চোখ মারুফদের বাসার মারুফের রুমের বড় জানালাটার দিকে। কিছুক্ষণ পর সেখানে একটা সুন্দরী মেয়ে একটা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে এসে দাঁড়ালো।মেয়েটার মুখে হাসি উপচে পড়ছে,ছোট বাচ্চাটাও মায়ের হাসি দেখে খিলখিল করে হাসছে।মেয়েটা মনে হয় মারুফের স্ত্রী!পৃথিশা ধরা গলায় বলল,
-“আপাই দেখ!লোকটার মনে হয় মেয়ে হয়েছে!”
চলবে,
গল্পের নামঃ #প্রণয়
লেখনিতেঃ #ফারিহা_জান্নাত
#পর্বসংখ্যা_০১