বৃষ্টি_ভেজা_গোলাপ #পর্ব_৩২

0
1132

#বৃষ্টি_ভেজা_গোলাপ
#পর্ব_৩২
#নবনী_নীলা

আজ রুহির জন্মদিন। জন্মদিন সবার জীবনে খুব খুশির একটা দিন হলেও রুহির জীবনে অভিশাপময় দিন। কারন এই দিনে তাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে তার মা আত্মহত্যা করেছিলো। সাড়া বছরে শুধু এই দিনটাই রুহির এতো কষ্ট হয়। সকাল থেকে লামিয়া প্রমা সবাই এসে রুহির মন ভালো করার চেষ্টা করেছে। রুহি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে কিন্ত চোখে মুখে বিষণ্ণতা স্পষ্ট। তারওপর আহান সকাল থেকে নেই। আজকের দিনটাও ওনার অফিসে যেতে হলো। সেই বিকেলে এসে নানুর কাছে নিয়ে যাবে বলেছে। বউয়ের থেকে কাজ বেশি তার কাছে। একবার উইশ পর্যন্ত করেনি। মনটা খারাপ এমনিতেই তারওপর আহানের এমন কাণ্ডে রাগ হচ্ছে রুহির।

প্রমা আর লামিয়া দুপুরে পরেই চলে যায়। লামিয়ার বিয়ে হলো মাত্র একমাস হয়েছে। তবুও বরকে রেখে তাকে খুশি করতে এসেছে আর এদিকে তার নিজের বর লাপাত্তা। রুহি বিকেলে রেডি হয়ে বসে রইলো আহানের আসার অপেক্ষায়। আহান এলো দেরি করে। রুহির খুব রাগ হচ্ছে কিন্তু রাগটা সে দমিয়ে রেখেছে। মুখ ফুলিয়ে গাড়িতে বসে নিজেই নিজের সিট বেল্ট পড়লো। আহান রুহির দিকে তাকালো, এতো বিষণ্ণতা রুহির মুখে এর আগে কখনো দেখেনি সে। মানুষকে কষ্টের সময় কিভাবে আগলে রাখতে হয় সেটা আহান জানে না আর তাকে কখনো সেটা শেখানো হয় নি। তবুও রুহির মন ভালো করার শেষ চেষ্টাটা সে করবে।

নানুর কাছে এসে রুহির অনেকটাই ভালো লাগছে। আশে পাশে সবাই তাকে নিয়ে মেতে থাকার চেষ্টা করছে যদিও ভিতরে ভিতরে নিজের মেয়ের মৃত্যু শোকে তারাও কাতর। তবুও রুহির পছন্দের সব রান্না করা হয়েছে। ছোটো মামা কবিতা পরে শুনিয়েছে। নানা নানি গিফট দিয়েছে। এসবের মাঝেও রুহির মনটা একটু খারাপ কারণ আহান তখন থেকে ফোন কার সাথে কথা বলছে, রাগারাগি করছে। লোকটার তার দিকে কোনো খেয়াল পর্যন্ত নেই। ভালোবাসা বলতে কিছু নেই,সব ভালোবাসা আজ উড়ে গেছে।

খাওয়া দাওয়া শেষ করেই আহান বেড়িয়ে পড়তে চাইলো। কিন্তু রুহি জেদ করলো সে আজ এইখানেই থাকবে।

” আজ চলো, অন্যদিন এসে থাকতে পারবে তো।”, রুহিকে বোঝানোর চেষ্টা করছে আহান।

রুহি না সূচক মাথা নেড়ে বললো,” কিন্তু আমার আজ থাকতে ইচ্ছে করছে। আমি যাবো না।”

” রুহি বাচ্চাদের মতন জেদ করো না। আজ থাকা যাবে না আমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে।”, কড়া গলায় বললো আহান।

“হ্যা এখন তো কাজই আপনার সব। বউকে আপনার কিসের প্রয়োজন?আপনার এতো অসুবিধে হলে আপনি চলে যান। আমি যাবো না।”, রেগে গিয়ে বলল রুহি।

আহান একটা বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,” তুমি বুঝতে চাইছো না, কেনো রুহি?”

” আমি বুঝতেও চাই না কিছু, আমি যাবো না। ব্যাস! আপনার খুব কাজ থাকলে আপনি চলে যান।”, রাগে গজগজ করে বললো রুহি।

আহান কোমড়ে হাত দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে রুহির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। এমন জেদ করবে জানলে রুহিকে নিয়ে এইখানে আসতোই না। কিন্তু এইখানে থাকলে আহানের উদ্দেশ্যটা কিছুতেই পূরণ হবে না। আহান কিছুক্ষণ ভেবে নিজের ঘড়ির দিকে তাকালো তারপর রুহিকে বললো,” তোমার কাছে দশ মিনিট আছে। চুপ চাপ দশ মিনিট পর আমি কল দিলেই বাহিরে আসবে। এরপর না এলে সবার সামনে দিয়ে একদম কোলে করে নিয়ে যাবো। বুঝতে পেরেছো?”, হুমকির মতোন দিয়ে আহান বেড়িয়ে গেলো।

রুহি রাগে ক্রমাগত ফুলছে, অসহ্য একটা লোক। নিজের কথাই কথা অন্যেরটা তো ছাই। সাধে কি আর কুম্ভকর্ণ ডাকি। রুহি রাগে ঘরে পায়চারি শুরু করেছে এর শোধ তো তোলা রইলো। সুধে আসলে তুলতে হবে। দশ মিনিট যেতেই রুহির ফোন বেজে উঠলো। রুহি সঙ্গে সঙ্গে কলটা কেটে দিলো। তার কিছুক্ষণ পর আবার একটা ম্যাসেজ এলো –

” তুমি কি চাচ্ছো আমি উপরে এসে, তোমায় কোলে করে নিচে নামাই? সেটা না চাইলে জলদি আসো।”

দেখেই রুহি রেগে মুখ বাকালো। কিছু করার নেই, যেতেই হবে। এই লোকটা পরে দেখা যাবে সত্যি সত্যি কোলে তুলে নিয়ে যাবে। রুহি বাড়ির সবাইকে বলে বের হয়ে বাসার নীচে দাড়ালো। কিন্তু কোথায় সে কুম্ভকর্ণ? গাড়িটাও তো নেই আশে পাশে। রুহি গাল ফুলিয়ে আহানের আসার অপেক্ষা করতে লাগলো। এতক্ষণ তাকে তাড়া দিয়ে এবার নিজেই উধাও। লোকটার ঘাড় মটকে দিতে ইচ্ছে করছে। রুহির রাস্তার এপাশ ওপাশ দেখছে, এমন সময় একটা বাইক এসে রুহির সামনে দাড়ালো। হটাৎ এমন সামনে দাড়ানোতে রুহি চমকে তাকালো। রুহির পুরানো অভ্যাস থেকেই রুহির চোখ গেলো বাইকের নাম্বারটার দিকে। সব নাম্বারের মাঝে চেনা একটা নাম্বার সে খুজে বেড়ায়। আজও তাকালো তবে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে তাকালো না। কিন্তু চেনা নাম্বারটা মনে পড়তেই রুহি বাধ্য হলো ফিরে তাকাতে।

একবার মিলিয়ে দেখলো, আরো অনেকবার দেখলো। রুহির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। সে ভুল দেখছে নাতো? এটাই সে বাইকটা। রুহি চমকে বাইকে বসা বাক্তিটার দিকে তাকালো। এইতো সেই চোখ! কিন্তু এটা আহানের চোখের মতন বেশি লাগছে। রুহি বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় যখন বাইকে বসা ছেলেটা নিজের হেলমেটটা খুলে ফেলে। এটা কি করে সম্ভব! সেকি ভুল কিছু দেখছে? রুহি এক পলকে তাকিয়ে রইলো।

আহান রুহির মূখের সামনে তুরি মারতেই রুহির হুশ ফিরল। আহান সেই ছেলেটা। যার উপর সে একটা সময়ে খুব দূর্বল ছিলো। কিভাবে সম্ভব? সেই ছেলেটার সাথেই তার বিয়ে হয়েছে! রুহি হা করে তাকিয়ে আছে আহানের দিকে।
আহান রুহির এই বিষ্ময়ের চেহারাটা দেখতে চাইছিলো। সেদিনের ডায়রি পরে অনেক রাগ হয়েছিলো আহানের কারণ রুহির প্রতি তখন সে অনেকটাই দুর্বল ছিলো তাই রুহির মনে অন্যকেউ আছে সেটা সে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু পরক্ষনেই আবছা কিছু ঘটনা মনে পরে আহানের। তাই ডায়রীতে লেখা নাম্বারটার ছবি তুলে নিয়ে গ্যারেজে থাকা আহানের বাইকের নাম্বারটা মিলিয়ে দেখতেই সবটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। আহান মনে মনে বললো মিসেস রুহি রহমান সবে মাত্র তোমার চমকানোর পালা শুরু হলো।

আহান রুহির দিকে হেলমেটটা এগিয়ে দিলো। কিন্তু রুহি হতবাক দৃষ্টিতে হেলমেটটা হাতে নিলো। বুকের ভিতরটা কেমন জানি করছে। আহান স্বাভাবিক ভাবে বললো,” কি ব্যাপার হেলমেট হাতে দাড়িয়ে আছো কেনো?”

রুহি একটা ঢোক গিলে হাতের হেলমেটের দিকে তাকালো। তারপর বললো,” এটা আপনার বাইক?”

আহান ভ্রু কুচকে বললো,” নাহ্ ডাকাতি করে এনেছি।”

” না মানে? একই নাম্বার… আপনার বাইক… সেদিন… কে ছিলো…?”, আনমনে বলতে লাগলো রুহি।

” রুহি স্টপ দিস। তাড়াতাড়ি হেলমেটটা পরো।”, সরু চোখে বললো আহান।

রুহি মাথা থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে ঘন ঘন মাথা ঝাঁকিয়ে হেলমেট মাথায় দিলো। কিন্তু নিচের দিকটা লাগাতে পারছে না। আনমনে কি যে করছে রুহি সেটা নিজেও বুঝতে পারছে না। আহান বাইক থেকে নেমে এগিয়ে এলো। রুহির দিকে ঝুকে রুহির হেলমেট লাগিয়ে দিতেই, আহানের নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে রুহির মুখে। আহান আজ এতটুকু কাছে আসতেই রুহির গাল দুটো লাল হয়ে গেছে। আহানের দিকে তাকাতেও পারছে না রুহি।

রুহির অস্থিরতা ভালো করেই টের পাচ্ছে আহান। হেলমেটটা পরিয়ে দিয়ে বাইকে বসে নিজের হেলমেট পরে নিলো আহান। তারপর রুহিকে পিছনে বসতে বলতেই রুহি একটা ঢোক। সবটা কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে রুহির কাছে। রুহি বাইকে বসতে বসতে বললো,”আপনি কি গাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছেন? নাকি শেয়ার বাজারে লস খেয়েছেন?”

আহান আড় চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে রুহির দিকে তাকালো। উল্টা পাল্টা চিন্তা করতে এই মেয়ে এক্সপার্ট। আহান রুহির দুই নিজের বুকের কাছে এনে বললো,” শক্ত করে ধরে রাখবে আর এইসব উল্টা পাল্টা চিন্তা বাদ দেও।” রুহি আহানের কথা মতন শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আহানকে। তারপর আহান বাইক চালানো শুরু করতেই প্রথমে একটু চিৎকার করেই আবার থেমে গেলো রুহি। একটা শক থেকে আরেকটা শক। মাথাই কাজ করছে না রুহির।

চাইলেও চিন্তা না করে পারবে না রুহি। কেমন জানি লাগছে তার, মাথার মধ্যে সব প্রশ্ন ঘুরছে। ভাবা যায় সারাজীবন যেই চোখের প্রেমে কাটিয়ে দিয়েছিলো সে কিনা তার নিজের বর। ইস আহানের চোখের সাথে এতো মিল পাওয়ার পরই বোঝা উচিৎ ছিলো তার।

আহানের বাইকটা একটা বিশাল বিল্ডিংয়ের সামনে এসে থামলো। বাইক থামতেই রুহি চিন্তা থেকে বেরিয়ে এলো। সামনে তাকাতেই কপালে ভাজ পড়লো রুহির। এটা আবার কোথায় নিয়ে এলো তাকে। রুহি আশে পাশে তাকাতে তাকাতে নিজের হেলমেটটা খুললো। তারপর নেমে দাড়ালো।

আহান রুহিকে বিল্ডিংটার টপ ফ্লোরে নিয়ে এলো। অন্য সময় হলে রুহি হাজারটা প্রশ্ন করতো কিন্তু এখন সে একদম চুপ। রুহি উপরে এসে অবাক হয়ে গেলো এতো সুন্দর একটা জায়গা। তারায় ভরা আকাশটা খুব কাছে মনে হচ্ছে রুহির। মেঘগুলো যেনো হাত বাড়ালেই ছুটে পারবে সে। আকাশের দিকে তাকাতেই রুহির ঠোঁটে হাসির ঝিলিক বয়ে যাচ্ছে। আহানের এখন একটু শান্তি লাগছে। আজ সারাদিন রুহি প্রাণখুলে হাসেনি। আহান বুকের কাছে হাত গুজে মুগ্ধ হয়ে রুহিকে দেখছে।

আশে পাশে তাকিয়েই রুহি বুঝতে পারলো এটা একটা হোটেল তবে খুবই বিশাল। আর এই ফ্লোরটা খোলা আকাশের নিচে সময় কাটানোর জন্যে । সেই রকম করেই সাজানো। অসাধারণ একটা পরিবেশ।

আহান রুহির হাত ধরে টেনে কাছে এনে কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো,” পছন্দ হয়েছে জায়গাটা?”
রুহি হ্যা সূচক মাথা নেড়ে বললো,” আপনি এই জন্যে জোর করে আমায় নিয়ে এলেন?”

” হুম। যাক জায়গাটা তোমার ভালো লেগেছে তাহলে?”, বলে রুহির হাত ধরে একপাশে নিয়ে এলো। সেদিকে মানুষজন কম, ছোটো ছোটো ক্যান্ডেল দিয়ে চারপাশটা সাজানো। রুহির খুব ভালো লাগে মোমবাতির আলো। তাই এমন করে সাজাতে বলেছে আহান। রুহি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতকিছু করেছে আহান। আহান গিয়ে গা হেলিয়ে সোফায় বসে পড়লো তারপর রুহিকে টেনে নিজের কোলে বসাতেই রুহি হকচকিয়ে তাকালো।

” আরে কি করছেন? মানুষ দেখবে তো।”, আহান রুহির ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে বললো,” কেউ দেখবেও না আর কেউ এদিকে আসবেও না। শুধূ তুমি আর আমি।”ঠোঁট থেকে আঙ্গুল সরিয়ে নিয়ে আলতো করে রুহির গাল স্পর্শ করলো আহান। রুহি চোখ সরিয়ে নিলো আহানের থেকে তারপর বললো,” একটা প্রশ্ন করি?”

আহান রুহির গাল থেকে হাত সরিয়ে বললো,” গাড়ী বিক্রি, শেয়ার বাজারে লস এইসব উল্টো পাল্টা কোয়েশ্চন একদম করবে না।”

” না না, ওসব না। অন্যকিছু।”,রুহি আর অপেক্ষা করলো না প্রশ্নটা করেই ফেললো,” আচ্ছা বিয়ের আগে আপনি আমায় কখনো দেখেছেন?”

রুহির প্রশ্নে আহান নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসলো তারপর না সূচক মাথা নাড়লো। আহান রুহির প্রশ্নের পিছনের কারন ভেবেই হাসছে। রুহি হাল ছাড়লো না, আহানের মুখের কাছে মুখটা নিয়ে বললো,” ভালো করে দেখুন তো আগে কখনো দেখেননি আমাকে।”

আহান মুখটা রুহির একদম কাছে নিয়ে এসে বললো,”আরেকটু কাছে আসো তারপর দেখি।”

[ #চলবে ]

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here