পুনরারম্ভ। পর্ব-৩

0
3138

#পুনরারম্ভ। পর্ব-৩
লেখক- ইতি চৌধুরী

যেহেতু বাবাকে না বলার কোনো উপায় নেই তাই বাধ্য হয়েই শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নেয় সেহের। আগে পাত্রপক্ষ দেখুক পরেরটা পরে দেখা যাবে।
পাত্রপক্ষের এসে পৌঁছাতে পৌছাতে আড়াইটা বেজে গেল। পথে ফল মিষ্টি কিনতেও থামতে হয়েছিল তাদের। সেহেরের ছবি দেখেই তাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে পাত্র অতুলের মা আনোয়ারা খানমের। সামনাসামনি কথাবার্তা বলে সব ঠিক থাকলে বিয়েতে বেশি একটা বিলম্ব করবেন না তারা। মনে মনে মোটামোটি অনেকটাই আশাবাদী তিনি। তাই প্রয়োজনের চাইতে একটু বেশিই ফল মিষ্টি কিনেছেন। মায়ের এত বেশি বেশি কেনাকেটা দেখেও সন্দেহ প্রকাশ করেছে অতুল। না জানি তাকে না জানিয়ে আজকেই বিয়েটা দিয়ে দে কিনা। এমন যে হয় না তা তো নয়। অনেকের ক্ষেত্রেই এমন হতে দেখা যায় পাত্রী দেখতে এসে বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয়। এতে অবশ্য পরিবারের বিশেষ ভূমিকা থাকে।
সেহেরদের বাসায় এসে ড্রইং রুমে বসতে না বসতেই আবার অতুলের পেটের খুদা তার উপস্থিতি জানান দেয়। বেচারা এমন এক পরিস্থিতিতে পরেছে না পারছে মুখ ফুটে বলতে আর না পারছে সহ্য করতে। খুদা জিনিসটা বরাবরই সে সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া দুপুরের খাবার সময় হয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে বলা যায়। তাই বেশি একটা সময় নেয় না কেউই। পাত্রপক্ষ এসে বসতেই সেহরকে ডেকে আনায় হয়। সামান্য কিছু বাক্য বিনিময় করেই সেহেরের বাবা শাহরিয়ার সাহেব সবাইকে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে বসান। মেয়ে এক ঝলক দেখা হয়েছে। এখন খাওয়া দাওয়া হোক তারপর বাকি দেখাদেখি ও কথাবার্তা হবে। খাবার টেবিলে বসে কোনো দিকে তাকায় না অতুল। তার আপাতত চিন্তা ভাবনায় খুদা ও খাওয়া ছাড়া কিছু নেই। সব বাদ দিয়ে তাকে শুধু খেতে হবে, খুব খেতে হবে। না খেলে বাঁচবে কীভাবে? আর সে না বাঁচলে রোগী বাঁচাবে কীভাবে? এই এত লেখাপড়া, সার্টিফিকেট, ডাক্তারীর কি মূল্য থাকবে 1 এক মনে খেয়ে যাচ্ছে অতুল। পাশ থেকে আনোয়ারা খানম খোঁচা দিয়ে আস্তে ধীরে খাওয়ার ইশারা করলেও মায়ের ইশারা আপাতত গোনায় ধরে না সে। সবে তার খাওয়া আধা বিদা হয়েছে কি হয়নি ওমনি ব্লেজারের বুক পকেটে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে। অতুল যতই ব্যস্তই থাকুক না কেনো কখনোই সে ফোন কল এভয়েড করে না। ডাক্তার মানুষ যেকোনো ইমার্জেন্সি হতে পারে বলা তো যায় না। ডাক্তারদের ধর্মই মানব সেবা করা। সবার আগে তাদের জন্য রোগী তারপর দিনদুনিয়া। কলটা রিসিভ করে কানে তুলতেই অন্যপাশ থেকে কে কি বলল কে জানে ‘ঠিক আছে আসছি আমি’ বলেই লাইন কেটে দিয়ে প্লেট থেকে হাত তুলে নিয়ে আঙ্গুল চেটে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় অতুল। ছেলের আচমকা ফোনে কাউকে আসছি বলায় আনোয়ারা খানম জিজ্ঞেস করেন,
‘সে কি কথা কোথায় যাচ্ছিস তুই এখন? আমরা পাত্রী দেখতে এসেছি তোর জন্য আর তুই চলে যাচ্ছিস মানে কী?’
মায়ের দিয়ে চোখ নামিয়ে অতুল বলে,
‘আম্মু আমি ওটি থেকে বেরিয়ে তোমাদের সাথে চলে আসছি। আমার পেশেন্ট আইসিইউতে আছে। আগামী বাহাত্তর ঘন্টা চোখে চোখে রাখতে হবে। আমার ওখানে থাকাটা বেশি প্রয়োজন।’
‘তাই বলে এই পর্যন্ত এসে তুই না দেখেই চলে যাবি?’
‘না দেখে যাব কেনো? এতক্ষণ হয়েছে এসেছি। আসার পর থেকেই তো দেখছিই। এই যে খেতে বসেও তো দেখেই গেলাম।’
কথাটা বলেই মায়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ঠিক তার সামনের চেয়ারে বসে থাকা সেহেরের দিকে তাকায় অতুল। আরও বলে,
‘এই যে দেখে নাও আমি আবার দেখলাম।’
এবার সে পাত্রীর বাবা শাহরিয়ার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আঙ্গেল প্লিজ বেয়াদবি নিবেন না। আপনিও তো দেশ ও জনগণের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। আমার অবস্থাটা এই মুহূর্তে আপনি সবচাইতে ভালো বুঝবেন। দায়িত্বের কাছে ওয়াদাবধ্য বলেই যেতে হচ্ছে কিছু মনে করবেন না প্লিজ, আমাকে যেতে হবে।’
‘কোনো সমস্যা নেই বাবা। এই মুহূর্তে তোমার হাসপাতালে যাওয়া বেশি জরুরী আমি বুঝতে পারছি। তুমি যাও।’
হাসি মুখেই বলেন শাহরিয়ার সাহেব।
অতুল বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট পনেরো পর মাকে ফোন দেয়। কলটা রিসিভ করতেই অতুল বলে,
‘তুমি কেমন মা বলো তো?’
‘এটা কেমন কথা?’ চমকে বলেন আনোয়ারা খানম।
‘আমি চলে আসলাম আমাকে জিজ্ঞেসও করলা না মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে কি হয়নি।’
‘বারে সময় দিয়েছিস নাকি কিছু জিজ্ঞেস করার।’
‘আচ্ছা শুনো আমার পক্ষ থেকে কোনো সমস্যা নাই। তোমার পছন্দ হলে আমার আপত্তি নাই।’
‘এত ঢং না করে সরাসরি বললেই পারিস মেয়ে তোর পছন্দ হয়েছে।’
‘তুমি বুঝলেই তো হইছে তাই না। বিয়ে করব একটু ঢং করব না তা কি হয়?’
‘রাখ, ফোন রাখ। বিরক্ত করিস না তো।’
আনোয়ারা খানমের সেহেরকে আগে থেকেই পছন্দ হয়ে আছে। তিনি আজ মূলত এসেছেনই ছেলের জন্য। তার ভালো করেই জানা তিনি বললে ছেলে তার আপত্তি করবে না। তবু জীবনটা যেহেতু ছেলের তাই মা হিসেবে সে ছেলের পছন্দকেই প্রায়োরটি দিবেন। আর যেহেতু তার পছন্দ করা মেয়ে ছেলেরও পছন্দ হয়েছে তাহলে আর অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। শুভস্য শীঘ্রম বলে একটা কথা আছে। শুভ কাজ যত জলদি হয় তত ভালো। বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে শুভ কাজ ফেলে রাখতে নেই।
পাত্রপক্ষের সেহেরকে পছন্দ হয়েছে। তারা এখানেই ফাইনাল করতে চান। শাহরিয়ার সাহেবও মোটামোটি মুখে মুখে পাকা কথা দিয়ে ফেলেছেন বলা যায়। সবার কথাবার্তা থেকেই সেহের বুঝতে পারে আজকের এই দেখাদেখিটা কেবল নামমাত্র। আসল খোঁজ খবর নেয়ার সব কিছু তলে তলে আগেই হয়ে গেছে। বাবা যে ইচ্ছা করে তাকে বলেনি সেটাও সে বুঝতে পারছে। কাটা গলায় এসে ঠেকেছে সেহেরের। এমন এক কাটা যা সে না পারবে গিলতে আর না পারবে বমি করে ফেলে দিতে। কারণ একজন তার বাবা আরেকজন ভালোবাসার মানুষ। এই দু’জনের একজনকে ছাড়াও তার কোনোভাবেই চলবে না।
পাত্রপক্ষ বিকালেই চলে গেছে। তারপর থেকে নিজের ঘরে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে সেহের। এখনো সে মাহিরকে কিছু জানায়নি। মাহির জানলে কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে তা ভেবেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। মাথার ভেতর সব ঝট বেঁধে আছে। কীভাবে এই বিপদের হাত থেকে নিজেকে উদ্ধার করবে বুঝে পায় না সেহের। কিন্তু উপায় কিছু না কিছু একটা বের করতেই হবে। কোনোভাবেই সে মাহিরকে হারাতে পারবে না। মাহিরকে ছাড়া তার চলবেই না। মরে যাবে তাও অন্য কাউকে বিয়ে অসম্ভব। নিজের ঘরে পা দাপটে জোর পদক্ষেপে পায়চারি করায় ব্যস্ত সেহেরের ঘরে আচমকা আগমন ঘটে ছোট বোন সোনিয়ার। ঘরের লাইট বন্ধ থাকায় সেহের সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে না কে এসেছে। এক মুহূর্তের জন্য বাবা মনে করে আঁতকে ওঠে। পরমুহূর্তেই ছোট বোনকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। কিন্তু এই স্বস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। সোনিয়া ঘরে ডুকেই বলে,
‘আব্বু তোমাকে ডাকছে।’
বাবা ডাকছে শুনতেই আবার সাবধান হয় সেহের। মনে মনে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে কেনো এই মুহূর্তে তার ডাক পরেছে। মনে মনে আল্লাহর নাম ডেকে নিয়ে ড্রইং রুমে এসে উপস্থিত হয় সেহের। বাবার মুখোমুখি মাথা নিচু করে বসে পরে। ড্রইং রুমময় পিনপতন নীরবতা। হালকা কেশে নিয়ে নীরবতা ভেঙে শাহরিয়ার সাহেব বলেন,
‘শুনেছ নিশ্চয়ই পাত্রপক্ষের তোমাকে পছন্দ হয়েছে।’
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায় সেহের। বাবা আরও বলেন,
‘আমার, তোমার আম্মুরও ছেলেকে তার পরিবারকে পছন্দ হয়েছে। আমরা তোমার বিয়াটা এখানেই দিতে চাই। পাত্রপক্ষ বেশি দেরি করতে চান না। আমরাও সম্মতি পোষণ করেছি।’
বাবার এই কথায় ঝট করেই মাথা তুলে তাকায়। মেয়ের হঠাৎ এভাবে মুখ তুলে তাকানোয় কিঞ্চিৎ সন্দেহ হয় শাহরিয়ার সাহেবের। সেহেরকে জিজ্ঞেস করেন,
‘তোমার আপত্তি আছে কি?’
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসতে লাগে সেহেরের। ভেতরে ভেতরে গুছিয়ে নিয়েও একটা কথাও গলা দিয়ে বের করতে পারছে না। বাবার মুখের উপর না করবে কীভাবে? তাছাড়া মাহিরের কথাই বা বলবে কীভাবে? মেয়েকে নার্ভাস হতে দেখে শাহরিয়ার সাহেব আবার জিজ্ঞেস করেন,
‘কিছু বলতে চাও তুমি?
অনেক কষ্টে কথাদের গলার কাছ থেকে টেনে এনে আমতা আমতা করে সেহের বলে,
‘ববললছিলাম কি ববাবা। আমার তো এখনো পপড়ালেখাই শেষ হয়নি।’
‘বিয়ের পরে শেষ করবে। সমস্যা নেই তো। ছেলে একজন ডাক্তার। এত শিক্ষিত ছেলে নিশ্চয়ই বউকে অশিক্ষিত রাখবে না। তবু তোমার জন্য আমি পাত্রপক্ষের সাথে কথা বলে নিবো। লেখাপড়া নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোমায়।’
কীভাবে আর কি বলে বাবাকে আটকাবে মাথায় আসে না সেহেরের। আরও একবার শাহরিয়ার সাহেব জিজ্ঞেস করেন,
‘আর কিছু? ফাইনাল কথা দেয়ার পর আমি পিছাবো না। তাই কিছু বলতে চাইলে এখনই বলতে হবে।’
একবার ঢোক গিলে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি নিয়ে বাবার দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে সেহের। মনে মনে নিজেকে সাহস সঞ্চয় করে কিছু বলবে বলে। মেয়ের মৌনতাকে তার সম্মতি মনে করে যেই বসা থেকে উঠতে নেন শাহরিয়ার সাহেব তখনই মুখ খুলে সেহের বলে,
‘ছেলে আমার থেকে অনেক বড়ো বাবা।’
বলেই সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেলে। উঠতে নিয়েও আবার বসে পরেন শাহরিয়ার সাহেব। কয়েক মুহূর্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন,
‘তোমার মা আমার থেকে পনেরো বছরের ছোট বয়সে। কই আমাদের তো সংসার করতে কোনো সমস্যা হয়নি। এইজ ইজ জাস্ট এ্যা নাম্বার নাথিং এলস। সবটাই হচ্ছে মানুষের মানসিকতা। আর আমি আমার ছেলেমেয়েদের এমন শিক্ষা দেইনি তারা একজন মানুষকে মানুষ হিসাবে নয় বরং তার বয়স দিয়ে বিচার করবে। তাছাড়া বাবা হিসাবেও আমি এমন নই যে পাত্র প্রতিষ্ঠিত, ভালো ইনকাম করে বলে আমার মেয়ের চাইতে দ্বিগুন বয়সী একজনের সাথে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিব। একমাস পরেই তুমি চব্বিশে পা দিবে। ছেলের তৌত্রিশ চলছে। খুব বেশি ব্যবধান মনে হচ্ছে না আমার। তোমার মা আর আমার তুলনায় তো কমই তাই না?’
‘তবুও আমি এখন বিয়ে করতে চাইছি না।’
‘কেনো? তোমার কি নিজের কোনো পছন্দ আছে?’
এই পর্যায় বাবার প্রশ্নে দপ করে নিভে যায় সেহের। মাহিরের কথা জানতে পারলে বাবা তাকে কেটে দুই টুকরা করতে দুই সেকেন্ড সময়ও নিবে না। সন্তপর্ণে আরেকবার ঢোক গিলে শুকিয়ে যাওয়া গলা ভিজিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে মাথা ঝাঁকিয়ে না করে।
‘তাহলে তো বিয়ে না করার কোনো কারণই দেখছি না।’
আর কথা বাড়ায় না শাহরিয়ার সাহেব। ড্রইং রুম থেকে প্রস্থান করেন। সেহেরের মনে হচ্ছে সে মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে। এই বিপদ থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। যেদিকে তাকায় সেদিকেই কেবল অচেনা চোরাবালি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here