অনাদৃতা – (৭)

0
560

#অনাদৃতা – (৭)
লিখাঃ #আতিয়া_আদিবা

বাড়িতে আজ আয়োজন করে রান্না করা হচ্ছে। বাবা নিজে কিছুক্ষণ পর পর এসে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। বেশি না, মিনিট পাঁচেক হবে। বাবা রান্নাঘরে এসেছিলো।
মাকে নরম সুরে বলল,
দাও দেখি! একটুখানি ঝোল দাও তরকারির। ঝাল, লবণ ঠিক হলো কিনা দেখি।
মা উৎসাহের সাথে ছোট চামচে করে বাবার হাতের তালুতে খানিকটা ঝোল দিলো। বাবা সেটুকু তৃপ্তিভরে জিভের ডগায় নিয়ে খেলো। তার চোখে মুখে আনন্দের ছাপ স্পষ্ট।
বাবা খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,
রান্না কিন্তু মজা হয়েছে! ব্যাপক স্বাদ!
মা মুখে কিছু বললেন না। কিন্তু তার হাসিতে সন্তুষ্টি।

সবার মাঝে অস্থিরতা। আমার নিজের মনও স্থির নয়। তবে আমার অস্থিরতার কারণ মাইনুল সাহেবের ছেলে নয়। ভিন্ন কিছু।
আজ সকালে আরো একটি নীল খাম পাওয়া গিয়েছে। গতকালের মতই যত্ন করে আঠা দিয়ে লাগানো। সে খামে আজ যে চিঠি ছিলো তাতে লিখা,

– অচেনায় খুঁজে পাবে আমায়!

ইতি,
রৌদ্র

চিঠিটা পড়ে সবচেয়ে বিস্ময়কর লেগেছে যে বিষয়টি তা হলো সংখ্যা। সাত।
চিঠির মাঝে এই সংখ্যার কি কাজ? আমি বুঝতে পারিনি। বোঝার চেষ্টাও যে করেছি তা নয়। ‘৭’ সংখ্যাটিকে অহেতুক কোনো নাম্বার বলে মনে হয়েছে।
তবে দুটো চিঠির কথা মিলিয়ে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়,

‘অনা, আমি ফিরে এসেছি। অচেনায় খুঁজে পাবে আমায়।’

অর্থাৎ রৌদ্র ফিরে এসেছে, তাকে খুঁজে পাবো অচেনায়।

আরো একটি ভুতুড়ে কাহিনী আজ আমার সাথে ঘটেছে। আমি যখন চিঠি পড়ছিলাম, আচমকা মনে হলো কেউ তার গরম নিশ্বাস আমার কাধে ফেলছে। আমার সাথে সাথে যেনো সেও চিঠি পড়ছে! একে নিছক মনের ভুল বলে উড়িয়ে দিতে পারছি না। গতকালকের পর থেকে আমার সর্বক্ষণ মনে হচ্ছে কেউ যেনো আমায় দেখছে। আবার আজ কাধের ওপর কারো উত্তপ্ত নিশ্বাস!
অষ্টপ্রহর কেউ যেনো আমার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছে। এমন অনুভূতির সাথে আমি অপরিচিত। অনভ্যস্ত।

আজও গোসল করে শাড়ি পরতে হলো। সুন্দর করে সাজতে হলো। ছেলে তার বাবা মায়ের সাথে আসবে। দুপুরে খাবে। আমি তখন তাদের সামনে যাবো না।
বিকালে তার সাথে আমার আলাদাভাবে কথা বলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা কথা বলবো বাগানের মাঝখানে বসে। সেখানে দুটো কাঠের চেয়ার আর একটি গোল টেবিল রাখা হয়েছে। প্রায় বছর দুয়েক আগে কোন এক মেলা থেকে মা পছন্দকরে কাঠের দুটো মগ কিনেছিলেন। কিন্তু ব্যবহার করা হয়নি। আজ তা ব্যবহার করা হবে বলে মায়ের আনন্দের সীমা নেই। সেই মগ দুটোতে চা বা কফি কিছু একটা পরিবেশন করা হবে। কথা বলার ফাঁকে ফুলি মাসি গিয়ে দিয়ে আসবেন। সব কিছুই পূর্ব পরিকল্পিত।

দুপুর দুইটায় মাইনুল আংকেল তার বৌ এবং ছেলে নিয়ে আমাদের বাসায় উপস্থিত হলেন। নানা পদের মিষ্টি নিয়ে এসেছেন তারা। হেনা আন্টি নিজে এসে আমার ঘরে দেখা করে গেলেন। উনিও খালি হাতে আসেন নি। খুব সুন্দর একটি জামদানী শাড়ি নিয়ে এসেছেন আমার জন্য। হালকা আকাশী রঙের। শাড়িটা আমার বেশ পছন্দ হলো।
আড্ডা এবং হাসাহাসির মাঝে সবার দুপুরের খাওয়া সম্পন্ন হলো। আমার খাবার ঘরেই দেওয়া হলো।

খাটে বসে আধশোয়া অবস্থায় দেয়ালে হেলান দিয়ে ছিলাম। কখন যে দুচোখে এক টুকরো ক্লান্তি ভর করেছিলো, সেদিকে হুশ নেই। তখন আমি কালঘুমে আচ্ছন্ন। আধো ঘুম, আধো জাগনা অবস্থায় কোন ইন্দ্রিয় যেনো জেগে উঠলো। দেখলাম,
রৌদ্রর বুকে মাথা রেখে গভীর ঘুমে মগ্ন আমি। সে আলতোভাবে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সুযোগ বুঝে কপালে ছোট্ট একটি চুমু এঁকে দিতে সে ভুললো না!
খোয়াব হলেও, আমার অবচেতন মন হয়তো এটুকু জানতো রৌদ্র এখন শুধুমাত্র আমার কল্পনা। তার অস্তিত্ব বাস্তবে আর নেই। তাই কপালে তার ঠোঁট দুটোর স্পর্শ অনুভব করার সাথে সাথে ঘুমের মাঝেই বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো। চোখের কোণে পানি এসে জমলো।
ভাগ্যিস মা এসেছিলো, নয়তো এ অনুভূতি মনের গহীনে কত ক্ষতের সৃষ্টি করতো কে জানে?

মা এসে ডাক দিতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। তিনি বললেন,
একি সেজেগুজে ঘুমিয়ে গিয়েছিস? ছেলে বাগানে তোর জন্য অপেক্ষা করছে। এক্ষুণি তৈরি হয়ে যা। ফুলিকে বলেছি কফি দিয়ে আসতে।

চোখজোড়া লেগে এসেছিলো। আমি যাচ্ছি।

আর শোন, অনা।

বলো মা।

খোলামেলা কথা বলিস। ছেলে সবই জানে। অসুবিধা নেই।

যেহেতু সবই জানে সে বিষয়ে কথা বলার দরকার কি?

তাও তোর মুখে শুনতে চাইতে পারে।

হেসে বললাম,
কেনো আমার মুখ দিয়ে কি একই কথা অন্য সুরে বের হবে?

মা গম্ভীর স্বরে বললেন,
এত কথার উত্তর দিতে পারবো না। তৈরি হয়ে নে আর যা বলেছি মাথায় রাখিস।

মা ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। চুল আঁচড়ালাম। কপালে ছোট্ট একটি টিপ পরলাম। সাজ এটুকুর মাঝেই সীমাবদ্ধ রইলো।

আজকের বিকালটা সুন্দর। ভাদ্র মাসের তুলনায় গরমের উত্তাপ নেই বললেই চলে। দক্ষিণের বাতাস গাছপালা ছুঁয়ে যাচ্ছে বার বার। গতকাল বৃষ্টি হয়েছে। বাগানের মাটি ভেজা। সোঁদা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ওইতো! কাঠের চেয়ারে হালকা খয়েরী রঙের শার্টে একজন পুরুষ বসে আছে। মাইনুল সাহেবের ছেলে। দূর থেকে মুখের এক অংশ দেখে বুক ধুকপুক করতে লাগলো! খুব পরিচিত লাগছে মুখের এই অংশটা! কাছে যেতেই সে আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। হেসে বলল,
হ্যালো, অনাদৃতা।

আমি চমকে উঠলাম। অস্ফুটে বলে উঠলাম,
রৌদ্র!

তিনি বললেন,
জি। দাঁড়িয়ে আছেন কেনো বসুন।

আমি বসলাম। কিন্তু তার ওপর থেকে চোখ এক মুহুর্তের জন্যও সরাতে পারলাম না। তাকে দেখতে অবিকল আমার রৌদ্রর মত। এত মিল কারো সাথে হয়? পুরো শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। জানি না, হৃদয়ের স্পন্দন সেও শুনতে পারছে কিনা। অপলক তাঁকিয়ে রইলাম তার দিকে।

রৌদ্র বলল,
কিছু বলছেন না যে?

কোনোভাবে নিজেকে সামলিয়ে বললাম,
এমনি। আসলে আমি খুব বেশি কথা বলতে পারিনা।

রৌদ্র হেসে জিজ্ঞেস করলো,
বিষয়টা কি নতুন মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে নাকি সবার ক্ষেত্রেই?

নতুন কারো ক্ষেত্রে।

হুম। অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। অচেনা মানুষের সাথে সাধারণ আলাপচারিতার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়।

হাসার চেষ্টা করে বললাম,
জি।

এর মাঝে ফুলি মাসি আসলো। আজকে তার চোখেমুখে কোনো ভয়ের ছাপ দেখছি না। তিনি হাসিমুখে কফি আর দু পিস কেক আমাদের সামনে রেখে চলে গেলেন। মাসি চলে যাওয়ার সাথে সাথে রৌদ্র এক মগ কফি আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
এই নিন কফি।
আমি তার হাত থেকে কফির মগ নিলাম। কোনো কথা বললাম না।
রৌদ্র হেসে বলল,
কাঠের মগে চা সার্ভ করা হয়। আগেও খেয়েছি। তবে কফি খাইনি। আজ খাবো। বিষয়টা ইন্টারেস্টিং!

আমি তার কথায় লজ্জা পেয়ে গেলাম। আসলেই তো কাঠের মগে সচরাচর কফি পরিবেশন করা হয় না। বললাম,
মগ দুটো মায়ের ভীষণ প্রিয়। এক শীতকালে গ্রামের বাড়ির মেলা থেকে এক জোড়া মগ আর একটি জগ কিনেছিলো। এতদিন ব্যবহার করা হয়নি। আজ আপনি আসবেন বলে বের করা হয়েছে। দুঃখিত।

রৌদ্র অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
দুঃখ প্রকাশ করছেন কেনো? আমার তো আন্টিকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। তার সুবাদে নতুন অভিজ্ঞতা হলো।

মুখে হাসি ফুটিয়ে বসে রইলাম। রৌদ্র জিজ্ঞেস করলো,
নিজের জীবন নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কি?

আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই। চাকরি খুঁজছি। ভালো চাকরি পেলে জয়েন করবো।

আমার তো সারাদিন যায় মানুষের মন নিয়ে গবেষণা করে। কে কখন কি ভাবছে, কার মনে কি চলছে, মানুষের মনের ভেতর ঢুকে তার লুকিয়ে থাকা সত্যিটা তুলে ধরাই আমার কাজ।

রৌদ্র স্বতস্ফুর্তভাবে একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে। আর আমি তাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি। এত মিল! একটা মানুষের সাথে আরেকটা মানুষের এত মিল কিভাবে হয়? নামের মিলটুকু নাহয় মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু চেহারাও যে অবিকল আমার রৌদ্রর মতো। আচমকা চিঠির কথা মনে হলো। তাতে লিখা ছিলো,
অচেনায় খুঁজে পাবে আমায়।

আরো একবার দক্ষিণের বাতাস ছাড়লো। সে বাতাসে আমার গা ছমছম করে উঠলো। ফুলের সুবাসে মেতে আছে বাগান। মন কুঁ ডেকে উঠলো,
এ কোন রৌদ্র বসে আছে আমার সামনে!
এ কোনোভাবে আমার রৌদ্র নয় তো?

চলবে…

পরের পর্বের লিংকঃ https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1077254746099437&id=549603828864534

‘মেঘের বিপরীতে’ বইটি ২৫% ছাড়ে ২০০ তে গ্রন্থাগার.কম এ পেয়ে যাবেন অটোগ্রাফসহ চিরকুট এবং একটি নেসক্যাফের প্যাকেট সহ!
————–
নন্দিতার মাঝে প্রেগন্যান্সির সব উপসর্গ আছে। কিন্তু সে প্রেগন্যান্ট নয়। অথচ তার পেট ফুলছে! স্তনে মিল্ক প্রোডাকশন শুরু হয়েছে গেছে। কিন্তু কেনো?

বইটি সংগ্রহ করুন- https://www.facebook.com/%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%AE-611937279461463/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here