#প্রেমমহল
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
০৫.
নাসরিন জাহান বিয়ের তোরজোড় শুরু করে দিলেন। সারাবাড়িতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যস্ত পায়ের পদচারণ।
সেদিন কাক ডাকা ভোরে উঠে পরেছিলো প্রেয়সী। এক মুঠো শীতল বাতাসের ঠান্ডা আমেজে গা ভাসিয়ে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতেই খেয়াল করলো তার কেমন যেনো লাগছে। কেমন যেনো! মনের মাঝে ভীষণ ভাবে কিছু খুতখুত করছে। মনে হচ্ছে, কিছু একটা ভুল হয়ে গেলো। কিছু একটা হবার কথা ছিলো কিন্তু হলো না। কিছু একটা হব হব করেও থমকে দাড়ালো মাঝপথেই। প্রেয়সী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উল্টো পায়ে চলল হৃদয়ের ঘরের দিকে। অভিনয় টা তো চালিয়ে যেতেই হবে বিয়ের আগমুহূর্ত অবধি। এতিম বাচ্চাদের বেচেঁ থাকতে কত কিছু করতে হয় এই দুনিয়ার। হাহ্!
হৃদয় উল্টো হয়ে ঘুমিয়ে আছে। উন্মুক্ত পিঠ দৃশ্যমান। পিঠের মাঝ বরাবর অবধি একটা পাতলা চাদর দেওয়া। প্রেয়সী ভ্রু কুচকালো। ওই… ফর্সা খালি পিঠটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। চোখ বন্ধ করে আরো একবার জোরালো দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলো।
কম্পনরত হাতটা আস্তে করে রাখলো হৃদয়ের পিঠে। হৃদয় চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠলো। ঘুমু ঘুমু চোখে প্রেয়সীকে দেখতেই চোখ কচলিয়ে আবার তাকালো। প্রেয়সী হাত সরিয়ে নিলো। ক্রোধে চোখ লাল করে হৃদয় বলল,
‘এখানে কেনো তুমি?’
প্রেয়সী বোকা বোকা চোখে তাকালো, ‘তো কোথায় যাবো?’
হৃদয় নিজেকে শান্ত করে ঠান্ডা আওয়াজে বলল,
‘দেখো প্রেয়সী, বুঝার চেষ্টা করো। আমি জানি না তুমি কেনো আমার পেছন লেগেছো, কি সমস্যা তোমার? কিন্তু তোমার বুঝতে হবে আমার একটা জীবন আছে। আমি প্রতিনিয়ত তোমাকে নিয়ে আতংকে থাকছি। আসলেই কি আমি তোমাকে চিনি? সত্যি কি তুমি আমাকে ভালোবাসো? সত্যি-ই কি তুমি এতোটা বোকা? এতোটা সহজ-সরল নাকি খুব বেশি চালাক?’
হৃদয় উঠে দাড়ালো। প্রেয়সী হাত গুটিয়ে মাথা নিচু করলো। এই প্রথম…এই প্রথমবার কাউকে ঠকানোর পর এতোটা দমবন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে.. মনে হচ্ছে বুকের হৃদপিণ্ডটা কে যেনো খামচে ধরেছে। জ্বলছে ভীষণ। প্রেয়সী হৃদয়ের পিঠে আবার হাত রাখলো। হৃদয় আগের চেয়েও ঠান্ডা আওয়াজে বলল,
‘প্রেয়সী, হাত সরাও। আমাকে ছুঁবে না।’
হঠাৎ কি হলো কে জানে প্রেয়সী আকস্মিক এক কাজ করে বসলো। হৃদয়ের উন্মুক্ত পিঠে নিজের মাথাটা এলিয়ে দিলো। সাথে সাথেই গড়িয়ে পড়লো অম্বুর ধারা। হৃদয় স্তব্ধ। আচম্বিতে সে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। অবাকতার মাঝেই কিছু সময় ফুরোলো।আস্তে আস্তে হৃদয়ের হাত মুঠো হয়ে এলো। চোয়াল শক্ত হলো। মুখে কঠোরতার ছাপ স্পষ্ট। প্রেয়সী আরেকটু শক্ত করে ধরতেই হৃদয় টেনে ওকে সামনে আনলো। এরপর… এরপর… ভীষণ অপ্রত্যাশিত ভাবে প্রেয়সীর গালে শব্দ করে চড় পরলো। দৈবাৎ এই দানব চড়ে প্রেয়সীর মাথা ঘুরে গেলো, গালে হাত চলে গেলো। মাথা ঘুরে পরতে পরতেও বেঁচে গেলো। ছলছল অবাক চোখে হৃদয়ের দিকে তাকাতেই হৃদয় ক্রুদ্ধ নয়নে রাগে কাঁপতে কাঁপতে চিল্লিয়ে বলল,
‘আমাকে টাচ করতে না করেছিলাম না? তবুও স্পর্শ করলে কেনো? আমার জীবনটা নরক বানিয়ে তুলেছো। কি চাও? টাকা? কারোর হয়ে কাজ করছো? যত টাকা চাও নিয়ে চলে যাও, তবু্ও আমাকে রেহাই দাও। তোমার জন্য আমাকে বিয়ে করতে হচ্ছে। যার প্রতি আমার কোনো উত্তাপ অনুভূতি-ই ব্যক্ত হয় না তাকে বিয়ে করে রোবটের মতো সংসার করতে হবে ভাবলেই আমার মাথা নষ্ট হয়ে যায়। ব্যাপারটা বুঝতে পারছো তুমি? কি চাও? কি মিশন নিয়ে এসেছো আমার বাড়িতে? তুমি কি জঙ্গি? টেরোরিস্ট তাই না?’
প্রেয়সী তখনো গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে। হতবাক, নির্বাক চোখে। ওকে জঙ্গি পর্যন্ত ডেকে ফেলল? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। হৃদয় হাতজোড় করে তখনো বলছিলো, প্রেয়সী ঝাপসা চোখে তাকিয়েই শুনলো।
‘দয়া করে বলো, কে তুমি? কি চাও? আমার বাসায় কেনো এভাবে মাটি কামড়ে পরে আছো? তুমি এতোটা সহজ-সরল সাজছো যে, সিম আর শিম এর পার্থক্য বুঝো না। এতোটা সহজ-সরল তো তুমি নও।’
প্রেয়সী অপ্রতিভ হলো। অসহায় চোখে একবার তাকালো। এরপর নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। খানিকবাদে ব্যাগ নিয়ে এসে হৃদয়ের সামনে দাড়ালো। চোখে চোখ রাখলো। কুয়াশাচ্ছন্ন চোখে ধীর আওয়াজে বলল,
‘কোনো মিশন নিয়ে আসিনি। ইনফেক্ট আমি তোমাকে ভালোওবাসি না। প্রেমও করতে চাই না। তোশকা আমার বান্ধুবি। আমার সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড। ও প্রতিদিন আমার কাছে এসে কান্না করতো। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে কিন্তু তুমি ওকে দেখতেই পারো না। এরপর একদিন আমি ওকে বুদ্ধি দিয়ে বললাম, আমি যদি তোমাকে জ্বালাই, বিয়ে করতে চাই, তোমার মাকে পটাই তখন নিশ্চয়ই তুমি অপরিচিত মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে না। অপশন হিসেবে বেছে নিবে তোশকাকে। তাই এতোসব নাটক। আর তাছাড়া তোশকা বলেছিলো এর বদলে আমাকে পনেরো হাজার টাকা দিবে। আর পনেরো হাজার টাকা আমার জন্য অনেক। আমার বাবা-মা নেই। অনাথ আমি। এই টাকা দিয়ে দুই-তিন মাস আমার অনায়াসে কেটে যাবে।’
হৃদয় বিস্মিত। এতোটা মাত্রায় বিস্ময় ওর চোখে চেপে ধরেছে যে ওর দুই ঠোঁটের মাঝে কিঞ্চিৎ ফাঁকা স্থান গঠিত হয়েছে। প্রেয়সীর হালকা হাতে চোখ মুছে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এখানে আমার বাসার এড্রেস আছে। আমি একটা রুম নিয়ে থাকি। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিতে পারো আসলেই আমি জঙ্গি কিনা? আমি জানি না, তোশকা এসব জানতে পারলে কখনো আমার সাথে কথা বলবে কি না। কিন্তু আমি নিরুপায়, কিছু করার নেই আমার।’
হৃদয়ের হাতে কাগজ টা ধরিয়ে দিয়ে আবারো বলল, ‘আমি চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো।’ এরপর আর মিনিটখানেক ও দাড়ালো না প্রেয়সী। চোখের পলকে উধাও হলো। হৃদয় স্তম্ভিত চোখে কাগজ টা খুলতেই দেখলো একপাশে এড্রেস এবং অপরপাশে লেখা,
‘বুঝতে পারছি না আমার কি হয়েছে! তবে মনে হচ্ছে, আমি বোধ হয় তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি কিংবা শুধুই তোমার মোহের খাঁচায় আবদ্ধ হয়েছি। এতোটা কাছাকাছি আমি আর কোনোদিন, কোনোকালে, কোনো পুরুষের সংস্পর্শে থাকিনি। তুমি প্রথম যাকে আমি চুমু দিয়েছি। তুমি প্রথম যার উন্মুক্ত পিঠের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছি। তুমি প্রথম যাকে জড়িয়ে ধরেছি। তুমি প্রথম যার জন্য হঠাৎ নিজ গোপনে কেঁদে ফেলেছি। আমি নিজেকে ঠকালাম সাথে তোশকাকেও। এ কয়দিন তোমাকে আর আন্টিকেও ঠকিয়ে ফেললাম। I feel like, I’m the worst person in this world.’
,
সেদিন বিকালেই হৃদয় প্রেয়সীর বাসার সামনে গেলো। প্রেয়সীর তখন টিউশনি ছিলো। বাসা থেকে বের হতেই মোড়ে হৃদয়কে দেখে ভ্রু দুটো আপনা আপনি কুচকে গেলো। রাস্তার ফুটপাত ধরে হাটতেই দেখা গেলো হৃদয়ও ওর পেছন পেছন যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পথ যাওয়ার পর প্রেয়সী থামলো। ঘাড় ঘুরিয়ে হৃদয়ের উদ্দেশ্যে বলল,
‘সমস্যা কি?’
হৃদয় ঠোঁট উল্টে বলল, ‘কিসের সমস্যা? সমস্যা আবার কি? এটা কি করে খায় নাকি মাথায় দেয়?’
প্রেয়সী তাজ্জব বনে গেলো, ‘তুমি আমার পিছু নিয়েছো কেনো?’
‘পিছু নিলাম কোথায়? আমি তো তোমার সাথে সাথেই হেটে যাচ্ছি। আমি কিন্তু ফলো করিনি।’
‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ।’
‘আরে, এটা তো তোশকার ডায়লগ, হাস্য রাক্ষসী।’
প্রেয়সী চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আবারো হাটা ধরলো। হৃদয় প্রেয়সীর সাথে হাটতে হাটতে বলল,
‘তোমার ওই সুন্দর মাড়ি বের করা হাসিটা একটু দাও তো, রাক্ষসী।’
‘তুমি কি যাবে?’
‘কোথায় যাবো? আমি তো তোমার কাছেই এসেছি।’
হৃদয় ঠোঁট উল্টে বলল। প্রেয়সী অবাক গলায় বলে,
‘তুমি কি আমাকে নকল করছো? সাংঘাতিক!’
হৃদয় ঠোঁট টিপে হাসলো। প্রেয়সী বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলো। এরপর হঠাৎ থমকে দাড়ালো। পা জোড়া থেমে গেলো। ইট-পাথরের ফুটপাতের সাথেই আটকে যাওয়া হলো। দমকা হাওয়ার সাথে চুলগুলো ভেসে গেলো। আরক্ত নয়নে পেছন ফিরে চাইলো। হৃদয় দূর থেকে দাঁড়িয়েই গাইলো,
“শোনো না রূপসী, তুমি যে শ্রেয়সী
কি ভীষণ উদাসী, প্রেয়সী।
জীবনের গলিতে, এ গানের কলিতে
চাইছি বলিতে, ভালোবাসি।”
চলবে