#চিলেকোঠায়_সমাপ্তি
এগারোতম_পর্ব
~মিহি
“পৃথিবীতে সব সম্পর্কে একটা করে বাঁধা আসেই। কেউ কাটিয়ে উঠতে পারে, কেউ কেউ পারে না।”
শ্রাবণ হয়তো না পারারই দলের। সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে যাওয়ার দলে সে। আজ শ্রুতির প্রতি তার অনুভূতিগুলো আগের মতোই প্রখর শুধু প্রাপ্তির আশাটুকু ফিকে হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করতেই শ্রাবণের চোখের সামনে ভেসে উঠে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া রাতটা।
______________
নেশায় টালমাটাল শ্রাবণ। মদ খায়নি সে তবুও কেন এমন নেশা হলো বোঝার চেষ্টা করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো এক নারী প্রতিচ্ছবি। শ্রাবণ নেশার ঘোরে জিজ্ঞাসা করলো,”কে?” নারীটির থেকে কোন উত্তর পাওয়া গেল না বরং সে ধীরে ধীরে শ্রাবণের কাছে এলো। শ্রাবণের কানের কাছে মুখ নিয়ে ‘শ্রুতি’ কথাটা বলতেই শ্রাবণের সারা শরীরে বিদ্যুতের ন্যায় কম্পন সৃষ্টি হলো। শ্রাবণের খুব ইচ্ছে হলো শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরতে। সে তা করলো না। শ্রুতির হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,”শ্রুতি, তোমায় ভালোবাসি। বড্ড বেশি ভালোবাসি। তোমায় বলার সাহস নেই বলে ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম। তুমি আটকালে না আমায়। কেন আটকালে না, হ্যাঁ? আমায় ছাড়া তো খুব ভালো থাকবে, সেজন্য? আমি যে মরে যাবো।” নারীটি তখনো কিছু বললো না, শ্রাবণকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। শ্রাবণ তার কাঁধে মাথা রেখে বললো,”ভালোবাসি তোমায়।”
‘শ্রাবণ!’ শ্রুতির কণ্ঠে নিজের নামের চিৎকার শুনে সামনে তাকালো সে। শ্রুতি সামনে? তাহলে যে তাকে জড়িয়ে রেখেছে, সে কে? নেশায় তখনো চোখে ঝাপসা দেখছে শ্রাবণ। শ্রুতিকে কিছু বোঝানোর সুযোগ পেল না সে। শ্রুতি কোন কথা না বলেই বেরিয়ে গেলো, হাতে থাকা লাল গোলাপটা ফেলে দিল ডাস্টবিনে। শ্রাবণ পিছু নিলেও শ্রুতিকে বোঝানোর মতো উপায় ছিল না। তানভী তখনো ওখানে বসে কাঁদছে।শ্রাবণ সরাসরি বাসায় যায়। গোসল করার পর নেশার মাত্রা কিছুটা কমে। এরপর সে বুঝতে পারে তার জীবনে কী অঘটন ঘটে গেছে। তানভীকে জিজ্ঞাসা করলে সে শুধুই স্যরি বলে কিন্তু শ্রাবণ বুঝেছে শ্রাবণের বউ হয়ে ঐ বুড়ো লোকের সাথে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার জন্যই এ প্ল্যান করেছে তানভী যে বুদ্ধি শ্রাবণ তাকে দিয়েছিল।
_________________
শ্রাবণের আর ভালো লাগছে না। এত চাপ সে নিতে পারছে না। হয়তো শ্রুতিকে আর সামনাসামনি কখনো মনের কথা বলা হবে না। শ্রুতির জন্য একটু আগে লেখা চিঠিটা একটা বইয়ের সাথে এক ক্লাসমেটের হাত দিয়ে শ্রুতির জন্য পাঠায় সে। তারপর নিজের ব্যাগ নিয়ে বের হয় বাড়ি থেকে। বাড়িওয়ালাকে ডেকেছিল সকালেই, তার হাতে টাকা বুঝে দিয়ে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে যায় শ্রাবণ।
___________________
শ্রুতির হাতে শ্রাবণের লেখা চিঠিটা,
“শুনেছিলাম মেয়েদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নাকি চট করে ধরে ফেলে কোন ছেলে তাদের দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকায়। আমার দিকে তাকিয়ে কখনো তোমার মনে হয়নি, এই ছেলেটা তোমার দিকে কতটা ভালোবাসার চোখে তাকায়? তানভীর সাথে যা হয়েছে, যদিও কিছুই হয়নি কিন্তু দোষটা আমার ছিল না শ্রুতি। আমি অরেঞ্জ জুস খেয়েছিলাম, তাতে ড্রাগস ছিল আমি জানতাম না। একটা সুযোগ দিতে সব বোঝানোর। যাই হোক, তুমি সুখে থাকবে এইটাই চাই আমি। ভালোবেসেছি তোমায়, বাসি, বাসবো। চলে যাচ্ছি, খুঁজো না আমায়। পৃথিবী তো গোল, হয়তো কোন একদিন না চাইতেও দেখা হয়ে যাবে। তুমি মুখ ফিরিয়ে নিও, আমি আফসোসে তিলে তিলে ঐদিনই শেষ হয়ে যাবো। আর কেউ থাকবে না তোমায় কষ্ট দেওয়ার।”
ইতি~শ্রাবণ”
চিঠিটা পড়ে ছিঁড়ে ফেলে শ্রুতি। মুখটা তখন বিবর্ণ। মন তখনো তাকে বলে চলেছে,”ক্ষমা করবি না ওকে। ও ক্ষমার যোগ্যই না।” শ্রুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তানভীকে আশেপাশে দেখতে পেল না। তানভী আর শ্রাবণ নামক দুই ব্যক্তির হারানোতে তার অনুভূতি পাথর হয়ে গেছে, কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে তো চায়নি ওদের হারাতে কিন্তু ক্ষমাও তো করতে পারবে না। হোক সব মিথ্যে তবুও ওর দেখা ঐ অনাকাঙিক্ষত মুহূর্তটুকু তো সত্যি ছিল। পারবে না সে ওদের ক্ষমা করতে। ভেঙে যাওয়া গ্রুপটাই এখন কেবল শ্রুতি, অয়ন, সিদ্ধি।
________________________
আজ সিদ্ধির বাগদান। তাহমিদ পুরো বাড়ি সাজিয়েছে। সায়ন সাহেব হাসপাতালেই আছেন। বাগদানের পর দুজন যেয়ে পা ছুঁয়ে দোয়া নিয়ে আসবে। সিদ্ধির নিজেকে কোন যন্ত্র মনে হচ্ছে কেননা মানুষের তো অনুভূতি থাকে কিন্তু তার মাঝের সব অনুভূতি যেন শেষ হয়ে গেছে। একটা মানুষ ঠিক কতটা সময় ধৈর্য ধরে থাকতে পারে? বাবার অসুস্থতা, হারিয়ে ফেলা ভালোবাসা, অপরিচিত একজনের সাথে বাগদান- সবকিছুর মাঝে সে ঝুলে আছে। গত এক মাসে ওষুধও খায়নি সে। মাথাটা বড্ড যন্ত্রণা করছে। তাহমিদ দেখতে এসেছে সিদ্ধির সাজা কতদূর। সিদ্ধিকে দেখেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। অবশেষে সে নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে পাচ্ছে।
তারেক রহমান চিৎকার করে হাসছেন। আজ জীবনের সব প্রাপ্তি তার পায়ের কাছে এসে মাথা নুইয়েছে। চাইলেই তিনি সেসব তুলে বুকে জড়াবেন, নইলে আরো বড় কোন প্রাপ্তির জন্য ষড়যন্ত্র করে যাবেন। আচমকা তার ফোনে একটা কল আসলো। নম্বর চেক করে দেখলেন বিদেশী কোম্পানির মালিক। ফোন ধরে মিনিট পাঁচেকের মতো কথা বললেন যার পরিশিষ্ট এই যে তারা আজ সন্ধ্যের মধ্যে দেশে আসছেন। তারেক রহমান বেশ খুশি মনে নিজের ছেলের বাগদানে তাকে আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি মানা করলেন না। তারেক রহমানের খুশিতে মাটিতে পা অবধি পড়ছে না। তার মনে হচ্ছে তিনি খুশির ঠেলায় শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছেন।
____________________
ব্যস্ত সন্ধ্যে, চারিদিকে মানুষের আনাগোনা। শতভাগ মানুষই কেবল তাহমিদের পরিচিত হয়তো বা সিদ্ধির বাবারও কিন্তু এত অপরিচিত মানুষগুলোর ভীড়ে সিদ্ধির চোখজোড়া একজনকেই খুঁজছে। সে কি আসবে? সে কি আদৌ জানে আজ সিদ্ধির বাগদান? জানার কথাও না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিদ্ধি। তাহমিদের বন্ধু-বান্ধবীরা সিদ্ধিকে ঘিরে বসে আছে। হঠাৎ সিদ্ধির মনে পড়ে তার বন্ধুদের কথা। এতক্ষণ মাথাতেই ছিল না ওদের কথা। সব কেমন যেন চটজলদি হয়ে গেল। কারো সাথে কথা বলার সুযোগটা অবধি পায়নি সে। আচ্ছা, সে নাহয় পরিস্থিতির চাপে কথা বলার সুযোগ পায়নি কিন্তু বন্ধুদের মাঝে একজনও সিদ্ধির নূন্যতম খোঁজটুকু নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলো না? এই ছিল তাদের বন্ধুত্ব? নীরব অভিমানের শিকলে জড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল সিদ্ধি। অথচ সে জানেনা তার সাধের বন্ধুগুলোর মাঝে কোন ফাটল ধরেছে। এজন্যই বলে, একজন কখনোই নিজের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অন্যজনের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারে না।
মানুষের আনাগোনা কমে গেছে। তাহমিদ এলো সিদ্ধির কাছে, সিদ্ধিকে নিচে নিয়ে যেতে। তাহমিদ সিদ্ধির দিকে হাত বাড়াতেই সিদ্ধি হাত ছাড়িয়ে নিল। কাঁপা স্বরে বললো,”আমি যেতে পারবো।” তাহমিদ কিছু বললো না। মুচকি হেসে সায় দিল। সিদ্ধির হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কেন যেন মনে হচ্ছে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে সে যা করছে তার পরিণতি কিছুতেই ভালো হবে না, কোনভাবেই না। এক পর্যায়ে মাথা ঘুরতেই বেসামাল হয়ে পড়ে যেতে ধরে সিদ্ধি কিন্তু তাহমিদ ধরে ফেলে। তাহমিদের স্পর্শে আরো কান্না আসে সিদ্ধির। তাহমিদের এই স্পর্শের দ্বারা এ সম্পর্কে কেবল সিদ্ধি নিজের বাধ্যতা খুঁজে পায়, ভালোবাসা নয়। একজনকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেললে নাকি দ্বিতীয় কাউকে কখনোই ভালোবাসা যায় না। সিদ্ধি ভেবেছিল কথাটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আজ মনে হচ্ছে আসলেই ভালোবাসা মানুষকে কতটা দুর্বল করে ফেলতে পারে। আমরা ভালোবাসি কেবল প্রথমবার, পরবর্তীতে যা হয় তা কেবল দায়িত্ব কিংবা অনুভূতির ভুল সংকেত।
সাজসজ্জায় মুখরিত সারা বাড়ি। একটু পরেই শুরু হবে বাগদান অনুষ্ঠান। তাহমিদ-সিদ্ধি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ভিডিও কলে সায়ন সাহেবকে সবই দেখানো হচ্ছে। তিনি একেবারেই নিস্তব্ধ, চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। পরিস্থিতির কাছে নিজের পরাধীনতা মেনে নিয়েছেন তিনি। সিদ্ধির দৃষ্টি ধীরে ধীরে ঝাপসা হচ্ছে। চোখ খোলা রাখার সমস্ত চেষ্টা যেন বৃথা। আচমকাই চোখ বন্ধ করে ঢলে পড়ে সে মেঝেতে।
______________________
-“কীরে সোহেল? পাইলি?”
-“স্যার এদিকেই তো লাগে। এক্সাক্ট লোকেশন ট্রেস করতে পারতেছি না। ফোন অফ করে ফেলছে বেটা।”
-“আচ্ছা শোন। দেখ আশেপাশে কোথাও শুনশান বাড়ি কিংবা গোডাউন আছে কিনা।”
-“আচ্ছা স্যার।”
-“আর শোন, ঐ দুজন যেন বিন্দুমাত্র খবর না পায় আমরা এসবের সাথে জড়িত না হলে আমার চাকরী রিস্কে পড়ে যাবে।”
কনস্টেবল সোহেল গাড়ি থেকে নামতেই অট্টহাসি হাসেন ইন্সপেক্টর জয়নব। বেশ ভালোভাবেই ষড়যন্ত্রের বেড়াজালটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এবার তবে চুনোপুটিসহ রাঘব-বোয়ালগুলোকেও খতম করার সময় এসে গেছে।
চলবে…
[আগামীকাল সমাপ্তি পর্ব দিব ইনশাআল্লাহ। সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন এবং গল্পের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইল।]