#৪র্থ_পর্ব
#আতিয়া_আদিবা
আমি উঠে দাঁড়ালাম। বাবা বললো,
কই যাচ্ছিস?
বাগানে যাচ্ছি। অনেকদিন যাওয়া হয় না। তুমি যাবে?
না। তুই যা।
বাবা ভেপ টানায় মনোযোগী হলেন।
আমি অফিস থেকে বের হয়ে নিচে নেমে এলাম। আমাদের বাড়ির পেছনে দুই ডেসিমলের মত খালি জায়গা ছিলো। সেখানে মা শখ করে বাগান করলেন। বাগানের শেষ মাথায় দুটো বড় বড় জাম গাছ আছে। বিল্ডিং এর গা ঘেঁষে বহুবছর দাঁড়িয়ে ছিলো একটি আম গাছ। বসন্তের শেষে গাছে মুকুল আসা শুরু করতো। গন্ধে ম ম করতো চারিদিক। তখন কাচা আম খাওয়ার মাঝেও অন্যরকম আনন্দ ছিলো। দুই ভাইয়ের সাথে বাটিতে লবণ আর মরিচের গুড়ো নিয়ে ছাদে চলে আসতাম। লম্বা বাঁশের প্রতিটি খোঁচায় গাছ থেকে আম পড়তো। ছোট ভাই চাকু দিয়ে আম কেটে লবণ মরিচ মাখিয়ে খেতে দিতো। আমি কখনো কখনো দরজার ফাঁকে আম রেখে চাপ দিয়ে ফাটিয়ে খেতাম। সেই আম গাছটাও গত বছর বাবা কেটে ফেললেন। বিল্ডিং এর ক্ষতি হচ্ছে। এত বড় গাছ আর রাখা যাবে না। গাছটির জন্য সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। ছোটবেলার কত শত স্মৃতি জড়িয়ে ছিলো! সময়ের সাথে সাথে সব কেমন বদলে যায়।
বাগানে আনমনে হাঁটছি। পাতার ফাঁকে ফাঁকে নরম রোদ খেলা করছে। আচমকা নিজের বিবেককে জিজ্ঞেস করলাম,
আমি কেনো বেঁচে আছি? অযথা একজন লক্ষ্যহীন মানুষ কেনো এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে?
বিবেক উত্তর দিলো,
মানুষ অযথা বেঁচে থাকে না। এর পেছোনে অবশ্যই কোনো না কোনো কারণ নিহিত।
কি কারণ?
তা আমি জানি না।
আমার বেঁচে থাকার পেছোনে কোনো কারণ নেই।
আছে। নিশ্চয়ই আছে। সময় হলেই তা জানা যাবে।
কবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ?
আসবে। খুব শিঘ্রই আসবে।
এভাবেই আমি বেঁচে আছি। লড়াই করে। না এ লড়াই অন্য কারো সাথে নয়। এ লড়াই আমার নিজের সাথে নিজের লড়াই। এ লড়াই আমার বাকি দশজন সাধারণ মানুষের মত বেঁচে থাকার লড়াই। মাঝরাতে জায়নামাযে বসে আমি আল্লাহর কাছে মৃত্যু চাই না। বেঁচে থাকার অজুহাত চাই।
সন্ধ্যায় মাইনুল সাহেব বাসায় আসলেন। সঙ্গে তার রূপবতী স্ত্রী। উনার স্ত্রীর নাম হেনা। প্রথম অবস্থায় তাদের দেখে কোনোভাবেই স্বামী স্ত্রী বলে মনে হচ্ছিলো না। বয়সের ব্যবধান বিস্তর। পরবর্তীতে জানা গেলো, হেনা আন্টি উনার দ্বিতীয় বউ। প্রথম বউটা কেন্সারে মারা গিয়েছে। মৃত্যুর আগে তিনিই মাইনুল সাহেবকে দ্বিতীয় বিয়ে করিয়ে গিয়েছেন। মাইনুল সাহেবকে প্রথমে রাজি করানো সহজ ছিলো না। প্রথম স্ত্রীকে তিনি যথেষ্ট ভালোবাসতেন। কিন্তু স্ত্রীর ক্রমাগত আর্জিতে তিনি বাধ্য হোন। তার স্ত্রীর চিন্তা ভাবনা ছিলো বিস্তৃত। সমাজের আবদ্ধ গন্ডির বাহিরে। চিত্তরঁজনের জন্য নয়, বৃদ্ধ বয়সে কৈশোরের স্মৃতিগুলো অনুস্মরণ করার জন্যও যে একজন ভালো বন্ধুর প্রয়োজন হয় তা তিনি বুঝতেন।
ড্রইং রুম থেকে হাসাহাসির শব্দ আসছে। মা, বাবা, মাইনুল সাহেব এবং তার স্ত্রী একসাথে ভালো সময় কাটাচ্ছে, গল্পগুজব করছে। আমি আমার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গুণছি আকাশের বিস্তৃত তারকারাজি। আকাশে অপূর্ণ এক ফালি রূপালি চাঁদ। একা চাঁদটার সাথে আমার কোথায় যেনো মিল খুঁজে পেলাম। প্রচন্ডরকমের নিঃসঙ্গতায় ভোগা চাঁদটি হাসছে। ঠিক যেভাবে আমাকে বহু মানুষের ভীড়ে হাসতে হয়। একাকিত্ব আমায় গ্রাস করে ফেলে প্রতিনিয়ত। তবুও আমি হাসি। হাসতে জানি।
মা ঘরে উঁকি দিলো।
অনা?
পেছোন ফিরলাম।
বলো মা।
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কি করছিস?
বিশেষ কিছু না। রাতের আকাশ দেখছিলাম।
ডায়নিং এ আয়। সবাই খেতে বসছে।
আসছি। তুমি যাও।
মা চলে গেলো। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। শাড়ির আঁচল ঠিক করলাম। চুলে হালকা করে চিরুনী বুলালাম। তারপর ডায়নিং এ গেলাম।
টেবিলে নানাবিধ খাবার সাজিয়ে রাখা আছে। বাইরে থেকে আনা খাবারগুলোও বেড়ে ফেলেছেন মা। বোঝার উপায় নেই কোন খাবার গুলো কেনা আর কোনগুলো মায়ের রান্না করা। আমি মাইনুল আংকেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি হৈ হৈ করে উঠলেন।
আরে অনাদৃতা! সুইটহার্ট। বসো বসো।
আমি মুখে ফিঁকে হাসি ফুটিয়ে বসলাম। আংকেল তার স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
হেনা! পরিচিত হও। ও হচ্ছে অনাদৃতা। শরিফুল সাহেবের একমাত্র মেয়ে। তোমার রাইভাল। কেনো রাইভাল বললাম জানতে চাও? ও নাকি অনেক সুন্দর গান করে। আজ তোমাদের মাঝে একটা ব্যাটেল হয়ে যাক। কি বলো? হে হে।
হেনা আন্টি যথেষ্ট আন্তরিকভাবে আমার সাথে কথা বললেন। পড়াশোনা কোন পর্যন্ত করেছি, কি সমাচার। আমার জীবনের পরিকল্পনা কি? ইত্যাদি।
মা খাবার বেড়ে দিতে লাগলো। এক লোকমা খাবার মুখে নিয়ে মাইনুল সাহেব মায়ের রান্নার প্রশংসায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
ভাবী! মারাত্বক রেঁধেছেন। খুব মজা হয়েছে। মুরগীর রোস্টের স্বাদ তো অমৃতের মতো লাগছে।
মা তৃপ্তির হাসি হেসে মাইনুল সাহেবের সকল প্রশংসা গ্রহণ করতে লাগলো। আমি আঁড়চোখে মার দিকে তাকালাম। তৃপ্তির মাঝে কোথাও অস্বস্তি আছে কি না! আমার ধারণা মিথ্যে ছিলো না। তার চোখে মুখে কিছুটা অস্বস্তির দেখা মিলছে। মায়ের এই অস্বস্তিকর চেহারা আমাকে ক্ষণিককালের জন্য নিয়ে গেলো ফেলে আসা অতীতে।
বিয়ের কদিন পর। রৌদ্র অফিস থেকে ঘন্টাখানিক আগেই ফিরে এসেছে। বেল বাজতেই আমি দরজা খুলে দিলাম। দেখলাম, বেচারার চোখ মুখ ফ্যাকাশে। ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,
আজকে এত আগে ফিরে এলে? চোখ মুখ এমন লাগছে কেনো? শরীর খারাপ?
সর্বনাশ হয়ে গেছে।
কি সর্বনাশ হলো আবার?
রাতে আমার দুজন কলিগ আসছে। এ বাসায় খাবে।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমার রান্নার হাত ভীষণ নড়বড়ে। যেটুকু রাঁধতে পারি তাতে শুধুমাত্র দুজনের পেট ভরে। স্বাদ নিয়ে রৌদ্রের কোনো অভিযোগ নেই বলে দিন চলে যাচ্ছে। কিন্তু মেহমানকে তো যেনো তেনো রান্না করে খাওয়ানো যাবে না! তার ওপর নতুন বৌ। আমি কিছুটা রাগী স্বরে বললাম,
কলিগ আসছে বললেই হলো? কি করে খাওয়াবো তাদের আমি? মাত্র রান্না শিখছি! এখনো নুন ঝালের পরিমাণ বুঝি না।
রৌদ্র নিচু গলায় বললো,
আমি কি করবো বলো? জোর করে দাওয়াত নিয়েছে। নতুন বিয়ে করেছি। বুঝোই তো। মুখের ওপর না তো করা যায় না।
ভালো করেছো। এখন কি করবো?
রৌদ্র বললো,
একটা উপায় বের করতে হবে।
করো। উপায় বের করে আমায় উদ্ধার করো।
আধা ঘন্টা ভরে রৌদ্র উপায় বের করলো। তারপর হাসিমুখে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। ফিরলো দু হাত ভর্তি গরম গরম খাবার নিয়ে। আমাকে বললো,
খাবারগুলো তাড়াতাড়ি বাটিতে বেড়ে ফেলো। ওরা মনে হয় কাছাকাছি চলে এসেছে!
মা একসেট ডিনার সেট উপহার দিয়েছিলো। যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। সেই ডিনার সেট সেদিন কাজে লাগলো। খাবার বেড়ে ফেললাম। কিছুক্ষণের মাঝেই মেহমান চলে এলো। খাবার খাওয়ার পর তারা তারিফের পর্বটুকু সেড়ে ফেললো। আমি লজ্জামিশ্রিত চোখে রৌদ্রের দিকে তাকালাম। দেখলাম ছেলেটাও মুচকি মুচকি হাসছে। রৌদ্রের হাসি দেখে আমার চোখে মুখে অস্বস্তির ছাপ পড়লো।
আমাদের হিসাবের সংসার। একদিনেই এতগুলো খরচ হয়ে গেলো। মেহমান চলে যাওয়ার পর মনে অনুশোচনা নিয়ে রৌদ্রকে জিজ্ঞেস করলাম,
অনেক খরচ হয়ে গেলো আজ। মাস চলবে তো?
রৌদ্র বললো,
যদি খুব বেশি সমস্যা হয় মরিচ ডলে ভাত খেয়ে নিবো।
আমি হেসে মাথা নাড়লাম। রৌদ্র সুযোগ বুঝে নাক টিপে দিলো। আমি রেগে গেলাম! এই ছেলেটা সুযোগ পেলেই নাক টিপে দেয় কেনো?
খাওয়া দাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন তারা। তারপর বাসায় গানের আসর বসলো। হেনা আন্টি গান গাইলেন। কণ্ঠস্বর কি মিষ্টি! কথা বলার সময় বুঝতে পারিনি তার গানের গলা এত সুমধুর! তিনি গান গাইলেন,
আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে।
ভোরের আল মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
পিছু ডাকে পিছু ডাকে
আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে।
গানের মাঝে শুনতে পেলাম রৌদ্রের চিরপরিচিত কন্ঠস্বর। ভরাট গলায় আমাকে ডাকছে।
‘অনা?’
রৌদ্র কি আমায় পিছু ডাকছে?
(চলবে…)